সব পাখি ঘরে ফেরে
বদিউজ্জামান শুধু বলেছিলেন, আমি সবই জানতাম। আর এই থেকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, মধ্যরাতে দরিয়াবান যখন ডুমুরগাছে ঝুলতে যাচ্ছে, তখন পিরসাহেবের অনুগত এক জিন ছুটে এসে খবর দিয়েছিল। জিনটি বলেছিল, আত্মহত্যাকারীদের প্রতি খোদার লানৎ (অভিশাপ)! পিরসাহেবের সঙ্গে জিনটির তুমুল তর্কাতর্কি হয়ে যায়। পিরসাহেবের মতে, আল্লাহ দোজখের একাংশ খালি রেখেছেন আত্মহত্যাকারীদের জন্য। কাজেই আল্লাহের ইচ্ছা পূর্ণ হোক। ক্ষুব্ধ জিনটি পরে আলোর বেগে অকুস্থলে পৌঁছেও দরিয়াবানুকে আটকাতে পারেনি। সে স্তম্ভিত হয়ে দেখে, ডুমুরগাছটিকে পাহারা দিচ্ছে একদল কালো জিন। সেই জ্যোৎস্নারাতে একটা কালো দেয়ালের ভেতর নাদান এক স্ত্রীমানুষের মৃত্যু হচ্ছিল। ব্যথিত জিন ফিরে এসে পিরসাহেবকে ধ্যানস্থ দেখতে পায় এবং আসমানের দ্বিতীয় স্তরে নিজের দেশে চলে যায়। আর সে কোনোদিন ভুলেও পৃথিবীর মাটিতে পা রাখেনি।
জিনটির সঙ্গে বদিউজ্জমানের তর্কাতর্কি শুনেছিল মসজিদ-সংলগ্ন একটি বাড়ির বুড়ো-বুড়িরা। তারা জোগই রাত কাটায়। তাই সাক্ষ্য দিয়েছিল, পিরসাহেব। বেয়ানের মরতে যাওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন। জিনটি চলে যাওয়ার সময়। নিমগাছে আলোর ঝলকও দেখেছিল তারা। সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে ভেবে তারা ভোরের প্রতীক্ষায় রাত কাটাচ্ছিল।
সকালে মৌলাহাট থেকে খবর এলে হুলুস্থুল পড়ে যায়। পিরসাহেবের বেয়ানের অত্যভুত মরণঝাপের একটা উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চলে। তবে বদিউজ্জামান। ভারী একটা শ্বাসের সঙ্গে শুধু এই বাক্যটি উচ্চারণ করেন, আমি সবই জানতাম।
ইসলামে আত্মহত্যাকারীদের ক্ষমা নেই এবং নিশ্চিত অনন্ত দোজখ। আসলে শয়তান তার কালো জিনের বাহিনী নিয়ে যখন কাউকে ঘিরে দাঁড়ায়, তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার জয়লাভ ঐশী নিয়মের অধীন। নইলে আল্লাহ যে হাবিয়া থেকে জাহান্নাম পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বড়ো থেকে ছোটো সাতটি দোজখ প্রস্তুত রেখেছেন, তা পূর্ণ হবে কেমন করে? :
শিসগাঁয়ের মসজিদের খতিব, যিনি জুম্মাবারে খুৎবা পাঠ কবতেন, সেই হোসেন মোগ্লাব এই ব্যাখ্যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এব ফলে কোনো মুসলমানের মৃত্যুসংবাদ শুনে যে ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না আলাইহে রাজেউন’ দোয়াটি মূতের আত্মার শান্তির জন্য উচ্চারিত হয়, হতভাগিনী দরিয়াবানুর জন্য তা হয়নি। আব পিবসাহেবের মুখে এক সাংঘাতিক গাম্ভীর্য। তার উজ্জ্বল ফরসা রঙ নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। মৌলাহাটের লোকটি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ক্ষুব্ধভাবে ফিরে যায়। সে আশা করেছিল, পিরসাহেবের সঙ্গে গোরুর গাড়ি চেপে বাড়ি ফিরবে। যতক্ষণ যা উনি বেয়ানের এই ভয়ঙ্কর পাপের জন্য আল্লাহেব কাছে ক্ষমা চাইছেন, স্ত্রীলোকটির যে পরিত্রাণ নেই। শুধু সে নয়, মৌলাহাটের সব মানুষই পথ চেয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল। আশা করেছিল, দরিয়াবানুর লাশের সামনে জানাজা নামাজে পিরসাহেবকে দাঁড়ানো দেখবে । কিন্তু তিনি যাননি। পরে সাব্যস্ত হয়, ফবাজি মৌলানার পক্ষে কোনো আত্মহত্যাকারিণীর লাশের জানাজায় দাঁড়ানো সম্ভবত নিষিদ্ধ।
কিন্তু এসবের চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বদিউজ্জামানের ক্রমাগত দূরাপসরণ। শিসগা থেকে হাটুলি, হাটুলিতে দুটো দিন কাটিয়ে কাঁদরা, সেখান থেকে ভবানীপুর, তারপর মণিগ্রাম-বিনোটিয়া। উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় সরলরেখায় অপসরণটি ঘটছিল। মণিগ্রামে আবার বাদশাহি সড়কের দেখা মেলে। সড়কের ধারে ঢ্যাঙা শিমূলের মাথায় তখন লাল ফুল। বসন্তঋতু আসন্ন। সেখান থেকে সড়ক ধরে দশ ক্রোশ দূরত্ব পেরিয়ে যাথারীতি শিষ্যরা বস্তাভরা ধান, একটিন গুড় আর একবস্তা মসুরির ডাল পৌঁছে দিতে গিয়েছিল মৌলাহাটে।
সাইদা বেগমের বাড়ির দরজায় সারা মরশুম এভাবে শিষ্যরা গাড়িবোঝাই জিনিসপত্র পৌঁছে দিত। তারা বলত, হুজুরের তবিয়ত খোদার বরকতে ভালো। তারা একটু রহস্যময় হাসিও হাসত। বলত, আপনাদের হালহকিকত হুজুরের অজানা নাই। অর্থাৎ অনুগত শাদা জিনদের অদৃশ্য গতিবিধি সমানে চলেছে। নুরুজ্জামান তখন শাশুড়ির বাড়ির মালিক। জোতজমার মালিক। রোজি মায়ের মতো কোমরে আঁচল জড়িয়ে সংসার গুছিয়ে বসেছে। এ বাড়িতে মনিরুজ্জামান নড়বড় করে হেঁটে শিষ্যদের গাড়ির কাছে যায়। গোঙানো কণ্ঠস্বরে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করে। দলিজঘরে ধান বা খন্দের বস্তা শিষ্যেরা তুলে দেওয়ার পর সে হুংকার দিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়া শস্য কণাগুলির দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে এজন্য নুরির মা ঝাঁটা হাতে তৈরি থাকে। যত্ন করে খুঁটিয়ে সব ঝাঁট দিয়ে পাকৃতি করে! আঁচলে বা কুলোয় তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় একটু হেসে নুরির মা লোকগুলোকে জিগ্যেস করে, হুজুর কবে ফিরছেন? ওরা শুধু বলে, কী জানি! হুজুরের ইচ্ছে।
ফাগুন মাসে ধান বেচে সাইদা বউবিবি রুকুকে সোনার নথ বানিয়ে দিলেন। রোজি তার মায়ের সব গয়না পেয়েছিল। নিজে সবই পরে থাকত। কিন্তু রুকুর কথা যেন তার মনে পড়ত না। আয়মনি এসে রুকুকে সাইদার সামনে তাতে চাইত। রুকু গ্রাহ্য করত না। সাইদার সোনার নথ কিনে দেওয়ার পেছনে সেই ক্ষোভ ছিল। রুকু শাশুড়ির খাতিরে একটা দিন নথ পরেছিল মাত্র। তারপর আবার সেই শাদাসিধে বেশভুষা। উদাসীন হাঁটাচলা, চাউনি দূরে বহু দূরে, খোঁড়াপিরের পোডড়া মাজারে বটগাছের শীর্ষে নীল-ধূসর আকাশের দিকে। সেখানে কেউ উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।
আর সেই ফাগুন মাসে শিষ্যদের কাঁদিয়ে বদিউজ্জামান যখন মহুলায় যাবার জন্য গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, সেই সময় মৌলাহাট থেকে টাটু ঘোড়ায় চেপে ক্লান্ত একটি লোক ভাঙা গলায় খবর দেয়, শেষ রাতে হুজুরের আম্মাজান ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না আলাইহে রাজেউন।
আশ্চর্য, বদিউজ্জামান বলেছিলেন, আল্লাহর ইচ্ছা! শিষ্যরা গাড়ির মুখ ঘোরাতে গেলে ভসনা করে বলেছিলেন, অ্যাই নাফরমান খোদার বান্দা! তোমরা জান না মউতের জন্য শোক হারাম? প্রবাদ আছে, এরপর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে মৌলাহাটে! কামরুন্নিসার জানাজা হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, কারণ দশ ক্রোশ দূর থেকে তাঁর পুত্রের পৌঁছনোর অপেক্ষা করা হয়েছিল। আর সেই সন্ধ্যায় আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে জমাট কালো মেঘ দেখা গিয়েছিল। আগাম একটা কালবোশেখির আশঙ্কা করছিল ওরা। ক্লান্ত লোকটি টাটু নিয়ে ফিরলে বিস্মিত মৌলাহাটবাসীরা গোরস্তানে লাশ নিয়ে যায় এবং সেই সময় কালবোশখি এসে পড়ে। জানাজার সময় আরও বিস্মিত হয়ে তারা দেখে, অবিকল হুজুরের মতো লম্বা-চওড়া এবং শাদা আলখেল্লা, সবুজ পাগড়ি পরা একটি মানুষ আগের সারির সামনে লাশের কাছে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ পড়ছেন। ধুলোর পরদার ভেতর ওই দৃশ্য এমন কি মেঘের গর্জনের ভেতর চেনা গম্ভীর কণ্ঠস্বরও কেউ-কেউ শুনেছিল। ছড়বড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়লে তারা দ্রুত লাশ কববস্থ করে এবং মাটি চাপিয়ে চলে আসে। আসার সময় পিছু ফিরে কবরের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ। কিন্তু কী খেয়ালে কেউ-কেউ তাকিয়েছিল। তাদের চোখে পড়ে লম্বাচওড়া মানুষটি কবরের দিকে ঝুঁকে কাদামাটি সযত্নে সমান করে দিচ্ছেন। শিলাবৃষ্টি শুরু না হলে তারা অন্য লোকেদের তখনই কথাটা বলত। তারা হলফ করে বলেছিল, বিদ্যুতের ঝিলিকে মানুষটিকে তারা স্পষ্ট দেখেছে এবং তিনিই যে হুজুর পিরসাহেব, তাতে কোনো ভুল নেই।
তখন বদিউজ্জামান মহুলার মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন শিষ্যদের সামনে দাঁড়িয়ে। এই মসজিদটি ছিল ইটের তৈরি এবং নতুন। হুজুরকে দিয়ে মগরেবের (সন্ধ্যার প্রার্থনার) সময় এর দ্বারোদঘাটন হয়। কালবোশেখি আর শিলাবৃষ্টির দৌরাত্মের দরুন মসজিদপ্রাঙ্গণে যে ভোজসভার আয়োজন হয়েছিল, তাতে বাধা পড়ে। তবে ব্যাপারটা হাজি নসরুল্লার প্রকাণ্ড দলিজঘর আর বারান্দায় ঢুকে যেতে অসুবিধা হয়নি। তখন আর বৃষ্টি ছিল না। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হুজুর কিছু মুখে তোলেননি। বলেছিলেন, মউতের জন্য শোক হারাম। তবে শোকে নয়, আমার তবিয়ত কাল থেকে ভালো নেই। শেষে অনেক সাধাসাধির পর শুধু একগ্লাস গুড়ের শরবত খেয়েছিলেন।
সে-রাতে মহুলার কিছু অসৎ কৌতূহলী যুবক জনহীন নতুন মসজিদে বদুপিরের সঙ্গে জিনের বাতচিত দেখার জন্য ওত পাততে যায়। তাদের একজনকে সাপে কামড়ায়। সে মারা পড়ে।
মহুলা নদীর তীরে বলে গ্রামটির নাম ছিল মহুলা। লোকগুলি ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। প্রায় ষাটঘরের বসতি। কিছু অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দুরও বসবাস ছিল। তারা ছিল মৎস্যজীবী। মুসলমান পিরকে তারাও খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত এবং যে-বাড়িতে পিরসাহেবের খাওয়ার দাওয়াত, খোঁজ নিয়ে সেই বাড়িতে তারা সেরা মাছটি পাঠিয়ে দিত। জুম্মাবারে তারা দল বেঁধে স্ত্রীপুত্রকন্যা নিয়ে মসজিদের বাইরে একটা গাবগাছের তলায় ভক্তিভরে বসে থাকত! অসুখের জন্য পিরসাবের মন্ত্রপুত জল ঘটিতে করে নিয়ে যেত। পিরসাহেবের দর্শন আর আশীর্বাদ চাইত। বদিউজ্জামান বেরিয়ে আসতেন। তারা ভূলুণ্ঠিত প্রণাম করায় ক্রুদ্ধ হয়ে বলতেন, অ্যাই বেঅকুফ! করছ কী তোমরা? আমি তোমাদের মতনই এক মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে মাথা নোয়াতে নেই। নোয়বে শুধু ওই আল্লাহের কাছে।
তারা কুণ্ঠিতভাবে জড়োসড়ো হয়ে তাকিয়ে থাকত। আসলে তারা এই মুসলিম ‘পির’কে ভাবত এক অলৌকিক শক্তিধর পুরুষ। তারা তাঁর কাছে যাচ্ঞা করতে আসত নদীর সঙ্গে লড়াই করার শক্তি। নদীটি ছোট্ট হলেও তার নিষ্ঠুরতা ছিল অসামান্য। বর্ষার পর থেকে তার হিংস্রতা যেত বেড়ে। এপাড়ের বাঁধ ভেঙে কতবার সর্বনাশী হয়ে ঘরসংসার ভাসিয়ে দিয়েছে লোকের। হাজি নসরুল্লাও বদুপিরকে এনেছিলেন এর একটা হিল্লে করতেই। নসরুল্লা আড়ালে মুচকি হেসে বলতেন, আর ডর নাই বাছারা। হুজুর বাঁধে হেঁটেছেন, বাঁধ পাথর হয়ে গেছে।
বদিউজ্জামান যতদিন মহুলায় ছিলেন, প্রতি বিকেলে অভ্যাসমতো বেড়াতে বেরুতেন। নিষেধ থাকায় কেউ তাঁর সঙ্গে যেত না– যেতে চাইত না। ওঁকে একা রাখতে চাইত। আর হুজুর তাঁর ময়ূরমুখো ছড়িটি নিয়ে বাঁধ ধরে বহুদূর হেঁটে যেতেন। বিকেলে কোনো ঘাসজমিতে একা ‘আসরে’র নামাজ পড়ে নিতেন। ‘মগরেবের’ সময় ফিরে আসতেন মসজিদে। একদিন ফেরার পথে বাঁধের ওপর ফণা-তোলা একটি সাপের মাথার ছড়ির ঘা মারেন বদিউজ্জামান। সাপটি সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে। সেই মরা সাপ ছড়িতে ঝুলিয়ে তিনি গাঁয়ে ফেরেন। খুব ভিড় জমে যায়। সাপটিকে আগুন জ্বেলে পোড়ানো হয়। গুজব রটে যায়, এই সেই শয়তান সাপ, যে নুহু নামে এক যুবককে কামড়েছিল। তবে তার চেয়ে বড়ো ঘটনা বাঁধের পাথর হয়ে যাওয়া। প্রতি বিকেলে মহুলার পুবে বা পশ্চিমে হুজুর নদীতীরে বাঁধ বরাবর হেঁটে যান, প্রতি সকালে বাঁধটি পরীক্ষিত হয়। লোকেরা বাঁধটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মাতে থাকে, এই শাদা আর ধূসর মাটির বাঁধ অবশ্যই পাথরে পরিণত হতে চলেছে। হাজি নসরুল্লা চাপাস্বরে বলতেন, আল্লার ইচ্ছায় আর হপ্তাটাক। হপ্তাটাক ওঁয়ার জুতো খেলেই ব্যাটা শায়েস্তা হয়ে যাবে।
হয়ে যেত। বাধা পড়ে গেল। এক সন্ধ্যায় মগরেবের নমাজের পর মসজিদপ্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে প্রবীণেরা চাপা স্বরে চাষবাসের গল্প করছে, বদিউজ্জামান। মসজিদের ভেতর রেড়ির তেলের আলোয় ফারসি শাস্ত্র খুলে বসেছেন, হঠাৎ একটা কালোরঙের ঘোড়া আঁধার ফুড়ে বেরিয়ে এল। লোকগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল। ঘোড়াটি উঁচু। মহুলায় এক সময় হাজি নসরুল্লার একটি ঘোডা ছিল বটে, কিন্তু সেটি নিছক টাটু। তার পিঠে ছেলেপুলেরা যখন-তখন চেপে বেড়াত। ছোটানোর চেষ্টা করত। এই করতে গিয়ে বাঁধ থেকে বেচারি টাটু সোজা নদীতে পড়ে যায়। নদীতে স্রোত ছিল। সে ভেসে যায় এবং পরে তার মড়া পাওয়া গিয়েছিল বহু দুরের এক বাকের মুখে। শেয়ালেরা তাকে টেনে চড়ায় তুলেছিল। এক বেলাতেই তার মাংস ফুরিয়ে যায় এবং শকুনেরা নাকি ঠোঁট চেটে চেটে শেয়ালগুলোকে গাল দিতে দিতে আকাশে উড়ে যায়। এই গল্পটা খুব রসিয়ে বলতে পারত নুহ, সেই সপেকাটা যুবকটি। সন্ধ্যাব অভাবিত এই উঁচু ঘোড়াটি দেখলে রসিক যুবক অন্য কোনো গল্প বানিয়ে নিতে পারত। ঘোড়ার সওয়ারকে নিয়েও তুখোড় একটি গল্প ফাঁদতে পারত। সে। কাবণ এমন ঘোড়সওয়ারও এ তল্লাটে কেউ কখনও দ্যাখেনি। গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সেই ঘোড়সওয়ার বলেছিলেন, এটা কি মহুলা?
লোকগুলো আড়ষ্টভাবে জবাব দিল, জি হ্যাঁ। এটাই মহুলা বটে।
এখানে কি মৌলাহাটের পিরসাহেব আছেন?
তারা একসঙ্গে হল্লা করে বলল, আছেন, আছেন। হুজুর আছেন।
সেই সময় কালো ঘোড়াটি হ্রেষাধ্বনি করল। কেন যেন ভয় পেয়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিল সে। সামনেকার দুই ঠ্যাং তুলে অন্য ধারে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিল। তাকে শান্ত করার পর সওয়ার নামলেন। ঘোড়াটি তখন স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার চোয়ালে একবার হাত বুলিয়ে সওয়ার মসজিদের দিকে এগিয়ে গেলেন। সম্ভাষণ করলেন, আসোলামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুম আস্সালাম।
বারান্দার চুনকামকরা থামের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন বদিউজ্জামান। ঘোড়ার আওয়াজ শুনেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। আগন্তুক করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালে তিনি দুহাতে হাতখানি গ্রহণ কবলেন। তাঁর মনে ঝড় শুরু হয়েছিল। অতিকষ্টে দমন কবে আস্তে বললেন, ভেতরে আসুন দেওয়ানসাহেব।
দেওয়ান আব্দুল বারি চৌধুরি নাগবাজুতো খুলে বাবান্দা উঠলেন। তাঁব বা হাতে বন্দুক ছিল। বন্দুকটি নিয়ে খোদাব ঘরের ভেতরে ঢোকা উচিত হবে কি না ভেবে একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন। সেটা লক্ষ্য কবে বদিউজ্জামান একটু হেসে বললেন, নিয়ে আসুন। ইসলাম কালাম (ঐশী বিদ্যা) আব হাতিয়াব দুই-কেই সমান ইজ্জত দেয়। আমার বসুলে কবিম (সাঃ) নিজে হাতিয়াব ধরে লড়াই করেছিলেন। আসুন।
কিন্তু তাঁর মনে ঝড় উঠেছিল। হঠাৎ এই অজ পাড়াগাঁয়ে দেওয়ানসাহেব এভাবে এসে পড়েছেন, নিশ্চয় তার কোনো মজবুত কাবণ Tছে। বদিউজ্জামান গালিচাব একাংশ দেখিয়ে বললেন, বসুন। বারি চৌধুবী গালিচায় বসলেন না। নগ্ন চুনকংক্রিটেব মেঝেয় বসে পড়লেন। তাঁকে ভীষণ গম্ভীব দেখাচ্ছিল।
বদিউজ্জামান গালিচায় বসে তাঁকে দেখতে-দেখতে বললেন, কোনো জরুরি খবর আছে দেওয়ানসাহেব?
বারি মিঁয়া আস্তে বললেন, ভেবেছিলাম আমাকে চিনতে পারবেন না।
বদিউজ্জামান মুখে সরল হাসির ছটা তুলে বললেন, আল্লাহের দুনিয়ায় কিছু কিছু চেহারা মনে খোদাই করে রাখার মতো।
আমি গোনাহগার মানুষ পিরসাহেব। আমাব তারিফ কববেন না। বারি মিঁয়া হাসবার চেষ্টা করে বললেন। হরিণমারার ছোটোগাজির মুখে আমার কুফবি (বিধর্মীসুলভ) চালচলনের কথা শুনে থাকবেন। যাই হোক, আপনার খোঁজে আজ প্রায় সারাটা দিন কেটে গেছে। আমার বরাত। আপনার দেখা পেলাম অবশেষে।
বদিউজ্জামান গম্ভীব হয়ে বললেন, খবব বলুন দেওয়ানসাহেব।
আপনি শফির খবর রাখেন?
বদিউজ্জামান চমকে উঠলেন। নিষ্পলক দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, শফিব খবর। সে তো আপনার রাখার কথা। কেন দেওয়ানসাহেব?
শফির সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি? আপনার কাছে আসেনি সে?
না। কেন –কী হয়েছে তার?
বারি মিঁয়া গলার ভেতর বললেন, প্রায় সাতদিন হতে চলল, তার পাত্তা নেই।
বদিউজ্জামান ঝুঁকে এলেন তাঁর দিকে। তাঁকে কুদ্ধ দেখাচ্ছিল। শ্বাস প্রশ্বাসজড়ানো গলায় বললেন, কেন পাত্তা নেই? তাকে আমি আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আপনি তার জিম্মাদার। আর আজ আপনি আমার কাছে তার খবব নিতে এসেছেন। আজ্জব।
বারি মিঁয়া মৃদুস্বরে বললেন, ওকে লালবাগে নিয়ে গিয়েছিলাম। হবিণমারা স্কুলে থাকলে ওর পড়াশোনা হবে না ভেবে কাছে বেখেছিলাম। নবাব বাহাদুব ইন্সটিটিউশনে বাইরের ছেলেদের ভরতি করে না। ওটা নবাব ফ্যামিলির প্রাইভেট স্কুল। তো–
বদিউজ্জামান প্রায় গর্জন করে উঠলেন, কুফরি বাত ছাড়ুন। সাফ-সাফ বলুন, কেন শফি চলে এল?
মাথা নেড়ে দুঃখিত স্বরে বারি মিয়াঁ বললেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ অমন করে চলে আসার পর আমি মৌলাহাটে গেলাম। গিয়ে শুনি, রোজি-রুকুর মা সুইসাইড করেছে। শফি সেখানে যায়নি। আবার ছুটে গেলাম হরিণমারায় বড়োগাজির কাছে। খোনকারসাহেবের কাছেও গেলাম। শফি যায়নি। তারপর ভাবলাম আপনার কাছে এসেছে নাকি।
বদিউজ্জামান চুপ করে থাকলেন। মুখটা নিচু। পিদিমের সামান্য আলোয় তাঁর চোখদুটি চিক চিক করছিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভাঙা গলায় বললেন, আপনি শফির জিম্মাদার! তার ভালোমন্দের সব দায় আপনার।
জি হ্যাঁ।
শফিকে আমি আংরেজি কালাম শিখতে দিয়েছিলাম! বদিউজ্জামান আবেগপ্রবণ মানুষ। এই কথাটি বলেই অবোধ বালকের মতো ফুঁপিয়ে উঠলেন। শয়তান আমাকে জাদু করেছিল। হা আল্লাহ! সেই গোনাহগারির এই খেসারত!
প্রার্থনায়, ভাষণে, মজলিশে উদাত্ত কণ্ঠস্বরে পবিত্র বাক্য আবৃত্তি করতে করতে হুজুর পিরসাহেবকে তাঁর সব শিষ্যই এভাবে কাঁদতে দেখেছে। মহুলার শিষ্যরা ততক্ষণে ভিড় করে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। তারা ভেতরে ঢুকতে ভরসা পাচ্ছে না। বাইরে গ্রামের পথে গাবগাছটার তলায় ঘোড়াটা তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে নদীর ওপারের আকাশে প্রকান্ড জালার মতো মেটেরঙের চাঁদটা উঠছিল। সেই পাংশু ছটায় কালো ঘোড়াটিকে অলীক দেখাচ্ছি– যেন এক পক্ষিরাজ। মেয়েরা একটু দূরে পিদিম হাতে দাঁড়িয়ে ওই অলৌকিককে প্রাণ ভরে উপভোগ করছিল। তাদের কেউ-কেউ হাসাহাসি করে বলছিল, নুহ বেঁচে থাকলে বড়ো মজা হত। মজাটা কী হত, বলা কঠিন। তবে নহ নিশ্চই ওই আশ্চর্য প্রাণীটির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারত।
বাইরে চটুল এবং চাপা হাস্যপরিহাস, ভেতরে ক্রন্দন। বিব্রতমুখে বারি মিয়াঁ বললেন, হুজুর পিরসাহেব! আপনি বুজুর্গ আলেম। এই সামান্য ব্যাপারে আপনার অস্থির হওয়া শোভা পায় না। আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম, শফি আপনার কাছে এসেছে কি-না।
সবুজ পাগড়ির প্রান্ত নাকে চোখে ঘষে বদিউজ্জামান সংযত হলেন এবার। ভাঙা গলায় বললেন, আপনি শফির আম্মার সঙ্গে দেখা করেছেন?
জি হ্যাঁ।
তিনি কী বলছেন?
পদ্মার ধারে ভগবানগোলার ওদিকে ওঁর ভাইয়ের বাড়ি। সেখানে গিয়ে থাকতে পারে!
যাবে না। বদিউজ্জামান গলার ভেতর বললেন। যায়নি।
কেন?
