Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড || কৃত্তিবাস ওঝা » Page 10

রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড || কৃত্তিবাস ওঝা

নিদ্রাগত ভরত পালঙ্কের উপর।
উঠেন কুস্বপ্ন দেখি সশঙ্ক-অন্তর।।
প্রভাতে ভরত আসি বসেন দেওয়ানে।
আইল অমাত্যগণ তাঁর সম্ভাষণে।।
যথাযোগ্য নমস্কার করে পাত্রগণ।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত করে শুভাশীর্ব্বচন।।
মিত্রগণ আসিয়া আলাপ করে কত।
ইতরে সন্তোষ করে ব্যবহার মত।।
ভরত বিষণ্ন অতি মুখে নাহি শব্দ।
নিশ্বাস প্রবল বহে রহে অতি স্তব্ধ।।
ভরতেরে জিজ্ঞাসা করেন পাত্রগণ।
শুনিয়া ভরত বাক্য বলেন তখন।।
কুস্বপ্ন দেখেছি আজি রাত্রি-অবশেষে।
যেন চন্দ্র সূর্য্য খসি পড়িল আকাশে।।
স্বপ্নে এক বৃদ্ধ আসি কহিল বচন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা গিয়াছেন বন।।
দেখিলাম মৃত পিতা তৈলের ভিতর।
এই স্বপ্ন দেখি আমি কম্পিত অন্তর।।
চারি ভাই আর পিতা, এই পাঁচ জন।
পাঁচের মধ্যেতে দেখি পিতার মরণ।।
ভরতের কথা শুনি সবাকার ত্রাস।
পাত্র মিত্র ভরতেরে করিছে আশ্বাস।।
দেখিয়াছ কুস্বপ্ন হে নৃপতি কুমার।
শুনহ ভরত, কহি তার প্রতিকার।।
দেবতার পূজা তুমি কর সাবধানে।
ব্রাহ্মণ দরিদ্রে তুষ্ট কর নানা দানে।।
ইহা বিনা ভরত নাহিক উপদেশ।
দান দ্বারা তোমার ঘুচিবে সর্ব্ব ক্লেশ।।
পাত্র মিত্র করিলেক এতেক মন্ত্রণা।
স্নান করি ভরত আনেন দ্রব্য নানা।।
পূজিলেন আগে দেবে দিয়া উপহার।
করেন ভরত দান সকল ভাণ্ডার।।
ভরতের যত ছিল ধনের ভাণ্ডার।
দিলেন সকল দ্বিজে, সীমা নাহি তার।।
সকল ভাণ্ডার শূন্য, নাহি আর ধন।
তথাপি তাঁহার কিন্তু স্থির নহে মন।।
প্রবল প্রতাপশালী কেকয় ভূপতি।
দেওয়ানে বসিল গিয়া যেন সুরপতি।।
ভরত বসেন গিয়া ভূপতির পাশে।
অযোধ্যার দূত গিয়া তখন প্রবেশে।।
কেকয় রাজার প্রতি নোয়াইয়া মাথা।
ভরতের আগে দূত কহে সব কথা।।
আইলাম তোমাকে লইতে সর্ব্বজন।
ভরত ঝটিতি দেশে কর আগমন।।
রাজার নিশান দেখ হাতের অঙ্গুরী।
ঝাট চল আমরা রহিতে নাহি পারি।।
একদণ্ড না রহিব, আছে বড় কাজ।
ভরতেরে পাঠাও কেকয় মহারাজ।।
কথার প্রবন্ধে তারা কহিল বিশেষ।
দেখিতে তোমায় বাঞ্ছা রাজার অশেষ।।
শুনিয়া ভরত কিছু না হন প্রতীত।
যত স্বপ্ন দেখিলাম, সব বিপরীত।।
ভরত বলেন, বল পিতার মঙ্গল।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ ভাই আছেন কুশল।।
কৈকেয়ী কৌশল্যা আর সুমিত্রা জননী।
সকলের মঙ্গল, বল হে দূত শুনি।।
দূত বলে, রাজপুত্র সবার কুশল।
সবারে দেখিবে যদি, শীঘ্র দেশে চল।।
প্রণাম করিয়া মাতামহের চরণে।
হইলেন ভরত বিদায় সেইক্ষণে।।
হাতী ঘোড়া দিল রাজা বহুমূল্য ধন।
অশন বসন আর নানা আভরণ।।
শত্রুঘ্ন ভরত দোঁহে চড়িলেন রথে।
কত শত সৈন্য চলে তাহার সহিতে।।
সূর্য্য যান অস্তগিরি বেলা অবশেষে।
হেনকালে সবে তারা অযোধ্যা প্রবেশে।।
শ্রীরামের শোকে লোক করিছে ক্রন্দন।
অযোধ্যার সর্ব্বলোক বিরস বদন।।
জিজ্ঞাসেন ভরত হইয়া বিষাদিত।
প্রজালোক কান্দে কেন, নহে হরিষিত।।
অনেক দিনের পরে আইলাম দেশে।
কাছে না আইসে কেহ, কেহ না সম্ভাষে।।
এত শুনি দূতগণ হেঁট করে মাথা।
কেহ নাহি কহে কোন ভাল মন্দ কথা।।
অযোধ্যার সর্ব্ব লোক আছে যে নিয়মে।
অশুভ সংবাদ নাহি কহে কোন ক্রমে।।
ভরত ভাবিত অতি মানিয়া বিস্ময়।
প্রথমে গেলেন তিনি পিতার আলয়।।
দেখিল নাহিক পিতা শূন্য নিকেতন।
ভরত ভাবিয়া কিছু না পান কারণ।।
মৃত্যুকালে দশরথ কৌশল্যার ঘরে।
তথা তাঁর মৃতদেহ তৈলের ভিতরে।।
ভরত পিঁতার গৃহ শূন্যময় দেখি।
মায়ের আবাসে যান হয়ে মনোদুঃখী।।
কৈকেয়ী বসিয়া আছে রত্ন-সিংহাসনে।
পড়িয়াছে প্রমাদ, মনেতে নাহি গণে।।
পুত্রের রাজত্ব লাভে আছে মনোসুখে।
ভরত গেলেন তবে মায়ের সম্মুখে।।
ভরতেরে দেখিয়া ত্যজিল সিংহাসন।
ভরত করেন তাঁর চরণ বন্দন।।
মুখে চুম্ব দিয়া রাণী পুত্র কৈল কোলে।
কুশল জিজ্ঞাসা করে তাঁরে কুতূহলে।।
শুকয় ভূপতি পিতা আছেন কুশলে।
কুশাল আছেন মম সোদর সকলে।।
মঙ্গলে আছেন ভাল বিমাতা সকল।
পিতৃরাজ্য রাজগিরি দেশের মঙ্গল।।
ভরত বলেন, মাতা না হও বিকল।
মাতা পিতা ভ্রাতা তব সবার কুশল।।
তোমার বান্ধব যত, কেহ নাহি মরে।
সকল মঙ্গল তব জনকের ঘরে।।
তুমি যত জিজ্ঞাসিলে দিলাম উত্তর।
আমি যে জিজ্ঞাসি, তাহা কহ ত সত্বর।।
অযোধ্যার রাজ্য কেন দেখি বিপরীত।
সকলে বিষণ্ণ কেহ নহে হরষিত।।
চতুর্দ্দিকে লোক কেন করিছে ক্রন্দন।
আমারে দেখিয়া কেন করিছে নিন্দন।।
পিতার আলয়ে কেন না দেখি পিতারে।
অযোধ্যানগর কেন পূর্ণ হাহাকারে।।
যে কথা কহিতে কারো মুখে না আইসে।
হেন কথা কহে রাণী পরম হরিষে।।
সত্যবাদী তব পিতা সত্যে বড় স্থির।
সত্য পালি স্বর্গেতে গেলেন সত্যবীর।।
শূন্যরাজা আছে তব পিতার মরণে।
ভরত আছাড় খেয়ে পড়েন সেক্ষণে।।
কাটিলে কদলী যেন ভূমিতে লোটায়।
ধূলায় পড়িয়া বীর গড়াগড়ি যায়।।
মূর্চ্ছাগত ভরত হলেন পিতৃশোকে।
কান্দিয়া বিকল তাঁরে দেখি অন্য লোকে।।
কৈকেয়ী বলিল, পুত্র কর অবধান।
তোমার ক্রন্দনে মোর বিদরে পরাণ।।
সর্ব্বশাস্ত্র জান তুমি ভরত অন্তরে।
পিতা মাতা লয়ে কেবা কোথা রাজ্য করে।।
ভরত বলেন, শুনি পিতার মরণ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ তাঁরা কোথা দুই জন।।
মহারাজ রামেরে অর্পিয়া রাজ্যভার।
করিবেন আপনি কেবল সদাচার।।
এই সব যুক্তি পূর্ব্বে ছিল, আমি জানি।
তাহার অন্যথা কেন, কহ ঠাকুরাণি।।
অযুত বৎসর জানি পিতার জীবন।
নয় হাজার বর্ষে তাঁর মৃত্যু কি কারণ।।
রাজার মরণে তব নাহিক বিষাদ।
অনুমানে বুঝি, তুমি করেছে প্রমাদ।।
রাজকন্যা কৈকেয়ী বাড়িছে নানা সুখে।
কত শত কথা বলে, যত আসে মুখে।।
রাম বনে গেলেন, লক্ষ্মণ তাঁর সাথে।
মনে কি করিয়া সীতা গেলেন পশ্চাতে।।
ভরত বলেন, কেন রাম যান বনে।
পরাণ বিদরে মাতা তোমার বচনে।।
হরিলেন কার ধন, কার বা সুন্দরী।
কোন দোষে হইলেন রাম বনচারী।।
কৈকেয়ী সকল কহে ভরতের স্থানে।
রামের অশেষ গুণ প্রথমে বাখানে।।
ভকতবৎসল রাম ধর্ম্মেতে তৎপর।
জনক-জননী প্রাণ গুণের সাগর।।
শ্রীরাম হইলে রাজা সবার কৌতুক।
রামের প্রসাদে লোক পায় নানা সুখ।।
কালি রাম রাজা হবে আজি অধিবাস।
হেনকালে রামেরে দিলাম বনবাস।।
তোমারে রাজত্ব দিয়া রাম যান বন।
হা রাম বলিয়া রাজা ত্যজিল জীবন।।
মাতৃঋণ পুত্র কভু শুধিতে না পারে।
রাম লয়েছিল রাজ্য দিলাম তোমারে।।
রাজা হয়ে রাজ্য কর বৈস রাজপাটে।
রাজলক্ষ্মী আছে পুত্র তোমার ললাটে।।
ঘায়েতে লাগিলে ঘা যেমন বড় জ্বলে।
ভরত তেমন জ্বালাতন হয়ে বলে।।
নিজগুণ কহ মাতা, আপনার মুখে।
আপনি মজিলে মাতা, ডুবিলে নরকে।।
রাজকুলে জন্মিয়া শুনিলে কোন্খানে।
কনিষ্ঠ হইবে রাজা জ্যেষ্ঠ বিদ্যমানে।।
তোর পিতা পিতামহ করে ধর্ম্ম কর্ম্ম।
সে বংশেতে কেন হৈল রাক্ষসীর জন্ম।।
নিশাচরী হয়ে তুই হইলি মানুষী।
রঘুবংশ ক্ষয় হেতু হইলি রাক্ষসী।।
শ্রীরামের শোকে রাজা ত্যজেন জীবন।
তুই কেন শ্রীরামেরে পাঠাইলি বন।।
রাজার প্রসাদে তোর এতেক সম্পদ।
তিনকূল মজাইলি স্বামী করি বধ।।
পূর্ব্বজন্মে করিলাম কত কদাচার।
সেই পাপে তোর গর্ভে জনম আমার।।
মা হইয়ে তনয়েরে দিলি এক শোক।
ইচ্ছা হয় কাটিয়া পাঠাই পরলোক।।
এমন রাক্ষসী তুই, নাহি দেখি কোথা।
তো হেন মাতায় বধি নাহি কোন ব্যথা।।
যমন পরশুরাম কাটিল মায়েরে।
তেমনি করিতে বাঞ্ছা, কিন্তু মরি ডরে।।
রাম পাছে বর্জ্জেন বলিয়া মাতৃঘাতী।
তবে ত নরকে মম হবে নিবসতি।।
ভরত জ্বলন্ত অগ্নিতুল্য ক্রোধে জ্বলে।
