Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এরপর দিনকতক কেটে গেল। গঙ্গাচরণের বাড়ীতে দুর্গা ভটচাযের পরিবারবর্গ পাকাপোক্তভাবে বসেচে। অনঙ্গ-বৌ নিজে খেতে না পেয়ে চিঁ চিঁ করচে, অথচ সে কাউকে বাড়ী থেকে তাড়াবে না। ফলে সবাই মিলে উপোস করচে।

এর মধ্যে ময়না বড় ভালো মেয়ে, গঙ্গাচরণ ক্রমে লক্ষ করলে। কোনো খাবার জিনিস যোগাড় হলে ময়না আগে নিয়ে আসে অনঙ্গ-বৌকে খাওয়াতে। বলে—ও কাকীমা, এটুকু খেয়ে নাও তো!

ময়নার মা আবার বড় কড়া সমালোচক। সে বলে—যা, ও তোর কাকীমাকে দিতে হবে না। ওর শরীর খারাপ, ও তোমার ওই ময়দার গোলা এখন খেতে বসুক! যা, ও নিয়ে যা—

দুর্গা ভটচায কোথায় সকালে উঠে চলে যায়। অনেক বেলা করে বাড়ী ফেরে। কিছু না কিছু খাবার জিনিস প্রায়ই আনে। চাল আনতে পারে না বটে, কিন্তু আনে হয়তো একটা নারকেল, একটা মানকচু, দুটো বিরি কলাই, নিদেন দুটো বড়ি।

এসব আনে সে ভিক্ষে করে।

আজকাল দুর্গা ভিক্ষে করতে শুরু করেছে।

তবে তার ভিক্ষেটা ঠিক আর পাঁচজন ভিক্ষুকের মত নয়, ওরই মধ্যে একটু কায়দা আছে। সেদিন দুপুরে দুর্গা গিয়ে হাজির এ গ্রামেরই কাপালীপাড়ায়। নিধু কাপালীর বাড়ীর দাওয়ায় উঠে বললে—একটু তামাক খাওয়াতে পার?

নিধু কাপালী ব্রাহ্মণ দেখে শশব্যস্ত হয়ে বললে—আসুন, বসুন, ঠাকুরের কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

—আমার বাড়ী কামদেবপুর, আমি আছি এই গঙ্গাচরণবাবুর বাড়ী।

—আপনার কেউ হন? জামাই নাকি?

—না না, আমার স্বজাতি ব্রাহ্মণ। এমনি এসে আছি ওঁর ওখানে।

—আপনার কি করা হয়?

—কিছুই না। বাড়ীতে জমিজমা আছে। দুটো গোলা ছিল ধানভর্তি, তা শোনলাম ধান রাখতে দেবে না গভর্নমেণ্টের লোক। বিশ মণ ধানের বেশি নাকি রাখতে দেবে না—সব বিক্রি করে ফেললাম!

বলা বাহুল্য এসব কথা সর্বৈব মিথ্যা।

নিধুর কিন্তু খুব শ্রদ্ধা হয়ে যায়, দু’গোলা ধানের মালিক যে ছিল এ বাজারে, সে সাধারণ লোক নয়, হতেই পারে না। আঠার টাকা করে ধানের মণ। দু’গোলায় অন্তত সাত-আট শো মণ ধান ছিল। মোটা টাকা রয়েছে ওর হাতে।

দুর্গা তামাক টানতে টানতে বলে—বাপু হে, ঘরে চিঁড়ে আছে, দুটো দিতে পার? এ গাঁয়ে তোমাদের দেখছি খাদ্যখাদকের বড় অভাব।

—আজ্ঞে, এখানে খাদ্যখাদক মেলেই না—চিঁড়ে ঘরে নেই ঠাকুরমশায়। বড় লজ্জায় ফেললেন—

—না না, লজ্জা কি? তোমাদের এ গ্রামে বাপু এই রকমই কাণ্ড—খাদ্য-খাদক কিছু মেলে না। কদিন থেকে ভাবছি দুটো চিঁড়েভাজা খাব। তা এ যোগাড় করতেই পারলাম না—অথচ আমার গোলায় এক পৌটি দেড় পৌটি ধান ছিল এই সেদিন।

নিধু কাপালী কাঁচুমাচু হয়ে গেল। এত বড় লোকের সামনে কি লজ্জাতেই সে পড়ে গেল।

দুর্গা বললে—যাক গে। আমসত্ব আছে ঘরে?

—আজ্ঞে না, তাও নেই। ছেলেপিলেরা সব খেয়ে ফেলে দিয়েচে।

—পুরনো তেঁতুল?

—আজ্ঞে না।

—বড় অরুচি হয়ে গেছে মুখে কিনা। তাই দুটো চিঁড়েভাজা, পুরনো তেঁতুল একটু এই সব মুখে—বুঝলে না? আরে মশায়, লড়াই বেধেচে বলে মুখ তো মানবে না? এই চালকুমড়ো তোমার?

সামনে গোলার ওপরে চালকুমড়ো লতার বড় বড় চালকুমড়ো সাদা হয়ে গিয়েচে পেকে। সারি সারি অনেকগুলো আড় হয়ে আছে গোলার চালে। নিধু কাপালী বিনীতভাবে বললে—আজ্ঞে, আমারই।

—দাও একখানা ভালো দেখে। বড়ি দিতে হবে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এখুনি—

নিধু হাঁ হাঁ করে ছুটে গেল এবং একটা বড় পাকা চালকুমড়ো পেড়ে নিয়ে এল গোলার চাল থেকে। দুর্গা ভটচায সেটি হাতে ঝুলিয়ে গঙ্গাচরণের বাড়ীর দিকে রওনা হল হৃষ্টমনে।

অন।-বৌ বললে—ওটা কি হবে জ্যাঠামশাই?

—নিয়ে এলাম মা, আনলেই কাজ দেয়। খাবার জিনিস তো? বড়ি দিও।

—কলাই খেয়ে প্রাণ বেঁচে আছে, বড়ি আর কি দিয়ে দেবো জ্যাঠামশাই?

—আচ্ছা রও, কলাইয়ের ব্যবস্থা করে ফেলচি কাল থেকে।

—না জ্যাঠামশাই, আপনি আমাদের বাড়ী এসেচেন, আর বেরুতে হবে না লোকের বাড়ী চাইতে। যা জোটে তাই খাবো।

—কি জান মা, ব্রাহ্মণের উপজীবিকা হল ভিক্ষা। এতে লজ্জা নেই কিছু। আমার নেই, আমি ভিক্ষা করবো। লড়াই বেধেচে বলে পেট মানবে?

—না জ্যাঠামশাই, আপনার পায়ে পড়ি ওতে দরকার নেই।

—আচ্ছা, তুমি চুপ করে থাক। সে ব্যবস্থা হবে।

দুর্গা ভটচায গঙ্গাচরণকে সন্ধ্যাবেলা বললে—একটা পরামর্শ করি। চাষাগাঁয়ে জ্যোতিষীর ব্যবসা বেশ চলে। কাল থেকে বেরুবেন? ওদেরই হাতে আজকাল পয়সা।

—সে গুড়ে বালি। আগে চলত, এখন আর চলবে না। চাল ডাল কেউ দিতে পারবে না। পয়সা হয়ত দেবে কিন্তু চাল দেবে কে? কিনবেন কোথায়?

—ধান যদি দ্যায়?

—কোথাও নেই এদেশে। সে যার আছে, নুকিয়ে রেখেচে, বের করলে পুলিসের হাঙ্গামা। ভয়ে গাপ করে ফেলচে সব। চাষা-গাঁয়ের হালচাল আমাকে শেখাতে হবে না।

—তাহলেও কাল দুজনে বেরুই চলুন। নয়ত না খেয়ে মরতে হবে সপরিবারে।

—যার জমি নেই এ বাজারে, তাকে উপোস করতেই হবে। জমি না চষে পরের খাবে, এ আর চলবে না। চাষা লাঙ্গল ধরে চাষ করে, আমরা তার ওপর বসে খাই, এ ব্যবস্থা ছিল বলেই আজ আমাদের এ দুর্দশা।

গঙ্গাচরণ একটু দম নিয়ে আবার বললে—নাঃ, ও জ্যোতিষ-টোতিষ নয়, এবার যদি নিজের হাতে লাঙ্গল ধরে চাষ করতে হয় তাও করব—একটু জমি পেলে হয়।

দুর্গা হেসে বললে—জমির অভাব নেই এদেশে। নীলকুঠির আমল থেকে বিস্তর জমি পড়ে। আমারই বাড়ীর আশেপাশে দু’বিঘে জমি জঙ্গল হয়ে পড়ে রয়েচে। আমার ভিটেজমির সামিল সে জমি।

—আপনি করেন না কেন?

—কি করবো তাতে?

—যা হয়, রাঙা আলু করলেও পারতেন। তাই খেয়েও দু’মাস কাটত। আমাদের ভদ্রলোকদের কতকগুলো মস্ত দোষ আছে। পরের পরিশ্রমে আমরা খাব। আপনি আমি এমন কিছু দুশো টাকার চাকরি করিনে, অথচ জমি করব না! এবার টের পাচ্ছে মজা।

দুর্গা ভটচায ওসব বোঝে না। সকলেই চাষ করবে নাকি? মজার কথা! ও হল বৈশ্যের কাজ, ব্রাহ্মণ বৈশ্যের কাজ করবে? তা কালে কালে তাও হবে! তিনি শুনেচেন শহরে নাকি কোনো বামুনের ছেলে জুতোর দোকান করেচে—জুতোর দোকান, ভেবে দ্যাখ। ব্রাহ্মণের আর কি হতে বাকি রইল?

কাপালীদের বড়-বৌ এসে অনঙ্গ-বৌকে ফিস ফিস করে বললে—কাল থেকে ছোটবৌকে পাওয়া যাচ্ছে না।

অনঙ্গ-বৌ বললে—সে কি কথা?

—তারে তো জান বামুন-দিদি! ক্যামন স্বভাব ছেল তার! ইটখোলার সেই এক ব্যাটার সঙ্গে—তুমি সতীনক্ষি, সেসব তোমার সঙ্গে বলব না। এখন কাল বিকেল থেকে আর বাড়ীতে দেখছি নে। ঘরের বৌ গেল কোথায়? জাত যে যায় এখন!

—যাক, কারো কাছে বলো না।

—কার কাছে আর বলতে যাচ্ছি দিদি? বলে কাটা কান চুল দে ঢাকো, তবুও তো লোকে জিজ্ঞেস করবে কোথায় গেল? সদু জেলেনী এখুনি ঢোকবে এখন বাড়ীতে। সে রটাবে এখন সারা গাঁয়ে। কি দায়েই আমি পড়িচি।

দু’দিনের মধ্যে ছোট-বৌয়ের টিকি দেখা গেল না। খোঁজাখুঁজি যথেষ্ট করা হয়েচে। কালীচরণ নিজেও আশেপাশের গ্রামে সন্ধান করেচে।

অনঙ্গ-বৌ রাত্রে বলে—কি হল?

গঙ্গাচরণ হেসে বললে—কি আর হবে? সে পালিয়েচে সেই যদু-পোড়ার সঙ্গে—সেই ঠিকেদার ব্যাটা, ভয়ানক ধড়িবাজ।

—ওমা সে কি সব্বোনাশ! হ্যাঁগো কি হবে ওর? ছুটকির?

—ওকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে শখ মিটে গেলে। তখন নাম লেখাতে হবে শহরে গিয়ে, নয়ত ভিক্ষে করতে হবে।

চতুর্থ দিন অনেক রাত্রে কে এসে ডাকলে ঘরের বাইরে থেকে—

—ও বামুন-দিদি—

ময়না জেগে উঠে বললে—কে ডাকচে বাইরে, ও দিদি বলে—

সে উঠে দোর খুলে দিতে ছোট-বৌ ঘরে ঢুকল। পরনে নতুন কোরা লালপেড়ে শাড়ী, গায়ে সাদা ব্লাউজ, হাতে নতুন কাঁচের চুড়ি।

অনঙ্গ-বৌ বিস্ময়ের ও আনন্দের সুরে বললে—কি রে ছোট-বৌ?

ছোট-বৌ মেঝের ওপর বসে পড়ল। একটুখানি চুপ করে থেকে ফিক করে হেসে ফেলল। ময়নার মাও ততক্ষণ উঠেচে। ছোট-বৌয়ের কাণ্ড সব শুনেছে এ ক’দিনে। ময়নার মা ছিল কামদেবপুর গাঁয়ের মধ্যে সকলের চেয়ে নিরীহ মেয়েমানুষ। কখনো কারো কথায় থাকে না, গরীব ঘরের বৌ—দুঃখ-ধান্দার মধ্যে চিরকাল ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করে এসেচে। সে শুধু চুপ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। এমন অবস্থায় আবার লোকের মুখে হাসি বেরোয়? ময়নার মা এই কথাই ভাবছিল।

অনঙ্গ-বৌ রাগের সুরে বললে—হাসি কিসের?

ছোট-বৌ মুখ চুন করে বললে—এমনি।

—ও পুঁটলি কিসের।

—ওতে চাল। তোমার জন্যি এনিচি।

—ঝাঁটা মারি তোর চালের মাথায়। নিয়ে যা এখান থেকে। আমি কি করবো তোর চাল?

—রাগ কোরো না বামুন-দিদি, পায়ে পড়ি! তুমি রাগ কল্লি আমি কনে যাব?

এবার ছোট-বৌয়ের চোখ দুটো যেন জলে ভরে এল। সত্যিকার চোখের জল।

অনঙ্গ-বৌয়ের মনটা নরম হল। খানিকটা স্নেহের সুরে বললে—বদমাইশ কোথাকার! ধাড়ি মেয়ে, তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই, কি কাজ করতে কি কাজ করে বসো তোমার জ্ঞান হয় না? আজ বাদে কাল কোথায় গিয়ে জবাবদিহি করতে হবে সে খেয়াল হয় না তোমার? সতের ঝাঁটা মারি তোমার মাথায় তবে যদি এ রাগ যায়।

অজ্ঞান পাপীকে ভগবানও বোধ হয় এমনি সস্নেহে অনুযোগের সুরে তিরস্কার করেন। ছোট-বৌ মুখ চুন করে মাটির দিকে চেয়ে বসে রইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress