অমৃতা (Amtrita) – ১৯
তিলক যেমন দোলাকে দেখেছিল, দোলাও ঠিক তেমনি তিলককে দেখতে পেয়ে যায়। মানুষই চোখের কোনা দিয়ে, আবার অনেক সময়ে সোজাসুজি না তাকিয়েও দেখতে পায়, এ সেই রকমের দেখা। কিন্তু তখন সে রাস্তা পার হচ্ছে, তিলকের মতো বাসন্তী দেবী কলেজের গায়ে সেঁটে যাওয়ার উপায় তার ছিল না। আগে ট্যাক্সি থেকে দেখতে পেলে, আর একটু সাহসী হয়ে বিজন সেতুটা পার করে দিতে বলত সে অমিতকে। এমনিতে দেখা হয়ে গেলে সে এতটা বিব্রত হয়ে পড়ত না। শম্পার সঙ্গে যখন পার্ক স্ট্রিট-রাসেলের মোড়ে দেখা হল তখন তো শম্পাকে সে আইসক্রিম পার্লারে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলই। কিন্তু আজকে তার মন খিঁচড়ে ছিল। ট্যাক্সিটাকে তারা ধরে ঠিক সন্ধের মুখে, বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে চলে যায় কোনা এক্সপ্রেসওয়ের মুখ পর্যন্ত। আবার ফেরে, তারপর জু গার্ডেনের পথে বেলভেডিয়ার আলিপুরের নির্জন রাস্তাগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বড্ড বেশি সাহসী হয়ে উঠেছিল অমিত। অতিরিক্ত। দোলার শরীর টং টং করে সরোদের মতো বাজছিল। বাধা দেবার কোনও ক্ষমতাই ছিল না। ইচ্ছেও না। কিন্তু এই সময়ে ট্যাক্সিচালক বলে ওঠে আপনারা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। হোটেলের ঘরে-টরে এসব করগে যান না, বেশ্যাদের তাই তো দস্তুর। আমার ট্যাক্সি ভদ্দরলোকের ট্যাক্সি।
অমিত তেড়ে উঠে বলেছিল—মুখ সামলে কথা বলবে। কে তোমার পরামর্শ চেয়েছে। এক্ষুনি থামাও, তোমার গাড়ি থেকে নেমে যাব আমরা।
—সেই ভাল, ট্যাক্সিচালক বলে, নইলে আমি সিধে আপনাদের আলিপুর থানায় নিয়ে যাব।
তারা ভাড়া চুকিয়ে নেমে যেতে ট্যাক্সিচালক হঠাৎ দোলার দিকে তাকিয়ে বলে— আপনারে তো বাইরে থেকে বেবুশ্যে বলে প্রত্যয় হয় না। সেকালে ওই ছোকরাটাই বেবুশ্যে। খানকি একটা!
হুস করে গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিল তার পর।
আরেকটা গাড়ি ধরতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তখন দোলার চোখ দিয়ে ক্রোধ ও অপমানের অশ্রু গড়াচ্ছে। অমিত ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে অনেকভাবে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল, পারেনি।
তখন আপনমনে অমিত বলেছিল—ট্যাক্সির এই ধরনের ব্যবহার তো আজ নতুন নয়, অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাই এভাবে ট্যাক্সিতে…এমন কি নববিবাহিত দম্পতিরাও, শুধু কলগার্ল আর তাদের ক্লায়েন্টদের সম্পত্তি নয় ট্যাক্সি, এ লোকটা অমন ভাবে রি-অ্যাক্ট করল কেন? আসলে ও নিজেও এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছিল বুঝলে? নিজে পাচ্ছে না। অন্যে পাচ্ছে!
ক্রোধ ও লজ্জার বদলে ঠাণ্ডা মাথার এই বিশ্লেষণে দোলার মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। কিন্তু আর একটা কথাও সে বলেনি। বাড়ি ফিরে প্রথমেই বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়েছিল, সাবানের চন্দন গন্ধে অশ্লীল শব্দগুলোর নোংরা যেন নিজের গা থেকে ধুয়ে ফেলবে। কিন্তু স্মৃতিকে তো ধোওয়া যায় না। বাথরুম থেকে যখন বেরোলো মা অবাক হয়ে বলল—এই বাদুলে সন্ধেয় মাথা ভেজালি? সে উত্তর দিল না। মা বিরক্ত হয়ে বলল—তোর কী হয়েছে বল তো? কার সঙ্গে ঝগড়া করে এলি? তিলক লাবণি?
মুহূর্তে মায়ের জন্য করুণায়, আর নিজের জন্য অকথ্য গ্লানিতে মন ভরে গেল তার। বেচারি মা, এত বয়স, এত অভিজ্ঞতা, একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, নাতিপুতি হল বলে, কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারে না। দোলা অনেকদিন ধরেই এ রকম অনিয়মিত আসা-যাওয়া করছে, আয়নায় চেয়ে দেখলে নিজের চোখের তলায় অনিয়মের কালি দেখতে পায় সে। খেতে পারে না ভাল করে। বেশি কথা বলে না কারও সঙ্গে। মা, বাপি কেউ তার এই পরিবর্তনকে অস্বাভাবিক মনে করেনি। বাপি সেদিন বলল—পরীক্ষাটাকে অত সিরিয়াসলি নিসনি দোলা। এ আবার কী ধরনের নার্ভাসনেস? টেক ইট ইজি, টেক ইট ইজি।
মা বলল—পুজোর সময়ে চলো কোথাও ঘুরে আসি। কদিন একটু ফ্রেশ হয়ে নেবে। তারপর পরীক্ষাটা শেষ হলে বেশ বড় করে বেড়ানো যাবে। কী রে দোলা? দোলা ঘাড় নেড়ে ছিল।
প্রেম তা হলে মানুষকে এমনি একা করে দেয়? মনটা হু হু করে ওঠে তার, এই মা, এই বাপি, এই বাড়ি, ওই জানলা সবই কেমন অবান্তর হয়ে গেছে আজকাল তার কাছে। কেমন উদ্বৃত্ত, অদরকারি! যে মা বিশেষত বাপিকে সে চক্ষে হারাত, তাদের এখন অল্প চেনা মানুষ বলে মনে হয় তার। মা গা ঘেঁষে দাঁড়ালে তার বিরক্ত লাগে, বাপি মাথায় হাত রাখলে অস্বস্তি হয়। আর সত্যিই তো পরীক্ষা এগিয়ে আসছে।
দোলা বই খুলে বসে, অক্ষরগুলো পোকার মতো হেঁটে যায় তার চোখের সামনে দিয়ে টেব্ল-ল্যাম্পের আলোর বৃত্তের মধ্যে। বইয়ের পাতায় মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ তাকে খেতে ডাকতে এসে তার মায়ের হৃদয় দ্রব হয়ে যেতে থাকে। উঃ কী খাটুনিই না যাচ্ছে মেয়েটার! কী যে সিলেবাস করে এরা।
তাঁদের সময়েও আটটা পেপার ছিল। একসঙ্গে পরীক্ষা দিতে হত। একদিন অন্তর অন্তর। একেবারে নিয়ম করে। এখন তো তবু দুটো পার্ট। নভেম্বরে চারটে পেপার আর দিতে হবে দোলাকে। পার্ট ওয়ানটাতে ফিফটি ফাইভ পার্সেন্ট রাখতে পারেনি। আজকাল মুড়িমুড়কির মতো ফার্স্ট ক্লাস বেরোয়। সে জায়গায় ফিফটি-ফাইভ-ও না হলে দোলার মান থাকবে না। তাঁর ইচ্ছে এম.এ. করে দোলা কিছু কাজ-টাজ করুক। একটা টি.টি ট্রেনিং নিয়ে নিলে অনায়াসে তাঁদের স্কুলে নিয়ে নিতে পারা যায়। তাঁর কিন্ডারগার্টেন ট্রেনিং আছে। তিনি নার্সারি, কেজিগুলো দেখাশোনা করেন, তার ওপরের গুলোতে দোলা পড়াবে। মা মেয়ে দুজনে বেশ একসঙ্গে স্কুলে যাবেন। বড়মেয়ের বিয়েটা বড্ড তাড়াতাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। কথাবার্তায় ধরন ধারণে সে যেন এখনই সাত গিন্নির এক গিন্নি। রান্না, শাড়ি, পরচর্চা, বরের চাকরি এ ছাড়া আর ভূ-ভারতে কোনও কিছুতে আগ্রহ নেই। দোলাটা আর কিছুদিন কুমারী জীবনযাপন করুক। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুখ স্বাধীনতা উপভোগ করুক।
তিনি সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকলেন—দোল। খাবি না! আয় টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছে।
দোলা তেমনি ঘুমিয়ে যেতে লাগল। মাথাটা জোর করে একটু তুলতে গেলেন তিনি। বই, বইয়ের পাশে খাতা। খাতার লেখাগুলোর কালি জলে ধেবড়ে গেছে। বইয়ের পাতাও ফুলে উঠেছে। দোলার নাকের পাশে চোখের জলের নুন শুকিয়ে রয়েছে।
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।—অমৃতা! অমৃতাকে আজও পাওয়া যায়নি। দোলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কাঁদছে তার জন্যে। তিনি জানেন দোলার কাছে অমৃতা কী! ওর পরামর্শদাতা, বন্ধু, শ্রদ্ধামিশ্রিত একটা বন্ধুত্ব বোধ আছে দোলার অমৃতার জন্যে। এমনিতে তাঁর মেয়ে খুব খোলামেলা। কিন্তু ইদানীং ও অমৃতার কথা বলতই না। কথা তুললেও চুপ করে যেত। বেদনা যখন গভীর থেকে আরও গভীরে চলে যেতে থাকে তখন এই ধরনের গুমোট নেমে আসে একটা মানুষের মেজাজে। অমৃতার জন্য তিনিও কম উদ্বিগ্ন নন। একজন মা বলে, একজন নারী বলেও। কিন্তু দোলার সঙ্গে কি আর তাঁর উদ্বেগের তুলনা চলে? ইস্স্ কত কালো রোগা, গম্ভীর, আনমনা হয়ে যাচ্ছে তাঁর আদরের মেয়েটা।
—দোলা, দোলা,—এবার জোরে জোরে ডাকলেন তিনি।
দোলা আধখানা চোখ মেলল, লাল চোখ।
—চল, খাবি চল।
—ন্না!
—না বললে হয়?
—খিদে নেই।
—এমন কোরো না দোলা। বসবে তো চলো, বাপি কতক্ষণ ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এ-সো—তিনি একটা টান দিলেন দোলার কাঁধে।
—উঃ, এমন জবরদস্তি করো না! একটুও ভাল্লাগে না।
খুব অনিচ্ছুক পায়ে উঠে গেল দোলা। খেতে তার গা বমি-বমি করছিল।
পরের দিন মা-বাপি বেরিয়ে গেলে যখন অমিতের ফোন এল, সে রুক্ষ গলায় বলল—আমি মাঠে-ঘাটে আর ঘুরতে পারব না। আমাদের বাড়িতে এসো। মায়েদের সঙ্গে কথা বলো।
—কী কথা?
—কী কথা মানে? ব্যাঙের মাথা।
দোলা ফোন রেখে দিল। য়ুনিভার্সিটি চলে গেল।
পর দিন আবার ফোন। মা বাড়ি ছিল। মা-ই ধরেছিল। বলল—তিলক ফোন করছে। তোদের য়ুনিভার্সিটির।
দোলা সত্যিই ভেবেছিল তিলক।
তিলকের আবার আমাকে কী দরকার পড়ল? ফাজিল একটা… ফোন ধরতেই ও পাশ থেকে গাঢ় গলা ভেসে এল—দোলা, দোলা, দে দোল দোল, এ মহাসাগরে তুফান তোল, বঁধূরে আমার পেয়েছি এবার ভরেছে কোল…
—কী হচ্ছে? দোলার গলায় ভাবের ছোঁয়া লেগেছে।
—প্লিজ দোলা, মনে হচ্ছে কতদিন দেখিনি।
—আমার যা বলবার বলে দিয়েছি তো! পড়াশোনা নেই? তোমার চাকরি নেই? — আড়চোখে মা চলে গেছে দেখে সে বলল।
—কাজ যার যার সে তো আছেই। আমি তো চিনসুরায় ট্যুর করব, আর তুমি তো লাইব্রেরি যাবে। যাবে না?
—না।
—শনিবার, তোমার ক্লাস নেই, আমারও হাতে সময় আছে। একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব তোমাকে। দেখলে ভী-ষণ অবাক হয়ে যাবে, খুশি হবে।
—কোথায়? তাজ বেঙ্গল?
—দূর পেটুকরাম, দেখোই না, তাজ বেঙ্গল নয় একবারে রয়্যাল বেঙ্গল।
সেই রয়্যাল বেঙ্গলেই আজ এসেছে সে। সল্টলেকের পূর্বাচলে একটা চমৎকার বাংলো বাড়ি। একটা অপরূপ ঘাসের লন পেরিয়ে, কয়েকটা সুদৃশ্য ধবধবে সিঁড়ি পেরিয়ে একটা আয়না পালিশের দরজা। তাতে পেতলের ওপর কাজ করা মোটা হাতল। দরজার মাঝখানে একটা পেতলের ভেনাস বসানো। সগর্বে তালা খুলল অমিত। শেষ দুপুরের ঝিমিয়ে পড়া আলোয় যেন স্বপ্নলোক উঠে এল। এ ঘরের সেন্টার টেবল হল একটা মস্ত তামার টাট, কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর আদর করে বসানো। চার পাশে নরম কোরা রঙের সোফাকৌচ, তাতে ঝলসাচ্ছে কতকগুলো নানান ডিজাইনের কুশন। চমৎকার একটা কোরা, লাল, খয়েরির কার্পেট তলায়। পর্দাগুলোও কোরার ওপর ছোট্ট ছোট্ট ডিজাইন। পাশে পাশে সুন্দর নিচু নিচু শোকেস নানান উচ্চতার, কোনওটাতে বই, কোনওটাতে ক্রিস্ট্যাল, কাট গ্লাস, কোনওটাতে নানান জায়গা থেকে সংগ্রহ করা শিল্পদ্রব্য। প্রায় প্রত্যেকটা কেসের মাথায় পাশে পোড়া মাটি, ব্রঞ্জ, কি পেতলের আধারে সবুজ পাতা মেলা গাছ। একটা দেওয়ালে একটা বিরাট ছবি। মধুবনীর। নানান গ্রাম্য কাজকর্মের নকশা তাতে। তার ঠিক তলায় একটা লম্বা বেতের ডিভান। আর একটা দেয়ালে লম্বিত স্ক্রোল একটা। অজন্তার বুদ্ধ রাহুল যশোধরার।
সিডি প্লেয়ারের মধ্যে রেকর্ড পুরে চালিয়ে দিল অমিত। অমনি মধুর সেতারের আওয়াজে ঘরের দিবানিদ্রা ভেঙে গেল। চমকে উঠে এ ওর দিকে চেয়ে হাসতে লাগল গাছগুলো। পাখার হাওয়ায় সামান্য একটু দুলে উঠছে ওদের পাতা।
—কার বাড়ি এটা?
—ধরো যদি আমাদের হয়?
—ধরতে হবে কেন?
—যদি হয়। তুমি খুশি হবে?
দোলা কিছু বলল না, তার মুখে আবেশ।
—বিলায়েৎ, না?
—ওহ, ইয়েস।
—বলো না কার বাড়ি?
—আমার এক বন্ধুর, থাকে কানাডায়, এখানে একটা আস্তানা করে রেখেছে। যখন কালে-ভদ্রে আসে, এখানে থাকে। শোভাবাজারে সাবেক বাড়িতে একগাদা লোকজন, নোংরা, চেঁচামেচি—থাকতে পারে না।
—কে দেখাশোনা করে?
—কেয়ার-টেকার আছে। আমি আবার কেয়ার-টেকারের কেয়ার-টেকার আছি। একটুও মনে হচ্ছে, এ বাড়িতে কেউ থাকে না?
—সত্যি! গাছগুলো!
—সব আর্টিফিশিয়াল। বাইরে থেকে আনা। অন্য ঘরগুলো দেখবে?
—চলো।—দোলা এমন উৎসাহের সঙ্গে বলল যেন সে সত্যিই কিনবে বা ভাড়া নেবে বলে বাড়ি দেখতে এসেছে।
ডাইনিংরুমে সব বেতের আসবাব। বেতের ডিনার টেবল, চেয়ার, বেতের সাইড-বোর্ড, যামিনী রায়ের ছবি দেওয়ালে, সুইচ টিপতেই একটা স্বপ্ন-আলো নেমে এল ঘরটায়। টেবলের ঠিক ওপরে লাল কোনাচে শেডের বাতি জ্বলছে। টেবিল সাজানো।
—ও মা। কার জন্যে?
—তোমার জন্যে দোলা, আমাদের জন্যে।
—কে সাজাল?
—কেয়ার-টেকারকে বলে দিয়েছিলাম। ও এনে সাজিয়ে গেছে। ক্যাসেরোলে রয়েছে খাবারগুলো। মাইক্রো-ওয়েভও রয়েছে। কিন্তু ঠাণ্ডা হতে দেবে কেন?
—দূর, কে এখন অত সব খায়! আগে বলোনি কেন?
—বাঃ, তুমি যে তাজ বেঙ্গলের নাম করলে? তাজ-এ কি কেউ শুধু আড্ডা মারতে যায়? নাও হাত ধুয়ে নাও।
চিকেন ফ্রায়েড রাইস, আর গার্লিক প্রন ছিল। অল্প একটু খেল ওরা। ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বার করে আনল অমিত। দোলা হেসে বলল—এতক্ষণে একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলে। পূর্ণ চোখে তার দিকে চেয়ে আছে অমিত। দোলা দেখল অমিত কী অসহ্য সুন্দর! চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। ঘিয়ে রঙের একটা টি শার্ট পরেছে, একটা চকলেট রঙের জিনস। সুন্দর একটা আফটার শেভের গন্ধ সব সময়ে ঘিরে থাকে ওকে। মুগ্ধ একরাশ চুল, ইন্দ্রজালময় চোখ দুটো, টসটসে ঠোঁট দুটো। যেন একটু টোকা মারলেই মধু ঝরবে।
—আর ঘরগুলো দেখবে না?
—আর কটা রুম আছে?
—বাঃ, বেডরুম আছে, লাইব্রেরি বা স্টাডি যা-ই বলো আছে একটা, একটা গেস্টরুমও আছে।
স্টাডিটা দেখেও দোলা অবাক। এত বই! পুরনো কালের স্টাইলের টেবল চেয়ার। বড় বড় রাজস্থানি কাজ করা পট। মাটির পট। মেহগনি রঙের সব বুক কেস বইয়ে ভর্তি। ফুল সেট রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়র, সংস্কৃত-সাহিত্য সম্ভার, ম্যানশনস অফ ফিলসফি, পুরো সেট হেমিংওয়ে। কত? কত?
—খুব পড়ুয়া তোমার বন্ধু, না?
—আরে দূর। সোনার জলে দাগ পড়ে না, খোলে না কেউ পাতা। যখন আসে, সময় কাটাবার জন্যে হয়তো একটু-আধটু পড়ল। এ সবও আসবাব।
—তাই?
—আবার কী? এসো বেডরুমটা দেখো!
—ন্ না।
একটি একলা পুরুষের বেডরুম দেখতে দোলার কেমন লজ্জা বোধ হল। সে বলল—আমরা বাইরের লোক, বাইরেই থাকি। যা দেখেছি তা-ই যথেষ্ট সুন্দর। আর সুন্দর দেখে কাজ নেই।
—অ্যাজ ইউ প্লিজ ম্যাডাম।
ওরা বসবার ঘরে বসে বাজনা শুনতে শুনতে মৃদু স্বরে গল্প করতে লাগল।
—আমার ওপর খুব কি রাগ করেছ?
—খুব না হলেও বেশ।
—কেন?
—এ ভাবে আমাকে মুগ্ধ করবার, সম্মোহিত করবার কী অধিকার তোমার আছে?—দোলা জল চকচকে দু চোখ মেলে বলল।
—দোলা!—দু হাতে দোলাকে বুকে টেনে নিল সে।
—সেদিন ওই কুৎসিত পরিস্থিতির জন্যে তোমার কাছে আমি কী ভাবে মাফ চাইব? দোলার কোলে মুখ ডুবে গেল।
দোলার হাত মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চকচকে নরম চুলের ওপর। তার দুই উরুর অতীব স্পর্শকাতর সংযোগস্থলে ওর মুখ। ও মুখ ঘষছে।
—ওঠো। মুখ তোলো, তোলো প্লিজ..দোলা ওকে জোর করে তুলতে গেল। ও মেঝেতে কার্পেটের ওপর এখন। দোলা স্পর্শকাতর সোফায়। দু হাত দিয়ে দোলার কোমর জড়িয়ে ও তাকে ঘনিষ্ঠভাবে মৃদু আকর্ষণ করছে। তার হালকা সমুদ্র-সবুজ ওড়না খসে গেল।
—ওঠো, অমিত! খুব ক্ষীণ এখন তার কণ্ঠ। খুব কাতর। সে একটা কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। টলমল টলমল করছে।
কেমনভাবে যে দুজনের স্থান অনবরত বদলাতে লাগল, অমিত বুঝল কি না কে জানে, দোলা কিন্তু বুঝল না। সে একটা সমুদ্রের ব্রেকারের মাথায় চড়েছে, দুলছে, কখনও ওপরে, কখনও নীচে, কখনও সু-উচ্চ শৃঙ্গে, কখনও আবার দুই ব্রেকারের মধ্যবর্তী বিপজ্জনক খাতে। দাঁড়িয়ে এবং শুয়ে এবং বসে পাশাপাশি, মুখোমুখি, যতরকমভাবে পারা যায় তারা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। হচ্ছে তো হচ্ছেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না দোলার সমস্ত চেতনা, সমস্ত প্রতিরোধ কূলপ্লাবী সমুদ্রস্রোতের মধ্যে হারিয়ে যায়। কখন যে অমিত তার মধ্যে প্রবেশ করেছে সেই নির্দিষ্ট ক্ষণটা পর্যন্ত সে বুঝতে পারেনি, এত বেসামাল এত অভিভূত ছিল।
অবশেষে প্রথম বিদ্ধ হবার সূচীমুখ যন্ত্রণা তাকে কিছুটা জাগিয়ে দিল। সে অস্ফুটে বলল—প্লিজ, অমিত প্লিজ।
এ কি তার সম্মতি না অসম্মতি সেটা পর্যন্ত রহস্যে রইল। এবং তারপর চূড়ান্ত হর্ষের শিখরে দুজনে কাঁপতে কাঁপতে উঠে গেল দমকে দমকে।