Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতা || Bani Basu » Page 20

অমৃতা || Bani Basu

অমৃতা (Amtrita) – ২০

অক্টোবরের পনেরো তারিখে বাংলা পয়লা আশ্বিন, তার মায়েরও জন্মদিনে অমৃতার পুত্র জন্ম নিল। গভীর ক্লেশে, যন্ত্রণায়, অবশেষে যন্ত্রণার উপশম ঘটিয়ে। প্রসবান্তে অমৃতা অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মনে হচ্ছিল যে লোকটা এখন তার স্ত্রীকে হত্যা করবার চেষ্টার অপরাধে ভারতীয় পিনাল কোডের ৩০৭ ও ৩০৮ ধারা অনুযায়ী তিন বছর জেল খাটছে, সেই অরিসূদনের বংশধরের জন্ম দিচ্ছে সে। এক অনিচ্ছুক মা। ওই মাংসপিণ্ডের প্রতি তার বিন্দুমাত্র মমতা, দায়বদ্ধতা নেই। নিয়ে যাক ওকে কেউ ওর শয্যা থেকে রাত্রির অন্ধকারে, মানুষে অথবা কুকুরে, অমৃতা ফিরেও দেখবে না। একটা শয়তানের ছেলে। ওই শয়তানের জিন ওর শরীরে। শয়তানটা না কি আগেও একটা বিয়ে করেছিল। তখন থাকত উত্তরপাড়ায়, সেই বউকেও বিয়ে করেছিল অনেক যৌতুক নিয়ে, ঠিক এই একভাবে মেরে ফেলেছিল তাকে। এগুলো স-বই ঘটনা। কিন্তু কিছুতেই প্রমাণ করা যায়নি একেবারে ঠিকঠাক হত্যার উদ্দেশ্য ছিল তার বা স্বাভাবিকভাবে গর্ভপাত হয়নি। আগের বিয়ের খবরটা গোপন করেছিল, সেই গোপনতার জন্য চূড়ান্ত জেরার সম্মুখীন হয়েছে সে। আত্মপক্ষে তার বক্তব্য এক্ষুনি নাকি তারা সন্তান ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারবে না। তার মা অবসর নেওয়ার মুখে, বাবা বহুদিন অবসর নিয়েছেন, বাবা-মা ছাড়াও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে তার, আছে বাড়ি করার দেনা, বাবার কিছু দেনাও নাকি সে এখনও মিটিয়ে চলেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তানটা চমৎকার অভিনয় করছিল—অমৃতা, প্লিজ ফিরে এসো, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমাদের সন্তানকে আমরা যেমন করে পারি পালন করব। প্লিজ…

অমৃতা তখন কঠিন মুখে দাঁড়িয়েছিল, তার হালকা গোলাপি শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর দিয়ে বুকের ওপর টেনে, যদিও তার উদরের স্ফীতি নিয়ে তার কোনও লজ্জা সংকোচ ছিল না। সাক্ষীর কাঠগড়ায় সে এক উদাসিনী। তখন শয়তানটা বলে উঠেছিল,—আমি তোমাকে ভালোবাসি অমৃতা—সারা কোর্টঘর হেসে উঠেছিল, ডাঃ রঞ্জন কার্লেকর মুখ ঘৃণায় বিকৃত করে বিচারশালা থেকে চলে গিয়েছিলেন। এসেছিল তার বন্ধুরাও। স-ব ক্লাসবন্ধু। তিলক তো বটেই, আরও। চঞ্চল, নিশান, লাবণি, শর্মিষ্ঠা, অণিকা…সব স-ব। হাসিটা কি তিলকের নেতৃত্বে ওরাই হাসে? কে জানে? ছিলেন বাবা, মা, শিবানী মাসি, শম্পা, শম্পার বর… সব। ছিল না খালি দোলা।

—কী দিচ্ছে রে শালা, বলছে ভালবাসে। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। জজ বললেন—অর্ডার অর্ডার। এবং অরিন্দম ঘোষ সারাক্ষণ মুখে তীব্র কৌতূহল নিয়ে চেয়ে ছিল অরিসূদনের দিকে। তার অর্ধেক-নামধারী এই গিধ্‌ধড়টার জন্যে তার জীবনে মননে অনুভূতিতে সম্পর্কে কতকগুলো অনভিপ্রেত জট পাকিয়ে গেছে।

প্রসব হয় ভোররাতে। আন্দাজ চারটে, সাড়ে চারটে। তারপর সে বোধহয় মিনিট দশ পনেরো অজ্ঞান হয়েছিল। জ্ঞান ফিরে আসতে দুর্বলতায়, রক্তক্ষয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, কে জানে হয়তো ঘুমের জন্য কিছু দেওয়াও হয়েছিল তাকে। ঘুম যখন ভাঙল তখন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। ডাক্তারের রাউন্ডও শেষ। নিস্তব্ধ নার্সিংহোমে ঘরে ঘরে খাওয়া-দাওয়ার টুং টাং শোনা যাচ্ছে। অমৃতার ঘুম ভাঙল। সে দেখল জানলার নিচু পর্দার ওপারে শরতের নীল আকাশ, দু-এক টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কে জন্মাল? সে না ওই শিশুটি? তার মনে হল সে-ই নতুন করে জন্মাল। কী সুন্দর আকাশ, কী সুন্দর মেঘ আর তার ওই ধীর ভেসে যাওয়া! কোনও একটা ঝাঁকড়া গাছের মাথাও দেখা যাচ্ছে পর্দার ওপরের পটে। দুপুর আকাশে কয়েকটা চিল। পাখসাট মারছে। যেমন মারত তাদের মানিকতলার বাড়ির ছোটবেলার আকাশে। সুদ্ধু এইটুকু, এইটুকু দেখার জন্যেই বোধহয় মানুষ বারবার জন্মাতে পারে।

শরীরের ভেতরটা দুয়ে ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেছে। অরিসূদনের ছেলের জন্য। আর মনটা স্বস্তিতে সুখে শান্ত, পরিষ্কার হয়ে গেছে অরিসূদনের শাস্তিপ্রাপ্তির জন্য। এখন সে পুনর্বার কুমারী। একটা পুরো জীবনের জন্য প্রতীক্ষা করে আছে।

সিস্টার মাধুরী ঢুকলেন। বড় মাধুরী। ছোট মাধুরী দেখতে বেশি ভাল, বয়স কম। কিন্তু তার বড় মাধুরীকেই ভাল লাগে বেশি। ওঁর ওপর নির্ভর করা যায়। উনি জানেন। সব জানেন।

—কেমন লাগছে এখন?

—ভাল।

—খিদে পাচ্ছে?

—ভী-ষণ।

—মনে হচ্ছে আকাশ খাই পাতাল খাই?

অমৃতা হাসল।

—তবু আজ এ বেলা শুধু ক্লিয়ার চিকেন স্যুপ, আর চার পিস রুটি। মিষ্টি দিয়ে গেছেন মা, মাসি, বন্ধুরা, খেতে পারেন।

—ঠিক আছে—

—এবার বাচ্চাকে আনি!

—না। প্লিজ।

মাধুরী সেন হঠাৎ নরম গলায় বললেন—ওর ওপর রাগ করছেন কেন? ওর কী দোষ?

—না। রাগ করব কেন? অমৃতা একটু লজ্জা পায়।

—ফীড করতেও হবে আপনাকে। কালই দুধ এসে যাবে।

মাধুরী সেন চলে গেলেন। একটু পরে একটা চাকা-লাগানো ক্রিব টানতে টানতে নিয়ে এলেন অমৃতার খাটের পাশে। কাপড় জড়ানো শিশুটিকে তিনি অমৃতার কোলে তুলে দিলেন। অমৃতা অবাক হয়ে দেখল তার কোলে তার মা ছোট্টটি হয়ে শুয়ে আছেন। অরিসূদন বা অনুকূলচন্দ্র বা সুষমা, এমনকী তার নিজের সঙ্গেও কোনও সাদৃশ্য নেই ছেলের। একেবারে তার মা বসানো। অমনি টকটকে রঙ। মাথা-ভর্তি মিশকালো, কোঁকড়া চুল, লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটোতে অপূর্ব ঢেউ। চোখ বুজিয়ে আছে। কিন্তু চোখ মেললেই সেই অপূর্ব আকৃতির চোখ সে দেখতে পাবে তাতে তার আর কোনও সন্দেহই রইল না।

