অমৃতা (Amtrita) – ৪
আকাশ। আকাশ কি এমন শাদা হয়? হয়। নীল আকাশ সাদাটে হয়ে আছে, কিংবা সাদা মেঘে-মেঘে সাদা হয়ে গেছে এমনটা দেখা যায়। কিন্তু এমন ধোবার বাড়ির পাটভাঙা থান কাপড়ের মতো শাদা? চারদিকে একটা এমনই শাদা আকাশ। শাদা আকাশের কোলে শুয়ে একটা শাদা প্রেতের মতো মানুষ। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে আরও কিছু শাদা প্রেত। শাদা শাদা বাসনকোসনে শাদা শাদা জিনিস রান্না করছে প্রেতেরা। নাঃ সে প্রেতেদের রান্নাঘর আর দেখতে পারে না। একটা শাদা ভেলায় সে হাত রাখে, অমনি তার পুরো শরীরটাই ভেলাটার ওপর আড় হয়ে পড়ে। কেউ তাকে ভেলায় তুলে নিতে চাইছে, কিন্তু তার সাধ্যে কুলোচ্ছে না। একটা গলে-যাওয়া ভ্যানিলা আইসক্রিমের কাঠির মতো সে ক্রমাগত সেই শাদা আকাশে না কি শাদা সমুদ্রে পিছলে পিছলে যেতে থাকে। ক্ষীণ কতকগুলো কণ্ঠ অনেক দূর থেকে ভেসে আসে।
হঠাৎ টলমল করতে থাকে শাদা সিলিংঅলা একটা ঘর। সবুজ পর্দা। শাদা শাড়ি টান টান করে পরা—ক্যাপ মাথায় কড়কড়ে একজন নার্স। তার হাতটা ধরে-থাকা, এপ্রন-পরা এক দোহারা চেহারার ভদ্রলোক। চশমা-পরা, সোনালি ফ্রেমের।
—সিস্টার, আপনি একটু যান তো। আমি পেশেন্টের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। সামনে থেকে শাদা ছায়া সরে যায়।
—আপনার নাম কী? মনে করতে পারছেন?
—অম্ … রি … তা গোস্।
—থাক ঠিক আছে।
—আপনার স্বামীর নাম কী?
কোনও উত্তর এল না।
—আপনার স্বামীর নাম কী?
এবারও কোনও উত্তর নেই।
—আপনি কীভাবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ঠিকঠাক বলুন তো!
—যাইনি।
—অজ্ঞান হয়ে যাননি? তা হলে …
—করে।
—করা হয়েছিল?
পেশেন্ট সামান্য একটু মুখ হাঁ করে, ডাক্তার ফিডিং-কাপ থেকে জল ঢেলে দেন মুখে।
—কত দিন পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে আপনার?
—চা চা …
—চার মাস? কাউকে বলেননি?
—শুনুন, আমি বলছি আপনি শুনে যান। চোখদুটো খুলুন। হ্যাঁ সুদ্ধু শুনে যান— আপনার চার মাসের প্রেগন্যান্সি। আপনাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে এই নার্সিং হোমে আনা হয়েছে। ওঁরা মানে আপনার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ক্লেইম করছেন, আপনি থেকে থেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এই প্রেগন্যান্সি সুতরাং টার্মিনেট করে দিতে হবে। আপনারও কি তাই মত!
—জা-নি না।
—সত্যি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন?
—না।
—শুনুন, এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। আর শুধু শুধু প্রথম সন্তান নষ্টই বা করবেন কেন? উনি আপনার লিগ্যাল স্বামী তো?
—বি … য়ে … হয়।
—বেশ, তা হলে বাচ্চা নষ্ট করার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আলট্রা সনো করে দেখে নিয়েছি, বাচ্চা পার্ফেক্ট। এখন শুধু শুধু সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভ্রূণ হত্যায় মানুষ হিসেবে ডাক্তার হিসেবে আমার এথিক্স-এ বাধছে। আপনারও কি নষ্ট করাই মত!
—ওর বা চ্ চা।
—শুধু ও কেন? কী আশ্চর্য! আপনারও তো৷ আপনারও তো ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে। অধিকার আছে।
—ওর বা চ্ চা—না।
—অন্য কারও বাচ্চা?
—না, চাই না।
—ও, ওই স্বামীর বাচ্চা আপনি চান না?
পেশেন্ট আবার একটু মুখ হাঁ করে, ডাক্তার জল দেন।
—শুনুন, বুঝতে পাচ্ছি, স্বামীর ওপর আপনার আস্থা নেই। কিন্তু ওই ভ্রূণটির অর্ধেকটা আপনার। মোটেই ও পুরোপুরি আপনার স্বামীর নয়। আপনি ঘুমোন। আজকের দিনটা ঘুমোন। একটু পরেই আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আপনাকে দেখতে আসবে। তখনও চোখ বুজিয়ে, অজ্ঞান থাকবার ভান করবেন। আপনি আরেকটু সুস্থ হলেই আপনার সঙ্গে আবার কথা বলব।
নার্সটি ঘরে এলেন। ডাক্তার তার সঙ্গে নিম্ন স্বরে কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর চলে গেলেন। নার্স স্যালাইন লাগাবার আয়োজন করতে হাতটা টেনে নিতে চাইল সে। লাগল। সিস্টার এসে তাড়াতাড়ি হাত ধরলেন—স্যালাইন চলবে। হাত ঝাঁকাবেন না। শরীরের যা অবস্থা করেছেন! চুপ করে থাকুন।
কতক্ষণ পরে, তার খেয়াল নেই, সে কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
অরিসূদনের গলা—কেমন আছে এখন?
সিস্টার—ভাল না। স্যালাইন চলছে, দেখছেন না?
অরিসূদন—জ্ঞান ফেরেনি?
—একবার ফিরেছিল, আবার … তবে এটা ঠিক অজ্ঞান অবস্থা নয়, শরীরটা খুব দুর্বল তো, তাই আবার একটা আচ্ছন্ন অবস্থা এসেছে। আপনারা যথেষ্ট যত্ন নেননি, যাই বলুন। ফার্স্ট প্রেগন্যান্সি।
—স্ত্রীকে কীভাবে যত্ন করতে হবে সে বিষয়ে আপনার মতামত আমি শুনতে চাই না।
—প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আমি ট্রেইন্ড নার্স, আমার মতামত জানাবার অধিকার আছে।
ডাক্তারের গলা। বাইরে থেকে ভেতরে এলেন বোধহয়।—হ্যাঁ সব ঠিকই আছে মিঃ গোস্বামী। কিন্তু জেনারেল হেল্থের অবস্থা ভাল না। একটু সুস্থ হয়ে উঠুন তার পরে।
অরি—শুনুন, পেশেন্ট আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
—সে কী? ডাক্তার হিসেবে আমি সেটা অ্যালাও করতে পারি না।
—আমরা বন্ড সই করে নিয়ে যাব।
—পেশেন্টের পার্টি যদি পাগল হয়, আমরা তো আর পাগলামো করতে পারি না। আই’ল আস্ক ইউ টু গো আউট নাউ, মিঃ গোস্বামী। দ্য পেশেন্ট ইজ ভেরি মাচ ইন ডেঞ্জার, শী মাস্ট বি লেফ্ট ইন পিস।