০৯. বিকালে মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে
বিকালে মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে সকলে পিঠা খাইতে বসিয়াছে। খাওয়ার জন্য বিভূতির লুব্ধ ব্যাকুলতা দেখিয়া তার মার চোখে জল আসিয়া পড়িতেছিল। ছেলে বাড়ি ফেরার পর বিভূতির মা আজকাল কেবল নানা রকম খাবারই তৈরি করে। বিভূতি খাইতে পারে না, সামান্য কিছু খাইলেই তার পেট ভরিয়া যায়। দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো উগ্র খাওয়ার লোভের তার তৃপ্তি হয় না। তার চাহনি দেখিয়া কত কথাই যে মাধবীলতার মনে হয়। হঠাৎ শিহরিয়া উঠিয়া মাথায় সে একটা ঝাঁকুনি দেয়।
ভিতরের চওড়া বারান্দায় অর্ধচন্দ্রাকারে সকলে বসিয়াছে, মুখোমুখি হওয়ার সুবিধার জন্য। বৈকালিক জলখাবার শেষ হইতে কোনো কোনোদিন দুঘণ্টা সময়ও লাগিয়া যায়। রাজ্যের কথা আলোচনা হয় এই সময়। আজ কথাবার্তা তেমন জমিতেছিল না। সকালের ঘটনায় একমাত্র মহেশ চৌধুরী ছাড়া সকলেই কম-বেশি অস্বস্তি বোধ করিতেছে।
হঠাৎ বিভূতি বলিল, আচ্ছা বাবা, তুমি পাগল হয়ে গেছ?
মহেশ চৌধুরী হাসিয়া বলিল, কে আগে কথা তোলে দেখছিলাম। পাগলামি মনে হয়েছে। তোদের, না? কেন বল তো? পাগলের কথা, কাজ, কোনো কিছুর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না, আমি
তো খাপছাড়া কিছু বলিও নি, কিছু করি নি।
বল নি? কর নি?
না। আমি আবোল-তাবোল কথা কোনোদিন বলি না, খাপছাড়া কাজ করি না। মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যেতে পারে, তা সেটা সবারই হয়।
এরকম অহঙ্কার তো কখনো দেখি নি তোমার! নিজেকে প্রায় মহাপুরুষে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছ।
মহেশ চৌধুরী মাথা নাড়িল, তা করি নি, একটা সোজা সত্য কথা বলেছি। তোর অহঙ্কার মনে হল কেন জানি? তোর সঙ্গে কথা বলবার সময় আমার মনে আছে তুই আমার ছেলে, কিন্তু আমার বিচার করার সময় তুই ভুলে যাচ্ছিস যে আমি তোর বাপ। কথাটা প্রভুকে বললে অন্যভাবে বলতাম শুনলে আমার বেশি বেশি বিনয় দেখে তুই চটে যেতিস, তখন তার খেয়াল থাকত যে আমি তোর বাপ, আর নিজের বাপের আত্মমর্যাদা, জ্ঞানের অভাব দেখে লজ্জায় দুঃখে অপমানে তোর মাথা হেঁট হয়ে যেত।
এভাবে মহেশ চৌধুরীকে বলিতে মাধবীলতা কখনো শোনে নাই। সে একটু বিস্ময়ের সঙ্গে মহেশ চৌধুরীর কৌতুকোজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
মহেশ চৌধুরী আবার বলিল, আত্মমর্যাদা বলতে তোরা কি বুঝিস জানিস? ফাঁকা গৰ্ব, গোয়াতুমি। মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাড়া তোদের আত্মমর্যাদা টেকে না, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকি লাগবে, দরকার হলে প্রকাশ্যেও হাতাহাতি হয়ে যাবে, লাঠি হাতে মারতে উঠবি, তবে তোদের আত্মমর্যাদা খাড়া থাকতে পারবে। কি বল মাধু তাই নয়?
মাধবীলতার মুখ ভৰ্তি ছিল, খাবারটা গিলিয়া কথা বলিতে হওয়ায় বড়ই সে লজ্জা পাইলকি জানি, ওসব বড় বড় দার্শনিক কথা ভালো বুঝি না।
মহেশ চৌধুরী হাসিয়া বলিল, বড় বড় দার্শনিক কথা আবার কখন বললাম? জানলে তো বলব! আচ্ছা, কথাটা বুঝিয়ে বলছি তোমাকে।
থাক না, আমার না বুঝলেও চলবে।
উঁহু, তা চলবে না। কথাটা তোমায় না বুঝিয়ে ছাড়ব না।
মহেশ চৌধুরীর একগুঁয়েমিতে মাধবীলতার হঠাৎ বড় হাসি পায়। মনে হয়, সে যদি কথাটা না বোঝে, সদানন্দের চরণদর্শনের জন্য একদিন যেমন ধন্না দিয়াছিল, আজ সকালে যেভাবে বিভূতিকে সদানন্দের পায়ে হাত দিয়া প্ৰণাম করাইয়াছে, তেমনি একটা কিছু কাণ্ড মহেশ চৌধুরী আরম্ভ করিয়া দিবে।
বুঝেও যদি না বুঝি?
মহেশ চৌধুরী শান্তভাবে বলিল, হেসো না, হাসতে নেই। বুঝবে বৈকি, বললেই বুঝবে। শোন বলি। সকালে বিপিনবাবুর সঙ্গে যে ঝগড়া করলে, মানুষটার মনে কষ্ট দিয়ে বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করলে, আত্মমর্যাদা বাঁচাবার জন্য তো? তুমি ভাবলে, বিপিনবাবুর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বললে সবাই তোমাকে ভীরু অপদার্থ মনে করবে, লোকের কাছে তোমার অপমান হবে। ব্যাপারটা কি বিশ্রী দাঁড়িয়ে গেল বল তো? তুমিও উল্টেপাল্টে সারাদিন ওই কথাই ভাব, বিপিনবাবুও ভাবছেন। তোমাদের দুজনের মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি যদি হাসিমুখে দুটো মিষ্টি কথা বলতে, এক মুহূর্তে বিপিনবাবুর রাগ জল হয়ে যেত। তুমিও চাইছিলে ঝগড়া না হয়ে বিপিনবাবুর সঙ্গে ভাব হোক, বিপিনবাবুও তাই চাইছিলেন–আত্মমর্যাদা বাঁচাবার জন্য তোমাদের ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। তোমরা সকলকে হিংসা কর কিনা, তাই এমন হয়। নিজের যাতে কোনো ক্ষতি নেই, পরের জন্য সেটুকু ত্যাগও করতে পার না।
মাধবীলতা কথা বলিল না।
বিভূতি বলিল, গালে যে চড় মারে, তার পায়ে লুটিয়ে পড়ার চেয়ে ওরকম ঝগড়া ঢের ভালো।
মহেশ চৌধুরী বলিল, গালে চড় মেরেছেন, প্রভুর সঙ্গে আমার কি শুধু এইটুকু সম্পর্ক বিভূতি? আমি তো চিরদিন প্রভুর পায়ে লুটিয়ে আসছি? প্রভুকে যদি আগে থেকে দেবতার মতো ভক্তি না করতাম, আজ গালে চড় মারার পর মানুষকে আমার ক্ষমা আর সহিষ্ণুতা দেখাবার জন্য প্রভুর পায়ে ধরতাম, তা হলে অন্যায় হত। তার মানে কি দাঁড়াত জানিস? আমি যেন প্রভুর চেয়ে বড়। কিন্তু প্রভুর সম্বন্ধে আমার অহঙ্কার নেই, দীনতা নেই, উদারতা নেই–আমি সোজাসুজি তাকে দেবতার মতো ভক্তি করি। গালে যখন উনি চড় মারলেন, আমি বুঝতে পারলাম উনি ভয়ানক রাগ করেছেন। আমার মনে বড় কষ্ট হল, তাই ওঁর পায়ে ধরলাম। উনি আমায় বড় ভালবাসেন বিভূতি–আমায় মারার জন্য না জানি মনে মনে কত কষ্ট পাচ্ছেন।
বিভূতি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, মানুষের পক্ষে মানুষকে দেবতার মতো ভক্তি করা—
মহেশ চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে রায় দিয়া বলিল, উচিত নয়। মানুষ কখনো মানুষকে দেবতার মতো ভক্তি করে না। কিন্তু সংসারে কটা মানুষ আছে বল তো? যে মানুষ নয়, সে মানুষকে দেবতার মতো ভক্তি করবে না কেন বল তো? সবাই যদি মানুষ হত বিভূতি, পৃথিবীটা স্বৰ্গ হয়ে যেত।
এবারো বিভূতি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার কথা ঠিক নয় বাবা। একজন মানুষ আরেকজনকে দেবতার মতো ভয় ভক্তি করে বলেই সংসারে এত বেশি অমানুষ আছে–সবাই মানুষ হতে পারছে না। একজন মানুষের চাপে আরেকজন কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কথা থাক–আমাকে কেন তুমি জোর করে ওঁকে প্রণাম করালে? আমি তো এঁকে দেবতার মতো ভক্তি করি না। বরং–
মহেশ চৌধুরী তাড়াতাড়ি বলিল, হ্যাঁ, হাঁ, জানি। তুই আমার ছেলে বলে তোকে প্ৰণাম করিয়েছি। তুই ভক্তি করিস বা না করিস সে কথা ভিন্ন, তোকে দিয়ে ওঁকে প্রণাম করাবার ক্ষমতা থাকতেও যদি প্রণাম না করাতাম, আমার পক্ষে অন্যায় হত। অন্য কাউকে তো আমি জোর করে। প্ৰণাম করাই না!
বিভূতি মুখ ভার করিয়া বসিয়া রহিল।
সন্ধ্যার পর হঠাৎ স্বয়ং সদানন্দ মহেশ চৌধুরীর বাড়ি আসিল।
সকলে ভাবিল, বুঝি সকালবেলা মহেশ চৌধুরীর গালে চড় মারার প্রতিবিধান করিতে আসিয়াছে। ভক্তকে সদানন্দ আজ অনেক আদর করিবে।
মহেশ চৌধুরী তাড়াতাড়ি প্ৰণাম করিয়া বলিল, প্ৰভু?
সদানন্দ বলিল, মহেশ, বিপিন আমাকে আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই তোমার কাছে এলাম। তোমার বাড়িতে থাকব।