Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অষ্টপুরের বৃত্তান্ত || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 9

অষ্টপুরের বৃত্তান্ত || Shirshendu Mukhopadhyay

মৃদুভাষিণী দেবী

মৃদুভাষিণী দেবীর একটা মুশকিল হয়েছে আজকাল। যখন আহ্নিকে বসেন বা যখন রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দিরে যান কিংবা যখন সন্ধেবেলা পুরনো গির্জায় যিশুর মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বেলে দু’খানি বাতাসা ভোগ দেন, তখনও একই দেবতাকে দেখতে পান। ইষ্টদেবতা, রাধাগোবিন্দ জিউ আর যিশু একাকার হয়ে যাওয়ায় তার মুশকিলটা হয়। একদিন চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছে ধন্ধটার কথা বলেওছিলেন। চক্কোত্তিমশাই বুড়ো মানুষ, জ্ঞানবৃদ্ধ। গুড়ক-গুড়ুক তামাক খেতে খেতে দুলে দুলে খুব হাসলেন। বললেন, “আমারও তো ওই গোলমাল গো ঠাকরোন। কাকে বাছি, কাকে রাখি। কত রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন…নিতি নব নটলীলা।”

“পাপ হচ্ছে না তো বাবা?”

“যিশু ভজলে পাপ হয় বুঝি? যে বলে সে আহাম্মক।”

“তা বলে সবাইকে সমান দেখা কি উচিত হচ্ছে বাবা?”

“যত উপরে উঠবি, তত সব সমান দেখবি। উপরে উঠবি তো নাম-বেলুন।”

“নাম মানে কি মন্তর নাকি বাবা?”

“হুঁ।”

মৃদুভাষিণী সেই থেকে সার বুঝেছেন। ভাঙা গির্জায় একা পড়ে থাকেন যিশুবাবা। বড় মায়া হয় তার।

আজ সন্ধের মুখে একটু হিমভাব। মৃদুভাষিণী সন্ধের সময়টায় যখন গির্জায় মোম জ্বেলে দিচ্ছেন, তখন আচমকা মনে হল, একটা বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দ শুনলেন যেন। খুশির হাসি।

চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন, “কে রে? কে লুকিয়ে আছিস?”

আর কোনও শব্দ নেই। মৃদুভাষিণীর অবশ্য ভয় হল না। যিশুর মন্দিরে কি ভয়ের কিছু থাকতে পারে? তবে ভাবনা হল। সকালেই প্রাণপতির ফুটফুটে মেয়েটাকে কে যেন চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। তার কোনও অমঙ্গল হল না তো!

যখন গির্জা থেকে বেরিয়ে দরজাটায় তালা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন, তখন ফের শুনতে পেলেন গির্জার ভিতর একটা বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দ। না, শুধু হাসির শব্দই নয়, ছোট ছোট পায়ে গির্জার ভিতরে যেন ছোটাছুটি করছে এক শিশু, কার সঙ্গে যেন খেলছে।

জোড়হাতে মৃদুভাষিণী বিড়বিড় করে বললেন, “রক্ষে করো যিশুবাবা, রক্ষে করো।”

.

প্রাণপতি আজ নিজেকে নিজেই চিনতে পারছেন না। শুধু বুঝতে পারছেন তিনি আর আগের প্রাণপতি নেই। দার্শনিক প্রাণপতি কোথায় নিরুদ্দেশ হল এবং কেনই বা, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই।

কে বা কারা তাঁর ফুটফুটে মেয়েটাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। অন্য সময় বা আগের প্রাণপতি হলে তিনি শয্যা নিয়ে ফেলতেন, কান্নাকাটি করতেন এবং পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন। কিন্তু নতুন প্রাণপতি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। মেয়ের স্কুলের দিদিমণিদের জেরা করলেন, মধুছন্দার বন্ধুদের কাছেও খোঁজ নিলেন।

জানা গেল, ছুটির পর একজন সেপাইয়ের পোশাক পরা তোক এসে মধুছন্দাকে বলে, “চলো খুকি, তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।”

“তুমি কে?”

“আমার নাম তপন দাস। এ থানায় নতুন এসেছি।”

“কিন্তু আমি তো রোজ একা-একাই বাড়িতে ফিরি। আজ তোমার সঙ্গে যাব কেন?”

“বড়বাবু যে নতুন মোটরবাইক কিনেছেন। সেটাতে চড়িয়ে তোমাকে থানা থেকে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে আমাকে পাঠালেন।”

মধুছন্দা খুব অবাক হয়েছিল, খুশিও। বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে তপন দাসের সঙ্গে সে চলে যায়।

প্রাণপতি খবর নিয়ে জানলেন, তপন দাসের চেহারা বেশ গাট্টাগোট্টা, গোঁফ আছে, মাথায় ঘন চুল, হাতে লোহার বালা।

গাঁয়ের লোকরাও কেউ কেউ জানাল যে, তারা খুকিকে একজন সেপাইয়ের সঙ্গে রথতলার দিকে যেতে দেখেছে। কিন্তু কিছু সন্দেহ করেনি।

ঘণ্টা দুয়েক ধরে সার্চ পার্টি সারা গা খুঁজে দেখল। কোথাও মেয়েটাকে পাওয়া গেল না। প্রাণপতি সারাদিন নিজেও ঘুরে ঘুরে নানা জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। চিরকুটটাকেও ভাল করে পরীক্ষা করলেন। মেয়ে চুরি যাওয়া নিয়ে যতটা না ভাবলেন, তার চেয়ে বেশি ভাবলেন ওই লম্বা টেকো, কটা চোখের লোকটাকে নিয়ে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ওই লোকটার সঙ্গে ঘটনার যোগ আছে।

দুপুরবেলা উদ্ধবকে ডেকে পাঠালেন তিনি। উদ্ধব কাঁপতে কাঁপতে এল। প্রাণপতি বললেন, “উদ্ধব, সেই ঢ্যাঙা লোকটাকে তুমি চেনো?”

মাথা নেড়ে উদ্ধব বলে, “না হুজুর, ঠিক চিনি না।”

“কিন্তু সকালে তোমার কথা শুনে তো তা মনে হল না।”

“চেনা বলতে যা বোঝায়, তা নয় বড়বাবু।”

“তা হলে?”

“আমি রাতবিরেতে মাঝে-মাঝে এখানে-ওখানে শুয়ে থাকি। ঘরে শুলে আমার কেমন দম আটকে আসে। মাঝে-মাঝে শীতলসাহেবের ভাঙা গির্জার দরজার সামনের জায়গাটায়ও শুই। রোজ সকালে হুজুর, গির্জার ভিতরে ঝটপাটের শব্দ হয়। গির্জায় ইঁদুর, আরশোলা ছাড়া আর কিছু তো থাকার কথা নয়। তাই একদিন জানলার ভাঙা শার্শি দিয়ে উঁকি মেরেছিলুম।”

“কী দেখলে?”

“আজ্ঞে, ওই মানুষটাকে। খুব লম্বা, মাথায় টাক, কটা চোখ, গায়ে জোব্বা মতো। ডান্ডি লাগানো বুরুশ দিয়ে ঘর ঝাটাচ্ছেন।”

“এসব তো ভুতুড়ে গল্প, বিশ্বাসযোগ্যই নয়।”

“আজ্ঞে হুজুর, আমার চোখের বা মনের ভুলও হতে পারে।”

“ধরলাম, ওরকম একজন মানুষ বা ভূত আছে। কিন্তু সে হঠাৎ কাল সকালে আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিল?”

“তা জানি না হুজুর। কিন্তু উনি আপনার মেয়েকে চুরি করার মতো মানুষ নন বড়বাবু। উনি ভাল লোক।”

প্রায় একই কথা শোনা গেল মৃদুভাষিণীর কাছেও। বললেন, “বাবা প্রাণপতি, তোমার খুকি যেখানেই থাক, ভালই থাকবে। কিন্তু ওকে ছেলেধরা বলে ভেবো না। যিশুবাবার সেবা করে তো, ওরা ওরকম নয়।”

“আপনারা কি আমাকে পাগল করে দেবেন মাসিমা! গির্জায় ওরকম একটা লোক এল কী করে? শেষ অবধি ভূতে বিশ্বাস করতে বলছেন?”

“অত সব জানি না বাবা। তোমার মাথা এখন গরম। মাথাটা ঠান্ডা হলে ভেবো৷”

“গির্জার আনাচ-কানাচ দেখা হয়েছে। সেখানে কেউ থাকে না, কেউ নেইও।”

“ওভাবে খুঁজলে কি পাওয়া যায়, বাবা?”

“তবে কীভাবে খুঁজব?”

“দোর ধরে পড়ে থাকলে হয়তো হয়। কিন্তু সে তুমি পারবে না।”

মেয়ের জন্য উদ্বেগে প্রাণপতির স্ত্রী বিজয়া সারাদিন বারকয়েক অজ্ঞান হয়েছেন, খাননি কিছু, প্রবল কান্নাকাটি করছেন। তবু মনের এই অবস্থায়ও তিনি তাঁর আলাভোলা স্বামীর পরিবর্তনটা লক্ষ করে একবার বললেন, “আচ্ছা, তোমাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন বলো তো!”

প্রাণপতি ভ্রু তুলে বললেন, “কীরকম?”

“কী জানি, বুঝতে পারছি না। কিন্তু যেন অন্য মানুষ। একদম অন্য মানুষ।”

প্রাণপতি এটা বুঝতে পারছিলেন যে, চিঠিতে লেখা শর্ত না মানলে তার মেয়েটাকে হয়তো গুন্ডারা মেরে ফেলবে। শর্ত না মেনে সুতরাং উপায় নেই। কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারছেন না যে, আসামিকে এভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে কী লাভ? কারণ, হুলিয়া জারি আছে, কাল সকালেই সদর থেকে ফোর্স আসবে এবং ওদের পালানো মুশকিল হবে। তা হলে কি ছেড়ে দিতে বলার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে?

রাত্রিবেলা তিনি যখন নবীনকে ছেড়ে দেবেন বলে স্থির করলেন, তখন ফটিক বলল, “কাজটা কি ঠিক হবে স্যার? আমাদের চাকরি নিয়ে না টানাটানি পড়ে যায়!”

“ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাকরি গেলে আমার যাবে। তোমাদের দোষ হবে না, ভয় নেই।”

ফটিক একটু গোঁজ হয়ে রইল।

রাত বারোটায় নবীনকে লকআপ থেকে ছেড়ে দিলেন তিনি। নবীন বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।

তারপর বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে এলেন। সেপাইদের মধ্যে ফটিক আর বক্রেশ্বর জিজ্ঞেস করল, “আমরা সঙ্গে যাব স্যার?”

“না, আজ আমাকে একাই যেতে হবে।”

কাজটা ঠিক হল কি না, তা প্রাণপতি বুঝতে পারছিলেন না।

নিশুতি রাতে তিনি একা হাঁটতে হাঁটতে গির্জাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। টর্চ জ্বেলে পুরনো নোনাধরা ভগ্নপ্রায় গির্জাটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এই গির্জার কি কোনও মহিমা থাকা সম্ভব? তিনি ভূত বা ভগবানে বিশ্বাসী নন। কিন্তু উদ্ধব আর মৃদুভাষিণী যা বলছেন, তা ভুতুড়ে ব্যাপার। নয় তো কোনও একটা লোক খ্রিস্টান যাজকের মতো সেজে ওদের ঘোল ঘাওয়াচ্ছে। দ্বিতীয়টাই সত্যি বলে মনে হয়।

টর্চটা নিভিয়ে তিনি চুপচাপ অন্ধকার গির্জাটার দিকে চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনও শব্দ নেই। ঘটনা নেই।

কিন্তু আবহাওয়ায় তিনি একটা বিপদ-সংকেত পাচ্ছেন। ঘটনার গতি ও প্রকৃতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আজ রাতেই হয়তো কিছু একটা ঘটবে। কী ঘটবে, সেটাই বুঝতে পারছেন না তিনি।

