অমৃতা (Amtrita) – ১০
ভোর থেকে সকাল হচ্ছে। আলোটা অস্ফুট, আচ্ছন্ন ছিল, এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শিবানী দত্তর কাজের মেয়ে দরজা থেকে চেঁচিয়ে বলল—মা, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
—বলে দে আমার ফিনাইল লাগবে না,—একটা কণ্ঠ ভেসে এল।
—জ্যাম আছে? জ্যাম—মেয়েটি বলল।
—জ্যামও লাগবে না—আবার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে এল।
—আপনাদের বাড়িতে বুঝি বসবার ঘর নেই? — ভদ্রলোক বললেন।
—কেন থাকবে না? অচেনা অজানা লোককে … বলতে বলতে মেয়েটি থেমে গেল। শিবানী সবে চান করে একটা কালো নকশা পাড় শাড়ি পরেছেন। তাঁর কাঁচাপাকা ভিজে চুল গিঁট দিয়ে পিঠে ফেলা। হাতে একটা ঝোলানো পাত্র।
—তাড়াতাড়ি দুধটা নিয়ে আয় কমলি৷ পাত্রটা নিয়ে কমলি বেরিয়ে গেলে, তিনি অরিন্দমের দিকে চেয়ে বললেন—এত সকালে? আপনাকে তো ঠিক?
—কেন? ডঃ কার্লেকর ফোন করেননি?
—ও, এক্ষুনি আসবেন আমি ভাবিনি। আপনাকে দোতলায় আসতে হবে।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শিবানী উঠোন পেরিয়ে ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, আসুন, একটা অভিজ্ঞতা বটে!
—কার?
—ওর তো বটেই। আমারও, আমাদেরও। শুনুন, ও কিন্তু একটা ভীষণ ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে। শরীরটাও খুব খারাপ। আপনাকে সাবধানে কথা বলতে হবে।
অমৃতা যে কেন ডঃ কার্লেকরকে জয়িতাদির নাম ঠিকানা বলেছিল সে জানে না। এইরকম চূড়ান্ত সময়গুলোতে বোধহয় মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, ভালবাসা, এইসবের পরীক্ষা হয়ে যায়। কিন্তু সল্টলেকের দিকে খানিকটা এগোতেই তার মনে হল—এ সে কী করছে। ক্লাসের বাইরে জয়িতাদির সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ। এইরকম বিপন্ন অবস্থায় তাঁর কাছে গেলে তো তাঁকে বিব্রত করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। তখন সে ডক্টর কার্লেকরকে সম্পদদের বাড়িতে ডোভার লেনে নিয়ে যেতে বলে।
ডঃ কার্লেকর বলেছিলেন—মন ঠিক করো অমৃতা। ইনি নির্ভরযোগ্য তো! অমৃতার মনে পড়ল তারা রমণী চ্যাটার্জিতে আসার পর কেমন করে দুধের বুথে শিবানী মাসির সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। বিধবা, একটি ছেলে নিয়ে একা থাকেন। তারপর সম্পদের সঙ্গে কী ভাব! দুজনকে আলাদা করা যেত না। সম্পদের মা হয়তো অমৃতা সম্পর্কে কোনও আশাও মনে পোষণ করে থাকতেন। কিন্তু সম্পদ কানপুরে চলে যাওয়ার পরই যোগাযোগটা কমে যেতে থাকে। একদিন সম্পদের কাছ থেকে একটা চিঠি পেল অমৃতা।
প্রিয় অমৃতা,
দারুণ আছি। এনজয়িং লাইফ। খুব চনমনে একটা জীবন। তোরা সেই ম্যাদামারা ইউনিভার্সিটিগুলোতে পড়ে এই দারুণ ক্যামপাস লাইফটা মিস করলি। আমাদের এখানে মেয়েরাও পড়ে জানিস নিশ্চয়। একটা সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়ে নাম তটিনী আয়েঙ্গার, খুব আমার পেছনে ঘুরছে। কী করি বল তো! ঝুলে পড়ব? সাউথ ইন্ডিয়ান মানে কিন্তু সেই রাজীব গান্ধীর খুনী ধানু মেয়েটার মতো মনে করিসনি। তটিনী রীতিমতো চার্মিং। আমি ওর অ্যাটেনশন উপভোগ করি। কিন্তু এখনও প্রেম-প্রেম ভাব হয়নি। অন গড। পরামর্শ দিস।
ইতি সম্পদ।
সম্পদের সম্পর্কে ওভাবে কোনওদিনই ভাবেনি অমৃতা। কিন্তু শিবানী মাসির আশার কথা সে বুঝতে পারত। যৌবনে বিধবা, একটিমাত্র ছেলে, এমন পূত্রবধূ চান যাকে চেনেন, জানেন। সহজেই ভালবাসার বিনিময় করতে পারবেন। কিন্তু সম্পদ তো প্রথমত তার একবয়সী বলেই তাকে ভাইয়ের মতো দেখতে অভ্যস্ত ছিল সে, তারওপর এই চিঠিই বলে দিল সম্পদেরও তার প্রতি সেরকম কোনও মনোভাব নেই। তবু শিবানী মাসির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। মাসি ভীষণ শক্ত মানুষ। মনের জোর সাঙ্ঘাতিক। সেইজন্যে ভীষণ খিদের মুখে সে যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে শিবানীমাসির কাছে পৌঁছে গেছিল।
কথায় কথায় মাসিও তার অনেক কথা জেনে গিয়েছিলেন। মা শুনলে হয়তো ভয়ে কেঁদে কেটে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, মাসির এক চোখে আগুন আর এক চোখে জল৷ মাসি বলেছিলেন—অমি, তুই তো এরকম বোকা ভালমানুষ কোনওদিন ছিলি না! গোড়ার থেকে প্রতিবাদ করিসনি কেন, তোর বরকে বলবি তো, পড়াশোনা চালিয়ে এত কাজ আমি করতে পারছি না, বলবি তো তোর খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো হচ্ছে না!
—মাসি পারিনি, আমার একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, হয়তো এটাই ইগো। আমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আর গোড়ার থেকেই ওঁরা এমন বলতেন—ঘটির মেয়ে, দেখো এক ঘটি জল গড়িয়ে খায় কি না।
—এখনও বাঙাল-ঘটি! পঞ্চাশ বছর পরেও? তা তোর বরকে তোর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধের কথা বলেছিলি?
—মাসি, তুমি পারতে?
—আমাদের জেনারেশন আর তোদের জেনারেশন?
—এটা তোমাদের ভুল ধারণা। খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে বেশিরভাগ মেয়েই এখনও লাজুক।
—লাজুক না কি অভিমানী?
—যা বলো। সকালে যাই হোক, রাত্রে তো একই সঙ্গে খেতে বসি। সবাইকার পাতে যা থাকে, আমার পাতে তার অনেকগুলোই থাকে না। ও দেখতে পায় না?
—আচ্ছা, তুই এখন ভাল করে খা। অনেক পুরুষই এগুলো জানে না। ওদের মাথায় আসে না।
—তা হলে আমরা যে অত যত্ন করে ওদের খাবার বেড়ে দিই, পছন্দসই রাঁধবার চেষ্টা করি এগুলো … অল দিজ আর টেক্ন ফর গ্রান্টেড?
—ঠিক ওই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। টেক্ন ফর গ্রান্টেড, বউ কি খেল না খেল নজর করলে পুরুষের পৌরুষ চলে যেত।
—যে-ত। এখনও কি যায়?
—অভ্যেস যে মা। বহু বহু যুগের অভ্যেস, মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে।
—আমি মানতে পারছি না মাসি।
—বেশ তো মানতে না পেরে কী-ই বা করবি। কী করতে পেরেছিস বল? কর না কিছু? বাঁচি তো তা হলে।
মাসি থাকেন একদম একা। ডোভার লেনের ওপর দোতলা বাড়ি। নীচে দুটো ঘর আর রান্নাঘর। ওপরেও তিনটে। একটু বারান্দা। পেছনের দিকে। আর ছাদ। মাসির কাছে সে নিরাপদ আশ্রয় পাবেই। ডঃ কার্লেকরকে নিয়ে সেই শেষ রাতে যখন সে মাসির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটার আকস্মিকতায়, রহস্যে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল, ‘মাসি!’ সে গলা চিরে ডেকেছিল। ‘কে রে?’ উনি বললেন, ‘অমি?—ওমা তুই এখন? কোনও বিপদ-আপদ? উনি কে? জামাই না কি?’
—আমি ডাক্তার। একটু ভেতরে ঢুকতে দিন, আমার হাতে বেশি সময় নেই।’
সব খুলে বলে, নিরাপত্তা আর গোপনতার ব্যবস্থা ষোলো আনা করে উনি চলে গেলে প্রথম ফোনটা সে মা-বাবাকেই করেছিল। বলেই দিয়েছিল যেতে পারবে না, বেশিবার ফোন করতেও পারবে না। ওঁরা যেন না ভাবেন।
অবশ্য অনেক পরে দ্বিতীয় ফোনটা অনেক ভাবনা-চিন্তার পর করে ডঃ জয়িতা বাগচিকে।
—কে বললে? অমৃতা? তুমি না নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলে?
সব শুনে বললেন—ইস্ লোকটাকে মারতে পারলে না, টেনে একটা চড়? হ্যাঁ, অবশ্যই সাহায্য করব। পরীক্ষা তুমি দেবেই। এ বছরেই। হ্যাঁ সিক বেড-এ হলেও।
আত্মগত সে বলে—ব্যস এইটুকুই চাই জয়তীদি। আবার কী? আর কিছু আপনাকে করতে হবে না।
একমাত্র উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছাদটাতে বেড়াতে পারে অমৃতা। দূরদর্শনে নিরুদ্দিষ্ট বলে তার ছবি দেখানো হয়েছে। এ পাড়ার অনেকে তাকে চেনেও। শিবানীর সঙ্গে তারাও আলোচনা করে মাঝে মাঝে। অনেক রকম শুনি বটে, কাগজেও পড়ি। কিন্তু সাক্ষাৎ আমাদের পাড়ার মেয়ে। ছোট্ট থেকে যাকে দেখছি তার এমন হতে পারে? ডাক্তারটাই বোধহয়…
তখন রুক্ষস্বরে শিবানী বলেন—তোমরা কোনও কিছু তলিয়ে ভাববার চেষ্টা করো না কেন বলো তো? ডাক্তারের স্বার্থ কী?
—ওর শ্বশুরবাড়িরই বা কী স্বার্থ?
—আমি জানি না। কিন্তু বধূহত্যা-টত্যা কি শোননি? সেগুলো তো শ্বশুরবাড়িই করে? স্বামী, দেওর, শাশুড়ি, শ্বশুর…
—হত্যাই যদি করবে তো নামী নার্সিংহোমে নিয়ে গেল কেন?
—দেখো পুলিশে কী বলে?
ছাদে বেড়িয়ে বেড়িয়ে সে থার্ড পেপার মুখস্থ করছিল। নিজেরই লেখা, তবু মুখস্থ করতে হয়।
এখন তার শরীরে বেশ ভালমতো গর্ভলক্ষণ দেখা দিয়েছে। কিন্তু তার ফর্সা রঙে এখন লালচে আভা। শরীর একটু ভারী হয়েছে। হনহন করে হাঁটতে তার একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু অন্যসব দিক দিয়েই শরীর সুস্থ। অন্যদের যা-যা হয় বলে সে শুনেছে তার কিছুই তার হয় না। বমি নয়, ব্যথা নয়, খাদ্যে অরুচি নয়। খালি অড়হর বা মটর ডালের গন্ধটা সে সহ্য করতে পারে না। আর কোকিল ডাকলেই সে কানে আঙুল দেয়। অর্থাৎ একটি শব্দ, একটি গন্ধ। বাকি পৃথিবীর রূপরস তার ওপর অত্যাচার করে না মোটেই।
শিবানীমাসি ছাদেই উঠে এলেন অরিন্দম ঘোষকে নিয়ে। সে থতমত খেয়ে গেল।
পাঁচ মাসের গর্ভিণী লম্বা দোহারা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অরিন্দমের বাক্রোধ হয়ে গেল। এ মেয়ের চোখমুখ চলাফেরা সবই নির্ভুলভাবে জানিয়ে দিচ্ছে এ একজন ব্যক্তি, নরম, মধুর। কিন্তু প্রয়োজনে রুক্ষ হতে পারে। সে শুনেছিল গর্ভসঞ্চারে মেয়েরা সুন্দর হয়। বিশ্বাস করেনি, কেন না দেখেনি কখনও। তার থেকে সাত বছরের ছোট বোন যখন মায়ের গর্ভে তখন পেট উঁচু, চোখ বসা মাকে দেখে তার কেমন গা ঘিন-ঘিন করত। নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেত অবশ্য। গর্ভ, অবাঞ্ছিত গর্ভ তার ওপরে, এ মেয়েটিকে কী যে শ্ৰী কী যে মহিমা দিয়েছে! এ যেন সেই ইম্যাকুলেট কনসেপশনের মেরি। ত্বক কী মসৃণ, চুল যেন ঝলমল করছে। মুখেচোখে একটা নরম আলো, খুব মনোযোগে এমনটা হয়। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, যে কাজটা এখন করছে, পড়া, সেটা ছাড়া আর সমস্ত কিছু, গোটা বিশ্বটাই ও ভুলে গেছে। ট্রমা? ও বোধহয় ওর অনতিঅতীত জীবন এবং জীবনসংশয়ের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।
—নমস্কার, আমি আপনার বন্ধুদের পক্ষ থেকে আপনাকে দেখতে এসেছি। ডঃ কার্লেকর অনুমতি দিয়েছেন।
—বন্ধু? কে বন্ধু? অমৃতা অবাক হয়ে বলল…
—ওরা মানে দোলা, তিলক, নিলয়, লাবণি—এরা সবাই আপনাকে খুব খোঁজাখুঁজি করছে। ভী-ষণ মনখারাপ ওদের, ভয়ও।
—ও! অমৃতার চোখ দুটো অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একটু পরে বলল—আপনি কে? গোয়েন্দা? সত্যান্বেষী?
—এগজ্যাক্টলি। ওই শেষেরটা যেটা বললেন।
—ওরা কি আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে?
—অনেকটা তাই। মানে আমি নিজেও আগ্রহী। আপনি যদি বন্ধুদের বা মা-বাবাকে কোনও চিঠি দিতে চান, আমি পৌঁছে দেব।
—আমার মা-বাবাকে আপনি চেনেন?
—চিনে নিতে হয় একজন সত্যান্বেষীকে।
—ওঁদের কাছ থেকেই কি আমার ঠিকানা পেলেন?
—না, না। ওঁরা আপনার বিনা অনুমতিতে ঠিকানা দেবেনই না। কিন্তু ওঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমাকে জানিয়ে দেয় আপনি বেঁচে আছেন, ভাল আছেন। ডঃ কার্লেকরই আপনার ঠিকানা দিয়েছেন।
—তা এখন? এখন আপনি কী করবেন? ওদের সব বলে দেবেন?
—নাঃ, সেটা করা যাবে না। ডাক্তারের বারণ আছে, আমি শুধু ওদের একটু নিশ্চিন্ত করে দেব। কেসটির জন্য অপেক্ষা করতে বলে দেব। আর…
—আর?
—আর সিঙ্গাপুরে ফিরে যাব।
—রিপোর্ট করবেন?
—কাকে?
—আপনার বস্কে?
—হ্যাঁ সে তো করতেই হবে, কিন্তু অমৃতা গোস্বামীর নিরুদ্দেশের বিষয়ে না। আমার কোনও ডিটেক্টিভ এজেন্সি নেই। আমি তো একটা এঞ্জিনিয়ার। সিঙ্গাপুরে কাজ করি। ছুটিতে এসেছিলাম। একটু সত্যান্বেষণ করে গেলাম।
—আপনার নাম?
—নাম জেনে আপনার কী লাভ? ঘোষ আমি ঘোষ একজন।
বলতে বলতে অরিন্দম তাড়াতাড়ি পেছন ফিরল। যেন পালাতে পারলে বাঁচে।