অমৃতা (Amtrita) – ১
ঠিক বেরোতে যাচ্ছে, আজকে ফার্স্ট আওয়ারেই ক্লাস আছে, এমন সময়ে ফোনটা বাজল, শ্বশুর ফোনটা ধরেছিলেন, চেঁচিয়ে বললেন—আবার তোমার বন্ধু, অমৃতা।
‘আবার’টা উনি কেন বললেন অমৃতা বুঝতে পারল না। আজকে তো তার কোনও বন্ধু এর আগে ফোন করেনি! এ বাড়িতে এখন সবচেয়ে বেশি ফোন অবশ্য তারই আসে। খুব স্বাভাবিক। কলেজ ইউনিভার্সিটি ধরলে অনেক বন্ধু তার। সকলেই যে এক পর্যায়ের তা নয়। খুব ঘনিষ্ঠ, খানিকটা ঘনিষ্ঠ, পড়াশোনার সূত্রে বন্ধু, গানবাজনার সূত্রে বন্ধু … এইরকম অনেক শ্রেণী-বিভাগ আছে। তারা ফোন করে, করবেই। অমৃতা বেশিক্ষণ কথা না বলে বুঝিয়ে দেয় আগে যেমন ফোনটাকে একটা গল্প করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত তারা, এখন আর তা চলবে না, চলে না, কিন্তু প্রাণ ধরে কিছুতেই কথাটা সোজাসুজি বলে দিতে পারে না সে কাউকে।
শ্বশুরমশাই অদূরে বসে কাগজ পড়ছেন। রিটায়ার্ড মানুষ। সারাদিন ধরে শুধু খবরের কাগজই পড়েন, উল্টে পাল্টে, পাল্টে উল্টে। দুপুরবেলা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সন্ধেবেলায় অমৃতা চা নিয়ে যেতে হন্তদন্ত হয়ে বললেন—‘কাগজটা, কাগজটা অমৃতা! কাগজটা কোথায় গেল?’ আচ্ছা, অমৃতা তো দশটার সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে, ঢুকছে এই পাঁচটায়। সে কী করে জানবে কাগজটা কোথায়! উনি কখনও খাবার টেবিলে পড়েছেন, কখনও বসার ঘরে পড়েছেন, কখনও শোবার ঘরে। অমৃতা সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে, আর উনি বলতে থাকেন—‘পার্সপেকটিভটা পড়া হয়নি, কড়চাটাও বাদ পড়ে গেছে, এ হে হে, আজ সেন্টারস্প্রেডে সুনন্দ সান্যালের লেখাটার কন্ক্লুশন হল। দুটো মিলিয়ে না পড়লে …’ যেন কাগজগুলো এইটুকু বাড়ি থেকে একেবারে ছুঁ-মন্তরে উড়ে গেছে।
কাগজটা শেষে বাথরুম থেকে পাওয়া যায়। রাজা-উজিররা বাথরুমে বই পড়তেন, বা রইস নেতা ব্যক্তিরা এখনও পড়ে থাকেন এমন কথা অবশ্য শোনা যায়। কিন্তু তার শ্বশুরমশাই অনুকূল গোস্বামী যদি তাদের চার বাই আট সরু লম্বা টয়লেটে কমোডের পেছনে সিসটার্নে কাগজটা রেখে আসেন, তাহলে ধরে নিতে হয় তিনিও বাথরুমে কাগজ পড়ে থাকেন। হোক সে জায়গাটা অপরিসর। পড়াশোনার ব্যবস্থা সেখানে না-ই থাক।
কাগজটা নিতে সে সময়ে কেমন একটু গা ঘিন ঘিন করে অমৃতার। অপরিষ্কার কিছু নয়। তাকে নিজেকেই চানের আগে দুটো বাথরুম ধুতে হয়। কিন্তু একটু পুরনো হতেই কমোড, সিসটার্ন, বেসিন সব কিছুতেই একটা বিবর্ণ ভাব এসে গেছে। মানুষের মল-মূত্রের কথাই কেন কে জানে তার মনে পড়ে যায় বারবার। তার বাবার যখন পা ভেঙেছিল, বাবাকে সে বেডপ্যান দিয়েছে, সামান্য একটু ঘেন্না কি আর করেনি? কিন্তু তাকে ছাপিয়ে ছিল বাবার জন্য দুশ্চিন্তা, যত্ন এবং সেবা করার আগ্রহ, ঠিক সেই ভাবটা শ্বশুরবাড়ির টয়লেট এবং শ্বশুর-শাশুড়ির মলমূত্র সম্পর্কে তার নেই, এটা বুঝতে পেরে একটু লজ্জাবোধ সে করে, কিন্তু ওই পর্যন্তই, ঘেন্নাটাকে আটকাতে পারে না। তবে, সেটা সে বুঝতে দেয় না। ঘেন্নাটাকে জয় করার চেষ্টাও করে যাচ্ছে অনলস। বাথরুম পরিষ্কার করার সময়ে, চান করে রাঁধতে রাঁধতে সেখান থেকে কাগজ আনবার সময়েও। —কে ফোন করল এখন?
—হা লো—
—অমৃতা, আমি রে! আজ তোর ছুটি কটায়? —শম্পার গলা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে শুনলে চিনতে পারবে সে।
—সওয়া চারটে—শ্বশুরের দিকে আড়চোখে চেয়ে সে বলে।
—ইস্স্, দশটা থেকে চারটে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিস না ফ্যাক্টরিতে দিনমজুরি করছিস রে!
—ওই কাছাকাছিই হল৷
—এত কাঠ-কাঠ করে কথা বলছিস কেন রে? হাতের কাছেই কেউ আছেন বুঝি?
—হুঁ।
—আমাকে আড়াইটে নাগাদ একটু সময় দিতে পারবি?
—আবার হুঁ!
—ঠিক আছে, ছাড়ছি—রিসিভারটা রেখে দিল অমৃতা।
তার আসলে আড়াইটেতে ছুটিই আজ। শম্পাকে সময় দিতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এখানে সে ছুটির সময়টা জানায় না। এইটুকু, সারাদিনে এইটুকু সময় সে চুরি করে।
—বাবা আসছি—চটির স্ট্র্যাপে পা গলাতে গলাতে সে বলে। শ্বশুরমশাই ওরই মধ্যে একবার খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে নেন। তিনটে বড় বড় ক্যাসেরোলে ওঁর আর শাশুড়ির দুপুরবেলার খাবার-দাবার গুছিয়ে রেখেছে অমৃতা। টেবিলের ওপর টেবল ক্লথ, তার ওপরে ম্যাট পাতা, সেখানে কাচের প্লেট উপুড় করে রাখা, একটা করে কাচের বাটি। দুটো হাতা ও চামচও পাশে রেখে দিয়েছে সে।
দশটার ক্লাসটা বোধহয় গেল। এগারোটারটা করতেই হবে, জে. বি.-র ক্লাস না করলে, এত কম সময় পড়াশোনা করে, অর্থাৎ এত ফাঁকি দিয়ে এম. এ.-টা টপকাতে পারবে না সে। অথচ, টপকানো দরকার, ভীষণ দরকার।
ঠিক পুকুরের ধারে নিমগাছটায় ফুল এসেছে। সাদা সাদা গুঁড়ির মতন। একটা মৃদু গন্ধ পেয়ে মুখ তুলেছিল। দেখতে পেল। এখন যদি যাদবপুর-হাওড়া মিনিটা ধরতে পারে তাহলে ভাল হয়। সোজা এসপ্লানেড চলে যাবে, সেখান থেকে কলেজ স্ট্রিট। নইলে গড়িয়াহাট পর্যন্ত অটো, তারপর চেঞ্জ করতে হবে। এখন আর নিমফুল-টুলে মন দিলে তার চলবে না। রাস্তা দিয়ে যে মানুষগুলো চলাফেরা করছে, খুব মড মেয়ে, মিনিস্কার্ট, কিংবা মডেলিশ চেহারার যুবক, শক্ত সমর্থ প্রৌঢ় বা টিপ ধেবড়ে যাওয়া প্রৌঢ়া, এই সমস্ত দেখতে, সব কিছুর দিকে মন দিতে তার ভীষণ ভাল লাগে। মনে মনে গল্প ফাঁদে। ওই প্রৌঢ়া যাঁর সিঁদুর টিপ ধেবড়ে গেছে? উনি সিঁদুর-টিপ পরেছেন কেন? আজকাল তো সব্বাই পেছনে আঠা লাগানো বিন্দি পরে। উনি পরেছেন সিঁদুর-টিপ। অথচ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে উনি অফিস যাচ্ছেন, ডালহাউসির টিকিট কাটলেন। অর্থাৎ বেশ আধুনিক। বেশিদিন একভাবে পরলে বিন্দির পেছনে চামড়ায় একটা দাগ হয়ে যায়। উনি বোধহয় এই দাগটাকে ভয় পান। আর তা নয় তো সিঁদুর-টিপ না পরলে বিবাহিতত্ব, সতীত্ব এ সব জাহির করা যাবে না মনে করেন। অনেকেই আজকাল কপাল থেকে সিঁদুর টানেন। এরকম মহিলা এখনও কত আছেন, প্রগতিশীলরা জানেনও না। কিংবা, এই সবচেয়ে সহজ সমাধানটাই তার মনে আসেনি। উনি হয়তো ভিতু মানুষ, কুসংস্কারও আছে, কিন্তু ওঁর একজন শাশুড়ি আছেন, শাশুড়ি ভিতু হোন বা না হোন আরও কুসংস্কারে ভর্তি। সেই সেকেলে শাশুড়িই ওঁকে সিঁদুর-টিপ পরতে বাধ্য করেছেন। ইস্স্, এখনও শাশুড়ির সর্দারি! কত বয়স হবে ভদ্রমহিলার! পঞ্চাশের এদিক ওদিক, ওঁর শাশুড়ি হয়তো ঠিক বাহাত্তর। বাহাত্তুরে। এম. এ.-টা পাশ, তারপর চাকরি, ব্যাস, তারপর তার শাশুড়ির খবরদারি থেকে সে মুক্তি খুঁজবে।
আর ওই যে মডেল চেহারার যুবক। শার্টের ওপরের বোতাম খোলা রেখেছে। ভেতরে ওর বক্ষকেশ দেখা যাচ্ছে। এই যুবকটি ভেবেছে যেহেতু তার প্রকৃতিদত্ত গড়নটা আছে, এবং ব্যায়াম-ট্যায়াম করে সে তাকে আরও সংগঠিত করে তুলেছে, সেহেতু সে তার শার্টের প্রথম অথবা দ্বিতীয় বোতাম খোলা রেখে বক্ষকেশের পৌরুষ যথাযথ দেখাতে পারলেই মেয়েরা সব একেবারে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক তার বর অরি, পুরো নাম অরিসূদন, যেমন ভাবে। তবু তো অরির এ যুবকটির মতো মুখশ্রী নেই। দেহখানা ভাল হলেও এমন সুসংগঠিতও নয় মোটেই। অরি ভাবে, পৃথিবীর যেখানে যত মেয়ে আছে, ওকে দেখলেই কাত হয়ে যাবে।
মিনিস্কার্ট পরা মেয়েটাকে অসহ্য লাগে অমৃতার। ও কী ভেবেছে কী। অতখানি পা বার করে রাখলে ওকে খুব সুন্দর লাগবে? সুন্দরও নয়, সেক্সি। এই এক হয়েছে আজকাল। সেদিন দোকানে গিয়েছিল। নিউমার্কেটে। বাচ্চাদের পোশাকের দোকানে দাঁড়িয়ে ও আর মিলি, ওর রমণী চ্যাটার্জি পাড়ার বন্ধু, এখন যাদবপুর পাড়ার বউ, মিলির ভাইঝির জন্মদিনে দেবার জন্য একটা ফ্রক দেখছিল। পাশের ভদ্রমহিলা বললেন—দেখি দেখি। এরকম আর আছে?
দোকানি আর একটা ওরকম বার করে দিলে নিজের বছর চারেকের মেয়ের গায়ে ফেলে, অদ্ভূত একটা মুখভঙ্গি করে মহিলা বললেন—ওহ, ইটস নট সেক্সি এনাফ।
মিলির এত রাগ হয়ে গেল যে ফ্রক ওরা আর কিনলই না। খেলনার দোকানে গিয়ে একটা পেল্লাই টেডি-বেয়ার কিনে ফেলল। টেডিটা আবার মিলির এত পছন্দ যে ও বলছে ওটা প্রাণ ধরে কাউকে সে দিতে পারবে কি না সন্দেহ। আজকাল এখানেই চমৎকার চমৎকার সফ্ট টয় তৈরি হচ্ছে।
মেয়েটা ছোট স্টেপ কেটেছে চুলে। ওপরের টপটা ওর ঢিলে। কিন্তু স্কার্টটা হাঁটুর ওপর। সবাই তাকাচ্ছে। এই গড়িয়াহাট পাড়াতেও। সবচেয়ে আধুনিক পাড়া বলে যার নাম। চাউনিতে ঠিক যে কোনও লোভ আছে তা নয়। যেটা আছে তাকে বলে ডিসগাস্ট, ছেলেগুলো বোধহয় মনে-মনে মজা পাচ্ছে। মুখে কিছু জানতে দিচ্ছে না। শি ডাজ্ন্ট নো শি হ্যাজ মেড হারসেল্ফ এ পিস অফ এগজিবিট। আচ্ছা ওর কি মা নেই? যিনি ওকে বলে দেবেন, এটা কলকাতা, কলকাতা এখনও লস এঞ্জেলেস নয়, এবং কলকাতার অফিস-টাইমের রাস্তা, ডিসকোথেকও নয়, চ্যানেল ফাইভও নয়। ওর মা নিশ্চয়ই তার শাশুড়ির মতো, যিনি তাঁর দুই বাচ্চার মা মেয়ের বেলায় একেবারে অন্ধ। মেয়ে যখন পিঠ-খোলা, হল্টার ছাঁট ব্লাউজ পরে ঘোরে কিছুই বলেন না, কিন্তু তার বেলায় সালোয়ার-কামিজ পরাও বন্ধ করে দিয়েছেন।
কী সুন্দর সালোয়ার-কামিজগুলো সে করিয়েছিল বিয়ের আগে। কালো জর্জেটের ওপর মেটে লাল কারুকাজেরটা পরেই তো সে অরিসূদনের সঙ্গে আলাদা সাক্ষাৎকারে গিয়েছিল বালিগঞ্জ কোয়ালিটিতে। শ্বশুর-শাশুড়ি যেদিন দেখতে আসেন সেদিন ঘটনাচক্রেই একটা নীল টাঙ্গাইল পরে ছিল। ওরা তো জানত না ওঁরা আসবেন। অতর্কিতে এসে তাকে প্রসাধন-বিনা দেখতে চেয়েছিলেন নাকি। ইস্স্ সেদিন যদি সে একটা স্কার্ট পরে থাকত। তখন নাকি ওঁদের ওকে খুব পছন্দ হয়েছিল। এখন আর পছন্দ হয় না বোধহয়।
ইস্স্—যাই-ই দেখুক, যাই-ই ভাবুক, যত দূরেই যাক—সেই শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-বর প্রসঙ্গ এসে পড়েছে তার মনে। কত ছোট্ট হয়ে গেছে তার পৃথিবীটা, কত ছোট হয়ে গেছে তার জীবন, মনও কী!
বাসটা খুব স্পিডে এসেছে। এমন স্পিডে আসছিল এক এক সময়ে যে ভয় করছিল, বাসটা আবার না খবর হয়ে যায়। সেইসঙ্গে তার সহযাত্রীরা এবং সে-ও। আজকাল এরকম আকছার ঘটছে। স্টপে এসে থামতে, কী শান্তি। কী মুক্তি। পুরনো আকাঙক্ষাগুলো ফিরে আসতে থাকে হুড় হুড় করে। সেই পরিচিত, চিরপরিচিত কলেজ স্কোয়ার, সেন্টিনারি বিল্ডিং, বিধ্বস্ত দর্শন আশুতোষ বিল্ডিং এক ঝলক, অমৃতা ছুটতে লাগল, মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে, জে. বি. নিশ্চয়ই ঢুকতে দেবেন। দৌড়তে দৌড়তে, সত্যিকার গলদ্ঘর্ম অবস্থায় ক্লাসে ঢুকল সে।
—আসতে পারি, ম্যায়াম?
—এসে তো পড়েইছ, আর অনুমতির দরকার কী!
