অমৃতা (Amtrita) – ১৬
ভরা শ্রাবণে যখন শেহনাই-শামিয়ানা-শামি কাবাব সহযোগে শম্পা-সৌমিত্রর বিয়ে হয়ে গেল, তখন শম্পা অঝোরঝোরে কাঁদছিল। তার ইচ্ছে ছিল, মায়ের টাকা যেন একেবারে খরচ না হয়। রেজিস্ট্রি বিয়ে, কিন্তু মায়ের ইচ্ছে তা নয়। সৌমিত্রও এমনই অদ্ভূত, যে টোপর পরতে শতকরা নিরানব্বুই দশমিক নয় নয় জন বাঙালি বর প্রিয়জনদের ঘোল খাইয়ে দেয়, সেই টোপর পরতে সে রীতিমতো আগ্রহই প্রকাশ করল। সৌমিত্রর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। সে মানুষ হয়েছে হস্টেলে হস্টেলে। পারিবারিক জীবনের প্রতি সামাজিকতার প্রতি তার ভী-ষণ টান। এটা সাধারণত হস্টেলি ছেলেদের হয় না। কিন্তু সৌমিত্রর দেখা গেল সামাজিক আনুষ্ঠানিক বিয়েটা খুব পছন্দ। তবে মায়ের টাকা বেশি খরচ হল না, সৌমিত্র বলল তার যে কজন আত্মীয় বন্ধুবান্ধব আছেন তাঁদেরও বিয়ের দিনেই আপ্যায়িত করা হবে। তার মেসোমশাই ও মাসতুতো বোন জামাইবাবু ব্যাপারটার ভার নিলেন। অর্ধেক খরচ সৌমিত্রই করল। পিচ রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি আর মায়ের গয়না স-ব পরে শম্পা সিঁথিময়ূর পরে আর পাঁচজন বাঙালি মেয়ের মতোই আলপনা কাটা পিঁড়িতে বসল। আশেপাশে তার জ্যাঠতুতোপিসতুতোরা। মামাতোরাও বেশ আগ্রহের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন দেখা গেল। বরটি খুব কোয়ালিফায়েড ও ভাল চাকরি করে তো? শম্পার মায়ের মান রাখতে দুই মামা মিলে একটা ভাল মুক্তোর সেট এবং মাইসোর সিল্ক উপহার দিলেন, বরকে আংটি। জ্যাঠামশাইরাও একটা বারোমেসে সোনার হার দিয়েছেন, বরের কোয়ালিফিকেশন এবং ভাল চাকরির খাতিরে। নিবেদিতার আনন্দ ও গর্বের সীমা নেই দেখা গেল। খালি শম্পা যে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলছে তা কারওরই জানা হল না। প্রথমত কারওর মনেই হয়নি, এটা একটা খোঁজ নেবার বিষয়। কেউ তো তেমন আপনও নেই তাদের। দ্বিতীয়ত বিয়ের দিনে মেয়েদের কান্নাকাটি একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। সেই যে কবে থেকে চলে আসছে কান্নার ট্র্যাডিশন।
বোন কাঁদেন বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে
সেই যে বোন গাল দিয়েছিল ভাতারখাকি বলে।
আত্মীয়রা একটু খেয়াল করলে বুঝতেন ব্যাপারটা শম্পার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়। আজকাল মেয়েরা বিয়ে হতে অত কাঁদেও না, অনেকেই নিজের নির্বাচিত পাত্র বিয়ে করে, বাবা-মার নির্বাচিতকেও দেখতে-শুনতে পায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কাটা কিছুটা কম থাকায় তারা নিজেদের বিয়েটা মোটামুটি উপভোগই করে। তবে শম্পা কেন এত কাঁদছে?
এ কথা শম্পাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলত যে সে কাঁদবে না তো কাঁদবেটা কে? সেই পাঁচ বছর বয়সে বাবা অকালে মারা যাবার পর সে আর তার মা পরস্পরের প্রগাঢ় বন্ধু। শম্পার খুব আশা ছিল, সৌমিত্রর যেহেতু কোনও পরিবার নেই, ডাফ স্ট্রিটের বাড়িতে সে থাকতে রাজি হবে। কিন্তু মা অনেক করে অনুরোধ করা সত্ত্বেও শম্পা অনেক কাকুতি-মিনতি করা সত্ত্বেও এবং পারিবারিক জীবনের প্রতি তার টান থাকা সত্ত্বে সৌমিত্র প্রস্তাবটা নস্যাৎ করে দিয়েছে। একেবারে নস্যাৎ। সে তার সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের ফ্ল্যাট থেকে কোথাও নড়বে না। এমন কী, শম্পার মা তাদের সঙ্গে বরাবর থাকুন এতেও তার আপত্তি। শম্পা জানে মা এ প্রস্তাবে রাজি হবে না, কিন্তু নিজের বিবেচনা বোধ থেকেও তো সৌমিত্র কথাটা বলতে পারত। বলল না দেখে শম্পা অগত্যা একটু ইঙ্গিতই দিল, —মা যে একা কী করে থাকবে— সে বলেছিল। সৌমিত্র তাতে বলল— কেন, বাড়ির অপর অংশেই তো তোমার জ্যাঠামশাইরা থাকেন! তা ছাড়া, এতদিন তো মা নিজেই নিজেকে দেখছিলেন। তুমি কি মনে করেছ তুমি মাকে দেখাশোনা করছিলে? হেসে বলল সৌমিত্র।
—স্বীকার করছি মাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হয়েছে, কিন্তু শেয়ার করতে তো আমি ছিলাম! তা ছাড়া মায়ের শরীর-টরীর খারাপ হলে কে দেখত আমি ছাড়া? সঙ্গ বলেও তো একটা কথা আছে।
সৌমিত্র বলেছিল— আমিও তো এতদিন একা থাকতাম!
এর পর আর কী বলা যায়?
বিয়ে করতে বসে শম্পার মনে হচ্ছে সে ভীষণ স্বার্থপর। মাকে সে একটা অন্ধকার ধোঁয়াশা-ভরা একলা জীবনের মধ্যে ফেলে চলে যাচ্ছে। ঠিক একটা পাখির ছানার মতোই সে উড়তে শিখেই ফুড়ুৎ।
আরও একটা কারণ আছে। সেটা অবশ্যই অমৃতা। অমৃতা, তার বেস্ট ফ্রেন্ড, বলা যায় ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড তার শ্বশুরবাড়ির ষড়যন্ত্রে নিখোঁজ হয়ে গেল। আর সে? সে? সে কী করছে? না বিয়ে করছে। দস্তুরমতো শানাই বাজিয়ে, বেনারসি পরে, পাত পেড়ে লোকজন খাইয়ে বিয়ে।
সীমামাসি আর বিশ্বজিৎকাকুকেও কাঁচুমাচু মুখে তারা নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল। ওঁরা খুব খুশি দেখালেন। মানে, ওঁদের পক্ষে যতটা খুশি দেখানো সম্ভব।
নিবেদিতা বলেছিলেন—আমাদের খুব খারাপ লাগছে ভাই। অমৃতার এখনও কোনও…
সীমা বলেছিলেন— তাই বলে কি শম্পা বিয়ে করবে না? না—না খুব ভাল হয়েছে, নিজে দেখে শুনে বিয়ে করছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। এটাই দরকার। এই দুটোই—নিজে দেখা-শোনা, আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
এসেছিলেনও ওঁরা। দুপুরে এসেছিলেন, লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আসতে হয়তো সঙ্কোচ বোধ করেছিলেন। খুব অদ্ভূত উপহার নিয়ে এসেছিলেন ওঁরা। একটা তো শাড়ি, আর একটা ছোট্ট অ্যালবাম, তাতে শম্পা আর অমৃতার টু না থ্রি থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছরের একটা করে স্কুলের গ্রুপ ফটো। কোনওটাতে ক্লাস-টিচারের সঙ্গে একাসনে বসে, কোনওটাতে পেছনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সব সময়ে দুজনে পাশাপাশি। গোলগাল বেবি-বেবি চেহারা থেকে সদ্য কৈশোরে পা রাখা দুই বন্ধু, যখন চেহারা, ব্যক্তিত্ব আলাদা হতে শুরু করেছে তখন পর্যন্ত। শেষ দিকের তিন-চারটে ফটো আবার শুধুই শম্পা আর অমৃতা, অমৃতা আর শম্পা, অমৃতা এক বিনুনি শম্পা দু বিনুনি, শম্পা স্কার্ট, অমৃতা মিডি। শম্পা শাড়ি অমৃতা সালোয়ার।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। সব। স-ব। কী ভাবে একবার অমৃতা অনেক নম্বর পেয়ে বাংলায় ফার্স্ট হয়েছিল বলে, শম্পা রাগে ফুঁসছিল— তুই আমাকে সব ক্লাস-নোটস দিসনি। না হলে দুজনের মার্কসের এত তফাত হয় কী করে? তোর সঙ্গে আর কখনও এক বেঞ্চে বসব না। তার রাগ আর জলভরা চোখ দেখে অমৃতা এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে বাংলার দিদি রেণুদিকে গিয়ে বলেছিল— আচ্ছা, দিদি, আমার মার্কস একটু কমিয়ে দিলে হয় না?
—মার্কস কমিয়ে দেব! কেন? —রেণুদি এত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।
অমৃতা ঢোঁক গিলে বলেছিল— না, মানে আমার বন্ধুদের থেকে অত বেশি নম্বর আমি কী করে পেতে পারি?
—তুমি কি আমার জাজমেন্টকেই কোয়েশ্চন করছ? আচ্ছা স্পর্ধা তো তোমার!
—কী ব্যাপার? —শেফালিদি, রেণুদির রাগ দেখে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
সব শুনে শেফালিদি বলেছিলেন— আমি বুঝেছি রেণু, বন্ধুরা নয়। ওই শম্পাই ওর ঘোরতর বন্ধু। সে নিশ্চয় কান্নাকাটি করছে কম নম্বর পেয়ে।
দুই দিদি মিলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন শম্পাকে। সমস্ত ঘটনাটা বলেছিলেন। তার পর তাকে মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। নম্বর পাও তোমরা যে যার মেরিটে, অমৃতা এবার খুব ভাল করেছে, তুমিও আসছেবার ভাল করার জন্যে খাটো। নিশ্চয় পাবে। আর শম্পা, অমৃতা তোমাকে কী ভীষণ ভালবাসে সেটা বুঝেছ তো! তোমার চোখের জল ওর সয়নি বলে ও রেণুর কাছে নিজের নম্বর কমাবার জন্যে দরবার করতে এসেছিল। এ রকম অনুরোধ আমরা জীবনে কখনও শুনিনি, এরকম ঘটনাও আর কোথাও ঘটেছে বলে জানি না।
তবু তো শম্পা কীভাবে অমৃতাকে গঞ্জনা দিয়েছিল, তার কিছুই দিদিরা জানতেন না।
বিশ্বজিৎকাকুও একদিন বলেছিলেন—শম্পা, তোর বাংলা ইংরেজির প্রশ্নোত্তর সব সময়ে অমৃতার দেখে নিয়ে লিখিস কেন রে? অমৃতা কি অঙ্কগুলো তোর দেখে দেখে করে? সব সিঁড়ি নিজে নিজে ভেঙে ভেঙে উঠতে হয়। না হলে শেখাটা ঠিক হয় না।
এতেও শম্পার ভীষণ অভিমান হয়েছিল। সে বিশ্বজিৎকাকুর কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। একদিন স্কুল ছুটি হবার পর দেখে বিশ্বজিৎকাকু দাঁড়িয়ে আছেন ঘর্মাক্ত কলেবরে। শম্পাদের দেখে বললেন—চ, শম্পা অনেক দিন আমাদের বাড়ি যাস না।
তখন অমৃতারা রমণী চ্যাটার্জিতে উঠে গেছে। শম্পার মাকে ওঁর অফিসে ফোন করলেন বিশ্বজিৎকাকু, তার পর ওদের দুজনকে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। কী আদর! কী আদর! কী খাওয়া! কী খাওয়া! সীমামাসি সেদিন তাঁর সমস্ত জ্ঞান উজাড় করে রেঁধেছিলেন বোধহয়, শম্পা যা যা খেতে ভালবাসে।
—কেন এতদিন আসিসনি রে? —বিশ্বজিৎকাকু জিজ্ঞেস করলেন খেতে বসে।
শম্পা অপ্রস্তুতমুখে বলল—বড্ড দূর হয়ে যায় যে!
—তা-ও তো হপ্তায় দু দিন করে আসতিস, এখন কি আর তোর উঁচু ক্লাসের অঙ্ক সায়েন্স পড়াতে পারছি না?
শম্পা ভীষণ অপ্রস্তুত।
অমৃতা বলল— তা নয় বাবা, মান হয়েছে মানিনীর।
সীমামাসি তার মুখে মাছের চপ গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন— কে মেরেছে কে বকেছে, কে বলেছে কী? তারপর কাকুর দিকে ফিরে বলেছিলেন—তোমাদের মাস্টারদের ওই বড্ড কড়া স্বভাব। একটা জিনিস জানবে ছেলেদের পড়ানো আর মেয়েদের পড়ানো এক জিনিস নয়। ছেলেদের তোমরা ঠেঙিয়ে শেখাতে পারবে। মেয়েদের বেলায় কিন্তু শেখাতে হবে ভালবেসে।
অমৃতা চোরা চোখে চাইছিল শম্পার দিকে, মুখে মিটি মিটি হাসি৷ সেই হাসিটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শম্পা। তার মুখের ওপর পানপাতা চাপা দেওয়া, সেই পানপাতার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছে অমৃতা অদূরে দাঁড়িয়ে আছে, একটা বিনুনি করা নীল চেকচেক একটা ধনেখালি শাড়ি পরা, শাদা ব্লাউজ, অমৃতা হাসছে মিটিমিটি—মান হয়েছে মানিনীর? তাই কান্না? দেখতে দেখতে হু হু করে জল পড়ে শম্পার মুখের সব মেকাপ ধুয়ে গেল। ফুলে ফুলে উঠছে বুক।
এত স্পষ্ট কেন দেখতে পাচ্ছে সে অমৃতাকে? অমৃতা কি মারা গেছে? কথাটা মনে হতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল তার বুকে। বিষ লাগতে লাগল শানাইয়ের সুর, কেটারারের খাবারের গন্ধ, জুঁইয়ের মালার সুবাস, নানান গয়নার কিঙ্কিণী, শাড়ির খস্খস্। ভুলে গেল সে সৌমিত্রের মুখ। কদিন পরেই আন্দামানে হানিমুন করতে যাবে সেই সুখ।
কেউ বোধহয় নিবেদিতাকে খবর দিয়েছিল শম্পা ভীষণ কাঁদছে। নিবেদিতা জানেন শম্পার মাকে ছেড়ে যেতে, থাকতে হবে বলে দারুণ কষ্ট হচ্ছে। তাঁদেরও কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু শম্পার মাতৃবিরহের প্রকৃতি আলাদা। তাঁরা যে কত বছর ধরে দুজন শুধু দুজনের। সেই নিভৃত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর কোনওদিনও কারও সঙ্গে হবে না শম্পার, হতে পারে না। তিনি সব ফেলে তাড়াতাড়ি এলেন।
—শম্পা এ কী করছিস? কাজল-টাজল সব ধেবড়ে গেছে, চোখের জলে মুখ ডোরা কাটা, এ কী?
মায়ের নতুন গরদ-শাড়ির বুকে মুখ গুজে শম্পা বলল—মা আমার অমৃতার জন্যে ভীষণ মন কেমন করছে। আমি আর থাকতে পারছি না।
অরিন্দম ঘোষ অনেক, অনেকক্ষণ বরযাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে বসে উসখুস করছিল। বরযাত্রীরা ভাবছে সে শম্পাদের পক্ষের লোক, শম্পার আত্মীয়রা ভাবছে সে বরযাত্রী। কে যে কী তা-ও সে আদৌ বুঝতে পারছিল না। বুঝে নিতে চেষ্টা করছিল। অমৃতা শম্পার খবর জানতে চায়। প্রথমটা চেয়েছিল উদাস ভাবে। একটিবার মাত্র উল্লেখ করেছিল। তারপর সে অরিন্দমকে সরাসরি অনুরোধ করে। সময় করে সে যেদিন আসতে পারল, দেখে বাড়িটার সদর দরজায় মাথায় লেখা— শম্পা ওয়েড্স সৌমিত্র। একবার ভাবল— এই তো খবর জানা হয়ে গেল। এবার ফিরে গিয়ে জানিয়ে দেওয়াই যায়— অমৃতা তোমার বন্ধু ওয়েড্স সৌমিত্র। জানাতে তার একটা নিষ্ঠুর আনন্দ হবে। যেন এতে করে বলা হয়ে যাবে— অমৃতা, সারা পৃথিবীতে কেউ তোমার জন্যে বসে নেই। সংসার চলছে তার নিজস্ব নিয়মে। তোমাকে সবাই ভুলে গেছে। তোমার জন্য বসে আছ—শুধু একলা আমি, অরিন্দম। তুমি একটু আমার দিকে ফেরো।
কিন্তু এই সময়ে কে খবর দিল, কনে ভী-ষ-ণ কাঁদছে। সৌমিত্রর কোনও বন্ধুই বোধহয় বলল— ‘এই শুনলাম অনেক দিন ধরে মন দেওয়া-নেওয়া চলছে, কেমন মন দিলি রে সৌমিত্র, তোর বউ নাকি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে!’ কথাটা শুনে সৌমিত্র টোপরটা পাশে খুলে রেখে, খুব স্মার্টলি হঠাৎ অন্তঃপুরের দিকে চলে গেল। অরিন্দম কৌতূহলী হয়ে বসে রইল, বসেই রইল, অন্তত আধঘন্টা পরে সৌমিত্র ফিরল, মুখটা উদাস।
এক বন্ধু বলল—কী রে প্রসপেক্টটা একটু ফেরাতে পারলি?
সৌমিত্র বলল— ওর ছোটবেলার বন্ধু হারিয়ে গেছে, তাকে আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছে।
বন্ধু বলল—বিয়ের লগ্নে বন্ধু? এহ্ সৌমিত্র, তোর হয়ে গেল।
সৌমিত্র বলল— বাজে ফাজলামি করিস না। মেয়েটি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে হঠাৎ কীভাবে কোথায় সরিয়ে ফেলেছে। মনে হয় শী ইজ ডেড অ্যান্ড গন, বাই নাউ।
ডেড অ্যান্ড গন—ডেড অ্যান্ড গন—মাথার মধ্যে ভীষণ একটা কষ্ট অনুভব করল অরিন্দম। অমৃতা মারা গেছে—এই খবরটা মিথ্যা, তবুও সে সইতে পারছে না সেটা। শম্পা তার বিয়ের মুহূর্তে অমৃতার জন্য কাঁদছে, আর কারও জন্য নয়। অমৃতার জন্য, অর্থাৎ ‘শম্পা ওয়েড্স সৌমিত্র’ এই সংবাদটা যতটা নিষ্ঠুর শোনাচ্ছিল, ততটা নিষ্ঠুর আর রইল না। কী গভীর তৃপ্তি। অমৃতা বেঁচে আছে। শম্পার স্মৃতি ও সত্তার মধ্যেও অমৃতা বেঁচে আছে। তার মনে হল, জীবনের এই শুভ মুহূর্তে শম্পাকে তাকে দেখতেই হবে। কে এই শম্পা যে বিবাহলগ্নে অমৃতার জন্য কাঁদে? সে উঠে পড়ে ভিড় ঠেলতে লাগল। এদিক ওদিক প্রশ্ন ছুড়তে লাগল—শম্পা কোথায়? শম্পা? —যেন সে শম্পার একজন বন্ধু। আর কাউকে এই বিয়ে বাড়িতে তো চেনে না। তাই, তা ছাড়াও উপহারটা তো তাকেই দিতে হবে। তাই সে শম্পাকে খুঁজছে।
একজন নিবেদিতাকে খুঁজে আনল। নিবেদিতা বললেন—শম্পাকে ওর বোনেরা একটু সাজিয়ে দিচ্ছে। একটু অপেক্ষা করবেন? আপনি কি ‘উইল পাওয়ার’-এর?
উইল পাওয়ারই বটে— অরিন্দমের সেই মুহূর্তে মনে হল— ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তির কী প্রচণ্ড জোর। এত প্রবল তার আকর্ষণ; যে ঠিক সেই সময়টাই আপাত-উদাসীন অমৃতার শম্পার কথা জানতে ইচ্ছে হল, যখন শম্পার মনও অমৃতার জন্য উতলা! সে নিচু গলায় বলল—খুব ইমপর্ট্যান্ট একটা খবর এনেছি শম্পার জন্য। ভয় নেই, ভাল খবর। একটু যদি ডেকে দেন, খবরটা ভিড়ের মধ্যে দেওয়ার নয় কিন্তু।
নিবেদিতার মুখের চেহারা এমন পাংশু হয়ে গেল যে তাকে আবার বলতে হল, —ভয়ের কিছু নেই।
শম্পার মুখ পুরো ধুয়ে গিয়েছিল চোখের জলে। সৌমিত্র সেই অবস্থাতেই তার সঙ্গে দেখা করে—সৌমিত্র আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। অথচ অমৃতার কোনও খোঁজ নেই সে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অমৃতার কথা আগে শুনেছিল সৌমিত্র ঠিকই, কিন্তু অমৃতা যে এত গুরুত্বপূর্ণ শম্পার শান্তির জন্য তা আগে বুঝতে পারেনি। সে কনেকে প্রাণপণে শান্ত করবার চেষ্টা করে—ঠিক খোঁজ পাওয়া যাবে, দেখো, খারাপ কিছু তো শোনা যায়নি, তবে?
—আজকালকার দিনে কেউ কাউকে খুন করে পুঁতে ফেললে কি আর খবর পাওয়া যায়?
সৌমিত্র তখন মনে, বাচনে দৃঢ়তা এনে তাকে বলে— অত সোজা নয় শম্পা। কেঁদো না, কেঁদে কিছু করতে পারবে? আমি বলছি— তুমি ভাল খবর পাবে।
এ-ও একরকম উইল পাওয়ার। হয়তো এই উইল পাওয়ারই অরিন্দমকে অন্দরে শম্পার খোঁজে টেনে আনল।
বোনেরা শম্পার মুখ ধুয়ে, শুধু একটু পাউডার লাগিয়ে দিয়েছে। আর কোনও প্রসাধনের পুনরাবৃত্তি শম্পা কিছুতেই করতে চায়নি। নিবেদিতা গিয়ে মেয়েদের দঙ্গলকে ওঠালেন— শম্পা ‘উইল পাওয়ার’ থেকে একটি ছেলে তোর খোঁজ করছে, বলছে কী বলার আছে।
উইল পাওয়ার? শম্পা শূন্যে হাতড়ায়? কে? শুক্লা, না রাঘবন? ব্যানার্জি? কে এল? কেন? কী খবর? তাদের প্রজেক্টটা কি ফিরে এল? একলা ঘরে অরিন্দমকে নিয়ে নিবেদিতা ঢুকলেন।
কে? এঁকে তো চিনি না?—শম্পা ভাবল!
অরিন্দম দেখল কচি বাঁশগাছের মতো তন্বী নমনীয় শ্যামলী একটি মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিয়ের কনের সাজগোজ বলতে তেমন কিছু নেই, যেটুকুও বা আছে তাকে দখল করে রয়েছে এক বিপন্নতা। এক মানুষের জন্য আরেক মানুষের এই বিষাদ মানুষকে এক অদৃষ্টপূর্ব শ্রী দেয়, সেই শ্রী শিশির বিন্দুর মতো লেগে আছে মেয়েটির সমস্ত অবয়বে। সে স্তব্ধ হয়ে ভাবল, কেন যে এতদিন অমৃতা এর খোঁজ করেনি সেটাই তো এক বিস্ময়।
সে সোজা শম্পার দিকে তাকাল, বলল— আমি অমৃতার কাছ থেকে আসছি।
শম্পা এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে সে কথা বলতে পারছিল না। নিবেদিতাও। অরিন্দম বলল— আপনার বিয়েতে অমৃতা শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। আর ভালবাসা।
—আপনি কে? অমৃতা কোথায়? কেন সে…
শম্পা কথা শেষ করতে পারল না।
অরিন্দম বলল—কাঁদবেন না, অমৃতা ভাল আছে। ওই মামলাটার কারণে ওর ঠিকানা, খবর কাউকে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আপনার কথা আলাদা। বিশেষত আজকের দিনে।
—আপনি সত্যি কথা বলছেন তো?
—মিথ্যা বলে আমার লাভ? ব্যাস এবার মন ভাল করে, হাসিমুখে বিয়ে করুনগে যান। আপনার বরটিও বেশ ভাল। বেশ ভাল লেগেছে আমার। আমারও শুভেচ্ছা রইল।
সে হাতজোড় করে নমস্কার করে বাইরে বেরিয়ে এল। মা, মেয়ে দুজনেই এত অবাক, যে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে। নিবেদিতা যে ভদ্রলোককে কোনও সৌজন্য দেখাবেন, খেয়ে যেতে বলবেন, সে সবের অবকাশ যখন এল তখন অরিন্দম বাইরে চলে গেছে। বিধবার মেয়ের বিয়ে, আত্মীয়স্বজন নিজেদের মজা লুটতেই ব্যস্ত। ভদ্রমহিলার হয়ে অতিথি-আপ্যায়নের মানসিকতাই নেই। তার ওপরে আবার বরের বাড়ির অচেনা লোকেরাও আছেন। তাঁদের আপ্যায়ন করবার জন্যে স্বয়ং বরের মাসতুতো বোন ভগ্নীপতি, মেসোমশাইও এসেছেন। দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেলে আর দায় থাকে না। খালি মজা থাকে। সুতরাং অরিন্দম নির্বিবাদে মাঝের দালান উঠোন পেরিয়ে, বরাসনে আর একবার বরকে দেখে সদরের বাইরে চলে গেল।
‘শম্পা ওয়েড্স সৌমিত্র’ এখন পেছনে পড়ে গেছে। সে ছুটে চলেছে এক নতুন প্রভাতের দিকে। নব আনন্দে জাগো। উইল পাওয়ার উইল পাওয়ার। অমৃতার যা শরীর ও মনের অবস্থা তাতে কোনও মানুষের প্রেমে পড়া কি সম্ভব? কিন্তু এই সময় তো আর চিরকাল থাকবে না। পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, অরিসূদনের শাস্তি হবে। অমৃতার পরীক্ষা হয়ে যাবে, তার সন্তান জন্মে যাবে, সে তার মা-বাবার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে পারবে।
ততদিন পর্যন্ত অরিন্দম অপেক্ষা করে থাকবে। দু পায়ে ইচ্ছা নিয়ে, যেন পদব্রজে নয়, দু ডানায় ভর করে সে উড়ে যেতে থাকে তার মারুতির দিকে। তার পর তার খেলনা গাড়ি উন্মুখ হাওয়ায় জোরে ছোটে। উইল টু পাওয়ার। উইল টু লাভ। উইল টু বি লাভড।