চা-বিস্কুট এসে গেল
কাল বাকি রাতটা নির্বিঘ্নে কেটেছে। ভোর হল। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় চলে গেল। ঘুম এল ঝড়ের মতো। যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন বেলা এগারোটা। বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে দরজা খুলতে, কাল রাতের সেই লোকটাকে দেখে চা দিতে বলল সে। মিনিট দশেকের মধ্যে চা-বিস্কুট এসে গেল। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে দেখে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
আমি গরিব মানুষ। চাকরি চলে গেলে মরে যাব। হাতজোড় করল লোকটি।
ডিউটির সময় হাঁড়িয়া খাও কেন?
আর খাব না স্যার।
ঠিক আছে। ওঁরা উঠেছেন?
হ্যাঁ স্যার। সেই ভোরবেলায় ওঁরা জঙ্গল দেখতে হাতির পিঠে চড়েছেন, এখনও ফেরেননি। লোকটি বলল।
হাতির পিঠে?
হ্যাঁ স্যার। এখানে প্রত্যেক ভোরে টুরিস্টদের হাতির পিঠে চড়িয়ে গন্ডার বাইসন দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওঁরা ফিরে আসেন সকাল নটার মধ্যে। আজ কেন দেরি হচ্ছে জানি না।
লোকটি কাপ-ডিশ নিয়ে চলে গেলে অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এল। মেজরের ঘরের জানলার নীচে এসে চারপাশে তাকিয়ে সাপটাকে দেখতে পেল না সে। মাটি থেকে বেশ উঁচুতে জানলা। যে ওই ভারী সাপটাকে ছুঁড়েছিল তাকে অবশ্যই জানলার এপাশে উঠতে হয়েছে। হয়তো ব্যাগের মধ্যে সাপটাকে পুরে রেখেছিল ছোঁড়ার আগে। কিন্তু উঠল কী করে? চারপাশ তাকিয়ে তেমন কোনও সিঁড়ি বা উঁচু বস্তু চোখে পড়ল না। সে জানলার নীচে এসে ভাল করে লক্ষ করতেই দেখল, দুটো জুতোর চাপে মাটি অনেকটা বসে গিয়েছে। একজন মানুষের শরীরের ওজনে মাটি অতটা বসে যেতে পারে না। নিজের জুতোর ছাপ পাশে রেখে বুঝল, যে দাঁড়িয়েছিল তাকে প্রচুর ওজন বইতে হয়েছিল। একটু ভাবতেই দৃশ্যটা আন্দাজ করল অর্জুন। একজন মানুষের কাঁধে দু’পা রেখে যদি আর-একজন মানুষ দাঁড়ায়, তা হলে মাটিতে দাঁড়ানো মানুষের জুতো নরম মাটিতে অতটা বসে যেতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে ওপরে দাঁড়ানো মানুষটাও জানলার গায়ে পৌঁছে যাবে সহজে।
এইসময় বাইরের গেটে কথাবার্তা শুরু হওয়ায় অর্জুন চলে এল সামনে। হাতি ফিরে এসেছে। লুসি নামলেন স্বচ্ছন্দে। মেজরকে নামাতে হল বেশ কসরত করে। রেঞ্জার এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্নের জবাবে মাহুত বলল, কী করব স্যার! সামনে পাঁচটা হাতি, নড়ছে না সরছে না। পিছনে বাইসনদের দল। ওরা যতক্ষণ সরে না যাবে, ততক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। শেষপর্যন্ত বাইসনদের দলটা সরে গেলে পিছন দিক দিয়ে অনেকটা ঘুরপথে ফিরে আসতে পারলাম।
এরকম তো ওরা করে না। নিশ্চয়ই কোনও ঘটনা ঘটেছে। রেঞ্জার বললেন।
লুসি খুব উত্তেজিত। এত কাছ থেকে হাতি বা বাইসন তিনি কোনও জঙ্গলে দ্যাখেননি। প্রথম দিকে পাখির ডাক রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু শেষ তিনটে উত্তেজনাপূর্ণ ঘণ্টায় সেসব মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিল।
মেজর শুধু মন্তব্য করলেন, গড ইজ গ্রেট।
হঠাৎ? অর্জুন অবাক হল।
ধরো হাতিকে যদি তার শরীরের সঙ্গে মানানসই চোখ ভগবান দিতেন, তা হলে বাঘ-সিংহ ল্যাজ গুটিয়ে পালাত। সাপটাকে ফেলে দিয়েছি।
সাপ! মানে?
উঃ। কাল রাত্রে যে-সাপটাকে তুমি মারলে…।
কখন ফেললেন? কোথায় ফেললেন?
ভোরবেলায়। সাফারিতে যাওয়ার আগে। ওপাশের খাদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। বেশ ভারী ছিল হে। ও হ্যাঁ, জানলার নীচ থেকে এইটে কুড়িয়ে পেয়েছি। কার জিনিস জানি না, যদি কোনও কাজে লাগে। পকেট থেকে একটা সাদা রঙের লাইটার বের করে অর্জুনকে দিলেন মেজর।
লাইটার হাতে নিয়ে অর্জুন বুঝল এটা বিদেশে তৈরি। একপাশে লেখা রয়েছে, ই ডি টি। এটা লোগো। পাশে লেখা, EXTRUSION, DIES AND TOOLS, 58769 NACHRODT/Tel : 02352-9386-0! না, ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় তৈরি নয় লাইটারটা। মেজরকে ঠিকানা দ্যাখাতে বললেন, এ জার্মানির লাইটার।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি ব্যবহার করেছেন বলে মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, এখন আমেরিকায় এই লাইটার কোনও দোকানে পাওয়া যায় না। আগে অঢেল আসত। মেজর বললেন।
এর কোনও বিশেষত্ব আছে?
শিয়োর। অন্ধকারে ল্যাম্পের কাজ করে। সোজা দাঁড় করিয়ে ফ্লেম বের করে সুইচ টিপে দিলে চমৎকার জ্বলতে থাকবে। অন্তত কুড়ি মিনিট।
আপনার এটা দরকার?
নো। পকেটে রাখলেই ধূমপানের ইচ্ছে হবে। নো মোর। তবে তুমি যাই বলো অর্জুন, দ্যাট ওয়াজ এ গ্রেট ড্রিঙ্ক। চোখ ঘোরালেন মেজর।
হাঁড়িয়া?
মাথা নেড়ে টুপিটাকে নাড়ালেন মেজর।
আপনি তো হুইস্কি-রাম খাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন!
করেছি এবং খাব না। কিন্তু ওই বস্তু তো হুইস্কি বা রাম নয়। স্রেফ কান্ট্রি লিকার। অযত্নে পড়ে আছে। ওর কোয়ালিটির উন্নতি করতে পারলে বিশ্বজয় করা যাবে। আমি ঠিক করেছি সেটাই করব। মেজর আর দাঁড়ালেন না।
ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হাতিটিকে এখন খাবার দিচ্ছে মাহুত। চুপচাপ সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে গত রাতের কথা ভাবছিল অর্জুন। অত কষ্ট করে যারা জানলা দিয়ে সাপটাকে ছুঁড়েছিল তাদের কেউ জার্মান লাইটার ব্যবহার করে। অর্থাৎ খুঁটিমারির বাংলোতে যারা হানা দিয়েছিল তারা উধাও হয়ে যায়নি। নিশ্চয়ই তাদের অনুসরণ করে জলদাপাড়ায় এসেছে। অথচ আসার সময় কোনও গাড়িকে অনুসরণ করতে দ্যাখেনি অর্জুন। তা ছাড়া যদি এসেও থাকে, তা হলে বিকেল থেকে রাতের মধ্যে ওই বিষধর সাপটাকে কী করে জোগাড় করল? ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে এই হলং-এর বাংলো অনেক দূরে। ঢুকতে গেলে অনুমতি নিতে হয়। ওই সাপটাকে নিয়ে ওরা নিশ্চয়ই গাড়িতে করেই এসেছে। অত রাতে গাড়ি ঢুকলে রক্ষীরা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জ করবে। অর্জুন রেঞ্জারের অফিসে গেল।
রেঞ্জার সবে কাজে এসে বসেছেন, অর্জুনকে দেখে আপ্যায়ন করলেন। উলটো দিকের চেয়ারে বসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, গত রাতে কোনও গাড়ি কি এদিকে এসেছিল? তেমন কোনও রিপোর্ট পেয়েছেন?
না তো! এদিকে কোনও গাড়ি আসেনি। তা ছাড়া রাতে জঙ্গলের পথে গাড়ি চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আছে। কেন বলুন তো? রেঞ্জার জিজ্ঞেস করলেন।
আমার সন্দেহ হচ্ছে বলেই জানতে চাইছি।
সন্দেহের কারণ?
আমার সঙ্গী ওই দাড়ি-গোঁফওয়ালা ভদ্রলোকের বিছানায় কাল রাতে কেউ মোটা সাপ ছুঁড়ে ফেলেছিল জানলা দিয়ে।
সে কী? রেঞ্জারের চোখ বিস্ফারিত।
ভাগ্যে বেঁচে থাকা ছিল বলে মেজর মারা যাননি।
সাপটা কোথায়?
গত রাতেই আমি মেরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম। আজ আর ওর মৃতদেহ দ্যাখা যাচ্ছে না। বোধহয় কোনও প্রাণী খেয়ে ফেলেছে।
কিন্তু ও সত্যি মরেছিল তো!
হ্যাঁ। মাথাটা একেবারে থেঁতলে গিয়েছিল।
রেঞ্জার টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন, মান সিংহ, কাল রাতে কোনও গাড়িকে ভিতরে ঢুকবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল?
লোকটার জবাব কানে এল অর্জুনের, আমি রাতের ডিউটিতে ছিলাম না সাব।
আঃ, খাতা দ্যাখো! ধমকালেন রেঞ্জার।
না সাব। কোনও এন্ট্রি নেই।
ডিউটিতে যারা ছিল তাদের কেউ কাছে আছে?
একটু দাঁড়ান সাব। মান সিংহের গলা অস্পষ্ট হল। তারপর আর একটি কণ্ঠ বাজল, মধুসূদন গড়াই সাহেব। কাল রাতে একটা জিপ ঢুকতে চেয়েছিল, আমরা পারমিশন দিইনি। ওরাও বেশি ঝামেলা না করে মাদারিহাটের দিকে চলে গিয়েছিল।
ক’জন ছিল গাড়িতে?
তিনজন। একজন সাহেব, মানে সাদা চামড়ার লোক। ঠিক আছে।
রিসিভার নামিয়ে রাখলেন রেঞ্জার, যেভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছিল, তাতে উত্তরগুলো নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছেন?
তা হলে কেউ কাল রাতে জঙ্গলে ঢুকতে চেয়েছিল। আচ্ছা বলুন তো, মেন গেট দিয়ে না এসে অন্য কোনও রাস্তায় ভিতরে আসা যায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
দেখুন, এত বড় জঙ্গল তো, পাহারা দিয়ে ঢোকা বন্ধ করা যায় না। আমাদের বিট অফিসাররা মাঝে মাঝেই জঙ্গলে ঘুরে দ্যাখেন, অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে কিনা। জঙ্গলে ঢোকার যেসব পথ আছে, সেগুলো পায়ে চলার পথ, এবড়োখেবড়ো। তবে তার উপর দিয়ে কেউ যদি জিপ চালিয়ে ঢোকে, তা হলে কিছু করবার নেই। অবশ্য জিপের হেডলাইটের আলো চোখে পড়বেই। রেঞ্জার বললেন।
কাল রাতে সাপটাকে ছোঁড়া হয়েছিল, যাতে ওর বিষে যাকে ওরা মারতে চায় সে মারা যায়। এই সাপ ওরা কীভাবে পেতে পারে?
সাপুড়েদের কাছ থেকে। জঙ্গল থেকে হরিণ-বাঘ ধরা যেমন বেআইনি, সাপও তেমন। তবু সাপ ধরতে অনেক সাপুড়ে জঙ্গলে ঢোকে। বর্ষার সময় এদিকে যখন সাপের অত্যাচার বাড়ে, তখন আমরাই বাধ্য হই ওদের খবর দিতে। তবে হাসিমারার কাছে একটা সেন্টার খোলা হয়েছে মাসদশেক হল। ওরা সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছে, বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু বিষ বের করে নেওয়ার পর সাপগুলোকে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দিতে হবে। কোনও অবস্থাতেই মারা বা বিক্রি করা চলবে না। ওই বিষ নাকি নানা ওষুধ তৈরির কাজে প্রয়োজন হয়। রেঞ্জার বললেন।
ওই সেন্টারে টুরিস্ট হিসেবে যাওয়া যায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
বেশ তো, কাল বিকেলেই চলুন। আমিও যাব।
রেঞ্জারের অফিস থেকে বেরিয়েই অর্জুন লুসিকে দেখতে পেল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। সে হাত নাড়তেই লুসি দাঁড়ালেন। কাছে গিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, রোদ বাড়ছে, এখন কি পাখিরা ডাকবে?
দিনের প্রতিটি ঘন্টায় পাখি ডাকে, এক-এক প্রজাতির পাখি এক-এক সময়। যাবেন নাকি? লুসি হাসলেন।
চলুন।
হাঁটতে হাঁটতে লুসি জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে মেজরের ঘরে যে-সাপটাকে মেরেছেন, সেটাকে সত্যি কেউ জানলা দিয়ে ছুঁড়েছিল?
হ্যাঁ। তখন আধা-অন্ধকারে মনে হয়েছিল বেশ ভারী সাপ। সকালে ওটার দ্যাখা না পাওয়ায় ওর জাত বা ওজন সম্পর্কে সন্দেহ থাকছে।
কিন্তু মেজরের মতো ভাল মানুষকে কেন কেউ মারতে চাইবে?
ঠিক। তা ছাড়া গত রাতে মেজর যে ওই ঘরে থাকবেন, তা তো উনি নিজেই জানতেন না! অথচ যারা মারতে এসেছিল তারা জানল কী করে?
এটাই অদ্ভুত লাগছে। ওই ঘরে আমি আমার ব্যাগ রেখেছিলাম। রাতে আপনার ঘর থেকে ফিরে মেজর আমাকে বলল, সে ওই ঘরে শোবে। আমি যদি মাঝখানের ঘরে যাই, তা হলে ভাল হয়।
তখন ওঁর হাতে কি একটা বোতল ছিল?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ও বলল মাঝখানের ঘরে একটাই জানলা আর ওখানে দুটো। ও জানলার পাশে বসে বোতলের পদার্থ টেস্ট করতে চায়। তারপর তো ডিনারেও এল না, আলোও নিভে গেল। মেজর যে ও ঘরে আছে, তা আমি ছাড়া কেউ জানত না। যে সাপ ছুঁড়েছিল সে যদি খবর নিতে আসে, তা হলে বেয়ারাদের কাছে শুনেছে আমি শুয়ে আছি ওই ঘরে। তা হলে মেজর নয়, আমিই টার্গেট ছিলাম? লুসি তাকালেন।
এমন কোনও ইঙ্গিত কি পেয়েছেন, যাতে মনে হতে পারে আপনাকে কেউ মারতে চাইছে? অর্জুন সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
লুসি মাথা নেড়ে বললেন, আমার কোনও শত্রু নেই।
ওরা জঙ্গলের ভিতরে পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটছিল। লুসি বললেন, আফ্রিকার জঙ্গলে গেলে যে আদিম গন্ধ পাওয়া যায়, তা এদিকের জঙ্গলে নেই।
আছে। সুন্দরবনে গেলে সেটা পাবেন। মুশকিল হল, ওখানে বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। হাঁটতে চেষ্টা করলে হয় সাপের কামড় খাবেন, না হয় বাঘের পেটে যাবেন।
সুন্দরবন, এখান থেকে কত দূরে?
অনেক দুরে। তবে কলকাতার কাছেই।
লুসি মাথা নাড়লেন। অর্জুন লক্ষ করছিল, মাথার উপর প্রচুর পাখি ডাকা সত্ত্বেও, লুসি সেগুলোকে রেকর্ড করার চেষ্টা করছেন না।
হঠাৎ একটা কাঠঠোকরা বিকট শব্দে জানান দিতেই যন্ত্র খুললেন লুসি। খানিকটা শব্দ রেকর্ড করে নিয়ে বললেন, এই পাখিরা পৃথিবীর সব দেশে একই আচরণ করে। এদের পক্ষে আটলন্টিক বা প্যাসিফিক পার হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ডানায় অত জোর নেই। ধরে নেওয়াই যেতে পারে যে, যে মহাদেশে জন্মেছে সেখানেই বংশপরম্পরায় থেকে গিয়েছে। তা হলে আচরণ এক হয় কী করে? একটা কাণ্ড দেখবেন? উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে লুসি ক্যাসেটটা বের করে ব্যাগ থেকে আর-একটা ক্যাসেট ভিতরে ঢুকিয়ে প্লে বোতাম টিপলেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই যন্ত্রের ভিতর থেকে শব্দটা বের হল। অবিকল কাঠঠোকরার ডাক। বেশ জোরে যেন পাখি ডাকছে। এটা থামতেই গাছের পাতার আড়ালে বসা কাঠঠোকরা ডেকে উঠল। এবারের ডাকটায় যেন আর্তি মেশানো। যন্ত্রের পাখির ডাক শুরু হতেই ওটা থেমে যাচ্ছে। তারপর ডানার ঝটপটানি কানে আসতেই অর্জুন দেখল, গাছের কাঠঠোকরা একেবারে নীচের ডালে উড়ে এসে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। লুসির আঙুল স্টপ বোতামটা টিপতেই যন্ত্র নীরব হল। গাছেরটি বোকাবোকা মুখ করে অর্জুনদের দেখে উড়ে গেল কোথাও। লুসি বললেন, এই ডাকটা মেক্সিকোর এক কাঠঠোকরা ডেকেছিল। ইন্ডিয়ান কাউন্টার পার্ট স্বচ্ছন্দে বুঝতে পেরেছে!
.
এখন ভরদুপুর। বাংলো থেকে প্রায় আধমাইল দূরের জঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। লুসি অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে নানা পাখির ডাক রেকর্ড করে চলেছেন। রেকর্ড করতে করতে ফিসফিস করে বলে চলেছেন, হারমিট, সিক্লেবিল, থর্নবিল, সোর্ডবিল। অথবা পিনটেল গ্রিন পিজিয়ন, হোয়াইট হেডেড মাউসবার্ড। অর্জুনের খুব খিদে পেয়ে গেল। সকালে চা আর বিস্কুট ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। জঙ্গলের ভিতরে খাবার পাওয়া অলৌকিক ব্যাপার। আর-একটু এগোলেই জঙ্গলঘেঁষা গ্রাম হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কথাটা বলার জন্য মুখ খুলতেই মেহগনি গাছটা থেকে ভেসে এল, বিপবিপ, বিপ, হুইলের আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটাকে রেকর্ড করতে লাগলেন লুসি। পাখিটা ডেকেই চলেছে। পাতার আড়াল থাকায় ওর চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। অর্জুনের মনে হল, অবিকল টেলিফোনের শব্দ গাছের উপর থেকে ভেসে আসছে। হঠাৎ অনেক দূরের গাছ থেকে বিপ, বিপবিপ ডাক শুরু হতেই পাখিটা ডাক থামাল। লুসি মুখ ঘুরিয়ে অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, ওকে উড়ে যেতে দেখলেন?
না।
যেদিক থেকে ক্ষীণ ডাকটা আসছিল সেদিকে পা বাড়ালেন লুসি। মিনিটদেড়েকের মধ্যে কানে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ বাজল। অর্জুন বুঝল, ওরা হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের প্রান্তে চলে এসেছে। এদিকে বোধহয় যাতায়াতের রাস্তা আছে। নইলে গাড়ি চলবে কী করে!
লুসিকে ওঁর কাজ করতে দিয়ে, সরু পথ ধরে কিছুটা এগোতেই একটা। মাটির রাস্তা দেখতে পেল সে। রাস্তার উপর গাড়ির চাকার দাগ। এই রাস্তা আজকাল কেউ ব্যবহার না করলেও যে-গাড়িটা এসেছিল, তার চালক খুব দক্ষ হাতে চালিয়ে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গিয়েছে। চাকার দাগ অনুসরণ করে কিছুটা হাঁটতেই জঙ্গলের বাইরে চলে এল অর্জুন। দূরে একটা গ্রাম দ্যাখা যাচ্ছে। পাশে ঝোঁপ, বুনো লতানো গাছ, তারপর পিচের রাস্তা। ন্যাশনাল হাইওয়ে। গাড়ি যাচ্ছে ওখান দিয়ে। কিন্তু ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারও পক্ষে জঙ্গলের এই প্রবেশপথ আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। ড্রাইভার নিশ্চয়ই এর খবর রাখত। মূল গেটে বাধা পাওয়ায় এদিক দিয়ে ঢুকছে।
এইসময় লুসি পাশে এসে দাঁড়ালেন, কী ব্যাপার?
গত রাতে যারা সাপ ছুঁড়েছিল তারা এই পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকেছিল। বাংলোর যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়, ততটা আলো নিভিয়ে গিয়ে জিপ থেকে নেমেছিল ওরা। তার মানে বুঝতে পারছেন? ওদের মধ্যে কেউ এই জঙ্গল চেনে। সাপও তার পক্ষে জোগাড় করা স্বাভাবিক। অর্জুন বলল।
কিন্তু কেন? লুসি তাকালেন।
আপনি জানেন না, মেজরেরও জানা নেই। তাই প্রশ্নটার উত্তর একমাত্র ওরাই দিতে পারে। অবশ্য তার আগে আমাদের কেউ যদি খুন হয়ে যায়, তা হলে ব্যাপারটা খুব দুর্ভাগ্যজনক হবে। একটু আগে শুনলাম, ওরা যে গাড়িতে এসেছিল, তাতে একজন সাদা চামড়ার মানুষও ছিল!
সাদা চামড়া?
হ্যাঁ। আমেরিকা না ইয়োরোপের তা জানা যায়নি। ওরা কথা বলতে বলতে আবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এবার পথ বদলে জিপের চাকা অনুসরণ করে যাবে বলে ঠিক করল অর্জুন। ঠিক তখন মাথার উপরে গাছের ডালে সেই পাখিটা বিপ বিপবিপ করে উঠতেই লুসি তড়িঘড়ি রেকর্ডার বের করতে উদ্যোগী হলেন। অর্জুন তাঁকে ফেরার জন্যে তাগাদা দিতে মুখ ফেরাতেই লোকটাকে দেখতে পেল। হাইওয়ে থেকে নেমে বুনো ঝোঁপের পাশ দিয়ে জঙ্গলের দিকে আসছে।
সে চাপা গলায় বলল, কোনও শব্দ করবেন না, চটপট লুকিয়ে পড়ুন। তারপর দ্রুত ছুটে গেল শালগাছগুলোর পিছনে। কিছু না বুঝেও লুসি চলে এলেন পাশে। অর্জুন ঠোঁটে আঙুল চেপেই ইশারা করল সামনের দিকে তাকাতে।
প্রথমে শিস শোনা গেল। তারপর লোকটাকে দ্যাখা গেল। পকেট থেকে একটা বড়সড় সিগারেটের প্যাকেট বের করে গন্ধ শুকল একটু। ওটা যে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই অর্জুনের। প্যাকেটটাকে পকেটে রেখে আবার শিস দিতে দিতে চলে গেল লোকটা এবড়োখেবড়ো জিপ চলা পথ দিয়ে।
লুসি জিজ্ঞেস করলেন, হু ইজ হি?
আমি জানি না। তবে মনে হচ্ছে ফরেস্টের একজন কর্মী। চলুন, এবার ফেরা যাক। অর্জুন হাঁটা শুরু করল।
নমস্কার স্যার। আপনারা এদিকে?’ দুটো লোক যেন জঙ্গল ফুড়ে ওদের সামনে হাজির হল। দু’জনের কাঁধেই বন্দুক, পরনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ইউনিফর্ম।
ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আপনারা? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমরা ফরেস্টের স্টাফ। পাহারা দিতে বেরিয়েছি।
এদিকে জন্তু-জানোয়ার থেকে কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই তো!
নেই বলব না। তবে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি। এদিকের সব জানোয়ার জঙ্গলের ওপাশে চলে গিয়েছে। এরকম ব্যাপার সাধারণত হয় না।
হয়তো কোনও কারণে ভয় পেয়েছে। চোরাশিকারিরা নিশ্চয়ই এদিকে আসে। ওদিকের হাইওয়ে খুব দূরে নয়। ঢুকে পড়তে কতক্ষণ! অর্জুন বলল।
এই গাদাবন্দুক দিয়ে ওদের আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না জেনেও আমরা সাহস দ্যাখাই। সরকার যদি বন্দুকগুলো বদলে না দেয়, তা হলে আর কতদিন সাহস থাকবে জানি না।
হঠাৎ দ্বিতীয় লোকটা গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেয়ে প্রথমজনকে ডেকে দ্যাখাল। প্রথমজন চটজলদি উবু হয়ে বসে আঙুল দিয়ে চাকার দাগ পরীক্ষা করতে করতে বলল, এটা রেঞ্জার সাহেবের জিপ নয়। এত বড় জঙ্গল কি সবসময় চোখে চোখে রাখা যায়! বদমাশরা হাতি-বাইসনকেও ভয় করে না।
গন্ডার? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এখানকার গন্ডাররা ঝামেলা এড়িয়ে চলে। আচ্ছা স্যার…।
ওরা হেঁটে এল পথটা। জিপ চলতে পারে, কিন্তু হাঁটার পক্ষে খুব কষ্টকর রাস্তা। হঠাৎ চোখে পড়ল জিপের চাকার দাগ ঘুরেছে। অর্থাৎ এখান থেকে জিপটা ঘুরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বাংলোর সামনে ওরা পৌঁছোল পাঁচ মিনিটের মধ্যে। এখন দুপুর দেড়টা। গত রাতে যে লোকটা হাঁড়িয়া এনে দিয়েছিল, সে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, সাব, খাবার তৈরি।
পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। ওই সাহেব কোথায়?
উনি ওঁর ঘরে কুকুরকে ট্রেনিং দিচ্ছেন।
কুকুর? অর্জুন অবাক। লুসি ঢুকে গেলেন তাঁর ঘরে। অর্জুন দেখল, মেজরের ঘরের দরজা বন্ধ। কিন্তু ভিতর থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসছে। সে দরজা ঠেলতেই ওটা খুলে গেল। দৃশ্যটা দেখে চোখ কপালে উঠল অর্জুনের। বারমুডা আর গেঞ্জি পরে হামাগুড়ি দিচ্ছেন মেজর। তাঁর সামনে মাসদেড়েক বয়সি একটি নেড়ি কুকুরের বাচ্চা। মেজর বলছেন, ইউ মাস্ট ফাইট, খপ করে ধরবি। ফাইট। কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা একটি দড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেড়ির বাচ্চাটার নেই।
মেজর! কী করছেন? অর্জুন ঘরে ঢুকল।
কে? ও তুমি! ট্রেনিং দিচ্ছি। কিন্তু ইন্ডিয়ানরা কখনও যুদ্ধ করেনি তো, তাই এটাকে লড়াকু করে তুলতে সময় লাগবে। কাম অন মাই বয়, ফাইট!
ও কার সঙ্গে লড়াই করবে?
সাপের সঙ্গে। যে-কেউ জানলা দিয়ে সাপ ছুঁড়ে আমাকে মেরে ফেলবে, তা চলবে না। একটা বেজি কিংবা ময়ূর পাওয়া গেলে খুব ভাল হত। কিন্তু ওরা বন্যপ্রাণী, ওদের ধরা চলবে না। তাই এটাকেই তৈরি করছি। কাম অন…। মেজরের কথাগুলো বেশ জড়ানো। অর্জুনের বুঝতে অসুবিধে হল না উনি পান করেছেন।
মেজর! আপনি ওসব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন!
ইয়েস। নো মোর হুইস্কি-রাম-ভদকা।
কিন্তু এই ভরদুপুরে আপনি পান করেছেন?
ওঃ! কাল রাতে প্রথম হাড়িয়া খেয়েছিলাম। আজ মনে হল, রাতে যেরকম লেগেছিল দিনের বেলায় সেরকম লাগে কিনা দেখতে হবে। তাই আর-একটা বোতল হাঁড়িয়া আনিয়ে টেস্ট করলাম। বুঝলে ব্রাদার, ভালভাবে বটলিং করে এক্সপোর্ট করলে এ জিনিস গোটা পৃথিবী লুফে নেবে। এদেশের বেকার সমস্যা এক মাসে দূর হয়ে যাবে। বলতে বলতে মেজর চোখ বন্ধ করে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। সেই সুযোগে নেড়ির বাচ্চা দৌড় লাগাল খোলা দরজা সামনে পেয়ে।
মেজর, আপনার স্নান হয়ে গিয়েছে?
ইয়েস।
নীচে আসুন। লাঞ্চ রেডি হয়ে গিয়েছে। অর্জুন বেরিয়ে এল।
.
লাঞ্চের পর লুসির ইচ্ছে ছিল উলটো দিকের জঙ্গলে ঢোকার। কিন্তু ওদিকে একটা বড়সড় হাতির দল এসেছে শোনবার পর তিনি বিশ্রাম নিতে ঘরে চলে গেলেন। মেজরের খুব ঘুম পেয়ে গেল। গত দুটো রাত প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে অর্জুনকে। তাকেও বিছানা টানছিল। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে সে বিশাল জঙ্গলের মাথা দেখতে দেখতে রেঞ্জারের অফিসের দিকে চোখ নামাতেই লোকটাকে দেখতে পেল। চোরাই পথ দিয়ে শিস দিতে দিতে ঢুকেছিল লোকটা। বিদেশি সিগারেটের ঘ্রাণ নিচ্ছিল মাঝে মাঝে। এখন লোকটা হাত নেড়ে কথা বলে যাচ্ছে একটি বৃদ্ধের সঙ্গে। তারপর ঢুকে গেল রেঞ্জারের অফিসে।
.
বড়জোর ঘণ্টাআড়াই ঘুমিয়েছিল অর্জুন। হঠাৎ মাথার ভিতর সেই অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। পাশ ফিরে শোওয়া অবস্থায় সে চোখ অল্প খুলতেই দেখতে পেল, মোবাইলের আলো দপদপ করছে। তারপরই শুরু হল, বিপ, বিপ, বিপ। যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া চেষ্টা চলছে বলে মনে হল। তারপরই শব্দটা থেমে গেল। অর্জুন পরিষ্কার শুনতে পেল, কেমন আছ অর্জুন? আমাকে চিনতে পারছ না? আমি বিষ্ঠুসাহেব। সেই কালিম্পং-এর!
ও হ্যাঁ। আপনার গলা চিনতে পারিনি। আপনি তো এখন আমেরিকায়!
হ্যাঁ। আমার বন্ধু প্রোফেসর ক্যালডার মুলেনের সৌজন্যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। বন্ধু অমল সোম তোমার ব্রেন স্ক্যানিং-এর রিপোর্ট আর মোবাইল নম্বর আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বিষ্টসাহেব বললেন।
কিন্তু মোবাইল সেট ছাড়া কী করে আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি?
না না। তোমার মোবাইল অফ থাকলে আমার কথা তুমি শুনতে পেতে না। যন্ত্রটির ব্যাটারির সাহায্যে তোমার মস্তিষ্কে আমার কথা পৌঁছোচ্ছে, বছরখানেকের মধ্যে এই আবিষ্কারের ফল ভোগ করবে গোটা পৃথিবী। যাক গে, লুসি কেমন আছে?
ভালই আছেন।
তুমি কি ওর মুখে প্রোফেসর মুলেনের নাম শুনেছ?
না।
ওকে জিজ্ঞেস করো, সব জানতে পারবে। গুড বাই!
অর্জুন চোখ খুলল। হাত বাড়িয়ে মোবাইল সেট তুলে দেখল, একটি প্রাইভেট কল এসেছিল। কোনও নম্বর ফুটে ওঠেনি।
বিষ্ণুসাহেবের মুখ মনে এল। কালিম্পং-এ দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। প্রিয় কুকুর মারা যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মেজরের সঙ্গে পরিচয় ওঁর মাধ্যমে। তারপর খুব অসুস্থ হয়ে বিদেশে চলে যান। বোঝাই যাচ্ছে, বিষ্টুসাহেব-মেজর অমলদার মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু বিষ্ঠুসাহেব যাঁর কথা বললেন, সেই প্রোফেসর মুলেনের এই আবিষ্কার যেদিন পৃথিবী জানবে, সেদিন হইহই পড়ে যাবে। শুধু যার সঙ্গে কথা বলতে চাই, তার ব্রেনের অবস্থান ঠিকঠাক জানা চাই। আর চাই তার মোবাইল নম্বর। পৃথিবীর যে-দেশেই থাকো, সেই মোবাইলের সাহায্যে মাথার ভিতর শব্দগুলো পৌঁছে দেওয়া যাবে। ফলে ঘুমন্ত অবস্থাতেও কথা বলতে অসুবিধে নেই। আর এই সংলাপ অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্জুনের মনে হল, সে শুধুই শুনতে পাচ্ছে। ইচ্ছে হলেও বিষ্টসাহেবকে কোনও কথা বলতে পারছে না। কারও মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে কী যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, তার চেহারাই বা কী, তা সে জানে না। বিষ্ট্রসাহেবও তাকে জানাননি।
.
বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে মেজর সব শুনলেন। লুসি তখনও তাঁর ঘরে, খবর পাঠানো হয়েছে চা খেতে আসবার জন্য। অর্জুন বলল, এখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনাদের অনুসরণ করা হচ্ছে।
কারা করছে? কারা? ওই সাপ যদি আমাকে ছোবল মারত, তা হলে কী হতে পারত ভাবলেই বুক কেঁপে উঠছে! আচ্ছা মানলাম, ওরা আমাদের অনুসরণ করে খুঁটিমারি বাংলোয় এসেছিল। ভোরবেলায় পালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। কিন্তু ওদের পাওয়া যায়নি। আমরা যে বিকেলে এখানে আসব, সেটা ওদের জানার কথা নয়। এখানে কোনও বুকিং ছিল না। মেজর মাথা নাড়লেন।
মোবাইল ফোনের দৌলতে ওরা নিশ্চয়ই জেনেছিল আমরা বাংলো ছেড়ে জলদাপাড়ার দিকে এগোচ্ছি। লুসি যে পাখির ডাক রেকর্ড করার জন্যে জঙ্গলে ঢুকবেন, এটা তো ওদের জানা তথ্য। ময়নাগুড়ি হয়ে গোরুমারার দিকে না গিয়ে, মাদারিহাটের রাস্তা ধরতেই ওরা বুঝে গিয়েছিল আমাদের ডেস্টিনেশন হল জলদাপাড়া। অর্জুন যেন নিজেকেই বোঝাতে চাইল।
বেশ। এবার সাপ! সন্ধেবেলায় এই এলাকায় পৌঁছে ওরা অত বড় বিষধর সাপ জোগাড় করে ফেলল? সারারাত সময় দিলে তুমি পারবে?
আমি তো এক সপ্তাহ সময় পেলেও পারব না। মেজর বললেন।
এইসময় টর্চের আলো গেট খুলে এগিয়ে এল। অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আসুন রেঞ্জারসাহেব। আমরা এখানে গল্প করছি।
না অর্জুনবাবু। আমাকে এখনই কোচবিহার ছুটতে হবে। আমি আপনাকে খবরটা দিতে এলাম। মাদারিহাটে আমরা একটা ট্রানজিট সেন্টার করেছি। যেসব হিংস্র প্রাণী জঙ্গলের বাইরে এসে অথবা চা-বাগানের ভিতর ধরা পড়ে, তাদের ওখানে রাখা হয় কয়েকদিন। একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে, আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজ বিকেলে ধরা পড়েছে যারা, তাদের একটিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তার মানে? অর্জুন অবাক।
গরম লাগলে অনেকেই দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে ভিতরে। কিন্তু বিকেলে খাবার খেতে বের হয়। আজ হয়নি। রেঞ্জার বললেন।
প্রাণীটি কী ধরনের? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
সাপ। যে-সাপটির কথা আপনি আজ সকালে বলেছেন, তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কাল সন্ধের পরে খাঁচার পিছনের তক্তা খুলে ওকে চুরি করেছে কেউ। খাঁচার ভিতর সাপের সুবিধের জন্যই দিনের বেলাতেও অন্ধকার করে রাখা হয় বলে কর্মীরা বুঝতে পারেনি। আমি ডি এফ ও-কে জানিয়েছি। থানাতেও ডায়েরি করা হয়েছে। রেঞ্জার বললেন, ব্যাপারটাকে আর হালকাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না, সাবধানে থাকবেন।
মাই গড! মেজর চাপা গলায় বললেন।
টর্চের আলো ফিরে গেল।
অর্জুন বলল, একটা ভুল হয়ে গেল। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ওই লোকটা সম্পর্কে রেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।
এইসময় লুসি এলেন। চেয়ারে বসে টি-পট থেকে কাপে চা ঢেলে নিয়ে বললেন, আমরা কি কাছাকাছির জঙ্গলে এখন একটু যেতে পারি না?
মেজর বললেন, না যাওয়াই ভাল। এখানে যে সাপ আছে তা প্রমাণিত!
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা লুসি, আপনি দু’দিনে যত পাখির ডাক রেকর্ড করেছেন, তা কি গবেষণার পক্ষে যথেষ্ট নয়?
লুসি তাকালেন, আমি ঠিক জানি না। যাদের ডাক পেয়েছি, তাদের বাইরে এমন অনেক পাখি থাকতেই পারে।
প্রোফেসর ক্যালডার মুলেন কি স্পেসিফিক কিছু বলে দেননি?
চমকে তাকালেন লুসি। প্রথমে অর্জুনের দিকে, তারপর মেজরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি প্রোফেসরের কথা ওঁকে বলেছ?
না তো! ওঁর বিষয়ে কোনও কথাই হয়নি। তা ছাড়া প্রোফেসরকে আমি খুব কম জানি। বিষ্টসাহেব আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তুমি যে ওঁর অধীনে গবেষণা করছ, তাও বিষ্টসাহেবের কাছেই শুনেছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগায় এদেশে আসতে আপত্তি করিনি। মেজর বললেন।
তা হলে আপনি প্রোফেসর মুলেনের কথা জানলেন কী করে?
ধরে নিন, বিষ্টুসাহেব জানিয়েছেন। অর্জুন বলল।
হ্যাঁ। গ্রোফেসর মুলেন আমাকে বিশেষ কয়েকটি পাখির ডাক রেকর্ড করতে বলেছেন। তবে তার বাইরে যে করা যাবে না, তাও বলেননি?
লুসি, প্রোফেসর মুলেন যে-বিষয়ে গবেষণা করছেন, তার সঙ্গে পাখির ডাকের সম্পর্ক কী? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
গবেষণার বিষয়ে আপনি কি জানেন?
কিছুটা।
ও। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে অনেক সময় লাগবে।
আপনি কি ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করছেন?
লুসি তাকালেন, এখন তো সেই রকমই মনে হচ্ছে।
কেন মনে হচ্ছে? কেউ তো আপনাকে এদেশে আসার পর ভয় দেখায়নি! অর্জুন হাসল।
লুসি তাকালেন, প্রোফেসর মুলেন ইদানীং বাড়ি থেকে বেরোন না। লং আইল্যান্ডের যে-বাড়িতে তিনি থাকেন, সেখানে তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। তবু তার মধ্যেই মাফিয়ারা তাঁর কাছে প্রস্তাব দিয়েছে, যে নতুন আবিষ্কার তিনি করেছেন, যা এখনও পরীক্ষার স্তরে আছে, তার পেটেন্ট ওরা কিনে নিতে চায়। তার জন্য ওরা তাঁকে এক বিলিয়ন ডলার দিতে রাজি আছে। কিন্তু প্রোফেসর মুলেন তাঁর আবিষ্কারের পেটেন্ট হাতছাড়া করবেন না। বুঝতেই পারছেন, এই প্রত্যাখ্যান মাফিয়ারা ভাল মনে নিতে পারে না। লুসি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
বুঝলাম না। আপনার সঙ্গে কারও তো শত্রুতা নেই। তা হলে আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমি দীর্ঘদিন ধরে পাখির ডাক নিয়ে গবেষণা করছি। এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই প্রোফেসর মুলেনের সাহায্য নিয়েছি। আমার গবেষণার বিষয় হল, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে মানুষ জন্মাবার পর গোষ্ঠীগতভাবে ভাষা তৈরি করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। ক্রমশ কাছাকাছি গোষ্ঠীর মানুষরা একত্রিত হলে তাদের ভাষাও পরিবর্তিত হয়েছিল প্রয়োজন মেনে। কিন্তু একই মহাদেশ তো বটেই, একই দেশের মানুষ নানা ভাষায় কথা বলে। কেউ কারও ভাষা বুঝতে পারে না। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহাদেশের ভাষা তো সম্পূর্ণ আলাদা হবেই। কিছু ধ্বনি বা অভিব্যক্তির বা শব্দের মিল পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেগুলো তো কথা বলে বোঝানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমি অবাক হলাম, যখন দেখলাম, আফ্রিকার কিছু পাখির ডাকের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার কিছু পাখির ডাকের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। দু’দেশের পাখির ডাক কম্পিউটারে ফেলে দ্যাখা গেল নোটেশন হুবহু এক। ব্রাজিলের সেই পাখির ডাক, আফ্রিকার জঙ্গলে বাজালে দেখেছি ওখানকার ওই বিশেষ পাখিরা চঞ্চল হচ্ছে। গোটা পৃথিবীতে একরকম ডাক ডাকে যেসব পাখি, তাদের চিহ্নিত করতে পারলে এত দিনের মেনে নেওয়া থিরোরিগুলোকে বাতিল করতেই হবে। যেসব পাখির ডাক একই রকম, তাদের ডানায় তেমন জোর নেই। যা থাকলে ভারত, প্রশান্ত বা অতলান্তিক মহাসাগর পার হওয়া সম্ভব! তা হলে এরা এক ভাষায় কথা বলতে শিখল কী করে? চিনের কোনও মানুষের মুখের বুলির সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার কোনও মানুষের এক ফোঁটা মিল কি পাওয়া যাবে? না। তা হলে দাঁড়াচ্ছে, পৃথিবীর সব দেশের পাখিদের কেউ কেউ একই ভাষায় কথা বলে। সেই ভাষাকে যদি ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গোয়েজ অফ বার্ডস বলা যায়, তা হলে নিশ্চয়ই খুব বাড়াবাড়ি হবে না। লুসি থামলেন।
ব্যাপারটা সত্যি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আপনি কেন ভয় পাবেন বুঝতে পারছি না।
প্রোফেসর মুলেন এই বিশেষ ডাকটাকে সাংকেতিক ভাষা হিসেবে তাঁর আবিষ্কারে ব্যবহার করতে চান। ধরুন, আপনার মোবাইলের মাধ্যমে কেউ কোনও খবর দিতে চায়। আপনার মোবাইলের ব্যাটারি তার ক্ষমতার রেঞ্জে আপনাকে পেলে তবেই বার্তা পেতে পারবেন। এই রেঞ্জটা খুব বেশি হলে সাধারণ একটি ঘরের মধ্যেই সীমিত। কিন্তু বিশেষ একটি পাখির ডাক আধমাইল দূর থেকেও শোনা যায়। আমি এর বেশি বলার অধিকারী নই। যে-পাখিটিকে অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে পেয়েছি, তারা আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। ওই যে, বিপ বিপবিপ বলার পর হুইসলের শব্দ তোলে যে-পাখি! প্রোফেসর মুলেন ওই ডাকটাকে সিগন্যাল হিসেবে ব্যবহার করতে চান। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওই সিগন্যাল পাখির ব্রেনে পৌঁছে গেলেই সে ডেকে উঠবে। আর সেই ডাক ছড়িয়ে যাবে সর্বত্র। যারা পেটেন্ট চেয়েছিল, তারা নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছে, আমি কেন ভারতে এসেছি। আমার উপর আঘাত করে ওরা প্রোফেসর মুলেনের মনে চাপ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে উনি বাধ্য হন ওদের শর্ত মেনে নিতে।
এটা যখন বুঝতে পারছেন, তখন ঝুঁকি নিচ্ছেন কেন? নিজের নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেননি কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
লুসি প্রশ্নটা শুনে মেজরের দিকে তাকালেন।
মেজর এতক্ষণ বেতের চেয়ারে শরীর এলিয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। লুসি তাকাতে সোজা হয়ে বসলেন, আসলে ব্যাপারটা তোমাকে বলা হয়নি। বিষ্টসাহেব প্রোফেসর মুলেনের কাছে লুসির ভারতবর্ষের এদিকটায় আসার পরিকল্পনা শুনে আমাকে ফোন করেন। ওর নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয়। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাইলে তাদের ব্যাপারটা বোঝানোই মুশকিল হয়ে যেত। তা ছাড়া প্রোফেসরের গবেষণার বিষয়ে সম্পর্কে পুলিশ বিশদ জানতে চাইত। তখন ওর ভিসা নিয়েও অসুবিধে হত। তা ছাড়া প্রোফেসর মুলেন চাইছিলেন লুসির ভারতবর্ষে আসাটা যেন মিডিয়া না জানতে পারে। তখন আমি অমল সোমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রোফেসর মুলেনের সঙ্গেও অমল সোমের কথা হয়। তিনিই তোমার নাম প্রস্তাব করেন। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে যে-কোনও পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবে বলে ভরসা দেন। আমিও আমার অভিজ্ঞতা থেকে তোমাকে সমর্থন করি।
অর্জুন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, প্রোফেসর মুলেন কোন দেশের মানুষ? আমেরিকা তো সব দেশের মানুষের মিলনভূমি।
উনি জার্মান!
আচ্ছা! আর ওই মাফিয়ারা? ওরা নিশ্চয়ই ইতালির লোক!
মেজর মাথা নাড়লেন, মাফিয়া শব্দটা শুনে তুমি ভাবছ ওরা ইতালির লোক? না অর্জুন, এখন মাফিয়ারা আর কোনও একটা বিশেষ দেশে আটকে নেই। সর্বত্র ওদের যাতায়াত।
প্রোফেসরের এই আবিষ্কারের কথা আমেরিকান সরকার জানেন?
লুসি জবাব দিল, নিশ্চয়ই অজানা নয়। কিন্তু আবিষ্কার সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত প্রোফেসর কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না। তবে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি খানিকটা আন্দাজ করে ব্যাবসা বাড়ানোর মতলব করছে। তার ফলেই ওইসব মাফিয়ারা এখন সক্রিয়।
অর্জুন দেখল বাংলোর সেই কর্মচারী, যে মেজরকে হাঁড়িয়া খাইয়েছিল, সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডাকল সে, কিছু বলবে?
বাবুর্চির খুব জ্বর এসেছে। লোকটি জবাব দিল।
তা হলে?
সাহেব যদি গাড়ির ড্রাইভারকে বলে দেন, তা হলে আমি এখন গিয়ে মাদারিহাট থেকে খাবার কিনে আনতে পারি।
সেটা করাই যেতে পারে। কিন্তু তোমরা কী খাবে?
আমরা? লোকটা স্পষ্টতই অবাক হল।
তোমরা যারা এখানে কাজ করো, তারা কী খাবে?
ভাত, ডিম, আলু। সাহেবরা তো তা খেতে পারবেন না। যাই?
আধঘণ্টা পরে এসে জেনে যেয়ো। অর্জুন বলল।
লোকটা ফিরে যাচ্ছিল, অর্জুন আবার তাকে ডাকল, এই যে ভাই!
লোকটা দাঁড়াল। মুখ ঘোরাল।
তুমি গত রাতে এবং আজ সকালে সাহেবকে হাঁড়িয়া এনে দিয়েছিলে। কোত্থেকে?
লছমনের কাছ থেকে।
লছমন কে?
ফরেস্ট অফিসের পিয়ন।
ও এসবের স্টক রাখে?
হ্যাঁ সাহেব। ওর কাছে সব পাবেন। বিলিতি মদও বিক্রি করে। তা ছাড়া, লেডিস ছাতা, সিগারেট… বিদেশি সিগারেট, বিদেশি সেন্ট।
বাঃ! চমৎকার। দ্যাখা যাবে জিনিসগুলো? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমি তা হলে ওকে খবর দিই?
বেশ।
লোকটি চলে গেলে মেজর জিজ্ঞেস করলেন, স্মাগলার?
ঠিক তা নয়। এরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেউ কেউ ওসব জিনিস টুরিস্টদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে। নর্থ বেঙ্গলে বাংলাদেশ আর ভুটানের দৌলতে বিদেশি জিনিসগুলো ঢালাও বিক্রি হয়। যাক গে, আজ রাতে আমরা বাংলোয় থাকব না। যারা গত রাতে সাপ ছুঁড়ে ফেলেছিল, তারা আজ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। অর্জুন বলল।
বাংলোয় থাকব না মানে? কোথায় থাকব? মেজর অবাক।
হয় খাবার আনার নাম করে আমরাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। এখান থেকে সুভাষিণী চা-বাগান বেশি দূরে নয়। ওই বাগানের ম্যানেজার অনিন্দ্য আমার খুব পরিচিত। রাতটা ওদের গেস্টহাউজে কাটিয়ে দিতে পারি। ওখানে কেউ লুসির কাছে পৌঁছোতে পারবে না। নয়তো ডিনার আনিয়ে খেয়ে নিয়ে, ঘরে শুতে যাওয়ার বায়না করে চুপিসারে জঙ্গলে ঢুকে অপেক্ষা করতে পারি ওদের জন্য। অর্জুন বলল।
গোটা রাত? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
দরকার হলে তাই।
কিন্তু রাতের জঙ্গলে নিশ্চয়ই মশা থিকথিক করছে। তা ছাড়া হাতিফাতি চলে এলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।
তা হলে প্রথমটাই করা যাক।
না। দ্বিতীয়টা অনেক বেশি থ্রিলিং। আমি অবশ্য আমার কথা ভেবে এসব বলছি না। বলছি লুসির কথা ভেবে। কঙ্গোর জঙ্গলে আমি তিন রাত গাছের উপরে বসে কাটিয়েছি। এক ওয়াটারবটল জল ছিল, তাই খেয়ে ছিলাম। গাছের নীচে সারারাত-দিন সিংহ, হায়েনা, টাইগার এমনকী, র্যাটল স্নেককেও ঘুরঘুর করতে দেখেছি। তবু নার্ভ শক্ত রেখেছিলাম, হ্যাঁ। মেজর বললেন।
কঙ্গোয় সিংহ পাওয়া যায়? প্লেন্টি!
ঠোঁট ওলটালেন মেজর।
তা হলে তো আপনার কোনও সমস্যা নেই। তা হলে লুসিকেই ওখানে রেখে আসি। ওঁকেই তো ওরা টার্গেট করেছে! অর্জুন দেখল লোকটি আবার এসে দাঁড়িয়েছে, ও একটু মাদারিহাট গিয়েছে সাহেব।
কী করে যাও তোমরা? হেঁটে?
না, সাইকেলে। খাবার আনতে যাব?
নাঃ! এখানে বসে থেকে সাহেবদের একঘেয়ে লাগছে। আমরাই যাই। গিয়ে ডিনার সেরে ফিরব। তুমি পদমবাহাদুরকে তৈরি হতে বলো।’ অর্জুন মাথা নাড়ল। মনে হচ্ছিল, লোকটি বেশ হতাশ হয়েছে।
.
সন্ধে সাড়ে ছ’টায় ওরা গাড়িতে উঠে বসল। লুসি তাঁর টেপ রেকর্ডার এবং রেকর্ডেড ক্যাসেটগুলো সঙ্গে নিয়েছেন। নির্জন বনপথে গাড়ি চালাতে চালাতে পদমবাহাদুর বলল, ওই বাংলোয় ভূত আছে সাহেব।
ভূত? মেজর পিছনের সিটে লুসির পাশে বসেছিলেন, চমকে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, সাহেব। কাল রাতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। জঙ্গল থেকে বেরোচ্ছিল আবার ঢুকে যাচ্ছিল। পদমবাহাদুর বলল।
তুমি তখন কী করছিলে? পাশে বসা অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমি তো গাড়িতে শুয়ে ছিলাম। ওসব দেখে জানলার কাচ তুলে দিলাম। ভূতগুলো বুঝতে পারেনি আমি গাড়ির ভিতরে আছি।
ভূতগুলো মানে?
তিন জন। সাহেব, আজ রাতে আমি আর গাড়ির ভিতর শোব না।
তুমি তো ইচ্ছে করলে ডাইনিং রুমে শুতে পারতে।
ওরে বাপ! মশা আমাকে শেষ করে দিত।
কিন্তু গাড়িতে কেউ না থাকলে আবার ইঞ্জিনের বারোটা বাজাতে চাইবে ভূতগুলো। ঠিক আছে, আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে গাড়িতে থাকব। অর্জুন বলল।
তা হলে মুশকিল হবে না। আপনি পিছনে শোবেন, আমি সামনে। পদমবাহাদুর এই সমাধানে খুশি হল।
জঙ্গলে ঢোকার প্রধান গেটে নামধাম লিখিয়ে বেরোবার সময় অর্জুন জানাল, ওরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে।
মাদারিহাটের দিকে না গিয়ে হাসিমারার দিকে গাড়ি চালাতে বলল অর্জুন। দু’পাশে ঘন অন্ধকার। একটা ব্রিজ পার হয়ে গেল গাড়ি। রাস্তাটা বাঁ দিকে ঘুরতেই অর্জুন চাপা গলায় পদমবাহাদুরকে জিজ্ঞেস করল, হেডলাইট নিভিয়ে চালাতে পারবে?
পারব। তবে বেশি দূরে যেতে পারব না। খুব অন্ধকার।
চেষ্টা করো। গাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিয়ে চলো।
সঙ্গেসঙ্গে ঝপাং করে যেন অন্ধকার ওদের গিলে ফেলল। ওই অবস্থায় গাড়ি চালানো মুশকিল। অর্জুন বলল, বাঁ দিকের জঙ্গলের মধ্যে নেমে যাও।
সাহেব, ওখানে গর্ত থাকতে পারে।
আমার মনে হচ্ছে নেই।
অতএব গাড়ির গতি শ্লথ করে পিচের রাস্তা ছেড়ে নড়বড় করতে করতে গাড়ি যেখানে দাঁড়াল, তার সামনে ঝোঁপঝাড়।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী হল?
আমাদের কেউ ফলো করছে কিনা দ্যাখা দরকার। অর্জুন বলল।
ওঃ! তাই বলো।
অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল। লুসি বললেন, একটু বাইরে যেতে পারি?
অর্জুন বলল, খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বেরোনোই উচিত।
কেন? লুসি জিজ্ঞেস করলেন।
এই জঙ্গলের সাপ খুব বিখ্যাত। তা ছাড়া জোঁক তো আছেই।
মিনিটপাঁচেকের মধ্যে মাদারিহাট থেকে দুটো ট্রাক ছাড়া কোনও গাড়িকে আসতে দেখা গেল না। উলটো দিক থেকে আসা গাড়ির সংখ্যাই বেশি। যদি কেউ তাদের অনুসরণ করত, তা হলে এই সময়ের মধ্যেই বোঝা যেত।
অর্জুন যখন পদমবাহাদুরকে বলতে যাচ্ছিল আবার রওনা হতে, ঠিক তখনই হেডলাইটের আলো দ্যাখা গেল। গাড়িটা আসছে মাদারিহাট থেকে। গাড়ির গতি কমে গেল হঠাই। একটা লোক চিৎকার করে কথা বলছে মোবাইলে। বারংবার ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলছে। এত দূর থেকে কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তারপর গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে আবার ফিরে গেল মাদারিহাটের দিকে। অর্জুন পদমবাহাদুরকে বলল, চলো।
লুসি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
আমরা যে হাসিমারায় পৌঁছোইনি, এই খবরটা মোবাইলে জানানো হল। তাই ওরা ফিরে গেল মাদারিহাটেই আছি কিনা দেখতে। অর্জুন বলল।
তার মানে ওরা আমাদের অনুসরণ করছে! মেজর বললেন, কিন্তু মাদারিহাটে ফিরে গেল কেন? আমরা তো এই পথের অন্য কোথাও থাকতে পারি!
এর উত্তর একটাই। আমাদের পরপর যে-দুটো ট্রাক হাসিমারার দিকে গিয়েছে, তাদের কাছ থেকে ওরা শুনেছে, রাস্তায় এইরকম কোনও গাড়িকে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি।
তা হতে পারে, মেজর মাথা নাড়লেন, তার মানে হাসিমারা এবং জলদাপাড়া, দুটো জায়গাতেই ওদের লোক রয়েছে।
অর্জুন উত্তর দিল না।
ওরা যখন সুভাষিণী চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর সামনে পৌঁছোল, তখন রাত আটটা। বাংলোর চৌকিদার জানাল, বড়সাহেব কলকাতায় গিয়েছেন মিটিং করতে। কিন্তু লোকটা অর্জুনকে চিনতে পারল। অর্জুন এই বাংলোয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে কয়েকবার এসেছিল। অনিন্দ্য ম্যানেজার হয়ে আসার পরেও এসেছিল। কিন্তু দরোয়ানের ক্ষমতা নেই গেস্টহাউজের দরজা খুলে দেওয়ার। সে ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে খবর দিল।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার চলে এলেন মিনিট আটেকের মধ্যে। অর্জুনকে তিনি ভাল করে চেনেন। তৎক্ষণাৎ কলকাতায় ফোন করে অনিন্দ্যকে ধরলেন। কথা বলে রিসিভার দিলেন অর্জুনকে।
অনিন্দ্য বললেন, কী আশ্চর্য! আপনি হঠাৎ…। একটু জানিয়ে আসবেন। তো!
অর্জুন বলল, আচমকা আসতে হল। বিপদে পড়েছি একটু। আমাদের সঙ্গে একজন আমেরিকান মহিলা আছেন। তাঁর জন্য একটা থাকার জায়গা দরকার।
আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি ওখানে থাকলে কোনও সমস্যা হত না। একটু কথা বলে নিই…!
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় অনিন্দ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে নির্দেশ দিল লুসির থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। শুধু তাই নয়, ওঁর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে যেন কোনও অযত্ন না হয়।
লুসিকে সুন্দর গেস্টহাউজে তুলে দিয়ে অর্জুন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে অনুরোধ করল, বাইরের কেউ যেন ওঁর কাছে না ঘেঁষতে পারে। উনি এখানে আছেন, তা গোপন না রাখলে ওঁর ক্ষতি হবে।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, কোনও চিন্তা করবেন না। এখানে উনি নিরাপদে থাকবেন। কিন্তু আপনারা কি এখানে থাকছেন না?
না। আমাদের ফিরে যেতে হবে হলং বাংলোয়।
লুসিকে বিশ্রাম নিতে বললেন মেজর। বললেন, বাংলোর বাইরে যেয়ো না, অচেনা জায়গা। আমরা কাল সকালেই ফিরে আসছি।
লুসির পক্ষে বাংলা বোঝা সম্ভব ছিল না। ইংরেজিতে যে কটা কথা হয়েছে, তা থেকে তিনি অনুমান করেছেন যা করবার। এখন মেজরের কথা শুনে প্রতিবাদ করলেন, আমি বুঝতে চাই, আমাকে অর্জুন কী ভাবছেন? আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই বোধহয় এখানে থাকতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি অর্জুনের সঙ্গে থাকতে পারো, তা হলে আমি পারব না কেন? আমি তোমার চেয়ে অনেক জোরে দৌড়োত পারি। আমার শরীরে শক্তি খুব কম নেই। শুধু মহিলা বলে যদি আমাকে তোমরা এখানে থাকতে বলো, তা হলে আমি তার প্রতিবাদ করছি।
আমেরিকানরা যখন উত্তেজিত বা আবেগে আপ্লুত হয়ে কথা বলেন, তখন তাঁদের উচ্চারণ ঠিকঠাক বুঝতে পারা ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব নয়। অর্জুনের কানেও সব শব্দ অর্থবহ হয়ে উঠল না। মেজরেরও কথা বলার ধরন। পালটে গেল। অভ্যস্ত আমেরিকান অ্যাকসেন্টে তিনি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে হাল ছাড়লেন। অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বললেন, ও আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইছে। দ্যাখো, ওর সঙ্গে কথা বলে পারো কিনা বোঝাতে!
অর্জুন হাসল। ভারতীয় উচ্চারণে কেটে কেটে সে কথা বলল, লুসি, আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু ধরুন, আজ যদি আমার অথবা মেজরের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়, তা হলে ডক্টর মুলেনের গবেষণা থেমে থাকবে না। আপনার কিছু হলে সেটা আঘাত পাবে। তা ছাড়া বোঝাই যাচ্ছে, ওদের লক্ষ্য আপনি। তাই জেনেশুনে ওদের কাজটাকে সহজ করে দেওয়া কি ঠিক হবে?
লুসি মাথা নাড়লেন, কথাটায় যুক্তি আছে। কিন্তু ওরা তো আপনাকেও মেরে ফেলতে পারে। আপনি কেন জেনেশুনে ঝুঁকি নিচ্ছেন?
আমি একজন সত্যসন্ধানী। বিষ্টসাহেব এবং মেজর আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, যাতে আপনি কাজ শেষ করে নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন। আমি সেই দায়িত্ব পালন করছি। এটা আমার প্রফেশন। অর্জুন হাসল।
প্রফেশন? তা হলে নিশ্চয়ই আপনি ফি নিচ্ছেন! কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি জানি না, আপনি ইন্ডিয়ান টাকায় কত ফি নিয়ে থাকেন!
এর জন্য তো মেজর আছেন। আমি কাজটাকেই গুরুত্ব দিই। টাকা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করি না। আচ্ছা, গুডনাইট।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের অনুরোধে ডাইনিং রুমে গিয়ে কিছু জলখাবার খেয়ে অর্জুনরা যখন বেরোল, তখন সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে।
পদমবাহাদুর বিড়বিড় করল, এখানে রাতটা থাকলেই তো ভাল হত!
অর্জুন বলল, এখানে থাকা আর জলপাইগুড়িতে রাত কাটানো একই ব্যাপার।
পদমবাহাদুর চুপ করে গেল।
গাড়ি চা-বাগান থেকে বেরোবার পর মেজর নড়েচড়ে বসলেন, অর্জুন!
বলুন। অর্জুন তাকাল।
লুসির কথা শুনে মনে হচ্ছে ভুলটা আমারই। তোমার সম্মানদক্ষিণা কত তা জানা হয়নি। সেটা যাই হোক, ও নিয়ে কোনও চিন্তা কোরো না, মেজর বাইরে তাকালেন।
কী আশ্চর্য! মেজর, আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? অর্জুন চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
না, কেন?
আপনার কাছে আমি টাকা চাইতে পারি? যা দেবেন, তাই মাথা পেতে নেব। অর্জুন বলল। সোজা জলদাপাড়ায় না গিয়ে মাদারিহাট বাজারের দিকে গাড়ি নিয়ে যেতে অর্জুন বলল পদমবাহাদুরকে। তখন বাজারের দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু একটা পাঞ্জাবি ধাবার ভিতর আলো জ্বলছে। কিছু লোকজন তখনও রয়েছে দোকানে।
একটু আগে জলখাবার খাওয়ার কারণে মেজরের খাওয়ার ইচ্ছে নেই, অর্জুনেরও তাই। পদমবাহাদুরকে বলা হল রাতের খাবার খেয়ে নিতে। কিন্তু সে খেতে চাইল না এখন। বলল, খাবার প্যাকেটে নিয়ে বাংলোয় গিয়ে খাবে। মেজর তাকে ধমকালেন, ঠান্ডা হয়ে গেলে এসব খাবার খাওয়া যায় না। পদমবাহাদুর মাথা নাড়ল, ঠান্ডা খাবার খেতে সে অভ্যস্ত। অর্জুন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, কফি পাওয়া যাবে?
জি সাব।
দুটো কফি দাও।
মেজর বললেন, চিনি-দুধ ছাড়া একটা।
ভিতরে বসুন সাব।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনাআটেক লোক বিভিন্ন টেবিলে বসে খাচ্ছে। মেজর চেয়ারে বসে নাক টানলেন, সেই গন্ধ! বুঝলে অর্জুন, এখানে হাঁড়িয়াও বিক্রি হয়।
হলেও সেটা আইনসম্মত নয়।
বুঝতে পারছি।
কী?
তোমার ওই পদমবাহাদুর, এখানে ডিনার করল না! আমাদের সামনে তো হাঁড়িয়া পান করতে পারবে না। আবার ডিনার করে ফেললে ভরা পেটে হাঁড়িয়া খেয়ে সুখ পাবে না। তাই বাংলোয় খাবার নিয়ে চলল। সেখানে গিয়ে জম্পেশ করে হাঁড়িয়া খেয়ে ডিনার সারবে। তখন খাবার ঠান্ডা না গরম, তা। নিয়ে কে মাথা ঘামাবে!
হঠাৎ কোনার টেবিল থেকে একটা রোগা লোক উঠে এসে সামনে দাঁড়াল, নমস্কার দাদা। আমাকে চিনতে পারছেন?
লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। চোখ আধবোজা। কয়েক সেকেন্ডে মনে পড়ে গেল রূপমায়া সিনেমার ব্ল্যাকারদের একজন। থানার একজন এস আই খুব মারছিল একে। অর্জুন বাধা দিয়ে বলেছিল, একে মেরে কী লাভ। পেটের দায়ে এই লোকটা কমিশনে কাজ করে। যে চক্র টিকিট ব্ল্যাক করায়, তাদের উচ্ছেদ করুন আগে। সেটা বন্ধ হলে এরা বিকল্প রোজগারের পথ ধরবে। অর্জুনের কথায় যুক্তি ছিল। লোকটাকে ছেড়ে দিয়েছিল এস. আই.।
মনে পড়েছে। তুমি এখানে? এখানে কি সিনেমা হল আছে? অর্জুন তাকাল।
সঙ্গে সঙ্গে জিভ বের করে নিজের কান ধরল লোকটা, ছি ছি ছি। ওসব কবে ছেড়ে দিয়েছি। আপনি আমাকে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তারপর আর ও-লাইনে যাইনি। এই মাদারিহাটে ছোটখাটো ব্যাবসা করছি আজ দু’বছর।
বাঃ! ভাল। কফি এসে যাওয়ায় সেদিকে তাকাল অর্জুন।
কিন্তু আপনি দাদা এত রাতে এখানে?
কফি খেতে ঢুকলাম।
ও। লোকটি সোজা হওয়ার চেষ্টা করল, কোথায় উঠেছেন দাদা?
হলং ফরেস্ট বাংলোয়।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চোখ বড় করে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও মেমসাহেব নেই! তাই তো?
অর্জুন কোনার টেবিলের দিকে তাকাল, ওরা কারা?
এখানকার লোক।
কফি যেটুকু খাওয়া গেল তাতেই খুব বিস্বাদ। পদমবাহাদুরের খাবার আর ওদের কফির দাম মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় অর্জুন দেখল, লোকটাও পিছন পিছন আসছে। অর্জুন তাকে জিজ্ঞেস করল, এখানে তোমার কাজ আছে?
এখন না। বারোটার পর…!
চলো, একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক। ভয় নেই, তোমাকে বারোটার আগেই এখানে নামিয়ে দেব। এসো।
মেজরকে পদমবাহাদুরের পাশে বসতে বলে, লোকটাকে নিয়ে পিছনের সিটে বসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার নামটা কী যেন!
সনাতন।
পদমবাহাদুর গাড়ি চালু করলে সনাতন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন?
কোথাও না। একটু চক্কর মেরে আবার ফিরে আসব।
এসব জায়গা আঁধারে ভাল না দাদা।
কেন?
রাত বাড়লেই এখানে ধান্দাবাজি শুরু হয়ে যায়!
ও। এখন বলো তো, আমাদের সঙ্গে মেমসাহেব আছে কিনা কেন জিজ্ঞেস করছিলে?
কী বলব দাদা। এখানকার বাতাসে এখন একটাই খবর ভাসছে। হলং বাংলোয় একজন মেমসাহেব এসেছেন বাঙালিদের সঙ্গে, যাঁকে মেরে ফেললে দশ হাজার আর জ্যান্ত ধরে আনলে পঁচিশ হাজার পাওয়া যাবে। সনাতন বলল।
খবরটা কে ভাসাল?
জানি না। মুখে মুখে চাউর হয়ে গেছে।
টাকাটা কে দেবে?
সনাতন চুপ করে থাকল। হঠাৎ পদমবাহাদুর ড্রাইভিং সিটে বসেই গলা তুলে বলল, ও মিথ্যে কথা বলছে সাব। এক নম্বরের মিথ্যেবাদী।
তুমি ওকে চেনো? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
চিনব না? জলপাইগুড়িতে টিকিট ব্ল্যাক করেছে, মিনিবাসের খালাসির কাজ করেছে; ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চিৎকার করে কাস্টমার ধরে জোর করে টাকা নিতে গিয়ে রামধোলাইও খেয়েছে একবার। ওর বড় ছেলে আমার পাড়ায় থাকে। অথচ এখানে আমাকে দেখে এমন ভান করছে, যেন কোনওদিন দ্যাখেনি! সনাতন, সত্যি কথা বল সাবকে, না হলে তুই জলপাইগুড়িতে ঢুকতে পারবি না। পদমবাহাদুর চেঁচাল।
আরে পদমদা নাকি! মাইরি বলছি, আঁধারে বুঝতেই পারিনি। তারপরে এক গলা হাড়িয়া খেয়ে চোখে ঝাপসা দেখছি…! বিশ্বাস করো।
মেজর একটু নড়েচড়ে বসলেন। সম্ভবত হাড়িয়া শব্দটা কানে যেতেই তার শরীর নড়ে উঠল।
অর্জুন বলল, এখানে তুমি কোথায় থাকো?
একটা ঝুপড়িতে। দু-তিনজন মিলে।
রাত বারোটায় তোমার কী কাজ থাকতে পারে?
একজনকে ফুন্টশোলিং পৌঁছোতে হবে। ওই যারা আমার সঙ্গে বসে ছিল, তাদের একজন ড্রাইভার। চারশো টাকা চেয়েছি। ওকে তিনশো দিতে হবে।
অত রাতে লোকটা কোত্থেকে আসবে?
জানি না দাদা। বলেছি ওই ধাবার সামনে আসতে। বিদেশি তো, তাই চিনতে অসুবিধে হবে না। আমি একটাও মিথ্যে বলছি না দাদা!
বিদেশি মানে? ভুটানি?
না, না। সাদা চামড়ার সাহেব।
কোন দেশের?
তা জানি না দাদা।
সেই সাহেবের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল?
হ্যাঁ, মানে, না দাদা!
পদমবাহাদুর বলল, বহুত জালি আদমি হ্যায়।
লোক দুটো শিলিগুড়িতে থাকে। বীরপাড়া থেকে প্রীতমের গাড়ি ভাড়া করে এখানে এসেছে। শিলিগুড়ির মাইকেল সাহেবের লোক।
মাইকেল! ঝাপসা মনে এল নামটা। শিলিগুড়ি মূলত মাফিয়াদের শহর। আর এই মাফিয়াদের নেতা এত দ্রুত বদলায় যে, তাল রাখা মুশকিল। কিন্তু ওই মাইকেল নামটা যেন বেশ কিছুদিন ধরে অর্জুন শুনছে।
পদমবাহাদুর জিজ্ঞেস করল, সাব, গেটে এসে গিয়েছি।
ভিতরে চলো।
পদমবাহাদুর গাড়ি থেকে নেমে গেটের রক্ষীদের কাছে গিয়ে কাগজপত্র দেখিয়ে সইসাবুদ করলে গেট খুলল। সেই সময় প্রহরীদের একজন জিজ্ঞেস করল, কিতনা আদমি হ্যায়?
আমাকে নিয়ে চারজন, পদমবাহাদুর জবাব দিল।
তো ঠিক হ্যায়।
গাড়ির ভিতর যে অন্ধকার, তা দরজা খোলা-বন্ধের সময় আলো জ্বলে উঠতেই উধাও হচ্ছিল। অর্জুন সে সময় সনাতনের মাথাটা নীচে নামিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছিল। গাড়ি চলতে শুরু করলে সনাতন ককিয়ে উঠল, এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
কোথায় যাচ্ছি তা তো বুঝতেই পারছ! অর্জুন বলল।
কিন্তু হলং বাংলোয় গিয়ে আমি কী করব? ওখান থেকে রাতের বেলা বেরোতে পারব না। হায়, হায়, আমার একশো টাকা চোট হয়ে যাবে আজ।
চোট হলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব। তা ছাড়া বলেছি তো, বারোটার আগেই তোমাকে পৌঁছে দেব। এখন বললো, টাকাটা কার কাছে পাওয়া যাবে।
সত্যি বলছি…!
বাধা দিল অর্জুন, ওই হলং বাংলোয় একজন আমেরিকান মেমসাহেব আছেন। আমি ওঁকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরে তোমাকে দিতে পারি। কিন্তু কেন দেব? তুমি তো নিজেই পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে!
কোন বদমাশ হাওয়া হবে? আমি বেইমান নই দাদা। আপনি যদি ওকে ধরে জঙ্গল থেকে বের করে দিতে পারেন, তা হলে আপনার অর্ধেক, আমার অর্ধেক।
অসম্ভব। আমার পনেরো, তোমার দশ।
বেশ, ঠিক হ্যায়। কবে পারবেন?
কবে মানে? এসব কেসে কেউ দেরি করে? লোক নেমে গেছে, দেখব আমি কিছু করার আগেই কেউ ওকে হাওয়া করে দিয়েছে। অর্জুন বলল।
ঠিক কথা। ওরা আজ চেষ্টা করবেই।
কারা?
শিলিগুড়ির লোক দুটো। জ্যান্ত না আনতে পারলে মেরে ফেলবে।
সেটা আমি হতে দিচ্ছি না সনাতন। কিন্তু টাকাটা পাওয়া যাবে তো?
আমার উপর ছেড়ে দিন। মাল না দিলে ডেলিভারি দেব না।
কিন্তু কে মাল দেবে?
কেন? শিলিগুড়ির লোক দু’টো যার জন্য খাটছে, সে!
ওই বিদেশি ভদ্রলোক?
হ্যাঁ।
তুমি কী করে জানলে?
দাদা, হাওয়ায় কথা ভাসে?
চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। লোকটা কোথায় উঠেছে?
আমি জানি না দাদা। আমাদের সঙ্গে একবারও দেখা করেনি। শিলিগুড়ির লোক দুটোই কথা বলতে এসেছে, সনাতন বলল।
ট্রানজিটের খাঁচা ভেঙে সাপটাকে কে বের করেছে?
সাপ? কী সাপ?
তুমি শোনোনি, ফরেস্টের খাঁচা থেকে একটা সাপ চুরি করা হয়েছে?
না দাদা। কবে হয়েছে?
অর্জুন চুপ করে গেল। হয় লোকটা মিথ্যে বলছে, নয় সত্যি জানে না। কিন্তু এখানে থাকলে না জানার কোনও কারণ নেই। ছোট্ট জায়গা, এত বড় খবর না জেনে উপায় নেই। একে নিয়ে কী করা যায় ভাবছিল অর্জুন।
হঠাৎ ঝকানি দিয়ে গাড়ি থামাল পদমবাহাদুর। অর্জুন দেখল, তাদের গাড়ির হেডলাইটের সামনে একটা বিশাল চেহারার হাতি ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, এদিকেই মুখ করে।
অর্জুন চাপা গলায় বলল, হেডলাইট, সাইডলাইট সব নিভিয়ে দাও।
আলো নিভে যাওয়ামাত্র মেজরের মন্তব্য শোনা গেল, ভয়ংকর ভাল।
পদমবাহাদুর নিচু স্বরে বলল, কথা বলবেন না।
ঠিক আছে, মেজর গলা নামালেন, কিন্তু ওটা ওখানে কী করছে?
কাকতালীয়ভাবে হাতিটা শুড় তুলে গর্জন করতেই বাঁ দিকের জঙ্গল থেকে পিলপিল করে বাচ্চা-বড় হাতির পাল বেরিয়ে এসে রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকে যেতে লাগল। নেতা হাতিটি একপা-ও নড়েনি। ঠায় চেয়ে ছিল গাড়ির দিকে। দলের শেষ সদস্য জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ার পর সে বিজয়ীর ভঙ্গিতে পা বাড়াল। তারও মিনিটপাঁচেক পরে আবার হেডলাইট জ্বালাল পদমবাহাদুর।
সনাতন বলল, রাখে হরি মারে কে? গত মাসে চাপড়ামারিতে হেডলাইট জ্বলতে দেখে গাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল হাতিরা।