অমৃতা (Amtrita) – ৩
অমৃতার কথাটা সর্বক্ষণ মাথায় ঘুরছে—‘তোর ডাউরি নেই বলেই কি বিয়ের আগে দুটো রাত উপহার দিতে চাইছিস?’ সৌমিত্র দাস যখন প্রস্তাবটা দিল, দিল এইভাবে—চলো শম্পা একটু বেড়িয়ে আসা যাক।
শম্পা তো বেড়াতে পেলে আর কিছু চায় না। বলল—কোথায়?
—দ্যাখো ডায়মন্ডহারবার পুরনো হয়ে গেছে। আরেকটু দূর। ধরো দিঘা। পুরো রাস্তাটা গাড়িতেই যাব। এখনও খড়্গপুর টু দিঘা, বা এখানকার যে বাসগুলো স্ট্রেইট দিঘা যায়, সেগুলো তেমন ভাল হয়নি। খড়্গপুর টু দিঘাগুলো তো লজঝড়। আমার মারুতি জেন শাঁ শাঁ করে চলে যাবে। এ. সি.। তুমি বাইরের ধুলো, পলিউশন, গরম কিচ্ছু টের পাবে না। ঠিক দুদিন আগেই সৌমিত্র বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। শম্পা কিছু বলেনি, মনে মনে বলেছে—ইস্ সত্যি?
মুখে সে বলেছে—কেন?
—কেন মানে?
—বিয়ে করতে চাইছেন কেন?
—চাইছি কেন? আশ্চর্য! তুমি এতদিনেও বুঝতে পারোনি, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাইছি! আজকে শুধু মুখ ফুটে বললাম এই পর্যন্ত।
শম্পার গলা ধরে গেছিল, সে বলেছিল—কী আছে আমার? কেনই বা আমাকে…
—তোমার এই কমপ্লেক্সগুলো আমার ভাল লাগে না শম্পা। সত্যি বলছি তোমার এই পার্টটাই সবচেয়ে ডিপ্রেসিং। তুমি একটা অ্যাট্রাকটিভ ইয়াং উওম্যান, পার্ফেক্টলি এডুকেটেড, ডুয়িং এ গুড জব, তোমার ভেতরে আজকালকার মেয়েদের তুলনায় কিছু বস্তু আছে। কেন তোমার এই সব কমপ্লেক্স আমি জানি না। তুমি কি বুঝতে পারো না আমাদের ললিত শা, অভিনাশ চোপরা—এরা তোমার সঙ্গে আলাপটা এগোতে খুবই ইচ্ছুক, খালি আমি তোমার প্রতি দুর্বল জানে বলেই এগোতে পারে না!
—ও তো পুরুষদের একটা মেয়ে দেখলেই র্যাগিং করার টেনডেনসি থাকে—
—নাঃ শম্পা, তোমাকে নিয়ে পারা যাবে না, আসলে তোমার বাবা অল্প বয়সে মারা গিয়েই, তোমার একটা পার্মানেন্ট সেন্স অফ ইনসিকিওরিটি এসে গেছে।
—বোঝেন যদি তো বলেন কেন?
সেদিন ওরা ব্লু-ফক্সে গিয়েছিল। ওয়লডর্ফ নয়।
মৃদু আলোর মধ্যে ওদের কথাবার্তা খুব জমেছিল।
যে লোকটা তাকে এত বোঝে, তার এত গুণের কথা খেয়াল করেছে, তার একমাত্র দোষের কথাও সরবে বলে তাকে সাবধান করে দিচ্ছে, তার প্রস্তাবটা কুপ্রস্তাব বলে মানতে মন রাজি হয় না।
মা, তার মা, নানা বিপদে-আতঙ্কে দিশেহারা বেচারি মা তার জীবনের অর্ধেক ব্যাপারই বোঝে না। বাবার মৃত্যুতে বাবার জন্য চাকরি একটা পেয়েছে, কিন্তু তা তো আর বাবার চাকরি নয়! মা পেয়েছে মায়ের বিদ্যে-বুদ্ধিমতো একটা কেরানির চাকরি। নেহাৎ টাটাদের কনসার্ন, ভাল পয়সাকড়ি দেয় বলে তাদের চলে যায়। ডাফ স্ট্রিটের বাড়িটাও আছে। যৌথ পরিবারের বাড়ি। তার বাবাই ভাগ করে পাঁচিল-টাঁচিল তুলে গিয়েছিলেন—তাই। তা নয় তো, ও পারে তার জ্যাঠতুতো জ্যাঠামশাইয়ের পরিবার তাদের কী অবস্থা করত তা একমাত্র ভগবানই জানেন। এখনও যথেষ্ট নাক গলায়। সৌমিত্রকে সে একদিনও বাড়িতে আনেনি। মায়ের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে বাইরে, সুতানুটি উৎসবে গান-টান শুনতে গিয়ে। মা তো এক কথায় মুগ্ধ। অত সুন্দর পুরুষালি চেহারা, অত ভাল চাকরি করে? সেই ছেলেকে তিনি যে কোনও মূল্যে জামাই পেতে চান।
সৌমিত্রর প্রস্তাবটা শম্পা খুব হেলায়-ফেলায় রেখেছিল মায়ের কাছে। মা জানো, দিঘাতে একটা কাজ আছে আমাদের কম্প্যানির। সৌমিত্র বলছে আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে।
—মানে তুই ওকে হেল্প করবি? না কি?
—তাই দাঁড়ায় ব্যাপারটা।
—আর কে যাবে?
—আবার কে? আমি আর ও।
চমকে উঠল মা।
—তুই আর ও? অফিসে কথা হবে না এ নিয়ে?
—সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে মা। দিনকাল বদলে গেছে টের পাও না?
—তা ছাড়া ও তো তোকে বিয়ে করবে কথা-ই দিয়েছে। তবু-তবু শম্পি ওখানে গিয়ে কিন্তু কাছাকাছি ঘরে থেকো না। আর সাবধানে থেকো। বিয়ের আগেই যদি ও স্বামীর মতো ব্যবহার করতে চায়, তুমি কিন্তু রাজি হয়ো না।
—আচ্ছা মা, আমার বুদ্ধি-বৃত্তি, আমার আত্মসংযমের ওপর এতটা আস্থা তোমার এল কী করে?—শম্পা মনে মনে ভাবে। এ কি আস্থা? না দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া, কিংবা দায়িত্ব একেবারে ছেড়ে দেওয়া! তাই, তাই-ই সে অমৃতার কাছে গিয়েছিল। অমৃতা এককথায় না করে দিল, বিষ উগরে দিল। সে বিষ কি তাকে, তার বিশ্বাসকেও আক্রমণ করেনি?
—কী? আমরা যাচ্ছি তো এই উইক-এন্ড-এ।—আবারও ব্লু ফক্স।
—এ সপ্তাহে যদি না যাই, তো কী হয়? শম্পা সৌমিত্রর চোখ এড়ায়।
—কী হয় মানে? আর আমার সময় হবে না কি? তুমি কি জানো না উইক-এন্ড-এও দস্তিদার আমার ওপর কী কাজ চাপিয়ে রাখে? আর তারপর তো আমাদের বিয়ের দিন এসেই যাবে। এই বৈশাখেই।
—আপনি তো আপনার বাড়ির কারও সঙ্গে পরিচয় করালেন না? আপনি স্থির করলেই স্থির হয়ে যাবে?
—ওহ, ইয়েস, হু এলস ইজ দেয়ার এনিওয়ে? দিদি জামাইবাবু থাকেন বম্বেতে, একটা বোন আছে সে জার্মানিতে, জার্মান বিয়ে করেছে। এগুলো তো তোমায় আমি বলেছি, বলিনি?
—না, দিদির কথা বলেছেন। আবছাভাবে বম্বের কথাও। তবে ছোট বোনের কথা, তার জার্মান সাহেবকে বিয়ে করার কথা বলেননি। তা আপনাদের পরিবারে সাহেব-জামাই থাকার জন্যই কি আপনারা এত পারমিসিভ?