ক্লাসসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। যাক্ বাবা, মজার ওপর দিয়ে গেছে। জে. বি. মোটেই সবদিনে এরকম মুড-এ থাকেন না। এ নিয়ে ক্লাসে প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হয়।
—দ্যাখ, এ. আর. রাগী মানুষ এটা আমরা জেনে গেছি। চোখ সব সময়ে রাগে গোল গোল হয়ে থাকে। পি. এম আবার বড্ড হাসি-খুশি, হাসকুটে বললেই হয়। একটা কোনও মজার উপলক্ষ পেলে সেটাকে আর ছাড়তে চান না। তখন চুলোয় যাক মঙ্গলকাব্য, ক্লাসে খালি হাসির হর্রা ওঠে, কিন্তু জে. বি. যে কখন কী রঙে থাকবেন সেটা কেউ বলতে পারবে না। এমন কেন রে উনি? এই ঝড় এই বাঁশি। এই আগুন এই জল! বুঝি না বাবা।
অমৃতা কিন্তু আজকাল ব্যাপারটা বোঝে। এগুলো প্রোফেসর জে. বি.-র পেছনে যে সংসারী জে. বি. আছেন, তাঁর সেই বিশেষ দিনের অভিজ্ঞতার উপচোনি, যাকে বলে লেফ্ট-ওভার। যেদিন সকালে কিছুর জন্য কিছু না বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যায়, কি শাশুড়ি কি শ্বশুরের সঙ্গে একচোট সেদিন জে.বি. বিরক্ত হয়ে থাকেন। ভীষণ দায়িত্বশীল টিচার তাই লেকচারের ওপর সে সবের বিশেষ প্রভাব পড়ে না, কিন্তু লেকচারের বাইরে যেটুকু অবকাশ, সেখানে পড়ে। এগুলো যে জে. বি. তাকে ডেকে বলেছেন তা নয়। কিন্তু সে জানে। নিশ্চিত জানে।
এ কথা অমৃতা যদি বন্ধুদের, মানে সহপাঠীদের বলে ওরা রৈ রৈ করে উঠবে একেবারে।
—প্রবলেম সবাইকার আছে অমৃতা, তার মানে এই নয় যে বাড়ির ঝালটা তুমি ক্লাসে ঝাড়বে।
‘প্রবলেম সবাইকার আছে’ এটা একটা কথার কথা হয়ে গেছে আজকাল। কেউ বুঝে বলে না, অনুভব করে বলে না। কী অভিজ্ঞতা আছে ওদের? কতটুকু? বাস্তবের কী জানে ওরা?
শর্মিষ্ঠার প্রবলেম কী? না ওর মা-বাবা চান ও দারুণ রেজাল্ট করে, রিসার্চ-টিসার্চ করে একটা অধ্যাপিকা-টিকা হোক, মা-বাবার এই চাওয়ার সঙ্গে শর্মিষ্ঠার চাওয়া একদম মেলে না। শর্মিষ্ঠা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে স্রেফ আড্ডা দেবার জন্য। অধ্যাপিকা হয়ে সারাজীবন পড়াশোনা করা আর পড়ানো?—ওরে বাবা। তার চেয়ে কলেজ স্কোয়ারে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করাও ভাল–ও বলে থাকে।
কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি প্রখর বলে ও বরাবর ভাল রেজাল্টটাও করে যাচ্ছে। ও এই ব্যাপারটা নাকি বাবা-মাকে বোঝাতে পারে না।
তিলকের কী প্রবলেম? না এত বড় ক্লাসে মাত্র নটি ছেলের অন্যতম ও। ওর বন্ধুরা যখন ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিকস এই সব পড়ছে, তখন ওকে বাংলার মতো একটা রদ্দি সাবজেক্ট পড়তে হচ্ছে। রদ্দি কেন রে? তুই জে. বি.-র ক্লাস, এ. কে. বি.-র ক্লাস, এ. আর.-এর ক্লাস উপভোগ করিস না? ভাল লাগে না তোর রবীন্দ্রনাথ খুঁটিয়ে পড়তে? ভাল লাগে না আধুনিক কবিতা বুঝে নেবার সুযোগ?—হ্যাঁ, লাগে, ভালই এনজয় করে, কিন্তু কোনও প্রসপেক্ট তো নেই! ভবিষ্যতে কী হবে এই ভাবনায়, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়ে-ক্লাসে পড়তে বাধ্য হবার কমপ্লেক্সেই ছেলেটা মুখ শুকিয়ে থেকে থেকে নিজের মনের ওপর অহেতুক চাপ বাড়াচ্ছে।
অনিন্দিতার প্রবলেম তো আর এক। ওর দিদিকে ওর চেয়ে দেখতে অনেক সুন্দর, তাই লেখাপড়ায় তাকে ওর ছাড়িয়ে যেতেই হবে। বোঝো? এটা একটা প্রবলেম হল? দিদিটা তো তোরই, না কী!
অমৃতার একেক সময় মনে হয় নিজের দিনরাতগুলো সে ওদের ধার দেয়। ওই অনিন্দিতাকে, ওই তিলককে, শর্মিষ্ঠাকে, রণিতাকে, চঞ্চলকে। ধার দেয় অন্তত একটা সপ্তাহের জন্য। তখন হয়তো বাস্তব সত্যি সত্যি কী, সে ধারণা ওদের হবে।
আপাতত কল্লোল যুগ এবং অচিন্ত্য সেনগুপ্ত এবং জগদীশ গুপ্ত। অমৃতা ক্লাসে মন দেয়।
বেল বাজল, ক্লাস শেষ হচ্ছে। জয়িতাদি অর্থাৎ জে. বি. হঠাৎ বললেন—অমৃতা ব্যানার্জি।—হ্যাঁ— সে উঠে দাঁড়াল, বাধ্য বিনীত মেয়ের মতো।
—আজ তিনটের সময়ে আমার সঙ্গে দেখা কোরো একবার। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে থাকব।
সর্বনাশ! আবার দেখা-টেখা করতে বলেন কেন রে বাবা! বন্ধুরা বলতে লাগল—তোর ব্যাপারই আলাদা অমৃতা, তুই জয়িতাদির চোখে পড়ে গেছিস। এখন রোটেশন-এ উনিই হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। তোর ফার্স্টক্লাস বাঁধা …
বিরক্ত অমৃতা যতই ওদের মন্তব্যগুলো ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে, ততই ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকে ওরা।
তিলক বলল—অধমের দিকে একটু কৃপাবৰ্ষণ করিস রে অমৃতা, একেই তো স্কুলমাস্টারি ছাড়া আর কিছু জুটবে বলে মনে হচ্ছে না।
অমৃতা রেগে-মেগে বলল—স্কুলমাস্টারি তোর মতো ছেলেদের না জোটাই উচিত। তাগড়া স্বাস্থ্য কর দিকি, রিকশ কি অটো চালাবি এখন, বেশ পুরুষালি কাজ। অন্তত নাকে কাঁদবার সময়টা পাবি না।
অমৃতার বাবা স্কুল-টিচার। স্কুল-টিচিং নিয়ে এসব কথা বললে ওর গায়ে লাগে। তিলকের মতো বা অনিন্দিতার মতো ও কমপ্লেক্সে ভোগে না। উচিত জবাব দেয়।
আজকে অর্থাৎ দুটো অ্যাপো। আড়াইটের সময়ে শম্পা, শম্পাকে সাধারণত ক্যানটিনেই দেখা করতে বলে ও। তো তারপর ছুটতে হবে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। খুঁজে বার করতে হবে জয়িতাদিকে। কেন ডেকেছেন কে জানে বাবা! বুকটা গুরগুর করছে। শম্পা আবার কথা শুরু করলে থামতে জানে না। কোথাও কমা, ফুল স্টপ নেই ওর। কথার সূত্রে কথা, তার সূত্রে আরও কথা, আর কাউকে কিছু বলতেই দেবে না ও। অর্থাৎ ফার্স্ট থিং ওকে আজ বলতে হবে,—শম্পা আমার সময় নেই, তিনটের সময়ে জয়িতাদি ডেকেছেন। মাস্টারমশাই, বুঝিস তো?
চৈত্র শেষ হলেও দিনটা বেশ ফুরফুরে আজ। হাওয়া-টাওয়া দিচ্ছে। দুটোয় ছুটি হতে ওরা সবাই কফিহাউজ যাচ্ছে, তুমুল আড্ডা হবে সেখানে, যে যার পকেট থেকে ব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা বার করবে। মোগলাই আসবে, পকোড়া আসবে, কফি তো আছেই। ইংরেজির তিশান ছেলেটা আসলে আরও জমবে। তিশান হচ্ছে একটি সবজান্তা হামবড়া ছেলে। ভীষণ আঁতেল-আঁতেল ভাব করে। তো আঁতেলমিটাও তো কোথাও না কোথাও ফলাতে হবে। তিশান খুব সম্ভব এই তাদের গ্রুপটাকে সে জন্য বেছে নিয়েছে। তিশানের আসল নাম নিশান। ও হচ্ছে আর্ট বিষয়ে অথরিটি। সব জানে। প্রি-র্যাফেলাইট, ইমপ্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়্যালিজম, ডাডাইজম স-ব। তা ও “তিশান-তিশান’ করত, অমৃতাই একদিন জিজ্ঞেস করে তিশান কে রে? কোন দেশের? কবেকার? তখনই বোঝা যায় ওরা যাকে টিশিয়ান বলে জানে তাঁর নামের আসল উচ্চারণ নাকি তিশান। ওরা যাকে জিয়োতো বলে, তাঁর নামটা উচ্চারিত হবে জত্তো৷ র্যাফায়েল নয়, র্যাফেইল। ওদের মুখে ‘গয়া’ শুনে তো নিশান বাঁকা হেসে মুখে একটার পর একটা মৌরি ফেলতেই লাগল, ফেলতেই লাগল, শেষে বলল—শুধু গয়া বলছিস কেন? ‘গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী মথুরা’ সবগুলো বল। গয়া নাকি উচ্চারণ নয়। ওটা হবে ‘গোইয়া’। তো সেই সূত্রেই শর্মিষ্ঠা ওর নাম দেয় তিশান। সেই তিশান আসলে আড্ডাটা ভাল জমে ওঠে। পারস্পরিক ঠাট্টায়, কথার পরে কথার খেলায়, তিশান তাদের যে জ্ঞান দান করে সেগুলোও নেহাত ফ্যালনা নয় : ভার্জিনিয়া উল্ফ নাকি একটা করে উপন্যাস লিখতেন আর পাগল হয়ে যেতেন, লরেন্স নাকি ভেগেছিলেন তাঁর নিজের মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে, শুধু অসকার ওয়াইল্ড নয়, ফরস্টার সাহেবও ছিলেন সমকামী, শেলির প্রথম বউ নাকি শেলির অবহেলায় বারনারী হয়ে গিয়েছিলেন … এইসব কেচ্ছা কেলেঙ্কারি কি পাগলামি না থাকলে না কি কোনওরকমের শিল্পীই হওয়া যায় না। সে যাক, আজ হয়তো তিশানের সঙ্গে ওদের খুব জমবে, কিছুটা সময় তরলভাবে কাটতে পারত, কিন্তু অমৃতার তা কপালে নেই। শম্পা তার স্কুলের সময়কার বন্ধু। চিরকালই দুজনে যত ঝগড়া, তত ভাব। শম্পার ধারণা, অমৃতা হল যাকে বলে ‘লাকি’। সেই জন্যেই বরাবর অমৃতার রেজাল্ট শম্পার চেয়ে ভাল, সেইজন্যেই অমৃতার মা-বাবা দুজনেই জীবিত, এবং সেইজন্যেই অমৃতার এত অল্পবয়সে অত ভাল বিয়ে হয়েছে। শম্পা চিরকালের ‘আনলাকি’। বিধাতাপুরুষ আঁতুড় ঘরেই তার কপালে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রেখেছেন তাই তার অল্পবয়সে বাবা মারা যান, তাই তার মামারা তাকে দেখে না, মাকে চাকরি করতে এবং ভীষণ ভুগতে হয়, তাই-ই শম্পা কালো, তাকে দেখতে ভাল না, অমৃতার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাই-ই তার রেজাল্ট অমৃতার চেয়ে খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাল করে ভেবে দেখতে গেলে সম্পর্কটা ঈর্ষার। ইচ্ছে করলে অমৃতাও শম্পাকে হিংসা করতে পারত ঠিক যে যে কারণে শম্পা তাকে হিংসে করছে সেই সেই কারণেই। শম্পার মা চাকরি করেন বলে অমৃতার মায়ের থেকে তিনি অনেক বাস্তববোধসম্পন্ন, কাণ্ডজ্ঞান তাঁর অনেক বেশি, স্বাধীন ইচ্ছার মানুষ। শম্পা কালো বলেই তার চেহারার শ্রীটুকু চট করে চোখে পড়ে না, না হলে হয়তো অমৃতার মতোই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। অমৃতার যেমন ভাষাজ্ঞান, সাহিত্য-জ্ঞান ভাল, শম্পার যে তেমন অঙ্কের মাথা অনেক ভাল, যে কারণে সে বি.এসসি করেই কম্পুটার ট্রেনিং নিয়ে মোটামুটি ভাল একটা চাকরি করতে পারছে। সেও তার ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারবে। শম্পা জানে না অমৃতার তুলনায় সে কত বেশি ভাগ্যবতী। একমাত্র দুর্ভাগ্য তার বাবার অল্পবয়সে মারা যাওয়াটা। সেটা মানতেই হয়। কিন্তু, অমৃতা জানে এসব কথা সে শম্পাকে বোঝাতে পারবে না। কখনও না।
ওই তো আশুতোষ বিল্ডিং-এর গেট দিয়ে শম্পা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। একটা হালকা রঙের ছাপা সালোয়ার কামিজ আর একটা পরিষ্কার বিনুনিতে শম্পাকে কত হালকা কত সুশ্রী, নির্ভার, স্বাধীন সুন্দর দেখাচ্ছে তা যদি ও জানত!
—অমৃতা, বাঃ এই তো তুই পাংচুয়ালি এসে গেছিস। চল কফিহাউজে যাই।
—না রে আমাকে আজকে প্রোফেসর বাগচি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে তিনটের সময়ে যেতে ডেকেছেন। তোর কী বলবার আছে তুই তাড়াতাড়ি বল বরং। আমরা একটু ওইদিকে দ্বারভাঙার সিঁড়িতে বসি চল।
—এত তাড়া করলে হয়? এভাবে কিছু বলা যায়? অমি, তুই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস, প্রতিদিন …
এ নালিশও শম্পার বহুদিনের। প্রতিবাদ করে লাভ নেই। অমৃতা বলল—কী করব বল, প্রোফেসর ডেকেছেন, না করতে তো আর পারি না। তুই বল না। আমি শুনছি। শুধু একটু ছোট করে বল। তোর নিশ্চয়ই কোনও জরুরি কথা আছে।
—জরুরি, বলে জরুরি। শম্পা মুরুব্বির মতো হাত আর কান নেড়ে বলে। কানে খুব বড় সাইজের রিং পরেছে ও। ওর মুখের পক্ষে অনেক বড়। কিন্তু রিংগুলো ওর মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুলতেই অদ্ভূত ভাল লাগে ওকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অমৃতা মনে মনে গেয়ে ওঠে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।’ গানটা যে কবে গলা থেকে মনে চলে গেছে ও টের পায়নি। এখন যেন আর গানের দিন নেই।
—তোকে একটা কথা বলিনি অমৃতা, প্লিজ কিছু মনে করিস না, আমার ইমিডিয়েট বস, অর্থাৎ প্রোজেক্ট ডিরেক্টর বেশ কিছুদিন ধরে খুব মানে বেশ ইনট্রেস্ট দেখাচ্ছে আমার ওপর। তোর কী মনে হয়?
—আমার কী মনে হবে? সিচুয়েশন তোর, মনে হওয়াটাও তোর।
শম্পার চোখে অভিমান ঘনিয়ে আসে তক্ষুনি।
—কথাটা তোকে বলিনি, কারণ আমি খুব শিওর ছিলাম না। রাগ করছিস কেন?
—আরে! রাগ করিনি। কিন্তু আমি যে ভদ্রলোককে দেখলুম না, তোর সঙ্গে তাঁর ইনটার-অ্যাকশন দেখলুম না, কী করে আমার কিছু মনে হবে, বল!
—তোর সঙ্গে শিগগির একদিন আলাপ করিয়ে দেব, বুঝলি? খালি একটাই ভয় করে। তোর সঙ্গে আলাপ হলে হয়তো আর আমার দিকে ফিরেও চাইবে না।
অমৃতা উঠে দাঁড়াল, বলল—বাজে কথায় নষ্ট করবার মতো সময় আমার নেই রে শম্পা। তোর কথা যদি হয়ে গিয়ে থাকে তো এবার আমায় ছেড়ে দে।
তার হাত ধরে টানল শম্পা—কথা শেষ হয়নি, আসল কথাটা বলাই হয়নি। শোন প্লিজ। আমরা। মানে আমি আর ও, সৌমিত্র দাস, দু-চারটে সিনেমা একসঙ্গে দেখেছি, ওয়ালডর্ফে খেয়েছি কয়েকবার, এখন একটা উইক-এন্ড ও দিঘায় যেতে চাইছে আমাকে নিয়ে।
অমৃতা চমকে উঠল।
—ছেলেটা, মানে লোকটা কিন্তু ভীষণ ভাল। কোনওদিন একবার হাতটাও ধরেনি। ও বলছে আমাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ফাইন্যাল বোঝাপড়ার জন্যে অন্য কোথাও যাওয়া দরকার। মা মত দিয়ে দিয়েছে। তুই কী বলিস!
অমৃতার চোখদুটোয় ক্রোধের জ্বালা। সে বলল—এটা যে অত্যন্ত অসম্মানজনক প্রস্তাব সেটা বোঝবার জন্যে তোর আমার কাছে আসতে হবে? শম্পা তুই দিনকে দিন অবোধ শিশু হয়ে যাচ্ছিস, না কী বল তো!
—শোন, আমি জানতুম তুই রাগ করবি। প্রস্তাবটা ওইরকম শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু সৌমিত্রকে দেখলে, জানলে তুই কথাটা বলবার আগে দুবার ভাবতিস। হি ইজ সো অনেস্ট অ্যান্ড অনারেব্ল। অফিসে ওর খুব নামডাক।
—সে যেমনই হোক, এটা যে ‘তোর’ পক্ষে অসম্মানজনক একটা প্রস্তাব, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তুই ‘না’ করে দিবি শম্পা।
—কিন্তু, কিন্তু তা হলে ও যদি বিয়ের প্রোপোজ্যালটা ফিরিয়ে নেয়?
—নিলে নেবে। শম্পা তোর বছর বাইশ বয়স হবে। এখনই কি তুই এমন অরক্ষণীয়া হয়ে গেলি যে তোকে বিয়ের জন্য একটা লোকের সঙ্গে উইক-এন্ড কাটাতে হবে?
—তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই সেফ অ্যান্ড সিকিওর, তুই আমার কথাটা বুঝবি না ঠিক। কে আমার বিয়ে দেবে বল? বিনা যৌতুকে আমার মতন একটা কালো মেয়েকে কে-ই বা বিয়ে করবে?
—তুই পাগল হয়ে গেছিস শম্পা। তোর কথা শুনে আমার ছি ছি করতে ইচ্ছে করছে।
—তা তো করবেই। অমৃতা, তোর বিয়েতে মাসিমা মেসোমশাই কত ডাউরি দিয়েছিলেন, কী কী আইটেম আমি কিন্তু সব জানি।
রাগে জ্ঞান হারাল অমৃতা।
—তা তুই কি তা হলে ডাউরি নেই বলেই, সেই ছেলেটাকে বিয়ের আগে দুটো রাত উপহার দিতে চাইছিস?
—আর একটাও কথা তোর সঙ্গে আমি বলব না, শম্পা বলল।—তোদের ক্লাসকে আমার খুব জানা হয়ে গেছে। আরও জানা হয়ে গেল। তোরা সেই যাকে বলে না ‘নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ সেই। যা তুই ভাল মেয়ে তোর প্রোফেসরের কাছে নোটস নিগে যা। শুধু যাবার আগে একটা কথা শুনে যাস, যে সৌমিত্র দাসকে না দেখেই চূড়ান্ত একটা অপমানকর মত দিয়ে দিলি সে মানে হি ইজ এ পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান, তোর বরের মতো এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার না হতে পারে, কিন্তু ওর লাইনে ও-ও বহু দূর পর্যন্ত উঠবে, উঠবে, উঠবে।
শম্পা রাগে গরগর করতে করতে উড়ুনিটা উড়িয়ে, কানের রিং দুলিয়ে চলে গেল।
একটা অনেক কষ্টে তৈরি করা শান্ত দুপুর ভেঙে খান খান হয়ে গেল। যাঃ। সে-ই একমাত্র জানে কত সাবধানে, নিজের সমস্ত শক্তি কতখানি প্রয়োগ করে তবে এইরকম একটা শান্ত দুপুরে পৌঁছনো যায়। এখনও চারিদিকে স্তব্ধতার তরঙ্গ। আড্ডা-পিয়াসীরা ক্যান্টিনে কিংবা কফিহাউজে, পড়ুয়ারা ক্লাসে। একজন বৃদ্ধমতো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। —মা, অফিসটা কোথায় বলতে পারো?
—অফিস তো একটা না! আপনি কী কাজে এসেছেন বলুন।
—এই একটা রিভিউয়ের অ্যাপিল জমা দেওয়া হয়েছিল, ছেলের বি.এ. পরীক্ষার।
ঠিক উইন্ডোটাতে ওঁকে নিয়ে গেল অমৃতা। ফেরবার সময়ে আবার সেই অনর্থক চিন্তা তাকে খোঁচাতে লাগল। এই ভদ্রলোকের ছেলে বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছে? এঁর তো নাতির বি.এ. দেবার কথা। অদ্ভূত তো, ভদ্রলোকের শেষ বয়সের ছেলে বোধহয়, হঠাৎ হওয়া, তখনও কি নিরোধ-টিরোধ বেরোয়নি? আবার দেখো মজা, ছেলে নিজে আসেনি, বাবাকে পাঠিয়েছে। নাতিপ্ৰতিম ছেলের প্রতি হয়তো ভদ্রলোকের ভীষণ মায়া। আদর দিয়ে মাথাটি খেয়েছেন একেবারে। এ ছেলের কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না।
সে-ও তো বাবা-মা-র একমাত্র সন্তান। খুবই আদরের। কিন্তু জীবনকে মুখোমুখি একটা লড়াই দেবার চেষ্টা তো সে করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে নিরন্তর। অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। অনেক কিছুই নিজের হাতে করে নিতে অভ্যস্ত সে৷ নিজের ইউনিফর্ম বরাবর নিজে কেচে পরেছে। পি.টি.-র জন্য কেডস-এ চক লাগানো, নিজের টিফিনটা গুছিয়ে নেওয়া, বাবাকে সময়মতো চা বা অন্য কোনও স্বাস্থ্য-পানীয় দিয়ে আসা, লোক না আসলে বাসন-টাসন মেজে নেওয়া। কোনওদিন এসব কাউকে বলতে যায়নি সে। কোনও নালিশও ছিল না—কে জানে তার ভাগ্যবিধাতা এইভাবেই তাকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন কি না।
এই সময়ে সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর দিকে যেতে দেখল সে জয়িতা ম্যাডামকে। উনিও তাকে দেখতে পেয়েছেন। দাঁড়িয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সে—আমি আসছি ম্যাডাম। উনি বললেন—ঠিক আছে লাইব্রেরিতে আর আসতে হবে না। আমার তোমাকে একটা ছোট্ট কথা বলার ছিল। সেটা বলেই ছেড়ে দেব। বলছিলাম—রোজ অত লেট করো কেন? থাকো কোথায়?
—যাদবপুর। মানে যাদবপুরের কাছে।
—দূর, মানছি। কিন্তু দূরত্বটা যখন জানাই হয়ে গেছে তখন তো সময় হাতে নিয়েই বেরোতে পারো।
—না, ম্যাডাম, আসলে …
—অন্য কিছু না। তোমরা ভাল ছাত্রীরা, ভাল মেয়েরা এইভাবে নষ্ট হয়ে যাও এটা আমার ভাল লাগে না। অমৃতা, দুটো যদি না পেরে ওঠো, তা হলে একটাই চুজ করে নাও। স্বামীসঙ্গ বা লেখাপড়া। দুটো একসঙ্গে হয় না।
জয়িতাদি লিফ্টে উঠে চলে গেলেন। অমৃতা সেখানেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ক্রোধ, নিজের ওপর, ম্যাডামের ওপর, তারপর নিদারুণ দুঃখ, নিজের জন্য, বাবার জন্য, মায়ের জন্য, তার পরে আবার ক্রোধ, নিজের ওপর, সম্পূর্ণ নিজের ওপর, একটা কথাও স্বপক্ষে বলতে পারল না বলে। ওই যে ছোট করে চুল ছাঁটা, ঈষৎ চৌকো মুখের আধা-ফর্সা, ভীষণ ব্যক্তিত্বঅলা মহিলা, যিনি এখন সম্ভবত তাদের ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে সমর্থ, সবচেয়ে আন্তরিক শিক্ষক, আসেন নিজস্ব একটা সাদা মারুতি এইট হানড্রেড নিজে চালিয়ে, উনি কী জানেন, কতটা জানেন, তার মতো একটি প্রায়ই-লেট ছাত্রীর জীবন সম্পর্কে? কী বোঝেন? যদি না-ই জানেন এবং না-ই বোঝেন তো কড়া-কড়া মন্তব্য করেন কেন? যেন উনি দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে অমৃতা স্বামীর অফিস যাবার সময়ে দীর্ঘক্ষণ তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। কিংবা স্বামীর আহ্বানে তার অফিস যাবার আগেই একবার …। সিঁথির মধ্যে সরু সিঁদুরের রেখা দেখেই উনি সব বুঝে নিলেন? বাঃ।
উনি কেমন করে জানবেন তার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির একটি কাজের লোক ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য লোকটিরও আসার কোনও ঠিক নেই। আসবে না এই ভয়ে সাত সক্কালেই তাকে তিনখানা ঘর আর খাবার-জায়গাটা ঝাঁট দিয়ে রাখতে হয়। শ্বশুর রিটায়ার্ড, কোনখানটা ঝাড়া ভাল হল না, কোন জায়গাটা ঝাঁট পড়ল না এসব ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য সে সময়ে তিনি হাজির থাকেন। শাশুড়ি স্কুলে চাকরি করেন। ভোর সাড়ে ছটায় আরম্ভ। তার আগে উঠে তাঁকে চা-জলখাবার তৈরি করে দেওয়া তার কর্তব্য। তার পরে শ্বশুর। তার স্বামী আর সে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে চা আর বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খায় না সকালে। তার পরেই তাড়াতাড়ি চান সেরে তাকে দুটো গ্যাস জ্বালিয়ে সংসারের রান্না শেষ করে, ঠিক নটায় স্বামীকে খেতে দিতে হয়। তিন-চারখানা ক্যাসেরোলে বাকি দুজনের খাবার ঠিক করে রাখতে হয়, এতসব করে, রান্নাঘর ঝকঝকে করে মুছে অনেক সময়ে তার নিজের খাবার সময়ই থাকে না, কোনক্রমে কয়েক দলা ভাত গলার ভেতর পাঠিয়ে সে যেমন আছে তেমন বেরিয়ে আসে। সকালে চান করেই সে কলেজে যাবার কাপড় পরে নেয়। এপ্রন তো তাকে কেউ কিনে দেবে না, তাই একটা তোয়ালে ব্লাউজের দুপাশে কাঁধের কাছে পিন দিয়ে আটকিয়ে কোমরে গুঁজে একটার পর একটা কাজ সারতে থাকে সে। স্বামীসঙ্গই বটে!
বিকেলে বাড়ি ফিরবে। ছটা পর্যন্ত চায়ের জন্য অপেক্ষা করবেন ওঁরা। তবু নিজেরা করে নেবেন না। ছটা বেজে গেলে, করবেন, শুধু নিজেদের জন্য। তাকে তার নিজেরটা করে নিতে হবে। লোক না এসে থাকলে বাসন মাজো, ঘর মোছো। তারপর আবার বসে যাও রাতের রুটি তরকারি বানাতে। ফ্রিজ খুললেই তার শাশুড়ি বলেন—বউমা কী নিলে?—ওঁর ভয় যদি অমৃতা ফ্রিজ থেকে দুধ বা কোনও ফলটল নিয়ে খেয়ে ফেলে! অথচ তার শাশুড়ি একজন স্কুল-টিচার! স্কুল টিচার!
সওয়া তিনটে বেজেছে এখন। কিছুটা সময় হাতে আছে এখনও। সাড়ে চারটেয় ক্লাস ছুটি কবুল করা আছে তার। হঠাৎ সে টের পেল খিদেয় তার বত্রিশ নাড়ি পাক খাচ্ছে। আজ কাজ সারতে সারতে দেরি, তারপর শম্পার ফোন আসায় তার বরাদ্দ লপ্সিটা খেতে বেমালুম ভুলে গেছে সে। ভুলে গেছে জয়িতাদির ক্লাস করবার আগ্রহে, তাড়ায়। যে জয়িতাদি, সে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ক’ মিনিট আগেই রায় দিয়ে গেলেন।
হঠাৎ তার মায়ের কাছে যাবার একটা তীব্র ইচ্ছে হল। কিন্তু তার নিজের মা এখন অনেক দূর, সল্টলেক করুণাময়ী, সে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলে মায়ের আবার না হার্ট-অ্যাটাক হয়। অথচ ভেতরে তীব্র তীক্ষ্ণ একটা মা মা ডাক! সে গড়িয়াহাটের মোড়ে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো নেমে গেল, ডোভার লেনে তার ছোটবেলার বন্ধু সম্পদের বাড়ি। সম্পদ ছিল তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, এখন আই.আই.টি. কানপুর। হঠাৎ সে দেখল সে সম্পদের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের রাস্তাটা সে কীভাবে এসেছে, কীভাবে পার হয়েছে, কিছুই মনে নেই তার।
—তুই? অমৃতা? আজকে কোন দিকে সূর্য উঠল রে! মাসি অবাক হাসিতে মুখ ঝলমলিয়ে বললেন।
উত্তরে অমৃতা বলল—মাসি, আমাকে কিছু খেতে দেবে?