শফির মামুজি এক শয়তান। নেশাভাং করে। খুদ জাহান্নামি শয়তান সে।
তবু একবার দেখে আসব। বারি চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন!…ঠিকানা নাম সবকিছু লিখে নিয়েছি শফির মায়ের কাছে।
বলেই বন্দুকটি কাঁধে তুলে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন। বদিউজ্জামান তাঁকে রাতের মেহমানির কথা বলার সুযোগই পেলেন না।
বাইরের ভিড় দেখল, কালো ঘোড়াটি কী ভাবে মুছে গেল– যেন পিছলে চলে গেল হলুদ জ্যোৎস্নার গা বেয়ে। তারপর বহুক্ষণ শুকনো মাটিতে খুরের শব্দ হতে থাকল খট খট খটাখট…খটা খট খটাখট–
মসজিদের বারান্দা থেকে কুণ্ঠিত মুখগুলি উঁকি দিচ্ছিল। বদিউজ্জামান গলা ছেড়ে ডাকলেন, হাজিসাহেব আছেন কি?
কেউ বলল, হাজিসাহেব নদীর পারে গেছেন ভুই দেখতে। খবর দিই হুজুর?
জি। জলদি খবর ভেজুন।
সে ছুটে বেরিয়ে গেল। নদীর ওপরে বোরো ধানের জমিতে কোথায় মুনিশেরা সেচ দিচ্ছে রাতভর এবং হাজি নসরুল্লা তার তদারক করছেন, সে জানে।….
হুজুরের তলব পেয়ে হাজি নসরুল্লা কাদা ধোওয়ার কথা ভুলে হাঁফাতে-হাঁফাতে গাঁয়ে ফিরেছিলেন। ফতুয়া লুঙ্গি আর টুপিতে প্রচুর কাদা। মসজিদের বারান্দায় উঠেই তিনি থ। ভেতরে মুসল্লি প্রবীণেরা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। হুজুর হাত তুলে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ব্যাপারটা কী, বুঝতেই সময় লেগেছিল। তারপর যখন। শুনলেন, হুজুর এখনই তাঁদের ছেড়ে চলে যাবেন এবং গাড়ি সাজাতে বলেছেন, তিনিও বিকট শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। বদিউজ্জামান বললেন, তওবা! নাউজুবিল্লাহ! আপনারা কি নাদান, না বেঅকুফ?
হাজি নসরুল্লা ভেতরে ঢুকে পায়ের কাছে আছড়ে পড়লেন। বিদায়ের সময় একটা চিরাচরিত রীতি বা দৃশ্য। কিন্তু বদিউজ্জামান বুঝতে পারছিলেন, মহুলার এই মানুষগুলো একেবারে আলাদা রকমের। কথায়-কথায় এরা যেমন খুনোখুনি করতে পারে, তেমনি কেঁদে বান ডাকিয়েও দেয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি এ ব্যাপারটা সহজভাবে নিয়েছেন। নিজেও প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু সে-মুহূর্তে তাঁর অসহ্য লাগছিল। তিনি শেষে কুদ্ধভাবে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এখনই গাড়ির ইন্তেজাম না হলে আমি পায়দল রওনা হব। বলুন আপনারা, কী চান?
হাজি নসরুল্লা চোখ মুছে বললেন, তাই হবে হুজুর! আগে দুমুঠো খানা তো খেয়ে নেন। এশার নামাজের পর গাড়ি ছাড়বে। ইনশাল্লাহ।
.
মহুলার একমাস পরে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরুতে পেরেছিলেন বদিউজ্জামান। মহুলা থেকে কোনো রাস্তা নেই। মাঠের জমির আল কেটে দুফালি চাকাগড়ানো ‘লিক’-রাস্তা করা হয় শুখার কয়েকটা মাস। বর্ষায় কাটা আলগুলো বুজিয়ে জমিতে জল ধরে রাখে চাষীরা। তারপর সেই শীতে ধানকাটা হয়ে গেলে আবার লিক-রাস্তাটা গড়ে ওঠে ক্রমশ। সেই লিক-রাস্তা ধরে দুক্রোশ এগিয়ে তবে বাদশাহি সড়ক। মৌলাহাট দশ ক্রোশ দূরত্ব। পৌঁছুতে পরদিন সন্ধ্যা হওয়ার কথা। কিন্তু খবর ছোটে বাতাসের আগে। সারা রাস্তায় যত গ্রাম, ততবার অলৌকিক শক্তিধর –বুজুর্গ-পুরুষ বদুপিরের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জনতা। হানাফি ফরাজি কোনো বাছাবাছি নেই। ততদিনে বটুপির মজহাব বা সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন। প্রতি গ্রামে তাঁর গাড়ি পৌঁছয়, দেখা যায়, আগে থেকে খবর পেয়ে প্রস্তুত মুসলমান-জনতা রাস্তায় অপেক্ষা করছে। এমনকী হিন্দুরাও তাঁকে উদ্দেশ করে কপালে হাত ঠেকায়। গাড়ি ছিল দুটি। একটিতে তিনি, পেছনেরটিতে কয়েকজন মহুলাবাসী শিষ্য ধান-খন্দের কয়েকটা রাস্তা নিয়ে। তাদের সঙ্গে লাঠি-টাঙ্গি-বল্লম এবং একটা তলোয়ার ছিল। বাদশাহি সড়কে রাহাজানি হয় প্রায়ই। তাই এই সতর্কতা। বদিউজ্জামান গাড়োয়ানের ঠিক পেছনে বসেছিলেন, হাতে তসবিহ বা জপমালা। মাথায় সবুজ রেশমি পাগড়ির শীর্ষে শাদা ছুঁচলো টুপিটি দেখা যাচ্ছিল। পরনে ঢিলে শাদা আলখেল্লা। বাঁহাতের কড়ে আঙুলে চাঁদির মোটা আংটি –তবে ওটা নিছক আংটি নয়, তাঁর সিলমোহর। আরবিতে নিজের নাম খোদাই করা আছে। কাজললতার কালি মাখিয়ে কাগজে ছাপ দিলে সেটি শাস্ত্রীয় দলিল বলে গণ্য হয়। বহু বিবাদের নিষ্পত্তি, শরিকি সম্পত্তি বাঁটোয়ারা, কোনো জটিল সামাজিক ঘটনায় বা ব্যক্তিগত বিষয়ে ‘ফতোয়া’র প্রামাণিকতা সিদ্ধ করে ওই চাঁদির আংটিটি। সারা রাস্তা সেবার তাঁর বড়ো বেশি দেরি করিয়ে দিচ্ছিল লোকেরা। দিনের নমাজগুলো কোনো-না-কোনো গ্রামের মসজিদে সেরে নিতে হচ্ছিল। আর নমাজ শেষ হলেও তাঁকে ওরা ছাড়তে চায় না। বহু সমস্যার ফয়সালা করে দিতে হয়। সিলমোহরে ছাপসহ ফতোয়া লিখে দিতে হয় কাগজে। তবে প্রচুর সেলামি পড়ছিল। তাঁর আলখেল্লার একটি জেব টাকাকড়িতে ভরতি হয়ে গিয়েছিল।
অথচ মনে এতটুকু শাস্তি ছিল না বদিউজ্জামানের। অস্থির হয়ে ভাবছিলেন, এর চেয়ে যদি দেওয়ানসাহেবের মতো তাঁর একটি তেজী ঘোড়া থাকত, তিনি পাখিওড়া পথে কখন পৌঁছে যেতেন মৌলাহাটে। এতদিনে বুঝতে পারছিলেন, তিনি যেন একটা ফাঁদে আটকে গেছেন। এই ফাঁকে ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে চলার জন্যই তিনি এক গ্রামে বেশিদিন বাস করতেন না। অথচ কী ভাবে খুব সহজেই ফাঁদে পড়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত! এখন তার দিকে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য অদৃশ্য চোখ– তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। একা হতে চান, একা বেরিয়ে পড়েন। তবু ওই তীক্ষ্ণ সজাগ ঝাঁকে ঝকে চোখ পেছনে অলক্ষ্যে থেকে তাঁকে দেখে। আহারে নিদ্রায় ভ্রমণে প্রার্থনায় ধ্যানে শয়নে সর্বত্র সর্বদা যেন হাজার-হাজার চোখ তাঁর প্রতি নিবদ্ধ। নাদান বেঅকুফ! ওরা তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ও কাজে ‘মোজেজা অন্বেষণ করে। নিশীথ রাত্রির বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অনুভব করার জন্য যখন তিনি ভোলা আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়ান, ওরা ভাবে একটা মোজজা ঘটতে চলেছে। তাঁর হাতের ময়ুরমুখো ছড়িটি দেখে ওরা কি ভাবে তিনি হজরত মুসার মতো দরিয়ার পানি দুভাগ করতে পারেন? উজবুগ, বুড়বক, গোমরাহ!
হুজুর!
গাড়োয়ান ঘুরে তাকে প্রশ্ন করছিল। বদিউজ্জামান বলেছিলেন, কিছু না।
গাড়োয়ান হলুদ দাঁতে হেসে বলেছিল, আর এসে পড়েছি বলে! ইনশাল্লা! ফজরের নামাজ মৌলাহাটের মসজিদেই পড়ব দেখবেন। আপনার মেহেরবানিতে, হুজুর, বলদ দুটো কেমন টগবগিয়ে পা ফেলছে দেখছেন?
এই বলে সে বলদ দুটোর লেজ খামচে বিকট চেঁচিয়ে উঠেছিল, ইর্র্র হেট্ হেট্! লে লে লে…হুদ্দে হুদ্দে হুদ্দে…
.
.
সাইদা খবর পেয়েছিলেন আগের দিন সন্ধ্যায়। ইন্দ্রাণীর হাটে গিয়েছিল কারা, তারা খবরটা পায়– হুজুর মদনপুর থেকে রওনা দিয়েছেন। রুকু হিসেব করে, বলেছিল, পৌঁছতে রাতদুপুর হরে। মনিরুজ্জামান কীভাবে ব্যাপারটা আঁচ করে আগের মতো মুখে হাত ভরে আপনমনে খ্যাখ্যা করে হেসে উঠেছিল। সাইদা বেগম নির্বিকার মুখে রান্না করছিলেন। মুরগির গোস্ত, খেজুরথড়ি চালের পোলাও, সেদ্ধ করে রাখা বাসি গোরুর গোস্তের কোপ্তা। সারা সন্ধ্যা রুকু শিলনোড়ায় গোস্তটা থেঁতলে নরম করেছিল। বাড়িতে কয়েকটা আলো এ রাতে। আয়মনি এসেছিল এশার নামাজের পর। পা ছড়িয়ে বারান্দায় বলে চাপাস্বরে রোজির সংসারের গল্প করছিল। শফির নিপাত্তা হওয়ার খবরে সে কান করেনি। বলেছিল, আছে কোনোখানে। বাপের স্বভাব। ঠিকই মা বসে ডেকে বাড়ি ঢুকবে। সাইদা কোনো মন্তব্য করেননি। দুদিন আগে দেওয়ানসাহেবকে Tড়াল থেকে বলে দিয়েছেন, শফি আমার মরা ছেলে। ওর কথা আমার মনে পড়ে না দেওয়ানসাহেব।
এদিন শফির আব্বা আসবেন শুনে শফির কথাই বেশি করে মনে পড়ছিল সাইদার। প্রস্তুত হচ্ছিলেন মনে-মনে, সামনে এসে দাঁড়ালেই জামা খামচে ধরে আকাশচেরা গলায় বলবেন, আমার শফিকে ফিরিয়ে এনে দাও! তোমার না জিনের পাল পোষা আছে, শুনি! বলো তাদের, এখনই এনে দিক আমার বুকের মানিককে। নইলে তোমার নিস্তার নেই।
রুকু দেখছিল, বিবিজি বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরছেন। যেন কার সঙ্গে ঝগড়া করছেন। চোখ নিষ্পলক! নাসারন্ধ্র স্ফুরিত!
দুখু শেখ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সাড়া দিচ্ছিল, মাজান! বিবিজান গো!
সাইদা তাকে দেখা দেন না। আয়মনি কান করে শুনে ফিক করে হাসল। ওই গো, খবর হয়েছে!
না –এখনও খবর হয়নি। দুখু শেখ জানিয়ে গেল, বানারিপুরে হুজুর এশার নামাজ পড়েছেন। আসতে ভোর হয়ে যাবে। দুদণ্ড বেলাও হতে পারে।
সাইদা শ্বাস ছেড়ে বললেন, বউবিবি! শোও গে যাও! আয়মনি, বাড়ি যাবি না শুবি আমার কাছে?
আযমনি বললে, একটু দাঁড়ান বিবিজি! বাপজানকে বলে আসি।
আযমনি বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে নুরুজ্জামান এল হন্তদন্ত। আম্মা! আম্মি! আব্বাসাব আসলেন?
না।
নুরুজ্জামান উঠানে দাঁড়িয়ে বলল, তাজ্জব।
উঠোনে চাঁদের আলো সবে পৌঁছেছে। কুয়োর কাছে রুকু কী একটা করছিল। নুরুজ্জামান দেখল, তার ভ্রাতৃবধূ হাতে বদনা নিয়ে টাট্টিঘরের দিকে চলেছে। সে মাঝখানের ঘরটার দিকে তাকাল। মনিরুজ্জামান তাপোশের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে খুব দুলছে। নুরুজ্জামান চোখ সরিয়ে নিল।
সাইদা বললেন, বসবি না নুরু?
নাঃ। যাই আম্মি! মসজিদ থেকে সোজা আসছি। শোচ করলাম কী, আব্বাসাব আসলেন নাকি দেখে যাই!
নুরুজ্জামান চলে গেলে সাইদা ক্ষুব্ধভাবে আপন মনে বললেন, ঢং! আব্বাসাব এলে মসজিদে খবর হবে না কি বাড়িতে খবর হবে! দুশমন– সব্বাই দুশমন!
রুকু বেরিয়ে বলল, কিছু বলছেন বিবিজি?
