খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর
Man’s like the earth, his hair like grasse is grown
His veins the rivers are, his heart the stone! .
…খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পরই পিছু ফিরে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ পৃথিবীর ঘৃণ্যতম পদার্থগুলোর অন্তর্ভুক্ত বলে জানতাম এই লোকটিকে। আর বারু চৌধুরির মুখে শুনতে-শুনতে মুখস্থ হয়ে-যাওয়া ওই সতেরো-শতকী ইংরেজি পদ্যটি প্রতিধ্বনিত হত তাঁর কথা মনে এলেই। স্বীকার করতে বাধ্য, কোনও এক প্রস্তরীভূত মুহূর্তকে এই পদবন্ধ বুঝি ছুঁয়ে আছে, কিংবা ধরা আছে এর মধ্যে আমার মতোই মানুষের চেরাগলার আর্তনাদ, যা শুনে কাল মধ্যরাতের রোগা শাস্ত্রীটি তার লম্বা নাক সেলের গরাদের ফাঁকে ঢুকিয়ে কুতকুতে চোখের মমতা দিয়ে আমাকে দেখছিল!
খানবাহাদুর চলে গেলে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে আব্বার আরবি শ্লোকপাঠের মতো পদ্যটি মনে-মনে আওড়ানোর পরই একটি ‘মোজেজা’ ঘটল। হঠাৎ দেখলাম, নিরেট স্তব্ধ ফ্যাকাশে দেয়াল কুয়াশার মতো নীলচে হতে-হতে অবিশ্বাস্য রোদের তীব্রতায় মিলিয়ে গেল। ভেসে উঠল হলুদ কল্কেফুলের জঙ্গল, নবারি মসজিদের গম্বুজ, হরিণমারা প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলের সামনেকার ত্রিকোণ শীর্ষভাগ, যাকে হেডমাস্টার বিষ্ণুচরণ রায়-স্যার বলতেন ইতালীয় স্থাপত্যের অনুকরণ—’তুমি হাজারদুয়ারি প্যালেস যদি দেখো থাকো লালবাগ শহরে, দেখবে নবাববাহাদুর হুমায়ুন জাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি।’ আসলে আমি তখন ষোলো বছর বয়সের সেই শরীরকে দেখতে পাচ্ছি। আমার সেই মায়া-শরীরকে দেখে বুঝতে পারছি, তার দণ্ডিত ভবিষ্যৎ, তার জঘন্যতম কীর্তিকলাপ, হত্যাকাণ্ড, তার নারীকে ভালোবাসার এবং অবাধ রমণে লিপ্ত হওয়ার সেই সময়টিকে, তার রাজনৈতিক বিদ্রোহ, তার ধর্মকে লাথি-মারা নাস্তিক্য– সবকিছুই ওই পরাবাস্তবতাময় কুয়াশার মধ্যে মুছে গেছে। ঘণ্টা বাজছে। স্কুলের ছুটির ঘণ্টা। ঘণ্টা বাজছে। দেওয়ান বারু চৌধুরির হাতির গলার ঘন্টা। ন্যাংটো, আধন্যাংটো ছেলেপুলে আর তাদের গতরজীবী বাবা-মায়েরা ভিড় করে চলেছে হাতির পেছনে। তারা সুর ধরে ছড়া গাইছে; ‘হাতি তোর গোদা গোদা পা/হাতি তুই নেদে দিয়ে যা। আর আমার অবোধ গ্রামীণ সারল্যভরা ষোলো বছর বয়সের হৃদয়টুকু নতুন এক আবেগে মুহুর্মুহু শিউরে উঠছে। তারপর হাতিটি হাঁটু ভাঁজ করে বসল আর বারুমিয়াঁ দেওয়ান মিটিমিটি হেসে বললেন, আয় শফি! দুরুদুরু বুকে আমি হাতির হাওদায় উঠলে বারুমিয়াঁ আমাকে সামনে বসিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। হাতির মাহুত কী সব আওয়াজ দিতে থাকল। আর বিশাল কালো জটি উঠে দাঁড়াল। পৃথিবী দুলতে লাগল। আমার চোখে সেই দুলন্ত পৃথিবী, ইতালীয় স্থাপত্যের অনুকরণ, ভিড়, হইহল্লা, নবারি মসজিদের গম্বুজ, জমিদার বিজয়েন্দ্রনারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ– যাকে ক্লাসে সবাই হাবুল বলে ডাকত, তার দুচোখের তাচ্ছিল্য পর্যন্ত দুলছিল, কাঁপছিল, দূরে সরে যাচ্ছিল। আর বারুচাচাজি যখন জিগ্যেস করলেন, তোের কি ভয় করছে শফি, আমি জোর গলায়। বললাম, না। তখন বারুচাচাজি বললেন, ভয় পাস নে। এ হাতি সেই হাতি নয়। হরিণমারা গ্রাম ক্ৰমে পিছনে চালচিত্র হতে-হতে ঘন নীল-ধূসর পোঁচে পরিণত হলে একবার জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন চাচাজি? বারু চৌধুরি বললেন, নেচারের ভেতর।।
বারুচাচাজি হাসছিলেন। শফি, এটা কী দেখতে পাচ্ছিস? বলে হাওদার পাশ থেকে যে লম্বাটে জিনিসটা বের করলেন, শিউরে উঠে দেখলাম সেটা একটা বন্দুক। সঙ্গে-সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, বারুচাচাজির পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে ছাইরঙা হাফ শার্ট, মাথায় শোলার টুপি। অমনি আমার গা ছমছম করল। মনে পড়ছিল, নবাবগঞ্জে থাকার সময় ঠিক এই পোশাকপরা একটি লোককে দেখে গ্রামের সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে মাঠে-বনে-বাদাড়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল। ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিদেব কী ভয় না করত লোকেরা!
বন্দুকের নলে আঙুল ছোঁয়াতেই টের পেলাম অসাধারণ ঠাণ্ডাহিম, যদিও সেটা শীতঋতু নয়। তারপর বললাম, আপনি কেন এ পোশাক পরেছেন চাচাজি?
বারুমিয়াঁ একটু হেসে বললেন, উলুশরার মাঠে বাঘ আছে শুনেছি। তবে বাঘের চেয়ে সাংঘাতিক জানোয়ার কী জানিস? মানুষ!
অবাক হয়ে বললাম, কেন?
আসলে তখনও মানুষ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। বদুপিরের সন্তান হিসেবে যত মানুষ দেখেছি, তারা বিনত, নম্র, মৃদুভাষী। তারা হিন্দু হলে কপালে হাত ঠেকিয়ে ‘আদাব’ বলেছে, মুসলিম হলে ‘সালাম’ অথবা ‘আসোলামু আলাইকুম’ সম্ভাষণ করেছে। আমি লালপাগড়ি মাথায়, খাকিপোশাক পরা পুলিশ দেখেছি, দারোগা দেখেছি। তারা লোকের কাছে যত ভয়াবহ হোক, আমি তাদের কখনও ভয় পাইনি। কারণ তারা কেউ-কেউ আব্বাকে সম্মান জানিয়েছে এবং তাঁর দোয়া-ফোঁকা জলও পান করেছে। এইসব কারণেই আমি বারুচাচাজির কথায় চমকে উঠেছিলাম। আর জবাবে বারুচাচাজি আস্তে আস্তে বললেন, আমি নবাববাহাদুরের। দেওয়ান জানিস তো? মহলে-মহলে গিয়ে নায়েবদের খাজনার তহবিল জমা নিই। এই হাওদার তলায় সেইসব টাকাকড়ি আছে। তাই কয়েকবার ডাকাতরা হামলা করেছিল।
হ্যাঁ, ডাকাতরা সাংঘাতিক মানুষ আমি জানতাম। তাই চুপ করে থাকলাম। এই সুবিশাল কালো জানোয়ার আর এই ঠাণ্ডাহিম বন্দুকের নল ডাকাতদের বিরুদ্ধে : যথেষ্ট ভেবে ও নিয়ে মাথা ঘামালাম না। কিন্তু এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, হাতির সামনে চলেছে জোব্বা ধরনের পোশাকপরা, কোমরে একটা চওড়া বেল্টআঁটা, মাথায় পাগড়িবাঁধা একটা লোক। লোকটার কাঁধে একটা বল্লম। তার প্রকাণ্ড গোঁফ আর গালপাট্টা। তাকে দেখিয়ে জিগেস করলাম, ও কে চাচাজি?
‘সাতমার’। বারুচাচাজি বললেন, ওদের সাতমার বলে। ওর নাম কী জানিস, কাল্লু পাঠান। ওকে আমি উল্লু পাঠান বলি। বারুচাচাজি হাসতে লাগলেন। লালবাগের পিলখানায় ওর ডেরা। লোকটা যেমন বোকা, তেমনি বদমায়েশ। ওর বিবি হল তিনটে। ছোটোবিবির বয়স মোটে বারো।
বারুচাচাজি এত জোরে হেসে উঠলেন যে সাতমার কাল্লু পাঠান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, হূজৌর?
কুছ নেহি! তুম আপন কদম বাঢ়াও।
বললাম, ও বাঙলায় কথা বলতে পারে না?
জবাবটা দিল কাল্লু পাঠানই। বুঝলাম তার কান তীক্ষ্ণ। সে সহাস্যে বলল, কুছু-কুছু পারে হজৌর!
ঢালু হয়ে ধাপে-ধাপে নেমে গেছে উত্তর-পশ্চিম রাঢ়ের বিস্তীর্ণ মাঠ। একটা সংকীর্ণ রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম নীল-ধূসর সেই উলুকাশের বন। একদিন যার মধ্যিখান দিয়ে আমরা মৌলাহাটে এসে পৌঁছেছিলাম। আমার ইচ্ছে করছিল, বারুচাচাজিকে সেই কালোজিন-শাদাজিনের গল্পটা বলি। কিন্তু সেই মুহূর্তে উনি মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, তুমি জিগ্যেস করছ না শফি, হঠাৎ আমি কোথা থেকে এসে তোমাকে কেন আচমকা তুলে নিলাম!
ওঁর দিকে ঘোরার চেষ্টা করে বললাম, হাতির পিঠে বসে থাকতে ভালো লাগছে না! এত দুলছে!
আমাদের দুজনের প্রশ্নোত্তর সেদিন এমনি অসংলগ্ন ছিল যেন। কিংবা আমরা পরস্পর ঠিক প্রশ্নের ঠিক উত্তরই দিচ্ছিলাম– বুঝি না। বারুচাচাজি বললেন, হুঁ। তুমি কি শুনেছ তোমার বড়ো ভাই বাড়ি এসেছে?
চাচাজি, ফেরার সময় মৌলাহাট হয়ে এলে–
শফি, তোমার–মানে তোমাদের দুভাইয়ের, নুরুজ্জামান আর শফিউজ্জামানের শাদির ইন্তেজাম হয়েছে, জানো?
চাচাজি, বড়ো ভাই মুখে লম্বা-লম্বা দাড়ি রেখেছে নিশ্চয়?
শফি, হেসো না। বারু চৌধুরির কণ্ঠস্বর ক্রমশ ভরাট হয়ে উঠেছিল। আমি দরিয়াবানুকে খুব বোঝালাম। ওকে তো জানো, বড় গোধরা মেয়ে। তোমার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে রোজির আর তোমার সঙ্গে রুকুর শাদির কথা পাকা হয়ে গেছে। আগামী সাতুই অঘ্রাণ শুক্রবার তোমাদের শাদি।…।
হাতি একটা সংকীর্ণ সোতা পেরুচ্ছিল। সাতমার কাল্লু পাঠান জোব্বা গুটিয়ে পায়ের নাগরাজুতো খুলে হাস্যকর ভঙ্গিতে জল পেরুচ্ছিল। ওপারে কয়েকটুকরো ধানখেতের ভেতর হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে থাকা দুটি লোক মাথা কাত করে হাতি দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিল। একঝাঁক বুনো হাঁস সোঁতার জল থেকে শনশন করে উড়ে ফুলন্ত কাশবনের ওপর দিকে ঘননীল আকাশে মিশে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কোথায় ডাকছিল একলা কোনও হট্টিটি পাখি ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি। আর আমি দেখছিলাম এইসব নানারঙের নানা ঘটনার টানাপোড়েনে গাঁথা বারু চৌধুরির ‘নেচার’কে কেউ বা কিছু এক অগাধ বিষাদে আচ্ছন্ন করে আছে। কুয়াশার মতো বিস্তৃত সেই বিষাদ, হরিণমারার জমিদারবাড়ির চত্বরে শোনা বেহুলা লখিন্দর যাত্রাপালার আসরে চারুমাস্টারের বেহালার বাজনার মতো গম্ভীর-করুণ এক সুর। ওই ধারাবাহিক ট্টি ডি ডি…টি টি ট্রি হট্টিটি পাখির ডাকে কি নীল আকাশজোড়া শূন্যতারই কণ্ঠস্বর? যেকারণে কাল্লু পাঠানের সোঁতাপেরুন এবং দুই আধন্যাংটো চাষার ভঙ্গিও আমাকে শেষ পর্যন্ত হাসাতে ব্যর্থ হল?
আর বারুচাচাজি কথা বলছিলেন ষড়যন্ত্রসংকুল কণ্ঠস্বরে….এ হতে পারে না শফি! তোমাকে লেখাপড়া শিখতে হবে। হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে মুসলমানকে। তুমি নিশ্চয়ই স্যার সৈয়দ আহমদের কথা পাঠ্য বইতে পড়েছ। দেওবন্দ যেখানে তৈরি করছে ছদ্মবেশী ভিখিরির দল, সেখানে আলিগড় তৈরি করছে নয়া জামানার প্রতিনিধিদের। কেন ছদ্মবেশী ভিখিরি বলছি, বুঝতে পারছিস তো শফি? তুই মৌলানাবাড়ির ছেলে। তুই বুদ্ধিমান। তোর বোঝা উচিত, এভাবে অন্যের দান হাত পেতে নিয়ে বেঁচে থাকাটা মনুষ্যত্বের অবমাননা। নুরুজ্জামানকে আমি বুঝিয়েছি। তাকে বলেছি, এটা ইসলামের প্রকৃত পন্থা নয়। নুরুজ্জামান মহা তর্কবাগীশ হয়ে ফিরেছে। কথায়-কথায় সে কোরানহাদিশ কোট করে। কিন্তু এটুকু বোঝ না, মুরিদ(শিষ্য)দের ওটা ভক্তি নয়, আসলে দয়া। শফি, তোর আব্বাও এটা হয়তো টের পান। তাই তোকে ইংরেজি স্কুলে পড়তে দিয়েছেন। তোর আব্বার মধ্যে বড্ড বেশি পরস্পর-বিরোধিতা। তিনিই বলেন, হিন্দুস্থান মুসলমানের দারুল হারাব’, আবার তিনিই পয়গম্বরের কথা আওড়ান; উতলুবুলইমা আলাওকানা বি সিন’। এলেম বা শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন মুলুকে যেতে হলেও চলে যাও। না শফি, নুরুজ্জামানকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তোকে আমি আবিষ্কার করেছি –তোকে আমি হারাতে চাই না। তোকে আমি নিয়ে পালিয়ে যাব লালবাগ শহরে। নবাববাহাদুরকে বলে তোকে ওঁদের ‘নবাববাহাদুর ইনসটিটিউশনে ভরতি করে দেব। ওটা ওঁদের পারিবারিক স্কুল। বাইরের ছাত্রদের নেওয়া হয় না। তবু আমি ওঁকে রাজি করাব। শফি, তুই এখনও নাবালক। শাদি দিলে তোর লেখাপড়া কিছুতেই হবে না, বাবা!
কাশবনের ভেতর থেকে দুটো শামুকখোল উড়ে গিয়ে একলা-দাঁড়ানো একটা নিষ্পত্ৰ গাছের ডালে বসলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, চাচাজি! শামুকখোল মারবেন না বন্দুকে?….
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি কেন সেদিন আমাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে উলুশরার জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃতি বিলাসী মানুষটি প্রকৃতির ভেতরে গিয়ে আমাকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন গোপনে। কারণ তিনিই জানতেন, প্রকৃতিই মানুষকে প্রকৃত গোপনীয়তা দিতে পারে।
কিন্তু রুকু– দিলরুখ, তাকে ওই ষোলবছর বয়সের কী দুর্দান্ত ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তা তো বারুমিয়াঁ জানতেন না। আমিও প্রথম-প্রথম জানতাম কি? হরিণমারার কাজি হাসমত আলির বাড়িতে থেকে প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলে পড়ছি। তাঁর দহলিজঘরে আমার আস্তানা। তক্তপোশে বিছানা পাতা। তাকে বই। দেয়ালে মক্কা-মদিনাব ছবি সাঁটা। আব যে-স্বর্গীয় বাহন পয়গম্ববকে সাত আসমানের পবে আল্লাব সামনে পৌঁছে দিয়েছিল, তাবও একটি ছবি ছিল। বাহনটির নাম বোববাখ। তাব মুখ সুন্দরী নাবীব, শবীব পক্ষিবাজ ঘোডাব। তার চুলগুলো ছিল এলিয়ে পড়া। আমি তার মুখে বুকুকে দেখতাম। দিনের পর দিন দেখতে-দেখতে ওই মুখ বুকুব মুখ হয়ে উঠেছিল। আমার বুক ঠেলে আবেগ আসত। মনে হত, কেঁদে ফেলি। বুকুকে দেখার জন্য অস্থির হতাম। ছটফট কবতাম। তাকে স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম সে আমার সঙ্গে কথা বলছে না। বাগে-দুঃখে আমার ইচ্ছে কবত তাকে প্রচণ্ডভাবে মাবি। আব একবাতে দেখলাম, তাকে কবরে শোযানো হচ্ছে। কে যেন বলছে, শফি, তুমি ওকে শেষ দেখা দেখে নাও, এবং সে করবে শোযানো শাদা কাফনপবা বুকুব মুখে কাপড় সবিয়ে দিলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার পাশে শুত হাসমত সাহবেব ছেলে আমার সহপাঠী রবিউদ্দিন–রবি যাব ডাকনাম। সে বলত, তোমাব পেছনে জিন লেগেছে শফি। বোজ বাতে তুমি খোব দেখে গোঙ্গাও। তোমাৰ আব্বাজানের কাছে তাবিজ নিয়ে এসো।
এই রবিই আমাকে সঠিকভাবে যৌনতা চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রতি বাতে সে অশ্লীল গল্প কবত। আমার গোপন অঙ্গটি দেখতে জববদস্তি কবত। ব্যর্থ হলে নিজেবটি দেখাত। সে আমাকে জঘন্যতম অনুবোধ জানাত। সাধাসাধি কবত। আমি একবাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে টেব পেয়েছিলাম, সে আমার শবীবেব একটি ত নিয়ে কিছু করতে চাইছে। আমি তাকে ধাক্কা মেবেছিলাম। সেই প্রথম আমি কাউকে আঘাত কবি শাবীবিকভাবে। কিন্তু দিনে রবি ছিল অন্য ছেলে। স্কুলে হিন্দু ছেলেদেবই সংখ্যা বেশি। তাদের সঙ্গে একমাত্র তাবই মাখামাখি ছিল। ক্রমশ রবিব মাবফত হিন্দু ছেলেদেব সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। আব রবিই আমাকে প্রথম বিড়ি ফুঁকতে শেখায়। স্কুলের পেছনে একটা মন্দির ছিল। মন্দিবটা ছিল ভেঙে পড়া অবস্থায়। ঘন কল্কেফুলেব জঙ্গলের ভেতর সেই ভাঙা কালীমন্দিবেব পেছনে রবি বিড়ি ফুঁকতে যেত। কয়েকটি হিন্দু ছেলেও যেত। দলবেঁধে সবাই বিড়ি টানত। বাঘ যেমন নাকি মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষখেকো হয়ে ওঠে, আমিও ক্রমশ প্রচণ্ড বিড়িখেকো হয়ে উঠেছিলাম। মাঝে-মাঝে ভয় পেয়ে ভাবতাম, আব্বার অনুগত কোনও জিন যদি এ গোপন খবব ওঁর কানে তোলে, আমার একটা সর্বনাশ ঘটে যাবে।….
উলুশবাবু মাঠ থেকে সেদিন আমাকে বারুচাচাজি হাসমত সাহেবের বাড়ির সামনে পৌঁছে দিলে আমার খাতির বেড়ে গিযেছিল ওবাড়িতে। কিন্তু বারুচাচাজি চলে যাওয়ার পরই আমার বুকের ভেতর একটা ঝড় বইতে লাগল। বুকুর সঙ্গে আমার শাদি হবে? এ কি সত্যি? বুকু আমার বউ হবে এবং সে আমার পাশে শোবে এবং আমি তাকে– এ কি সত্যি হতে পাবে?
সে কি কাম? নাকি প্রেম? রবিকে সে-রাতে কথাটা বলামাত্র সে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। জঘন্যতম সব ব্যাপার সে আমাকে হাতেনাতে শেখাতে চাইল, আর আমি আত্মসমর্পণ করলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমি চমকে উঠলাম। লজ্জায় সংকোচে কাঠ হয়ে গেলাম। বুকু্র সঙ্গে আমি এসব অশালীন কিছু করব ভাবতেই খাবাপ লাগল। মনে-মনে মিনতি করে বললাম, বুকু। তুমি মায়ের কাছে শোনা সেই আকাশচারিণী পরি, বাড়ির পিছনে তালগাছে যে মধ্যরাতের জ্যোৎস্নায় বিশ্রাম নিতে বসত আর খড়খড় সরসর শব্দে তালের বাগড়াগুলো নড়ত। রুকু সেই পরি, যার বাসস্থান আকাশের দ্বিতীয় স্তরের পরিস্তানে, যেখানে ফুটে আছে লক্ষকোটি নক্ষত্র দিয়ে গড়া প্রলম্বিত ছায়াপথ।….
.
খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যেতেই আমি যে খোলামেলা পৃথিবীকে দেখতে পেয়ে ছুটে গেলাম, সেখানে মানুষের গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো নিষ্ফল। দবিরউদ্দিন আমাকে কলকাতার উচ্চ আদালতে আপিলের খবর এনেছিলেন। আমি তাঁকে মনে মনে গাল দিয়ে বললাম, শুওরের বাচ্চা! ইংরেজশাহির পা-চাটা গোলাম কুত্তা। আমাকে কেউ ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে না, তুমি জানো না?
এই যে অবাধ দুনিয়ার হাট করে খোলা দরজা দিয়ে আমি ছুটে চলেছি, আমার ষোলো বছর বয়সের শরীরটাকে ফিরে পেয়েছি, আমার এই স্বাধীনতা প্রকৃতি থেকে আমার বুকের ভেতর ঢোকানো হয়েছিল। খানবাহাদুর, তুমি মাথামোটা এক খয়েরখা। তুমি যে এত ধর্ম-ধর্ম করো, সব তোমার শেখা বুলি। পয়গম্বরের ছেলেবেলার একটি গল্প বলতেন আব্বা। বালক পয়গম্বর যখন রাখাল ছিলেন, হঠাৎ সেই উপত্যকায় নেমে এল দুই ফেরেশতা। তাঁকে ধরে ফেলল তারা। চিত করে শোয়াল। তারপর তাঁর বুক চিরে ফেলে তাঁর কলজে থেকে অসৎ টুকরোটি কেটে নিয়ে সৎ এবং স্বর্গীয় একটি টুকরো জুড়ে দিল! এ একটি শল্যচিকিৎসা। ফেরেশতারা উধাও হয়ে গেলে সঙ্গী রাখাল বালকেরা আতঙ্কিত হয়ে খবর দিল পয়গম্বরের ধাইমা বিবি হালিমার কাছে। বিবি হালিমা ছুটে এসে দেখলেন, বালকটি শুয়ে আছে। কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই তার বুকে। আর এই ঘটনার নাম ‘সিনা-চাখ’ বা বক্ষবিদারণ। দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরী একটি বিশাল কালো জানোয়ারের পিঠে চাপিয়ে উলুশরার তৃণভূমিতে আমাকে নিয়ে যেন এমন কিছুই করেছিলেন এবং আমার কলজে আমারই অজান্তে বদলে গিয়েছিল। আমার ‘সিনা-চাথ বুঝতে আরও তিরিশ বছর লেগে গিয়েছিল। আমি বুঝতেই পারিনি আমি কী হয়ে গেছি সেদিন থেকে। অথচ রবিউদ্দিনের সঙ্গে রাতভর দিনভর খালি রুকুর কথা বলেছিলাম। কালীমন্দিরের পেছনের কল্কেফুটের জঙ্গলে বিড়ি টানতে-টানতে বলেছিলাম, রুকুর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আমি ওসব কিছু করতে পারব না, রবি! আর রবি খি-খি করে হেসে বলেছিল, তোর আব্বাজান তো পির-মৌলানা মানুষ! একজোড়া জিন-পরি পাঠিয়ে দেবেন তোকে হাতে-কলমে শেখাতে। তোর আবার ভাবনা?
হরিণমারার মুসলিমরা ছিল হানাফি সম্প্রদায়। তারা কেউ কেউ আব্বাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত। রবিও করত। কিন্তু তার বাবা খোন্দকার হাসমত আলি ছিলেন আব্বার অনুরাগী মানুষ। লম্বাটে চেহারার এই মানুষটির চিবুকে ছিল ছাগলদাড়ি। মাথায় সব সময় তুর্কি ফেজটুপি পরে থাকতেন। লাল কৌটো-গড়নের টুপিটার শীর্ষে ছিল কালো মাদুলির মতো দেখতে একটুকরো গালা আর তা থেকে ঝুলত রেশমি কালো একগুচ্ছ সুতোর ঝালর। বিনীত, মৃদুভাষী এই লোকটি প্রথম দিন থেকেই আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তার বংশ-পদবি ছিল খোলকার। তিনি ছিলেন উচ্চবণীয় আশরাফ, যাঁদের মিয়াঁ বলাই মুসলিমদের মধ্যে রেওয়াজ। হিন্দুরা অজ্ঞতাবশে মুসলিমমাত্রেই মিয়াঁ বলেন দেখেছি। বারুচাচাজি বলতেন, মিয়াঁ বা মিঞা কথাটা ফারসি। এর মানে হল মধ্য। সমাজের মাঝখানে যারা আছে। কিন্তু জেনো শফি, এই মাঝখানে-থাকা লোকগুলোর মতো বদমাইশ দুনিয়ায় আর থাকতে নেই। এরা গাছেরও খায়, তলারও কুড়োয়। এই যে ‘খোন্দকার’-সায়েবকে দেখছ, আমার কথা মানেন-গোনেন, ভয়-ভক্তি করে চলেন, তার কারণ কী জানো? উলুশরার নাবাল মাঠে নবাববাহাদুর যে ঘের (বাঁধ) তৈরির আরজি মনজুর করেছেন, তার মূলে আমি। আর খোকার আছেন তদ্বিরে, চাষাভুষো গরিব-গুরবোর ইস্তফা দেওয়া ভুইখেত সামান্য সেলামিতে যাতে পেয়ে যান। ঘের হলে উলুশরার মাঠে ফসল ফলবে। নবাবের খাজাঞ্চিখানা উঠবে ভরে।
জমিজমা ভুঁই-খেত এসব আমি তখনও বুঝতাম না। আব্বা গর্ব করে বলতেন, মাটি নিয়ে দুনিয়াদারি আমাদের নয়। খোদাতা’র দুনিয়ায় সব ছেড়ে শুধু মাটি মেপে বেড়ায় যারা, তারা গোনাহগার পাপী। সেই পাপেই মুসলমানের বাদশাহি বরবাদ হয়েছে। খোনকারসায়েব তাঁর ছাগলদাড়ি মুঠোয় চেপে যখন ছড়ি-হাতে মাঠের জমির আলে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমার মনে হত, আব্বা যদি এখন ওঁকে দেখতেন, কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেন।….
বারুচাচাজি আমার কানে ফুসমন্তর দিয়ে চলে যাওয়ার কদিন পরেই দুখু নামে একটি লোক এল মৌলাহাট থেকে। শীর্ণকায় এই খেতমজুরটি ছিল ভারি আমুদে। সে মুচকি হেসে যখন বলল, হুজুর তলব দিয়েছেন, তখনই আমি সতর্ক হলাম। আমার চোয়াল আঁটো হয়ে গেল। আস্তে বললাম, কদিন পরেই স্কুলে পুজোর ছুটি পড়বে। তখন যাব।
দুখু চোখ নাচিয়ে বলল, সে যখন যাবেন, তখন যাবেন। হুজুর বলেছেন, আপনার আম্মাজানও বলেছেন– পইপই করে বলেছেন, একবেলার জন্য যেতেই হবে। আমাকে ধরে আনতে হুকুম জারি হয়েছে, বাপজি!
শরৎকালের বিকেলে বাদশাহি সড়কের ধারে ক্লাস সিক্সের কজন বন্ধু মিলে আমরা রোজ গিয়ে বসে থাকতাম। রবি, কালীচরণ, বিনোদ আর পোদো। পেপাদোর আসল নাম ছিল হরেন। কালোরঙের মারকুটে চেহারার পোদো দুখুকে চোখ পাকিয়ে বলল, শফির বাবাকে গিয়ে বললো, শফি বিয়ে করবে না। শালা! গুয়োর ডিম ভাঙেনি, এখনই মেয়েমানুষের পাশে শোবে!
শোনামাত্র আমি চমকে উঠলাম। রবি তাহলে কথাটা রটিয়ে দিয়েছে। তখন স্কুলেপড়া ছাত্রদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে। এমন কী, বিনোদেরও বিয়ে হয়েছে। সে ময়রাবাড়ির ছেলে। বয়সে সবার বড়ো। সে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। দুখুও খিকখিক করে বেজায় হাসল। বলল, বাবুমশাই, তা বললে কি চলে? গাঁ জুড়ে রোয়াব উঠেছে, পিরসাহেবের ছেলেদের বিহা।
পোদো আমার গোপন অঙ্গে খামচে ধরে বলল, কী রে? বিয়ে করবি? ছিঁড়ে ফেলব– বল, করবি?
আমি জোরে মাথা নেড়ে, কিন্তু মুখ নামিয়ে বললাম, না।
দুখু বেগতিক দেখে গোমড়ামুখে বলল, সেটা পরের কথা! হুজুর যখন ডেকেছেন, তখন একবার চলুন। মাজান বড়ো কাঁদেন আপনার জন্য। আর আয়মনি– আয়মনিও কেঁদে ‘বিয়াকুল’। বলে আহা, চোখের ছামু থেকে ছেলেটা দূর হয়ে গেল গো!
হঠাৎ আমার মনে হল, রুকু কি কিছু বলে না? কোনো কথা বলে না কারুর কাছে? সড়কের দুধারে অপার সবুজ ধানখেত। সাঁকোর ধারে আমরা বসেছিলাম। নিচে স্বচ্ছ জলেভরা কাঁদর। দিনের শেষ আলোয় সবকিছুর ভেতর রুকুকে প্রতিষ্ঠিত দেখলাম। উত্তরদেশের গাড়োয়ানদের যে দলটি সার বেঁধে গোরুর গাড়ি নিয়ে একটু আগে সাঁকো পেরিয়ে গেছে, তাদের একজনের গান তখনও ভেসে আসছিল দূর। থেকে। হরিণমারার জমিদারবাড়ির সিংহবাহিনীর মন্দিরে কাসরঘণ্টা বাজতে থাকল। মুসলিমপাড়ার প্রাচীন নবারি মসজিদের শীর্ষ থেকে মোয়াজ্জিনের আজানধ্বনি ভেসে এল। আর দুখু শেখ ব্যস্ত হয়ে কাঁদরের জলে অজু করে নমাজে দাঁড়াল। তার বিস্মিত আর বিচলিত চাউনি দেখে বুঝতে পারছিলাম, পিরসাহবের ছেলেকে তার পাশে নমাজে আশা করেছিল। কিন্তু শেষে হতাশ হয়ে নমাজ পড়তে থাকল। রবি চাপা গলায় রুকু আর আমার সম্পর্কে অশালীন কথা বলতে থাকল বন্ধুদের সঙ্গে। সে কি নিছক কাম? সে কি প্রেম? আমার চারপাশ থেকে প্রতিবিম্বিত রুকু হাতছানি। দিল। তার মেয়েলি চুলের গন্ধ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার, যে গন্ধ সে কাছে এসে দাঁড়ালেই ঝাঁঝাল হয়ে নাকে ঢুকেছে এবং কী এক প্রক্ষোভে জর্জরিত হয়েছে আমার আমূল অস্তিত্ব। দুখু নমাজ শেষ করে টুপিটি ভাঁজ করে ফতুয়ার পকেটে খুঁজে আমার কাছে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। রবি বলল, রাত্তিরটা থাকিস। কালীচরণ আর বিনোদ খ্যাখ্যা করে হাসতে থাকল। শুধু পোদো বলল, মরবি শফি, মারা পড়বি।….
.
মৌলাহাটে পৌঁছেই দুখু আমাকে প্রথমে মসজিদে আব্বার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন এশার নমাজ চলেছে । নমাজের প্রতি ততদিনে আমার গরজ কমে গেছে। দুখু মসজিদে ঢুকে চত্বরের চৌবাচ্চায় অজু করতে ব্যস্ত হলে আমি সেই সুযোগে কেটে পড়লাম। সোজা বাড়ি গিয়ে ঢুকলাম। ডাকলাম, মা! তারপরই শুধরে নিয়ে ডাকলাম, আম্মা!
দেখলাম, মা বারান্দায় সবে নমাজ শেষ করে ‘মোনাজাত’ –করজোড়ে প্রার্থনা করছেন। একটু তফাতে একটা লম্ফ জ্বলছে! রান্নাঘরের বারান্দাতেও একটি লক্ষের সামনে বসে মেজোভাই মনি দুলছে আর আঙুল চুষছে। তার মুখের দুপাশ লালায় ভেসে যাচ্ছে। তার গালে দাড়ি গজিয়ে গেছে। সে আমাকে দেখে অদ্ভুত গোঙানো। গলায় যখন বলে উঠল, ছফি! তখনই আমার চমক লাগল। আব্বার অনুরক্ত জিনেরা কি তাহলে একদিন মনিভাইয়ের ভেতরকার কালো জিনটিকে তাড়াতে পেরেছে?
ঘরের ভেতর থেকে দাদি-আম্মার সাড়া পেলাম, কে রে? নুরু?
না দাদি-আম্মা! আমি।
শফি! পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা বৃদ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। খুশি ফেটে পড়ছিল তাঁর কণ্ঠস্বরে। ঘরে ঢুকে তাঁর কদমবুসি –পদচুম্বন করামাত্র তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন। হেসে-কেঁদে বৃদ্ধা অস্থির। তারপরই দেখতে পেলাম দরজার সামনে দাঁড়ানো এক ছায়ামূর্তি।
ছায়ামূর্তিই। মাকে চিনতে পারছিলাম না। সে যেন মায়েরই বিকৃত এক প্রতিরূপ। কোটরগত চোখ, কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়েছে, বসা গলা, সরু নাকটিও নেতিয়ে গেছে। পরনে যেমন-তেমন একটা শাড়ি। উঠে এসে কদমবুসি করলে বুকে চেপে ধরলেন। বুকের স্পন্দন অনুভব করলাম। সেই মুহূর্তে দাদি-আম্মা সহাস্যে বলে উঠলেন, তোমার ব্যাটার মুখে বস্তু (দুর্গন্ধ) নিকলাচ্ছে, বউবিবি! ওকে পুছ করে দ্যাখো, বিড়ি-তামুক খেতে শিখেছে ইস্কুলে!
দাদি-আম্মা খুব হাসতে থাকলেন। মা কোনো কথা না বলে আমাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। দেখলাম, ঘরখানিতে অনেক বদল ঘটেছে। তত্তায় রাখা আব্বার আরবি-ফারসি কেতাবের স্তূপটি নেই। সেখানে নতুন কিছু তোরঙ্গ আর বেতের পেটরা রয়েছে। তত্তাপেশের বিছানাটি নতুন বলে মনে হল। আলনায় কিছু নতুন শাড়ি ঝুলছে। মা আমাকে নিয়ে বিছানা বসলেন। তাঁর চোখে জল ছিল। মুছে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, তুই-ও আমাকে ভুলে গেলি, বাছা?
মনে-মনে বললাম, ভুলিনি আম্মা! মুখে বললাম, স্কুলে খুব পড়ার চাপ।
মা একটু চুপ করে থেকে বললেন, নুরু এসেছে খবর পেয়েছিস?
হুঁ। বারি-চাচাজি বলছিলেন।
নুরু ‘ফাজিল’ হয়েছে। মায়ের মুখে ঈষৎ গর্বের রেখা ফুটে উঠল কথাটা বলতে।
‘ফাজিল’ ইসলামি শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি। কিন্তু আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম, বড়োভাই এবার খুব ফাজলেমি করে বেড়াবে দেখবেন!
মা ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ছিঃ! বড়োভাই সম্পর্কে আদব-লেহাজ করে কথা বলতে হয়।
বড়োভাই বুঝি মসজিদে?
মা মাথা নাড়লেন। তারপর একটু হেসে বললেন, তোদের দু-ভাইয়ের শাদির ইন্তেজাম হয়েছে। দরিয়াবানুরই জেদ। তোর আব্বাসাহেবও মত দিয়েছেন।
মায়ের একটা চোখ ছিল রান্নাঘরের বারান্দার দিকে। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। দেখলাম, মনিভাই লম্পটার দিকে ঝুঁকে দিচ্ছে। মা ‘অই! অই! বলে তার হাত থেকে লম্প কেড়ে নিলেন। তারপর ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম মনিভাইয়ের কাঁধ ধরে টানতে-টানতে নিয়ে আসছেন। মনিভাই টলোমলো পা ফেটে হেঁটে আসছে। এঘরে ঢুকেই সে মেঝেয় বসে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যা ফ্যা করে হাসতে লাগল। মা আমার পাশে বসে একটু হেসে বললেন, মনির আমার খানিক-খানিক হুঁশবুদ্ধি ফিরেছে।
গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে বললেন, ফের, খবরদার বাবা, তোর আব্বা যেন জানতে না পারেন। দরিয়া-আপার কথায় খোঁড়াপিরের মাজারে গিয়ে সিন্নি চড়িয়েছিলাম। অমনি মনি আমার
মা! আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
মা বললেন, চুপ। চুপ। দেওয়ালের কান আছে।
আমরা ফরাজি না?
মায়ের মুখে একটা কালো ছাপ পড়ল। ঠোঁট বেঁকে গেল। হিশ-হিশ করে বললেন, এতকাল দুনিয়া জুড়ে পিরদের সঙ্গে জেহাদ করে এবার নিজেই পির সেজে বসেছেন! মসজিদে রাতের বেলা জিনপরি এসে খিদমত (সেবা) করছে। তাই হুজুরের আর বাড়ি আসা হয় না। ফরাজি! আহলে হাদিস! লা-মজহারি! মোহাম্মদি! তারপর কি না ওহাবি। মুখে কতরকম বুলি! এদিকে–
হঠাৎ মা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরে বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন আম্মা?
মা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আয়। ইঁদারার পানি তুলে দিই। হাত পা ধো!
মা বেরিয়ে গেলেন, তখনও আমি বসে আছি। কিছু বুঝতে পারছি না। তারপর মনিভাইয়ের দিকে চোখ পড়ল। সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। মুখে কেমন একটা হাসি। তারপর সে দুইহাতের আঙুল দিয়ে মিথুন-সংকেত দেখাতে লাগল। এই সংকেতটি খয়রাডাঙার স্কুলে পড়ার সময় আবু নামে এক সহপাঠীর কাছে প্রথম দেখি। মনিভাইয়ের এমন কাণ্ড দেখে লজ্জায়-রাগে-ঘেন্নায় দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।
উঠোনের জীর্ণ ইঁদারাটি মেরামত হয়েছে। লম্পের সামান্য আলোয় বাড়িটা নতুন দেখাচ্ছিল। মা নিজেই আমার হাত-পা ধুয়ে দিলেন। দিতে-দিতে বললেন, দেখছিস কত গাঁদাফুলের ঝাড় হয়েছে। সব আয়মনির কাণ্ড। একটু আগে খবর: নিতে এসেছিল শফি এল নাকি। সবচেয়ে ওর খুশিটাই বেশি, জানিস? বলে কী, পিরসাহেব তো মসজিদে। আমরা ঢোলক বাজাব, শাদিতে নাচব। গীত গাইব। সং দেব। পিরসাহেব শোনে তো শুনুক। ফরাজি হয়েছি তো কী হয়েছে? ‘পুরুষান’ (পুরুষানুক্রমে) যা হয়ে এসেছে মৌলাহাটে, তা না হলে চলে?
মা অনর্গল এসব কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি শুনতে চাইলাম রুকুর কথা। রুকু কী বলছে? রুকু কি আগের মতো আসছে আমাদের বাড়িতে? রুকু কি খুশি হয়েছে?
মা ওসব কথা কিছুই বললেন না। আঁচল দিয়ে আমার পা, হাত, মুখ মুছিয়ে কাঁধ ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর বাইরে কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠল, আম্মাজি! স্বরটা চেনা মনে হল। কিন্তু আব্বার চেয়ে গম্ভীর আর প্রতিধ্বনিময় সেই কণ্ঠস্বর। আবার সে বলল, শফি এসেছে শুনলাম। কই সে? তারপর দরজায় একজনকে দেখতে পেলাম। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ঝকমকে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ মুখে কালো দাড়ি। মাথায় ফেজ টুপি। পরনে ঘিয়ে রঙের আচকান। পায়ে নাগরা জুতো। এই কি আমার বড়োভাই নুরুজ্জামান? মা আমাকে ঠেলে দিয়ে বললেন, বড়োভাইয়ের সঙ্গে আদব-লেহাজ করতে হয় জানো না? ছিঃ!
আমি ওঠার আগেই নুরুভাই এসে আমাকে আলিঙ্গন করল। বলল, তু কিতনা বাঢ় গিয়া, শফি? তুমকো হাম পছনতাভি নেহি!
মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ওই জবানে বাতচিত আর করিস না বাবা! ওই খোট্টামি শুনলে আমার গা জ্বলে যায়।
নুরুভাই হাসতে-হাসতে বলল, মুসলমানের জবান, আম্মাজান! তারপর আমার পাশে বসে বলল, তুই নাকি ইংরেজি ইস্কুলে পড়ছিস? আব্বাজানকে বললাম, ইয়ে ক্যা কিয়া আপনে? আব্বাজানের বাত সমঝ করা গেল না। কে এক নবাববাহাদুরের দেওয়ানসাব নাকি তেনাকে কীসব সমঝেছেন, আব্বাজান তাঁর ফাঁদে পড়ে –তো শফি, তোর চেহারায় হিউঁর ছাপ পড়েছে। তুই কি ইস্কুলে থোতি উতি পিঁধিস, নাকি পায়জামা-কুর্তা পিঁধিস?
আস্তে বললাম, হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরে স্কুলে যেতে হয়।
নাউজুবিল্লাহ! নরুভাই বলল। অবশ্য সে হাসছিল। তোকে আব্বাজান–
না। বারিচাচাজি কিনে দিয়েছেন।
উও কৌন? কে সে?
মা বললেন, সেই তো দেওয়ানসাহেল। দরিয়া-আপা –মানে তোদের হবু শাশুড়ির দেওর হন তিনি। হাতিতে চেপে মহালে-মহালে ঘোরেন। ওনাকে তুই চিনিস নে, নুরু! উনি ইংরেজিপাস পণ্ডিত। হিন্দুরাও ওনার কত কদর করে জানিস?
নুরুভাই একটু গম্ভীর হয়ে বলল তো ঠিক হ্যায়। নসিব আপনা-আপনা। আম্মাজান, ভুখ লেগেছে। জলদি খানা নিকালেন। অনেকবছর পরে দুভাই পাশাপাশি বসে খাই। দেওবন্দের মেহমানখানায় (অতিথিশালা) খেয়ে মু খারাব হয়ে গিয়েছে। শফি, তুই নাকি কার বাড়ি ‘জায়গির’ আছিস?
মা বলে গেলেন, খোনকারসাহেবের বাড়ি। খবর নিয়েছি, ওনারা শরিফ ঘর।
নুরুভাই ঘোষণা করল, আল্লার দুনিয়ায় শরিফ-নিচ, আশরাফ-আজলাফ কিছু নাই। সবাই আল্লাহতায়লার বান্দা । দুনিয়ায় কোথাও ইসলামে এ জিনিস নাই। খালি হিন্দুস্তানের মুসলমান হিন্দুদের দেখে জাত-বেত শিখেছে। মুসলমান ‘কুফরি কালাম’ (নাস্তিক্যমূলক বিদ্যা) পেয়েছে হিন্দুস্তানে এসে। সব মানুষ সমান। আমরা সবাই বনি-আদম (আদমবংশধর)।
নুরুভাইয়ের এই কথাটাই এতক্ষণে ভালো লাগল।…
বারুচাচাজি বলতেন, ‘ইসলাম ইজ দ্য ড্রাসটিক ফরম অব ক্রিসটিয়ানিটি’ বলে একটা কথা চালু আছে, জানিস শফি? তো তোর বড়োভাই মৌলানা নুরুজ্জামান। ইজ দা ড্রাসটিক ফরম অব ইওর ফাদার মৌলানা বদিউজ্জামান! পিতৃনিন্দা শুনে রাগ করলি না তো? নিন্দাছলে স্তৃতি। অলঙ্কারশাস্ত্রে একে বলে ব্যাজ্যুতি। তোর পড়ার বইতে নেই ভরতচন্দ্রের সেই কবিতাটা– শিবের ব্যাজ্যুতি?
হরিণমারা স্কুলে গিয়ে একটা বিপত্তি ঘটেছিল। ঘটিয়েছিলেন বারুচাচাজিই। আব্বাকে জানতে দেননি, আরবি-ফারসির বদলে সংস্কৃত নিয়েছিলাম আমি। তাঁরই কথায়। তাঁর কথায় সায় দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না আমার। আমাকে তিনি বশ করে ফেলেছিলেন। তবে খোনকারসাহেবের ছেলে রবিকেও সংস্কৃত নিতে হয়েছিল। কাবণ প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলে গোড়ার দিকে আরবি-ফারসি শিক্ষক নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ছিল খুবই কম। আমার ভর্তি হওয়ার বছর। নবাববাহাদুরেব অর্থসাহায্যে সক্রেটাবি হিন্দু জমিদার রায়সাহেব প্রথম মৌলবি শিক্ষক রাখেন। তাঁর নাম ছিল জসিমুদ্দিন। তাঁকে ছাত্ররা বলত, যশু মৌলবি। কেপ্পনের যাশু এই মৌলবি সম্পর্কে নানান গুজব ছড়াত ছাত্ররা। আমাকে আর রবিকে দুচোখে দেখতে পারতেন না তিনি। তবে পোদোকে বড্ড ভয় করতেন। তারই ভয়েই হয়তো আব্বার কানে আমার সংস্কৃত পড়ার কথাটা তুলতে যাননি।…
লম্বানেকো শাস্ত্রটি গরাদের ভেতর দিয়ে কুতকুতে চোখে ডাকল, সাব!
মুহূর্তে দেখলাম আমার চারদিকে কালো দেয়াল এগিয়ে এসে ঘিরল। মুখ তুলে দেখলাম, উঁচুতে একটা ছাদ। কোনায় মিটমিটে বিজলিবাতি জ্বলছে।
কুছ তকলিফ হ্যায়, সাব?
না তো ভাই!
সে সরে গেল। তার বুটের শব্দ থামলে আমি আবার সামনে দেয়ালের দিকে তাকালাম। দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সাতমার কান্নু পাঠান। তার গলার কাছে টাটকা ক্ষত! গলগল করে রক্ত পড়ছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। কাটা শ্বাসনালী দিয়ে লাল বুজকুড়ি ফুটে উঠছে। সে বলল, শফিসাব! আর বুজকুড়িগুলো ফাটতে থাকল। ঘড়ঘড় শব্দ।
বলো কাল্লু!
সিতারা –সিতারা আমাকে বলল কী—
কাল্লু পাঠানের বুকে দুমদাম ঘুসি মারতে থাকলাম। আমার হাতে রক্ত লাগল।
লম্বানেকো শাস্ত্রীটি ব্যস্তভাবে ডাকছে শুনতে পেলাম, সাব! সাব!
ঘুরে দেখে স্থির দাঁড়িয়ে গেলাম। আস্তে বললাম, ও কিছু না!…
কোথাও ঢং-ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজল। গোনার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম ঘণ্টাধ্বনি দূরে অপস্রিয়মাণ, আর তা ক্ষীণতম হতে-হতে ভীষণ গম্ভীর অন্ধকার চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। মাথা তুলে দেখি, কালো আকাশ জুড়ে এরাতে বডো বেশি নক্ষত্রের ঝাঁক। আর স্তব্ধতা। বড়ো বেশি সেই স্তব্ধতা, যা গাছপালা থেকে শিশিরের ফোঁটা ঝরে পড়ার টুপটাপ ধ্বনিপুঞ্জকেও করতলগত করে। আর হঠাৎ যদি দূরে হেঁকে ওঠে রোদের চৌকিদার, তারপর ভেসে আসে কোনও হকচকিয়ে ওঠা কুকুরের ডাক, তবুও এ শবকালীন মধ্যবাতেব ওই স্তব্ধতা সেগুলোকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বারুচাচাজি বলতেন, প্রকৃতি সর্বগ্রাসী …।
আলোর বিন্দুটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। যত স্পষ্ট হচ্ছিল, তত আমার কাঁধে কারুর হাতের ছোঁয়া টের পাচ্ছিলাম। চমকে উঠে আবিস্কার করলাম নুবুভাইকে। আমি তার সঙ্গে মসজিদের দিকেই চলেছি। বারান্দার থামের ফাঁক দিয়ে সুদৃশ্য চীনা লণ্ঠনটি দেখা যাচ্ছে। চত্বরে ঢুকে নুরুভাই একটু কেশে সাড়া দিল। তারপর চত্বরকেন্দ্রের চৌবাচ্চার কাছ থেকে সাড়া এল, নুরুজ্জামান!
জি।
শফি এসেছে?
জি হাঁ।
অন্ধকার উঁচু বিরাট ছায়ামূর্তির কাছে গিয়ে পদচুম্বন করলাম। আর সেই বুঝি ছিল এক আশ্চর্য ও অবিস্মরণীয় রাত, যে-রাতে সেই প্রথম ও শেষবার আমার পিতা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
মসজিদের বারান্দার নিচে জুতো খুলে রেখে আমরা দুভাই তাঁকে অনুসরণ করলাম। তিনি খালি পায়ে ছিলেন। ভেতরে লণ্ঠনের আলোয় একটি নকশাদার কাশ্মীরি গালিচা দেখলাম। গালিচাটির পরিপ্রেক্ষিত ছিল লাল। সেটি পুরু ও নরম। আব্বা পা-মুড়ে বসে আস্তে বললেন, বসো। একটু দূরত্ব রেখে বসতে যাচ্ছিলাম। আব্বা বললেন, এখানে বসো। আমরা দু-ভাই গালিচার ওপর বসলাম। তখন আব্বা চোখ বুজলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তসবিহদানা (জপমালা)। চোখ বুজে থেকে তিনি বললেন, তোমাদের দু-ভাইয়ের শাদির ইন্তেজাম করেছি।
নুরুভাই আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আস্তে বলল, জি! তার এই ‘জি’ শব্দে সম্মতি ছিল।
আব্বা আমাকে ডাকলেন, শফিউজ্জামান!
জি? আমার এই ‘জি’ শব্দে প্রশ্ন ছিল।
আব্বা চোখ না খুলেই বললেন, দেওয়ানসাহেব তোমার শাদিতে নারাজ। দরিয়াবিবির সঙ্গে তাঁর এজন্য কাজিয়া হয়েছে, শুনেছি। দেওয়ানসাহেব নাকি বলে গেছেন, শফিউজ্জামানের সঙ্গে বেটির শাদি দিনে’ উনি আর এবাড়ি কখনও আসবেন না।
নুরুভাই কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু বলল না। তার মুখে বাঁকা কিছু রেখা ফুটে উঠল।
আব্বা বললেন, ইসলাম বলেছে ছেলে-মেয়ের শাদি দেওয়া বাবা-মায়ের ফরজ (অবশ্য পালনীয়)।
কথাটা বলে আব্বা চোখ খুললেন। আমার দিকে তাকালেন। নুরুভাই তাকাল আমার দিকে। লণ্ঠনের আলোয় তিনটি মুখ পরস্পরের দিকে নিবদ্ধ। বাইরে দূরে রোদের চৌকিদার ডাকল একবার। হেই-ই-ই! জা–আ-গো-ওঃ! তারপর আব্বা ডাকলেন, শফিউজ্জামান!
আমি ফের বললাম, জি! এই শব্দটি এবার ছিল নিরর্থক একটি শব্দমাত্র। যেমন শিশির-পড়ার কিংবা যে-কোনো প্রাকৃতিক ধ্বনির মতোই, যার এমন কঠিন নিজস্বতা আছে যে মানুষ তাকে উপমায় বা প্রতাঁকে বা কোনোভাবেই চৈতন্যসংক্রান্ত ব্যাখ্যায় পরিণত করতে পারে না। সেটি একটি জড় ধ্বনিমাত্র। জলে ঢিল ছুড়লে যে শব্দ ওঠে, তাকে তুমি –হে লম্বানেকো শান্ত্রী, জলের আর্তনাদ বলে একটি ব্যাখ্যা দিতে পারো। কিন্তু আমার ওই জি-শব্দটির তেমন কোনো আরোপিত ব্যাখ্যাও চলে না।
অথচ মানুষের মূঢ়তা এমনই অবিমৃষ্যকারী, এমনই অসহায়তা তার অস্তিত্বের এক মৌল উপাদান– যা সে মাতৃগর্ভ থেকে সঙ্গে নিয়ে জন্মায় যে, সবকিছুকেই চৈতন্যময় ভাবে। আজ আমি অনিবার্য মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি বলেই নয়, এ তো একটা নিজস্ব-সাধিত পরিণতি আমারই অস্তিত্বের, ক্রমশ জেনেছিলাম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জড়প্রক্রিয়ারই এক হঠকারী পরিণাম জীবন নামক একটা ঘটনা– নিছক ঘটনামাত্র!
এই দেখো, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। চল্লিশ বছর আগের এক শরৎকালীন মধ্যরাতে মৌলাহাট গ্রামের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন মসজিদের ভেতর লণ্ঠনের আলোয় কাশ্মীরি গালিচায বসে, পরবর্তীকালে বদুপির নামে যিনি প্রখ্যাত হন এবং যার মাজার শরিফ পর্যন্ত গড়ে ওঠে, অথচ যিনি একদা ছিলেন। পিরতন্ত্র বিরোধী কট্টর ফরাজি মৌলানা, তাঁর ‘শফিউজ্জামান’ সম্ভাষণে প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন ছিল শাদিতে আমার সম্মতি আছে কি না! ভাবা যায় না হে লম্বানেকো শাস্ত্রীভাই, তা তোমার কাঁধে বন্দুকই থাক কিংবা কোমরে ঝুলুক খাপেঢ়াকা বেয়নেট!
কিন্তু আমার ‘জি’ শব্দটিকে তিনি, তাঁর মতো বিচক্ষণ জ্ঞানী পুরুষ, একই সাধারণ মূঢ়তায় সম্মতি বলে ধরে নিলেন, যদিও আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলতে চাইনি। কারণ তখন আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। বারুচচাজি এবং রুকু। আমি ভাবছিলাম কার দিকে যাব– কে আমার প্রিয়?….
.
খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙাল আয়মনি। তার চেহারার ঝলমলানি দেখে তো আমি অবাক! সে গাভরা রুপোর গয়না পরেছে। রঙিন ডুরে শাড়ি, এমন কী কুর্তাও পরেছে –যত বেঢপ দেখাক আর তার কপালে কাঁচাপোকার টিপ। তার সারা দেহ ঝিকমিক করছিল হাসিতে। শফি এসেছ? মানিকসোনা এসেছ? বলতে বলতে সে আমার হাত ধরে টেনে ওঠাল বিছানা থেকে। সে আমার শাদিতে কত খুশি বোঝনোর জন্য চাপা গলায় একরাশ কথা বলতে থাকল। আমি চুপ করে থাকলাম। অথচ আমার জানতে ইচ্ছে করছিল রুকুর কথা। মুখ ফুটে জিগ্যেস করতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ পরে আয়মনি নিজে থেকেই জানিয়ে দিল, দুই-বোন এখন পরদাবন্দি। বাড়ি থেকে বেরুনো বারণ। তারা যে শাদির দুলহান এখন। তাছাড়া গ্রামে কড়া পরদা চলেছে আউরতদের। সবাই ফরাজি হয়ে গেছে কিনা! আর– আয়মনি উপসংহার বলল, এখন দরিবিবির বাড়িমুখো হতে নেই তোমার তুমি যে শাদির নওশা। ওবাড়ির জামাই হবে!
হঠাৎ একটা জোরালো অভিমান আমার বুকের ভেতর চেপে বসল। সেই অভিমান সূর্য ওঠার পর আমাকে বলিয়ে দিল, আম্মা, আমি চললাম। স্কুল কামাই করলে নাম কেটে দেবে। আর আমাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মা আর্তনাদের সুরে ডাকলেন, শফি! শফি! আমি পিছু ফিরলাম না….