কাছাকাছি কোনও লোক এসে দাঁড়ালে তার শরীরের তাপ হোক বা গন্ধ হোক, কিছু একটা টের পাওয়া যায়, সে যত নিঃশব্দেই আসুক না কেন। প্রাণপতিও টের পেলেন। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার বলে কিছু দেখার উপায় নেই। টর্চটা জ্বালাবেন কি না বুঝতে পারছেন না। লোকটা শক্ত না মিত্র, তা জানেন না। কিন্তু তার ঘাড় শক্ত হয়ে গেল এবং শরীরের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। নির্ভুল টের পাচ্ছেন, তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

স্বভাবসিদ্ধ আত্মরক্ষার তাগিদেই কোমরের পিস্তলটার দিকে হাত বাড়িয়েও হাতটা সরিয়ে নিলেন। কাজটা বোকামি হবে। পিস্তল বের করার আগেই লোকটা যা করার করে ফেলবে। তাই তিনি আচমকা নিচু হয়ে দ্রুত মাটিতে ঝাঁপ খেয়ে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু ডান্ডাটা এড়াতে পারলেন না। মাথার ডান ধারে একটা কঠিন আঘাত লাগতেই চোখে অন্ধকার দেখে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

তাঁর পড়ে থাকা শরীরটা ডিঙিয়েই তিনজন লোক আর-একটা লোককে টানতে টানতে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে গির্জার দিকে নিয়ে চলল।

গির্জার দরজা খুলে চারদিকে একটা জোরালো টর্চ ফেলে একজন বলল, “মেয়েটা কোথায়?”

আর-একজন জবাব দিল, “এখানেই আছে। আমি নিজে মেয়েটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে গিয়েছি। চাবি আমার কাছে।”

“মেয়েটা কোথায় খুঁজে দেখ। দারোগাটা কিছু একটা সন্দেহ করে এখানে এসেছিল, কাজেই আমাদের চটপট কাজ শেষ করে পালাতে হবে।”

যে লোকটাকে হেঁচড়ে আনা হয়েছে, সে মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

দ্বিতীয় লোকটা বলল, “সে তো বুঝলুম, কিন্তু এতটা পথ আসতে হয়েছে, একটু জিরোতে দাও।”

“জিরোতে গেলে ধরা পড়ার ভয় আছে। আচ্ছা, পাঁচ মিনিট। কিন্তু তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে দেখ।”

“বাচ্চা মেয়ে, কোথাও গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। পরে দেখা যাবে।”

পাঁচ মিনিটও কাটেনি। হঠাৎ একটা শব্দে তিনজনেরই চটকা ভাঙল এবং তারা অবাক হয়ে দেখল, যিশুর মূর্তির সামনে বেদির উপর মস্ত বড় একটা সাদা মোম কে যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে, দু ধারে ভাঙা বেঞ্চের স্থূপ আর মাঝখানে চওড়া একটা প্যাসেজ। সেই প্যাসেজটায় বেদির দিক থেকে একটা লাল রঙের বল গড়িয়ে আসছে। তার পিছনেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে বঁকড়া চুলওলা একটা মেয়ে দৌড়ে আসছে।

চণ্ডী বলল, “ওই তো দারোগার মেয়েটা!” ভ্রু কুঁচকে পল্টু পাকড়াশি বলল, “কিন্তু মোমটা জ্বালাল কে?”

“তা তো জানি না।”

“ভাল করে দেখ। গির্জায় লোক ঢুকেছে নিশ্চয়ই।”

তিনজনই লাফিয়ে উঠল। টর্চ নিয়ে চারদিকে খুঁজে দেখতে লাগল। কোথাও কাউকে পাওয়া গেল না।

চণ্ডী অবাক হয়ে বলে, “ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি রে বাবা!”

“মেয়েটাকে ধরে জিজ্ঞেস কর। ও নিশ্চয়ই জানে।”

কিন্তু মেয়েটা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপও না করে সারা গির্জা বলের পিছনে ছুটছে আর হাসছে। কখনও হাততালি দিয়ে উঠছে।

চণ্ডী তার পিছনে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, “ও খুকি, শোনো, শোনো। মোমটা কি তুমি জ্বালিয়েছ?”

মেয়েটা জবাব দিচ্ছে না। সামনে বলটা কেবলই গড়িয়ে যাচ্ছে। আপনা থেকেই ডাইনে গড়িয়ে যাচ্ছে, আবার বাঁয়ে। মেয়েটার সঙ্গে ছুটে পেরে উঠছে না হোঁতকা চণ্ডী। হাঁপসানো গলায় বলল, “ওরে পল্টু, ওকে সামনে থেকে ধরে থামা।”

মেয়েটা প্যাসেজে ঢুকতেই পথ আগলে দাঁড়াল পল্টু। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েটা দিব্যি তার হাত এড়িয়ে লহমায় পেরিয়ে গেল তাকে। বগা মেয়েটাকে দু হাতে জাপটে ধরার চেষ্টা করতে গেল। কীভাবে যে হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গেল, তা বোঝাই গেল না। মেয়েটা যেন তাদের দেখতেই পাচ্ছে না, এমন ভাবে ছুটছে বলটার পিছনে। আর বলটাও দিব্যি গড়িয়ে যাচ্ছে আপনা থেকেই।

চণ্ডী বলল, “কী ব্যাপার বল তো, কী হচ্ছে এসব?”

পল্টু দাঁত কড়মড় করে বলল, “মেয়েটা বহুত চালাক। ধর ওকে, নয়তো বিপদ।”

সুতরাং, তিনজনই তিন দিক থেকে মেয়েটাকে রোখার চেষ্টা করতে লাগল। দৌড়ে, ঝাঁপিয়ে, ল্যাং মেরে কোনও ভাবেই তারা কিছু করে উঠতে পারছিল না। মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসছে আর মনের আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনও যিশুবাবার বেদিতে উঠে যাচ্ছে, কখনও ভাঙা বেঞ্চের তূপের উপর দিয়ে লাফিয়ে, ডিঙিয়ে যাচ্ছে, হাঁফিয়ে পড়ছে না, ক্লান্ত হচ্ছে না।

কিন্তু মেয়েটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে ক্রমে ক্রমে তিনজন হফিয়ে পড়ছিল। একসময় কোমরে হাত দিয়ে চণ্ডীচরণ দাঁড়িয়ে পড়ল। বগা একটা ভাঙা বেঞ্চে পা আটকে দড়াম করে পড়ল। পল্টু বুক চেপে বসে পড়ল হঠাৎ।

প্রাণপতিকে দু’জন লোক দু’ দিক থেকে ধরে তুলে বসাল।

“কেমন আছেন বড়বাবু?”

মাথাটা এখনও টনটন করছে, কিন্তু প্রাণপতি বুঝতে পারছেন, ব্যথাটা অসহ্য নয়। তিনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক আছি। কিন্তু সেই লোকগুলো কোথায় গেল?”

ভুবন মণ্ডল বলল, “ওই গির্জায় ঢুকেছে। মনে হয়, এতক্ষণে নবীন দাসকে মেরে ফেলেছে।”

বিশু গায়েন বলল, “লাশটাকে পল্টু পাকড়াশির লাশ বলে চালিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে।”

ভুবন মণ্ডল মাথা নেড়ে বলল, “পল্টুর কোমরে পিস্তল আছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। কুড়ুল নিয়ে যে হামলা করব, তাতে লাভ হওয়ার নয়। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে।”

পিস্তলটা হাতে নিয়ে গির্জার দিকে এগোতে এগোতে প্রাণপতি বললেন, “ভোর হতে আর দেরি নেই। ওরা কি আর এতক্ষণ গির্জার ভিতর বসে আছে! পিছনের কোনও চোরা দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই।”

গির্জার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। প্রাণপতি দরজায় ঘা দিয়ে বললেন, “দরজা খোলো।”

দরজা অবশ্য খুলল না। প্রাণপতি বারবার ঘা দিতে লাগলেন।

ভোরের পাখিরা ডাকছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। আলো ফুটে উঠল একটু একটু। আর এই সময় বড়, কালো একটা পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়াল গির্জার সামনে। ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নেমে ফটিক চেঁচিয়ে উঠল, “সদর থেকে ফোর্স এসে গিয়েছে স্যার!”

দশ-বারোজন বন্দুকধারী সেপাই নেমে প্রাণপতিকে স্যালুট ঠুকে বলল, “কী করতে হবে স্যার।”

চিন্তিত প্রাণপতি বললেন, “গির্জার দরজাটা ভাঙা হোক, এটা আমি চাই না। কনফ্রন্টেশনও নয়। কারণ, আমার মেয়েটা ওদের হেফাজতে রয়েছে। আপনারা বরং গির্জাটা ঘিরে থাকুন।”

তাই হল।

সূর্যের প্রথম রশ্মি গির্জার মাথার উপরকার ক্রসটাকে ছুঁয়ে ফেলল। গির্জার সামনের দরজাটা খুলে গেল আস্তে আস্তে। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত তিনজন লোক মড়ার মতো চোখ চেয়ে হাত উপরে তুলে বেরিয়ে এল। পল্টু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “গুলি চালাবেন না। আমি সারেন্ডার করছি।”

তাদের ভ্যানে তোলার পর নবীন টলতে টলতে বেরিয়ে এসে মাথায় দু হাত চেপে সিঁড়িতে বসে পড়ল। বলল, “ভাববেন না বড়বাবু, আমার তেমন কিছু হয়নি।”

“কিন্তু আমার মেয়েটা!”

“বাবা! এই তো আমি!” বলে ফুটফুটে মধুছন্দা দরজায় এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা লাল বল।

প্রাণপতি স্মিত হাসলেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ওরা তোকে মারধর করেনি তো?”

“না তো! আমি তো সারারাত একটা ছোট্ট ঘরে সুন্দর একটা বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম। ওরা কারা বাবা?”

“ওদের কথা তোমার মনে রাখার দরকার নেই।”

নবীন দাস ছাড়া পেয়ে মাধবগঞ্জে ফিরে গিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, “নগেন পাকড়াশির ওই পাপের টাকার দরকার নেই আমার। চার বিঘে জমি আছে, চাষবাস করলে আমার চলে যাবে।”

কিন্তু প্রাণপতির অনেক হিসেবই মিলছে না। আসামি তিনজনই বলেছে যে, গির্জার মধ্যে সারারাত তারা প্রাণপতির মেয়েকে ধাওয়া করেও ধরতে পারেনি। মেয়েটা তাদের হয়রান করে, বেদম করে দিয়েছিল। প্রাণপতি জানেন, কথাটা সত্যি নয়। মধুছন্দা রাত্রে কোথাও একটা বিছানায় ঘুমিয়েছিল। তা হলে সেই মেয়েটা আসলে কে? প্রশ্ন আরও আছে। তার যে মাথায় নানারকম উদ্ভট চিন্তার উদয় হত, সেগুলো উধাও হল কেন? এসব ভেবে মাঝে-মাঝে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

কয়েকদিন পরে সন্ধেবেলা মৃদুভাষিণী দেবী টুকটুক করে গিয়ে গির্জার তালা খুলছেন, পাশেই দেখলেন, প্রাণপতি দাঁড়িয়ে।

“ও বাবা! প্রাণপতি যে!”

“আপনার যিশুর কাছে আমার জন্য একটু প্রার্থনা করবেন মাসিমা?”

“কী প্রার্থনা বাবা?”

“আমার মাথায় আগে নানারকম সুন্দর সুন্দর চিন্তা আসত, তাতে বেশ আরামে থাকতাম। সেই চিন্তাগুলো সব হারিয়ে গিয়েছে। আপনার যিশুবাবাকে বলুন, আমার চিন্তাগুলো যেন ফিরে আসে।”

“সে আর বেশি কথা কী! তা তুমিই কেন যিশুবাবাকে বলো।”

“আজ্ঞে, ভারী লজ্জা করে যে!”

“ও মা, যিশুকে লজ্জা কীসের?”

“আমি যে নাস্তিক!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 9 of 9 ): « পূর্ববর্তী1 ... 78 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress