সকালবেলা ধলভূমগড় স্টেশনে
সকালবেলা ধলভূমগড় স্টেশনে চারজন যুবক ট্রেন থেকে নামলো। ছোট্ট স্টেশন, সারা দিন-রাতে দুতিনবার মাত্র সরব হয়ে ওঠে, বাকি সময়টা অলসভাবে নিঝুম। আলাদা টিকিট কালেক্টার নেই, স্টেশন মাস্টার নিজেই ট্রেন থেকে নামা ছোট্ট যাত্রীদলের দিকে এগিয়ে আসেন টিকিটের জন্য—যাত্রীরা অধিকাংশ স্থানীয় লোক, নেংটি পরা সাঁওতাল আর ওরাওঁ–তাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে একখানা করে লাঠি, আট হাত শাড়ি ফেরত দিয়ে পরা মেয়েরাআমি পল্লবের মতন তারা পাঁচজন পাঁচজন হাত ধরাধরি করে থাকে ও গানের সুরে কথা বা ঝগড়া করে যায়, এ ছাড়া দুচারজন আধা-বিহারী আধা-বাঙালিবাবু কিংবা পাইকার।
এর মধ্যে ঐ চারজন যুবক একটুখানি নতুনত্ব, কেননা এই জায়গায় কখনো চেঞ্জাররা আসে না, সে-রকম কোনো ব্যবস্থাও নেই। ছোট্ট একটুখানি শহর-সাজা গ্রাম, থাকলেও হয়, না থাকলেও ক্ষতি ছিল না—এমন ভাব, দুচারখানা বাড়ি ফুরোতেই না ফুরোতেই শুরু হয়ে গেছে জঙ্গল। যুবক চারজনের বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে, প্রত্যেকেরই সুঠাম স্বাস্থ্য, হাতে ভালো চামড়ার সুটকেস, হোন্ডঅল, টেরিলিন জাতীয় সুদৃশ্য পোশাক পরিহিত, ওদের মুখ-চোখ দেখলেই আর কারুকে বলে দিতে হয় না যে, ওরা কলকাতার মানুষ।
স্টেশন মাস্টার মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা বেড়াতে এলেন বুঝি?
ওদের মধ্যে একজন প্যান্টের এ—পকেট ও–পকেট খুঁজছিল। পিছন পকেটের চামড়ার ব্যাগ থেকে বেরুলো ভাড়ার রসিদ, তখন সে জবাব দিলো, হ্যাঁ, সেইরকমই, দেখা যাক! আমাদের কাছে কিন্তু টিকিট নেই। মাঝরাত্রে টিটির কাছে ভাড়া দিয়ে এই রসিদ নিয়েছি। চলবে তো? স্টেশন মাস্টার এক পলক উঁকি দিয়ে দেখেই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। এই সময় এখানে বেড়াতে এলেন? আপনাদের তো অসুবিধে হবে…
–কেন, অসুবিধে কিসের; আপনার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হয় না!
–থাকবেন কোথায়? এখানে তো–
–সে আমরা যা-হোক ব্যবস্থা করে নেবো।
ওদের মধ্যে আরেকজন বললো, কেন, এখানে একটা বাংলো আছে না? তাই শুনেই তো এলাম।
–তা আছে, যদি জায়গা পান দেখুন, তাছাড়া খাবার-দাবারেরও অসুবিধে হবে।
–আপনি যদি খাবার-দাবার পান, তাহলে আমরা পাবো না কেন?
-–কিছু পাওয়া যায় না। এখানে স্যার! জংলীদের জায়গা, মাছ নেই, দুধ নেই, মাংস ও সপ্তাহে দুএকদিন–আপনারা একটু আনন্দ-টানন্দ করতে এসেছেন–
ওদের মধ্যে যার সবচেয়ে দীর্ঘ চেহারা, মাথার চুল কোঁকড়ানো, প্যান্টের পিছন পকেটে হাত, সে হা-হা করে হেসে উঠলো। বললো, কী করে বুঝলেন, আমরা আনন্দ করতে এসেছি? কলকাতায় কি আনন্দ কম?
আরেকজন এগিয়ে এলো, আপাতত আমরা অন্তত একটা আনন্দ পেতে চাই। এখানে চায়ের ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা আছে কোথাও?
স্টেশন মাস্টার বিমৰ্ষভাবে বললেন, স্টেশনে কিছু নেই, এ লাইনটাই এ রকম, একটু এগিয়ে-কলকাতার মতন রেস্টুরেন্ট অবশ্য পাবেন না। তবে বাজারের মধ্যে দুএকটা চায়ের দোকান–
–বাজার কত দূরে?
–কাছেই, ঐ তো–
প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ওরা ওভারব্রিজে উঠলো। নরম সকালের হাওয়া আলগাভাবে খেলা করে গোল ওদের চোখে-মুখে-চুলে, ছানার জলের মতন আলো চারদিকে, ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ওরা চার-পাশটা একবার তাকিয়ে দেখলে। ডানদিকে যতদূর দেখা যায় ঢেউ খেলানো মাঠ ও ছোট ছোট টিলা, বহুদূরে অবস্থা একটা পাহাড়, বাঁ দিকে জঙ্গল শুরু হয়েছে, জঙ্গল কেটে চলে গেছে রেললাইন—এইমাত্র ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটা এখনো অস্পষ্টভাবে দেখা যায়। নতুন জায়গায় ঢোকার আগে ওরা যেন ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সমগ্র পরিস্থিতি বিধেচনা করে দেখেছে। সামনেই বাজার, গোটা তিরিশেক পাকা বাড়ি একটু দূরে দূরে ছড়ানো, তারপর এক পাশে মাঠ এক পাশে জঙ্গল।
ওরা ঘুরে ঘুরে পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চারদিকেই দেখলো। আর বিশেষ কোনো বৈচিত্ৰ্য নেই। একজন বললো, ধলভূমগড় নাম যখন, তখন একটু দুর্গ-টুর্গ থাকা তো উচিত। কোথায়, দেখতে তো পাচ্ছি না!
–জঙ্গলের মধ্যে ভাঙচুরো কোথাও পড়ে আছে হয়তো।
মাথার ওপরের আকাশ গভীর সমুদ্রের মতন নীল। এক ছিটে মেঘ নেই। ওদের মধ্যে একজনের হাতে একটা পাকানো খবরের কাগজ ছিল, সে সেটা ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, বিদায়।
তার পাশের জন বললো, এই সঞ্জয়, কাগজটা ফেললি কেন?
–ধুৎ। খবরের কাগজের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাই না।
–ফেরার সময় জুতো মুড়ে নিয়ে যাবার জন্য কাজে লাগতো।
–তখন দেখা যাবে। দে, সিগারেট দে।
খবরের কাগজটা হাওয়ায় দুলতে দুলতে নিচে লাইনের ওপর গিয়ে পড়ে ছড়িয়ে গেল। কি একটা কাপড় না সিগারেট কোম্পানির আধিপাত জোড়া বিজ্ঞাপনের ছবিতে সুট-টাই পরা একজন লোভী লোকের হাত একটি শালোয়ার কামিজ পরা খুঁকির শরীর দোলাচ্ছে। ওভারব্রিজের রেলিং ধরে ঝুঁকে সেদিকে তাকিয়ে একজন বললো, সঞ্জয়, ঐ ছবির ওপর ঠিক করে থুতু ফেলতে পারবি?
–ছেলেটার মুখে না মেয়েটার মুখে?
–তুই ছেলেটার, আমি মেয়েটার।
হাওয়ায় থুতু উড়ে যাচ্ছে, সোজা নিচে পড়ছে না। বিজ্ঞাপনের ছবি অম্লানই রইলো। বিরক্ত হয়ে একজন জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে মারলো। সেটাও কাগজের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নিচে চলে গেল কোথায়।
সবচেয়ে লম্বা যুবকটি বললো, এই, কি ছেলেমানুষী করছিস! তাড়াতাড়ি চল, চা না খেয়ে পারছি না!
ওভারব্রিজ পেরিয়ে একটু দূরেই একটা বড় চাতাল। একটা বট গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো অনেকখানি বেদি, সেখানে দশ-বারোটা আদিবাসী মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। তার ওপাশে কয়েকটা ছোট দোকান, ছোটখাটো বাজারের মতন। বাজারটায় যেন কোনো প্ৰাণ নেই, মানুষজনের ভিড়ে জমজমাট নয়। পটল ওজন করছে একটা লোক, কিন্তু কি রকম অলস তার ভঙ্গি, দুটো দিচ্ছে, তিনটে কমাচ্ছে, ওজন আর ঠিকই হয় না—তার সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরটিরও যেন কোনো তাড়া নেই—সিনেমা দেখার মতন গভীর মনোযোগে দেখছে। পটল মাপ। এক পাশে ডাই করা কতকগুলো কুমড়ের চূড়ার ওপর চুপটি করে বসে আছে একটা ঘেয়ো কুকুর।
মেয়েগুলো শুধু বসেছে আলাদা—এদের থেকে দূরে, পরিষ্কার উঁচু চাতালে। প্রত্যেকের কাঁখালে একটা করে ঝুড়ি, ঝুড়িতে করে কি বেচাতে এসেছে তা দূর থেকে দেখা যায় না। কিন্তু ওদের সামনে কোনো খদের দাঁড়িয়ে নেই। সঞ্জয় বললো, অসীম, দ্যাখ তো ওদের কাছে ডিম আছে নাকি? তা হলে কয়েকটা ডিম কিনে নে, চায়ের সঙ্গে খেতে হবে তো।
অসীম ও আরেকজন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি রে তোদের কাছে ডিম আছে! আণ্ডা?
পা ঝুলিয়ে বসা মেয়েগুলো এ-ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে মুখ টিপে হাসলো কেউ বাঁ গ্ৰীবা সামান্য বেকিয়ে বাঁ দিকের কাঁধে মুখ গুজলো। কেউ কোনো উত্তর দিলো না।
–আণ্ডা মিলেগা? আণ্ডা হায় তুমরা পাশ?
মেয়েগুলো পূর্ববৎ তরঙ্গের মতন সবাই হাসিতে দুললো, পরস্পর গা ঠেলাঠেলি করলো, ওদের মধ্যে দুএকজন জলে ঘটি ডোবানোর মতন গুপ গুপ করে হাসলো, কিন্তু উত্তর দিলো না।
তখন পর্যন্ত ওরা ঐ মেয়েগুলো সম্পর্কে কোনোই ধারণা করে নেয় নি, নতুন জায়গায় এসে হাল্কা চোখে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, কোনো ব্যস্ততা নেই। বাজারে ঢোকার আগে, এক কোণে বসা এই মেয়েগুলোকে চোখে পড়লো বলেই যেন কিছু জিনিস কেনার কথা মনে পড়েছে, জিনিসপত্র তো কিছু কিনতেই হবে—আর কিনতে হলে ময়লা ধুতি জড়ানো রুক্ষ দাড়িওলা দোকানিদের বদলে—এই হাসিখুশি সোমথ মেয়েগুলোর কাছ থেকেই কিছু কেনার কথা স্বাভাবিকভাবেই ওদের মনে আসে। দাম হয়তো একটু বেশি নেবে, তা হোক, সঙ্গে তো বাতাস-খুশি করা হাসি দেবে। শহুরে ছেলে সকালবেলা ডিম কেনার কথাই ওরা প্রথম ভেবেছে। ডিম না থাকে-মেয়েদের যে-কোনো সওদা, শিম-বরবটিকিংবা আলু-পেঁয়াজ যাই হোক–তাও হয়তো কিনবে।
অসীমরা এগিয়ে এসে মেয়েগুলোর ঝুড়িতে উঁকি মারলো। কিছু নেই ফাঁকা বুড়ি সবারই ফাঁক ঝুড়ি। ওরা একটু অবাক হলো। নীলপাড় শাড়ি পরা একটি কচি-মুখ মেয়েকে অসীম বললো কি রে, সব ফুরিয়ে গেছে? ডিম-টিম নেই কারুর কাছে?
মেয়েটি ঝংকারময় গলায় বললো, ডিম নেই তো দেখতেই পেছিস! অ্যা!
–কিছু নেই তো এখানে বসে আছিস কেন?
–বসে আছি, হাওয়া খেতে মন লয়! তুহার তাতে কি?
অসীম বললো, আরে, এইটুকু লঙ্কার ঝাল তো কম নয়। দেখছি ঝগড়া করতে চাইছে। কী দোষ করলুম। বাপুঃ–সে তার বন্ধুদের দিকে ফিরে বললো আশ্চৰ্য ব্যাপার মাইরি, এতগুলো মেয়ে খালি ঝুড়ি নিয়ে এমনি সকালবেলা বসে আছে!
আশপাশের দুচারজন লোক কৌতূহলী হয়ে ওদের দেখছিল টেরা চোখে একটা হলুদ গেঞ্জি পরা ছোঁকরা ওদের দিকে ঘন হয়ে এসে শুনছিল ওদের কথা। সে বললো, উ মেয়েগুলো সব জন খাটে বাবু। ডিম বেচে না।
–জন খাটে মানে?
–রাজমিস্তির কাজে যোগান দেয়, ইট বয়।
–তা এখানে বসে আছে কেন?
–ইখানে বসে থাকে, যদি কারুর দরকার হয় তো ডেকে খাটাতে লিয়ে যার।
–ও বুঝলুম। তা এখানে আর প্রত্যেক দিন কী এত রাজ-মিস্তিরির কাজ হয় কে জানে। থাকগে তোমাদের এখানে ডিম পাওয়া যাবে?
–ডিম তো মিলবে না। আজ, সেই হাটবার মঙ্গলবার।হাটবার ছাড়া আর ডিম পাওয়া যাবে না?
–যাবে, সে আপনার হোটেলে।
–ও, হোটেলও আছে এখানে? আচ্ছা রেষ্ট হাউসটা কত দূরে?
–ওসব কিছু তো এখানে নাই বাবু।নেই মানে? আলবৎ আছে। ফরেষ্ট রেষ্ট হাউস।
–ফরেস্ট বাংলা? সে আপনার সেই দিকে জঙ্গলে।
–ঠিক আছে, এখোনে রিক্সা-টিক্সা পাওয়া যায়?
–আজ্ঞে না, রিক্সা ইদিকে কোথায় পাবেন, এসব জংলা জায়গা-বাবুরা তো কেউ আসে না তেমন, যারা আসে তারা মোটর আনে–
লোকটির নাম লখা, তাকে ওরা তল্পিদার হিসেবে নিযুক্ত করলো। লোকটির কাঁধে কিছু মোটঘাট চাপিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো ওরা চারজন-সঞ্জয়, অসীম, শেখর এবং রবি! কাল রাত্তিরেই হয়তো বৃষ্টি হয়েছে, সরু বাস্তায় প্যাঁচপ্যাঁচ করছে কাদা, দুপাশে কয়েকটা মুদির দোকান, সিমেন্ট সুরকির আড়ত, নোংরা ভাতের হোটেল, একটা সেলুনও আছে, সিগারেটের দোকানে ঝ্যান ঝ্যান করে রেডিও বাজছে।
একটা দোকান বেছে নিয়ে ওরা বাইরের বেঞ্চিতে বসে গরম জিলিপি আর সিঙাড়া সঙ্গে চা খেলো! গেলাসের চায়ে কী রকম কাঁঠাল কাঁঠাল গন্ধ, এটো শালপাতায় এসে বসেছে নীল রঙের ড়ুমোড়মো কাঁঠালে মাছি। দোকানের বাকি লোকরা নিজস্ব কথা বলা থামিয়ে ওদের দিকেই চেয়ে আছে। যে-কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তাদের সকলেরই মুখভঙ্গি ব্যগ্র। ওরা চারজন অন্য কোনো দিকেই মনোযোগ দিলো না, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে লাগলো, রেডিওয়া ফাট আওয়াজটা খুবই বিরক্ত করছিল, অসীম উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চলো এগোই।
দুচার পা হাঁটতেই বাজার শেষ হয়ে গেল, সরু রাস্তা এসে মিশলো বড় রাস্তায়। এখানে দুচারটে ছড়ানো সুদৃশ বাড়ি, প্রত্যেক বাড়ির সামনে কম্পাউন্ডে ফুল, লতা ও ইউক্যালিপটাস গাছ, শুধু এই জায়গাটুকু দেওঘর বাঁ মধুপুরের এক টুকরো মনে হয়। লিখা অনবরত বকবক করে যাচ্ছিল, কোনটা কার বাড়ি সেই বিবরণ, এই জায়গাটার অসংলগ্ন ইতিহাস-ভূগোল, ওরা সব কথা শুনছিল না, মাঝে মাঝে দুএকটা প্রশ্ন করছিল। হঠাৎ। একটা বাড়ির দিকে ওদের সবারই চোখ পড়লো, গোলাপি রূঙা একটা সুন্দর বাড়ি, বাড়ির সম্পূর্ণ সীমানা দেড় মানুষ উঁচু পাঁচল দিয়ে ঘেরা তার ওপর ভাঙা কাচ ও কাঁটা তার বসিয়ে সুরক্ষিত, এক অংশে সবল লোহার গেট। গেটের পাশে একটা পুরোনো মরিস গাড়ি, একজন চাকর সেটা ধুচ্ছে। গেটের মধ্যে দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়, বাগানের মাঝখানে পাথরের পর বসানো ফোয়ারা, বাগানের পথটুকু ব্যতীত বাকি অংশ ঘাসের বদলে লাল পর্তুলেকায় ছেয়ে আছে, যেন টুকটুকে লাল রঙের বাগান এক পাশে নেট খাটিয়ে দুটি মেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে, পালক দেওয়া কর্কের বদলে ওরা খেলছে রেশমের বল দিয়ে, মেয়ে দুটি খেলছে আর ঝলমল করে হাসছে, বার-বারান্দায় ইজিচেয়ারে এক প্রৌঢ় খবর কাগজ নিয়ে ঝুঁকে বাসা।
ওরা চারজন গেটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দুএক পলক মাত্র এই দৃশ্য দেখলো, পরস্পর চোখাচোখি করলো, ব্লবি বললো, এখানে এক টুকরো বালিগঞ্জও আছে দেখছি। তবে যে শুনেছিলুম, এখানে জঙ্গল আর আদিবাসীরা ছাড়া কিছু নেই?
সঞ্জয় বললো, বড়লোকেরা কোথায় না আছে! তারা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে।
শেখর একটু চিন্তিতভাবে বললো, ওদের মধ্যে একটা মেয়েকে কী রকম যেন চেনা-চেনা মনে হলো!
রবি সঙ্গে সঙ্গে খোঁচা মারলো, বাজে গুল মারিস না! দুনিয়ার সব মেয়েই তোর চেনা। নতুন জায়গায় পা দিতে না দিতেই তোর চেমা মেয়ে? অ্যা?
–হাঁ, সত্যি বলছি, খুব চেনা না হলেও মনে হলো আগে কোথাও দেখেছি।
–আমার তো সব মেয়েকেই দেখে মনে হয় আগে দেখেছি, এজন্মে না হোক গতজন্মে। সে কথা বাদ দে।
–তা নয়, সত্যিই, মনে করতে পারছি না অবশ্য।
রবি বললো, চল ফিরে যাই, ভালো করে দেখে আসি তোর চেনা কিনা। তোর চেনা হলে আমারও চেনা হতে পারে!
তখন ওরা বাড়ির গোটটা থেকে বেশ কয়েক গজ দূরে চলে এসেছে। শেখর বললো, যাঃ তা হয় নাকি, ফিরে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্যাট প্যাট করে তাকাবো? যদি সত্যিই চেনা না হয়?
রবি শেখরের একটা হাত ধরে টানাটনি করতে বললো, চল না, চল না, চেনা নাই-বা? হলো, মেয়ের বাগানে খেলছে তা দেখতে দোষ কি?
শেখর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো যাঃ।
অসীম জিজ্ঞেস করলো, লেখা এটা কাদের বাড়ি?
–ইটা তো ত্ৰিপাঠী সাহেবের বাড়ি। খুব ভারী ব্যবসা ওঁয়াদের-কলকাতায় আপনাদের হাওড়াপাড়া আছে যে, সেখানে ওঁয়াদের–
অসীম মুখ ঘুরিয়ে শেখরকে প্রশ্ন করলো, কি রে, তুই ত্ৰিপাঠী পদবীর কোনো মেয়েকে চিনিস?
শেখরের মুখ দেখে মনে হয় তন্ন-তন্ন করে সে ভেতরটা খুঁজছে। অন্ধকার রান্নাঘরে কালো জিরে খুঁজে না পেলে গৃহিণীরা যেমন এক একটা কৌটা খুলে গন্ধ শুকে দেখেন আর রেখে দেন, শেখরও সেইরকম আধ-চেনা প্রত্যেকটা মেয়েকে চোখের সামনে এনে প্রশ্ন করছিল, তুমি কি ত্ৰিপাঠী? না, না, গন্ধ মিলছে না; প্রেসিডেন্সি কলেজে অমলেশ ত্ৰিপাঠীর কাছে ইতিহাস পড়েছিলুম, দীপ্তি ত্ৰিপাঠীর লেখা বই ছিল তাপসের ঘরে, ভবানীপুরে ত্ৰিপাঠী অ্যান্ড সন্স নামে একটা রেডিওর দোকান আছে, না, আর কোনো ত্ৰিপাঠীর কথা সে শোনে নি। শেখরকে হার মানতেই হলো।
ঐ বাড়িটা ছাড়বার পর আর দুএকটা এদিক ওদিক ছড়ানো খাপরার চালাঘর, তারপর রাস্তা ফাঁকা হয়ে এলো, এবার জঙ্গলে ঢুকবে, সামনেই জঙ্গল দেখা যায়। এই রাস্তাটা চাকুলিয়া হয়ে জামসেদপুরে চলে গেছে।তাই মাঝে মাঝে ট্রাকের আনাগোনা।
এপ্রিলের শেষে, রোদুর এখনো বিরক্তিকর হয় নি, ঝকঝকে আকাশ থেকে রোদ এসে খেলা করছে বনে চূড়ায়। এই বন দেখলে গা ছমছম করে না, তরুণ শালগাছগুলোয় বল্লরী ধরেছে। বিশ্বাস করা যায় না। ঐ কঠিন সব শাল বৃক্ষের এত সুন্দর নরম-রঙা ফুল। দুএকটা জারুল আর ইউক্যালিপটাসের ভেজাল থাকা সত্ত্বেও জঙ্গলটা এখানে পুরোপুরি শালেরই জঙ্গল! লালচে রাস্তা দিয়ে ওবা বনের মধ্যে ঢুকলো।
বনের মধ্যে ঢুকেই ওদের অন্য রকম লাগলো। স্পষ্ট বোঝা যায়, এটা আলাদা জগৎ। বনের ভিতরটা সব সময় নিঃশব্দ। আসলে অনেক রকম শব্দ আছে, কিচকিচে পাখির ডাক, হাওয়ার শো শোঁ, লুকানো কাঠবিড়ালির চিড়িক চিড়িক, ঝিঝির কোরাস, শুকনো পাতার খরখর, দূরে কোথাও কাঠ কাটার একঘেয়ে শব্দও ভেসে আসছে।তবু মনে হয় অরণ্য নিস্তব্ধ। ওসব শব্দ নিস্তব্ধতারই অলঙ্কার। জঙ্গলে ঢুকলে সত্যিকারের একটা বিশাল জিনিসকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়।
কালো পীচের চওড়া রাস্তা, দুপাশে লাল সুরকি ছড়ানো–তার ঠিক মাঝখান দিয়ে ওরা হাঁটছে। অসীমকে অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়, শেখরও বন্ধুবান্ধবদের না বলে মাঝে মাঝেই হঠাৎ দুএক মাসের মধ্যে কোথায় নিরুদ্দেশে চলে যায়। ক্রিকেট খেলার জন্য রবি ভারতবর্ষের নানা প্রদেশে ঘুরেছে, মধ্য প্রদেশের জঙ্গলে একটা শিকারের পার্টিতেও গিয়েছিল একবার। সঞ্জয় একটু ঘরকুনো, কিন্তু বছরে একবার তাকে হরিদ্ধারে যেতেই হয়। ওর বাবা সংসার ছেড়ে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে হরিদ্ধারে আছেন, সঞ্জয় তার সঙ্গে দেখা করে আসে। অর্থাৎ ওরা চারজনেই আগে নানা জায়গায় ঘুরেছে, এই প্রথম ওরা দল বেঁধে একসঙ্গে বাইরে এলো। ওরা একসঙ্গে মিশেছে—কিন্তু সবকিছু মেলে নি, মাঝে মাঝে ওরা একসঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছে, মাঝে মাঝেই আবার অন্যমনস্ক, তখন চারজনে যেন চার রকম ভাবনায় অন্যমনস্ক।
বেশি হাঁটতে হলো না, আধ মাইলের মধ্যেই চোখে পড়লো ডাক-বাংলোর গেট, বাঁ দিকে চওড়া মোরাম বিছানো পথ, ভিতরে জাপানি ছবির মতন সাজানো বাড়িখানা। উঁচু সিমেন্টের ভিতের ওপর বাড়ি, বারান্দার ঝুলন্ত টবে সাজানো রয়েছে নানা জাতের শৌখিন আর্কিড কয়েকখানা পরিচ্ছন্ন অটুট ইজিচেয়াব! বাড়ির সামনে কেয়ারি করা ফুল বাগান, একপাশে গাড়ি রাখার ছোট গ্যারাজ, তারও ওপাশে চৌকিদারের ঘর। ওদের দুতিনজন একসঙ্গে বলে উঠলো, বাঃ! সত্যি চমৎকার জায়গাটা।
লখা মালপত্তারু নামিয়ে রেখে, সমগ্ৰ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চোঁচাতে লাগলো, রতিলাল! কৃতিলালী-। এ-চৌকিদার!
কারুর সাড়া পাওয়া গেল না; দূর থেকে শুধু সেই কাঠ কাটার অক্লান্ত শব্দটা একঘেয়েভাবে শোনা যাচ্ছে। সঞ্জয় বললো, দেখে মনে হচ্ছে এ জায়গায় বিশেষ লোকজন আসে না। চৌকিদার কি আর সব সময় থাকে?
লখা বললো, দাঁড়ান বাবু আমি ওকে ঢুঁড়ে লিয়ে আসছি।
–হ্যাঁ যাও, তাড়াতাড়ি দাখো। চৌকিদার না আসা পর্যন্ত তোমার বকশিশ মিলবে না। বকশিশের কথা শুনে লিখা যেন চমকে উঠলো, যেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কিংবা এসব কথা তার সামনে উচ্চারণ করাই উচিত নয়। অত্যন্ত লাজুকভাবে ঘাড় নুয়ে বললো, সে জন্য কি আছে
ওরা বারান্দায় উঠলো। চেয়ারে বসে হাত-পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলো : রবি আর সঞ্জয় দুদিকের বাব্লান্দা ঘুরে তদন্ত করে এলো। রবি বললো, সত্যি খুব গ্র্যান্ড জায়গা, ট্রেনের সেই লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত মাইরি।
অসীম বললো, লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এলে হতো; মনে হচ্ছে, সেও খুব রসিক লোক।
ওরা ছিল ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে। মাঝ রাত্তিরে যখন চেকার ওঠে, ওরা বলেছিল, আমরা টিকিট কাটি নি কোথায় যাবো এখনো ঠিক করি নি।
–কোথায় যাবেন জানেন না তা হলে ট্রেনে উঠেছেন কেন?
–এমনিই শাখা হলো। জানিলা দিয়ে দেখছি–কোনো জায়গা পছন্দ হলে নামার সময় গার্ডকে ভাড়া দিয়ে দেবো।
–মাঝ রাত্তিরে জায়গা দেখছেন? তা বেশ! ট্রেনের আইনে তো ওসব চলে না। অন্তত টাটানগর পর্যন্ত টিকিট কাটুন এখন!
–টুটানগর গিয়ে কী করবো? বাজে জায়গা!
–কোথায় যাবেন তা-ই যখন জানেন না–
এই সময় ওদের পাশের লোকটি কথা বলে। লোকটি মধ্যবয়স্ক ঘন নীল-রঙা সুট পরে ছিল–হয়তে সব সময় একখানা বই, প্রত্যেক স্টেশনে চা খাচ্ছিল; দেখে মনে হয়েছিল লোকটি অবাঙালি, এবার সে পরিষ্কার বাংলায় বললো আপনারা নিরিবিলিতে কোথাও ছুটি কাটাতে চান তো? আমি একটা জায়গা সাজেষ্ট করতে পারি। ধলভূমগড়, বেশি দূত্র নয়। ঝাড়গ্রামের দুস্টেশন পরেই!
রবি জিজ্ঞেস করেছিল কী রকম জায়গা বলুন তো?
লোকটি উত্তর দিয়েছিল এতক্ষণ আপনাদের কথাবার্তা শুনে আপনাদের মেজাজটা বুঝেছি। ধলভূমগড়ে যান, আপনাদের ভালো লাগবে। আমি অনেকবার গেছি, খুব নিরিবিলি। রেষ্ট হাউসে থাকবেন, কেউ বিরক্ত করবে না। আপনার তো সেই রকম জায়গাই চান!
লোকটি ওদের সাহায্য করতেই চাইছিল, তবু গায়ে পড়ে পরামর্শ দিচ্ছে বলে ওদের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। রবি বলেছিল, আমরা কী রকম জায়গা চাই, তা আপনি কি করে বুঝলেন দাদা?
লোকটি সামান্য হেসে বলেছিল, বছর পনেরো আগে আমার বয়েসও আপনাদের সমান ছিল। আমার সেই সময়কার কথা ভেবে বললুম। আর কি! আমরা সভ্য মানুষরা মাঝে মাঝে জঙ্গলে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাই। সেদিক থেকে ও জায়গাটা ব্রিলিয়ান্ট!
—আমরা কী রকম জায়গা চাই, তা অবশ্য ঠিক জানিনা। আচ্ছা, ধলভূমগড়েই গিয়ে দেখা যাক।
এখন চেয়ারে পা ছড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে সঞ্জয় বললো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আগে থেকে রিজার্ভ না করলে ফরেষ্ট বাংলোতে থাকা যায় না। বোধহয় গোলমাল করবে: চৌদিকাক্স এসে।
—ওসব কিছু না। দুটো টাকা একস্ট্রা দিলেই হবে।
–হবে কি না সন্দেহ।
দূরে দেখা গেল একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে লিখা ফিরছে। শেখর বললো, সকলের একসঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। রবি, তুই চৌকিদারকে ট্যাক্ল কর।
রবির সু জোড়া নতুন, হাঁটলে গস গস শব্দ হয়, ফরসা মুখে ওর ঘন কালো জোড়া ভুরু–বেশ একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে। প্যান্টের হিপ পকেটে হাত দিয়ে রবি বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল, অত্যন্ত অবজ্ঞা ভরে লেখাকে জিজ্ঞেস করলো, এই লোকটাই চৌকিদার নাকি?–কী নাম তোমার?
রবি লোকটার চোখে চোখ ফেলে প্রতীক্ষায় তাকিয়ে রইলো। লোকটা এখনো সেলাম করে নি, রবির কাছে সেইটাই এখন সবচেয়ে বড় ব্যাপার। নিরীহ চেহারার মাঝ বয়স্ক লোকটা, সম্পূর্ণ খালি গা, তামাটে বুকের ওপর ঝুলছে মোটা পৈতে। লোকটা খানিকটা উদ্ভ্রান্ত, কোনো অসমাপ্ত কাজ থেকে যেন হঠাৎ উঠে এসেছে। রবির চোখের দিকে সে তাকাচ্ছিল না, কিন্তু চোখে চোখ পড়লোই, সঙ্গে সঙ্গে সে সেলামের ভঙ্গিতে কপালের কাছে হাত তুলে দুর্বল গলায় বললে, হ্যাঁ, হুজুর। আমার নাম রতিলাল।
হঠাৎ অকল্পনীয় সুবি প্রবল কঠোরতার সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো, এতক্ষণ কোথায় ছিলেঃ অ্যা? উল্লুক-কাঁহাকা; আধা ঘণ্টা ধরে বাইরে বসে আছি–দরজা তালাবন্ধ।
লোকটা ভয়ে একবারে কোঁপে উঠলো। ক্ষীণ গলায় বললো, হুজুর, কারুর তো আসার কথা ছিল না।
–অ্যাসার কথা ছিল মা মানে? সাতদিন আগে চিঠি দিয়েছি!
— হুজুর, কোনো খৎ তো পাই নি।
–খৎ পাও না পাও, তোমার ডিউটি এখানে থাকা। যাও, তাড়াতাড়ি দরজা খোলো।
লোকটা খানিকটা দম নিয়ে একটু সাহস সঞ্চয় করলো, তারপর বললো, হুজুরের কাছে সিলিপ আছে? রিজার্ভ না থাকলে তো–
সে-সব পরে হবে, তুমি আগে দরজা খোলো। ফরেস্টারবাবু কোথায়?
—ফরেষ্টারবাবু চাকুলিয়া গিয়েছেন, কাল বিকালে আসবেন।
—ঠিক আছে, ফরেষ্টারবাবু এলে তাঁকে সিলিপ দিয়ে দেবো। এখন দরজা খুলে দাও।
-–কিন্তু আমার ওপর অর্ডার আছে, ক্লিপ না দেখালে তালা খুলতে মানা।
রবির মেজাজ এবার সপ্তমে পৌঁছুলো। সমস্ত মুখ বিকৃত করে সে বললো, আঃ, জ্বালালে দেখছি! এ–পকেট সে–পকেট খুঁজতে লাগলো রবি। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, এর নামে রিপোর্ট করতে হবে। ডিউটির সময় আড়ড়া মারতে যাওয়া! তারপর রবি পকেট থেকে কিছু একটা পেয়ে গেল—ট্রেনে চেকার ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যে রসিদ দিয়েছিল—ধলভূমগড়ের স্টেশন মাস্টার যেটা দেখেই খুশি হয়েছিলেন—আর নিতে চান নি, রবি সেই কাগজটা মুড়ে চৌকিদারের দিকে ছুঁড়ে বললো, এই নাও! এবার খোলো—
শেখর, সঞ্জয় ও অসীম তখন অতি মনোযোগ দিয়ে নিজেদের হাতের পাঞ্জা দেখছে, কেউ পরীক্ষা করছে দেয়ালের চুনকাম, মুখগুলো কঠিন, যাতে কোনোক্রমে হাসি বেরিয়ে না পড়ে।
রতিলাল কাগজটা তুলে নিয়ে দেখলো! সব সরকারি কাগজই একরকম, সে কাগজটা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে চাবি বার করে দরজা খুললো। তারপর অতি ব্যস্ত হয়ে বললো, আমি টাঙ্কিতে এখনি পানি ভরে দিচ্ছি।
রবি বন্ধুদের দিকে চেয়ে বিশ্বজয়ীর কণ্ঠস্বরে বললো, কি চলবে তো? চল ঘরগুলো দেখা যাক। এই লখা, মালপত্তরগুলো ঘরে তোল।
দুখানা ঘর, পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট সঙ্গে বাথরুম। প্রত্যেক ঘরে দুখানা করে খাট, ড্রেসিং টেবিল, পোশাকের র্যাক, এমনকি শীতের জন্য ফায়ার প্লেস। ঘর দেখে ওদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটার কৃতিত্ব নেবার ভঙ্গিতে রবি মুখ প্রসন্ন করলো, তারপর রতিলালকে বললো, শোনো চৌকিদার ঝটপট চায়ের ব্যবস্থা করে। রান্নাবান্নাও করতে হবে। এখানে কী কী খাবার পাওয়া যাবে?
রতিলাল বললো, হুজুর, আমি চা বানাতে পারবো। কিন্তু খানা পাকাতে আমি জানি না। আমার বহু উসাব করতো, সাহেবরা তার রান্না খেয়ে কত খোস হয়েছেন, কিন্তু তার বড় বোখার। ডাগদরবাবুর পাশ গিয়েছিলুম, ডাগদরবাবু বললেন, সুই নিতে হবে।
–তাহলে তো মুশকিল। রান্না করবে কে? অসীম, তুই পারবি?
–দুএকবেলা চালিয়ে দেবো।
–ঠিক আছে, আজকের দিনটা তো চলুক। চৌকিদার, তুমি বাথরুমে জল তুলে দাও, চা করো, আর জিনিসপত্র কিনতে হবে, চাল, আলু, আর এখানে মুর্গী পাওয়া যাবে তো?
–মুর্গী তো সেই হাটবার।
–ভাগ, সবই শুধু হাটবার! গ্রামের মধ্যে মুর্গী পাওয়া যাবে না?
লখা বললো, আমি মুর্গী যোগাড় করে পুবে বাবু। ভালো মুর্গী, দুবলা-ফুবলা নয় নিজের ঘরের।
–ঠিক আছে, এই লোকটাকে দিয়েই জিনিসপত্র আনানো যাক। চৌকিদার, তুমি একে চেনো তো? এ টাকা পয়সা নিয়ে পালালে তুমি জামিন রইলো।
লখাকে টাকা আর জিনিসের লিস্ট দিয়ে পাঠানো হলো। রতিলাল গেল জল তুলতে। ওরা এবার জুতো-জামা খুললো, সুটকেস থেকে বেরুলো টাটক গেঞ্জি আর পা-জামা। অসীমের সুটকেসের এক কোণে উঁকি মারলো একটা ব্ৰান্ডিক্স বোতল। রবি একটু ছটফট, সে চটি জুতো খুঁজে পাচ্ছে না, তার ধারণা বেডিং-এর মধ্যেই রেখেছিল, সেখানে নেই। সুটকেস হাঁটকেও না পেয়ে রবি পুরো সুটকেসটাই উলটে দিলো। চটি জুতো আনতে সে ভুলেই গেছে, কিন্তু তার জিনিসপত্রের মধ্যে সবার চোখে পড়লো একটা খাপসুদ্ধ বড় ছোরা। অসীম বললে, আরে, দারুণ জিনিসটা তো!
অসীম সেটা তুলে নিয়ে খাপ থেকে ছোরাটা বার করলো। খাটিষ্টিলের নইঞ্চি ফলা, ঝকঝক করছে। জিজ্ঞেস করলো, এটা এনেছিস কেন?
রবি বললো, রেখেছি সঙ্গে-যদি কাজে লাগে।
অসীম বললো, এত বড় ছোরা সঙ্গে থাকলেই কাজে লাগাতে ইচ্ছে করে। ডেঞ্জারাস!
রবি তাকে তাড়া দিয়ে বললো, নে নে যা, চট করে আগে চান করে নে, আবার রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।
টুথব্ৰাস, টুথ পেষ্ট, তোয়ালে নিয়ে দুজন ঢুকলো বাথরুমে। শেখরই শুধু পুরো পোশাকে অলসভাবে বসে রইলো চেয়ারে। জুতোও খোলে নি। একটু একটু পা দোলাচ্ছে, ওদের কথার দিকে মন নেই! একমলে সিগারেট টানতে লাগলো, একটা হাত তার মাথার চুল নিয়ে খেলা করছে।
রবি বললে, কি রে শেখর তুই জাম-কাপড় ছাড়লি না?
—দাঁড়া, এই সিগারেটটা শেষ করে নিই।
—মুখখানা অমান উদাস কেন? ও বাড়ির সেই মেয়েদের কথা ভাবছিস বুঝি?
–কোন বাড়ির?
–ঐ যে আসবার সময় দেখলুম, ত্ৰিপাঠীদের বাড়ির সুন্দরীরা, তোর চেনা-চেনা—
–যাঃ, ও কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
—তাহলে, এমন চুপচাপ!
–বঃ, চুপচাপ নিরিবিলিতে কাটাবার জন্যই তো এখানে এলাম।
–দাঁড়া না, নিরিবিলি বার করছি। একেবারে নরক গুলজার করে তুলবো।