অমৃতার বুক টনটন করে উঠল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। আনন্দাশ্রু। সে দুর্বল হাতে বাচ্চাটাকে তুলে নিজের গালে ঠেকাল, বুকে ঠেকাল তারপর আবার কোলে নামিয়ে রেখে নির্নিমেষে চেয়ে রইল। মাকেও তো সে বারবার জননী স্নেহেই পালন করেছে। তার মা এক অসহায় বালিকা, যিনি ভুল করে চেয়েছিলেন, যা পেয়েছিলেন তা চাননি। সেই বিষাদ, সেই কারুণ্য সব সময়ে ঘিরে থাকত মাকে। ছোট্টখাট্ট মানুষটি। পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা হবেন না। কিন্তু এমন অনুপাত আর এমন সৌষ্ঠব তাঁর অঙ্গসংস্থানে যে দেখলে মনে হবে এই-ই ঠিক। এর চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্য ভাল নয়। মার যখন শরীর খারাপ হত মায়ের পথ্য তৈরি করা থেকে, বেডপ্যান দেওয়া, স্পঞ্জ করানো সব সে করেছে এগারো বারো বছর বয়স থেকে। তার আগে করতেন বাবা, বাবাকে কচি কচি হাতে সাহায্য করত সে বারবার। বাবা সে সময়ে খুব বিরক্ত হতেন, গম্ভীর মুখে বেডপ্যান দিতেন। বার্লিটা যখন গ্যাসের ওপর নাড়তেন তখন তাঁর মুখে কোনও প্রসন্নতা থাকত না। মা কুঁকড়ে যেত প্রকৃতির ডাক এলে। যতক্ষণ পারত চেপে থাকবার চেষ্টা করত। ঈশ্বরকে ডাকত করুণ অস্পষ্ট কণ্ঠে। কিন্তু ঈশ্বর তো আজ পর্যন্ত কাউকে বেডপ্যান দেননি। তাই শেষ পর্যন্ত বাবাকেই আসতে হত, যতদিন না অমৃতা তাঁর হাত থেকে এ কাজের ভার নিয়ে নেবার মতো বড় হল। বাবা যেন বাঁচলেন, খাতা আর টুইশনির পাহাড়ে তাঁর কাঁধ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ডুবিয়ে দিলেন। মা কিন্তু বাঁচল না, তার চুলে চোখে গালে হাত বুলিয়ে মা বলত—কী ভাগ্য করেই এসেছিলাম! কত পাপ ছিল গত জন্মের কে জানে! কিন্তু যেটুকু পুণ্য করেছিলাম, সেইটুকুই আমার মেয়ের রূপ ধরে এসেছে।

মা এইসব বললে অমৃতা আরও স্নেহাতুর, আরও জননী-জননী হয়ে উঠত, আরও যত্ন করে মায়ের খাবার তৈরি করত। মায়ের প্রশংসা, মায়ের প্রসন্নতার স্বাদই আলাদা। সে পড়ার টেবিলের পাশে টেব্‌ল-ক্লক নিয়ে বসত। ওষুধ খাওয়াবার সময়ের যেন একটুও এদিক-ওদিক না হয়। তবু হয়তো মায়ের আপন জননীর তৃষ্ণা মেটেনি। ষোলো সতেরো বছর বয়স থেকে আর দেখেননি তাঁকে। লোকমুখে শুনেছেন তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর কথা। সে শোক বুকে চেপে রেখে দিতেন। একটা ফটো পর্যন্ত ছিল না বাড়িতে। সেই জননীকে পাবার জন্যেই কি মা তোমার শিশু অংশটা আমার কোলে চলে এল?

—বাঃ, এরই মধ্যে দুধ এসে গেছে? —সিসটার মাধুরী খুব খুশি গলায় বললেন—অমৃতার ব্লাউজ তখন চুপচুপে ভেজা, বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। ব্লাউজটা পাল্টে দিলেন সিসটার। শিশুকে কোলে দিয়ে এক হাঁটুর নীচে বালিশ দিয়ে দিলেন, বললেন—খাওয়ান, এই ভাবে।

এবং অমৃতধারা একজনের বক্ষ থেকে আর একজনের মুখগহ্বরে বয়ে যেতে লাগল, নিচ্ছিদ্র, নিঃশব্দ স্রোতে, এমন একটা সম্বন্ধ সৃষ্টি হতে লাগল যা পৃথিবীতে বারবার হয়েছে মাতা আর সন্তানের মধ্যে, তবু যেন কখনও হয়নি। কেন না, কোথায় আর এমন মা আছে যে গর্ভাবস্থার প্রথমে তার শিশুকে বাঁচাতে চেয়েছিল, সবাইকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তারপর দিনে দিনে তার প্রতি উদাসীন হয়ে যায়, প্রসবের সময়ে যার হৃদয়ে ছিল শিশুর প্রতি দুরন্ত ঘৃণা, কিন্তু তাকে দেখবার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে স্বামী নয়, মাতৃমুখ আবিষ্কার করে যে এমন আপ্লুত হয়ে যায় যে সঙ্গে সঙ্গে উৎসারিত হয় অমৃত-স্রোত?

শিশুটি পুংলিঙ্গ, তবু তাকে খাওয়াতে খাওয়াতে অমৃতা মনে মনে বলতে লাগল—খাও মা খাও, সুস্থ হয়ে ওঠো শরীরে ও মনে, আনন্দে থাকো মা, আর ভেবোনা, আর কেঁদো না, এই তো আমি আছি।

বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ারে প্রথমেই এলেন শিবানী মাসি।

—কী রে কেমন লাগছে এখন?

—ভাল—সে হেসে বলল।

—দেখেছিস বাচ্চাটা অবিকল সীমার মতো হয়েছে?

—দেখেছি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকল বাবা-মা। দুজনেরই মুখে আলো জ্বলছে।—কেমন আছিস খুকি?

—তুমি কেমন আছ মা?

বিশ্বজিৎ বললেন—এইবারে নাতিকে তোর মায়ের কোলে ফেলে দে। ও ভাল হয়ে যাবে।

উপস্থিত সকলেই হাসলেন।

তৃতীয়জন এল অরিন্দম ঘোষ সঙ্গে লাবণি।

লাবণি এসেই ছুটে গেল বাচ্চাটার ক্রিবের কাছে।

—কী সুন্দর হয়েছে রে বাচ্চাটা! এইটুকু ছানা তো সাধারণত বাঁদর ছানার মতো হয়!

শিবানি মাসি বললেন—ওজন আট পাউন্ড তো! তাই মানুষের আকৃতিই পেয়েছে। মানে মানুষের ছানার।

সবাই হাসল।

লাবণি বলল—কিছু মনে করলি না কি রে তুই?

—দূর।

অরিন্দম যতক্ষণ রইল চুপ করেই রইল। এত চুপচাপ যে শিবানী মাসি ও অমৃতা দুজনেরই সেটা চোখে পড়ল।

অমৃতা বলল—কী ব্যাপার? অন্যদিন তো আপনার মুখে খই ফোটে। আজ এমন চুপ?

অরিন্দম শুধু হাসল। কিছুই বলল না।

চতুর্থজন এল তিলক।

—কী রে? তোকে কবে ছাড়বে? লেখাপড়া শুরু করতে হবে তো! নাকি এখন থেকেই জননী জন্মভূমিশ্চ হয়ে গেলি?

অমৃতা বলল—একটু তর দে আমাকে! আমার অবস্থাটা বোঝবার জন্যে তোরও একটা বাচ্চা হওয়া দরকার। তোর নিজের গর্ভে।

এ সময়টা বড়রা নীচে গিয়েছিলেন।

অমৃতার কথায় অরিন্দম পর্যন্ত হেসে উঠল।

তিলক বলল—যাক বাবা, ইয়ার্কি-ফাজলামির পরিচিত ওয়ার্ল্ডে ফিরিয়ে আনতে পারলুম তোকে।

—তুই পারলি? তুই কে রে? আমি নিজে ফিরেছি।

অরিন্দম এইবার বলল—উঁহু! আপনার ওই বাচ্চাটা আপনাকে ফিরিয়েছে।

চতুর্থজন এলেন জয়িতাদি। লাবণি পালাল।

—অমৃতা!!!

সেই যেদিন তাকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির মুখে ধমকে ছিলেন, তারপরে এই দেখা।

নিচু হয়ে তার কপালে গালটা একটু ছোঁয়ালেন উনি। তারপর তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে বললেন—না, না। এখন তোমার কাছে যাওয়াটা ঠিক না। তোমাকে একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, কিন্তু পার্ফেক্টলি নর্ম্যাল। তাই তো?

—হ্যাঁ ম্যাডাম, একটু দুর্বলতা শুধু

—ম্যাডাম-ট্যাডাম আবার কী? এটা কি আশুতোষ বিল্ডিং না তার তিনতলার ঘর, না তার সেন্টিনারি বিল্ডিং?

—জয়িতাদি—অমৃতা হাসিমুখে বলল।

—বাচ্চাটা কই? দেখতে পারি?

—ওই তো! মশারি-ঢাকা ক্রিবটার দিকে দেখাল তিলক।

জয়িতাদি একা একা গেলেন কোণটায়, মশারির চালের ওপর মুখ রেখে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে এসে বললেন—এ তো একটা দেবশিশু?

তিলক বলল—অমৃতার পুত্র তো?

অমৃতা বলল, সব শিশুই তো দেবশিশুই দিদি!

—হেভ্‌ন লাইজ অ্যাবাউট আস …

জয়িতাদি আস্তে আস্তে বললেন। বলতে বলতে কেমন দীর্ঘশ্বাসে মিলিয়ে গেল কথাগুলো। তারপর তার কাছে এসে আর একবার কপালে হাত ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বললেন—যখন যা দরকার হবে বলো। একটু থেমে বললেন … শুধু পড়াশোনার ব্যাপারে নয়। একটা প্যাকেট রাখলেন তিনি অমৃতার মাথার কাছে।—এবার যাই?

তিলক ওঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। একা অরিন্দম।

অমৃতা বলল—আপনি এত চুপচাপ যে! কী হল?

অরিন্দম একটু ইতস্তত করে বলল—না, আসলে আপনার পার্সন্যালিটিটাই বদলে গেছে। যেন আপনাকে চিনতে পারছি না।

—আপনি কি তবে ভেবেছিলেন দুঃখ প্লাস বিষাদ প্লাস বিপদ ইকোয়াল টু অমৃতা?

—না, না, কখনওই না। তীব্রস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল অরিন্দম।

লাবণি এই সময়ে ঢুকে ব্যস্তভাবে বলল—চলো অরিন্দম, যাবে না? —লাবণি আজকাল মা-বাবার আড়ালে অরিন্দমকে ‘তুমি’ বলে।

অরিন্দম তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, বলল—আজ আসি?

নার্সিংহোমের করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল এই সুখ, এই ব্যক্তিত্ব যেন সে কোথায় দেখেছে, কোথায়? কিছুতেই মনে করতে পারছে না। লাবণিকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ফিরতে ফিরতে সে চিন্তা করছিল। পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গির ক্রসিং-এ পেয়ে গেল। আকারগত কোনও সাদৃশ্য নেই। কিন্তু যাঁর সঙ্গে অমৃতার মিল আজ সে দেখেছে তিনি হলেন ভার্জিন মেরি। সেই কুমারী মাতা, সান্‌ৎসিও রাফেইল্লোর আঁকা।

ডক্টর কার্লেকর ঢুকেই বললেন—সে কী! এত ফুল কেন? সিসটার সরান, সরান। বাচ্চাটার ক্ষতি হবে।

—বাচ্চাটাকেই বরং নার্সারিতে সরিয়ে দিই। আপনার পেশেন্টের ফুল খুব ভাল লাগছে।

—তা তো লাগবেই। আমার ঘরেও দু-চারটে পাঠিয়ে দিতে পারেন। কী অমৃতা আপত্তি আছে?

পরীক্ষা করার পর, মাধুরী সেন চলে গেলে, অমৃতা বলল—ডক্টর আমার জন্য পাঠানো ফুল কেন, আমি নিজেই তো আপনাকে ফুল দিতে চাই।

—কোথায় পায়ে? পুজো-টুজো করবে না কি?

—করাই তো উচিত।

—আচ্ছা এবার ভাল করে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।

ডাক্তার চলে গেলে সে জয়িতাদির প্যাকেটটা খুলল—গোটা ছয়েক নানান রঙের ঝাপলা। এক প্যাকেট ন্যাপি। কয়েকটা সুন্দর নরম তোয়ালে, আর একটা কাঁচা হলুদ রঙের উলের সেট—জামা, টুপি, মোজা। সব কিছুর তলায় একটা অফ হোয়াইটের ওপর ছোট ছোট নীল মোটিফ-অলা নরম ছাপা শাড়ি। এই উলের সেট কি জয়িতাদি নিজেই বুনেছেন?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress