জামাইবাবু যে
“জামাইবাবু যে! নমস্কার, নমস্কার! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!”
পল্টু পাকড়াশিকে পাকড়াও করার জন্য সরকার বাহাদুর কোনও পুরস্কার ঘোষণা করেছে কি না সেটা জানতে থানায় এসেছিল অবনী ঘোষাল। করেনি শুনে ভারী হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরোবার মুখেই অবনী ঘোষালের পথ আটকাল একটা বেশ হাসিখুশি আহ্লাদি চেহারার উটকো লোক। অবনীর মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। এই নিয়ে চার-চারটে দিন কেটে গেল, সরকারের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দই নেই! এরকম চললে মোটরবাইকটা কেনার কী হবে তা ভেবে পাচ্ছিল না অবনী। এই পোড়া দেশে ভাল কাজের কি কোনও দামই নেই?
ঠিক এই সময় লোকটা গ্যালগ্যালে মুখে তার পথ আটকে দাঁড়াতেই অবনী বিরক্ত হয়ে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নমস্কার। আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি মশাই!”
“তা তো ব্যস্ত থাকারই কথা! চারদিকে যে আপনাকে নিয়ে ধন্যি-ধন্যি হচ্ছে জামাইবাবু! লোকে তো শতমুখে আপনার সুখ্যাতি করে বেড়াচ্ছে! সেদিন তো গাবতলির হাটে শুনলুম, এক কবিয়াল গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আপনাকে নিয়ে গান বেঁধে গাইছে, আর লোকে শুনছেও ভিড় করে। অষ্টপুরে অবতীর্ণ মোদের জামাই, সবারে ভরসা দিল আর ভয় নাই…”।
অবনী পুলকিত হয়ে বলে, “তাই নাকি?”
“তবে? আমি তো আপনার দর্শন পাব বলে সেই দোগাছি থেকে আসছি।”
“বটে!”
“তা জামাইবাবু, অষ্টপুরের লোকেরা আপনাকে সংবর্ধনা টংবর্ধনা দিচ্ছে না?”
“না হে বাপু, সেসব লক্ষণ তো কিছু দেখছি না!”
“এঃ, এটা তো ভারী অন্যায় কথা! প্রাণ হাতে করে আপনি যে অষ্টপুরের অত বড় একটা খুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করলেন, তার কি একটা দাম নেই? কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা কথা আছে, নাকি?”
“সে তো বটেই।”
লোকটা গলা আরও দু’ পরদা নামিয়ে বলল, “তবে কি জানেন জামাইবাবু, অষ্টপুরে গিজগিজ করছে খারাপ লোক। খুনে, গুন্ডা, পকেটমার, চোর, ডাকাত, কেপমার একেবারে ছয়লাপ। এ তো সবে শুরু।”
অবনী একটু থতমত খেয়ে বলে, “না-না, আমি আর অষ্টপুরের উপকার করতে পারব না মশাই, আমার কাজকর্ম পড়ে আছে।”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “আপনি না চাইলেই তো হবে না জামাইবাবু, চোর-গুন্ডা-বদমাশরা সেকথা শুনবে কেন? তাদেরও তো একটা প্রেস্টিজ আছে!”
“তার মানে?”
লোকটা গলা আরও এক পরদা নামিয়ে বলে, “আজ্ঞে, সেই খবর পেয়েই তো আসা।”
“খবর! কীসের খবর মশাই?”
“পরশু রাত্তিরে যে শ্মশানের পাশের আমবাগানে বিরাট মিটিং হয়ে গেল! জোর বক্তৃতা হল মশাই, শুনলে গা গরম হয়ে যায়।”
অবনী ঘোষাল একটু ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, “তা তারা কী নিয়ে বক্তৃতা করছিল?”
“আজ্ঞে, আপনাকে নিয়েই। তাদের আঁতে বড্ড লেগেছে কিনা। একজন নিরীহ চোরকে ওরকম ভাবে পেটানোয় তারা বেজায় চটে গিয়েছে। নাটা শিট তো বেশ জবরদস্ত বাগ্মী। বলছিল, একজন নবীন প্রতিভা, একজন উদীয়মান শিল্পীর উত্থানকে এভাবে থামিয়ে দেওয়া শুধু অন্যায় নয়, মহাপাপ। কত বড় একটা সম্ভাবনার অকালমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছিল, তা ভেবে আমাদের আশঙ্কা হয়। এই ঘটনার পিছনে নাটের গুরু হল শ্রীনিবাস আচার্যির ছোট জামাই মহাপাষণ্ড, কুলাঙ্গার, কাপুরুষ এবং অহংকারী অবনী ঘোষাল। ভাইসব, এই অবনী ঘোষাল দেশ ও দশের শত্রু, নরঘাতক, রক্তলোলুপ, বিশ্বাসঘাতক এবং মহাপাপী। পল্টু পাকড়াশির গণধোলাইয়ের পিছনে শুধু এর নোংরা হাতই ছিল না, এই অবনী ঘোষাল আবার এই অপকর্মের জন্য সরকার বাহাদুরের পুরস্কার পাওয়ার জন্যও ঘোরাঘুরি করছে। আপনাদের কাছে আজ আমার বিনীত আবেদন, অবনী ঘোষালকে এই অষ্টপুরের মাটিতেই কবর দিন। সে যেন আর অষ্টপুরের সীমানা ডিঙোতে না পারে। ওঃ, এসব শুনে যা হাততালি পড়ল না জামাইবাবু যে, অত রাতেও কাকগুলো কা কা করে ভয়ে বাসা ছেড়ে উড়ে পড়েছিল।”
অবনী ঘোষাল শুকনো মুখে একটা ঢোক গিলে বলল, “কিন্তু পল্টু পাকড়াশি তো অষ্টপুরের ছেলে নয়! তা হলে অষ্টপুরের লোক রেগে যাচ্ছে কেন?”
“আজ্ঞে, সে কথাও উঠেছিল জামাইবাবু। দামোদর হাতি কথাটা তুলে বলেছিল, ‘পল্টু পাকড়াশি বহিরাগত, ফরেনার। সে ভূমিপুতুর নয়। তার জন্য অষ্টপুরের জামাইকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা উচিত হবে কি না। তাতে গদাই মল্লিক জলদগম্ভীর গলায় খুব ভাবাবেগ দিয়ে বলতে লাগল, ‘ভাইসব, অপরাধ জগতে বহিরাগত বলে কিছু নেই। গুন্ডা ভারতবাসী, চোর ভারতবাসী, ডাকাত ভারতবাসী, খুনি ভারতবাসী আমার ভাই, আমার আত্মার আত্মীয়। তাদের অপমানে আমাদেরও অপমান। তাদের ব্যথা, তাদের বেদনা আমাদেরই ব্যথা ও বেদনা…’ওঃ জামাইবাবু, কী বলব আপনাকে, গদাইয়ের বক্তৃতা শুনে অনেকে চোখের জল চাপতে পারেনি। শেষে সভায় ঐকমত্য হল যে, অবনী ঘোষালকে প্রথমে হাটুরে প্রহার, তারপর জীয়ন্ত কবর দেওয়া হবে, যাতে এরকম অসামাজিক এবং অমানবিক কাজে নামবার আগে জনসাধারণ সতর্ক হয়।”
অবনী ঘোষাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “কিন্তু পল্টু পাকড়াশিকে মেরেছে তো পাবলিক, আমার কী করার ছিল বলুন!”
“আহা, সেসব আলোচনাও কি হয়নি জামাইবাবু! পশুপতি গুছাইত তো পষ্ট করেই বলল, অবনী ঘোষাল যদি জনতাকে খেপিয়ে না তুলত, তাদের উত্তেজিত করার জন্য ইন্ধন না ছড়াত, তা হলে এরকম নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারত না। আপনারা জানেন অষ্টপুর একটি শান্তিপ্রিয় জায়গা, এখানে দারোগা পুলিশ পর্যন্ত আলস্যে সময় কাটায়। ওই যমতুল্য জামাইটি এসেই আজ অষ্টপুরের চরিত্র নষ্ট করেছে। ভাইসব, ওই অবনী ঘোষালের রক্তে হাত না রাঙালে আমাদের শান্তি নেই। ওঃ, তাই শুনে কী উল্লাস চারদিকে!”
জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে অবনী বলে, “আচ্ছা, আমার যে ভারী জলতেষ্টা পেয়েছে!”
“তার আর ভাবনা কী! এই যে আমার জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে মেরে দিন।”
জল খেয়ে বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে অবনী বলে, “আচ্ছা, এখান থেকে হরিপুর যাওয়ার পরের বাসটা কখন ছাড়বে যেন!”
“বেলা তিনটের আগে নয়। কিন্তু জামাইবাবু, অষ্টপুরকে এইসব গুন্ডা বদমাশদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি কোথায় যাবেন? আর অষ্টপুরের জনগণই কি আপনাকে ছাড়বে ভেবেছেন? তারা যে আপনার মুখাপেক্ষী হয়েই আছে।”
অবনী সখেদে বলল, “অষ্টপুরে বিয়ে করাটাই আমার মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে দেখছি। এর চেয়ে বিষ্ণুপুরে বিয়ে করলে অনেক ভাল ছিল।”
“আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। তবে কিনা অষ্টপুরে আপনার যা নাম হল, এমন ক’জনের ভাগ্যে হয় বলুন! এই তো পুলক মিত্তির বারোখানা যাত্রাপালা লিখেও তেমন নাম করতে পারল না, মদন মালো এত বড় পালোয়ান হয়ে তেমন সুখ্যাতি পেল না, প্রহ্লাদ প্রামাণিক আড়াইশো রসগোল্লা খেয়ে বিশ্বরেকর্ড করা সত্ত্বেও ক’জন তার নাম জানে বলুন। আর আপনার নাম এখন দশটা গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ফিরছে। বাঘা যতীন, ক্ষুদিরামের পরেই এখন আপনার সুখ্যাতি। তার উপর ধরুন, অষ্টপুরের গুন্ডা বদমাশরাও তো ছেড়ে কথা কওয়ার লোক নয়। তারা সব রাস্তাঘাট, অলিগলিতে নজর রেখেছে। এই যে একটু আগে মাথায় গামছা জড়ানো একটা লোক উত্তর দিকে হেঁটে গেল, আর তারপরেই যে বেঁটেমতো একজন ঝাঁকা মাথায় দক্ষিণ দিকে দুলকি চালে যাচ্ছিল, তাদের দেখে কিছু বুঝলেন?”
“আজ্ঞে না।”
“ওরা হল গে অষ্টপুরের নষ্ট লোকদের আড়কাঠি। আপনার উপর আড়ায়-আড়ায় নজর রাখছে। পালানোর উপক্রম হলেই…”
“ওরে বাবা! কিন্তু আমার মায়ের যে বড় অসুখ! আমার আজই রওনা হওয়া দরকার।”
“সে তো ঠিকই। বড়ই দুঃখের কথা। মায়ের অসুখ হলে তো রওনা হয়ে পড়াই দরকার। কিন্তু জামাইবাবু, আমি যেন কানাঘুষো শুনেছিলুম যে, গত বছরই আপনার মায়ের গুরুতর অসুখ হয়ে তিনি গঙ্গাযাত্রা করেছিলেন। কালাশৌচ পড়ে যাওয়ায় আপনার বিয়ে ছয়মাস পিছিয়ে এই গত আষাঢ়ে হয়েছে! কথাটা কি তা হলে গুজব?”
“অসুখটা ঠিক মায়ের নয় বটে, আমার এক মাসির। আমি তার ছেলের মতোই।”
“তা তো বটেই। মায়ের বদলে মাসির অসুখ হওয়াও খুব খারাপ। তা দেখুন, তিনটে দশের বাসটা যদি ধরতে পারেন।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। বরং পুলিশ পাহারা নিয়ে এই বাসটাই ধরে ফেলি। কী বলেন?”
“আজ্ঞে, পুলিশ পাহারাও নিতে পারেন। তবে কিনা অষ্টপুর থানার সেপাইদের তেমন বীরত্বের খ্যাতি নেই। বছর দশেক আগে রামভজন সিংহ নামে এক সেপাই ছিল। শোনা যায়, কালুডাকাত যখন নবকান্তবাবুর বাড়িতে ডাকাতি করতে এসেছিল, তখন ডাকাতি সেরে পালানোর সময় একজন ডাকাত একটু পিছিয়ে পড়ায় ওই রামভজন তাকে জাপটে ধরে। অষ্টপুর থানার শেষ বীর বলতে ওই রামভজন, তা সেও তো কবেই রিটায়ার করে দেশে চলে গিয়েছে।”
“ডাকাতটাকে ধরে কী করা হল?”
“ধরে রাখা যায়নি যে। সে রামভজনকে কাতুকুতু দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রাণপতিবাবু তো গত পরশুদিনই তাঁর নিজের বউকে ভুল করে ‘বউদি’ বলে ডেকে ফেলেছিলেন। শুধু কি তাই? স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় একটা ফুটফুটে মেয়েকে দেখে থুতনি নেড়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাঃ খুকি, ভারী মিষ্টি দেখতে তো! নাম কী তোমার?’ বললে পেত্যয় যাবেন না, ওই খুকিটি প্রাণপতিবাবুর নিজেরই মেয়ে।”
“বলেন কী মশাই!”
“আরও শুনবেন? হেড কনস্টেবল ফটিক তবলা বাজিয়ে বেড়ায়, বক্রেশ্বরের হাতযশ হোমিয়োপ্যাথিতে, ছোট কনস্টেবল তন্ময় পাল কবিতা লেখে, নন্দগোপাল হালুই ঘুড়ি ওড়ানোয় চ্যাম্পিয়ন। এরা কেউ কখনও কোনও চোর-ডাকাত বা গুন্ডা-বদমাশকে ধরেনি, ঘাঁটাতেও যায়নি।”
ভারী হতাশ হয়ে অবনী বলে, “তা হলে কী উপায় বলুন তো!”
“ওই দেখো কাণ্ড! জামাইবাবু কি ঘেবড়ে গেলেন নাকি? আপনার খেল দেখব বলেই যে দোগাছি থেকে এত দূর ছুটে এলুম!”
অবনী আমতা-আমতা করে বলে, “সে তো বুঝলুম। কিন্তু আমার যে আর এই অষ্টপুর জায়গাটা মোটেই ভাল লাগছে না!”
“কেন, অষ্টপুর তো দিব্যি জায়গা!”
“অষ্টপুরের চেয়ে আমাদের খিজিরগঞ্জ অনেক ভাল জায়গা মশাই।”
“কেন জামাইবাবু, অষ্টপুরের চেয়ে খিজিরগঞ্জ ভাল কীসে?”
অবনী অনেক ভেবেও খিজিরগঞ্জের ভাল কিছু মনে করতে পারল না। শুধু বলল, “খিজিরগঞ্জের ভোটকচু খুব বিখ্যাত।”
লোকটা হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য হেসে বলে, “কচুঘেঁচুর কথাই যদি ওঠে জামাইবাবু, তা হলে বলি অষ্টপুরের মানকচুর কথা সাহেবরাও জানেন। জগদ্বিখ্যাত জিনিস। বছর দশেক আগে এত বড় একটা মানকচু তোলা হয়েছিল যে, সেই জায়গায় একটা সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে গিয়েছে। লোকে দেখতে আসে!”