প্রথমটা হাঁ হয়ে গেল সৌমিত্র। তারপর বলল—বাহ্ বাহ্ এই তো মাটির পুতুলের মুখে খই ফুটছে। গড নোজ কোনও ভেন্ট্রিলোকিস্ট মিষ্টি পুতুলটাকে নিজের কথা বলবার জন্য ব্যবহার করছে কি না!
—ঠিক আছে। তাই—শম্পার চোখ এবার জল চকচক—ভেন্ট্রিলোকিস্ট-ই ব্যবহার করছে, তাই বলে আপনিও ব্যবহার করবেন?
—কী বলছ শম্পা? কী বলছ তুমি জানো।
—হতে পারি আমি মাটির পুতুল, তো সেই মাটির পুতুলটাকে ভেঙে দেবেন না সৌমিত্রদা।
চোখ থেকে জল এবার উপচোচ্ছে। শম্পা উঠে দাঁড়াল। সামনে টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে স্মোক্ড হিলসা, বাটার নান। চিকেন দো পিঁয়াজা।
—আরে আরে শম্পা, চললে কোথায়? ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন প্লিজ।
—পরে যাতে এর চেয়েও বেশি সিন ক্রিয়েট করতে না হয় তাই, আমি কোয়ায়েটলি চলে যাচ্ছি। আপনি বসুন।
—এই এত খাবার আমি একা খাব?
—খেতেই তো পারেন। ছেলেরা তো একটু বেশিই খায়। কয়েক পেগ হুইস্কি নিয়ে নিলেই পেরে যাবেন। আর নেহাৎ না পারেন আর কাউকে ডেকে নিন না, কোনও কাচের কি পোর্সিলেনের পুতুলকে, কোনও বার্বি ডলকে যে আপনার সঙ্গে দিঘা যেতে রাজি হবে!
ক্রুদ্ধ হতভম্ব সৌমিত্রকে একা বসিয়ে রেখে বেরিয়ে এল শম্পা। ভেতরে এক বুক কান্না। তাদের মায়ের মেয়ের ভীষণ বিয়ের শখ। বিয়ে হলে একটা পুরুষ হবে তাদের সংসারে। সে মাকে এনে রাখবে নিজের কাছে তার বর যদি মায়ের বাড়ি থাকতে না-ও চায়। কিংবা মায়ের কাছাকাছি থাকবে। একটা সমর্থ পুরুষের যে কী ভীষণ দরকার জীবনে, তা তার বাইশ বছরের জীবনে হাড়ে হাড়ে বোঝে শম্পা। সে জানে না, সে ঠিক করল কি না। সৌমিত্রর হয়তো কোনও অসৎ উদ্দেশ্যই ছিল না। সে হয়তো এখনই তাকে বউ ভাবতে শুরু করেছে। কিংবা হয়তো সে তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করত। ওরা সত্যিই একটু হাই-সোসাইটির মানুষ। তারা যেমন বিয়ের আগে অদূরে ভাই কি মেসোমশাইকে বসিয়ে রেখে, মুখোমুখি বোঝাপড়া করে, ওদের সমাজে হয়তো সেটাই হয় এই রকম উইক-এন্ড ট্যুরে গিয়ে। আজকে সে তার আপাদমস্তক মধ্যবিত্ততাই প্রমাণ করে দিল সৌমিত্র দাসের কাছে।
পার্ক স্ট্রিট রাস্তাটা পার হওয়া খুব শক্ত। বিশেষত শম্পার চোখ ঝাপসা, মন বোধবুদ্ধি সবই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাস্তার আলোকস্তম্ভ, যেখানে হলুদ, সবুজ, লাল সংকেত জ্বলে নেভে সে সেটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলেও বুঝতে পারছে না যেন পুরোপুরি।
‘ব্লাডি বাস্টার্ড, ডার্টি হোর’—সে জেব্রা দিয়ে পার হচ্ছিল না, মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দেখে পার হতে যাচ্ছিল। প্রায় চলে যাচ্ছিল একটা ফিয়েট য়ুনোর চাকার তলায়। গাড়ির বনেটের ঠাণ্ডা কঠিন স্পর্শ ঠিক মৃত্যুর স্পর্শের মতো তার কোমর ও ব্লাউজের মাঝখানের খোলা অংশে লেগে রয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর স্পর্শের কিছু শব্দ তার শরীর হিম করে দিল। গাড়িটা তাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে একেবারে শাঁৎ করে চলে গেল। মুখে পাইপ এক মধ্যবয়সী মনে হল। না কি মধ্যবয়সী নয়? খুব বয়স্ক না কি? বিপরীত দিকের পেভমেন্টে সে এলই বা কেন? তাকে তো যেতে হবে উত্তরে, পার্ক স্ট্রিটটুকু সিঙ্গারের শোরুম আর এশিয়াটিক সোসাইটির পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চৌরঙ্গি রোডে পড়া। তারপর ট্রাম গুমটির দিকে যাওয়া, এই তো তার পথ। কেন সে রাস্তা পার হতে গেল। ‘ব্লাডি বাস্টার্ড’টা না হয় পথ-চলতি মুখের কথা সাধারণ গালাগালি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ‘ডার্টি হোর?’ তাকে একটা নোংরা পণ্য মেয়ের মতো মনে হচ্ছে লোকের? আজকাল? সাধারণত সে সালোয়ার কামিজই পরে, আজ পরেছে মায়ের একটা লাল রঙের সিল্ক। ঘন গাঢ় রক্তের মতো রংটা, এটা পরে তাকে খুব ভাল দেখায়। সবাই বলে। সৌমিত্রও আজ বলেছিল। একটা মোটা বিনুনি এখনও তার মাথার পেছনে, সৌমিত্রর খুব ইচ্ছে সে স্টেপ কাটে। কিন্তু অতগুলো চুল! একবার স্টেপ কাটলে আর কিচ্ছু করার থাকবে না। তাই সে প্রাণ ধরে কাটতে পারছে না চুলটা। মাথার পেছনে হাত দিল সে, হেয়ার পিন দিয়ে কতকগুলো লাল গোলাপ আটকানো। পার্ক স্ট্রিটের মোড়েই ফুলগুলো গছাল একটা অল্পবয়সী ছেলে। সৌমিত্র কিনল। নিজে অবশ্য পরিয়ে দেয়নি। হাত স্টিয়ারিং-এ। বলল—পরে নাও শম্পা প্লিজ। এই ফুলগুলোই কি ওই গালাগালের কারণ! তার ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। গরম পড়ছে বলে সে অন্য কোনও প্রসাধন করে না। চোখে ম্যাসকারা লাগায়নি। খালি হালকা বাদামি একটা আই শ্যাডো ব্যবহার করেছে আর আইব্রো পেনসিল দিয়ে চোখের ওপর পাতায় পলক ঘেঁষে একটা সরু লাইন। বোঝাই যায় না কিন্তু চোখে একটা শ্ৰী আসে। এতেই তাকে ‘ডার্টি হোর’-এর মতো দেখাল? সৌমিত্ররও তা হলে ওই জাতীয় কিছু লাগে নিশ্চয়ই। একটা সস্তা মেয়ে যাকে উইক এন্ডে এ. সি. গাড়ি করে দিঘা নিয়ে গিয়ে কিছু ফুর্তি করা যাবে? ছি, ছি, বিয়ের আগ্রহে, একটা নোঙরের আগ্রহে সে এমন চোরাবালির ওপর এসে দাঁড়িয়েছে?
একটা ভাঙাচোরা পুতুল। হ্যাঁ, একটা মাটির পুতুল চোখের জলে যার অর্ধেকটা গলে গেছে, আর ক্রোধের আগুনে যার বাকিটা জ্বলে গেছে। এই হল শম্পা, বাড়ির রাস্তা পার হয়ে সে কারবালা ট্যাঙ্ক লেনের দিকে চলে যেতে থাকল। আসলে তার বাড়ি সে পেরিয়ে গেছে সে খেয়ালই তার হয়নি। নিজের রাস্তা সে চিনতে পারছে না।
—এই শম্পাদি কোথায় যাচ্ছিস রে? —শম্পা সাড়া দিচ্ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয়বার—এই শম্পাদি’ শুনে তাকে ফিরে তাকাতেই হয়।
বাবুল। প্রতিবেশী এই ছেলেটি একেবারে এক নম্বরের ভাল ছাত্র। এবার জয়েন্টে সেকেন্ড এসেছে। যাদবপুরে বোধহয় কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ারিং কি ইলেকট্রনিক্স এরকম কিছু পড়ছে। বাবুলের ফর্সা নিষ্পাপ চশমা পরা মুখটার দিকে তাকিয়ে শম্পা যেন একটু একটু করে তার চেনা পৃথিবীতে ফিরে এল। ওই তো বাবুলদের বাড়ি, গায়ে গায়ে লাগা সুপ্রিয়াদের বাড়ি। সে তার বাড়ি পেছনে ফেলে এসেছে।
—কোথায় যাচ্ছিস?
—কোথাও না।
—তার মানে! আমি তো ভাবলুম তুই আমাদের বাড়িতেই আসছিস, দিদি এসেছে খবর পেয়েছিস।
—না, আমি মিণ্টির কাছে যাচ্ছি না। কোথাও যাচ্ছি না। বাড়িও যাচ্ছি না।
বাবুল ওর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল—তুই কি কেঁদেছিস না কি রে, গালময় জলের দাগ। তোর পাউডার ধেবড়ে গেছে।
—পাউডার আমি মাখি না।
—মেয়েরা পাউডার মাখে না! এটা তুই আমাকে খাওয়াতে পারবি না।
—ঠিক আছে, আমায় বিরক্ত করিস না।
—আরে মাসিমা বকেছেন তো হয়েছে কী? এমন বকলেন যে তুই লাল শাড়ি পরে একেবারে সুইসাইড করতে চললি! কোন সাইটটা বাছলি৷ হেদো তো পেছনে ফেলে এসেছিস? দেশবন্ধুর পুকুরই এখন নিয়ারেস্ট। তা মাইল দুয়েক তো হবেই! হ্যাঁ রে পুকুরটা এখনও আছে তো!
শম্পা বলল—আমাকে বিরক্ত করিস না।
—ও বুঝেছি। ট্রাম লাইনে মাথা দিবি। জীবনানন্দকে চাপা দেবার পর থেকে ট্রাম-কোম্পানি খুব সাবধান হয়ে গেছে রে! একে তো লালবাতি জ্বলতে চলেছে তার ওপর যদি আরও কলঙ্ক বাড়ে …
শম্পা ফিরে দাঁড়াল। —ঠিক বলেছিস।
—কী ঠিক বললুম!
—ওই যে সুইসাইডের কথাটা!
—সত্যি তুমি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে?
—যাচ্ছিলাম না, কিন্তু তুই সাজেস্ট করতে এখন মনে হচ্ছে দ্যাট ইজ আ বেস্ট ওয়ে।
—একটা সাজেশন যখন নিলে শম্পাদি, তখন আরেকটাও নাও।
—মানে?
—আমি বলছিলুম তুমি সুপ্রিয়াদির সঙ্গে ঘণ্টাদুয়েক আড্ডা মেরে এসো। চমৎকার একটা সুইসাইডের অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে।
শম্পার মুখে একটা ফিকে হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। কারবালা ট্যাঙ্ক লেনের সুপ্রিয়া চাটুজ্জে একটি বিখ্যাত বিশ্বনিন্দুক এবং ঝগড়ুটে। ওর মতে একজন যদি হয় ডাফ লেনের ছাগল তো অন্য আরেকজন বেথুন রো-এর, আরশুলো। বাবুলকে দেখলেই বলে—কী রে, যাদবপুর তো হয়ে গেল? এখনও মাস্টারগুলোকে তেল মারছিস? অবশ্য বাবুলকেই একমাত্র কথাটা সামনে বলে, অন্যদের ক্ষেত্রে বলে পেছনে। কে পাকা কুমড়ো কিন্তু কচি শশাটি হবার সাধ হয়েছে, কে আবার কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম, কে বা কাকিনী, এই রকম। সুপ্রিয়াদির গুণমুগ্ধ একটা ছোট দল যে পাড়ায় নেই, তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগই ওর এই স্বভাবে বিরক্ত। বাবুল যেমন শম্পাও তেমন ওকে এড়িয়ে যায়। সামনে পড়ে গেলে হয়তো বলবে—কী রে, মায়ার ছোটপিসির মতো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস না কি? দেখতে পাই না কেন আজকাল? এর পরই মায়ার ছোটপিসির গল্পটা সবিস্তারে বলবার জন্যে ছটফট করবে সুপ্রিয়াদি। তখন তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়াই এক দুষ্কর ব্যাপার। প্রতিভার তোড় এসেছে তো!
বাবুলই বলে—কবিরা যেমন প্রেরণার তোড়ের মাথায় যা আসছে তা লিখে ফেলতে না পারলে খেপে যায়, সুপ্রিয়াদিও তেমন নিন্দের তোড় এলে আর সামলাতে পারে না। কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যায়, বুঝলি?
শম্পা এখন বলল—ভাল বলেছিস। সেই অর্জুনের আত্মঘাতী হবার জেদ চাপল আর কৃষ্ণ অমনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন, বেশ খানিকটা আত্মপ্রশংসা করে নাও, তা হলেই আত্মহত্যার কাজ হয়ে যাবে!
বাবুল বলল—এটাও আমার অরিজিন্যাল রাখতে দিলি না? তোরা মহাভারত-টারত এত পড়ে রাখিস কেন রে? নাঃ এবার ল্যাটিন অ্যামেরিকান পড়তে হবে। নইলে আর তোদের কাছে পাত্তা পাচ্ছি না।
বাবুল পাশে পাশে হাঁটছে। যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, আবার সবার সঙ্গে মেলামেশাও করে খুব। চমৎকার হালকা কথাবার্তা বলতে পারে। হঠাৎ শম্পার মনে হল—এই যে নিষ্পাপ, হাসিখুশি বাবুল এ-ও তো ভাল পড়াশোনা করছে, সেই সুবাদে ভাল চাকরি-বাকরিও পাবে, তখন ওরও কিছু সাবর্ডিনেট মেয়ে থাকবে, আর একটা এ.সি. গাড়ি, আর ওয়ালেটে অনেক পয়সা, আর একটা মাত্র উইক-এন্ড ছাড়া ছুটিও থাকবে না। সারাক্ষণ কাজে যোতা। তা, ও-ও কি একটি পছন্দের সাবর্ডিনেট মেয়েকে ওর সঙ্গে উইক-এন্ড-এ দিঘা যেতে বলবে? তো সেই মেয়েটি হয়তো শম্পার মতো ডাফ স্ট্রিটের পুরনো বাড়ির বাপ-মরা লড়াই-করা মায়ের লড়াই করা বিস্তর কমপ্লেক্সঅলা মেয়ে নয়, সে হয়তো ‘দেবাঞ্জলি’ কি ‘আকাশ প্রদীপ’ জাতীয় ফ্ল্যাটে থাকে, অনেক আধুনিক, অনেক মডার্ন। দিঘার হোটেলের ডাব্ল বেড এ.সি. রুমে বাবুল কন্ডোম বার করলে হয়তো সে মেয়েটি অবাক তো হবেই না, নিশ্চিন্ত হবে, কারণ তার ব্যাগেরটা আর বার করতে হল না। তারপর হয়তো চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে দুজনে দুদিকে চলে যাবে, বাবুলের অন্য কোনও উইক-এন্ড অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে যুগলে বেড়াতে যাবার পথে হিংস্র ফণা তুলে, কিংবা দুচোখ ভর্তি গরম জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না।
আড়চোখে সে বাবুলের দিকে চাইল। চশমাটা ঠেলে নাকের ওপর ওঠাচ্ছে বাবুল। একটা মোটা-কালো ফ্রেমের চশমা পরেছে। তাতেও তার মুখের ছেলেমানুষি যায়নি। কিন্তু ভী-ষণ সেয়ানা ছেলে। শুধু পড়াশোনাতেই নয়।
—বাবুল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
—কর না। আবার অনুমতির কী আছে? ওই সুইসাইড সম্পর্কিত নয়তো, যদি আমাকে কয়েক ফাইল সিডেটিভ জোগাড় করে দিতে বলিস, সেটা পারব না কিন্তু।
—বাজে বকিস না। তোরা, মানে তুই মেয়েদের সম্পর্কে কী ভাবিস? বলবি? আমি তোর দিদির মতো!
—তোরা, মানে তুই’টাতে আমার খুব আপত্তি আছে শম্পাদি। আমি হলাম একটা আলাদা ব্যক্তি, আমি আমার মতো ভাবি, ওরা মানে আমার পেছনে যদি পুরো আমাদের জেনারেশনের ছেলেগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিস তা হলে আমাকে ভেবে ঠিক করতে হবে, মানে একটু বিশ্লেষণ করে নিতে হবে এই আর কি। আমার দ্বিতীয় আপত্তি হল ‘দিদির মতো’ কথাটায়। মতো টতো কেন? তুই তো আমার একরকম দিদিই হলি, মিন্টির মতো নিজের দিদি নয়, কিন্তু পাড়াতুতো দিদি তো!
—আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোর পাড়াতুতো দিদি। কিন্তু তুই মেয়েদের সম্পর্কে তোর নিজস্ব ধারণার কথাও বল, আবার একটু জেনারালাইজও কর, প্লিজ।
বাবুল বলল—এইরকম হাঁটতে হাঁটতে? যদি গাড়ি চাপা পড়ি? কিংবা সুপ্রিয়াদি এসে পড়ে? জানলায় চোখ রেখে দেখছে হয়তো এখন।
—তা হলে কীভাবে বলতে চাস?
—একটু ‘গজব’-এ খাওয়া না রে শম্পাদি। হেভি চাকরি করিস তো!
—তুইও তো হেভি স্কলারশিপ পাস?
—আমি? স্কলারশিপ? জানিস না ফ্যামিলির উপার্জন পাঁচ-টাচের বেশি হলে স্কলারশিপটা দেয় না। ওই কুমিরছানার মতো দেখিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে একটা সার্টিফিকেট দেয়।
—তাই বুঝি? জানতুম না তো!
—কত কিছুই জানিস না এ পৃথিবীতে। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানিস বল, অথচ চাকরিতে ঢুকে অব্দি কেমন একটা সবজান্তা, সবজান্তা ভাব করিস। তবে ন্যাশন্যাল ট্যালেন্টেও আমি একটা স্কলারশিপ পাই। তোকে বাজে কথা বলব কেন? তা, সেটা তো বই-টই কিনতেই চলে যায়।
—কী খাবি?
—রেশমি কাবাব চিকেনের। আর আইসক্রিম। তোর রেস্তয় কুলোবে তো? দুজনেই খাব কিন্তু।
সত্যি খিদে পেয়েছে। দা-রুণ! শম্পা নিজের ব্যাগের ভেতরটায় উঁকি দিয়ে বলল—হ্যাঁ হয়ে যাবে। দাঁড়া মায়ের জন্যও একটা প্যাকেট করে দিতে বলি।
অর্ডার দেওয়া হয়ে গেলে, বাবুল বলল—এবার বল তোর হবু বর সৌচিত্র না সৌমিত্র, পদবি জানি না, তোকে এমন কী বলেছে যে তুই কেঁদে মুখের মেকাপ ধুয়ে ফেললি?
এত অবাক শম্পা জীবনে কখনও হয়নি।
সে বলল—সৌমিত্রর কথা তুই কী করে জানলি?
—সবাই জানে পাড়ায়। পাড়ার জামাই আসছে, সব হাত ধুয়ে বসে আছে, কখন পাতে পোলাও পড়বে।
—সর্বনাশ! আলাপ, একটু বেশি আলাপ হলেই বিয়ে? এই তোর তোদের মেয়ে সম্পর্কে ধারণা?
—তোরা তো ঝুলে পড়তে পারলেই বেঁচে যাস। যে প্রথম অ্যাপ্লিক্যান্ট তারই সঙ্গে।
—সেটা উচিত নয় বলছিস?
—অবশ্যই নয়, প্রেমে হাবুডুবু খাস তো আলাদা কথা, তখন আর তোদের হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান থাকে না। কিন্তু আদারওয়াইজ একটু বাজিয়ে নেওয়া তো দরকারই।
—তুই, তুই কী ভাবে বাজিয়ে নিবি?
—আমি? আমার কথা উঠছে কেন? —বাবুল চোখ গোল গোল করে বলল।
—কেন, তুইও তো একদিন বিয়ে করবি?
—আমার কথা তো হচ্ছিল না, হচ্ছিল মেয়েদের কথা।
—বেশ। মেয়েদের কথাই বল। কী ভাবিস তোরা মেয়েদের?
—ছিঁচকাদুনে, রাগী, হিংসুটে, তিলকে তাল করা, তালকে তিল করা, কুচুটে …
—ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বলতে হবে না—শম্পা বলল। তার মুখে রাগ নেই। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট পড়া যায়।
—আরে শোনই না, তারপরে মেয়েরা সেলফলেস, স্যাক্রিফাইসিং, অ্যাডজাস্টিং, অসম্ভব টলারেন্স, একটু রক্ষণশীল। খুব নির্ভরযোগ্য।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝেছি … প্রথমে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে তারপরে তেল মারছিস। তুই যা বললি মানুষ সব মানুষই মোটামুটি এইরকম ভালমন্দের মিশ্রণ …
—এগজ্যাক্টলি। মেয়েরা আলাদা কিছু নয়। ঠিক ছেলেদেরই মতো। ধরন-ধারণগুলো একটু আলাদা, বুঝলি? নইলে এ-ও যেমন সময়ে কুচুটে, ও-ও তেমন সময়ে ক্লিকবাজ। আর এক্সপ্লয়েট করতে পেলে দুজনেই ছাড়বে না। যেমন দ্যাবা, তেমন দেবী। সুপ্রিয়াদি সুবিমলদাকে ভালমানুষ পেয়ে এক্সপ্লয়েট করছে, আবার আমার সমীরকাকু কাকিমাকে দুর্বল পেয়ে এক্সপ্লয়েট করছে। তবে ছেলেরা ছিচকাঁদুনে নয়।
—ছিঁচরাগুনে তা হলে …
—যা বলিস। আর একটা মস্ত ডিফারেন্স হল তোরা যেমন কাউকে পাকড়াও করতে পারলেই ঝুলে পড়তে চাস, ছেলেরা তেমন পাকড়িত হলেও পকৌড়ি হয়ে যেতে চায়।
—মানে?
—মানে ফুটে যেতে চায় আর কি! খাও, দাও, বেড়াও, এক্ষুনি আবার বিয়ে কী? অমনি তো বউয়ের দাঁত কনকন, পেট কনকন শুরু হবে। কে অত ঝামেলা পোয়ায়? বুঝলি না? তোদের চলনটা সেন্ট্রিপিট্যাল, আমাদেরটা সেন্ট্রিফুগ্যাল। কেন্দ্রা—ভিগ, আর কেন্দ্রা—তিগ বুঝলি তো?