আক্কেল গুড়ুম
— হ্যালো ! মিঃ অরূপ দত্ত বলছেন ?
— বলছি ।
— গুড মর্নিং স্যার । আমি হুড়ুমতাল ফাইন্যান্স
থেকে মোনালিসা বলছি ।
— গুড মর্নিং । বলুন কি বলতে চান।
— কনগ্রাচুলেশন স্যার আমাদের কম্পিউটারে
রেনড্যাম সিলেকশনে আপনার নাম উঠেছে
আপনি এখন মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট মান্থলি
ইন্টারেস্টে পাঁচ লাখ থেকে পঁচিশ লাখ অবধি
লোন পেতে পারেন। স্যার আপনার দরকার
কত আর স্যার আপনার ডক্সগুলো আনতে
আমাদের এক্সিকিউটিভ কবে আর কখন গেলে
সুবিধে হতো যদি বলেন ?
এই শুরু হলো পচানো । ইদানিং খুব বেড়েছে । কোথা থেকে যে নম্বর পায় কে জানে, আমার দরকার নেই আদৌ তবুও ওরা লোন দেবেই দেবে। রোজ দু তিনটে ফোন আসে । লাগবে না বললেই ওরা শুরু করে নতুন নতুন গল্প । লাইন কেটে দি। ফের ফোন,একপ্রস্থ ক্ষমা চায় লাইন কেটে গিয়েছিল বলে , ফের শুরু। ফলাফল – ফোনটা সুইচ অফ করি আর ইতিমধ্যে অফিসের বড়বাবু দরকারি কাজে ফোনের পর ফোন করে যায়, পায়না । অফিসে ঢোকা ইস্তক আমার সঙ্গে আমার চোদ্দ পুরুষের অশৌচ পালন এবং অশৌচ শেষে শ্রাদ্ধ করেন, শেষ করেন পিন্ডি গিলিয়ে । পুরো এপিসোড মেটাতে বড়বাবু দিন চারেক সময় নেয় ।
আজ সাত সকালেই “লোন নেবেন স্যার” শুরু হলো। কাল অফিসে বোর্ড মিটিং আজ ভাইটাল দিন ,আজকে আমার শপথবাক্য ” প্রাণ যায় পর ফোন সুইচ অফ না হয় “। দশদিক ভেবে এক কেজি খাঁটি স্বদেশী গলায় ঢেলে চিকন সুরে বললাম –
— ম্যাডাম এই নিয়ে আলোচনা তো করতে হবে
তারপর তো নেবো। এখন একটু ব্যস্ত আছি,
আপনি কি দুপুর দু’টো নাগাদ ফোন করতে
পারবেন ?
অত্যন্ত বিগলিত হয়ে সেই সুন্দরী তন্বী তরুণী ( আশা করি ) মিষ্টি করে মদন দেবের কাছে ধার নেওয়া একটা হালকা প্রশ্রয়ের হাসি ছেড়ে সম্মত হলো। অবশ্য যাওয়ার আগে ফেরত আসার আগে অবধি সময়টা শুভ যাওয়ার শুভেচ্ছা জানাতে ভুললো না।
অফিসে এসে আগামীকালের বোর্ড মিটিং-এর জন্য প্রেজেনটেশন তৈরির কাজে মন দিলাম । এইটা আমার জীবনের সবথেকে দুঃখজনক কাজ। সব কাজ করবো আমি আর মিটিং-এ বড়বাবু তা উপস্থিত করে নাম কামাবেন। অবশ্য মাসের শেষে এন্ডায় গন্ডা মিটিয়ে হাজার টাকা এক্সট্রা পাইয়ে দেন ।
আগে থেকে অনেকটাই করা ছিল বলে ঘন্টা দুয়েকের মত লাগল শেষ করতে। বড়বাবুকে ডেকে সব বোঝালাম ।বুঝলো কি না জানতে পরীক্ষা নিলাম, ব্যস আমার ছুটি , এখন সাতদিন নো কাজ , নো চাপ , নো টেনশন। কলিগরা জ্বলে পুড়ে মরে। মরুকগে যাক। লাঞ্চ করলাম অফিসের কাছের একটা নামি হোটেল থেকে ,ঐ এক্সট্রা হাজার টাকাটা তুলে নিয়েছিলাম তাই ভালোমন্দ খেলাম। সিগারেট ধরিয়ে সবে দুটো সুখটান দিয়েছি ফোন বেজে উঠলো।
— হ্যালো ।
– স্যার আমি মোনালিসা বলছি হুড়ুমতাল
ফাইন্যান্স থেকে।
– হ্যাঁ বলুন ।
– স্যার আপনি সকালে বলেছিলেন এখন ফোন
করতে আলোচনা করবেন লোনের ব্যাপারে।
— ও আপনি লোন নিতে চান ! কত টাকা লোন চাই
আপনাদের ?
