১৯. কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা
কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপর আবার মারামারি আরম্ভ হইয়া গেল। এবার আরো জোরে। আসরে মহেশ চৌধুরীরও অনেক ভক্ত উপস্থিত ছিল, তাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিয়াছে। ব্যাপার দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, মহেশ চৌধুরী আর্তনাদের সুরে বিভূতিকে হাঙ্গামা থামাইতে অনুরোধ করে নাই, বিভূতিকে রক্ষা করার জন্য তার অনুগতদের কাছে আবেদন জানাইয়াছে। বাপের আর্তনাদ বিভূতির কানে পৌঁছায় নাই। গোলমালের জন্য নয়, সে তখন প্রায় সদানন্দের পায়ের কাছেই উদ্ভট ভঙ্গিতে পড়িয়া আছে, বা হাতটা কজি ছাড়াও আরেক জায়গায় ভঁজ হইয়া শরীরের নিচে চাপা পড়িয়া গিয়াছে আর ডান হাতটা টান হইয়া নিবেদনের ভঙ্গিতে আগাইয়া গিয়াছে সদানন্দের পায়ের দিকে। শরীরটা রক্তমাখা। তবে কোনো কোনো অঙ্গের নড়নচড়ন দেখিয়া বোঝা যায় তখনো মরে নাই। আরো অনেকে জখম হইয়াছে, সকলে তারা বিভূতির সঙ্গীও নয়, সদানন্দের মান রক্ষার জন্য তার যে সব উৎসাহী ভক্তেরা আগাইয়া আসিয়াছিল, তাদের মধ্যেও কয়েকজন অন্য উৎসাহী ভক্তের হাতে মার খাইয়াছে। মারামারির সময় হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই দুঘা দিতে এমন হাত নিশপিশ করে।
শুধু হাতের মার নয়, গ্রামের লোকের পথ চলিতে লাঠির বড় দরকার হয়।
মারামারির দ্বিতীয় খণ্ডটা পরিণত হইয়া গেল রীতিমতো দাঙ্গায়, কেউ ঠেকাইতে পারিল না। অনেকে আগেই পালাতেই আরম্ভ করিয়াছিল, ব্যাপার এতদূর গড়াইবে না আশায় বুক বাঁধিয়া যারা অপেক্ষা করিতেছিল, এবার তারাও ছিকটাইয়া সরিয়া গেল। কেউ সটান পা বাড়াইয়া দিল বাড়ির দিকে, কেউ দূরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল মজা। কেউ মাটির ঢেলা ইটপাটকেল, হাতের কাছে যা পাইল, দূর হইতে তাই ছুড়িয়া মারিতে লাগিল যুদ্ধক্ষেত্রে একটু আগেও যেটা ছিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাকীর্তনের আসর। খানিক তফাতে একটা চ্যালাকাঠের স্তুপ ছিল, আট-দশজন লোক হঠাৎ কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া দুহাতে চ্যালাকাঠ ছুড়িতে আরম্ভ করিয়া দিল–ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে নয়, একপাশে, সেখানে তখন সমবেত স্ত্রীলোকদের অর্ধেকের বেশি নিরুপায় আতঙ্কে। কিচিরমিচির সুরে আর্তনাদ করিতেছে। কোনো অল্পবয়সী স্ত্রীলোক পুরুষ সঙ্গীর খোজে বিফলদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে প্রাণপণে চিৎকার করিতেছে বাবাগো মাগো বলিয়া, আর কোনো বয়স্কা স্ত্রীলোক বসিয়া বসিয়াই মধুসূদনকে ডাকিতেছে। মেয়েদের অবস্থাই সবচেয়ে সঙ্গিন। আসরের চারিদিকে রাত্রি আর নির্জনতা, পালানোর উপায় নাই। কয়েকজন অবশ্য দাঙ্গার সূচনাতেই উন্মাদিনীর মতো যেদিকে পারে ছুটিয়া পালাইয়াছে, সকলে সে রকম উদ্ভ্রান্ত সাহস কোথায় পাইবে? পুরুষ অভিভাবকরা আসিয়া অনেককে উদ্ধার করিয়া নিয়া গিয়াছে, কিন্তু এখন। উদ্ধারের কাজটাও হইয়া দাঁড়াইয়াছে আরো কঠিন। নিজেদের সঙ্কীর্ণ সীমানাটুকুর মধ্যে অনেকে ভয়ের তাড়নায় কয়েকটি পলাতকা উন্মাদিনীর মতোই দিশেহারা হইয়া এদিক ওদিক ছুটিতে আরম্ভ করায় নিজেদের মধ্যে নিজেরাই হারাইয়া গিয়াছে। তারপর আছে ছোট ছেলেমেয়ে। তারপর আছে। ধাক্কা দেওয়ার, গা মাড়াইয়া দেওয়ার বচসা আর গালাগালি। যে দু-একজন অভিভাবক লজ্জা ভয় ভদ্রতা ছাড়িয়া একেবারে মেয়েদের মধ্যে আসিয়া খোঁজ করিতেছে, খোঁজ পাইয়া, দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া, কাছে আনাইয়া সঙ্গে করিয়া পালাইতে তারও সময় লাগিতেছে অনেকটা।
এই অবস্থায় চ্যালাকাঠগুলি আসিয়া পড়িতে লাগিল তাদের গায়ে মাথায়।
কেউ থামানোর চেষ্টা না করিলেও দাঙ্গা আপনা হইতেই থামিয়া যায়। কোনোটা তাড়াতাড়ি থামে, কোনোটার জের চলে এখানে সেখানে ছাড়াছাড়া হাতাহাতিতে, পিছন হইতে মাথা ফাটানোয়। এই দাঙ্গাটা থামাইয়া দিল বিপিন। আশ্রমে একটা লুকানো বন্দুক ছিল। বন্দুকের লাইসেন্স ছিল, তবু বন্দুকটা লুকানোই থাকিত। ছুটিয়া গিয়া বন্দুকটা আনিতে বিপিনের সময় লাগিল মিনিট পাঁচেক আর খানিকটা তফাতে দাঁড়াইয়া কয়েকবার আওয়াজ করিতে সময় লাগিল দু মিনিট। শেষ মিনিটের আওয়াজ দরকার ছিল না, এ ধরনের শখের দাঙ্গা থামাতে এক মিনিটে যে কটা আওয়াজ করা যায় তাই যথেষ্ট।
দাঙ্গা থামার পরে হাঙ্গামার প্রথম বীভৎস আর বিশৃঙ্খল অবস্থাটাও শেষ হইয়া গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। এ রকম হাঙ্গামার ডালপালা ছটিয়া ফেলিতে সদানন্দের আশ্রমবাসী শিষ্য-শিষ্যাদের পটুতা দেখা গেল অসাধারণ। পরিচালনার ভারটা নিতে হইল বিপিনকে, সদানন্দের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না, সেও মার খাইয়াছে। মেয়েদের শান্ত করিয়া অভিভাবকদের সঙ্গে মিলন ঘটাইয়া দেওয়া হইতে লাগিল এবং আহতদের প্রাথমিক শুশ্ৰুষার ব্যবস্থা করা হইল।
আধঘণ্টা পরে দেখা গেল আসরে আছে শুধু আশ্রমের লোক, আহত আর নিহতদের আত্মীয়স্বজন, আর আছে গহনার শোকে কাতর কয়েকজন নরনারী। মধ্যে যারা চ্যালাকাঠ ছুড়িয়া মারিতেছিল, দাঙ্গার শেষের দিকে হঠাৎ সে কাজটা বন্ধ করিয়া মেয়েদের ভিড়ে ঢুকিয়া কয়েকজনের গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের চুড়ি ছিনাইয়া নিয়া তারা সরিয়া পড়িয়ছিল। সকলে পলাইতে পারে নাই, একটা চ্যালাকাঠ কুড়াইয়া নিয়া রত্নাবলী দুজনের মাথা ফাটাইয়া দেওয়ায় তারা এখনো আহতদের সারির একপ্রান্তে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া আছে।
আনকোরা নূতন আঘাতের রক্তমাখা চিহ্ন গায়ে নিয়া সদানন্দ, আর পুরোনো আঘাতের ব্যান্ডেজবাধা চিহ্ন গায়ে নিয়া মহেশ চৌধুরী, জড়ভরতের মতো একরকম কাছাকাছিই বসিয়া আছে–বিভূতির গা ঘেঁষিয়া। দাঙ্গা শেষ হওয়ার একটু আগে অথবা সঙ্গে সঙ্গে অথবা একটু পরে বিভূতি মরিয়া গিয়াছে। এক মিনিট স্তব্ধতার আগের তিন মিনিট আর পরের সাত মিনিট, মোট দশ মিনিটের দাঙ্গায় মারা গিয়াছে চারজন। গুরুতর আঘাত পাইয়াছে সাতজন আর সাধারণভাবে আহত হইয়াছে সতেরজন। আরো কয়েকজন আহত হইয়াছে সন্দেহ নাই, তবে তারা এখানে নাই, আগেই সরিয়া পড়িয়াছে। সদানন্দ আর মহেশ আহতদের প্রাথমিক সেবাশুশ্ৰুষার পর প্রাথমিক চিকিৎসার আয়োজন চাহিয়া দেখিতে থাকে, আর শুনিতে থাকে মরা ও আধমরা মানুষগুলিকে ঘিরিয়া বসিয়া মেয়েদের ড়ুরানো কান্না আর পুরুষদের হায় হায় আফসোস। সদানন্দের মাথায় মৃদু ঝিমঝিমানির মধ্যেও মনে হয়, এতগুলি গলার কান্না আর আফসোসের শব্দ না থামা সত্ত্বেও আসরটা যেন বড় বেশি নিঃশব্দ হইয়া গিয়াছে মানুষের ভিড়ে যখন গমগম করিতেছিল আর খোল করতালের সঙ্গে কীৰ্তন চলিতেছিল, তখনো আসরে যেন ঠিক এইরকম স্তব্ধতা নামিয়া আসিয়াছিল। মেয়েদের কান্না শুনিতে শুনিতে মহেশ চৌধুরীর মনে হয় অন্য কথা–এই শোকের ছড়াছড়ির মধ্যে বিভূতি যেন অন্যায়রকম ফাঁকিতে পড়িয়া গিয়াছে, তার জন্য শোক করিবার কেউ নাই!
অন্যায়টা শেষ পর্যন্ত তার বোধহয় সহ্য হইল না, তাই মাঝরাত্রি পার হইয়া যাওয়ার অনেক পরে বিপিনকে ডাকিয়া বলিল, বাড়িতে একটা খবর পাঠাতে পার বিপিন?
পাঠাচ্ছি–সকালে পাঠালে ভালো হত না? এত রাত্রে মেয়েদের—
না, এখুনি খবরটা পাঠিয়ে দাও। মেয়েরা এসে একটু কাঁদুক।
সদানন্দ এতক্ষণ বার বার শুশ্রুষা আর চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, এবার বিপিন অনুরোধ করিতেই রাজি হইয়া গেল এবং একজন শিষ্যের গায়ে ভর দিয়া খেড়াইতে খেড়াইতে নিজের তিন মহল আশ্রমের দিকে চলিয়া গেল। সঙ্গে গেল একজন শিষ্য। মনে হইল, এতক্ষণ অন্য সব আহতদের মতো কেবল সাধারণ শুশ্রুষা আর চিকিৎসা পাওয়া যাইত বলিয়া, সে গ্রহণ করে নাই, এবার বিশেষ ব্যবস্থা করা সম্ভব হওয়ায় সকলের চোখের আড়ালে সেটা উপভোগ করিতে যাইতেছে।
এদিকে কয়েক মিনিট কাটিতে না কাটিতে মহেশের মনে হইতে লাগিল, বাড়ির মেয়েদের আসিতে বড় দেরি হইতেছে। তাই, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া নিজেই সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল। মনে হইল, সদানন্দের সামনে ছেলের জন্য কাঁদিতে এতক্ষণ তার যেন লজ্জা করিতেছিল, এবার সুযোগ পাওয়ায় প্রাণ খুলিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছে।
বিভূতির মা, মাধবীলতা আর বাড়ির সকলে আসিল প্রায় শেষ রাত্রে। কিন্তু তেমনভাবে কেউ কাঁদল না। মাধবীলতা একরকম হ করিয়া বিভূতির দিকে চাহিয়া নিঃশব্দেই বাকি রাতটুকু কাবার। করিয়া দিল। বিভূতির মা এত আস্তে কাঁদতে লাগিল যে একটা কান ব্যান্ডেজে ঢাকা না থাকিলেও পাশে বসিয়া মহেশ চৌধুরী সব সময় তার কান্নার শব্দ শুনিতে পাইল না।
পুলিশ আসিল সকালে।
পুলিশের লোকের কাছে একটা খবর পাওয়া গেল, ইতিমধ্যেই তারা তিনজনকে গ্রেপ্তার করিয়া ফেলিয়াছে। তখন দাঙ্গার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। আশ্রমের পশ্চিম সীমানায় আশ্রমের যে ছোট ফুলের বাগানটি আছে, সেখানে পঁচজন লোক কাল রাত্রে একটি এগার বছরের মেয়েকে নিয়া একটু আমোদ করিয়াছিল। তিনজন ধরা পড়িয়াছে দুজন পলাতক।
না, মরে নি, বেঁচে উঠবে বলেই তো মনে হয় মেয়েটা। তবে কি জানেন বিপিনবাবু
মহেশ চৌধুরী শুনিতেছিল, হঠাৎ তার মনে হইল দাঙ্গার চেয়ে এই মেয়েটির আলোচনাই সকলে যেন বেশি উপভোগ করিতেছে। দাঙ্গাহাঙ্গামা সামান্য ব্যাপার, জগতের কোথাও না কোথাও সর্বদাই যে কুরুক্ষেত্ৰীয় কাণ্ড চলিতেছে, তার তুলনায় দাঙ্গাহাঙ্গামার ক্ষুদ্রতা আর তুচ্ছতা শোচনীয়ভাবে লজ্জাকর। কিন্তু এগার বছরের একটি রক্তমাংসের বিন্দুতে তীব্র আর বীভৎস অস্বাভাবিকতার সিন্ধু খুঁজিয়া মেলে, রোমাঞ্চকর লজ্জা ভয় রাগ দ্বেষ আর অবাধ্য আবেগে স্নায়ুগুলি টান হইয়া যায়, কানে ভাসিয়া আসে লক্ষ কোটি পশুর গর্জন।
মহেশ চৌধুরী একটা নিশ্বাস ফেলিয়া একচোখে চারিদিক চাহিতে থাকে। আহতদের অনেক আগেই ভালো আশ্রয়ে সরানো হইয়াছে, পড়িয়া আছে কেবল তিনটি সাদা চাদর ঢাকা দেহ। এত বয়সে এত কাণ্ডের পর এ রকম আবেষ্টনীতে এমন অসময়ে একটা জানা কথা নূতন করিয়া জানিয়া নিজেকে তার বড় অসহায় মনে হইতে থাকে। চাপা দিলে সত্যই রোগ সারে না, হিমালয় পাহাড়ের মতো বিরাট স্তৃপ সুগন্ধী ফুলের নিচে চাপা দিলেও নয়।
[লেখকের মন্তব্য : মহেশ চৌধুরীর এই অস্পষ্ট আর অসমাপ্ত চিন্তাকে মহেশ চৌধুরীর চিন্তার শক্তি ও ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া স্পষ্টতর করিয়া তুলিতে গেলে অনেক বাজে বকিতে হইবে, সময়ও নষ্ট হইবে অনেক। আলপিন ফুটাইয়া খাড়ার পরিচয় দেওয়ার চেয়ে মন্তব্যের এই ভোঁতা ছুরি বেশি কাজে লাগিবে মনে হয়।
মোট কথা, মহেশ চৌধুরীর মনে হইয়াছে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ অনেকদিন হইতে রোগে ভুগিতেছে। মাঝে মাঝে দু-একজন মহাপুরুষ এবং সব সময় অনেক ছোটখাটো মহাপুরুষ এই রোগ সারানোর চেষ্টা করিয়াছেন, এখনন করিতেছেন, কিন্তু সে চেষ্টায় বিশেষ কোনো ফল হয় নাই, এখনো হইতেছে না। কারণ, তাদের চেষ্টা শুধু ভালোর আড়ালে মন্দকে চাপা দেওয়ার, কেবল দুধ ঘি খাওয়াইয়া রোগীকে স্বাস্থ্যবান করার।
মানুষের রোগের কারণ তারা জানে না, অর্থ বোঝে না, চিকিৎসার পথও খুঁজিয়া পায় না। তারা নিজেরাও রোগী। না হইয়া উপায় কী? মানুষ হইতে যে মানুষের জন্ম, মানুষের কাছ হইতে খুঁটিয়া খুঁটিয়া যার আত্মসহ, মানুষের যা আছে তা ছাড়া মানুষের যা নাই তা সে কোথায় পাইবে? উপাদানগুলি সেই এক, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ শুধু নিজের মধ্যে ভিন্নভাবে আত্মচিন্তার খিচুড়ি বঁধে।
তাই মানুষের রোগের চিকিৎসার উপায় কেউ খুঁজিয়া পায় না, পাওয়া সম্ভবও নয়। তাই মানুষকে সুস্থ করার সমস্ত চেষ্টা গরিবকে স্বপ্নে বড়লোক করার চেষ্টার মতো দাঁড়াইয়া যাইতেছে। ব্যর্থ পরিহাসে।
জগতের কোটি কোটি অন্ধকে অন্ধের পথ দেখানোর চেষ্টার করুণ দিকটা মহেশ চৌধুরীকে একেবারে অভিভূত করিয়া ফেলে। হতাশায়, অবসাদে সমস্ত ভবিষ্যৎ তার অন্ধকার মনে হয়। কেহ খুঁজিয়া পাইবে না, মানুষের মুক্তির পথ কেউ খুঁজিয়া পাইবে না।
মনুষ্যত্বকে অতিক্ৰম করিয়া মানুষের নিজেকে জানিবার, নিজের আর বিশ্বের সমস্ত মানুষের মুক্তির পথ খুঁজিয়া পাওয়ার, একটা উপায়ের কথা যে শাস্ত্রে লেখা আছে, মহেশ চৌধুরীও তা জানে, আমিও জানি। তবে, শুধু লেখা আছে, এইটুকুই আমরা দুজনে জানি।]
দাঙ্গাহাঙ্গামার জের চলিতে লাগিল, মহেশ চৌধুরীও বিবাদ ও অবসাদের ভারে জীৰ্ণশীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। মানুষের মুক্তি নাই, মানুষের ভালো নাই, এ কথা ভাবিলেই তার মনে হয় পৃথিবীসুদ্ধ আত্মভোলা লোক ভালোেমন্দে জড়ানো জীবন নিয়া মনের আনন্দে বাঁচিয়া আছে, সেই কেবল পশুর খাঁচায় আটক পড়িয়াছে। সকলে ভাবে পুত্ৰশোকে মহেশ কাতর, মহেশ ভাবে, পুত্ৰশোকে সে যদি সকলের মতো রীতিমতো কাতর হইতে পারিত! একটিমাত্র ছেলে, তার শোকেও আত্মহারা হইতে পারিতেছে না, এ কি ভয়ানক অবস্থা তার? শোক বাড়ানোর জন্যই মহেশ সর্বদা বিভূতির কথা ভাবিতে চেষ্টা করে, গৃহ কেমন শূন্য হইয়া গিয়াছে অনুভব করার চেষ্টা করে, বিভূতির স্মৃতিচিহ্নগুলি ঘাটাঘাটি করে, বার বার মাধবীলতার নূতন বেশের দিকে তাকায়।
কেবল শোক বাড়ানোর জন্য। অন্য কোনো কারণে নয়।
মহেশ চৌধুরীর শোক দেখিয়া বাড়ির লোকের বুক ফাটিয়া যায়। বিভূতির মা মাথা নাড়িয়া বলে, ও আর বাঁচবে না। না বাঁচুক, আর বেঁচে কি হবে? ওর আগেই যেন আমি যেতে পারি, হে মা কালী, ওর আগেই যেন তোর মতো বেশ যেন আমায় ধরতে না হয় রাক্ষসী।
মাধবীলতার শোকটা তেমন জোরালো মনে হয় না। তাকে কেবল একটু বেশিরকম রুক্ষ দেখায়–তেল মাখিয়া স্নান না করার রুক্ষতা নয়, ভিতর হইতে রস শুকাইয়া যাইতে থাকিলে যেমন হয়।
অনেক ভাবিয়া একদিন সে মহেশ চৌধুরীর সামনে জোড়াসন করিয়া বসে, আগে মাথার ঘোমটা ফেলিয়া দিয়া বলে, ওই লোকটাই খুন করেছে বাবা।
স্বামীজি?
ওই লোকটা বলিতে মাধবীলতা যে কাকে বুঝাইতেছে, অনুমান করিতে মহেশের দ্বিধা পর্যন্ত করিতে হয় না।
হ্যাঁ।
তুমি জানলে কি করে, তুমি যাও নি!
লোকের কাছে শুনেছি। আপনিও তো জানেন। ওই তো সকলকে ক্ষেপিয়ে দিল, সকলকে ডেকে খুন করতে বলল–
খুন করতে বলেন নি, বলেছিলেন–
মাধবীলতা অসহিষ্ণু হইয়া বলে, তার মানেই তো তাই। এ লোকটা আমায় অপমান করেছে, তোমরা চুপ করে সহ্য করবে ও কথা বলে সকলকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার আর কি মনে হয়? কি অপমান করেছে সবাই তো দেখতে পাচ্ছিল, শুনতে পাচ্ছিল? কেউ তখন আর মারতে উঠে নি। কেন, যেই সকলকে ডাকল তখনি সবাই এসে একজনকে মারতে আরম্ভ করল কেন?
মহেশ চৌধুরী ধীরভাবে বলে, উনি হয়তো ওকে শুধু আসর থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সবাইকে ডেকেছিলেন।
মাধবীলতা আরো ব্যাকুল হইয়া বলে, না না, আপনি বুঝতে পারছেন না। আশ্রমের লোকেরা তাড়াতে পারত না?
দল নিয়ে গিয়েছিল যে?
অগত্যা মাধবীলতাকে ধৈর্য ধরিতে হয়, শান্ত হইতে হয়। সব কথা বুঝাইয়া না বলিলে মহেশ চৌধুরী বুঝিতে পারিবে না, এমন ভালোমানুষ কেন যে সংসারে জন্মায়।
তা নয়, দলে আর কজন ছিল? ওঁকে খুন করাই ওই লোকটার উদ্দেশ্য ছিল। জেলে দেবার জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল মনে নেই? ওঁকে জেলে পাঠালে আমার পেছনে লাগার সুবিধে হত। জেলে পাঠাতে পারল না, তাই একেবারে মেরে ফেলল।
এবার মহেশ চুপ করিয়া চাহিয়া থাকে। একজন স্ত্রীলোককে পাওয়ার লোভে তার স্বামীকে হত্যা করা দুর্বোধ্য ব্যাপার নয়, তবু যেন মহেশ কিছুই বুঝিতে পারিল না। ও রকম হত্যাকাণ্ডগুলি অন্যভাবে হয়। বিভূতিকে সদানন্দ ডাকিয়া পাঠায় নাই, বিভূতি যে আসরে যাইবে, তাও সদানন্দ জানিত না। বিভূতি নিজে হইতে গিয়া হাঙ্গামা আরম্ভ করিয়াছিল। এ রকম অবস্থায় সদানন্দের সম্বন্ধে এমন একটা ভয়ানক কথা অনুমান করা চলে কেমন করিয়া?
মহেশের মুখ দেখিয়া মাধবীলতার শরীর রাগে রি রি করিতে থাকে। এমন অপদার্থ হবাগো ভালোমানুষও পৃথিবীতে জন্মায়।
বুঝতে পারছেন না? আমার বিয়ে হবার পর থেকে দিনরাত ভাবত ওকে কি করে সরানো যায়, সেদিন সুযোগ পাওয়ামাত্র–যেই বুঝতে পারল যে সবাইকে ক্ষেপিয়া দিলেই সকলে মিলে ওঁকে মেরে ফেলবে, অমনি সকলকে ক্ষেপিয়ে দিল।
তা বটে, সুযোগ পাওয়ামাত্র সুযোগের সদ্ব্যবহার করা সদানন্দের পক্ষে অসম্ভব নয়।
মাথা হেঁট করিয়া মহেশ চৌধুরী চুপ করিয়া বসিয়া আকাশপাল ভাবে আর মাধবীলতা ক্ষুব্ধদৃষ্টিতে তার দিকে চাহিয়া থাকে। এই সহজ কথাটা কেন যে মানুষ বুঝিতে পারে না। বিভূতিকে বাঁচাইতে দুহাত বাড়াইয়া আগাইবার উপক্ৰম করিতে গিয়া হঠাৎ যে চিন্তা মনে আসায় সদানন্দ পিছাইয়া গিয়াছিল, মাধবীলতা সেই চিন্তাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া সদানন্দের জীবনের দিনে, মাসে, বৎসরে পরিব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে। সদানন্দ এই কথাই সর্বদা চিন্তা করিত, কি করিয়া বিভূতিকে মারিয়া মাধবীলতাকে লাভ করা যায়। মাধবীলতাকে পাওয়ার চিন্তা ছাড়া সদানন্দের কি অন্য চিন্তা থাকিতে পারে?