দেখিয়া কৈকেয়ী তবে যায় অন্য স্থলে।।
যাইতে যাইতে রাণী করেন বিষাদ।
কার লাগি করিলাম এতেক প্রমাদ।।
আইলেন শত্রুঘ্ন করিতে সম্ভাষণ।
ভরতের ক্রন্দনে কান্দেন দুই জন।।
ভাই ভাই বলিয়া ভরত নিল কোলে।
দুজনার অঙ্গ তিতে নয়নের জলে।।
অনুমানে বুঝিলেন কুঁজীর এ ক্রিয়া।
কহিতে লাগিল দোঁহে কুপিত হইয়া।।
রামেরে দিলেন পিতা নিজ ছত্রদণ্ড।
কোথা হতে কুঁব্জী চেড়ী পাড়িল পাষণ্ড।।
পাইলে কুঁজীর দেখা বধিব জীবন।
বিধির নির্ব্বন্ধ কুঁজী এল সেইক্ষণ।।
শোভা পায় পট্টবস্ত্রে আর আভরণে।
সর্ব্বাঙ্গ ভূষিতা কুঁজী সুগন্ধ চন্দনে।।
মুক্তাহার শোভে তার কুঁজের উপর।
শ্রীরামের বনবাসে প্রফুল্ল অন্তর।।
এতেক প্রমাদ হবে কুঁজী নাহি জানে।
ভরতের নিকটে আইসে হৃষ্টমনে।।
হেনকালে দ্বারী বলে শুনহ শত্রুঘ্ন।
এই কুঁজী হেতু বৃদ্ধ রাজার মরণ।।
এই কুঁজী মজাইল অযোধ্যানগরী।
এই কুঁজী মরিলে সকল দুঃখ তরি।।
শত্রুঘ্ন বলেন, ভাই ইচ্ছা করে মন।
এখনি কুঁজীর আমি বধিব জীবন।।
শত্রুঘ্ন কুপিত হয়ে ধরে তার চুলে।
চুলে ধরি কুঁজীরে সে ফেলে ভূমিতলে।।
হিচড়িয়া লয়ে যায় তাহারে ভূতলে।
কুমারের চাক হেন ঘুরাইয়া ফেলে।।
মরি মরি বলি কুঁজী, পরিত্রাহি ডাকে।
চুল ছিঁড়ে গেল, সে কৈকেয়ী-ঘরে ঢোকে।।
কুঁজী বলে কৈকেয়ী করহ পরিত্রাণ।
ভরত শত্রুঘ্ন মোর লইল পরাণ।।
শত্রুঘ্ন প্রবেশে ক্রোধে কৈকেয়ীর ঘরে।
চুল ধরে কুঁজীরে সে আনিল বাহিরে।।
তবু তার হার আছে কুঁজের শোভন।
ছিঁড়িয়া পড়িল যেন দীপ্ত তারাগণ।।
তোর লাগি পিতা মরে ভাই বনবাসী।
সৃষ্টিনাশ করিলি হইয়া তুই দাসী।।
কৈকেয়ীর মুখ্যা দাসী, ধাত্রী ভরতের।
সর্ব্বাঙ্গ ভিজিল রক্তে, এই কর্ম্মফের।।
চুলে ধরি লয়ে যায়, কুঁজে যায় ছড়।
শত্রুঘ্নে দেখিয়া ত কৈকেয়ী দিল রড়।।
চেড়ীরে মারিল, পাছে প্রহারে আমায়।
এই ত্রাস মনে করি কৈকেয়ী পলায়।।
শত্রুঘ্ন বলেন, শুন কৈকেয়ী বিমাতা।
পলাইয়া নাহি যাও, কহি এক কথা।।
সাতশত রাণী জিনি তোমার প্রতাপ।
তুমি যা বলিতে, তাই করিতে বাপ।।
রাজার মহিষী তুমি, রাজার নন্দিনী।
তোমা সম দুর্ভাগা স্ত্রী না দেখি না শুনি।।
শচীর অধিক সুখ বলে সর্ব্বলোক।
আমি কি মারিয়া মাতা ডুবিব নরকে।।
দাসীর কথায় বুদ্ধি গেল রসাতলে।
দোষ-অনুরূপ আমি কি বলিব ফল।।
যদি তোমা বধি প্রাণে, দুঃখ নাহি ঘুচে।
মাতৃবধ করিয়া নরকে ডুবি পাছে।।
তোমার চেড়ীরে মারি তোমার সম্মুখে।
জ্বলিয়া পুড়িয়া যেন মর এই শোকে।।
চুল ধরি চেড়ীরে মাটিতে মুখ ঘসে।
দেখিয়া কৈকেয়ী দেবী কাঁপিছে তরাসে।।
বুকে হাঁটু দিয়া সে কুঁজীর ধরে গলা।
মুদগরের ঘায়েতে ভাঙ্গিল পায়ের নলা।।
একে ত কুৎসিতা কুঁজী, তায় হৈল খোঁড়া।
সর্ব্ব গায়ে ছড় গেল যেন রক্তবোড়া।।
অচেতন হৈল কুঁজী, শ্বাসমাত্র আছে।
ভরত ভাবেন, নারীহত্যা হয় পাছে।।
বারে বারে বলেন ভরত সুবচন।
নারীহত্যা হয় পাছে শুন রে শত্রুঘ্ন।।
রক্ত চর্ম্ম নাহি আর অস্থি মাত্র সার।
নারীবধ হয় পাছে, না মারিহ আর।।
নারীহত্যা মহাপাপ, শুনহ শত্রুঘ্ন।
যদি এই পাপে রাম করেন বর্জ্জন।।
মাতৃহত্যা নাহি করি শ্রীরামের ডরে।
এত শুনি শত্রুঘন ছাড়িল কুঁজীরে।।
লইলেন কুঁজীরে কৈকেয়ী বিদ্যমান।
এতেক প্রহারে তার রহিল পরাণ।।
ভরত বলেন, ভাই দেব সব জানে।
এতেক হইবে ভাই, জানিব কেমনে।।
রামেরে দিলেন পিতা রাজসিংহাসন।
কে জানে করিবে মাতা অন্যথাচরণ।।
সংসারের সার ভুঞ্জে, তবু নাহি আঁটে।
রাজার মহিষী কি চেড়ীর বাক্যে খাটে।।
আমি দুষ্ট হইলাম জননীর দোষে।
কৌশল্যার কাছে যাব কেমন সাহসে।।
শত্রুঘ্ন বলেন, তিনি না করিবেন রোষ।
আপনি জানেন মাতা, যার যত দোষ।।
ভরত শত্রুঘ্ন হেথা করেন রোদন।
কৌশল্যা বসিয়া ঘরে করেন শ্রবণ।।
ভরত শত্রুঘ্ন গিয়া ভাই দুইজন।
করিলেন কৌশল্যার চরণ বন্দন।।
পুত্র বলি কৌশল্যা ভরতে নিল কোলে।
উভয়ের সব্বাঙ্গ তিতিল নেত্রজলে।।
কৌশল্যা কহেন, শুন কৈকেয়ীনন্দন।
মায়ে পোয়ে রাজ্য কর ভরত এখন।।
কালি রাম রাজা হবে আজি অধিবাস।
হেনকালে তব মাতা দিল বনবাস।।
হরিল কাহার ধন রাম কার নারী।
কোন্ দোষে পুত্রে মোর করে দেশান্তরী।।
আমারে করিয়া দূর ঘুচাও এ কাঁটা।
পাঠাও রামের কাছে, শিরে ধরি জটা।।
দুঃখভাগী যেই জন সেই পায় দুঃখ।
মায়ে পোয়ে ভরত করহ রাজ্যসুখ।।
ভরত কাতর অতি কৌশল্যার বোলে।
রামের সেবক আমি তুমি জান ভালে।।
মম মতে যদি রাম গিয়াছেন বনে।
দিব্য করি মাতা আমি তোমার চরণে।।
রাজা যদি প্রজা পীড়ে, না করে পালন।
আমারে করুন বিধি সে পাপ-ভাজন।।
প্রজা হয়ে রাজদ্রোহ করে যেই লোকে।
সেই পাপে পাপী হয়ে ডুবিব নরকে।।
বিদ্যা পেয়ে গুরুকে যে, না করে সেবন।
কর্ম্ম করি দক্ষিণা না দেয় যেই জন।।
আপনা বাখানে যেবা, পরনিন্দা করে।
সেই মহাপাপরাশি ঘটুক আমারে।।
স্থাপ্যধন হরণেতে যে হয় পাতক।
তত পাপে পাপী হয়ে ভুঞ্জিব নরক।।
রামেরে বঞ্চিয়া রাজ্য যদি আমি চাই।
ইহ পরকাল নষ্ট শিবের দোহাই।।
শপথ করেন এত ভরত তখন।
কৌশল্যা বলেন, পুত্র জানি তব মন।।
রামের হৃদয় ধর্ম্মে যেমন তৎপর।
তোমার হৃদয় পুত্র একই সোসর।।
চৌদ্দবর্ষ গেলে রাম আসিবেন দেশ।
ততদিনে মম প্রাণ হইবে নিঃশেষ।।
মৃতদেহ আছে ঘরে, বড় পাই লাজ।
শীঘ্র কর ভরত পিতার অগ্নিকাজ।।
পিতৃশোক ভ্রাতৃশোক মায়ের অযশ।
ভরত করেন খেদ রজনী দিবস।।
আমা হেতু পিতা মরে, ভ্রাতা বনবাসী।
এতেক জানিলে কি দেশেতে আমি আসি।।
বশিষ্ঠ বলেন, তুমি ভরত পণ্ডিত।
তোমারে বুঝাব কত, এ নহে উচিত।।
সত্য পালি ভূপতি গেলেন স্বর্গবাস।
তাঁহার কারণে কান্দ, হয় পুণ্যনাশ।।
রাম হেন পুত্র যাঁর গুণের নিদান।
কে বলে মরিল রাজা, আছে বিদ্যমান।।
এইরূপে বুঝান বশিষ্ঠ মহামুনি।
ভরত না শুনে কিছু, কহে খেদবাণী।।
কিমতে ধরিব প্রাণ পিতার মরণে।
কিমতে ধরিব প্রাণ রামের বিহনে।।
কিরূপে হইব স্থির কাহারে নিরখি।
দুই শোকে প্রাণ রহে, কোথাও না দেখি।।
শশধর যেমন হইল মেঘাচ্ছন্ন।
পাত্র মিত্র সহিত বশিষ্ঠ পুরোহিত।।
পিতার নিবাসে যান লোকেতে নিরাশ।
ভরতের সঙ্গে গেল রাজার নিবাস।।
ভরত বলেন, পিতা এই তব গতি।
উঠিয়া সম্ভাষ কর ভরতের প্রতি।।
তোমারে দেখিতে আসিয়াছে পুরীজন।
উঠিয়া সবারে কহ প্রবোধ বচন।।
মাতৃদোষে আমা সহ না কহ বচন।
যদি থাকে অপরাধ, কর বিমোচন।।
বশিষ্ঠ বলেন, ত্যজ ভরত ক্রন্দন।
পিতৃ-অগ্নিকার্য্য-শ্রাদ্ধ করহ তর্পণ।।
পিতৃকার্য্যে জ্যেষ্ঠ তনয়ের অধিকার।
রাম দেশে নাহি, তুমি করহ সৎকার।।
অগুরু চন্দন কাষ্ঠ আনে ভারে ভারে।
ঘৃত মধু কুম্ভ পূরি আনিল সত্বরে।।
মুকুতা প্রবাল আনে বহুমুল্য ধন।
চতুর্দ্দোল আনিল বিচিত্র সিংহাসন।।
সুগন্ধি পুষ্পের মাল্য, গন্ধ মনোহর।
চতুর্দ্দোলে চড়াইল রাজারে সত্বর।।
অযোধ্যানগরে যত স্ত্রী পুরুষ আছে।
শিরে হাত দিয়া যায় ভরতের পিছে।।
তৈলের ভিতরে যে ছিলেন মহারাজা।
সরযূর তীরে লয়ে যায় বন্ধু প্রজা।।
তাঁরে স্নান করাইল সরযূর জলে।
দেখিয়া কাতর অতি হইল সকলে।।
শুক্ল বস্ত্র পরাইল, সুন্দর উত্তরী।
সর্ব্বাঙ্গ ভরিয়া দিল সুগন্ধি কস্তূরী।।
নানাবিধ কুসুমের মাল্য মনোহর।
যথাস্থানে দিল তাঁর গলার উপর।।
চিতার উপর লয়ে করায় শয়ন।
হেঁটে ঊর্দ্ধে কাষ্ঠ দিল অগুরু চন্দন।।
তিন লক্ষ ধেনু দান করেন ভরত।
রাজার সম্মুখে আনি যথা শাস্ত্রমত।।
পিতারে করেন দাহ ঘৃতের অনলে।
করিলেন তর্পণাদি সরযূর জলে।।
তর্পণ করিয়া পিণ্ড দিয়া নদী-পাড়ে।
ভরত মূর্চ্ছিত হয়ে মৃত্তিকাতে পড়ে।।
ভরত বলেন, সবে যাহ নিজ দেশ।
পিতার অগ্নিতে আমি করিব প্রবেশ।।
পিতা পরলোকগত, ভ্রাতা গেল বনে।
দেশেতে যাইব আমি কোন্ প্রয়োজনে।।
বশিষ্ঠ বলেন, যে ভরত যুক্তি নয়।
জন্মিলে মরণ আছে একথা নিশ্চয়।।
মরণকে এড়াইতে না পারে সংসার।
মরিলে সবার জন্ম হয় আরবার।।
সকলে মরেন, কেহ নহে ত অমর।
ক্রন্দন সম্বর যে ভরত চল ঘর।।
শূন্যরূপা আছে অদ্য অযোধ্যানগরী।
ভরতেরে নিলেন বশিষ্ঠ রাজপুরী।।
কান্দিয়া ভরত পোহাইলেন রজনী।
বিলাপ করেন সদা কোথা রঘুমণি।।
ত্রয়োদশ দিবসে করয়ে শ্রাদ্ধ দান।
নানা দান করেন সে শাস্ত্রের বিধান।।
তুরঙ্গ মাতঙ্গ আর তরী ভূমি গ্রাম।
বিবিধ বসন শাল আর শালগ্রাম।।
বিপ্রে দান দেন সোণা সাত লক্ষ তোলা।
ধেনু দান করিলেন সোণার মেখলা।।
ত্রি-অশীতি লক্ষ মণ সোণার ভাণ্ডার।
বিতরণ করিলেন ধন নাহি আর।।
অষ্টাশীতি লক্ষ ধেনু করিলেন দান।
পৃথিবীতে দাতা নাহি ভরত সমান।।
যত যত রাজা হৈল চন্দ্র-সূর্য্যকুলে।
হেন দান কেহ কোথা না করে ভূতলে।।
সমাপ্ত হইল শ্রাদ্ধ নিবারিল দান।
পাত্র মিত্র কহে গিয়া ভরতের স্থান।।
আসমুদ্র রাজ্য আর অযোধ্যানগরী।
দিয়া রাজা তোমারে গেলেন স্বর্গপুরী।।
পিতৃদত্ত রাজ্য তুমি ছাড় কি কারণ।
রাজা হৈয়া কর তুমি প্রজার পালন।।
তোমা ভিন্ন রাজকর্ম্ম অন্যে নাহি সাজে।
তুমি রাজা না হইলে পিতৃরাজ্য মজে।।
ভরত বলেন, পাত্র না বলিবে আর।
জ্যেষ্ঠ সত্ত্বে কনিষ্ঠের নাহি অধিকার।।
রাজা হৈয়া আমি যদি বসি রাজপাটে।
মায়ের যতেক দোষ আমাতে সে ঘটে।।
রাজ্যের উচিত রাজা রামচন্দ্র ভাই।
রামেরে করিব রাজা, চল তথা যাই।।
যত অভিষেক দ্রব্য লহ রাজখণ্ড।
তথা গিয়া রামেরে অর্পিব ছত্রদণ্ড।।
রামে রাজা করিয়া পাঠাই নিজ দেশে।
রামের বদলে আমি যাই বনবাসে।।
সমান করাহ যত উচ্চনীচ বাট।
সুখে পথে যায় যেন ঘোড়া হাতী ঠাট।।
ভরতের আজ্ঞায় সকলে পড়ে তাড়া।
ভরতে বলেন সবে হাত করি যোড়া।।
তোমার যতেক যশ ঘুষিবে সংসারে।
কৈকেয়ীর অপযশ ভারত ভিতরে।।
ভাল মন্দ সকলি হেথাই বিদ্যমান।
মায়ের হইল নিন্দা পুত্রের বাখান।।
ভরত বলেন, আর তোমরা না বল।
হাতী ঘোড়া কটক সমেত সবে চল।।
ঘোড়া হাতী রথ চলে, সাজয়ে সারথি।
ভরত আনিতে রামে যায় শীঘ্রগতি।।
দাস দাসী চলিল রাজার যত নারী।
ছোট বড় সকল চলিল অন্তঃপুরী।।
শ্রীরামে আনিতে যায় সকল কটক।
বাল বৃদ্ধ কেহ কার না মানে আটক।।
অনন্ত সামন্ত চলে, বৃদ্ধ সেনাপতি।
ভরতের সাথে চলে বহু রথ রথী।।
কৌশল্যা সুমিত্রা যান উভয় সতিনী।
আর সবে চলিল রাজার যত রাণী।।
বশিষ্ঠাদি করিয়া যতেক মুনিগণ।
রাজ্যশুদ্ধ চলিল সকল পুরীজন।।
কৈকেয়ী না যান মাত্র ভরতের ডরে।
কুটিলা কুঁজীর সহ রহিলেন ঘরে।।
কতদূর গিয়া পথে হইল দেয়ান।
বলিলেন বশিষ্ঠ ভরত বিদ্যমান।।
যত্ন করি বিধাতা আপনি যদি আসে।
রামেরে আনিতে তবু না পারিবে দেশে।।
রামেরে আনিতে কেন করিলা উদ্যোগ।
না পারিবে আনিতে কেবল দুঃখভোগ।।
পিতৃসত্য পালিতে গেলেন রাম বন।
পিতা দিল রাজ্য, তুমি ছাড় কি কারণ।।
ভরত বলেন, মুনি তুমি পুরোহিত।
পুরোহিত হয়ে কেন বলহ অহিত।।
তোমার চরণে মম শত নমস্কার।
হেন অমঙ্গল বাক্য না কহিও আর।।
রামের চরণ বিনা গতি নাহি আর।
রামেরে আনিয়া আমি দিব রাজ্যভার।।
প্রবোধিয়া ভরতেরে না পারে রাখিতে।
শ্রীরাম স্মরিয়া যান ভরত ত্বরিতে।।
আছেন যমুনা-পার রাম বনবাসে।
ভরত গেলেন তথা শৃঙ্গবের দেশে।।
পৃথিবী যুড়িয়া ঠাট এক চাপে যায়।
গঙ্গাতীরে বসি গুহ করে অভিপ্রায়।।
কোন্ রাজা আইসে সমর করিবারে।
আপনার ঠাট গুহ এক ঠাঁই করে।।
চিনিলেক বিলম্বে সে অযোধ্যার ঠাট।
আপন কটকে গুহ আগুলিল বাট।।
গুহ বলে, দেখি ভরতের সেনাগণ।
শ্রীরামের সহিত করিতে আসে রণ।।
পরাইয়া বাকল সে পাঠাইলে বনে।
রাজ্যখণ্ড নিল, তবু ক্ষমা নাহি মানে।।
সাজ রে চণ্ডাল ঠাট চাপে দিয়া চড়া।
বিষম শরেতে মুই কাটি হাতী ঘোড়া।।
সর্ব্ব সৈন্য কাটিয়া করিব ভূমিগত।
দেশে বাহুড়িয়া যেন না যায় ভরত।।
মার মার বলিয়া দগড়ে দিল কাটি।
হেনকালে গুহ বলে ভরতেরে ভেটি।।
শুন রে চণ্ডালগণ ব্যস্ত হও নাই।
আসিয়াছে ভরত রামের ছোট ভাই।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত মধু কলসী কলসী।
অমৃত সমান ফল আন রাশি রাশি।।
নারিকেল গুবাক কদলী আম্র আর।
দ্রাক্ষাফল পনাস আনহ ভারে ভার।।
ভাল মৎস্য আন সবে রোহিত চিতল।
শিরে বোঝা, কান্ধে ভার, বহ রে সকল।।
যদ্যপি ভরত করে শ্রীরামেরে রাজা।
ভালমতে কর তেবে ভরতের পূজা।।
ভরত আসিয়া থাকে শত্রুভাবে যদি।
ভরতের ঠাট কাটি বহাইব নদী।।
সাত পাঁচ গুহক ভাবিছে মনে মন।
হেনকালে সুমন্ত্র কহেন সুবচন।।
আইলেন শ্রীরামেরে লইতে ভরত।
বল গুহ, শ্রীরাম গেলেন কোন পথ।।
গুহ বলে, হেথা দেখা না পাবে ভরত।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা বহুদূর গত।।
ভরতেরে তবে গুহ নোয়াইল মাথা।
ভেট দিয়া গুহ তাঁরে কহে সব কথা।।
গুহ বলে, ঠাট তব বনের ভিতরে।
আজ্ঞা কর, থাকুক অতিথি ব্যবহারে।।
ভরত বলেন, ঠাট আছে অনশন।
যাবৎ রামের সনে নহে দরশন।।
যে দেখি গঙ্গার ঢেউ, পড়িনু প্রমাদে।
তুমি যদি পার কর যাই নিরাপদে।।
গুহ বলে, আমার কটক পথ জানে।
কটক সহিত আমি যাই তব সনে।।
তোমার বচনে আমি না পাই প্রতীত।
মনে তোলপাড় করি, দেখি বিপরীত।।
কোন্ রূপ ধরি এলে ভাই দরশনে।
সাজন কটক দেখি ভয় হয় মনে।।
ভরত বলেন, মন না জান আমার।
রামের চরণ বিনা গতি নাহি আর।।
রাম বিনা রাজত্ব লইতে অন্যে নারে।
রাজ্যসহ আইলাম রামে লইবারে।।
গুহ বলে, ধন্যবাদ তোমারে আমার।
তব যশ ঘুষিবেক সকল সংসার।।
তোমা হেন ধন্য ভাই রঘুনাথ মিত্র।
রঘুবংশ ধন্য ‍তুমি করিলা পবিত্র।।
ভরত বলেন, শুন চণ্ডালের রাজা।
কত দিন শ্রীরামের করিলে হে পূজা।।
আমি দুষ্ট হইলাম জননীর দোষে।
বল গুহ, শ্রীরাম গেলেন কোন্ দেশে।।
গুহ বলে, এখানে ছিলেন দুই রাতি।
দুই রাতি এক ঠাঁঞি ছিলাম সংহতি।।
লক্ষ্মণ রামেরে ভক্ত সেবে রাত্রদিনে।
ধনুঃশর হাতে করি থাকে সর্ব্বক্ষণে।।
সুমন্ত্রে বিদায় দিয়া চিন্তিলেন মনে।
হেথা ভরতের হাত ছাড়াব কেমনে।।
হেথা হৈতে যাই আমি অন্য কোন স্থলে।
ভরত না দেখা পাবে যেখানে থাকিলে।।
এই পথে তাঁহারা গেলেন মহাবনে।
গঙ্গা পার করিয়া রাখিনু তিন জনে।।
গুহস্থানে পাইয়া সকল সমাচার।
সেই পথে গমন হইল সবাকার।।
তাহা এড়ি ভরত কতক দূরে গেলে।
তৃণশয্যা দেখিলেন এক বৃক্ষতলে।।
তদুপরে শুইতেন রাম বনবাসী।
তৃণ-লগ্ন আছে পট্ট কাপড়ের দশী।।
কাপড়ের দশীতে স্খলিত আভরণ।
ঝিকিমিকি করে যেন সূর্য্যের কিরণ।।
তাহা দেখি ভরত চিন্তেন সকাতরে।
কেমনে শুইলা প্রভু খড়ের উপরে।।
কেমনে লক্ষ্মণ ছিলা কেমনে জানকী।
চিনিলাম আভরণ করে ঝিকিমিকি।।
আছাড় খাইয়া পড়ে ভরত ভূতলে।
সুমন্ত্র ধরিয়া তাঁরে লইলেক কোলে।।
ভরত উভয় শোকে হইল অজ্ঞান।
ভরতের ক্রন্দনেতে বিদরে পাষাণ।।
অনেক প্রবোধবাক্যে উঠেন ভরত।
শ্রীরামের শোকে দুঃখ পান অবিরত।।
ঘোড়া হাতী পদাতিক সাত শত রাণী।
উপবাসে সেইখানে বঞ্চিল রজনী।।
প্রভাতে ভরত যান মহাকোলাহলে।
কটক সমেত রহে জাহ্নবীর কূলে।।
গুহক চণ্ডাল আছে ভরতের সঙ্গে।
নৌকা আনি পার করে গঙ্গার তরঙ্গে।।
বহু কোটি নৌকার গুহক অধিপতি।
আনাইয়া তরণী ছাইল ভাগীরথী।।
তরণী মানুষের গঙ্গা পূর্ণ দুই কূলে।
হইল কটক গঙ্গাপার এক তিলে।।
হইল সমস্ত সৈন্য শীঘ্র নদী পার।
তারপর ঘোড়া হাতী কটক অপার।।
সাজান নৌকায় পার হন যত রাণী।
পরে পার হইলেক সাত অক্ষৌহিণী।।
গুহ বলে, আমার সেখানে নাহি কার্য্য।
বিদায় করহ, আমি যাই নিজ রাজ্য।।
ফিরিয়া যখন দেশে করিবা গমন।
আমারে আপন জ্ঞানে করিবা স্মরণ।।
ভরত বলেন, গুহ শ্রীরামের মিত।
করিতে তোমার পূজা আমার উচিত।।
যাঁরে কোল দিয়াছেন আপনি শ্রীরাম।
তাঁহারে উচিত হয় করিতে প্রণাম।।
আপনি ভরত তাঁরে দেন আলিঙ্গন।
সুগন্ধি চন্দন দেন বহুমূল্য ধন।।
প্রসাদ পাইয়া গুহ গেল নিজ দেশে।
চলিলেন ভরত শ্রীরামের উদ্দেশে।।
মাধব তীর্থের কাছে আছে যেই পথ।
তাহারে দক্ষিণ করি চলেন ভরত।।
হস্তী ঘোড়া প্রভৃতি রাখিয়া সেই স্থানে।
অল্প লোকে গেলেন ভরত তপোবনে।।
ভরদ্বাজ মহামুনি আছেন বসিয়া।
ভরত জানান তাঁর চরণ বন্দিয়া।।
আমি রাজ-তনয় ভরত মম নাম।
লক্ষ্মণ কনিষ্ঠ মম, জ্যেষ্ঠ হন রাম।।
রামের উদ্দেশ্যে আমি আসিয়াছি বন।
কহ মুনি কোথা তাঁর পার দরশন।।
জিজ্ঞাসেন মুনি তাঁরে কেন আগমন।
একেশ্বর আসিয়াছ না বুঝি কারণ।।
কটক সকল তুমি রাখিয়াছ পথে।
কোন্ভাবে আসিয়াছ না পারি বুঝিতে।।
ভরত বলেন, আমি কপট না জানি।
ধ্যান করি মুনি সব জানহ আপনি।।
সর্ব্বশুদ্ধ আইলে আশ্রমে হবে ক্লেশ।
তেকারণে সৈন্য মম বাহিরে অশেষ।।
সকল কটক মম সাত অক্ষৌহিনণী।
কোন্ স্থানে রবে ঠাট, ভয় করি মুনি।।
তোমায় পীড়িতে মুনি বড় করি ভয়।
অন্য সব বাহিরে আছয়ে মহাশয়।।
রাজ্যশুদ্ধ আসিয়াছে অযোধ্যানগরী।
রামেরে লইয়া যাব, এই বাঞ্ছা করি।।
অতিশয় শ্রান্ত সৈন্য পথ পরিশ্রমে।
কোন্খানে রবে ঠাট তোমার আশ্রমে।।
ভরতের কথা শুনি আজ্ঞা দেয় মুনি।
আপন ইচ্ছায় আন যত অক্ষৌহিণী।।
দিব্য পুরী দিব আমি, দিব্য দিব বাসা।
অতিথি সবার আমি পূরাইব আশা।।
ভরত বলেন, দেখি খানকত ঘর।
কেমনে রহিবে ঠাট কটক বিস্তর।।
ভরতের কথাতে কহেন হাসি মুনি।
প্রয়োজন মত ঘর পাইবা এখনি।।
কটক আনিতে যান ভরত আপনি।
হেথা চমৎকার করে ভরদ্বাজ মুনি।।
যজ্ঞশারে গিয়া মুনি ধ্যান করি বৈসে।
যখন যাহারে ডাকে, তখনি সে আসে।।
বিশ্বকর্ম্মা প্রথমতঃ হন আগুয়ান।
আশ্রমে অপূর্ব্ব পুরী করিতে নির্ম্মাণ।।
মুনি বলে, বিশ্বকর্ম্মা শুনহ বচন।
নির্ম্মাণ করহ যেন মহেন্দ্র-ভুবন।।
অশীতি যোজন করে পুরীর পত্তন।
সোণার আবাস ঘর করিল গঠন।।
সোণার প্রাচীর আর সোণার আওয়ারী।
সোণার বান্ধিল ঘাট দিঘি সারি সারি।।
পুরীর ভিতর কর দিব্য সরোবর।
শ্বেতপদ্ম নীলপদ্ম শোভে নিরন্তর।।
সুবর্ণ পালঙ্ক কর রত্ন-সিংহাসন।
দেবকন্যা লয়ে ঠাট করিবে শয়ন।।
করিল সোণার বাটা, সোনার ডাবর।
কস্তূরী কুঙ্কুম রাখে গন্ধ মনোহর।।
যত যত নদী আছে পৃথিবী-মণ্ডলে।
যোগবলে মুনি আনাইল সেই স্থলে।।
সাত শত নদী আর নদ যত ছিল।
সেখানে প্রভাস আদি যমুনা আইল।।
আইল নর্ম্মদা নদী, কৃষ্ণা গোদাবরী।
আইল ভৈরবী সিন্ধু গোমতী কাবেরী।।
সরযূ তমসা নদী আর মহানদ।
তর্পণে যাহার জলে পায় মোক্ষপদ।।
কালিন্দী পুষ্কর নদী আইল গণ্ডকী।
শ্বেতগঙ্গা স্বর্গগঙ্গা আইল কৌশিকী।।
ইক্ষুরস নদী আইল সুগন্ধি সুস্বাদ।
মধুরস নদী আইল, ঘুচে অবসাদ।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত আদি রহে চারিভিতে।
ঘৃতনদী বহিয়া আইসে শুধু ঘৃতে।।
সাত শত নদী তথা অতি বেগবতী।
আইলেন আশ্রমে আপনি ভাগীরথী।।
ভরদ্বাজ ঠাকুরের তপস্যা বিশাল।
আইলেন সর্ব্ব দেব দশ-দিকপাল।।
দেবকন্যা লইয়া আইল পুরন্দরে।
যে কন্যার রূপেতে পৃথিবী আলো করে।।
হেমকূট দেখি যেন সূর্য্যের কিরণ।
আছুক অন্যের কাজ, ভুলে মুনিগণ।।
আইলেন কুবের ধনের অধিকারী।
সোণার বাসন থালে আলো করে পুরী।।
সুমেরু পর্ব্বত হৈতে আইল পবন।
মলয়ের বায়ুতে সবার হরে মন।।
আইলেন সুধাকর সুধার নিধন।
পরম কৌতুকে সবে করে সুধাপান।।
আইলেন অগ্নি আর জলের ঈশ্বর।
শনি আদি নবগ্রহ, সঙ্গে দিবাকর।।
মরুদগণ বসুগণ যেবা যথা রয়।
আইল সকল দেব মুনির আলয়।।
তুম্বুরু নারদ আদি স্বর্গের গায়ক।
আইল নর্ত্তকী কত, কত বা নর্ত্তক।।
দেবতুল্য হইল যে ইন্দ্রের নগরী।
ভরদ্বাজ আশ্রম হইল স্বর্গপুরী।।
হেনকালে সৈন্যসহ ভরত আইসে।
এতেক করিল মুনি চক্ষুর নিমিষে।।
নিরখিয়া ভরতের লাগিল বিস্ময়।
তখন মন্ত্রণা করে স্বর্গে দেবচয়।।
ভরতের সঙ্গে যদি রাম যান দেশে।
দেবগণ মুনিগণ মরিবেন ক্লেশে।।
রাম দেশে গেলে নাহি মরিবে রাবণ।
সাধুলোক সকলের নিতান্ত মরণ।।
যেরূপে না যান রাম অযোধ্য-ভুবন।
তেমন করহ যুক্তি, মরুক রাবণ।।
দেবগণ মুনিগণ করেন মন্ত্রণা।
ভুবনমণ্ডল ঘেরে রহে সর্ব্বজনা।।
যার যোগ্য যে আবাস, পায় সেইজন।
যে দিকে যে চাহে, তার তাহ রহে মন।।
মাখিয়া সুগন্ধি তৈল স্নান করিবারে।
কেহ যায় নদীতে কেহ বা সরোবরে।।
কোন পুরুষেতে গঙ্গা যে জন না দেখে।
করে স্নান তর্পণ সে পরম কৌতুকে।।
হস্তী ঘোড়া কটক চলিল সুবিস্তর।
জলকেলি করে সবে গিয়া সরোবর।।
ভরদ্বাজ মুনির কি অপূর্ব্ব প্রভাব।
কত নদী আশ্রমে আপনি আবির্ভাব।।
স্নান করি পরে সবে বিচিত্র বসন।
সর্ব্বাঙ্গে লেপিয়া দিল সুগন্ধ চন্দন।।
বহুবিধ পরিচ্ছদ পরে সৈন্যগণ।
যার যাতে বাসনা, পরিল আভরণ।।
সবার সমান বেশ, সমান ভূষণ।
কেবা প্রভু, কেবা দাস, নাহি নিরূপণ।।
ভোজনে বসিল সৈন্য অতি পরিপাটি।
স্বর্ণপীঠ স্বর্ণথাল স্বর্ণময় বাটী।।
স্বর্ণের ডাবর আর স্বর্ণময় ঝারি।
স্বর্ণময় ঘরেতে বসিল সারি সারি।।
দেবকন্যা অন্ন দেয় সৈন্যগণ খায়।
কে পরিবেশন করে, জানিতে না পায়।।
নির্ম্মল কোমল অন্ন যেন যূথী ফুল।
খাইল ব্যঞ্জন কিন্তু মনে হৈল ভুল।।
ঘৃত দধি দুগ্ধ মধু মধুর পায়স।
নানাবিধ বিষ্টান্ন খাইল নানারস।।
চর্ব্ব চুষ্য লেহ্য পেয় সুগন্ধি সুস্বাদ।
যত পায় তত খায় নাহি অবসাদ।।
কণ্ঠাবধি পূর্ণ হৈল, পেট পাছে ফাটে।
আচমন করি ঠাট কষ্টে উঠে খাটে।।
খাটে গিয়া প্রিয়ালয়ে করিল শয়ন।
দেবীরা আসিয়া করে শরীর মর্দ্দন।।
মন্দ মন্দ গন্ধবহ বহে সুললিত।
কোকিল পঞ্চম স্বরে গায় কুহুগীত।।
মধকর মধুকরী ঝঙ্কারে কাননে।
অপ্সরীরা নৃত্য করে মাতিয়া মদনে।।
অনন্ত সামন্ত সৈন্য লইয়া রমণী।
পরম আনন্দে বঞ্চে বসন্ত রজনী।।
সবে বলে দেশে যাই হেন সাধ নাই।
অনায়াসে স্বর্গ মোরা, পাইনু হেথাই।।
এত সুখ এ সংসারে কেহ নাহি করে।
যে যায় সে যাউক আমি না যাইব ঘরে।।
এত সুখ ঠাট করে ভরত না জানে।
রামের চরণ বিনা অন্য নাহি জ্ঞানে।।
এতেক করেন মুনি ভরত-কারণ।
ভরত ভাবেন মাত্র রামের চরণ।।
প্রভাতে ভরত গিয়া মুনিরে জিজ্ঞাসে।
ছিলাম পরম সুখে তোমার নিবাসে।।
কহ মুনি, কোথা গেলে পাইব শ্রীরাম।
উপদেশ কহিয়া পূরাও মনস্কাম।।
মুনি বলে জানিলাম ভরত তোমারে।
তব তুল্য ভক্ত আমি না দেখি সংসারে।।
বর মাগ ভরত, আমি হে ভরদ্বাজ।
যারে যেই বর দেই, সিদ্ধ হয় কাজ।।
ভরত বলেন, মুনি অন্যে নাহি মন।
বর দেহ শ্রীরামের পাই দরশন।।
মুনি বলেন, শ্রীরামের জানি সবিশেষ।
দেখা পাবে, কিন্তু রাম না যাবেন দেশ।।
চিত্রকূট পর্ব্বতে আছেন রঘুবীর।
তথা গেলে দেখা হবে, এই জেন স্থির।।
অন্য অন্য মুনিগণ দিল তাহে সায়।
ভরতের সৈন্যগণ চিত্রকূটে যায়।।
দশদিক হইল ধূলায় অন্ধকার।
হইল ভরত-সৈন্য যমুনার পার।।
রামের সন্ধান পেয়ে প্রফুল্ল কটক।
বায়ুবেগে চলে সবে না মানে আটক।।
যত হয় চিত্রকূট পর্ব্বত নিকট।
তত তথাকার লোক ভাবয়ে বিকট।।
চিত্রকূট-পর্ব্বত-নিবাসী মুনিগণ।
শ্রীরামের সহবাসে সদা হৃষ্ট মন।।
সৈন্য-কোলাহল শুনি সভয় অন্তরে।
রক্ষা কর রামচন্দ্র বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
হেনকালে ভরত শত্রুঘ্ন উপনীত।
সবার তপস্বীবেশ অযোধ্যা সহিত।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আর জনকের বালা।
বসতি করেন নির্ম্মাইয়া পর্ণশালা।।
তার দ্বারে বসিয়া আছেন রঘুবীর।
জানকী তাহার মধ্যে লক্ষ্মণ বাহির।।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
Tags:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress