অমৃতা (Amtrita) – ১৭
প্রোফেসর জয়িতা বাগচির কাছে অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়তে যায়। তিনি সেভাবে কোচিং করেন না। কেউ জানেও না তিনি কোচিং করেন। দু-চারজন ছাত্র-ছাত্রী থাকে নাছোড়বান্দা। ক্লাস থেকে বেরোচ্ছেন— জয়িতাদি! স্টাফরুম থেকে বেরোচ্ছেন—জয়িতাদি! লাইব্রেরিতে ঢুকছেন— জয়িতাদি! এই নাছোড়বান্দাগুলোর মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি পাত্তা দেন। পড়ানোর জন্য বেশ উচ্চ ফি নিয়ে থাকেন। এরা অন্যদের লুকিয়ে টুকটুক করে জয়িতাদির বাড়ি যায়। পড়ে। নোট্স্ নেয়। তিলক এদের মধ্যে একজন। সে বেচারি মরিয়া হয়ে গেছে আসলে। পড়ছে বাংলা, এদিকে ছেলে, কোথাও কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। চাকরির দরখাস্ত সে এখন থেকেই পাঠাতে শুরু করেছে, কম্পিউটার শিখছে। কিন্তু একটা কথা—বিষয়টা পড়তে তার সত্যি-সত্যি ভাল লাগে। এই ভাল লাগাটা অদ্ভূত। তার বয়সী বেশির ভাগ ছেলের সঙ্গেই মেলে না। কিন্তু তার এই ভাল লাগাটা জীবনে কোনও কাজে আসবে না— ভাবতে তার খুব খারাপ লাগে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবেও সে পাঁচশো টাকা দিয়ে জয়িতাদির কাছে পড়তে যায়। সপ্তাহে একদিন। একজন অধ্যাপক হতে গেলে কী এবং কতটা আয়ত্ত করতে হয় সেটাই সে জয়িতাদির কাছ থেকে জেনে নিতে চায়।
জয়িতাদির ক্লাসের পড়ানোটা অন্য রকম। সেটা যেন একটা পারফর্ম্যান্স, যেমন গায়ক গান করেন, নট অভিনয় করেন একটা পরিশীলিত, মার্জিত, বহুদিনের অভ্যাসে রপ্ত ব্যাপার। সেটা একটা শোনবার জিনিস। এত তাড়াতাড়ি একটা ভেতরের ভাললাগার তোড়ে বলে যান তিনি ছাত্র-ছাত্রীরা বেশির ভাগ সময়েই স্তব্ধ হয়ে শোনে। বিশদ নোট নিতে পারে না, কেননা তাতে করে রস উপভোগের বাধা হবে। টেক্সট হলে তার মার্জিনে, না হলে দু-চারটে কথায় তারা ধরে রাখতে চায় এই ম্যাজিক। কিন্তু বাড়িতে পড়ানোর সময়ে জয়িতাদি একটু একটু করে ইট গাঁথেন, সযত্নে লাগান সিমেন্ট, পলেস্তারা। সেটা থেকে শেখার সুবিধে হয়।
জয়িতাদির বাড়িতে যেতে কোনও অসুবিধেও নেই। আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে সল্টলেক সেক্টর থ্রি খুবই কাছে। কিন্তু অসুবিধেটা অন্য জায়গায়। জয়িতাদি হয় তো পড়াচ্ছেন, খুব মনোযোগ দিয়ে তারা লিখে রাখছে সব। জয়িতাদির স্বামী প্রোঃ সুপ্রতীক বাগচি, ভেতর থেকে হাঁক পাড়বেন— জয়িতা! জয়িতা!
হন্তদন্ত হয়ে জয়িতাদি চলে যান। কোনও দিন পাঁচ মিনিট, কোনও দিন দশ মিনিট, কোনও দিন তারও বেশি সময় চলে যায়। অনেক সময়ে ভেতরে একটা চাপা কথা কাটাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। একটু পরে হয়তো অধ্যাপক সুপ্রতীক বাগচি বেরিয়ে যান। জয়িতাদি আবার এসে বসেন।
সেদিন তিলক গেছে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে। ভিজে ভিজে সে যখন পৌঁছল জয়িতাদির বাড়ির জানলাগুলো বন্ধ। সে বেল দেবার প্রায় পাঁচ মিনিট পরে দরজাটা খুলে দিলেন জয়িতা বাগচি নিজেই।
—ও তুমি এসেছ? এ কি? ভিজে গেছ যে একেবারে।
—হ্যাঁ এলোমেলো ছাঁট ছিল তো!
—এত ভেজা অবস্থায় আজকে নাইবা পড়লে তিলক। আর কেউ আসেওনি। উনি বসবার ঘরের আলো জ্বেলে দিতে দিতে বললেন।
—ঠিক আছে। তিলকের একটু একটু শীত অবশ্য করছিল। কিন্তু ভেজা জায়গাগুলো পাখার তলায় কিছুক্ষণ বসলেই শুকিয়ে যেত! মাসে পাঁচ শ’ টাকা! দিদি তো অন্য কোনও দিন আর দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। জয়িতাদি বললেন—অনেকদিন ধরে তোমায় একটা কাজ দেব ভাবছি। করবে?
—কেন করব না? বলুন।
—আমি তোমাকে একটা প্যাকেট দেব, তুমি সেটা অমৃতাকে দিয়ে আসবে?
—অমৃতা? তিলক হাঁ হয়ে গেছে।
—শোনো ও বেঁচে আছে, ভালই আছে, সমস্ত ব্যাপারটা সম্ভবত একটা পারিবারিক ষড়যন্ত্র, যার থেকে ও কপালজোরে বেঁচে গেছে। ও যেখানে আছে সেখান থেকে ও আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ করে। কিন্তু ও বেরতে পারে না। নিরাপত্তার জন্য, বুঝতেই পারছ। এই প্যাকেটটা ওর কাছে পৌঁছে দিলে ওর খুব উপকার হবে। আমারও মনে হবে আমি একটি অসহায় বিপন্ন মেয়ের জন্য কিছু করতে পারলাম।
অমৃতা বেঁচে আছে এ খবর সে অরিন্দমদার কাছে শুনেছে। কিন্তু জয়িতাদির সঙ্গে তার যোগাযোগ, জয়িতাদির হঠাৎ অমৃতার উল্লেখ সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে জয়িতাদি সবে পেছন ফিরে দরজা বন্ধ করছেন সুপ্রতীকবাবুর গলা শুনতে পেল তিলক।
—মানে কী এর? মানে কী? দিলে কী ওটা? নোট্স? ওটা তো তোমার-আমার করা বেস্ট নোট্স—ওইগুলো দিয়ে দিলে?
জানলার মধ্যে থেকে আসছে কথাগুলো।
—তোমার আর কী করা? আমারই। আমি বুঝেছি দিয়েছি। কোনও কোনও সময়ে একটু অতিরিক্ত করতে হয়, যেমন তোমার জন্যে করেছিলাম।
—তোমার এই কথা আমি নিজের থুতু গেলানোর মতো করে গেলাব তোমাকে একদিন।
—গেলাও না। আমার চেয়ে বেশি শান্তি তাতে আর কেউ পাবে না সুপ্রতীক। অস্বীকার করতে পার এই চোদ্দো বছর এক জায়গায় অনড় হয়ে বসে আছ? কলেজ পলিটিক্স ছাড়া আর কিচ্ছু করছ না! অস্বীকার করতে পার দুজনের মিলিত দায়িত্বের ওয়ান থার্ডও তুমি নাও না—তুমি আমাকে তোমার স্যালারির যে অংশটা দাও তাতে কী হয়? হয় কিছু? আমার ভরণপোষণ তো দূরের কথা, তুতুর আর তোমারও কী হয়? হয় না!
—আমি যেমন উপার্জন করি, তুমি সেই স্ট্যান্ডার্ডে চললেই হয়। দ্যাট য়ু ওন্ট ডু, য়ু অ্যামবিশাস বিচ।
পাথরের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তিলক। অন্যের কথা এভাবে শোনা ঠিক নয়, সে জানে, কিন্তু পারছে না। জয়িতাদি, মাথার ওপর ঝুড়ি চুল, ঈষৎ চৌকো মুখের অত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জয়িতাদি যিনি নিজের মারুতি এইট হানড্রেড চালিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে আসেন, যাঁর ডক্টরেটের থিসিস বাজারে বই হয়ে বেরিয়ে গেছে, তিরিশ থেকে শুরু করে নব্বুই দশক পর্যন্ত যাঁর উপন্যাসের আলোচনাগ্রন্থ প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই তাঁকে তাঁর স্বামী—বিচ বলছেন? অ্যামবিশাস বিচ? আর সে শুনবে না!
—মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ সুপ্রতীক। হোয়াট ডু য়ু মিন বাই ইওর স্ট্যান্ডার্ড? মদ সিগারেট আর আড্ডা মারার খরচ সামলে কত টাকা তুমি আমাকে দাও? নিম্নবিত্তের সংসারও আজকালকার দিনে আর ওতে চলে না। আর অ্যামবিশন নিয়ে প্রায়ই তোমায় বক্রোক্তি করতে শুনছি। ব্যাপারটা কী বলো তো? আমি তো তোমার মতো পলিটিক্স করি না, লবি-টবিও জানি না। নিজের ক্ষমতায় পড়াশোনা করে কিছু অর্জন করলে, মানুষের সম্মান শ্রদ্ধা পেলে সেটাকে ঘৃণা করতে হবে? অ্যামবিশন? আমি কি তোমার মতো প্রেমিকার নোট্স পড়া ফার্স্ট ক্লাস?
একটা চাপা গর্জন, একটা অদ্ভূত আওয়াজ, আর ‘উঃ’ বলে একটা ক্রুদ্ধ কাতর চিৎকার শুনতে পেল তিলক। সুপ্রতীকবাবু কি জয়িতাদিকে মারছেন? মারছেন একজন ফার্স্ট ক্লাস কলেজের প্রোফেসর তাঁর স্ত্রীকে যিনি য়ুনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধান? সম্ভব? এটা সম্ভব? সে এখন কী করবে? পালিয়ে যাবে এখান থেকে? সেটা কাপুরুষতা হবে না? আর যদি থাকে? যদি ঢোকে? সেটাও তো হবে পরের ব্যাপারে নাক গলানো। খুব তাড়াতাড়ি চিন্তাটা করছিল সে। এখন মন স্থির করে জোর বেল দিল। রিং রিং রিং রিং রিং। এতক্ষণ কোনও সভ্য মানুষ আরেক সভ্য মানুষের বাড়িতে বেল টেপে না।
দরজাটা খুলল বেশ একটু পরে। সামনে সুপ্রতীকবাবু। মুখটা লাল, চোখ দুটো দপদপ করছে। কিন্তু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কী ব্যাপার? আবার ফিরে এলে যে?
—ম্যাডামকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।
—পরে জিজ্ঞেস করলে হয় না? শী ইজ বিজি নাও।
—অনেক দূরে থাকি সার, প্লিজ একবার ডেকে দিন।
সুপ্রতীকবাবু ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জয়িতাদি এলেন, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, মুখে চোখে জল দিয়েছেন। শাড়ির সামনেটা ভিজে। চুলে বোধহয় একবার চিরুনিও চালিয়ে এসেছেন। মারটা কি চুল ধরেই হয়েছিল?
—কী ব্যাপার? তিলক? একই প্রশ্ন দুজনে করলেন দুভাবে। সুপ্রতীকবাবু করেছিলেন রীতিমতো ক্রুদ্ধ গলায়। অভদ্রের মতো। জয়িতাদির প্রশ্নটায় সামান্য বিরক্তি। খুব সামান্য। কিন্তু গলার একটা থির থির কাঁপুনি তিলক টের পেল।
সে বলল—ম্যাডাম, আপনি অমৃতার ঠিকানাটা কিন্তু আমায় দিতে ভুলে গেছেন।
—ঠিকানাটা প্যাকেটের ওপরই লেখা আছে। দেখো!
—ও, একটু ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম?
—এসো, আমি আসলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।
—একটু ডিরেকশনটা জেনে নিতাম।
—ও, তুমি ওদিকটায় যাও না, না? গড়িয়াহাটের মোড় আসবার দু-তিন স্টপ আগে রাস্তাটা, ওখানটায় একটু জিজ্ঞেস করে নিও। ফিরতে গিয়ে আবার মুখোমুখি হলেন উনি তিলকের। বললেন—অনেকটা চলে গিয়েছিলে, না?
তিলক বুঝল উনি নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। সে বলল—অনেকদূর, প্রায় ওই আইল্যান্ড পর্যন্ত, ছুটতে ছুটতে আসছি। সেই জন্যেই…
কথা শেষ না করে হঠাৎ তিলক তার স্বভাববিরুদ্ধভাবে জয়িতাদিকে একটা প্রণাম করল। উনিও অবাক হলেন। তিলকও। সে আর দাঁড়াল না। পেছন ফিরে প্রায় ছুট লাগাল।
এই সব দাম্পত্য-কলহে কথায় কথা বেড়ে যায়, সে জানে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করে। করতে করতে এক সময়ে ব্রহ্মাস্ত্রের আগুন বেরিয়ে আসে। একেবারে বধ। এটা সে দেখেছে। এতটা দেখেনি। কখনওই না। কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু এর ছোট সংস্করণ বাড়িতে দেখেছে। কোনও বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হল। মা বাবাকে ঠেস, বাবা মাকে ঠেস। তারপরই বাবা অবধারিতভাবে মায়ের বাপের বাড়ির নিন্দা আরম্ভ করবে। ব্যাস ক্রোধ আর কষ্ট চোখের গরম জল হয়ে বেরিয়ে আসবে। মা খাবে না। বাবা বলবে একদিন না খেলে কিছু হয় না। তারা মাকে সাধবে। মা কিছুতেই উঠবে না। তিলক বিরক্ত মুখে বলবে—‘তোমরা যা ইচ্ছে করো, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, আমি খেয়ে নিচ্ছি।’ পরের দিন ঈষৎ গম্ভীর-বিষণ্ণ মুখে মায়ের অবতরণ, বাবার নির্দেশ—জলখাবার না খেয়ে মা যেন কোনও কাজ না করে…ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত বাড়িতে এত ভদ্র মার্জিত, উচ্চকোটির ব্যাপার এঁদের, সল্টলেকে ছবির মতো বাংলো বাড়ি, বাইরের লনে একটি ফুটফুটে কিশোরী মেয়েকে দেখা যায় অনেক সময়েই। এইখানে ‘য়ু অ্যামবিশাস বিচ?’ এইখানে একজন প্রোফেসর স্বামী আরেকজন প্রোফেসর পত্নীকে মারেন?
বাসে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিলকের মাথায় শুধু এই চিন্তাই ঘুরছিল। তার বাবা পদে ফোরম্যান, বিদ্যায় ডিপ্লোমা এঞ্জিনিয়ার, মা বি.এ পাসকোর্স। তাঁরা পর্যন্ত ঝগড়াকে মারামারি পর্যন্ত গড়াতে দেননি। আর এঁরা? জয়িতাদিই বা কী? ওই ভদ্রলোককে অমনি বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে না বললেই কি চলছিল না? তবে সত্যিই যদি ভদ্রলোক পলিটিক্স করেন, মদে সিগারেটে আড্ডায় নিজের উপার্জন বেশিটাই খরচ করে ফেলেন, স্ত্রীকে গোটা সংসার চালাতে হয়, তবে এসব কথা উঠতেই পারে। উপরন্তু, ওই নোট্স নিয়ে আদেশজারি? জয়িতাদির নোট্স তিনি কাকে দেবেন, তিনি বুঝবেন? সার কেন খবরদারি করতে আসেন? ওঁদের কথায় বোঝা যায় কোনও এক সময়ে ওঁদের প্রেম-পর্ব চলাকালীন জয়িতাদি তাঁর নোট্স দিয়ে সারকে সাহায্য করেছিলেন। তার ফলেই সার ফার্স্টক্লাস পান। কিন্তু তারপর থেকে আর কিছুই করেননি। অথচ ওঁর স্ত্রী করে চলেছেন—এই নিয়েই অশান্তি।
হঠাৎ একটা কথা তিলকের মাথায় খেলে গেল। ওঁদের কথাবার্তা থেকে এটা খুব পরিষ্কার, যে এই প্যাকেটে যা আছে তা হল নোট্স। অত্যন্ত মূল্যবান। এগুলো জয়িতাদির করা। এগুলো দেখবার লোভ সে সামলাতে পারছে না, পারবে না। হঠাৎ জয়িতাদিদের বাড়ির গোলমাল-অশান্তি, সুপ্রতীকবাবুর অভব্য আচরণ সব হুড়হুড় করে পেছনে সরে যেতে লাগল। সে জায়গায় সামনে যেন সমুদ্র মন্থন করে ঊর্বশীর মতো উঠে এল অপরূপ রূপবতী এক নগ্নিকা—নোট্স। জয়িতা ভাদুড়ি ভূতপূর্ব জয়িতা রায়ের রেকর্ড মার্কস পাওয়া নোট্স।
বাড়ি ফিরতে তিলকের আর তর সইছিল না। পথে আর একবার বৃষ্টি নামল। নোট্স-এর প্যাকেট পলিথিন-কাগজে মোড়াই ছিল, তবু সে দাঁড়িয়ে গেল একটা দোকানে। অনেক লোক জড়ো হয়েছে দোকানটায়। ছাতা গুটিয়ে সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টিটা দেখাচ্ছে ঘন কুয়াশার মতো। কুয়াশা স্থির থাকে, বৃষ্টিজনিত কুয়াশাটা খালি অস্থির। বাঁদিক থেকে ডানদিকে সরে যাচ্ছে। তার পেছনে আর একটা কুয়াশার পরদা। সেটাও সরে যাচ্ছে একইভাবে। তার পেছনে আর একটা।
একজন বললেন—সব কেলো হয়ে গেল, বুঝলি নিতাই। সন্ধেবেলা তেরপল তছনছ হয়ে যাবে। তার তলায় তোর ম্যারাপে জল ঢুকে গিয়ে রং ধেবড়ে জঘন্য একটা ব্যাপার হবে। সাতশো লোক নেমন্তন্ন হয়েছে। তিনশোও হলে হয়।
নিতাই নামধারী বললেন—এ-ও হতে পারে দ্বিজুদা, এই দিনের বেলা বিষ্টিটা হয়ে আকাশটা ক্লিয়ার হয়ে গেল। সন্ধেবেলাটা ঠাণ্ডা, সাতশো না হোক ছশো নব্বুই জন লোক আরামে এসে গেল।
দ্বিজুদা বললেন—সবই নির্ভর করছে তোর এই বোনটা বাদুলে কি না তার ওপর।
—বা বা বা বা! বিয়ে ঠিক করবে শ্রাবণ মাসে, বিষ্টি হলেই কনের দোষ…
—ও দাদা একটু চেপে দাঁড়ান না…আর এক ব্যক্তি উঠে এলেন।
—দাঁড়ানোর আর জায়গা নেই, দেখতেই তো পাচ্ছেন।
—একটু মাথাটা বাঁচাতে দিন। অবস্থা দেখুন না…চশমা পুরো ঝাপসা-এক বিন্দুও দেখতে পাচ্ছি না।
—কই জামাইকে তো তোমরা বাদুলে-টাদুলে বলো না!
—পিতৃতান্ত্রিক, দ্বিজুদা বললেন, বুঝলি না পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, সবটাতেই মেয়েদের দোষ ধরে।
—ধরে আবার কী! ধরি বলো।
একজন জনান্তিকে আর একজনকে বললে—একে বৃষ্টিতে ছয়লাপ৷ এদিকে আবার নারীবাদের আলোচনা ধরেছে। হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দেবে আজ।
—আঃ ঠেলছেন কেন? পড়ে যাব যে!
—দেখুন, এখানে ঠেলাঠেলি একটু হবেই। দশজনের জায়গায় কুড়িজন দাঁড়িয়েছে, আমি আপনাকে ঠেলছি না।
—তবে আমি ঠেলিত হচ্ছি কী করে?
—আজ্ঞে, ভিড়ের স্বাভাবিক চাপের জন্যে।
আর একজন বললেন গোটা দেশটারই তো অবস্থা তাই দাঁড়িয়েছে। ধরো পঁচিশ কোটি লোক খেয়ে-পরে শুয়ে-বসে আরাম করে থাকতে পারে, সে জায়গায় যদি নিরানব্বুই কোটি লোক হয়ে পড়ে, তো সবেতে টান ধরবেই, সবেতেই ঠেলাঠেলি…
এই ঠেলাঠেলির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিলক ভাবছিল—হাঃ হাঃ হাঃ তোমরা জানো না, এই উতলধারা বাদল ঝরে’র মধ্যে সাত কোটি নিরানব্বুই কোটির ঠেলাঠেলির মধ্যে একজন জাস্ট একজন দ্যাট চোজ্ন ওয়ান দাঁড়িয়ে আছে, যার হাতে-নাতে উর্বশী। জয়িতা রায়ের নোট্স৷
এই সময়ে বৃষ্টিটা একটু ধরল। অনেকেই নেমে গেল। তিলকের ছাতা নেই। ছাতা আবার তার বয়সের ছেলে কবে ব্যবহার করে? কিন্তু আজ সে কোনও ঝুঁকি নিল না। একটা বুড়ো পাকশিটে মতো রিকশাঅলার রিকশায় নির্লজ্জের মতো উঠে বসল। বসেই বলল, এই হ্যাট্ হ্যাট্।
রিকশাওলা তার ঠোঙার মতো পলিথিনের কভার-এর ঘোমটা সরিয়ে খিঁচিয়ে উঠল—হ্যাট্ হ্যাট্ বলছেন কেন? রিকশা চালাই বলে কি আমাদের জান-মান নেই?
তিলক মনে মনে একটা জিভ কেটে বলল—না রিকশাদাদা, কিচ্ছু মনে করবেন না, এই জলে আপনাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যেন পক্ষীরাজ ঘোড়া পেয়েছি একটা।
এ কথায় কিছুমাত্র সান্ত্বনা পেল না লোকটা। থুক করে একদলা থুতু ফেলল জলের মধ্যে। কোথায় যাবেন?
—আমহার্স্ট স্ট্রিট। এই আর একটু ভাই।
—আমহাস ইস্টিট অনেকটা।
—আরে না না, বেশিদূর না। বৈঠকখানার একটু আগে।
—তিরিশটা টাকা দিতে হবে কিন্তু।
—তিরিশ? আচ্ছা পঁচিশ দেব।
রিকশাঅলা ঠুং-ঠুং করতে করতে জল ভাঙতে লাগল।
বাদলের শেষ দুপুরে মাথা মুছে, জামাকাপড় পাল্টে এক কাপ চায়ের জন্যে রান্নাঘরের দিকে গেল তিলক। মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কাজের মাসি মিনু তাকে দরজা খুলে দিয়েছিল, সে মিনতির সুরে বলল—মিনুমাসানি একটু চা করে দেবে? বড্ড ভিজেছি ডিয়ার।
মিনু মাসানিটা শুনলে মিনু মাসি কেন যেন বড্ড খুশি হয়। সে হাসিমুখে ভ্রূকুটি করে বলল—সে তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু ডিয়ার ফিয়ার বললে দোব না।
আচ্ছা—ডিয়ার নয়, সুদ্ধু মাসানি। প্লিজ এক কাপ নয়, এক গ্লাস। মানে গেলাস।
কোণের ঘরে সে পড়ে। ছোট্ট ঘরটায় টেবিলে বইয়ের গাদা অগোছালো হয়ে আছে। দেওয়ালে একটা শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি। সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললে—জয় বাবা দক্ষিণেশ্বরের পাগল ঠাকুর।
ঊর্বশীর ঢাকনা খুললে সে।
প্রিয় অমৃতা,
এতদিনে নিশ্চয় বুঝেছ, তোমাদের জয়িতাদিকে যা ভাবতে তিনি তা নয়। কঠিনকঠোর নয়, তিরস্কারপ্রবণ নয়, ছাত্রদের কাছ থেকে প্রাইভেট কোচিং-এ টাকা কামিয়ে বাড়ি-গাড়ি করার মতলবে ক্লাসটাকে অবহেলা করার ইচ্ছাও তাঁর নেই। তুমি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছ, যখন তোমায় আর ছাত্রী, শুধু ছাত্রী বলে মনে করতে পারছি না। তোমার এই ঘটনা আমার ভিতসুদ্ধ নাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর দ্বারা ক্লোরোফর্মড হয়ে নার্সিংহোমে প্রেরিত হয়েছিলে, একটা সম্পূর্ণ সুস্থ মায়ের সুস্থ ভ্রূণকে বিনা কারণে অকালে নষ্ট করার জন্য, সম্পূর্ণ তোমার সম্মতি ছাড়া? এটা জানবার পর থেকে আমার রাতের ঘুম চলে গেছে। অমৃতা, আমার দ্বিতীয় সন্তানকে আমি এমনিভাবেই হত্যা করেছিলাম। তখন আমাদের জীবনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সময়। সল্টলেকের জমিতে বাড়ি শুরু হয়েছে। ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছি। মেয়েকে অত্যন্ত দামি স্কুলে ভর্তি করেছি। আমার স্বামী যখন বললেন এ সম্ভাবনা বিনষ্ট করতে, ভয়ে চমকে উঠেছিলাম। তারপর ভেবে দেখলাম—আমার আর কোনও সহায়সম্বল নেই, নিজের মেধা এবং পরিশ্রম করবার শক্তি ছাড়া। স্বামী অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন, বুঝতেই পারছ কেন বিবাহিত দম্পতির পরিকল্পিত জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান আসে। দায় সম্পূর্ণ তার। সেই সে, অনায়াসে অবলীলায় নিজের সন্তানকে গর্ভে হত্যা করতে চাইছে, অর্থাৎ এর আর্থিক দায়িত্বও সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ একা আমার। তখন ভয়ে দুশ্চিন্তায় দিশাহারা হয়ে এম.টি.পি করাই, তখন অ্যাক্ট পাস হয়ে গেছে। অমৃতা, তখন সে সবে অঙ্কুরিত হয়েছে। জানি না তার লিঙ্গ। কিন্তু যা-ই হোক সে, আমার কাছে সে স্বাগত ছিল। জানি সে শুধু সম্ভাবনার তৃণাঙ্কুর। তবু তারপর থেকে সে আমার দিনে-রাতে আমার চেতনা-অচেতনায় পেছু নেয়। অকাল-মৃত পিটার প্যানের মতো সে জানলার কার্নিশে বসে আমার দিকে তার শিশু চোখ মেলে থাকে, বলে, মা তুমি আমায় নিলে না? মা, তুমি আমার জন্যে কাঁদবে না মা? আমি তাকে নিইনি, কিন্তু তার জন্য বোধহয় আমরণ কাঁদব। তোমাদের ক্লাসে লেকচারের সময়েও সে হঠাৎ-হঠাৎ পেছনের বেঞ্চে এসে বসে থাকত। তখন আমি কথা খুঁজে পেতাম না। চোখে সব অন্ধকার দেখতাম। পড়তে গিয়ে আজকাল অনেক সময়ে বুঝতে পারি যে কিছু বুঝতে পারছি না। যেন গ্রীক ভাষা, লাতিন ভাষার গ্রন্থ খুলে বসে আছি। আমার সেই একান্ত নিভৃত জায়গা থেকে অমৃতা আমি তোমায় নমস্কার করছি। তোমার অবস্থানও আমার থেকে খুব ভিন্ন ছিল না। কিন্তু তুমি তাকে স্বাগত করছ, করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে। অমৃতা তোমার ভাল হোক। আজ থেকে, এখন থেকে আমি তোমার দিদি, দিদিও নয়, হয়তো বন্ধু। আমার কাছে তোমার দুয়ার খোলা। আমারই জন্য।
জয়িতাদি।
তিলক পাতা উল্টোল। ফিফথ্ পেপার রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ উল্টে যাচ্ছে, উল্টে যাচ্ছে, সিক্সথ্ পেপার থিয়োরি, থিয়োরি উল্টে যাচ্ছে, উল্টে যাচ্ছে, সেভেনথ্ পেপার মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ, এইটথ্ পেপার। প্রত্যেকটি টেক্সট ধরে খুঁটিনাটি আলোচনা, প্রশ্নোত্তর, দীর্ঘ রচনা, পড়তে পড়তে তিলকের আর দিনরাত জ্ঞান রইল না। গভীর কোনও উপন্যাস, কিংবা পাতায় পাতায় ছড়ানো কোনও মগ্ন কবিতা, কিংবা সরস আলোকিত নিবন্ধের মতো রসময় সে সব। বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল। মননে, হার্দ্য গুণে গভীর, ভাষার ওজস্বিতায়, সংক্ষিপ্ততায় আদ্যন্ত চমক সৃষ্টি করা।
সে বুঝতে পারল কেন জয়িতা বাগচি গত পঁচিশ বছরের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে বিবেচিত, পুরস্কৃত। কেন তিনি সমস্ত য়ুনিভার্সিটি পলিটিক্স, পার্টি পলিটিক্সকে মাথা হেঁট করিয়ে তাঁর আসনে বসেছেন। এ-ও সে বুঝতে পারল—কেন জয়িতাদির আরও আরও কোনও উজ্জ্বল উত্তরণ ঘটছে না।
তারপরে তার চৈতন্যের মধ্যে যেন একটা বোমা ফাটল। মাসিক পাঁচশো টাকা দিয়ে সে জয়িতাদির কাছে পড়তে যায়, কিন্তু এর সিকি ভাগও তিনি কোনওদিন তাকে বা আর কাউকে দেননি। প্রচণ্ড ক্ষোভ, আক্রোশ হল তার একটা। তখন রাত নটা। সে ছুটল নোট্স ফটোকপি করাতে। বহু রাত অবধি খোলা থাকে নিখিলদার জেরক্স কাম এস.টি.ডি. বুথ। নিখিলদা বললেন—রেখে যা। কাল বিকেলে দেখি শেষ করতে পারি কি না।
সে বলল—তা হবে না নিখিলদা, যতটা আজ পারেন করে আমায় দিন, রেখে আমি যাব না।
পর দিন বিকেলের মধ্যে যখন সব হয়ে গেল, মার কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নেওয়া কড়কড়ে তিনশো টাকার তিনটে নোট সে তুলে দিল নিখিলদার হাতে। তার পরে আবার বিশদ পড়া। আসলগুলো আগের মতোই পর্বে পর্বে স্টেপ্ল করা, যাতে কিছু বোঝা না যায়। অমৃতার প্রতি জয়িতাদির চিঠিটা আলাদা কোনও খামের মধ্যে ছিল না, ছিল নোটসগুলোর সবচেয়ে প্রথম পাতায়, যেন সেটা কোনও মুখবন্ধ। নান্দীমুখ। তারপর আবার শুরু করল বিশদে পড়া। নকলগুলো। দেখবার জন্যে যে সব ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে কি না।
পরিষ্কার গাঢ় কালো কালি দিয়ে পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে লেখা। কেনই বা তার ফটোকপি খারাপ হবে? কিন্তু এইবার তিলক আবছাভাবে বুঝতে পারল কেন এ নোট্স জয়িতাদি তাদের দেননি। তারা কেউ এর সদ্ব্যবহার করতে পারবে না। এগুলোর সঙ্গে যেই নিজেদের কথা, নিজেদের রচনা, একটা বাক্যও ঢোকাতে যাবে, তেলে জলে মিশ খাবে না। এসব তাদের জন্য নয়। অনেক পড়াশোনা থাকলেই এগুলো ব্যবহার করা যায়। অমৃতাকেই বা কেন দিয়েছেন? অমৃতা-ও সে দরের ছাত্রী নয়। সে-ও এগুলো ব্যবহার করতে পারবে না বলেই তার ধারণা, জয়িতাদি এগুলো ওকে দিয়েছেন অভিনন্দন, অভিবাদন, শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা জানাবার জন্য। সে সময়ে তাঁর অধ্যাপকী বিচারবৃত্তি কাজ করেনি।