সাইদা গম্ভীর মুখে বললেন, না। শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।
আয়মনিখালা আসুক।
সাইদা ধমক দিলেন, শোও তো তোমরা।
মনিরুজ্জামান গোঙানো গলায় যেন গান গাইবার চেষ্টা করছিল। ভুতুড়ে শব্দটা ভারি বিরক্তিকর। কিন্তু কেন মনি আজ এত খুশি, বুঝতে পারছিলেন না সাইদা। ওর আব্বা তো জন্ম দিয়েই খালাস। কোনোদিন ভুলেও কি তার দিকে একবার। তাকিয়েছে? তাকালে কবে ও পুরোপুরি মানুষ হয়ে যেত।
সেই মুহূর্তে সাইদা বেগম আরও শক্ত হয়ে গেলেন।…
সে রাতে সাইদা চেয়েছিলেন মজবুত এক উদাসীনতা। প্রবলভাবে ঘুমোতে চেয়েছিলেন, এমন ঘুম যেন কেউ এসে ডাকাডাকি করে ফিরে যাক। কিন্তু উদাসীনতা, ঘুম বা শক্ত ভাবটা শেষ পর্যন্ত তিনি ধরে রাখতে পারেননি। আয়মনি গাঢ় ঘুমে কাঠ। সাইদার ঘুম নেই। বাদশাহি সড়কে সারারাত গাড়ি চলার গড়গড় কোঁচ কোঁচ অদ্ভুত সব শব্দ হয়। মাঝে-মাঝে ভেসে আসে ঘুমঘুম গলায় গাড়োয়ানের গানের সুর। সে রাতে প্রতিটি শব্দের স্বাদ যাচাই করেছিলেন সাইদা। দুরের গাড়ির চাকার শব্দ শুনতে শুনতে প্রতীক্ষা করছিলেন কখন শব্দটা এসে তাঁর খুব কাছে, হয়তো বা বুকের পাঁজরের কাছে এসে থেমে যাবে।
কিন্তু কোনো চাকার শব্দই থামল না। তাঁর বুক মাড়িয়ে মাথার খুলির ভেতর একটি গুরুভার গাড়ির দুটি চাকা গড়িয়ে যেতে থাকল অনন্তকাল, আজীবন।
বদিউজ্জামানের খবর এল সকালে। দুখু শেখ খবর এনেছিল। হুজুর পিরসাহেব ফজরের নামাজ পড়েছেন হরিণমারায়। ছোটোগাজি ছাড়েননি। এবেলা হরিণমারায়। থাকবেন। বিকেলে রওনা দেবেন। দুখু শেখ হুজুরের আসন্ন প্রত্যাবর্তনের ‘নমুদ (সাক্ষ্য) হিসেবে একটি গোরুর গাড়িকে রাস্তা দেখিয়ে এনেছিল। গাড়িটিতে শস্যের বস্তা, জালাভরতি গুড়, কয়েকটা কুমড়ো। দুখু সদর দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ঘোষণা করছিল এইসব খবর। সাইদা তাকে দেখা দেন না। রুকু ঘোমটা টেনে দলিজঘরের দরজা খুলে দিল। তারপর সাইদা দেখলেন, মনিরুজ্জামান নড়বড় করে হেঁটে দলিজঘরের দিকে চলেছে। বুঝলেন, আব্বা কী নমুদ পাঠিয়েছেন, তা দেখার জন্যই যাচ্ছে সে। রুকু তার পাশ কাটিয়ে সরে এল। সাইদার ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি জানেন, দরিয়াবানুর এই মেয়েটি তাঁর মেজো ছেলেকে ঘৃণা করে।
.
তখন বদিউজ্জামান হরিণমারায় গাজিদের দলিজঘরে বসে আছেন বড়োগাজির পালঙ্কে। ছোটোগাজি হুজুরের শিষ্য। খাসি কেটে ভোজসভার আয়োজনে ব্যস্ত। আর বড়োগাজি বিনীতভাবে একটা চেয়ারে বসে শাস্ত্র-আলোচনা করছেন পিরসাহেবের সঙ্গে। বলছেন, আপনি ঠিকই বলেছেন হুজুর! নাফরমানি-বেইমানির জন্যই মুসলমানের শাহি বরবাদ হয়েছে। আজ সে রাস্তার ফকির। আর আপনি ওই সে বললেন, ইংরেজ মুসলমানের দুশমন, সেও ঠিক! নানা ফিকিরে সে হিন্দুদের লড়িয়ে দিচ্ছে মুসলমানের সঙ্গে। তবে আমার মতে, হিন্দুদের সঙ্গে লড়তে হলে তাদের মতো ইংরেজিবিদ্যা শেখা এখন মুসলমানের ফরজ। এ বিষয়ে হুজুরের মত জানতে পারলে খুশি হই।
বদিউজ্জামান দেখামাত্র টের পেয়েছিলেন লোকটি ভঙ। তার এই ঘরভরতি বিলায়তি জিনিস, আংরেজি কেতাব! লোকটির চোখেমুখে চালাকি ঠিকরে বেরুচ্ছে। কিংবা এটা তার আংরেজি এলেমেরই পরিণাম। বদিউজ্জামান আস্তে বললেন, আমাদের একহাতে লড়াই করতে হবে হিন্দুদের সঙ্গে, অন্যহাতে আংরেজশাহির সছে।
বদিউজ্জামানের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। অথচ বড়োগাজির কথার জবাব ভদ্রতাবশে দিতে হচ্ছে। একে-একে গ্রামের মান্যগণ্যেরা এসে জুটলে বড়োগাজির হাত থেকে একটু রেহাই পাওয়া গেল। কিন্তু এবাও তেমনি নাছোড়বান্দা। হুজুরের মুখে শাস্ত্রীয় তত্ত্ব শুনতে আগ্রহী। হুজুরকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল। ছোটোগাজি এসে অবশেষে বাঁচিয়ে দিলেন। তাড়া দিয়ে বললেন, জোহরের নমাজের সময় মসজিদে ওসব কথা হবে। আপনারা এবার মেহেরবানি করে হুজুরকে একলা থাকতে দিন। উনি বড় পেরেসান। মহুলা কি এখানে?
লোকগুলো চলে গেলে বড়োগাজি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, খানার কী ইন্তেজাম করলেন?
মইদুর বললেন, খাসি জবাই হয়েছে।
বড়োগাজি সইদুর বাঁকা হাসলেন। বদিউজ্জামানের দিকে ঘুরে বললেন, আমাদের এই এক বদনসিব হুজুর। হরিণমারায় গোরু হালাল করা বারণ। হিন্দু জমিদারের মাটি। অনেক লড়াই করেছি।
বদিউজ্জামান আনমনে বললেন, মাটি আল্লাহতায়লার।
বড়োগাজি ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আমি কয়েকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই যে বললাম, মুসলমান নিজেই যদি নাফরমান-বেইমান হয়, তাহলে? হরিণমারার মুসলমান আমার হুকুমে খুন দিতে রাজি; কিন্তু এই কাজটি বাদে। ওরা বলে, চিরকাল এরকম চলছে। বাড়তি ঝামেলা করে কী হবে?
ছোটোগাজি মুখটিপে হেসে বললেন, তুমি দেখো না এবারে কী করি। হুজুরকে এতদিন বাদে যখন পেয়েছি, তখন আল্লাহ ভরসা। সামনে বকরিদের দিন হুজুর এখানেই এসে
বদিউজ্জামান কথার ওপর বললেন, ইশা আল্লাহ। আমি নিজের হাতে হালাল করব।
বড়োগাজি নেচে উঠলেন।…মৌলাহাটের তামাম মুসলমানকে জেয়াফত করব বকরিদের নামাজে।
ছোটোগাজি বললেন, হুজুরের হুকুমে নিজের জান কোরবান করব।…
বারি চৌধুরী হরিণমারার গাজিভ্রাতৃদ্বয়কে বলতেন ডনকুইক্সোট-সাংকোপাঞ্জা। সেবার বকরিদ পড়েছিল বর্ষাকালে। হরিণমারায় গোরু কোরবানি নিয়ে এলাকায় বড় রকমের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়েছিল। স্থানীয় পুলিশের তা থামানোর সাধ্য ছিল না। মুসলিম অধ্যুষিত মহকুমা। এস ডি ও বাহাদুর ছিলেন এক অস্ট্রেলিয়ান সায়েব। সারকেল অফিসার মুসলিম। শেষ পর্যন্ত একটা ফায়সালা হয়ে যায়। গোরু কোরবানি চলবে, তবে সদর রাস্তা থেকে অনেকটা আড়ালে। মসজিদের পেছনে আগাছার জঙ্গলে ভরা পোড়ো জমিটাকে এজন্য চিহ্নিত করে যান। এস ডি ও চার্লস প্যাটারসন। খবর পেয়ে সদর শহর থেকে খানবাহাদুর গরিবুল্লা হক পর্যন্ত এসে হাজির হরিণমারায়। শুধু আসেননি বারি চৌধুরী। কিন্তু মুসলমানদের এ একটা জয় তো বটেই এবং হুজুর পির বদিউজ্জামান এর মহানায়ক। গুজব রটে। যায়, কোরবানির দিন ইদগাহের প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে বাঁজা ডাঙা অব্দি যে নামাজিদের দেখা গিয়েছিল, তাদের একাংশ ছিল মানুষবেশী জিন। বিলপারের গ্রাম ঝিঙেখালির ডানপিটে গোয়ালার দল উলুশরার মাঠে এসে জিনের পাল্লায় পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তারা অগত্যা ফিরে যায় নাকাল হয়ে। আবার এও শোনা যায়, গোয়ালারা তাদের বাঁজা আর বুড়ো গোরুমোষের বাড়তি খদ্দের জোটায় ভেতর ভেতর খুশিও হয়েছিল। মৌলাহাটের হামদু কশাই নাকি এই গোপন খবরটা দেয়।…
তো সে অনেক পরের কথা। বদিউজ্জামান সেদিন মৌলাহাট রওনা হন বিকেলের নামাজ পড়ার পর। ছোটোগাজি তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন। মৌলাহাটে পৌঁছুতে এশার নামাজের সময় হয়ে যায়। ফলে হজুরকে প্রথমে মসজিদেই অবতরণ করতে হয়। নামাজ শেষে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, মাথায় শাদা টুপি, পরনে কোর্তা-পাজামা, মুখে দাড়ি– একটি তরুণ নড়বড় করে ভিড় ঠেলে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তার মুখে অজস্র লালায় ভেজা হাসি ঝলমল করছে। নুরুজ্জামান পিতার পেছনের সারিতে ছিল। সে বলে উঠে, আব্বাসাব! মনিকে পহচান করতে পারলেন কি? আর প্রধান শিষ্যরা কোলাহল করে বলে ওঠেন, হুজুরের মোজেজা! মারহাবা! মারহাবা!
মোজজাই বটে! বদিউজ্জামান বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে এই প্রথম মেজো ছেলেকে আলিঙ্গন করলেন।
শোনা যায়, সেই প্রথম আলিঙ্গনেই মনিরুজ্জামানের দেহ থেকে ততদিনে অতিশয় রুণ কালো জিনটি পড়ি-কী-মরি করে ভেগে যায়। সে রাতে জ্যোৎস্না ছিল। মৌলাহাটের ওপর দিয়ে সবকিছু প্রচণ্ড নাড়া দিতে-দিতে একটা আচানক তুফান বয়ে যায় এবং মসজিদের উত্তর-জানালা দিয়ে একটা কালো কিছু বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন মুসল্লিরা।
সাইদার কাছে খবর হয়েছিল, যে খবর হাওয়ার আগে ছোটে, হুজুর পিরসাহেব তাঁর মায়ের কবর জেয়ারত করে দুই ছেলের কাঁধে হাত রেখে রওনা হয়েছেন। কিন্তু ওই একটুখানি দূরত্ব অতিক্রম করতে কী সময় যে লেগে গেল! বারান্দায় রুকু ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছ ঘেঁসে দেয়ালে সেঁটে আয়মনি, নুরির মা, আর নুরি। সাইদা যেই শুনতে পেলেন সদর দরজায় বরাবর শোনা সেই পবিত্র দোয়াদরুদ উচ্চারণ, অমনি গম্ভীর শান্ত কণ্ঠস্বরটি তাঁকে বিপন্ন করল বুঝি। শরমের মাথা খেয়ে সাইদা তাঁর ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বারান্দায় চারটি মেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেল। রুকু বন্ধ দরজার দিতে তাকিয়ে রইল। আর বদিউজ্জামান। উঠোনে দাঁড়িয়ে সাইদার সংসার দেখছিলেন। চাঁদের আলোয় নুরুজ্জামান পিতাকে দেখাচ্ছিল সরকিছু। গোয়ালঘর, কুয়ো, রান্নাঘর, টাট্টিখানা, বড় তিন কামরা মাটির ঘরের খড়ের চাল, উঠোনপ্রান্তের গাছগাছালি। মনিরুজ্জামান তার ছড়িতে ভর করে। দাঁড়িয়ে খালি দুলছিল আর দুলছিল। জ্যোৎস্নায় তার দাঁত চকচক করছিল। নুরুজ্জামান মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করাটা লক্ষ করেনি। করেছিলেন বদিউজ্জামান। অস্বস্তি বোধ করেছিলেন।
কী-একটা আশঙ্কা করে এবং শরমে আয়মনি, নুরি, ও তার মা হালকা পায়ে খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বদিউজ্জামান বারান্দায় রুকুর উদ্দেশে যখন আস্তে বললেন, কে –তখন রুকু ঝটপট নেমে এসে শ্বশুরের পদচুম্বন করল। আর মনিরুজ্জামান গোঙানো কণ্ঠস্বরে আম্মাকে ডাকতে থাকল।