অর্থমনর্থম্ ৫
সপ্তাহখানেক পরে আমরা দুইজনে আমাদের বসিবার ঘরে অধিষ্ঠিত ছিলাম। বৈকালবেলা নীরবে চা—পান চলিতেছিল।
গত কয়দিন অপরাহ্ণে ব্যোমকেশ নিয়মিত বাহিরে যাইতেছিল। কোথায় যায়, আমাকে বলে নাই, আমিও জিজ্ঞাসা করি নাই। তাহার কাছে মাঝে মাঝে এমন দু’একটা গোপনীয় কেস আসিত যাহার কথা আমার কাছেও প্রকাশ করিবার তাহার অধিকার ছিল না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আজও বেরুবে না কি?’
ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ।’
একটু সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘নুতন কেস হাতে এসেছে, না?’
‘কেস? হ্যাঁ—কিন্তু কেসটা বড় গোপনীয়।’
আমি আর ও বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিলাম না, বলিলাম, ‘সুকুমারের ব্যাপার সব চুকে গেছে?’
‘হ্যাঁ—প্রোবেটের দরখাস্ত করেছে।’
আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, ঠিক কিভাবে ফণী খুন করলে, আমাকে বুঝিয়ে বলতো; এখনও ভাল করে জট ছাড়াতে পারছি না।’
চায়ের শূণ্য পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা শোন, পর পর ঘটনাগুলো যেমন ঘটেছিল, বলে যাচ্ছি—
‘সেদিন দুপুরবেলা করালীবাবুর সঙ্গে মতিলালের ঝগড়া হল। সন্ধ্যেবেলা সুকুমার এসে তাই শুনে করালীবাবুকে বোঝাতে গেল। সেখান থেকে গালাগালি খেয়ে বেরিয়ে ফণীর ঘরে প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাটালে; তারপর খেয়েদেয়ে বায়স্কোপ দেখতে গেল। এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই।’
‘না।’
‘রাত্রি আটটার থেকে নয়টার মধ্যে—অর্থাৎ সত্যবতী যে সময় রান্নাঘরে ছিল, সেই সময় ফণী তার ঘর থেকে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করলে। সে বুঝতে পেরেছিল, করালীবাবুর আবার উইল বদলাবেন এবং এবার সে সম্পত্তি পাবে। সে ঠিক করলে, বুড়োকে আর মত বদলাবার ফুরসৎ দেবে না। বুড়োকে ফণী বিষচক্ষে দেখত; বিকলাঙ্গ লোকের একটা অদ্ভুত মানসিক দুর্বলতা প্রায়ই দেখা যায়—তারা নিজেদের দৈহিক বিকৃতি সম্বন্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে পারে না। ফণী বোধহয় অনেকদিন থেকেই করালীবাবুকে খুন করবার মতলব আঁটছিল। ‘বামুনঠাকুর এজেহার থেকে জানা যায়, রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারোটার সময় মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। আমি হিসাব করে দেখেছি , মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ঠিক এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। তার ও-দোষ বরাবরই ছিল—রাত্রে বাড়ি থাকত না।
‘সে বেরিয়ে যাবার পর ফণীও নিজের ঘর থেকে বেরুল। মতিলালের ঘর করালীবাবুর শোবার ঘরের ঠিক নীচেই, পাছে পায়ের শব্দ হয়, তাই ফণী এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। ঘুমন্ত করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল; তারপর সে তাঁর ঘাড়ে অপটু হস্তে ছুঁচ ফোটালে। তিনবার ফোটবার পর তবে ছুঁচ যথাস্থানে পৌছল। সুকুমারের মতন ডাক্তারি ছাত্র যদি একাজ করত, তাহলে তিনবার ফোটাবার দরকার হত না।
‘করালীবাবুকে শেষ করে ফণী পাশের ঘরের দেরাজ থেকে তাঁর শেষ উইল বার করলে—দেখলে, উইল তার নামেই বটে।
‘এখানে একটু সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে যে, ফণী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করে পাশের ঘরে গিয়ে উইলটা পড়লে; যখন দেখলে উইল তারই নামে, তখন ফিরে এসে করালীবাবুকে খুন করলে। সে যাই হোক, এই ব্যাপারে তার দশ-বারো মিনিট সময় লাগল।
‘এখন কথা হচ্ছে, উইলখানা নিয়ে সে কি করবে? যথাস্থানে রেখে দিলেও পারত, কিন্তু তাতে সুকুমারকে ভাল করে ফাঁসানো যায় না। অথচ নিজেকে বাঁচাতে হলে একজনকে ফাঁসানো চাই—ই।
উইল আর ক্লোরোফর্মের শিশি সে সুকুমারের ঘরে লুকিয়ে রেখে এল। জানত, এত বড় কাণ্ডের পর সব ঘর খানাতল্লাস হবেই—তখন উইলও বেরুবে। এক ঢিলে দুই পাখি মরবে—সুকুমার তখন ফিরতে পারে না; সে ফিরছে—যখন ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে—
‘আর কিছু বোঝাবার দরকার আছে কি?’
‘উইলে সাক্ষীর দস্তখত না থাকার কারণ কি?’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘আমার মনে হয়, খাওয়া-দাওয়ার পর করালীবাবু উইলটা লিখেছিলেন, তাই আর রাত্রে কিছু করেননি। সম্ভবত তাঁর ইচ্ছে ছিল, পরদিন সকালে চাকর-বামুনকে দিয়ে সহি দস্তখত করিয়ে নেবেন।’
নীরবে ধুমপান করিয়া কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল, তারপর জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সত্যবতীর সঙ্গে তারপর আর দেখা হয়েছিল? সে কি বললে? খুব ধন্যবাদ দিলে তো?’
বিমর্যভাবে মাথা নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। শুধু গলায় আঁচল দিয়ে পেন্নাম করলে।’
‘চমৎকার মেয়ে কিন্তু—না?’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল,তর্জনী তুলিয়া বলিল, ‘তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, সে কথাটা মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ—কেন?’
উত্তর না দিয়া ব্যোমকেশ পাশের ঘরে প্রবেশ করিল। মিনিট পাঁচেক পরে বিশেষ সাজ-সজ্জা করিয়া বাহির হইয়া আসিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার গোপনীয় মক্কেল তো ভারী শৌখিন লোক দেখছি, সিল্কের পঞ্জাবি পরা ডিকেটটিভ না হলে মন ওঠে না।’
এসেন্স-মাখানো রুমালে মুখ মুছিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। সত্য অণ্বেষণ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, অনেক তোড়জোড় দরকার।’
আমি বললাম, ‘সত্য অণ্বেষণ তো অনেকদিন থেকেই করছ, এত সাজ-সজ্জা তো কখনো দেখিনি।’
ব্যোমকেশ একটু গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘সত্য অণ্বেষণ আমি অল্পদিন থেকেই আরম্ভ করেছি।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে অতি গভীর। চললুম।’ মুচকি হাসিয়া ব্যোমকেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।
‘সত্য—ওঃ।’ আমি লাফাইয়া গিয়া তাহার কাঁধ চাপিয়া ধরিলাম—‘সত্যবতী! এ ক’দিন ধরে ঐ মহা সত্যটি অণ্বেষণ করা হচ্ছে বুঝি? অ্যাঁ—ব্যোমকেশ! শেষে তোমার এই দশা। কবি তাহলে ঠিক বলেছেন—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খবরদার। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, অর্থাৎ সম্পর্কে তার ভাণ্ডর। ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলবে না। এবার থেকে আমিও তোমায় দাদা বলে ডাকব।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আমাকে এত ভয় কেন?’
সে বলিল, ‘লেখক জাতটাকেই আমি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি।’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, ‘বেশ, দাদাই হলুম তাহলে।’ ব্যোমকেশের মস্তকে হস্তার্পণ করিয়া বলিলাম, ‘যাও ভাই, চারটে বাজে, এবার জয়যাত্রায় বেরিয়ে পড়। আশীর্বাদ করি, সত্যের প্রতি যেন তোমার অবিচলিত ভক্তি থাকে।’
ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গেল।