— না স্যার আমরা দেবো । আপনি নেবেন আমরা
দেবো।
— তবে শুনুন মোনালিসা। আজ থেকে দেড়শ বছর
আগে বর্ধমান জেলার এক অজ পাড়াগাঁ থেকে
একটা গরীব লোক একটা লোটা ,একটা মাদুর ,
কিছু জামাকাপড় আর মাত্র এখনকার হিসেবে
দু’শো টাকা আর কিছু চিঁড়ে মুড়ি ভেলিগুড় নিয়ে
হাঁটা শুরু করলেন। উদ্দেশ্য, কলকাতায় এসে
ব্যবসা করা।
— স্যার আমি আপনার লোনের কথা ……..
— আরে আগে শুনবেন তো । যাই হোক তা ঐ প্রৌঢ়
মানুষটি দুদিন ধরে হেঁটে অবশেষে কলকাতায়
এলো।অবাক চোখে দেখতে লাগল শহরটাকে।
পৌঁছলো তো বটে এবার তার উদ্দেশ্য সফল কি
করে হবে।অল্প টাকা আছে । ভাবছে টাকা দিয়ে
খাবে না মাথায় মাখবে। এমন সময় তার সঙ্গে
পরিচয় হলো এক সহৃদয় ব্যক্তির সঙ্গে। ওনার
নাম। থাক পুরো নাম বলছি না। বি কে পাল
এইটুকুই জেনে রাখুন । পাল ।পাল মহাশয়ের
বদান্যায় ওই গেঁয়ো ভূত শুরু করলো ছাতার
ব্যবসা।
— স্যার আপনার কত টাকা লোনের দরকার সেইটা
আগে বলুন না ।
— ধুত্তেরিকা, আগে পুরোটা শুনবেন তো। কি
বলছিলাম যেন , ও হ্যাঁ ছাতার ব্যবসা। ধীরে
ধীরে ব্যবসা বাড়তে লাগল , পাল মহাশয় ওনাকে
বেশ কিছু বিলাতি কোম্পানীর সঙ্গে আলাপ
পরিচয় করিয়ে দিলেন । ওই সব বিলাতি
কোম্পানিগুলো ইংল্যান্ড থেকে মাল আমদানি
করতো।
— স্যার স্যার , আমি বলছিলাম কি ……
— আঃ মাঝখানে তাল কাটবেন না। হ্যাঁ যা
বলছিলাম ।উনি শুরু করলেন স্টিভেদারির
কাজ। মানে কলকাতা বন্দরে মাল খালাস করার
জন্য কুলি মজুর সাপ্লাই ।বেশ টু পাইস রোজগার
হতে থাকলো। নিজের গ্রাম থেকে বা
আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলে পুলেদের এনে
কুলির কাজে লাগালেন । তারাও …….
— স্যার আমাদের অন্য এক ক্লায়েট লাইনে
অপেক্ষা করছে আপনি যদি আপনার
রিকোয়ারমেন্টটা বলেন তবে আমি প্রসেসিং
শুরু করতে পারি । একটু বলুন না কত টাকা
আপনি লোন নেবেন ?
— এই জন্যই বাঙালি মরলো। আপনার দেখছি
বিন্দুমাত্র ধৈর্য্য নেই। যাই হোক তাই ঐ পাল
বাবুর কথায় উনি বাগবাজারে একটা পেল্লায়
বাড়ি কিনলেন। তিন মহলা বাড়ি। আমরা এখন
যেখানে থাকি। এই যে সব কুলি মজুর উনি
কাজে লাগিয়েছিলেন। তাদের মাস ফুরোবার
আগেই পকেট ফাঁকা হয়ে যেত। উনি এই
সুযোগটা নিলেন। শুরু করলেন তেজারতি
কারবার। সোনার গয়না গচ্ছিত রেখে টাকা ধার
দিতেন অল্প সুদে আর যারা সুদ দিতে পারতো না
তাদের চড়া সুদ বসাতেন। পুষলেন লেঠেল
বাহিনী। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
সত্যি বলতে কি ওই গ্রাম্য লোকটা পুরো তিনশ
ষাট ডিগ্রি …….
— স্যার এক মিনিট শুনুন । আপনার কত টাকা
দরকার প্লিজ একটু বলে দিন না। আমি কাজটা
শুরু করে দি। কাজ করতে করতে আপনার গল্প
শুনবো !
— আরে ধ্যাত্তেরি, কথার মাঝখানে কথা বলবেন
না প্লিজ । হ্যাঁ যা বলছিলাম । পুরো ঘুরে গিয়ে
অসৎ হয়ে গেল। তেজারতি কারবার এতটাই
ফুলে ফেঁপে গেল যে সে আর বলার নয় ।
**
কুঁ কুঁ কুঁ কুঁ কুঁ কুঁ
^^^^^^^
— আরে কি হলো ? মুরগীর মত ডাকছেন কেন ?
— হ্যালো , হ্যালো। যাচ্চলে লাইনটাই কেটে দিল !
@@@@
বুঝলাম আমার গল্প শুনে হুড়ুমতাল কোম্পানির আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে । সুতরাং নটে গাছটা মুড়িয়ে দিয়ে কেটে পরেছে।