Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতা || Bani Basu » Page 5

অমৃতা || Bani Basu

অমৃতা (Amtrita) – ৫

সকাল সাতটা। কোল্যাপসিব্‌ল-এ গোঁজা খবরের কাগজ টেনে নিল তিলক। ওর বাবা বললেন—আমাকে আগে দে। বাবা চা-এ চুমুক দিচ্ছিলেন। তিলক বলল—কাল পাকিস্তান-সাউথ আফ্রিকার ম্যাচটা কী হল দেখেই দিচ্ছি। লোডশেডিং-এ তো দেখতে দিলে না।

বাবা বললেন—তোর কি এখনও আশা পাকিস্তান ১৩৫-এর কম করবে ; আর ইন্ডিয়ার মরা চান্স আবার জিইয়ে উঠবে? আমি বলে দিচ্ছি দেখে নে পাকিস্তান সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়েছে। তিলক বলল—শচীন-সৌরভ একা কী করবে বলো! বোলার নেই একটা। ম্যাচ-উইনিং বোলার দরকার।

বাবা বললেন—আমি তো অনেক দিন ধরেই বলছি— ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নয়, মেন অফ দ্য ম্যাচ করা উচিত। একটা ব্যাটসম্যান আর একটা বোলার। বোলাররা তো পায়ই না। এভাবেই মোটিভেশন নষ্ট হয়ে যায়। তার ওপর যেমনই খেলুক, টাকাটা বাঁধা। শচীনই তো একবার পারফর্ম্যান্স বেজড পেমেন্টের কথা বলেছিল। করুক না সেটা। দেখবে হই-হই করে ম্যাচ জিতে আসছে।

তিলক বলল—যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বোলো না বাবা। আ ম্যাচ ইজ আ ম্যাচ। খেলবার সময়ে অত মনে থাকে না কি টাকা পাচ্ছি কি পাচ্ছি না!

—বেশ মনে থাকে, ইনজামাম অতগুলো ছয় হাঁকড়াল কেন তা হলে তাক করে করে? সুপার সিক্স?

—ভেদডুশ মার্কা বোলিং হলে সিক্সার হাঁকড়াবে না তো কী! বলতে বলতে তিলক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

বাংলা কাগজের প্রথম পাতার তলায় অমৃতার ছবি। হ্যাঁ, অমৃতা-ই তো! নামী নার্সিংহোম থেকে রোগিণী নিখোঁজ। অফিসঘর ভাঙচুর, ডাক্তার প্রহৃত। হেডলাইন থেকে বিশদে যায় সে—গতকাল সকাল সাড়ে দশটায় অমৃতা গোস্বামী নামে একটি বছর বাইশের রোগিণীকে ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি বারবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছিল। রাত পর্যন্ত সে আচ্ছন্ন ছিল, তিন নং কেবিনের নার্স মায়াবতী সরকার জানিয়েছেন। সকালবেলায় দেখা যায় তার শয্যা শূন্য। মেয়েটি ঘোরের মধ্যে কোথাও চলে গেছে কি না—এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়, খোঁজও শুরু হয়, কিন্তু তিনতলা এই নার্সিংহোম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। অতঃপর ভিজিটিং আওয়ারে রোগিণীর স্বামী ও শ্বশুর এ কথা জানতে পারলে, স্বামী অরিসূদন গোস্বামী ডাক্তারের চশমা কেড়ে নিয়ে তাঁকে মারধর করেন, বাইরে জনতা জমে। রোগিণী হারিয়ে গেছে এই অভিযোগে জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে, ওই নার্সিংহোমের এনকোয়ারি কাউন্টার চেয়ার বসবার সোফা তছনছ করে দেয়। পুলিশ আসায় ঘণ্টা দুই পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতাল থেকে না হয় কুকুরে গরিব মানুষের বাচ্চা মুখে করে নিয়ে যেতে পারে, গরিব মানুষ তো মানুষ বলেই গণ্য নয়। কিন্তু নামী নার্সিংহোমের মধ্যেও যদি এই জাতীয় কুকুরের নিঃশব্দ পদসঞ্চার আরম্ভ হয়ে যায়, এবং শিশুর জায়গায় সে কুকুর যদি যুবতী হরণ করতে থাকে তা হলে তো সত্যিকার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়!

—কী হল? তুলু?

—বাবা দেখো।

—কী পাকিস্তান জিতেছে।

—উঃ ও সব নয়, আমাদের বন্ধু, য়ুনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ি আমরা—অমৃতা গোস্বামী।

—কী হল? সিনেমায় নেমেছে?

—উঃ না, দেখো না খবরটা।

বাবার হাতে কাগজটা তুলে দিয়ে মুখোমুখি সোফাটায় ধপাস করে বসে পড়ে তিলক। হঠাৎ সব বন্ধু-বান্ধবের অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে থেকে ত্রিমাত্রিক ছবির মতো ভেসে ওঠে অমৃতার চেহারাটা। অমৃতা, একটু গম্ভীর, কিন্তু রসকষহীন মোটেই নয়, সেই অমৃতা যাকে কথায় কথায় ওরা খেপাত, জে.বি.-র ফেভারিট অমৃতা গোস্বামী। বিবাহিত মেয়ে বলে গোড়ায় গোড়ায় ওর দিকে বেশি ঘেঁষেনি তারা। কিন্তু দূরত্ব খুব শিগগিরই ঘুচে যায়। কত আড্ডা মেরেছে কফিহাউজে। ওর অবশ্য সব সময়ে একটা তাড়া থাকত, চারটের পর আর বসতে চাইত না। খুব দায়িত্বশীল মেয়ে। কী করল এই ডাক্তার? অযত্নে মেরে ফেলেছে, তারপর বডি কোথাও পাচার করে দিয়েছে? কেন? এতেও তো মার খেল। অযত্নে মরে গেলেও মার খেত। কী-ই বা এমন হল অমৃতার? হঠাৎ? এই গত সপ্তাহটায় বোধহয় ক’দিন আসেনি। তার আগে পর্যন্ত তো এসেছে, সমস্ত ক্লাস করেছে, নোট নিয়েছে, ক্যান্টিনে খেয়েছে। এক প্লেট মাংস নিয়ে পাঁউরুটি দিয়ে খাচ্ছিল। অনেকটা ঝোল নিয়েছিল। ওর পাশে ছিল দোলা, যাকে ওরা আদুরি কিংবা ‘দোল দোল দোলুনি/ রাঙা মাথায় চিরুনি’ বলে খেপায়। দোলা বোধহয় একটা ফিশফ্রাই নিয়েছিল। তিলক বলল—‘তোদের বেশ পয়সাকড়ি রয়েছে মনে হচ্ছে, এ অধমের দিকে একটু তাকা …

দোলা তাকে বলল—আজকে অমৃতা খেয়ে আসতে পারেনি, তা জানিস, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে, ও বাসভাড়া ছাড়া পয়সা পর্যন্ত আনেনি। অমৃতার দিকে চেয়ে বলল—একটু চেক করে নিবি তো পার্সটা। আশ্চর্য! তারপর আবার তিলককে বলল, আমি ওকে খাওয়াচ্ছি। কিন্তু তিলক, তুই তো আর শ্বশুরবাড়িতে নেই যে শ্বশুরবাড়ির ডিউটি সেরে খেয়ে আসবার সময় পাসনি। আর তোদের তো শ্বশুরবাড়ি হলে তোরা রাজা লোক, তোদেরই সবাই খাওয়াবে আমরা হাঁ করে দেখব …

অমৃতা মন দিয়ে হাড় থেকে মাংস ছাড়াচ্ছিল দাঁত দিয়ে, ‘শ্বশুরবাড়ির ডিউটি’ বলতে সে শুধু একবার দোলাকে বকেছিল— ‘আঃ দোলা!’ আর একটিও কথা না।

দোলার সাতকাহন শুনে তিলক বলেছিল—খাওয়াবি তো একটা ফিশফ্রাই কি একটা এগরোল। অত বক্তিমে কীসের রে? যাঃ তোকে খাওয়াতে হবে না। তিলক মজুমদারের পকেটেও পয়সা থাকে।

সেই অমৃতা, শেষ! শেষই তো! শেষ ছাড়া কী? কী আর হতে পারে!

ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ধরল তিলক—আমি নিশান বলছি। আজ সকালের কাগজটা…।

—হ্যাঁ এইমাত্র দেখলাম। দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি।

—হাইলি সাসপিশাস৷ বুঝলি? সামথিং ইজ ভেরি মাচ রং সামহোয়্যার।

—সে তো বটেই।

—সেই বন্দনা মুখুজ্জের কেসটা দেখলি না, আজও সলভ্‌ড হল না। একটা র‍্যাকেট আছে নিশ্চয়ই এর পেছনে।

নিশান ফোন রাখতেই দোলার নম্বরটা টিপল তিলক। দোলারই সবচেয়ে বন্ধু ছিল অমৃতা। দোলা হয়তো কিছু বলতে পারবে।

—দোলা আছে? আমি তিলক বলছি।

—এ মা! আমার গলাটা তুই চিনতে পারলি না? আসলে কাল থেকে ঠাণ্ডা লেগে…

—বাজে কথা রাখ। আজকের কাগজ দেখেছিস? বাংলা কাগজ আনন্দবাজার…

—আমাদের বাড়ি তো আনন্দবাজার শুধু শনি রবিবার নেওয়া হয় রে! কেন পরীক্ষাটা এগিয়ে এল, না কী?

—অমৃতার সম্পর্কে খবর বেরিয়েছে কাগজে।

—কী—ই—ই—ই? দোলার ‘কী’টা বহু বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল, উপরন্তু তীক্ষ্ণ আঘাত করল তিলকের কানের পর্দায়।

—হ্যাঁ, ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে নিখোঁজ। রাত্তিরবেলাও আচ্ছন্ন ছিল। ভোরবেলা দেখা যাচ্ছে নেই।

—বলিস কী রে? কালকে আমরা ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। কেউ ছিল না।

—কে কে গিয়েছিলি?

—আমি আর লাবণি। পাড়ার একটা ছেলে, নামটা ভুলে যাচ্ছি, বলল ওকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় সাদা অ্যাম্বাসাডার-এ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর বরের অফিসের গাড়ি।

—তা হলে তো সব মিলে যাচ্ছে। ডাক্তারটা একটা কেলো করেছে চিকিৎসা নিয়ে…তারপর…

—শোন তিলক, ওই ছেলেটা বলছিল, ওপরের ফ্ল্যাটের ওরাও বলছিল—ওরা লোক ভাল না। ছেলেটা আমাদের ওর বাপের বাড়িতে খবর দিতে বলেছিল।

—দিয়েছিলি?

—না। ওর মায়ের হার্টের অবস্থা জানিস তো? ভেবেছিলাম আজকে য়ুনিভার্সিটি যাব না। ওদের বাড়ি গিয়ে আবার খোঁজ নেব। খবরটা ওঁদের দিইনি।

—ভাল করেছিস। এখন খোঁজ নিয়ে কী করবি? তার তো বডি গাপ্‌ হয়ে গেছে।

—কী আজেবাজে বলছিস। —দোলা ককিয়ে উঠল—না, কক্ষনো না। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

ফোনটা নামিয়ে রেখে দোলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। মা ছুটে এল, বাপি ছুটে এল। সব শুনল।

বাপি বলল—ও বাড়িতে তুমি আর যেও না দোলা। খুব ফিশি ব্যাপার মনে হচ্ছে।

মা বলল—যাবে না মানে? তুমিও তো অমৃতাকে চেনো। অমৃতার অত বিপদ। দোলা ওর বন্ধু। অমনি যাবে না বলে দিলে? ওকে এসকেপিস্ট হতে শেখাচ্ছ? স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছ?

বাপি বলল—তারপর দোলা যাক আর অমৃতার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর পেছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দিক। তা হলে তোমার পরার্থকাতরতার লেস্‌নগুলো ঠিক-ঠিক কাজে লাগবে তো?

দোলার হাউ হাউ কান্না তখন ফোঁপানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বাপিকে জড়িয়ে ধরে বলল—আমার ভীষণ ভয় করছে বাপি। অমৃতাকে ওরা ভাল করে খেতে দিত না। সংসারের সমস্ত কাজ করাত। ওর পাড়ার একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে আমাদের বলে গেল ওর মা-বাবাকে খবর দিন। বধূ-হত্যার কথা কি আপনারা শোনেননি? আমি মাসির হার্ট খারাপ বলে কিছু বলিনি। এখন কাগজে এই খবর দেখে ওঁর কী হবে? কিছু করো বাপি, কিছু করো, কিছু একটা…

মা সব শুনে বলল—ব্যাপারটা তো আরও গোলমেলে হয়ে গেল। নার্সিংহোম থেকে উধাও শুনে ওরাই তো এসে ডাক্তারকে ঠেঙিয়েছে। তো ডাক্তারের সঙ্গে কি কোনও যোগসাজস না কী? লোক-দেখানো মারধর?

বাপি বলল—এ সব কেসে ফট করে একটা জাজমেন্ট দেওয়া খুব শক্ত। পুলিশ ঠিক খুঁজে বার করবে সত্য কী। এও বলি—অমৃতার বাবা মা দেখেশুনে একমাত্র মেয়ের ওইরকম বিয়ে দিলেন?

মা বলল—বাইরে থেকে দেখতে শুনতে তো খারাপ না। দোলা তো দেখেছে ওর বরকে? কী করে রে?

—সি.ই.এস.সি-র এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার। বেশ ভাল চেহারা। তবে আমার একটু রাফ লেগেছিল মা। ছবিতে বেশ। সামনে কেমন রাফ।

—তবে? মা বাবার এক ছেলে, ভাল চাকরি করে, চেহারা স্বাস্থ্য ভাল, নিজেদের ফ্ল্যাট রয়েছে। সাধারণ মানুষ আর কী চায়?

—বাইরে নয়, ভেতরে দেখতে হয়। আশেপাশে খোঁজ নিতে হয়।—সব্যসাচী বললেন।

—আশপাশের লোক কি চট করে খারাপ কিছু বলবে? প্রথমত আজকাল এক ফ্ল্যাটের লোক আরেক ফ্ল্যাটের কিছু জানে না, তারপর খারাপ-টারাপ লোকে চট করে বলতেও চায় না। বলবে ভাঙচি দিয়েছে।

—আমার মেয়ের বিয়ের সময়ে কিন্তু আমি সব দিকে খোঁজ নিয়ে তবে এগোব, শার্ট উল্টো করে তার সেলাই দেখার মতো, যাকে বলে ইনসাইড আউট।—সংকল্পে ঠোঁটে ঠোঁট বসে গেল সব্যসাচীর।

বাবা মায়ের কথা শুনে দোলার বুকের মধ্যে ঢিপ্‌ ঢিপ্‌ ঢিপ্‌ শুরু হয়ে গেল। আজ অবধি মাকে লুকিয়ে তো কিছু করেনি! এই প্রথম। এর সঙ্গে মিশেছে অমৃতার নিরুদ্দেশের খবর।

শম্পাও দেখেছিল খবরটা। সকালবেলা কাগজ খুলেই অমৃতার ছবি। সে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

—মা, মা, ও মা!

—কী রে! অমন করে ডাকছিস কেন? পিঠে মশা কামড়াল?

—মা, শিগগিরি।

মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এলে সে শুধু কাগজটা মার হাতে ধরিয়ে দিতে পারল।

নিবেদিতা, শম্পার মা দু-চার লাইন পড়েই কাগজটা হাত থেকে ফেলে দিলেন। মানে, হাত থেকে পড়ে গেল কাগজটা।

—এ কী খবর? এ কি সত্যি?

শম্পা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিল। আলগা গলায় বলল, এই তো গত সপ্তাহেই য়ুনিভার্সিটি লনে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। ও আমাকে কত উপদেশ দিল।…শম্পার চোখ উপচোতে থাকল, ধরা গলায় সে বলল—আমি কত ঝগড়া করলুম।

—কী তবে হয়েছিল মেয়েটার? কিছু বলেছিল?

—উঁহু।

শম্পা আর কথা বলতে পারছিল না। সে তার ঈর্ষার সবটাই উজাড় করে দিয়ে এসেছিল। কী যে বিশ্রী একটা তুলনামতো করেছিল অমৃতার পতিগর্বে আঘাত দিতে!

—অদ্ভূত অদ্ভূত অসুখ হয় একেক সময়ে। অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাওয়া…নার্ভের কিছু। কিন্তু গেল কোথায়?

শম্পা বোবা গলায় বলল—মা, ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম কোনটা বুঝেছ?

—কোনটা?

—প্রথমে যেটার নাম ছিল ‘জীবন’। বাবা যেখানে…মা কতদিন আগেকার কথা। তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই নার্সিংহোমটার পেছনে একটা বড় পুকুর ছিল…

—হ্যাঁ, তাই তো! বাঁধানো ঘাট, চারদিকে গাছপালা, নীলরতন সরকারের কম্পাউন্ডে যেমন আছে… অত বড় নয়।

—মা যদি ও ঘোরের মধ্যে চলতে চলতে…

নিবেদিতা মেয়ের মুখের ওপর হাত চাপা দিলেন। অমৃতার ভাগ্যকে তিনিও চিরকাল ঈর্ষা করে এসেছেন। কার ভাগ্যকেই বা করেননি। শম্পাদের ক্লাসে যত জন পড়ত—নূপুর, শর্মিলা, চন্দ্রা, মনীষা…যতজন মেয়ের বাবা বেঁচেছিলেন, যত জন মেয়ে শম্পার থেকে ভাল রেজাল্ট করত। তাঁর মনে হত, সব্বাই বিশেষ সুবিধে পাচ্ছে, আর তাঁর মেয়ে পিতৃহীন বলে, কালো বলে সব্বাই ওর ওপর অবিচার করছে। অমৃতা সেই ছোট্ট থেকেই খুব কর্মঠ, স্বাধীন ধরনের মেয়ে ছিল। বলত—‘মাসি, আমরা তো আছি, আমরা সবাই শম্পাকে দেখব। কথা রাখত অমৃতা। নিজের খাতাপত্র, নোটস সব নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিত শম্পার সঙ্গে। ওর বাবা টিচার ছিলেন সায়েন্সের। তাঁর কাছে কত পড়েছে শম্পা। অথচ আজ এই পিতৃহীন মেয়েটাই পাশ করে ভাল চাকরি করছে। তার ভাল বিয়ে হতে যাচ্ছে। অমৃতা কোথায় হারিয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন—হে ভগবান, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, রক্ষা করো, রক্ষা করো, রক্ষা করো শম্পাকে, রক্ষা করো অমৃতাকে। আরও যত মেয়ে তাঁর মেয়ের মতো, যে যেখানে বিপদে পড়েছে সবাইকে রক্ষা করো।

কাজকর্ম শেষ করে অল্প একটু ভাত আলু ভাতে দিয়ে খেয়ে ওঁরা বেরিয়ে পড়লেন সল্টলেকের উদ্দেশে। যখন ওরা ব্রাহ্ম বালিকায় পড়ত, তখন অমৃতারা থাকত মানিকতলায়, তারপর গেল দক্ষিণে রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিট। মেয়ের বিয়ে দিয়ে তবে ওঁরা একটা আস্তানা নিজেদের মতো করতে পেরেছেন সল্টলেক পূর্বাচলে। সে বাড়িতে কখনও যাবার দরকার পড়েনি তাঁদের। সম্পর্কটা অমৃতার সঙ্গেই আছে। মাসি মেশোর সঙ্গে নেই।

ঠিকানা খুঁজে খুঁজে মা-মেয়ে যখন পূর্বাচলের বাড়িতে পৌঁছলেন তখন একতলা ছোট বাড়িটার মাথায় গন গন করছে রোদ। ছোট্ট একটু বাগান, সেখানে সামান্য কিছু ফুলের গাছ। দু-চারটে জবা। কিছু জিনিয়া। ফুল নেই কোথাও, শুধু গাছগুলোই সার। সাবধানে বেল বাজালেন নিবেদিতা। খুব আস্তে। সামান্য একটু পরে দরজা খুলে দিলেন বিশ্বজিৎবাবু, অমৃতার বাবা।

বোঝাই যাচ্ছে স্কুল কামাই করেছেন। গালে না-কামানো দাড়ি। পায়জামাটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বাসিটাই পরে আছেন।

—ও শম্পা, এসো। আসুন আপনি।

সীমা কই?

—ও ঘরে।

সীমা শুয়েছিলেন। ওদের দেখে উঠে বসলেন। বিস্রস্ত জামাকাপড়। চোখ মুখ বসে গেছে।

—দিদি কিছু খবর পেলেন?

—না ভাই।

—কী হয়েছিল?

—কিচ্ছু জানি না। কোনও খবরই ওঁরা আমাদের দেননি। মেয়ের শরীর খারাপ হয়েছিল বলেও কিছু শুনিনি। তবে..

—তবে কী?

—ওর একটু অনিয়মিত হচ্ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল।

—তা হলে তো কনসীভ করেছিল!

—তাও ঠিক জানি না, ভাই। অন্য কোনও লক্ষণ তো ছিল না। খালি বলত খুব খিদে পাচ্ছে, খুব খিদে পায় মা।

চোখদুটো জলে ভরে এল সীমার।

—আমরা সল্টলেকে এসে থেকে তো বেশি আসতেও পারত না। আমাদের যাওয়া তো আরও অসম্ভব। কেন যে রমণী চ্যাটার্জি থেকে চলে এলাম। মেয়েটাকে বোধহয় হাত-পা বেঁধে জলেই ফেলে দিয়েছি।

—কেন? এ কথা বলছেন কেন? ছোট্ট ফ্যামিলি! জামাই অত গুণের!

কোনও কথা বললেন না সীমা। মুখ নিচু করে শুধু নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে আঙুলগুলো ভিজতে লাগল। নিবেদিতার মনে হল কী অপূর্ব সুন্দরী এই ভদ্রমহিলা। কিন্তু কোনওদিন সুখের মুখ দেখলেন না। স্বামী দিবারাত্র কোচিং করেন। উনি দিবারাত্র শুয়ে বসে থাকেন। সকাল সন্ধে নিয়ম করে একটু হাঁটেন, হার্টের ব্যারাম। কোনওদিন ভাল থাকেন, বেশির ভাগ দিনই ভাল থাকেন না। সে ভাবে দেখতে গেলে ওর মেয়েও শম্পার থেকে খুব একটা সুখের ছোটবেলা পায়নি। ক্লাস টু থ্রি-এর মেয়েকে যদি নিজের ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করে পরে আসতে হয়। ফাইভ সিক্সের মেয়ে দুধ জ্বাল দেওয়া, একটু ভাতে ভাত রান্না করাও শিখে নিয়েছিল। তাঁর পিতৃহীন মেয়েকেও অতটা করতে হয়নি।

ওঁর স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিতে না পারো, অন্তত মেয়েকে ফিরিয়ে দাও। হে ঈশ্বর, ওঁর মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।

শম্পা বলল—আমি তোমার কাছে কয়েক দিন এসে থাকব মাসি?

—কী করবি থেকে? তোর তো অফিসও আছে…

—ছুটি নেব।

—তোর মায়ের অসুবিধে হবে।

—না না আমার কোনও অসুবিধে হবে না।

নিজের শোক-দুঃখ নিয়ে একলা একলা থাকতেই স্বস্তি। অন্য কেউ এসব সময়ে থাকলে বড় অসুবিধে হয়, মন খুলে কাঁদা যায় না, স্বামীর সঙ্গে এই ঝগড়া-কথা কাটাকাটি আবার দুজনের একত্র শোকবিহ্বলতা এ সবই কেমন আটকে যায়। যতই হোক পরের মেয়ে, অতিথি, তার দিকেও একটু না একটু নজর দিতেই হয়। অথচ সে সামর্থ্য নেই, না মানসিক, না শারীরিক। তিনি অসহায়ের মতো একবার নিবেদিতা আর একবার শম্পার দিকে তাকান।

—দরকার নেই রে! উনি আছেন। হয়ে যায় আমাদের, চলে যায়।

—ঠিক আছে। দরকার হলেই কিন্তু ডাকবে। কোনও সংকোচ করবে না। ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে যোগাযোগ করেছিল?

—হ্যাঁ। আজ সকালেই। জামাই বলল ডাক্তারটা কিছু গণ্ডগোল করেছে। নার্সদের অসতর্কতায় কখন ও উঠেছে, বাইরে চলে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। একটা নামী নার্সিংহোম, এত অসাবধান! ওরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এই বলল, আর কী বলবে?

—নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে কেস করা উচিত।

—তা হয়তো করবে।

শম্পা বিকেলের চা করল। খাওয়াল সবাইকে। তারপর ওরা চলে গেল। মা-মেয়ে। বিশ্বজিৎ আর সীমাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটা অনভ্যস্ত গোপনতা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ওঁদের। আজ খুব ভোরবেলায় অমৃতার ফোন এসেছিল—মা, আমি বেঁচে আছি। ভাল আছি, কোথায় আছি এখন বলব না। তবে যথাসময়ে জানতে পারবে। ভাবনা কোরো না। কাউকে বোলো না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress