অমৃতা (Amtrita) – ৮
—‘আমি যাব না, যাব না, যাব না’—এই প্রতিজ্ঞা শম্পার। নিবেদিতা মাঝে মাঝে তাঁর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তার দিকে চেয়ে দেখছেন। মেয়েটার মুখ চোখ কঠিন। তিনি কিছু বলতে গেলে ধমকে ধমকে কথা বলছে।
—দুধটা খেয়ে নে শম্পি।
—তুমি খাও।
—আমি তো এক্ষুনি অফিস যাব, ভাত খাব…
—আমিও তো
—তুই তো বললি অফিস যাবি না, ছুটি নিচ্ছিস।
—অফিস যাচ্ছি না মানেই বেরোব না, তা তো বলিনি।
—বেরোবি? কোথায়?
—তোমার না জানলেও চলবে।
অনেকক্ষণ সহ্য করেছেন নিবেদিতা। আর পারলেন না। বললেন—তা তো বটেই পাঁচ বছর বয়স থেকে এই বাইশ বছর পর্যন্ত বড় করে তুললুম স্রেফ একা হাতে, নিজের অসুখ-বিসুখ গ্রাহ্য করিনি। একদিকে অফিস চলেছে আর একদিক মেয়ের জামা সেলাই, পড়া দেখিয়ে দেওয়া…
—প্লিজ মা, প্লিজ—শম্পা কেঁদে ফেলল— তুমি অমন করে বলো না। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে আছে। মন খারাপটাই রাগ হয়ে বেরোচ্ছে।
—মন খারাপ তো হবেই। হওয়ারই কথা। নিবেদিতা বললেন, মন কি আমারই কম খারাপ? কোথায় গেল মেয়েটা?
—মাসি মেসোর কী রকম গা-ছাড়া ভাব দেখলে মা!
—ঠিক বলেছিস! ঠিক বলেছিস। অদ্ভূত একটা চুপচাপ ভাব। যেন নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন দুজনেই। নিবেদিতা বললেন, ভগবান না করুন, আমার যদি অমনি হয় তো আমি তো দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলব।
—আসলে মাসি-মেসোর সারা জীবনের দুঃখকষ্ট বোধ হয় এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে মা। আমি যদ্দূর জানি মাসিদের বিয়েটা ওঁদের কারও বাড়িতেই মেনে নেয়নি বলে চিরদিন ওঁরা একা। একা একাই সব সামাল দিতে হয়েছে। অমৃতার ঠাকুমা বোধহয় নাতনি হওয়ার পর ওদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। অমৃতার মামার বাড়িতে কে আছে না আছে, আমি জানিই না। বুঝতে পারি, এঁদের ভীষণ সাফারিং। অত তো স্ট্রাগ্ল করে দিন কাটাচ্ছিলেন, তার ওপর হল মাসির ওই রকম দুরারোগ্য অসুখ।
নিবেদিতা রান্নার শেষে এখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছেন। তাঁর হাতে একটা ঝাড়ন আস্তে আস্তে তেলচিটে হয়ে উঠছে। শম্পা হঠাৎ দেখল তার মা যেন বড্ড রোগা হয়ে গেছে, যেন বুড়োটে, অথচ মায়ের মাথায় পাকা চুল দেখাই যায় না। কতই বা বয়স হবে মায়ের। চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ! সে অমৃতার মা বাবার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলছিল, একাকিত্বের কথা বলছিল বটে, কিন্তু তার মায়ের দুঃখ-দুর্দশাও তো কিছু মাত্র কম নয়। তার পাঁচ বছর বয়সে হঠাৎ এনকেফেলাইটিস হয়ে তার বাবা চোদ্দো-পনেরো দিন ভুগে মারা গেলেন। তার মামারা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। বড় জন দিল্লিতে থাকেন। কিন্তু ছোট মামা তো থাকেন এখানেই কোম্পানির ফ্ল্যাটে দেওদার স্ট্রিটে। বাবার কাজকর্ম চুকে গেলে একমাত্র ছোট বোনকে না কি বলেছিলেন—আমার উচিত ছিল তোকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কম্প্যানির দেওয়া ফ্ল্যাট, আত্মীয়স্বজন অ্যালাও করে না বুঝলি তো!
নিবেদিতা না কি বলেছিলেন— না দাদা, এ বাড়ি আমার শ্বশুরবাড়ি। ওঁর বাড়ি। এখান ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। তা ছাড়া স্কুল এখান থেকে খুব কাছে।
নিবেদিতা তখনও তাঁর স্বামীর অফিস থেকে প্রাপ্য টাকা-পয়সার কিছুই পাননি। ছোট মামা টাকা-পয়সার দরকার আছে কি না আছে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না। আর এদিকে তার জ্যাঠামশাই? তিনি অবশ্য উদার স্বরে বললেন, বউমা ভেবো না, আমাদের যখন জুটছে, তোমাদেরও জুটে যাবে, আলাদা সংসার আর রাখার দরকার কী? তবে আস্তে আস্তে নিবেদিতা তাঁর ভাসুরের রান্নাঘরে ঢুকে যেতে লাগলেন। এই সময়ে যেমন স্বামীর টাকা-পয়সাগুলো পেলেন, তেমন একটা চাকরি দেবার অফারও পাঠাল ওরা। নিবেদিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর ভাসুর ও জা অনেক বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। শরীর থাকবে না বউমা, কেন তুমি চাকরি করতে যাবে? কিন্তু নিবেদিতা তত দিনে বুঝে গেছেন এ সব কুম্ভীরাশ্রুর মানে। কোনও মতে যদি মাঝের দেওয়ালটা ভেঙে দেওয়া যায়। গোটা বাড়িটাই ওঁদের হয়ে যাবে, উপরন্তু জুটবে একটি বিনা মাইনের রাঁধুনি, একটি ফাই ফরমাশ খাটার মেয়ে।
আশ্চর্য হয়ে শম্পা ভাবে—কেন সব মৃত্যুর গল্প, সব বিধবার গল্পই এ রকম এক রকম! কেন অন্য কিছু হয় না। স্বামী মারা গেলেই বিধবার ভাসুর দেবর জা-রা স্বার্থপর ধান্দাবাজ হয়ে ওঠে কেন? স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব তো বলে— আহা, এই বয়সে স্বামী মারা গেল, ওই টুকুনি মেয়ে নিয়ে বেচারি এখন কী করবে? খাওয়া-পরার বা শিক্ষা-দীক্ষার ভাবনা নেই, সে তো আমরাই আছি, ওর নিজেরও কিছু টাকা-পয়সা আছে, কিন্তু—শোক? এই শোক এই একাকিত্ব? এগুলো কাটিয়ে ওঠার কী মন্ত্র ওদের আমরা দিতে পারি?
শম্পাকে মা কোনওদিন সেভাবে সংসারের কাজ করতে দেননি। অসম্ভব কর্মঠ মানুষ নিবেদিতা। এখনও শম্পার ও নিজের ব্লাউজ পেটিকোট সেলাই করেন। সালোয়ার-কামিজ তো করেন হেলায়। আর এই সব করেন দশটা পাঁচটার চাকরি করে। রান্না করে। ঘর পরিষ্কার করা ও বাসন মাজার একটা ঠিকে লোক আছে তাদের। বাস। শম্পা মাঝে মাঝে শখের রান্না করে, ঘরদোরও অবশ্য গোছায়, বিছানা ঝাড়ে, কিন্তু কোনওটাই দায়িত্ব নিয়ে নয়। সে যদি একদিন তাড়াহুড়োয় বিছানা ঝাড়তে ভুলে যায়, মা কিছুই বলবে না। নিজে ঝেড়ে দেবে।
সে হঠাৎ মার হাত থেকে ঝাড়নটা কেড়ে নিয়ে বলল—কী এত পরিষ্কার করছ মা! দাও বাকিটা আমি করে দিচ্ছি।
নিবেদিতার একটু হাঁপানি আছে। তিনি বললেন—তুই পারবি? আমি তাহলে খোলা হাওয়ায় গিয়ে একটু নিশ্বাস নিয়ে বাঁচি। শোন গ্যাসটা ভাল করে মুছবি। ওভন দুটোয় আর এই তলার লোহার পাইপটায় একটু কেরোসিন ঘষে দিবি। তলায় সবুজ বোতলটায় কেরোসিন আছে। ওভন মোছার আর ধাপিটা মোছার ঝাড়ন আলাদা। একটু সাবান নিয়ে নিস। নইলে উঠবে না। সবশেষে একটু ফিনাইল দিবি। পারবি তো এত সব?
—এত করার দরকার কী মা?
—এত? ওভনগুলোয় মরচে ধরে জং ধরে গেলে পাল্টাতে হবে। ধাপিটা যদি ছেড়ে দিস এমন তেলচিটে হয়ে যাবে যে সে আর কহতব্য নয়। ফিনাইল দিলে পোকা-মাকড় আরশুলার হাত থেকে কিছুটা রেহাই। থাক তুই পারবি না। আমায় দে।
—না, না, পারব। জাস্ট জিজ্ঞেস করেছিলাম।
মা রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেলে, ঝাড়ন দিয়ে শম্পা তার নিজের যাবতীয় দুঃখ, সন্দেহ, অপমান সব প্রবল বেগে ঝাড়তে থাকল। দুঃখ মুছতে মুছতে কেমন একটা চকচকে আকার ধারণ করে, আর দুঃখ থাকে না শুধু, যেন ট্রাজেডি হয়ে যায়— ট্রাজেডি অফ শম্পা সেন, হু ট্রাস্টেড। না শুধু শম্পা কেন, ট্রাজেডি অফ নিবেদিতা সেন হু লস্ট হার হাজব্যান্ড অ্যাট দা এজ অফ থার্টি ওয়ান। মুছতে মুছতে তার সন্দেহ এক অমোঘ সত্য রূপে, বিশ্বাসঘাতকতা রূপে দেখা দেয়, তার অপমান হয়ে যায় আত্মসম্মান। শুধু আত্মসম্মান বললে যেন সবটা বলা হয় না, হয়ে ওঠে আত্মমর্যাদা। এতক্ষণ যে তার প্রবল মন খারাপ করছিল তার মধ্যে তো শুধু অমৃতাই ছিল না, সে নিজেও ছিল।
মা বেরিয়ে যাবার পরে, শম্পা আর একবার গা ধুয়ে নিয়ে ভাল করে সাজল। গরম পড়ে গেছে। একটা হালকা, নতুন ছাপা শাড়ি বাছল সে। ঠোঁটে একটু মেরুন ধাঁচের লিপস্টিক, চোখে হালকা করে আই-ব্রো পেনসিল। বেণীটা ঝুলতে থাকল, কপালে একটা মেরুন রঙের ছোট্ট টিপ পরে সে ছাতা আর মেরুন ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রয়েজ কমপিউটার ফার্মে কাজ করতে করতেই আরও বেশ কয়েকটার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে। মনে হয় কোনও একটাতে হয়েই যাবে।
প্রথম সে ঢুকল ‘উইল পাওয়ার’-এ—মিঃ মিশ্র আছেন? একটু দেখা করব।
—আপনার নাম?
—শম্পা সেন, ফ্রম ‘রয়েজ’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাক পড়ল।
—আরে মিস সেন—কী ব্যাপার? ‘রয়েজ’-এর জন্য কী করতে পারি, বলো।
—‘রয়েজ’ নয়, আমার জন্য করতে হবে।
—তোমার জন্য? তুমি ওখানে নেই?
—আছি এখনও। কিন্তু থাকবার ইচ্ছে নেই৷ প্লিজ কীপ ইট সিক্রেট।
—তা না হয় রাখলাম। কিন্তু তুমি ঠিক কী চাইছ?
—বেটার ওয়ার্কিং অ্যাটমসফিয়ার, অ্যান্ড ন্যাচার্যালি বেটার পে৷ অ্যানালিস্ট হিসেবে আমার তিন বছরের এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেল। আমি কি একটা প্রমোশন আশা করতে পারি না?
—ওয়েল, অফ কোর্স, কিন্তু তুমি আবার যদি হুট করে ‘উইল পাওয়ার’ও ছেড়ে দাও?
—তেমন কোনও কারণ ঘটলে তো ছেড়ে দেবই। আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই তেমন কিছু ঘটাবেন না।
—তোমার ফ্র্যাংকনেস আমাকে মুগ্ধ করেছে মিস সেন। আমাকে দু’দিন সময় দেবে? আমি আমাদের পোজিশনটা একটু রিভিউ করে নিতে চাই।
—সময় দিতে পারব না মিঃ মিশ্র। আপনার যা রিভিউ করার এক্ষুনি করে নিন। ফ্র্যাংকলি স্পিকিং আমি এক্ষুনি আরও কয়েকটা অর্গ্যানাইজেশনে যাব। একটা না একটায় পেয়ে যাব ঠিক।
—আচ্ছা! এত তাড়া?
—এতই তাড়া।
—ঠিক আছে। তোমাকে রেখে নিচ্ছি। কিন্তু প্রজেক্ট নিয়ে বাইরে যেতে হতে পারে।
—মোস্ট ওয়েলকাম। শুধু থাকার বন্দোবস্তের সময়ে যদি মনে রাখেন আমি মেয়ে তাহলেই আর কোনও অসুবিধে থাকবে না।
তিন দিন পরে ‘রয়েজ’-এ পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়ে ‘উইলপাওয়ার’-এ যোগ দিল শম্পা। এ তিনদিন অফিস গেল না। অন্য কোথাও বেরোল না। খালি অমৃতার কথা ভাবল। অমৃতাই তাকে বলেছিল—প্রস্তাবটা তোর পক্ষে অসম্মানজনক এটা বুঝতে তোর আমার কাছে আসতে হবে শম্পা?
অমৃতা এমনিতেই যাকে বলে প্রাজ্ঞ। তার ওপরে বিবাহিত। বিয়ে মানুষকে অন্য অভিজ্ঞতা দেয়। অনেক পরিণত করে দেয় তাকে। কিন্তু সেই অমৃতা যে না-কি তাকে একটা মহাসর্বনাশ থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল, সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, কেন? কেন? কী এমন সে পরিস্থিতি যা অমৃতার বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার বাইরে, যা তাকে এমনভাবে পরাজিত করতে পারে? কী সেটা? কী? কী? কী?
মাকে সে জানাল না পর্যন্ত যে সে চাকরি বদল করেছে। মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি এখনই সে হতে চাইছে না। কেন না মায়েরও তার কাছ থেকে কিছু তিরস্কার প্রাপ্য রয়েছে। সৌমিত্রর প্রস্তাবটায় মা না করেনি। অবশ্য, বেড়াতে যাওয়ার কথা সে মাকে বলেনি, কাজের কথা বলেছিল, কিন্তু একমাত্র সৌমিত্রর সঙ্গেই সে যাচ্ছে সে কথা তো গোপন করেনি! মা কী করে তাকে ছাড়তে চাইল! মা নিজে তো বিবাহিত। মা জানে না দিঘায় নির্জন মুহূর্ত আসতে পারে? মা জানে না সৌমিত্র আগেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে? মা জানে না এরকম পরিস্থিতিতে একজন মেয়ের কাছে একজন পুরুষ কী হয়ে উঠতে পারে?
আসলে লোভ! অস্বীকার করে লাভ নেই তার মা যে কোনও মূল্যে এই বিয়েটা চেয়েছিল। মায়ের মতো রক্ষণশীল আবহাওয়ায় বড় হওয়া, বাস করা একজন মহিলা। মেয়ের বিয়ে হবে, এই লোভে তিনি মেয়েকে বাঘের মুখে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করলেন না। কী করে সে আর মায়ের ওপর আস্থা রাখবে? অমৃতা, অমৃতাই তাকে বাঁচার মন্ত্র দিয়ে গেছে। নিজে মরে। না, না, অমৃতা, তুই কখনও মরতে পারিস না, অমৃতা তুই অমৃতা। তুই কখনও অতি নশ্বর মানুষদের ভাগ্য স্বীকার করে নিস না। আমি শম্পা, তোর ছোটবেলার বন্ধু, কত ঈর্ষা করেছি তোকে, কত জ্বালিয়েছি অভিমান করে করে, কিন্তু আমি তোকে ভালবাসি, আমি তোকে শ্রদ্ধাও করি, পূর্ণ আস্থা আছে আমার তোর শক্তি, তোর বুদ্ধির ওপরে। অমৃতা তুই কোনও জ্যোতির্বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে একবার দেখিয়ে দে। সংসারে ভালমানুষদের, ভাল মেয়েদের ক্ষতি হয় না, কেউ করতে পারে না।
গরম চোখের জল টপ টপ করে পড়ে শম্পার চিবুক, গলা, ওপর বুক সব ভিজিয়ে দিতে লাগল। কী এখন করবে সে? অমৃতার জন্য কিছুই করতে পারবে না? কিছু না?
হঠাৎ একটা সংকল্প জাগল তার। সে টেলিফোন ডাইরেক্টরির পাতা খুলে কয়েকটা ফোন নম্বর টুকল।
—হ্যাললো, যাদবপুর থানা? ও. সি.র সঙ্গে একটু কথা বলব।
—বলছি।
—আপনাদের অঞ্চলে ৪/১এ সেন্ট্রাল পার্কে অমৃতা গোস্বামী…।
—আপনি কে বলছেন?
—ওর বন্ধু!
—নাম?
—নামে দরকার নেই। আমার বন্ধুকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এবং ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমের ডাক্তার মিলে কিছু করেছে।
—কিছু করেছে মানে কী?
—মানে খুন করেছে কি না জানি না। আপনাদের জানবার কথা, আপনারা ইনভেস্টিগেট করুন।
সে ফোন নামিয়ে রাখল। তারপর করল বালিগঞ্জ থানায়। ওঁরা বললেন ওটা কড়েয়ার কেস।
—হ্যাললো কড়েয়া থানা।
—ইয়েস
—ও.সি-র সঙ্গে একটু কথা বলব…।
—ধরুন…।
—একটু পরে ভীষণ গম্ভীর বাজের মতো গলায় প্রশ্ন এল— কে বলছেন? আমি কড়েয়া থানার ও.সি.।
—আপনাদের এলাকায় ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে।
—দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কে?
—আমি অমৃতার বন্ধু। সে নিখোঁজ হয়েছে। এখনও খোঁজ দিতে পারছেন না কেন? ‘উজ্জীবন’-এর পেছনের পুকুরটা দেখেছেন?
—মেয়েটি পুকুরে আত্মহত্যা করেছে এ ধারণা আপনার হল কেন?
—আত্মহত্যা নয়। কখনও নয়, হয় হত্যা করে ওকে ওখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আর নয় তো অ্যাকসিডেন্ট। রাতে হয়ত ওর ফোন এসেছিল ভাল বুঝতে পারেনি—নেমে আধা-আচ্ছন্ন অবস্থায় পুকুরে।
—ফর ইয়োর ইনফর্মেশন পুকুরটা চারপাশ থেকে জাল দিয়ে ঘেরা। আপনার নাম?
—শম্পা সেন।
—আবাস?
—কুড়ির-এ ডাফ স্ট্রিট—বলবে না বলবে না করেও শম্পা কী রকম বোকা আনাড়ির মতো বলে ফেলল।
—আপনার সন্দেহের কোনও কারণ? কাকে সন্দেহ করছেন? বাড়িকে? না ডাক্তারকে?
—জানি না। শুধু এইটুকু জানি পুরুষরা ভয়ানক। স্বামীই হোক, জ্যাঠামশাই-ই হোক।
—আর ও.সি-ই হোক। বাজের মতো গলাটা ওপার থেকে গমগম করে উঠল।
হঠাৎ ওরই মধ্যে শম্পার মনটা কেমন ভাল হয়ে গেল। এই কড়েয়া থানার ও.সি. ভদ্রলোক, বাজের মতো গলা, কিন্তু তার সঙ্গে একটু অপ্রত্যাশিত রসিকতা করলেন। এমন একটা সময়ে যখন একটি নিরুদ্দিষ্ট পেশেন্টের কেস ঝুলছে। তাহলে কি উনি অমৃতা সম্পর্কে আশাজনক কোনও খবর শুনেছেন? অবশ্য, সে ভাবে দেখতে গেলে খুন, জখম, রাহাজানি, দুর্ঘটনা, নিরুদ্দেশ সবই এঁদের কাছে জলভাত। এই সব ঘটনা, এই সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য, সংশ্লিষ্ট আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি বিলাপ সবই এঁদের প্রতি মুহূর্তে দেখতে শুনতে হয়। তবু, তবু, কেমন একজন নির্ভরযোগ্য; মানুষ-মানুষ মানুষ বলে মনে হল বজ্র-কণ্ঠকে। এবং পরের ফোনটা যখন এল সে সেটা এই মেজাজেই ধরল।
—আমি সৌমিত্র বলছি। ফোনটা রেখে দিল সে। আবার বাজল। তক্ষুনি।
—আমি সৌমিত্র বলছি। কী করেছি আমি?
কোনও কথা বলতে পারল না সে।
—‘রয়েজ’ ছেড়ে দিলে!
সে নীরব।
—‘উইলপাওয়ার’ জয়েন করছ?
সে নীরব।
—তুমি কী করে জানলে ‘উইলপাওয়ার’-এ সৌমিত্র দাসের মতো খারাপ কোনও লোক নেই।
আস্তে খুব আস্তে সে বলল—জানি না।
—তবে?
—ধরেই নিয়েছি।
—কী ধরে নিয়েছ! ওখানেও সৌমিত্র দাস আছে?
—হ্যাঁ।
—তবে?
—ট্যাক্ল করতে পারব এবার।
—কী ভাবে?
—সর্বতোভাবে অ্যাভয়েড করে।
—ভাল।
ও পাশে ফোন রেখে দেবার শব্দ হল।
যে মন কড়েয়া থানার ও.সি. ভাল করে দিয়েছিলেন, সে মন সৌমিত্র দাস আবার খারাপ করে দিয়ে গেল।
—তুমি শম্পা না? অমৃতার বন্ধু?
—তুমি দোলা, য়ুনিভার্সিটিতে…।
অপ্রত্যাশিতভাবে ওদের দেখা হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে। শম্পা একা। দোলার সঙ্গে অবশ্য একটি অতি রূপবান যুবক। দোলা বলল— শুধু য়ুনিভার্সিটি কেন? আমি তো কলেজ থেকেই ওর সঙ্গে আছি। তোমার সঙ্গেও। তুমি সায়েন্সে ছিলে বলে বেশি দেখা হত না। অনেকদিন পর তোমায় দেখছি।
—আমি তো চাকরি করি।
—কোথায়?
—আগে ‘রয়েজ কমপিউটার’-এ ছিলাম রফি আমেদ কিদোয়াই স্ট্রিটে। এখন এই রাসেল স্ট্রিটে ‘উইলপাওয়ার’-এ এসেছি। তুমি?
তখন সবে গোধূলি ফুরোচ্ছে। শম্পা বাড়ি ফিরছে। সব দিন সে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না অবশ্য। আজ দোলা, দোলাদের সঙ্গে দেখা হবে বলেই বোধ হয়…
শাঁ শাঁ করে গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। আলো জ্বলে উঠছে রাস্তার। দোলা বলল—আইসক্রিম পার্লারে যাচ্ছিলাম। এ আমার বন্ধু অমিত।
—রে নয় তো? শম্পা হেসে জিজ্ঞেস করল।
—রে হতে হলে আবার অমিট্-ও হতে হয়। অমিত ছেলেটি বলল। রে আপাতত একজনই এ দেশে—সত্যজিৎ রে। স্ট্রেইট ফ্রম দা সান।
—আপনি অভিনয় করেন? —শম্পার আসলে মনে হল ছেলেটির এমন ফিগার, এমন চেহারা, মুখ চোখ, তার ওপর সত্যজিৎ রে-র কথা বলছে, ও হয়তো!…।
হেসে উঠল ছেলেটি, বলল— প্রতিদিনকার লাইফে যেটুকু অভিনয় বাধ্যতামূলকভাবে করতেই হয় তার বাইরে আর কোনও অভিনয় আমি করি না।
সন্ধেটা ঝপ করে নেমে গেল। দোলা বলল চলো না শম্পা, তুমি তো বাড়িই ফিরছ, আমাদের সঙ্গে চলো না প্লিজ।
—টু ইজ কম্প্যানি, থ্রি ইজ ক্রাউড— শম্পা ভেতরে ভেতরে একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলল।
অমিত বলল— টু ইজ কনভার্সেশন। থ্রি ইজ ডিসকাশন। প্লেজেন্ট, থ্রিলিং। চলুন। একটু মুখ ঠাণ্ডা করে আসা যাক। যা গরম!
শম্পা আর একটু গাইগুঁই করেছিল, কিন্তু দোলা কিছুতেই ছাড়বে না।
প্রথম সন্ধের এই পার্ক স্ট্রিট শম্পার ভীষণ পরিচিত, ভীষণ প্রিয়। তারা এদিকটায় এলে রাসেল স্ট্রিটেই নিজের গাড়ি পার্ক করত সৌমিত্র। বার্গেন কাউন্টার থেকে রিডাকশন সেল-এ তোয়ালে, বেড শীট কিনত শম্পা। ওই দিকে ব্লু ফক্স, আরও এগিয়ে ওয়ালডর্ফ। এগুলো তাদের নিজস্ব জায়গা। যেন মার্কা মারা আছে।
দোলার কোনও বয়ফ্রেন্ড আছে জানত না সে। থাকতেই পারে। কতদিন পরে দেখা হল তাদের। দোলা আগে খুব দোহারা গোলগাল মাখন মাখন ধরনের মেয়ে ছিল, দেখলেই বোঝা যেত, বড়লোকের আদুরি। গালগুলো শীতকালে লাল হয়ে যেত একটু ফেটে। কাঁধ পর্যন্ত সোজা চুল। দোলার বন্ধুদের একটা খেলাই ছিল দোলার ভুঁড়িতে কাতুকুতু দেওয়া।
এখন কি দোলা একটু লম্বা হয়েছে? আঠারো উনিশের পর মেয়েরা আর লম্বা হয়? সেই গোলগাল ভাবটা ওর আছেই এখনও। কিন্তু এখন আর কেউ ওর ভুঁড়িতে কাতুকুতু দেবে না। মোছা মোছা ভুরু, ছোট চোখ, ঠোঁট দুটো মিলিয়ে একটা গোল মতো কমলার কোয়ার মতো। তাইতেই লাবণ্য ফেটে পড়ছে ওর। লাইল্যাক রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে, অদ্ভূত অ্যাট্রাকটিভ দেখাচ্ছে। শম্পা যেতে যেতে একবার পাশের দোকানের কাছে নিজের ছায়াটা দেখে নিল। লম্বা, কালো, পোড়খাওয়া, সাজগোজ করা একটা মেয়ে। দোলা যেন একটা আকাশের মতো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তার কোনও রঙ লাগে না। আর শম্পা একটা বাজ পড়া গাছ। গাছটাতে আদিবাসীরা গোবর মাটি আর সিঁদুর লেপে গেছে। আর দোলার সঙ্গের ছেলেটি? যেমনি লম্বা তেমনি অদ্ভূত সুন্দর একটা শ্যামের ওপর লালচে রঙ ধরা ত্বকের জৌলুষ। মুখ চোখ কেমন, তাকিয়ে তাকিয়ে তো আর দেখা যায় না। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ শম্পা বলল— মা ভাববে দোলা, আমি বরং চলেই যাই।
দোলা হঠাৎ ওর হাতটা ধরে ফেলল, কানের কাছে মুখ এনে বলল—প্লিজ ডোন্ট টেল এনিবডি।
অমিত বলল— কী হল? —সে একটু এগিয়ে গিয়েছিল।
দোলা বলল— দ্যাখো না শম্পা আসতে চাইছে না।
—তার মানে একজন অ্যাট্রাকটিভ লেডির সঙ্গ থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি?
শম্পা বলল—মনে পড়ে গেল বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার আছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
—আপনাকে দেখে কিন্তু এত গরমেও ঠিক বাড়ি ফিরতি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এইমাত্র বিউটি পার্লার থেকে বেরোলেন কোনও বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে…।
শম্পা লজ্জা সামলে বলল—কম্পুটার-এর কাজ তো। সারাক্ষণ এ.সি-র মধ্যে থাকি। আচ্ছা আসছি। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।
ফিরতে ফিরতে শম্পা ভাবল— কোন বুদ্ধিতে সে ওদের সঙ্গে যাবার উদ্যোগ করছিল? কে না জানে প্রেমিক-প্রেমিকারা একা থাকতে চায়?
মুখের কথা কখনও মনের কথা হয় না কি? দোলা মুখে বলছে এসো এসো, মনে মনে বলছে যাও যাও। তারও এমন দিন ছিল। সে আর সৌমিত্র অবশ্য ঠিক রোম্যান্টিক প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল না। সৌমিত্র একটু প্র্যাকটিক্যাল গাদ্যিক ধরনের মানুষ। শম্পার ভেতরে রোমান্টিকতা কি আর ছিল না? কিন্তু সেই রোম্যান্টিকতার চাহিদা মেটেনি বলে তার কোনও নালিশ ছিল না। শক্তিশালী, প্র্যাকটিক্যাল পুরুষ। তারা হয় নির্ভরযোগ্য, দায়িত্বশীল, মিষ্টি মিষ্টি কথার ঝুড়ি নয়, হিম্যান। হঠাৎ সে চমকে উঠল—কী ভাবছে সে? সৌমিত্র দাস নির্ভরযোগ্য? দায়িত্বশীল? এই তার ধারণা তার চেহারা, কথা-বার্তা থেকে? না শুধু তাই নয়, অফিসের মধ্যে তার কাজ কর্ম থেকেও। কে জানত সেই দায়িত্বশীল মানুষটার মুখ থেকে এমন একটা উড়নচণ্ডে অশালীন প্রস্তাব আসবে?
এখন সমস্ত বাসে ট্রামে প্রচণ্ড ভিড়। শম্পা হাঁটতে লাগল। হাঁটতে লাগল। ট্রাম গুমটিতে গিয়ে দাঁড়াবে, লাইন দেবে। তারপর নিজের পালা এলে চড়তে পাবে ট্রামে, যদি না কেউ কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে এগিয়ে যায়। তার চেয়ে পাতাল রেলে যাওয়া ভাল। শোভাবাজার স্টপে নামতে হবে সম্ভবত। বেশ খানিকটা ফিরতে হবে তারপর। কিন্তু যাওয়াটা হবে খুব তাড়াতাড়ি। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট বড় জোর।
পাতালে নেমে ট্রেনে বসতে পেয়ে গেল শম্পা। হঠাৎ তার মনে হল—ভালবাসা জিনিসটা ঠিক কী? এই যে বাবা মা স্থির করে দিচ্ছেন ছেলে মেয়েরা বিয়ে করছে যেমন অমৃতা করেছিল—তার মধ্যে দেখাই তো যাচ্ছে ভালবাসা ছিল না, একটা পরের বাড়ির মেয়ে তার বাবা-মা নিজের কত অভ্যাস, কত ভালবাসার জিনিস ছেড়ে অন্যের বাড়ি আসছে, তাকে তো সাদর অভ্যর্থনা করতে হবে, ভালবাসা, স্নেহ, আশ্রয় দিয়ে নিশ্চিন্ত করতে হবে, অথচ প্রথমেই লোকে চোখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করবে—বউ কেমন হল? মানিয়ে নিচ্ছে তো? আরে বাবা তোমাদেরই তো তার সঙ্গে মানাতে হবে! তার যা কিছু অভ্যাস সে একদিনে পাল্টে ফেলতে পারবে কেন? আর পাল্টাবেই বা কেন? তার জ্যাঠতুতো দাদার বউ এল, জেঠিমা দু-দিন পরই মুখ বেঁকিয়ে বললেন—সকালে বাসিমুখে চা না খেলে তার মাথা ধরে, কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না। আচ্ছা, সে বেচারি কী করবে? এই অভ্যেসটা সে গত দশ কি পনেরো কি তারও বেশি বছর হয়তো করেছে। তামাক তো আর খায় না! বেড-টি অনেকেই খায়। এখন শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বলে তাকে যদি এক্ষুনি অভ্যেসটা পাল্টাতে বলা হয় সে কি পারবে? এটা অন্যায় নয়? এরা একবাড়ি লোক, নিজেদের পরিবেশ নিজেদের লোকজন নিজেদের অভ্যেসের মধ্যে বাস করবে, আর সে সব ছেড়ে এসে বেমালুম এদের মতো হয়ে যাবে? সাধে কি আর তখনকার মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যেতে মড়াকান্না কাঁদত? এখনও কাঁদে। যাদের একটু বয়স বেশি, পঁচিশ-ছাব্বিশ তারা তবু একটা লড়াই দিতে পারে, তার চেয়ে ছোটরা স্রেফ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। অসুখী হয়, অশান্তিতে জ্বলে। অমৃতাটার কী হয়েছিল কে জানে? বড্ড চাপা মেয়ে, তেমন কিছু বলত না। কিন্তু আজকে এই দোলার মুখে যে আভা সে দেখেছে, অমৃতার মুখে কোনওদিন তা দেখেনি। অর্থাৎ বিনা ভালবাসায় এক ছাদের নীচে সহবাস কতকগুলি সহানুভূতিহীন মানুষের সঙ্গে, একটি পুরুষের সঙ্গে সহবাস বিশেষ অর্থে। সে এমন শিউরে উঠল, যে পাশের যাত্রিনী তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসলেন।
সৌমিত্রর সঙ্গে তার যেটা ঘটেছিল, সেটাও কিন্তু ভালবাসা নয়। একটা ব্যবস্থা। অ্যারেঞ্জমেন্ট। এই যে এতদিন তাদের দেখা হল না তার জন্য সে বা সৌমিত্র কেউই কি বিন্দুমাত্র বিচলিত? বিচলিত সে অপমানে, সৌমিত্রও নিশ্চয় অপমানিত বোধ করেছে, সে দিনের ফোনালাপে। সে তো বুঝিয়েই দিয়েছে সৌমিত্র দাসকে সে কতটা খারাপ ভাবে। তাদের পরস্পরকে না হলেও চলবে। একটা পারস্পরিক বন্দোবস্ত হতে যাচ্ছিল, হল না। ভাগ্যিস, অমৃতা তাকে সাবধান করেছিল! অথচ বাইরে থেকে লোকে তো এটাকে ভাব ভালবাসাই বলবে? বিয়েটা হলে সকলেই বলত, ওরা নিজেরা দেখেশুনে করেছে, প্রেমের বিয়ে। প্রেম জিনিসটা কী তা সে বুঝতেই পারছে না। কারও জন্যে তার কোনও টান নেই। অমৃতার স্বামী-ভাগ্যকে ঈর্ষা করে তার খুব শিক্ষা হয়েছে, তার পর থেকেই সে চারপাশের মানুষগুলোকে আরও ভাল করে বুঝতে শুরু করেছে। যেমন সে বুঝতে পেরেছে দোলা ওই অমিত ছেলেটির দারুণ প্রেমে পড়েছে। অর্থাৎ মোহাচ্ছন্ন হয়েছে। তা নয়তো দোলার মতো ধনী বাবা মায়ের আদরের মেয়ে তাঁদের লুকিয়ে ছেলেটির সঙ্গে বেড়াতে আসতে পারে? চুম্বকের মতো একটা টান আছে ওই ছেলেটির। সামলানো যায় না। সে নিজেও যে সে টান অনুভব করেনি তা নয়। যেই ছেলেটি তার দিকে চাইল, তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। একেই বোধহয় তাহলে সেক্স অ্যাপীল বলে। ছেলেটির চেহারা চিন্তা করলেই রক্তের মধ্যেটা কেমন রিমঝিম রিমঝিম করতে থাকে। রূপান্ধ। রূপের মোহ। সুন্দরী অভিনেত্রীদের যেমন প্রেমে পড়ে ছেলেরা। হ্রস্ব-দীর্ঘ তাল থাকে না। ধনসম্পত্তি তার পায়ে বিলিয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়!
কিন্তু অমিত ছেলেটি কী রকম? তার ধরন ধারণ আগে হলে সে বলত স্মার্ট। এখন মনে হল ওপর চালাক। বেশ চালাক-চালাক কথা বলবে, মেয়েদের কমপ্লিমেন্ট দেবে, ফ্লার্ট করবে। তার মন বলল এ রকম ছেলে নিরাপদ নয়, কিন্তু প্রেম তো! নিরাপদ খুঁজতে গেলে যদি প্রেমের বিরল অনুভূতি ফসকে যায়। তা হলেই বা জীবনে কী লাভ! খালি ভাল খেয়ে পরে, কর্তব্য করে বেঁচে থাকা? যেমন তার মা বেঁচে আছে এখন? অমৃতার বাবা-মা তো ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। দু পক্ষের বাধা অগ্রাহ্য করে। তা হলে তাঁদের রক্তে এই রিমঝিম লেগেছিল? কয়েক বছরের জন্যও তো লেগেছিল! সারা জীবন দুঃখ-ধান্দা করতে করতে সে-প্রেমের কতটুকু টিকে আছে, এখন? বিশেষত মেয়ের এই ট্রাজেডি ঘটার পরে? কে জানে? ওরা হয়তো পরস্পরের প্রতি এতই অনুরক্ত যে মেয়ের বিয়েটা একটু দেখেশুনে দিতেও গাফিলতি করলেন। বোকামি? না অবহেলা?
শম্পার মনে হল সে কেন বিয়ে করতে চেয়েছিল? আশ্রয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য। আর কিছুর জন্য না। ভাল যদি বাসতেই হয় তো সে একমাত্র মাকে ভালবাসবে। সারা পৃথিবীতে আর কাউকে না। কাউকে না। যেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত সেখানে হয়তো বিয়ে করবে, কিন্তু মাকে চাই। মাকে ছেড়ে সে কোনও আশ্রয় আর খুঁজবে না, খুঁজবে না, খুঁজবে না।
ডাফ স্ট্রিটের বাড়িটা তাদের শক্তপোক্ত, পুরোনো। কিন্তু কেমন একটা মহিমা আছে, পুরনো কিন্তু ভাল জিনিসের যেমন মহিমা থাকে। সিঁড়ি তিনটে ভেঙে, বেল-এ হাত রাখল সে। মা এসে খুলে দিল। আর কে-ই বা দেবে? এ সময়ে তো কোনও লোকজন থাকে না।
মা বলল—আয় শম্পি, দেরি করলি যে?
—কেন? আজ অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই তো ফিরেছি মা।
দালান পার হয়ে বাইরের ঘরে ঢুকল সে। ঢুকেই স্থাণু হয়ে গেল। সৌমিত্র বসে আছে।
মা একটি কথাতেও তাকে জানতে দেয়নি। বাইরে ওর জেন ডিলুক্সটাও কই দাঁড়িয়ে নেই।
মা বলল—চা খাবি তো করি?
শম্পা কোনও কথা বলতে পারল না। মা একবার তাদের দিকে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সৌমিত্র উঠে দাঁড়াল। ওর রং কালো। সামান্য একটু ভুঁড়ি হয়েছে। মুখটা খুব পুরুষালি, পরিষ্কার কামানো, কিন্তু ঠোঁট দুটো খুব নরম। খানিকটা মেয়েলি। খুব লম্বাও নয়। শম্পা ওর কাঁধ ছাড়িয়ে যায়।
সে বলল—আস্তে আস্তে, খুব নিচু গলায়—আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও শম্পা, দেবে?
আর এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শম্পার রক্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম। কীসের টানে যে সে সৌমিত্রর দিকে এগিয়ে গেল স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সে জানে না। তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
সৌমিত্র খুব ভয়ে ভয়ে আলতো করে তাকে ধরল, খুব দামি মুক্তো ধরার মতো রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল চোখের জল। খুব আস্তে বলল—এ ক’দিন কী ঝড় যে বয়ে গেছে আমার ওপর দিয়ে তা আমিই জানি। শম্পা, প্লিজ ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মি, এভার। হয়তো নিজেকে ঠিক বোঝাতে পারি না, বাট আই অলওয়েজ মীন ওয়েল।
শম্পার ভেতরে অনেক কথারা ভিড় করে আসছিল। সৌমিত্র, সৌমিত্র, তুমি কেন বিয়ের আগে দিঘা বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিলে? এটা তো আমেরিকা-ইয়োরোপ নয়, এখানকার একজন মেয়ে কী ভাবতে পারে এ কথা শুনলে? আমি ভুল বুঝেছি ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কী বুঝেছিলে? আমাকে কী বুঝে, কী ভেবে তুমি …. তুমিও তো কিছু ইয়াংকি নও। তোমারও তো কিছু কিছু ইনহিবিশন থাকার কথা, সামাজিক, ব্যক্তিক। এ তো শুধু আমার ভুল বোঝা নয় সৌমিত্র, সমস্ত সমাজ, সমাজের সমস্ত মানুষ ভুল বুঝত। একবার যদি ভুল করে—লোভে পড়ে দিঘা চলে যেতুম, ফেরবার পর আমি আর এই শম্পা থাকতুম না, সারা পৃথিবীর মূল্যায়নে আমি একটা আলাদা শম্পা হয়ে যেতুম, হয়তো বা তোমার চোখেও … হয়তো কেন নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই…।
কিন্তু এত সব কথার একটাও বলতে পারল না সে৷ চোখ দিয়ে একটার পর একটা ফোঁটা গড়াতে লাগল। পেছনের ফোঁটাটা সামনের ফোঁটার সঙ্গে মিশে একটা অবাধ অনর্গল অশ্রুধারা তৈরি করতে লাগল।
শুধু যখন চূড়ান্ত বিচলিত সৌমিত্র ভয়ে ভয়ে বলল, শম্পা, এত কাঁদছ কেন? তোমাকে হার্ট করে আমি ভীষণ অনুতপ্ত, প্লিজ শম্পা … তখন সে কোনওমতে অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলতে পারল—‘এরকম আর কখনও কোরো না। কখনও না।’