অশনি সংকেত (Ashani Sanket) : 03
গঙ্গাচরণ সেদিন পাঠশালা জমিয়ে বসেচে, সামনের পথ দিয়ে একজন পথ-চলতি লোক যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পাঠশালার মধ্যে ঢুকে বললে—এটা পাঠশালা?
—হ্যাঁ।
—মশাই দেখচি ব্রাহ্মণ, একটু তামাক খাওয়াতে পারেন? আমিও ব্রাহ্মণ। নমস্কার।
—বসুন বসুন, নমস্কার—ওরে—
গঙ্গাচরণের ইঙ্গিতে একজন ছাত্র তামাক সাজতে ছুটলো।
আগন্তুক লোকটির পায়ে পুরোনো ও তালি দেওয়া ক্যাম্বিসের জুতো, গায়ে মলিন পিরান, হাতে একগাছি তৈলপক্ব সরু বাঁশের ছড়ি। পায়ে জুতো থাকা সত্বেও সাদা ধুলো হাঁটু পর্যন্ত উঠেচে। লোকটি একটা কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর ক্লান্তভাবে বসে পড়লো।
গঙ্গাচরণ বললে—মশায়ের নাম?
—আজ্ঞে দুর্গা বাঁড়ুয্যে। নিবাস, কুমুরে নাগরখালি, আড়ংঘাটার সন্নিকট। আমিও আপনার মত ইস্কুল মাস্টার। অম্বিকপুর চেনেন? এখান থেকে পাঁচ কোশ পথ। অম্বিকপুরে লোয়ার প্রাইমারী ইস্কুলে সেকেন পণ্ডিত।
—বেশ, বেশ। তামাক ইচ্ছে করুন—
—আগে আমায় একটু জল খাওয়াতে পারেন?
—ডাব খাবেন? ওরে পাঁচু, যাও বাবা, হরি কাপালীর চারাগাছ থেকে আমার নাম করে দুটো ডাব চট করে পেড়ে নিয়ে এসো তো?
আগন্তুক লোকটি প্রশংসমান দৃষ্টিতে গঙ্গাচরণের দিকে চেয়ে বললে—বাঃ, আপনার দেখচি এখানে বেশ পসার!
গঙ্গাচরণ মৃদু হেসে চুপ করে রইল। বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজের পসার-প্রতিপত্তির কথা নিজের মুখে বলে না।
ইতিমধ্যে ডাব এসে পড়লো। ডাবের জল খেয়ে দুর্গাপদ বাঁড়ুয্যে আরামের নিঃশ্বাস ফেলে হুঁকো হাতে নিয়ে সজোরে ধূমপান করতে লাগলো। আপন মনেই বললে—বেশ আছেন আপনি—বেশ আছেন—
গঙ্গাচরণ বিনীতভাবে বললে—আপনাদের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে এক রকম চলে যাচ্চে—
—না, না, বেশ আছেন। দেখে আনন্দ হয়, আমার মতই ইস্কুল মাস্টার একজন, ভালো ভাবে থাকতে দেখলেই আনন্দ হয়।
—আপনি ওখানে কি রকম পান?
—মাইনে পাই তিন টাকা ইস্কুল থেকে। গভর্ণমেন্টের এড পাই দেড় টাকা। ইউনিয়ন বোর্ডের এড পাই ন’-সিকে মাসে। এই ধরুন সর্বসাকুল্যে পৌনে সাত টাকা। তা এক রকম চলে যায়—
গঙ্গাচরণ বললে—মাসে মাসে পান তো?
দুর্গাপদ বাঁড়ুয্যে গর্বের সুরে বললে—নিশ্চয়ই, এ হল গভর্ণমেন্টের কারবার। এতে কোনো গোলমাল হবার জোটি নেই। তবে মোটে সাত টাকায় সংসার ভালো চলে না।
—মশায়ের ছেলেপিলে কি?
—একটি মাত্র মেয়ে, আর আমার পরিবার। তবে আমার বিধবা ভগ্নী আমার সংসারেই থাকে। সাত টাকায় এতগুলি লোকের—
—আর কিছু আয় নেই?
—আজ্ঞে না। আমি বিদেশী লোক, ওখানে আর কি আয় থাকবে?
—ও গ্রামে কি ব্রাহ্মণের বাস বেশি? নাকি অন্য অন্য জাতও আছে? আপনি সঙ্গে সঙ্গে দশকর্ম ধরুন না কেন! এই ধরুন লক্ষ্মীপুজো মনসাপুজো ষষ্ঠীপুজো-টুজো—
—ও-সব চলবে না। সেখানে পুরুত আছে গ্রামে। ব্রাহ্মণের গ্রাম—
—ওখানেই আপনি ভুল করেচেন—এই! গোলমাল করবি তো একেবারে পিঠের ছাল তুলবো সব। ব্রাহ্মণের গ্রামে বসতে নেই কক্ষনো। ওতে পসার হয় না মশাই—
—কথাটা ঠিকই বলেচেন। আপনি বেশ আছেন, ডাব আনতে বললেন অমনি ডাব এসে হাজির। অমন না হলে বাসের সুখ! আমার আর কোনো আয় নেই ওই পৌনে সাত টাকা ছাড়া। তবে ধরুন কলাটা, বেগুনটা মধ্যে মধ্যে ছাত্রেরা আনে।
দুর্গাপদ বাঁড়ুয্যে কথাবার্তার ফাঁকে অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবতে লাগলো। পুনরায় তামাক সেজে যখন হুঁকো তার হাতে দেওয়া হল, তখন বললে—একটা কথা ভাবছি—
—কি বলুন?
—দু’জনে মিলে একটা আপার প্রাইমারি ইস্কুল গড়ে তুলি না কেন? আপনি কি গুরুট্রেনিং পাস?
—না।
দুর্গাপদ চিন্তাকুল ভাবে বললে—তাই তো! গুরুট্রেনিং পাস না থাকলে হেড মাস্টার হতে পারবেন না যে! বাইরে থেকে আবার কাউকে আনলে তাকে ভাগ দিতে হবে কিনা? সে নিজের কোলে সব ঝোল টেনে নেবে। তাতে সুবিধে হবে না—আমার ওখানে আর ভালো লাগচে না। সঙ্গী নেই, দুটো কথা কইবার মানুষ নেই—ব্রাহ্মণ যা আছে, সব অশিক্ষিত, চাষবাসই নিয়ে আছে। সংসার অনিত্য, আমি মশাই আবার একটু ধম্মকথা, একটু সৎ আলোচনা বড্ড পছন্দ করি।
গঙ্গাচরণ মনে মনে বললে—এই রে, খেয়েচে! মুখে বললে—সে তো খুব ভালো কথা।
—আপনি আর আমি সমব্যবসায়ী। তাই আপনার কাছে এত কথা খুলে বললাম। কিছু মনে করবেন না যেন। আচ্ছা আজ উঠি। অনেকদূর যেতে হবে।
—আবার যখন এদিকে আসবেন, দেখা দেবেন দয়া করে।
—সে আর বলতে মশাই? একদিন আমার পরিবারকে নিয়ে এসে আপনাদের বাড়ীতে আলাপ করিয়ে দেবো। আচ্ছা আসি নমস্কার—
গ্রামের বিশ্বাস মশায়ের নাতিটি কাকতালীয় ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলো গঙ্গাচরণের শান্তি-স্বস্ত্ব্যয়নের পরে। এতে গঙ্গাচরণের পসার আরো বেড়ে গেল গ্রামের লোকেদের কাছে। একদিন একজন লোক এসে গঙ্গাচরণকে বললে—আমাদের গাঁয়ে একবার যেতে হচ্ছে পণ্ডিত মশায়—
—এসো, বসো। কোথায় বাড়ী?
—কামদেবপুর, এখান থেকে তিন ক্রোশ। আপনার নাম শুনে আসচি। সবাই বললে, পণ্ডিত মশায় গুণী লোক। আমাদের গাঁয়ের আশেপাশে বড় ওলাউঠোর ব্যায়রাম চলচে। আপনাকে যেয়ে আমাদের গাঁ বন্ধ করতে হবে।
গঙ্গাচরণ ‘গাঁ বন্ধ করা’ কথাটা প্রথম শুনলো। তবুও আন্দাজ করে নিল লোকটা কি চাইচে। তাদের গ্রামে যাতে ওলাউঠার অসুখ না ঢোকে, এজন্যে মন্ত্র পড়ে গ্রামের চারিদিকে গণ্ডি টেনে দিয়ে মহামারীর আগমন বন্ধ করতে হবে, এই ব্যাপার।
কাঁচা লোকের মতো গঙ্গাচরণ তখনই বলে উঠলো না, ‘হ্যাঁ, এখুনি করে দেবো, তাতে আর কি? ইত্যাদি।’ সে গম্ভীরভাবে তামাক টেনে যেতে লাগলো, উত্তরে ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ কিছুই বললে না।
লোকটি উদ্বিগ্নসুরে বললে—ঠাকুর মশায়, হবে তো আমাদের ওপর দয়া?
গঙ্গাচরণ স্থিরভাবে বললে—তাই ভাবচি।
—কেন পণ্ডিতমশায়? এ আপনাকে হাতে নিতেই হবে—
—বড্ড শক্ত কাজ। বড্ড শক্ত—
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। পরে লোকটা পুনরায় আকুলভাবে বললে—তবে কি হবে না?
গঙ্গাচরণ নীরব। দু’মিনিট।
—পণ্ডিত মশায়?
—বাপু হে, অমন বকবক কোরো না। মাথা ধরিয়ে দিলে যে বকে! দাঁড়াও, ভাবতে দাও—
লোকটা ধমক খেয়ে চুপ করে রইল, যদিও সে বুঝতে পারল না এতক্ষণ সে এমন কি বকছিল, যাতে পণ্ডিত মশায়ের মাথা ধরতে পারে। নিজে থেকে সে কোনো কথা বলতে আর সাহস করলে না। গঙ্গাচরণ নিজেই খানিকটা চিন্তার পর বললে—কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ করতে হবে, বড্ড শক্ত কথা। পয়সা খরচ করতে হবে, পারবে?
লোকটা এবার উৎসাহ পেয়ে বললে, আপনি যা বলেন পণ্ডিতমশাই। আমাদের গাঁয়ে আমরা ষাট-সত্তর ঘর বাস করি। হিঁদু-মোছলমানে মিলে চাঁদা তুলে খরচ যোগাবে। প্রাণ নিয়ে কথা, আশপাশের গাঁ মরে উজোড় হয়ে যাচ্চে, যদি পয়সা খরচ কল্লি আমাদের প্রাণগুলো বাঁচে—
—নদীর জল খাও?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের গাঁয়ের নিচেই বাঁওড়—বাঁওড়ের জল খাই।
—গাঁ বন্ধ করলে বাঁওড়ের জল আর খেতে পাবে না কেউ। পাতকুয়োর জল খেতে হবে।
—সে আপনি যেমন আজ্ঞে করবেন—কত খরচ হবে বলুন?
গঙ্গাচরণ বাড়ীর মধ্যে ঢুকে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলে। সংসারের কি কি দরকার? অনঙ্গ-বৌ বেশি আদায় করতে জানে না। স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করে একটা ফর্দ খাড়া করলে, তেমন ব্যয়সাধ্য ফর্দ নয়।
অনঙ্গ-বৌ বললে—আমি পাঠশালায় ছেলেদের ‘স্বাস্থ্য প্রবেশিকা’ বই পড়াই। তাতে লেখা আছে মহামারীর সময় কি কি করা উচিত অনুচিত। আসলে তাতেই গাঁ বন্ধ হবে। মন্ত্র পড়ে গাঁ বন্ধ করতে হবে না।
বাইরে এসে বললে—ফর্দ লিখে নাও—আলোচাল দশ সের, পাকা কলা দশ ছড়া, গাওয়া ঘি আড়াই সের, সন্দেশ আড়াই সের—কাপড় চাই তিনখানা শাড়ী, কস্তাপেড়ে, তিন ভৈরবীর, আর প্রমাণ ধুতিচাদর ভৈরবের—আরও ধরো—হোমের তাম্রকুণ্ড।
লোকটা ফর্দ নিয়ে চলে গেল।
কামদেবপুর গ্রামে যেদিন গঙ্গাচরণ যায়, সেদিনই সেখানে একজন বললে পণ্ডিত মশাই, চাল বড্ড আক্রা হবে, কিছু চাল এ সময়ে কিনে রাখলে ভালো হয়।
—কত আক্রা হবে?
—তা ধরুন মণে দু টাকা চড়া আশ্চয্যি নয়।
কথাটা উপস্থিত কেউই বিশ্বাস করলে না। শান্তিস্বস্ত্ব্যয়ন এবং গাঁ বন্ধ করার প্রক্রিয়া দেখবার জন্য আশপাশ থেকে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। গ্রামের চাষীরা বললে—মণে দুটাকা! তাহ’লি আর ভাবনা ছেল না। কে বলেচে এ সব কথা?
আগেকার বক্তা নিতান্ত বাজে লোক নয়—ধানচালের চালানি কাজ করেচে, এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয়। সে জোর গলায় বললে—তোমরা কিছু বোঝো না হে—আমার মনে হচ্চে গতিক দেখে, চালের দর ঠিক বাড়বে। আমি এ কারবার অনেকদিন ধরে করে আসচি, আমি বুঝতে পারি।
কথাটা কেউ গায়ে মাখলে না। তখন গাঁ বন্ধ করার ব্যাপার নিয়ে সকলে গঙ্গাচরণকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। হোম, শেষ ক’রে পুজো আরম্ভ করতে গঙ্গাচরণ পুরো তিনটি ঘণ্টা কাটিয়ে দিলে। এসব অজ পাড়াগাঁ, এখানকার হালচাল ভালোই× জানা আছে তার। পয়সা কি অমনি অমনি রোজগার হয়? তিনটি মাটির কলসী সিঁদুর দিয়ে চিত্রিত করতে হয়েচে, তালপাতার তীর বানিয়ে চারকোণে পুঁতে পৈতের সুতো দিয়ে সেগুলো পরস্পর বাঁধতে হয়েচে, গাবকাঠের পুতুল তৈরি করতে হয়েচে গ্রাম্য ছুতোর দিয়ে, তেল সিঁদুর লেপে সেটাকে তেমাথা রাস্তায় পুঁততে হয়েচে—হাঙ্গামা কি কম? সে যত বিদঘুটে ফরমাশ করে, গ্রামের লোকের তত শ্রদ্ধা বেড়ে যায় তার ওপরে।
ওর কানে গেল লোকে বলাবলি করচে—বলি, এ কি তুই যা তা পেলি রে? ওঁর পেটে এলেম কত? যাকে বলে পণ্ডিত। এ কি তুই বাগান-গাঁর দীনু ভটচায পেয়েছিস?
গঙ্গাচরণ হেঁকে বললে—নিষ্কালি সরা দু’খানা আর শ্বেত আকন্দের ডাল দুটো—
ঠিক দুপুরবেলা, এখন এ সব জিনিস কোথা থেকে যোগাড় হয়, আর কেই বা আনে! সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো।
একজন বিনীতভাবে বললে—আজ্ঞে, এ গাঁয়ে তো কুমোর নেই, নিষ্কালি সরা এখন কোথায় পাই?
গঙ্গাচরণ রাগের সুরে বললে—তবে থাকলো পড়ে, ফাঁকি-জুকির কাজ আমায় দিয়ে হবে না। গাঁ বন্ধ করতে নিষ্কালি সরা লাগে এ কথা কে না জানে? আগে থেকে যোগাড় ক’রে রেখে দিতে পারো নি?
গ্রামের লোকে নিজেদের অজ্ঞতায় নিজেরাই লজ্জিত হয়ে উঠলো। বলাবলি করলে—এ খাঁটি লোক বাবা। এর কাছে কোনো ফাঁকি নেই। যেভাবে হোক সরা এনে দিতেই হবে।
নানা অপরিচিত অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বেলা দুটোর সময়ে প্রক্রিয়া শেষ হল।
গঙ্গাচরণ বললে—সবাই এসে শান্তিজল নিয়ে যাও—
খুব ঘটা ক’রে শান্তিজল ছিটিয়ে দিয়ে গঙ্গাচরণ গম্ভীর মুখে বললে—এবার আসল কাজটি বাকি—
উপস্থিত সকলে এ ওর মুখের দিকে চায়। সকাল থেকে ফাইফরমাসের চোটে প্রত্যেকে হিমশিম খেয়ে গিয়েচে, শান্তিজল পর্যন্ত ছিটানো হয়ে গেল, তবুও এখনও আসল কাজটি হল না! বেলা তিনটে বাজে এদিকে।
গ্রামের মাতব্বর লোক এক-আধজন এগিয়ে বললে—আজ্ঞে, কি কাজের কথা বলচেন পণ্ডিত মশাই?
—ঈশান কোণে নিমগাছ আছে এ গাঁয়ে?
—আজ্ঞে কোথায় বললেন?
—ঈশান কোণে।
তারা মাথা চুলকে বললে—আজ্ঞে—সে কোথায়?
—ঈশান কোণ জানো না? উত্তর-পশ্চিম কোণ—এই দিক—
আঙুল দিয়ে গঙ্গাচরণ ঈশান কোণ দেখিয়ে দেয়। গ্রামে ঢুকবার পথই সেদিক দিয়ে, আসবার সময় সেদিকে একটা বড় নিমগাছ সে লক্ষ করে এসেচে আজই সকালবেলা।
একজন বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে বটে একটা।
—আছে? থাকতেই হবে। ঈশানে যোগিনী যে—
—আজ্ঞে কি করতে হবে।
—ওখানে ধ্বজা বাঁধতে হবে। চলো আমার সঙ্গে—
দুজন জোয়ান ছোকরা গঙ্গাচরণের আদেশে নিমগাছের মগডালে ধ্বজা বাঁধতে উঠলো। বেলা চারটে বাজে।
গঙ্গাচরণ হাঁপ ফেলে নিশ্চিন্ত হবার ভঙ্গিতে বললে—যাক, এবার ব্যাপারটা মিটে গেল। বাবাঃ, পয়সা খরচ ক’রে ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করলে তোমরা, এর মধ্যে খুঁত থাকতে দেবো কেন? এবার তোমরাও নিশ্চিন্দি, আমিও নিশ্চিন্দি। গাঁ বন্ধ বললেই গাঁ বন্ধ হয়! খাটুনি আছে।
সকলে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে উঠলো। এমন না হলে পণ্ডিত?
গ্রামের সবাই মিলে অনুরোধ ক’রে এক গোয়ালবাড়ীতে নিয়ে গিয়ে গঙ্গাচরণের জলযোগের ব্যবস্থা করলে। গঙ্গাচরণ বললে—ডাবের জল ছাড়া আমি অন্য জল খাবো না। তোমরাও নদীর জল ব্যবহার বন্ধ কর একেবারে। এক মাসকাল নদীর জল কেউ খেতে পাবে না। বাসি বা পচা জিনিস খাবে না। মাছি বসলে সে খাবার তখুনি ফেলে দেবে। মনে থাকবে? সবাইকে বলে দাও—
মাতব্বর লোকেরা সকলকে কথাটা বলে বুঝিয়ে দিলে।
সন্ধ্যার আগে গরুরগাড়ী করে ফিরচে, পথে গ্রাম্য পুরোহিত দীনু ভটচায এসে বললে—নমস্কার, চললেন—
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আমার একটা কথা আছে, গাড়ী থেকে নেমে একটু শুনুন—
গঙ্গাচরণ গাড়ী থেকে নেমে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে দীনু ভটচাযের সঙ্গে কথা বললে। দীনু ওর হাত ধরে বললে—আমার একটা অনুরোধ—
—হ্যাঁ হ্যাঁ—বলুন—
—আমায় কিছু দিয়ে যান আজ যা পেলেন—
—কেন?
—আমি না খেয়ে মরচি। ঘরে এক দানা চাল নেই। চালের দাম হু হু ক’রে বাড়চে। ছিল সাড়ে চার, হল ছ’টাকা। পাঁচ-ছটি পুষ্যি নিয়ে এখন চালাই কি ক’রে বলুন? আমি নিজে এই বুড়ো বয়সে রোজগার না করলে সংসার চলে না। অথচ বুড়ো হয়ে পড়েচি বলে এখন আর কেউ ডাকেও না, চোকি আর তেমন ভালো দেখি নে।
গঙ্গাচরণ চুপ করে থেকে বললে—তাই তো—বড় মুশকিল দেখচি—আপনার বয়স কত?
—ঊনসত্তর যাচ্চে। মেয়েরা বড়, ছেলে বড় হলে ভালো ছিল। এ বুড়ো বয়সে রোজগার করার কেউ নেই আমি ছাড়া।
—চালের দাম কত চড়েচে?
—আরও নাকি চড়বে শুনচি। এখনই খেতে পাচ্চি নে—আরও বাড়লে কি কিনে খেতে পারবো! এই যুদ্ধুর দরুণ নাকি অমনটা হচ্চে—
গঙ্গাচরণ মাঝে-মিশালে শোনে বটে যুদ্ধের কথা। মাঝে মাঝে দু-একখানা এরোপ্লেন মাথার ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেচে। তবে এ অজ চাষাগাঁয়ে কেউ খবরের কাগজ নেয় না, শহরও সাত-আট মাইল দূরে। গঙ্গাচরণ নিজের ধান্দায় ব্যস্ত থাকে। ওসব চর্চা করবার সময়ও তার নেই। তবু কথাটা তাকে ভাবিয়ে তুললে। সে বুড়ো ভটচাযকে বললে—যা চাল পেয়েছি, তা থেকে কিছু আপনি নিয়ে যান—আর কিছু ডাল আর গাওয়া ঘি—
দীনু ভটচায বললে—না, গাওয়া ঘি আমার দরকার নেই। বলে ভাত জোটে না, গাওয়া ঘি! আচ্ছা, আমি এই কাপড়ের মুড়োতেই চাল ডাল বেঁধে নিই। আপনি আমায় বাঁচালেন। ভগবান আপনার ভালো করুন।
কথাটা ভাবতে ভাবতে গঙ্গাচরণ বাড়ী এসে পৌঁছুল। অনঙ্গ-বৌ জিনিসপত্র দেখে খুব খুশি। বললে—চাল এত কম কেন?
—এক বুড়ো বামুন ভটচায্যিকে কিছু দিয়ে এসেছি পথে।
—যাক গে, ভালোই করেচ। দিলে তাতে কমে না, বরং বেড়ে যায়।
—শুনচি নাকি চালের দাম বাড়বে, সবাই বলচে।
—ছ’টাকা থেকে আরও বাড়বে? বল কি গো?
—সবাই তো বলচে। যুদ্ধুর দরুণ নাকি এমন হচ্ছে—
—কার সঙ্গে যুদ্ধু বেধেচে গো?
—সে সব তুমি বুঝতে পারবে না। আমাদের রাজার সঙ্গে জার্মানি আর জাপানের—সব জিনিস নাকি আক্রা হয়ে উঠবে।
—হোক গে, আমাদের তো অর্ধেক জিনিস কিনে খেতে হয় না। তবে চালটা যদি বেড়ে যায়—
—সেই কথাই তো ভাবচি—
সেদিন বিকেলে বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী বসে এই সব কথার আলোচনা হচ্ছিল। বিশ্বাস মশায় বললেন—আমাদের ভাবনা কি? ঘরে আমার দু’গোলা ধান বোঝাই। দেখা যাবে এর পরে।
বৃদ্ধ নবদ্বীপ ঘোষাল বললে—এ সব হ্যাঙ্গামা কতদিনে মিটবে ঠাকুর মশাই? শুনচি নাকি কি একটা পুর জারমান নিয়ে নিয়েছে?
বিশ্বাস মশায় বললে—সিঙ্গাপুর—
নবদ্বীপ বললে—সে কোনো জেলা? আমাদের এই যশোর, না খুলনে? মামুদপুরের কাছে?
বিশ্বাস মশায় হেসে বললেন—যশোরও না, খুলনেও না। সে হল সমুদ্দুরের ধারে। বোধ হয় পুরীর কাছে, মেদিনীপুর জেলা। তাই না পণ্ডিত মশাই?
গঙ্গাচরণ ভালো জানে না, কিন্তু এদের সামনে অজ্ঞতাটা দেখানো যুক্তিযুক্ত নয়। সুতরাং সে বললে—হ্যাঁ। একটু দূরে—পশ্চিম দিকে। ঠিক কাছে নয়।
নবদ্বীপ বললে—পুরীর কাছে? আমার মা একবার পুরী গিয়েছিলেন। পুরী, সাক্ষীগোপাল, ভুবনেশ্বর। সে বুঝি মেদিনীপুর জেলা?
বিশ্বাস মশায় বললেন—হ্যাঁ।
ভৌগোলিক আলোচনা শেষ হলে যে যার বাড়ীর দিকে চলে গেল।
গঙ্গাচরণ পাঠশালায় বসে পরদিন ছেলেদের জিজ্ঞেস করলে—এই সিঙ্গাপুর কোথায় জানিস?
কেউ বলতে পারলে না, কেউ নামই শোনে নি।
গঙ্গাচরণ নিজের ছেলের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বললে—হাবু, সিঙ্গাপুর কোথায়?
হাবু দাঁড়িয়ে উঠে সগর্বে বললে—পুরীর কাছে, মেদিনীপুর জেলায়।
পাঠশালার অন্যান্য ছেলেরা ঈর্ষামিশ্রিত প্রশংসার দৃষ্টিতে হাবুর দিকে চেয়ে রইল।