শেখর আর জয়া
শেখর আর জয়া বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে, বাগানে পাতা টেবিল-চেয়ার তুলছে রতিলাল। টেবিলের উপর ফাঁকা ডিসগুলো পড়ে আছে, ঝকঝকে পরিষ্কার, খাবার দেবার সুযোগ হয় নি। রেঞ্জার সুখেদুর সঙ্গে কী যেন কথা বলছে সঞ্জয়। সেদিকে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে শেখর জয়াকে বললো, আজকাল একটা মুশকিল হয়েছে, কোনো একজন মানুষ-ভালো কি খারাপ, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এই কনজারভেটর লোকটিকে ঠিক কি রকম মনে হলো তোমার? আমার তো দেখে মনে হলো বেশ ভদ্ৰ, এলো আর চলে গেল, কোনো খাবার ছুলো না। অথচ শুনেছি, অৰ্ন্যবার এসে নাকি সব খাবার হালুম হুলুম করে খায়! আশ্চৰ্য, লোকটা তা হলো-ভদ্র না ভণ্ড?
জয়া হেসে বললো, আপনি সব মানুষ দেখেই বুঝি ভালো কি খারাপ বিচার করতে চান? আমার তো লোকটাকে দেখেকিছুই মনে হয়নি। সব লোকই তো এই রকম-খানিকটা খানিকটা ভণ্ড–
–যাঃ, সব লোকই ভণ্ড হবে কেন?
জয় অন্যদিকে মুখ ফেরালো, খানিকটা উদাসীনভাবে বললো, হয়, আমি জানি।
জয়ার উদাসীনতাটুকু লক্ষ করে শেখর চুপ করে গেল। জয়া দূরের জঙ্গলের ক্রমশ অবনত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টি। শেখর একটা সিগারেট ধরালো।
রতিলাল কাপ—ডিসগুলো জড়ো করেছিল একজায়গায়, সেগুলো তুলতে গিয়েও নামিয়ে রেখে হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলো। চমকে উঠলো। ওরা দুজনেই। ধুতির ওপর খাকি পোশাকে জোয়ান চেহারার মানুষ, সে হঠাৎ মাটিতে বসে পড়ে কান্নায় আকুল হলো। যেন অমন একজন বয়স্ক পুরুষকে ওরকমভাবে কখনো কাঁদতে দেখে নি, সে রকমভাবে জয়া বললো, ওমা, ওকি? ওরকম করছে কেন?
শেখর বললো, বোধহয় ওর চাকরি যাবে!
–লোকটা চাকরি যাবার ভয়ে ওরকমভাবে কাঁদছে নাকি? আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি। এমন কিছু আজ হয় নি, যে জন্য। ওর চাকরি যেতে পারে—আমার তো মনে হয়, সঞ্জয়বাবু যে রকম অকারণে কনজারভেটরের সঙ্গে রাগারগি করলেন—সেই জন্যই ওর চাকরি যেতে পারে। নইলে সত্যিই তো এমন কিছু হয় নি।
–সঞ্জয়টা ঐরকমই…পাগলামি যত সব! এইসব লোকদের ব্যাপারে ওর একটা গ্লানি আছে। দেখছে না, ওর কপালে ঐ কাটা দাগটা—
–কী হয়েছিল?
–থাক, সে গল্প শুনে আর কি হবে!
জয়া বনেদী বাড়ির মেয়ে ও বউ, অকারণে কৌতূহল প্রকাশ না করার একটা বংশগত শিক্ষা আছে! সেই কারণে, ও বিষয়ে আর প্রশ্ন না করে আপন মনে বললো, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এমন একটা কিছু না, যদি চাকরি যায়ও, আমি বাবাকে বলে আমাদের কাঠের গোলার ওর একটা চাকরি করে দেবো না-হয়।
সঞ্জয়ের গলার অ্যাওয়াজ ক্রমশ চড়ছে, সুখে দুকে সে কি যেন বোঝাতে চাইছে ব্যস্তভাবে। বারান্দা থেকে শেখর আর জয়া তাকিয়ে রইলো সেদিকে। জয়া শেখরকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, সঞ্জয়বাবু কি আপনাদের অনেকদিনের বন্ধু?
শেখর বললো, হাঁঠা, ছেলেবেলার বন্ধু! এখন মাঝে মাঝে অনেকদিন দেখা হয় না, কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না কখনো।
–উনি। কিন্তু আপনাদের তিন বন্ধুর থেকে অনেক আলাদা।
–কেন আলাদা?
–দেখলেই মনে হয়। সব সময় কপাল কুঁচকে থাকেন–কি একটা ব্যাপারে যেন খুব চিন্তিত। বেড়াতে এসেও সে কথা ভুলতে পারেন নি!
শেখর একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে পড়লো, মাসখানেক আগে এক ভোরবেলা সঞ্জয় তার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল, উদ্ধাত্রান্ত চেহারা, ক্ষতবিক্ষত মুখ…। শেখর বললো, সঞ্জয় সত্যিই আমাদের মতন নয়, ও খুব ভালো ছেলে।
জয়া বললো, তা দেখলেই বোঝা যায়, বড্ড বেশি ভালো।
সঞ্জয় উত্তেজিতভাবে ওদের দিকে এগিয়ে এলো। সারা মুখে তার ক্রোধ ও বেদনা। বললো, জানিস, কি ধ্যাপার? কল্পনা করা যায় না! কোন দেশে আছি? আজ সকাল দশটায় ডাক্তার এসে বলে গেছে ওরা কষ্ট আর এক বেলাও বাঁচবে কি না সন্দেহ আর ও সারা দুপুর এখানে সাহেবদের সেকার জন্য…ঐ রেঞ্জার সুখে দুষ্ট। ওকে চাকরির ভয়, অমানুষিক ব্যাপার–
শেখর বললে, ঠিক জানতুম, কোথাও একটা কিছু গণ্ডগোল আছে। ঐ রেঞ্জাবেরই স্বাৰ্থ…
–কে জানে কার স্বাৰ্থ! অসহ্য! অসহ্য! মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না যে দেশে…আমি রেঞ্জারকে বলেছি, ওকেও যেতে হবে, আমরা সবাই রতিলালের বাড়ি যাবো, চল–।
—রতিলালের বাড়ি? আমরা সবাই গিয়ে কি করবো?
—বাঃ, আমাদের একটা দায়িত্ব নেই? আমরা শুধু আরাম করবো। আর পয়সা দিয়ে দায় মেটাবো? এ সময় আমাদের সবারই ওর পাশে দাঁড়ানো দরকার—
—সবাই গেলে কোনো লাভই হবে না—শুধু ওকে বিব্রত করাই হবে। তাছাড়া রবি আসে নি, অপর্ণা, আর অসীম কোনোদিকে গেলে, তুই বরং একা যা, তোর যাওয়া দরকার।
—দরকার? আমার একার কি দরকার! আমার একার দায়িত্ব নাকি?
—হাঁ, তোরই যাওয়া দরকার, তাতে তোর ভালো হবে। তুই যা।
–তার মানে?
সঞ্জয় দুচোখ এক রেখায় করে তাকালো শেখরের দিকে। শেখর স্পষ্ট স্পন্দনহীন চোখে চেয়ে আছে। দুএক মুহূর্ত, তারপর সঞ্জয়ের মুখে আলতো ব্যথার আভাস ভেসে উঠলো, নিঃশ্বাস ফেলে চাপা গলায় সে বললো, হ্যাঁ যাই, আমি ঘুরে আসি—।
এতক্ষণ অস্বাভাবিক রকমের উত্তেজিত ছিল সঞ্জয়। হঠাৎ বদলে গেল। দুর্বল মানুষের মতন আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে, বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে না নেমে সিঁড়ি ভাঙলো, সেইরকমই মন্থরভাবে এগিয়ে রতিলালের কাঁধে হাত রেখে বললো, চলো!
ওদের দলটা ডাকবাংলোর এলাকার প্রান্তে পৌঁছালে শেখর চেঁচিয়ে বললো, সঞ্জয়, বেশি দেরি হলে একটা খবর পাঠাস কারুকে দিয়ে!
নিরালা হয়ে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ শেখর আর জয়া চুপ করে বসে রইলো। অন্ধকার ভারী হয়ে নেমে এসেছে, বাংলোয় আলো জ্বালা হয় নি, দৃষ্টির সীমায় কোনো আলো নেই, পাশাপাশি ওরা দুটি মূর্তি ঝিঝির একঘেয়ে ডাক, কখনো জোর, কখনো বাঁ মৃদু, হাওয়ায় গাছের পাতায় বিভিন্ন রকম শব্দ। এক একটা পাতার সরসরানি এমন হয়, যেন মনে হয় বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই নেই, আকাশে একছিটে মেঘ নেই, আস্তে আস্তে সেদিনের চাঁদ তার সেদিনের নিজস্ব রীতিতে জেল্লা ছড়াচ্ছে।
খানিকটা পরে শেখর সচকিত হয়ে বললো, রুণি আর অসীম এখনো এলো না! ওদের খোঁজ করবো?
-থাক না, একটু বেড়াচ্ছে।
–কিন্তু এই অন্ধকারে… তোমাদের ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
–না, এমন কিছু দেরি হয় নি। কোনো দরকার থাকলে পরমেশ্বর খবর নিতে আসতো। জানে তো এখানেই আছি।
–-কিন্তু তোমার শ্বশুর কি ভাববেন?
–কি ভাববেন?
–মানে, তোমরা দুটি মেয়ে এতগুলো ছেলেছোকরার সঙ্গে ডাকবাংলোয় আছ…।
জয় ঝরঝর করে হেসে বললে, আমার শ্বশুরের চেয়ে আপনারই ভাবনা যে বেশি দেখছি! শেখর একটু অপ্ৰস্তুত হয়ে বললো, না, মানে ভাবতে তো পারেন-যাই হোক-আমাদের সঙ্গে খুব বেশি তো চেনা নয়–।
বাইরে এলে অনেককিছুই অন্য রকম! কলকাতায় আলাপ হলে সহজে আড়ষ্টতা ভাঙতে চায় না, কিন্তু বাইরে জঙ্গলের মধ্যে সব জিনিসটা সহজ হয়ে যায়।আপনার বন্ধুদের সঙ্গে তো মনে হচ্ছে যেন কতদিনের চেনা!
–তোমার সঙ্গে আমার তো অনেক দিনেরই চেনা। কলেজে…তখন বোধহয় তোমার দিকে দুএকটা ইশারা ইঙ্গিতও করেছিলাম।
–বাবাঃ, কলেজে আপনি যা দুৰ্দান্ত ছিলেন!। সব মেয়েদের আপনি বিষম জ্বালাতন করতেন।
—-জ্বালাতন করবো না কেন? মেয়েরা আমাকে পাত্তা দিতেই চাইতো না। সেইজন্যই জ্বালাতন করে…
–বাজে কথা বলবেন না! একমুখ দাড়ি রেখে, ময়লা জামা-প্যাণ্ট পরে কলেজে এসে খুব বীরত্ব দেখাতেন! ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া আর অসভ্য কথা বলার জন্যই তো আপনি বিখ্যাত ছিলেন!
—শুধু সেইজন্য বিখ্যাত ছিলুম? আমি ম্যাট্রিকে থার্ড স্ট্যান্ড করেছিলাম না?
–ভারী তো থার্ড! ফাষ্ট কিংবা সেকেন্ড তো হন নি! সেইজন্যই ফাষ্ট সেকেন্ড বয়দের থেকে আলাদা হবার চেষ্টায় ঐরকম চ্যাংড়া সেজে থাকা।
——আমি তোমার সঙ্গে কোনোদিন চ্যাংড়ামি করেছি?
আপনার সাহসই হতো না! একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ফেলে আপনি একটা মেয়েকে…কি যেন নাম ছিল মেয়েটার? সোফিয়া? হ্যাঁ, সোফিয়া চৌধুরী, দারুণ দেখতে, ইংলিশ-এ অনার্স ছিল, আপনি বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ফেলে পেছন থেকে গিয়ে তার চোখ টিপে ধরেছিলেন। সারা কলেজে ছড়িয়েছিল সেই গল্প! আমি শুনে বলেছিলাম, আমার সঙ্গে ওরকম করতে এলে চালাকি বার করে দিতাম!
শেখর হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, কি করতে?
জয়া ডান হাতটা মুঠো করে তুলে ধরে বললো, গুম্ গুম্ করে পিঠে কিল মারতাম। দুজনেই অনাবিলভাবে হেসে উঠলো! জয় বললো, এখন কিন্তু আপনি অনেক শান্ত হয়ে গেছেন।
শেখর খানিকটা চিন্তিতভাবে বললো, শান্ত হয়ে গেছি? কি জানি। কিন্তু এ জঙ্গলে বেড়াতে এসে আমার কিন্তু সত্যিই নিজেকে খুব শান্ত লাগছে। এই দেখো না, এতক্ষণ তোমার সঙ্গে নিরালায় বসে আছি, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু তোমার সঙ্গে একটুও দুষ্টুমি করার চেষ্টা করেছি? মনে হয়, আগেকার সব কিছু যেন ভুলে গেছি।
তারপর শেখর হঠাৎ ধড়মড় করে ওঠার চেষ্টা করে বললো, দাঁড়াও আলোটা জ্বেলে দিই।
–না, থাক না। এই তো বেশ!
–কিন্তু তোমার শ্বশুর সত্যিই কিছু ভাববেন না? যদি হঠাৎ খোঁজ করতে আসেন—
আপনি অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমার শ্বশুর কিছুই ভাববেন না, সন্ধের পর তাঁর কিছুই ভাববার সময় নেই! সন্ধের সময় তিনি ঠাকুরঘরে ঢোকেন, তারপর অন্তত তিনটি ঘণ্টা–।
-সে কি! খালি বাড়িতে আর দুটি মেয়ে…
বাড়ির দুটি মেয়ে নিজেদের যথেষ্ট সামলাতে পারে, তা তিনি জানেন। তাছাড়া, ওঁরও তো কিছুক্ষণ একা থাকা দরকার। সারাদিন সংসারের সঙ্গে, মানুষ জনের সঙ্গে মানিয়ে চলেছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ অন্তত একা হয়ে ওঁর কান্নার সময় তো চাই। দুঃখ-কষ্ট মানুষটার কম নাকি?
শেখর ধীর স্বরে বললো, জয়া, তোমার একা থাকার দরকার হয় না? তোমার কান্নার জন্য সময়–
তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় জয়া বললো, না। কাঁদতে যাবো কেন? আমার কান্নার কি আছে?
শেখর একটু সময় চুপ করে রইলো। জয়ার আংটির হীরোটা ঝিকমিক করছে অন্ধকারে, সেই হীরের জ্যোতি দেখে বোঝা যায়, জয়ার হাত খুব কাছেই মাটিতে ভর দেওয়া! একটু বাদে শেখর হাত বাড়িয়ে জয়ার হাতটা ধরলে, খুব নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, তিন বছর কেটে গেল, জয়া, সত্যি তোমার কষ্ট হয় না? তুমি শরীরে কোনো জ্বালা টের পাও না?
—-না। শরীরের মধ্যে আমি সব সময় একটা অপমান টের পাই।
–কিসের?
—বুঝতে পারলেন না? ভালবেসে বিয়ে করলুম, সে কেন দূর দেশে গিয়ে আত্মহত্যা করলো? এই রহস্য যতদিন না বুঝতে পারি, ততদিন নিজের প্রতি একটা অপমান–
–হয়তো আত্মহত্যা নাও হতে পারে। যদি দুৰ্ঘটনা হয়?
–তাহলেও! বিলেত যাবার কি দরকার ছিল? বাড়িতে কোনো অভাব নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি ছিল, তবু আমাদের কারুকে না জানিয়ে চুপিচুপি সব ব্যবস্থা করে হঠাৎ একদিন চলে যাওয়া–
—তোমরা আগে থেকে কিছুই বুঝতে পার নি?
–আমি বোধহয় ভালবাসা কাকে বলে তাই কখনো বুঝতে পারি নি।
শেখর এবার একটু বিরক্ত হয়ে জয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, তোমরা মেয়েরা ভালবাসা কথাটা নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করো! দুজনে দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলে, সচ্ছল সংসার, আমন সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে–মানুষের সুখি জীবন তো একেই বলে, এর মধ্যে ভালবাসা নিয়ে বেশি ন্যাকামিই বা আসে কোথা থেকে আর আত্মহত্যার প্রশ্নই বা আসে কি করে?
জয়া আলতোভাবে হেসে বললো, আপনি বুঝি ভালবাসায় বিশ্বাস করেন না?
—করবো না কেন? কিন্তু ভালবাসা নিয়ে অতটা মাতামাতি করা আমি মোটেই পছন্দ করি না! একজনকে না পেলেই জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেল-ন্যাকামি! আমাদের রবিটা যেমন…যাকগে! তোমরা দুজনে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলে–তারপর মতের অমিল হতেও বা পারে কখনোসখনো—একটু-আধটু অন্যদের সঙ্গেও ফষ্টি-নষ্টি চলতে পারে–কিন্তু এর মধ্যে আত্মহত্যার কথা ওঠে কি করে?
একটুও বিচলিত না হয়ে বেশ সপ্রতিভ গলায় জয়া বললো, সেই কথাই তো বলছি, আপনিই বলুন না, এর মধ্যে আত্মহত্যার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আমি কোনো অবিশ্বাসের কাজ করি নি, তবু কেন ও আমাকে তুচ্ছ করে দূরে চলে গেল? বিয়ের আগে ও বলেছিল, আমাকে না পেলে ওর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিয়ে করে ও তো আমাকে পেয়েছিল, তবুও কেন নিজের জীবনটা ব্যৰ্থ করে দিলে! একটা মেয়ের কাছে এটা কত বড় প্রশ্ন আপনি বুঝতে পারবেন? ভালবাসা ছাড়া আর কিসের কাছে আমি এর উত্তর খুঁজবো?
নিজের প্রশ্ন নিজেরই কাছে ফিরে আসায় উত্তর না দিতে পেরে শেখর একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, কি জানি! এসর সমস্যা নিয়ে আমার মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না! এখানে সব অন্যরকম। আমি একটু শোবো!
অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঝুঁকে পড়ে শেখর জয়ার কোলের ওপর মাথা রাখলে। জয়া আপত্তি করলো না, বরং নিজের দুই ঊরু সমান করে বিশাল কোল পেতে দিলো। শেখর ওপরে তাকালো, জয়ার দুই চোখের অস্পষ্ট আভাস দেখতে পাওয়া যায় অন্ধকারে। বিধবা কথাটার মধ্যে কি দারুণ নিঃস্বতা আছে, কিন্তু জয়ার মাংসল দুই ঊরু ও ভরাট কোল, বেশবাস ভেদ করে বেরিয়ে আসা শরীরের চাপা সুগন্ধ-জয়াকে শুধু নারী বলেই মনে হয়। শেখরের শরীরটা হালকা হয়ে এলো। চাপা গলায় বললো, জয়া, কলেজে পড়ার সময় তোমাকে আমি একদিন আইসক্রিম খেতে আমার সঙ্গে কোয়ালিটিতে যেতে বলেছিলুম! তুমি যাও নি। যদি যেতে–
–গেলে কি হতো?
—তাহলে, বলা যায় না, হয়তো আমাদের দুজনেরই জীবন অন্যরকম হতো।
–অন্য অনেক মেয়ে তো আপনার সঙ্গে আইসক্রিম খেতে যেতে রাজি হয়েছিল জানি–তাদের জীবন কি অন্যরকম হয়েছে?
—কলেজে পড়ার সময় তুমি কিন্তু খুব গম্ভীর ছিলে। কফি হাউসে কিংবা ওয়াই. এম. সি. এ-তে কেউ কোনোদিন তোমায় আড্ডা দিতে দেখে নি। বাড়ির গাড়িতে কলেজে আসতে, আবার বাড়ির গাড়িতে ফিরে যেতে। কেউ কথা বলতেই সাহস করতো না। আমি যেদিন তোমাকে কোয়ালিটিতে যাবার কথা বললুম, তুমি যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠেছিলে। তুমি বলেছিলে, আমি? না, না, আমি কোথাও যাই না, গেলেও আপনার সঙ্গে যাবো কেন?
শেখর জয়ার গলা নকল করেছিল বলে জয়া রেগে উঠে শেখরের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, মোটেই আমি ওরকমভাবে বলি নি! ইস্, আমি ভয় পাবো!
শেখরও দুহাত উঁচু করে জয়ার কোমরে সুড়সুড়ি দেবার চেষ্টা করে বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলেছিলে! কেন বলেছিলে? কেন আমার সঙ্গে সেদিন যাও নি?
–বেশ করেছি। যাই নি। কোন যাবো? এক একদিন এক একটা মেয়েকে তো ঐ একই কথা বলতেন! অনেক মেয়েই তো গেছে আপনার সঙ্গে।
—হাঁ, কিন্তু তুমি রাজি হও নি বলেই তোমার কথাটা বেশি করে মনে আছে। আজ এই মুহূর্তে, কেন জানি না, মনে হচ্ছে, যদি তুমি যেতে তাহলে জীবনটা–
——ওসব যদির কথা বাদ দিন। তাহলে তো বলা যায়, যদি আমি না জন্মাতুম-!
-ওকি কথা? তোমার কি জীবনের ওপরেই বিতৃষ্ণা এসে গেছে নাকি?
–মোটেই না। কেন? আমার কি দোষ?
–তোমার দোষের কথা তো বলি নি।
–তাহলে, ওসব কথা আর বলতে হবে না।
–আচ্ছা আর বলবো না। আমার এখানে শুয়ে থাকতে খুব ভালো লাগছে। আর একটু শুয়ে থাকি?
জয়ার যে হাত শেখকের চুলের মুঠি ধরেছিল, সেই হাত এখন সেখানেই বিলি কাটছে। শেখরের যে হাত জয়ার কোমরের কাছে সুড়সুড়ি দেবার জন্য উঠেছিল, সে হাত এখন সেখানেই থেমে আছে। খুব কাছেই জয়ার দুটি স্তন, শেখরের হাত একবারও লোভী হয়ে সেদিকে উঠতে চায় নি! বরং হাতটা নেমে এলো, ভর রাখলে জয়ার ঊরুর পাশে। সিস্কের শাড়ি পরেছে জয়া, শেখরের হাত সেখানে ভারী আরাম পায়। যেন পরম স্নেহের ভঙ্গিতে শেখর সেখানে আস্তে আস্তে হাত বুলোতে লাগল।।
কলেজ-জীবনে জয়ার সঙ্গে ভালো করে আলাপও হয় নি শেখরের, এক ক্লাসে পড়তো, কিন্তু কখনো নিরালায় বসে নি দুজনে। অথচ, এতদিন পরে দেখার পর, কোন মন্ত্রবলে কাদের সম্পর্ক কত সহজ হয়ে এসেছে। এই জঙ্গলের নির্জনতা, পাতা আর বাতাসের ফিসফাস, অন্ধকারের নিজস্ব অবয়ব-এখানে যেন কোনো স্বভাব-বিরুদ্ধ কৃত্রিমতাই মানায় না।
কিছু না ভেবেই শেখর হঠাৎ প্রশ্ন করলো, জয়া, তোমার বিয়ের পর কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলো?
এরকম কোনো প্রশ্নের জন্য জয়া একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। অবাক হয়ে বললো, কেন, সে কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
—এমনিই। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিলো নিশ্চয়ই কোথাও?
—গিয়েছিলাম, মাউণ্ট আবু-তে; কিন্তু সে কথা শুনে আপনার কি হবে?
–বলো না! করে গেলে, কতদিন ছিলে, এইসব। তোমার জীবনের কোনো একটা আনন্দমধুর সময়ের কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করছে!
জয়া একটা হাত শেখরের চোখে চাপা দিয়ে বললো, বোকারাম একটি! বুঝতে পারছেন না, ঐ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই?
দুজনেই আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। দুজনেই অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। অন্ধকারে প্রথমে চোখে কিছুই দেখা যায় না! কিন্তু কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে—তারপর অন্ধকারকে অন্তত স্পষ্ট দেখা যায়। জঙ্গলে অবশ্য এখন আর অবিমিশ্র অন্ধকার নেই! কোথাও কোথাও ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো পড়েছে।শেখর কিন্তু চাপ–বাঁধা অন্ধকার অংশগুলোর দিকেই তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে তাকিয়ে ক্রমশ তার অস্বস্তি জাগলো। রাত বাড়ছে। রবিটা এলো না! অসীম, অপর্ণা এলো না!
শেখর বললে, অসীম আর রুণি এলো না-ওরা পথ হারিয়ে ফেলে নি তো?
নিশ্চিন্ত গলায় জয়া বললো, এর মধ্যে আবার কোথায় হারাবে? তাছাড়া রুণি কখনো পথ হারায় না!
—কেন? টর্চ সঙ্গে নেয় নি, এই অন্ধকারে, অসীমের সঙ্গে ও একা গেছে, তোমার ভাবনা হচ্ছে না?
—উ হুঃ! আপনি রুণিকে চিনতে পারেন নি। ও আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলে কি হয়, বুদ্ধিতে আমার চেয়ে বেশি। রুণি একবার মাত্র পথ ভুল করেছিল, তাও মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে, আর কখনো ভুল করবে না। জানি।
—ঐটুকু তো মেয়ে, তার সম্বন্ধে অমান জোর দিয়ে বলার কি আছে!
–ঐটুকু হলেও, জানেন না, ও মানুষকে খুব স্পষ্ট বুঝতে পারে। কাল রবি যখন আমাদের ওখানে বিকালবেলা–
-কাল রবি তোমাদের ওখানে—
–হ্যাঁ, কাল যখন এক গেল—
যেন শেখর ঘটনাটা জানে। সেইরকমভাবে শেখর কোনো বিস্ময় প্রকাশ করলো না। কাল ওরা দুজন যখন মহুয়ার দোকানে গিয়েছিল, সঞ্জয় গিয়েছিল রতিলালের বাড়িতে, রবি তো সে সময় জয়াদের বাড়িতে যেতেই পারে, এইরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখর বললো, হ্যাঁ, কাল আমরা যখন জঙ্গলে বেড়াতে গোলাম, রবি গেল না, তোমাদের বাড়িতে যাবে বলেছিল–
হাঁ, রবি হন্তদন্ত হয়ে গেল, গিয়ে বললো, একা এক ভালো লাগছে না। আমরা তখন কাটলেট ভেজে আপনাদের জন্য পরমেশ্বরের হাত দিয়ে পাঠাবো ঠিক করছিলুম, আমরা বললুম, আপনি এসেছেন যখন ভালোই হলো। কিন্তু কি রূকম বন্ধু আপনার, পাগল! আর কোনো কথাবার্তা নেই, রুণির দিকে তাকিয়ে বললো–চালো, তৈরি হয়ে নাও, আমরা এখন বেড়াতে বেরুবো। আমি বললুম, সে কি, এখন বেড়াতে যাবে কি করে? রবি কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলে নি, রুণিব দিকেই তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টি, সোজাসুজি রুণির হাত ধরে টান মেরে বললো-কেন, যাবে না কেন? নিশ্চয়ই যাবে–আমার এক এক ভালো লাগছে না।
শেখর এবার বিস্ময় গোপন করতে পারলো না; জিজ্ঞেস করলো, রুণিকে একা যেতে বলছিল?
জয়া সামান্য হেসে বললে, তাই তো মনে হয়। যাই বলুন, আমার কি দারুণ ভালো লেগেছিল। তখনো তো রুণির সঙ্গে বলতে গেলে ওর ভালো করে পরিচয়ই হয় নি, সেই গাছতলা থেকে আমাদের বাড়িতে আসার পথটুকু পর্যন্ত যা কথা হয়েছে, কিন্তু তবুও একটা ছেলে সোজাসুজি এসে ওরকম হাত ধরে বললো-চালো, আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতেই হবে-এর মধ্যে এমন একটা পৌরুষ আছে, আমি আগে কখনো দেখি নি। কিন্তু বেচারাকে কষ্ট দিতেই হলো। রুণিই হাসতে হাসতে বললো, কি করে যাবো? আমরা যে এক্ষুনি ঘাটশীলা যাচ্ছি। সকালে বলেছিলুম, ভুলে গেছেন। রবি তাতেও দামে নি, বললো, ঘটশীলা যেতে হবে না। রুণি বললো, ইস, কেন আপনার সঙ্গে যাবে! ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ চড়ে গেল। রবি বললো যাবে না? ঠিক আছে! আমি চললুম তা হলে! যেমন এসেছিল তেমনি হঠাৎ আবার তখুনি চলে এলো কাটলেটগুলো হাতে নিয়ে। কত বসতে বললুম-আমি রুণি দুজনেই, আর বসলো না। রবি চলে যাবার পর কুণি বললো, জনিস দিদি, ওকে দেখলেই মনে হয়, উনি যখন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন, তখন ঠিক আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে অন্য কারুর কথা ভেবে ওসব বলছিলেন। উনি কারুর ওপর খুব অভিমান করে আছেন, তাই ছটফট করছিলেন সবসময়-; আমি তক্ষুনি বুঝলুম, রুণি ঠিকই বলছে। বলুন, সত্যি কিনা?
শেখর হাসার চেষ্টা করে বললো, রবি আবার কার ওপর অভিমান করে থাকবে, ও অমনিই পাগলাটে–
শেখর গোপনে আবার একটু ভেবে নিলো। প্রথম দিনের আলাপেই রুণিদের বাড়িতে রবি একা গিয়েছিল? বলে নি তো! রবির এ ধরনের স্বভাব নয়। কিন্তু কেন? এ-ও আর এক ধাঁধা। শেখরের এ সম্পর্কেও আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না।
শেখর জয়ার কোলে উপুড় হলো। জয়ার নরম ঊরুতে ওর মুখ ড়ুবে যাচ্ছে! কিন্তু কোথাও কোনো শান্তি বিঘ্নিত হয়নি। শেখর যেন এতখানি শান্তিতে বিশ্বাস করতে পারলো না, তাই পরখ করার জন্য জয়ার ঊরুতে একটা চিমটি কাটলো। জয়া উঃ শব্দ করে বললো, এবার বুঝি আরম্ভ হলো ছেলেমানুষী? তাহলে কিন্তু–শেখর আবার মুখ ফিরিয়ে বললো, না জয়া, সত্যি ছেলেমানুষীই। এখানে শুয়ে থাকতে এত ভালো লাগছে–এক্ষুনি উঠতে বলো না। একটা কথা বিশ্বাস করবে? আমি কোনো মেয়ের কোলে এতক্ষণ মাথা দিয়ে আগে কখনো এমন চুপ করে শুয়ে থাকি নি! এতটা ভালোমানুষ আমি কোনোদিনই তো ছিলুম না! আমার পাগলামি একটু বেশি, আমি শরীরকে সব সময় শরীর হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছি। কিন্তু আজ কেমন অন্যরকম লাগছে, পুরোনো কোনো কথা মনে পড়ছে না। জঙ্গলে এসে জংলী হবার বদলে আমি হঠাৎ সভ্য হয়ে গেলুম! আচ্ছা, সত্যি কথা বলে তো, তোমার ভালো লাগছে না? তোমার পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে না?
জয়া হেসে বললে, আমার ভালো লাগছে; কিন্তু আমার পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে না।
–এই তিন বছরের মধ্যে কোনোদিন ইচ্ছে করে নি?
–না। ঐ যে বললুম, ভালবাসার ব্যাপারে আমি ভুল বুঝেছিলুম কিনা, তার উত্তর না পেলে–
–আঃ! আবার সেই ভালবাসা নিয়ে বাড়াবাড়ি! ভালবাসা-টাসা ছাড়াও শরীরের তো কতগুলো নিজস্ব দাবি আছে–নাকি, তোমাদের মেয়েদের সেটা নেই?
–থাকবে না কেন? কম বয়সে ঐ পাগলামিটা বেশি থাকে। আমার বয়েস এখন সাতাশ, সেটা খেয়াল আছে?
—সাতাশ? তাই নাকি? তা হলে তো একেবারেই বুড়ি!
জয়া হাসলো না। আপন মনে কথা বলার মতন বলে গেল, বুড়ি হই নি, কিন্তু কম বয়েসের সেই ছটফটনিটা আর নেই! মেয়েদের একবার সন্তান হলে শরীরের রহস্যটা অনেকখানি জানা হয়ে যায়। তখন হৃদয়ের রহস্য জানার জন্য খুব ব্যাকুলতা আসে। অবশ্য আপনারা একথা বুঝবেন না,। ছেলেরা সাতাশ কেন, সাতচল্লিশেও ছেলেমানুষ থাকে।
–জয়া, আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যিই! তুমি কি বলতে চাও, তুমি তোমার স্বামীর স্মৃতি নিয়েই চিরকাল থাকবে?
—বয়ে গেছে আমার, কোনো মরা মানুষের স্মৃতি নিয়ে দিন কাটাতে! আমি জানতে চাই আমার ভালবাসায় কোথায় ভুল হয়েছিল, যাতে দ্বিতীয়বার আর ভুল না করি।
—আবার সেই ভালবাসা। জ্বালালে! দেখছি ঘুরে ফিরে সেই একজায়গায়।
–আপনি সত্যিই ভালবাসায় বিশ্বাস করেন না?
—আমি ভালবাসায় বিশ্বাস করি না। ভালবাসতে চাওয়াটুকু বিশ্বাস করি। সেই চাওয়াটুকুতেই যা আনন্দ। ভালবাসা কোনো পবিত্র অলৌকিক ব্যাপার নয়!
—কিন্তু শরীরের ছটফটানি কি সেই চাওয়াটুকুও ভুলিয়ে দেয় না? শরীরের নিজস্ব চাওয়া একটা গোটা মানুষকে চাইতে ভুলিয়ে দেয়।
–আচ্ছা, থাক ও কথা; জয়া, তোমার হোতটা দাও তো—
জয়া তার হীরের আংটি পরা ঝিকমিকে হাতখানা শেখরের কপালে রাখলো। তারপর চমকে উঠে বললো, এ কি, আপনার গা এত গরম কেন!—জ্বর হয়েছে নাকি?
জয়ার চমকনি দেখে শেখর কৌতুক বোধ করলো। হাসতে হাসতে বললো, না, কিছু হয় নি। এরকম আমার মাঝে মাঝে হয়। তোমারও হাতখানা খুব গরম—
এবার জয়াও হেসে উত্তর দিলো, আমারও এরকম মাঝে মাঝে হয়।
–তা হলেই দেখছে, আমাদের দুজনের জীবনে কতটা মিল!
–জীবনের না হোক, আমাদের দুজনেরই নিশ্চয়ই দুঃখের মিল আছে।
শেখর সচকিত হয়ে বললো, দুঃখ? আমার আবার দুঃখ কি?
–লুকোচ্ছেন কেন, আপনি ভালবাসায় বিশ্বাস করেন না, আপনারও কি দুঃখ কম নাকি? আপনারও চাপা দুঃখের কথা আমি জানি।
—তুমিও বুঝি রুণির মতন সব মানুষের সত্যি বা মিথ্যে কথা বলে দেওয়ার প্র্যাকটিস শুরু করেছো!
–রুণির মতন অতটা না হলেও, আপনি এতক্ষণ আমার কোলে মাথা দিয়ে আছেন, আপনার সম্পর্কে অন্তত এইটুকু বলতে পারবো না! বলুন, কোনো দুঃখ নেই?
–না, নেই। দুঃখ নেই, গ্লানি নেই। থাকলেও কিছু এখন মনে পড়ে না।
–কিছুই মনে পড়ে না? তা হলে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কেন?
–ভ্যাট্! চালাকি হচ্ছে, না? মোটেই কথার মাঝখানে মাঝখানে ব্রাকেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলা আমার অভ্যোস নয়! সত্যিই জয়া, এই জঙ্গলে এসে আমার মনটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেছে। আমি যে কোনোদিন কোনো মেয়ের শুধু কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থেকে এত আনন্দ পাবে-এ ধারণাই আমার ছিল না। আমি যেন বাচ্চা ছেলে হয়ে গেছি! কি জানি, আমার উন্নতি হচ্ছে, না অবনতি হচ্ছো!
জয়া শেখরের ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রাখলো। তারপর খুব মৃদুভাবে বললো, আপনি এখনো ছেলেমানুষ, ভীষণ ছেলেমানুষ। এবার উঠে পড়ুনতো। আমার পা যে ব্যথা হয়ে গেল। শেখর উঠে বসলো। পাশাপাশি বসে জয়ার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, জয়া, তোমাকে আমি একদম বুঝতে পারছি না।
–বুঝতে হবেও না। একদিনেই বোঝা যায়?
শেখর হঠাৎ গলার স্বর বদলে ডাকলে, জয়া–। জয়া কোনো উত্তর দেবার আগেই, ঠিক সেই সময়, দূরের জঙ্গল থেকে আর্তনাদের মতন ডাক ভেসে এলো, শেখর-। প্রথমটা শেখর ঠিক বুঝতে পারলো না, পরে আরেকবার। অনেকটা দূর হলেও এবার চেনা গেল রবির গলা। শেখর অতি দ্রুত উঠে পড়ে বললো, রবির গলা না? বিপদে পড়েছে মনে হচ্ছে-দৌড়ে শেখর বারান্দার আলো জ্বললো। ঘর থেকে বড় টর্চটা নিয়ে এসে বললো, জয়া, তুমি এখানে বসো, আমি দেখে আসছি।
জয়া বললে, আমি এক বসে থাকবো নাকি? আমিও যাবো।
দুজনে নেমে জঙ্গলের মধ্যে ছুটলো! শেখর প্রাণপণে চোঁচাতে লাগলো, রবি। রবি! কোনদিকে?
রবির আর কোনো সাড়া নেই। জয়ার হাত ধরে আন্দাজে ছুটছে শেখর। একটু আগে শেখরের শরীরে যে একটা মন্দির আলস্য এসেছিল তা সম্পূর্ণ অন্তৰ্হিত হয়েছে। শেখর বিপদের গন্ধ নিঃশ্বাস টেনে বুঝতে পারে। রবির বিপদের কথা টের পেয়ে সে জয়ার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে ভুলে গেছে। শক্তভাবে জয়ার হাত চেপে ধরেছে, ছুটতে জয়ার অসুবিধে হলেও জোরেই তাকে টেনে নিয়ে চলেছে শেখর, আর মাঝে মাঝে রবির নাম ধরে চিৎকার করছে।
একটু বাদেই মানুষের গলা পাওয়া গেল, অসীম ডাকছে শেখরের নাম ধরে; শেখর চেঁচিয়ে বললো, তুই শুনেছিস? রবির গলা–
–হ্যাঁ–
—কোনদিকে?
—বড় রাস্তার দিকে, তোর ডান দিকে। অসীম আর অপর্ণা একটুক্ষণের মধ্যেই ওদের সঙ্গে এসে মিললো। শেখর ওদের বললো, তোরা কতদূরে ছিলি? রবির এরকম গলার আওয়াজ, কোনো বিপদ-টিপদ হয়েছে নিশ্চয়ই—
জয়া বললো, রুণি তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
—আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে মরছিলুম, পথ হারিয়ে ফেলেছি।
—পথ হারিয়ে ফেলেছিলি?
—ঠিক হারাই নি, অসীমদা বলছিলেন আমাকে একটা কি সাদা ফুলগাছ দেখবেন, ঘুরে মরছিলুম, খুঁজে পাচ্ছিলুম না কিছুতেই।
—এই অন্ধকারে —
–ভেবেছিলুম, বাংলোয় আলো দেখতে পাবো। তোরা আলো জুলিস নি বুঝি?
চার জনেই তখনো ছুটছে। শেখরের হাতে জোরালো আলো, তন্ন তন্ন করে খুঁজছে জঙ্গলের প্রতিটি কোণ। অসীম বললো, আমার একবার মনে হয়েছিল, আওয়াজটা হবার পর কয়েক জন লোক ছুটে পালালো।
—তোদের থেকে কতটা দূরে?
—বেশ খানিকটা দূরে। মনে হলো রাস্তার পাশে, তার একটু পরেই একটা ট্রাক গেল।
—ডাকাত-টাকাতের পাল্লায় পড়ে নি তো! যে রকমভাবে ভাব দিলো, উঃ, এমন ছেলে—
খুঁজতে খুঁজতে ওরা বড় রাস্তায় পৌছোলো। রাস্তার ওপাশে সেই মিলিটারিদের ভাঙা ব্যারাকটাও দেখে এলো। আবার ফিরে এদিকে একটু খুঁজতেই শেখরের টর্চের আলো পড়লো একটা মানুষের শরীরে।
দুমড়ে মুচকে পড়ে আছে। রবি, মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে মাটি ভিজো গেছে, জামা-প্যান্ট ছেড়া, চুলের মধ্যেও চাপ চাপ রক্ত। মাথার কাছে একটা সাদা ফুলগাছ-গাছটায় একটাও পাতা নেই, শুধু ফুল। অসীম আর রুণি যে গাছটা খুঁজছিল, সেই গাছটার নিচে পড়ে আছে রবি। শেখরের টর্চ স্থির হয়ে রইলো। জয়া আব–ধরনের একটা শব্দ করেই হাত দিয়ে মুখ চাপা দিলো। অসীম ফিসফিস করে বললো, মরে গেছে! মরে গেছে!
সাদা ফুলগাছটা ও রবিকে একসঙ্গেই দেখতে পেয়েছিল অপর্ণা। সে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার তুলে বললো, একি! না, না—।
অপর্ণা ছুটে যেতে চাইছিল, শেখর একটা হাত বাড়িয়ে তাকে তাকে বললো, জয়া, ওকে ধরে। অপর্ণা তবুও ছটফট করে চেঁচিয়ে উঠলো, না, না—। অসীম এক পা এগোতে এগোতে বললো, মরে গেছে—বুঝি মারে গেছে। রবি, উঃ, এত রক্ত –
শেখর অবিচলিতভাবে বললো, কিছু হয় নি! মরতে পারে না, অসম্ভব, আমি কখনো মৃত্যু দেখি নি, আজও দেখবো না। কোনো ভয় নেই। জয়া, তুমি রুণিকে ধরো, কোনো ভয় নেই–অপৰ্ণাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, জীবনে সে কখনো এ ধরনের দৃশ্য হয়তো দেখে নি। মুখ দিয়ে একটা চাপা কান্নার স্বর বেরুচ্ছে তার, জয়ার হাত ছাড়াবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বলছে, আমি একবার দেখবো, একবার—।
অসীম এসে অপর্ণার আর একটা হাত ধরতেই সে এক ঝটিকায় ছাড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় বললো, ছেড়ে দিন! আমাকে ছোঁবেন না।
শেখর এসে রবির মাথার কাছে ঝুঁকে দাঁড়ালো। মুখখানা রক্তে মাখামাখি, প্রায় চেনাই যার না। একটা জ্বলন্ত সিগারেট রবির ঠিক মাথার কাছে পড়েছিল, ওর চুলের খানিকটা পুড়িয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে বিশ্ৰী গন্ধ আর ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শেখর তাড়াতাড়ি সেটাকে নিবিয়ে দিলো, রবির একটা হাত খুঁজে বার করে নাড়ি দেখার চেষ্টা করলো।
সেই সাদা ফুলগাছটার ফুলের পাশে পাশে বড় কাঁটা। একটা কাঁটা শেখরের গায়ে বিঁধতেই শেখর বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গাছটার দিকে তাকালো। বেশ শক্ত বুনো গাছ, শুধু ফুল ফোঁটায় আর ফুলের পাশে ধারালো কাঁটার পাহারা রেখেছে। রবির একটা হাত সেই গাছের ওপর। গাছটাকে শেখর সাবধানে ধরে হেলালো, আর কোনোদিকে সে ভ্রূক্ষেপও করে নি, গাছটাকে মাটিতে নুইয়ে তার ওপর বুটজুতো পরা দুপায়ে দাঁড়িয়ে সে সেটাকে মড়মড় করে ভেঙে জায়গাটা পরিষ্কার করলো। তারপর বললো, অসীম, আমি মাথাটা তুলে ধরছি, তুই পা দুটো সাবধানে ধর, রবিকে এখুনি বাংলোয় নিয়ে যেতে হবে।