অমৃতা (Amtrita) – ১৪
একটু পরে চোখ মুছে অমৃতা বলল—আপনি কবে সিঙ্গাপুরে ফিরছেন?
অরিন্দম বলল—কেন? এতই গোলমাল করছি না কি?
—এত উপকার করছেন আর বলব গোলমাল? আমাকে এতটাই অকৃতজ্ঞ ভাবলেন?
—তা নয়, অমৃতা কিন্তু আপনার মনে হতে পারে কেন নিজের কাজ ছেড়ে এতদিন এখানে পড়ে আছি। তা ছাড়া আপনার এই রকম সময়ে আমি ফাজলামি, ফাজলামিও না, ছ্যাবলামি করে যাচ্ছি ক্রমাগত।
—ছ্যাবলামি-টামি আমার মনে হয়নি। ভালই তো আপনি আবহাওয়াটাকে হালকা করে দেন। সব সময়েই যদি মনে রাখতে হয় আমি একটা বিপদে পড়া মেয়ে, যাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে, তা হলে তো পাগল হয়ে যাব। তবে প্রথম প্রশ্নটা কৌতূহল থেকেই করেছিলাম। মানে কী করে অত ছুটি পাওয়া সম্ভব।
—ও চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি অমৃতা।
—সে কী? কেন?
—কেন আপনি জানেন না, লাবণি বলেছে অমৃতা ফিরে না এলে সে বিয়ে করবে না। তা ছাড়া সিঙ্গাপুর-টুর-এও সে যাবে না। অচেনা জায়গায় একা পেয়ে তাকে যদি আমি গুম করে ফেলি!
অমৃতার মুখে হাসি, তার পরেই সে অন্যমনস্কভাবে বলল—লাবণি? লাবণি আমাকে এত ভালবাসত বলে তো জানতাম না! আমার আজকাল পুরনো কথা বেশি মনে পড়ে না, তবু এটুকু মনে আছে যে আমার বেশি বন্ধুত্ব ছিল দোলার সঙ্গে। আর শম্পার সঙ্গে, শম্পা অবশ্য য়ুনিভার্সিটির গ্রুপ না। ওরা কেমন আছে, কী করছে, বিশেষত শম্পা…
—আমাকে ঠিকানা দিন, খবর এনে দেব। দোলা ভালই আছে। সেদিন দেখলাম একটি কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে ব্লু-ফক্স থেকে বেরোচ্ছে!
অমৃতা চুপ করে গেল।
দোলা? দোলা? দোলা কেমন করে? অমৃতা-অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান হল না, অথচ দোলা, অমৃতার ভক্ত-বন্ধু কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে ব্লু-ফক্স থেকে বেরোয়? আর লাবণি, যে লাবণির সঙ্গে য়ুনিভার্সিটিতে এসে মোটে দু বছরের কাছাকাছি সময় ভাব, সে ভাব খুব গভীরও নয়, সে-ই কি না চিতোরগড়ের রানার মতো প্রতিজ্ঞা করে বসল? লাবণির চেহারাটাও তার এখন ভাল করে মনে পড়ছে না। চোখগুলো খুব বড় বড়, সুন্দর, চোখ দুটোকে খুব সাজাতও লাবণি। হ্যাঁ, মনে পড়ে যাচ্ছে, দোলার মতো নাদুসনুদুস নয়। স্লিম চেহারার মেয়ে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। সেই লাবণি তার ফিয়াঁসে এই ভদ্রলোককে রহস্য-সমাধান করতে দিয়েছে? এমনই তার জেদ যে এই ভদ্রলোক সিঙ্গাপুরের চাকরিটা ছেড়েই দিলেন। আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! তবু তো লাবণিকে সে ভাবে ভালবাসতে পারছে না সে, দোলাকে যে ভাবে বা শম্পাকে যে ভাবে…। ভালবাসা তা হলে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে জন্মায় না? একটা মানুষ মানুষ হিসেবে ভাল বলে নিজেকে প্রমাণ করলেও না? তোমার কুশলের জন্য সে উৎসুক, উদ্বিগ্ন, খানিকটা আত্মত্যাগ। হ্যাঁ আত্মত্যাগই তো করছে লাবণি নামের একটি মেয়ে অমৃতা নামের আরেকটি মেয়ের জন্য, তবুও আসে না সেই অন্তঃস্রোত, সেই তুমুল টান যা একটি মানুষকে আরেকটি মানুষের কাছে এনে দেয়! শুধু নারী-পুরুষ না, নারী-নারী, বা পুরুষ-পুরুষ সম্পর্কেরও এই-ই কি শেষ কথা? কত উপকার করছেন তার এই ভদ্রলোকও। মোটামুটি সুপুরুষ, চমৎকার ব্যবহারও। মা-বাবার খবর-চিঠি নিয়ে আসেন। বন্ধুবান্ধবদের খবরাখবরও রাখেন। চাইলেই দেন, যদিও কেন যেন অমৃতা বন্ধুদের খবর জানতে চায় না, এক ঝটকায় সে যেন চলে গেছে কোনও চতুর্থ মাত্রার জগতে যেখান থেকে এদের কতকগুলো খেলনা-পুতুল, বড় জোর বালক-বালিকা বলে মনে হয়। সে যাই হোক এই সুশিক্ষিত, সুপুরুষ, সজ্জন, সুরসিক যুবকটি আসবে বলে সে কি পথ চেয়ে থাকে? তেমন কোনও আগ্রহ জন্মায়নি তো এঁর সম্পর্কে? সে কি তার সুপার-ইগো তাকে বারবার সাবধান করে দিচ্ছে বলে? সাবধান। সাবধান অমৃতা ভুলো না ইনি তোমার ক্লাস-বান্ধবী লাবণির বাগদত্ত! ভুলো না তুমি বিবাহিতা, সন্তানসম্ভবা! ভাল লাগা মানেই তো ভালবাসা নয়! কত বর্ণচ্ছায় ভালোবাসা বা ভাললাগা কথা দুটোর। বন্ধুর স্বামীকেও তো ভাল লাগতে পারে, সেটা প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের মতো নয় মোটেই। কিন্তু এটা ঠিক এই লালটু ঘোষ-এর জন্য সে কখনও পথ চেয়ে থাকে না। বাবা-মার চিঠি বা বার্তা আনবেন বলেও না।
আর একটা অদ্ভূত কথা, সে খুব খারাপ হাতে পড়েছিল বটে, তার শ্বশুর শ্রীলশ্রীযুক্ত অনুকূলচন্দ্র গোস্বামী যিনি বরাবরই গুপ্তভাবে প্রতিকূল ছিলেন, তার শাশুড়ি সুষমা যিনি নিজেকে ক্রমাগতই বিষমা বলে প্রতিপন্ন করলেন, সর্বোপরি তার সেই অরিসূদন নামক স্বামী, যে শেষ পর্যন্ত পত্নীসূদন হয়ে দেখা দিল, এরা সবাই মিলে তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি একটা অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল। কেউ ছিল না তখন। কেউ জানত না, সে নিজেই জানত না এমন একটা ব্যাপার হতে যাচ্ছে! এ যেন ঘুমের মধ্যে কাউকে খুন করে ফেলা। তফাত এই যে কাউকে ঘুমের মধ্যে খুন টুন করলেও প্রমাণ থেকে যায়, প্রমাণ থেকে খুনি ধরা পড়ে, যদি পুলিশ ইচ্ছা করে, শাস্তিও হয় যদি আইন-আদালত ইচ্ছা করে, কিন্তু একটি মেয়ে চার মাসের গর্ভিণী তার গর্ভপাত হয়েছে এবং সে তাতে মারা গেছে, এই পরিস্থিতিতে খুব শক্তপোক্ত শক্তিশালী সংকল্পে অটল কেউ না থাকলে কিচ্ছু করার থাকে না। তার বাবা-মা আদৌ এ জাতীয় লোক নন। কিন্তু তার পর থেকে, ক্লোরোফর্ম দিয়ে জোর করে অজ্ঞান করে সেই মেয়েটিকে মিথ্যা কথা বলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সেই যে নার্সিংহোমে নিয়ে এল অমনি কে বা কারা যেন তার সমস্ত দায় তুলে নিল নিজেদের কাঁধে। কারা যেন চারদিক থেকে, দশ দিক থেকে বলে উঠতে লাগল—না না, এ সব বাজে, এ সব মিথ্যা। অমৃতা—অমৃতাই। অমৃতা…অমৃতা। অমনি অমৃতার জন্য এসে গেলেন সিস্টার মাধুরী সেন, এসে গেলেন ডক্টর রঞ্জন কার্লেকর। এসে গেলেন শিবানী মাসি, তারপর এই লালটু ঘোষ, এখন শুনছে এর পেছনে তার য়ুনিভার্সিটির বন্ধুরাও ছিল। এইভাবেই সব এসে যাবে। এসে যাবে যখন যা দরকার। এমন নয় যে সে প্রত্যাশা করে বসে আছে। কিন্তু সে নির্ভাবনায় নির্ভীক চিত্তে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। কোনও কিছুর জন্যেই আগ বাড়িয়ে কারও কাছে হাত পাততে যাচ্ছে না।
মাত্র একজনের কাছেই সে আশ্রয় চেয়েছিল। তিনি শিবানী মাসি। চাইতেও হয়নি— ‘মাসি’ বলে একটা ডাক দিয়েছিল শুধু। কী ছিল সেই ডাকে? কাতরতা? আর্তি? প্রার্থনা? —কে জানে! কিন্তু কথা সব বললেন ডক্টর কার্লেকর এবং মাসি হাট করে খুলে দিলেন দরজা, বাইরের এবং ভেতরের। এখনও পর্যন্ত সে মাসিকে তার ভরণ-পোষণের জন্য মা-বাবার পাঠানো একটা টাকাও নেওয়াতে পারেনি।
—আমার অনেক আছে অমি। কোনও অসুবিধে নেই। তুই যদি আমার মেয়ে হতিস!
—কিন্তু মেয়ে তো সত্যিই নই মাসি। অযথা সেন্টিমেন্টাল হয়ে লাভ কী? আমার মা-বাবারও তো ব্যাপারটা খারাপ লাগবে!
—ঠিক আছে ওঁরা যা পাঠাচ্ছেন নে, নিয়ে রাখ। কখন কী দরকার পড়ে তার ঠিক কী? তোর নিজের দরকার হতে পারে।
এই মাসিকে সে ছোট্ট থেকে ভালবেসে এসেছে। বালিকা হিসেবে এসেছিল মানিকতলার বাড়ি থেকে। উনি ডেকে ডেকে আলাপ করলেন মিল্ক-বুথে।—তোমরা নতুন এসেছ না? কী নাম তোমার? অমৃতা? ও মা! কী সুন্দর নাম!
শিবানী মাসির একটা মেয়ের শখ ছিল খুব। প্রত্যেক মা-ই বোধহয় ভেতরে ভেতরে একটা মেয়ে চান, যাকে দিয়ে যাবেন তাঁর সুখ-দুঃখ-অভিজ্ঞতা-অনুভূতির উত্তরাধিকার। মেয়েদের জীবনটা তো অদ্ভূতই। এক জায়গায় বড় হয়। একরকম পরিবেশে, ধ্যানধারণায়, তারপর তাকে চলে যেতে হয় অন্য পরিবেশে, অন্য পটে, বারবার কত ভূমিকা বদল! মায়েদের গোপন বাক্সে বাক্সে ঝুলিতে ঝুলিতে ভরা থাকে সেই সব।
অমৃতার মা একদিন এক গাঢ় দুপুরে তাকে বলেছিলেন—বাবা! বাবা যে আমাকে কী ভালবাসতেন তুই ধারণা করতে পারবি না খুকি! সেই বাবা আমার ডাক্তারের চেম্বারে আমাকে বসে থাকতে দেখে বেরিয়ে চলে গেলেন। একবারও মনে হল না—কেন? কেন মেয়েটা কার্ডিওলজিস্টের চেম্বারে নাম লিখিয়ে বসে আছে। আজও জানি না বাবা কার জন্য কেন এসেছিলেন। এটা কীরকম জানিস? তুই মনে করছিস সময়টা সকাল, আশপাশে যারা ঘুরছে তারা তোর চেনাজানা ভাল মানুষ ভদ্রলোক, হঠাৎ দেখলি, না, তুই ভুল করেছিস, ওটা আসলে সন্ধে, আশপাশের লোকগুলো চেনা তো নয়ই, ভদ্রলোকও নয়, ওরা সব গুণ্ডা, খুনি, মস্তান…বাবা আমায় সারাজীবন আর মায়ের কোলে ফিরতে দিলেন না, …বলতে বলতে মা নিঃশব্দে কেঁদেছিল।
অমৃতা তখন পনেরো ষোলো বছরের হবে, তার কেমন গা ছমছম করে উঠেছিল। সে বলেছিল—অমন চুপ করে থাকো কেন মা? হাউ হাউ করে, শব্দ করে করে কাঁদো না! ওই জন্যেই তোমার অত বুকে ব্যথা হয়।
—ওভাবে কাঁদতে পারি না খুকি, যদি তোর বাবা শুনতে পান?
—কেন, বাবা শুনলে কী হবে?
—উনি চান না আমি এ সব নিয়ে আর ভাবি। উনি তো খুবই অপমানিত হয়েছিলেন!
একজন মেয়ে তার বাবা-মার কথা ভেবে, তাঁদের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা ভেবে কাঁদবে, তাতেও তার স্বামী আপত্তি করবেন? মা-বাবার সঙ্গে যাঁর জন্যে চিরবিচ্ছেদ! কী অদ্ভূত কথা! এমন করলে তো বুক ফেটে মরে যাবার কথা!
মায়ের বিয়ের সে কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! দু বাড়িতেই আপত্তি। তার বাবা বিশ্বজিৎ মাকে আল্টিমেটাম দিলেন। তিন দিনের মধ্যে মনস্থির করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে জীবনে আর দেখা হবে না। কী সঙ্কট একটি সতেরো আঠারো বছরের মেয়ের! বেরিয়ে তো এলুম এক কাপড়ে। উঠব কোথায়? খাব কী? শ্বশুরবাড়িতে সাত দিনের জন্যে জায়গা হয়েছিল চাকরদের থাকার ঘরে। ওঁরা ব্রাহ্মণ তো, আর আমরা সোনার বেনে! সাত দিনের মধ্যে বিশ্বজিৎ চাকরি ঠিক করলেন, একঘরের এক বাসাবাড়ি তাঁর কোনও বন্ধু জোগাড় করে দিল। তারপর? সংসার করতে গেলে কী লাগে কোনও ধারণা নেই সে মেয়ের। ঘর নোংরা হচ্ছে ঝাঁটা চাই, রান্না করতে হবে? স্টোভ চাই, কেরোসিন চাই, দেশলাই চাই। রান্নার বাসন, খাবার বাসন, চাল, ডাল, তেল নুন, মশলা কিছুই জানে না সেই বড়লোকের দুলালী। তখন পদে পদে মতান্তর, মনান্তর। ঠেকে ঠেকে ঠেকে যবে শেখা হল সব তখন সীমার সীমা পেরিয়ে গেছে। হার্টের অসুখে জবুথবু। এক অসহায়, অকর্মণ্য সুন্দরী, যাঁকে স্বামীর রান্না ভাতে-ভাত, কচি মেয়ের রান্না ডাল-ভাত খেতে হয়। অমৃতার দাদু খুবই ধনী ছিলেন, দুই মেয়ে, তিন ছেলে, আজও পর্যন্ত কেউ এই অসহায় ছোট মেয়েটিকে কোনও সাহায্য করেননি। দাদুর ছেলেরা ছোট বোনের প্রাপ্য বলেও কিচ্ছু দেননি, কিচ্ছু না। স্বর্ণবণিকের মেয়ে সারাজীবন নিরাভরণ রইলেন।
কত কথা! কত অভিজ্ঞতা! এ সবই দিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মেয়েকে। আর কাউকে দেওয়া যায় না। ছেলেকেও না। শিবানী মাসি হঠাৎ একদিন বললেন—অমৃতা, কাউকে কখনও বিশ্বাস করবি না।
—কাউকে বলতে? স্বামীকে যে বিশ্বাস করা যায় না সে তো শিখেই গেলাম মাসি।
—হ্যাঁ তাই বলছিলাম…চুপ করে গেলেন মাসি। হয় তো ঝুলিতে কোনও গুপ্ত কথা আছে, কোনও একদিন বলবেন, বলতে পারবেন অমৃতাকে, বলে মুক্ত হবেন।
এখন বলেন—মেথিফোড়ন দিয়ে চাটনি রাঁধবি। আর লুচির ময়দায় একটু জোয়ান মিশিয়ে নিবি—অম্বল হবে না, খেতেও ভাল হবে। ধোঁকার ডাল বাটায় একটু কুমড়ো কি একটু বাঁধাকপি কি একটু ফুলকপির ফুল বেটে মিশিয়ে নিই আমি, ধোঁকার টেস্টই আলাদা হয়ে যায়।
—তুমিও যেমন মাসি, আমি আর ধোঁকা রেঁধেছি!
সে যখন নতুন শ্বশুরবাড়ি যায় তখনও কতকগুলো টিপস দিয়ে ছিলেন মাসি। খিচুড়িতে নুন আর মিষ্টি একেবারে সমান পরিমাণে দিতে হয়। ডাল চালের চেয়ে একটু কম দিই আমি। অপূর্ব টেস্ট হবে দেখবি। যে সব রান্নায় ঘটিরা মিষ্টি দেয় না, আমরা ঢাকাই বাঙালরা সে সবেও কিন্তু মিষ্টি দিই, খুব সামান্য, ফোড়নের মতো, তাইতে রান্নায় অত লাবণ্য আসে৷