রবিবারের সকালবেলা
দুদিন পরেই, রবিবারের সকালবেলা সুজিত দেখল, শিবেন নিজে দাঁড়িয়ে বাইরের ঘর পরিষ্কার করাচ্ছে। সে শুনেছে, আজ বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী আর প্রিয়নাথ দাশ এখানে আসছেন। হয়তো এমন কিছু নয় ব্যাপারটা, তবু সুজিতের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। শিবেন নিজেই তাকে বলেছে, সুনীতার সঙ্গে যাতে তার বিয়ে হয়, সেটাই প্রিয়নাথের এবং বীরেন্দ্রনারায়ণের ইচ্ছা। কিন্তু সুনীতা নাকি এখনও কোনও মতামত দেয়নি। এটা প্রধান বাধা। তা ছাড়া রঞ্জন যে একটা সমস্যা, এ কথাও সে স্বীকার করেছে। রঞ্জন যে কত দূর কী করতে পারে না পারে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। শিবেনের ভাষায়, রঞ্জন হচ্ছে একটা নোংরা লোফার, যার কোনও আত্মসম্মানবোধ নেই। যাদের আত্মসম্মানবোধ নেই, তারা কিনা করতে পারে। তবে সুনীতাই হচ্ছে সুনীতার মালিক। সে যা বলবে, সে যা চাইবে, তাই হবে!
গতকাল রাত্রেই এ সব কথা হচ্ছিল। স্বভাবতই, সুজিত তার স্বাভাবিক কৌতূহলবশতই হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিল শিবেনকে, আপনি বুঝি সুনীতাকে খুব ভালবাসেন?
শিবেন থমকে গিয়েছিল। ভ্রূ কুঁচকে, ঠোঁট টিপে খানিকক্ষণ নির্বাক থেকে বলেছিল, ভালবাসার আমি কিছু বুঝি না, জানিও না। বিয়ে একটা সামাজিক রীতি, মানুষ করেও থাকে, তাই করা।
সুজিত গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ও! তবে সুনীতাকে বিয়ে করবার চেষ্টা করছেন কেন? যে কোনও মেয়েকে করলেই তো হত।
শিবেন হঠাৎ রেগে উঠে বলেছিল, সে কৈফিয়ত আপনাকে দিতে চাই না।
সুজিত তাড়াতাড়ি বিব্রত হয়ে বলেছিল, না না, তা দেবেন কেন। বিশেষ কাউকে বিয়ে করতে চাইলে মনে হয়, নিশ্চয়ই খুব ভাল লেগেছে, মানে তাকে পাবার জন্যে মনটা কী বলে, আমার আবার সবসময় সব কথা ঠিক মুখে জোগায় না!
শিবেন সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল, মুখে জোগায় না?
সরলভাবে হেসে বলেছিল সুজিত, না। মানে আমি কী বলছি, তাকে পাবার জন্যে–পাবার জন্যে-মনটা যাকে বলে, ভীষণ ব্যাকুল হয়ে থাকে, সমস্ত মন জুড়ে সে থাকে, সব সময়ে তাকে পেতে
শিবেন প্রায় ধমকে উঠেছিল, থাক, আপনার ও সব বইয়ের বুলি কপচানো আমি ঢের জানি।
–ও!
–হ্যাঁ, ও সব ভালবাসার ন্যাকামি আমি কিছুই জানি না। এ যুগে আমার কাছে স্ট্যাটাসটাই বড় কথা। স্ট্যাটাস, স্ট্যাটাস, তার মানে বোঝেন?
সুজিত অসহায় ভাবে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল, না।
–তা হলে আপনাকে আমার কিছু বোঝাবার নেই। খালি এটুকু জেনে রাখুন, সুনীতাকে বিয়ে করলে এই সমাজে দুর্নামে কান পাতা দায় হবে, তবু আমি বিয়ে করতে চাই।
কারণ সুনীতা অনেক টাকা পাবে প্রিয়নাথ দাশের কাছ থেকে, বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল সুজিত।
শিবেন বিরক্ত বিস্ময়ে বলেছিল, জানেন দেখছি। কার কাছে শুনেছেন?
সুজিত হেসে বলেছিল, তার নাম বলতে বারণ আছে।
শিবেন ভ্রু কুঁচকে বলেছিল, দোলার কাছে শুনেছেন?
বললাম যে আপনাকে, নাম বলতে বারণ আছে, আমি কথা দিয়েছি কিনা। তা ছাড়া, আপনি তো দোলাকেও বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু
তীব্র উত্তেজনায় শিবেন প্রায় গোঙানো স্বরে বলে উঠেছিল, এ সব নিশ্চয় দোলা বলেছে, দোলা। বলুন সত্যি করে!
সুজিত করুণ স্বরে বলেছিল, নাম বলতে যে বারণ আছে।
শিবেন যেন ক্রুদ্ধ আক্রোশে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলেছিল, আপনি–আপনি একটা মূর্খ না শয়তান, বুঝতে পারছি না।
সুজিত তার বড় বড় চোখ দুটি মেলে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমি?
শিবেন হঠাৎ উঠে সরে গিয়েছিল। সামনে থাকলে সে হয়তো সুজিতকে মেরেই বসত। কয়েকবার পায়চারি করে আবার সামনে যখন এল তখন তার মুখ অনেকখানি শান্তভাব ধারণ করেছিল। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হেসে বলেছিল, আমি মেনে নিচ্ছি, আপনাকে দোলাই এ সব কথা বলেছে। অতএব আপনি তো সবই জানেন, তাই বলতে বাধা নেই, টাকা আমার প্রয়োজন। স্ট্যাটাস মেন্টেন করতে পারলে, এ সমাজ রক্ষিতাকেও স্ত্রীর সম্মান দিতে বাধ্য হয়, বুঝেছেন?
সুজিতের মুখখানি কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। সুনীতাকে শিবেন যে কী চোখে দেখে, এটা সে বুঝতে পেরেছিল। বলেছিল, না না, একী বলছেন আপনি। নিজের স্ত্রীর সম্পর্কে মানুষের সম্মানবোধ থাকবে না?
শিবেন হঠাৎ একটু থমকে গিয়েছিল। বিব্রতভাবে হেসে বলেছিল, সম্মানবোধ থাকবে বইকী! ওটা আমি আপনাকে একটা তুলনা দিলাম মাত্র। কিন্তু টাকা চাই, টাকা! টাকাই এ সমাজের প্রাণ। টাকাই সম্মান ভালবাসা পবিত্রতা, ওই যা সব আপনি বলছেন।
কিন্তু সুজিত আর কথা বলতে পারেনি। তার বুকের মধ্যে কী রকম করছিল। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
শিবেন হেসে বলেছিল, কী হল সুজিতবাবু?
সুজিত হাসবার চেষ্টা করে বলেছিল, এ সব আমি বুঝি না। আমার কী রকম ভয় করে।
শিবেন হা হা করে হেসেছিল।
.
আজ শিবেন তাই নিজেই বাইরের ঘরটা বিশুকে দিয়ে পরিষ্কার করাচ্ছে। দীপুকে বলে রেখেছে, ভুজঙ্গভূষণকে যেন সবসময় প্রহরায় রাখা হয়। হঠাৎ যেন বাইরের ঘরে না এসে পড়তে পারেন। যে দুজন আজ আসছেন, সেটা যে শিবেনের পরম ভাগ্য, সেটা নানাভাবে সে ব্যক্ত করেছে। কলকাতার নামকরা দুই ধনী ব্যক্তি আজ আসছেন।
ঘর সাজানো শেষ হতে না হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। বিশু বাড়ির ভিতরে চলে গেল। সুজিত তার ঘরে চলে গেল। আসলে তার যেতে ইচ্ছে করছিল সুনয়নীর ঘরে। সেখানেই তার সময়টা ভাল কাটত। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে, তাই যাবে কি না সে ভাবছিল। এমন সময়ে শিবেন এসে বলল, আপনাকে মিঃ রায়চৌধুরী দেখতে চাইছেন। জামাটা গায় দিয়ে আসুন।
জামা বলতে আপাতত শিবেনেরই একটা ধোয়া জামা পরতে হচ্ছে সুজিতকে, কারণ তার দুটো জামাই ধুতে গিয়েছে। শিবেনের এই জামাটা তার গায়ে, লম্বায় এবং প্রস্থে, উভয়েই বড়। স্বভাবতই হাস্যোদ্রেক করে। কিন্তু উপায় ছিল না।
সুজিত গিয়ে বাইরের ঘরে দাঁড়াতেই, বীরেন্দ্র ডাক দিলেন, এই যে, এদিকে এসো হে সুরজিত।
সুজিত হেসে বলল, সুরজিত নয়, সুজিত।
বীরেন্দ্র বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, দ্যাট উইল ডু, দ্যাট উইল ডু! দেখ তো, এ ভদ্রলোককে তুমি চেন কি না?
সুজিত তাকিয়ে দেখল, ট্রেনের সেই মিঃ পি. দাশ। এবং এখন জানে, উনিই প্রিয়নাথ দাশ। সে ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ, চিনি–মানে দেখেছি, সেই ট্রেনে।
প্রিয়নাথ নিজেই বলে উঠলেন, রাইট, রাইট। হি ইজ দি ম্যান, আই মিন, দ্যাট ম্যাড ম্যান।
সুজিত তাড়াতাড়ি হেসে বলল, আজ্ঞে না, ম্যাড নই, আপনাকে আমি তো সেদিনই
বীরেন্দ্র বাধা দিলেন, আচ্ছা হয়েছে হয়েছে, এখন বসে দিকিনি এখানে। কেমন লাগছে এ বাড়িতে?
সুজিত বলল, খুব ভাল।
–কিন্তু তুমি এটা কার জামা গায়ে দিয়েছ?
–শিবেনবাবুর! আমারগুলো ধুতে গেছে।
দু-একটা জামা করিয়ে নাও না, অসুবিধে তো নেই।
–হ্যাঁ, করিয়ে নেব।
বীরেন্দ্র প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ইংরেজিতে বললেন, একেবারেই বোকা নয়, কিছুটা ইন্টেলিজেন্সি আছে, কী বলেন? আমার স্ত্রীর মতে, অতি সরল ভালমানুষ। দোলাও দেখলাম খুব ইমপ্রেসড। অর্থাৎ ছেলেমানুষি আর কী। আপনি তো বলছিলেন ওকেও খুব ইমপ্রেস করেছিল।
প্রিয়নাথ বললেন, হ্যাঁ, সুনীতাকে অদ্ভুত ইমপ্রেস করেছে ছোকরা। হাওড়া স্টেশন থেকে অনবরত একই কথা বলেছে, কোথায় গেল সেই লোকটি? কোথায় গেল। প্রত্যেকটি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
বীরেন্দ্র হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, বাই দি ওয়ে, তুমি নাকি সুনীতার একটা স্কেচ করেছ? সেই ট্রেনে দেখেছিলে, তারপরে মন থেকে নাকি এঁকেছ?
শিবেন এমনিতেই অবাক হচ্ছিল। প্রিয়নাথও থ। সুজিত বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–সেটা কোথায়, আমি দেখতে চাই।
ওটা যে দীপুকে দিয়ে দিয়েছি।
বীরেন্দ্র চেঁচিয়েই বললেন, দীপু? হু ইজ হি?
শিবেন বলে উঠল, আমার ভাই। আমি ওকে এখুনি ডেকে নিয়ে আসছি।
বলেই সে বাড়ির ভিতর ছুটে গেল। প্রিয়নাথ অবাক হয়ে বললেন, মন থেকে সুনীতার স্কেচ?
বীরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, আমাকে মিসেস রায়চৌধুরী এবং দোলা, দুজনেই রিপোর্ট করলে। সে কথা তো বলতেই ভুলে গেছি আপনাকে।
প্রিয়নাথ তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালেন সুজিতের দিকে। সুজিত কিছুটা সলজ্জ বিব্রতভাবে হাসছিল। এ সময়ে দীপেনকে নিয়ে ঢুকল শিবেন। বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, ও, এই বুঝি। ওহে, সুনীতার সেই ছবিটা একবার নিয়ে এসো তো, আমরা দেখব।
দীপেন গম্ভীর মুখে বলল, ওটা সুনীতাদিকে দিয়ে দিয়েছি।
শিবেন বিস্মিত চোখে একবার সুজিত আর একবার দীপেনের দিকে তাকাতে লাগল। এ সব খবর তার কিছুই জানা ছিল না।
দীপেনের জবাব শুনে সুজিতও অবাক হল। স্কেচটা দিয়ে দেবার খবর তাকেও বলেনি দীপেন।
বীরেন্দ্র বললেন, তা হলে আর কী হবে। শিবেন বুঝি জান না ব্যাপারটা?
শিবেন বলল, না কাকাবাবু, স্কেচ-এর কথা আমি কিছুই জানি না।
সুজিত বলল, আপনাকে বলিনি বুঝি! আমার মনেই ছিল না।
বলা বাহুল্য, শিবেন তাকে বিশ্বাস করল না। সে দীপেনকে জিজ্ঞেস করল, কই, তুই তো আমাকে কিছু বলিসনি।
দীপেন এমনভাবে ঠোঁট টিপে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন সে কথাই বলবে না। তবু বলল, তোমাকে তো সুনীতাদি-ই বলবে। আমি এবার যেতে পারি?
বীরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি যাও।
দীপেন চলে গেল। বীরেন্দ্র আবার বললেন, এনি হাউ, সুরজিত সুজিত আই মিন, একটা স্কেচ এঁকেছে, এবং সেটা নাকি আশ্চর্য সুন্দর হয়েছে, সো ফার আই অ্যাম রিপোর্টেড। অসম্ভব নয়, কারণ হি ইজ এ ব্রিলিয়ান্ট আর্টিস্ট। আপনারা সবাই ওকে দিয়ে একটা করে স্কেচ করিয়ে নিতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের বক্তব্য আমরা আলোচনা করি। আরে, তুমি বসো শিবেন। সুজিতও থাকতে পারে এখানে, ওর তো এ সবে কোনও কনসার্ন নেই, আর তা ছাড়া ওর মাথায় ও সব ঢুকবে না।
সুজিত বলে উঠল, কী কথা বলুন তো?
বীরেন্দ্র বললেন, কিছু নয়, তুমি বসো।
প্রিয়নাথ হাসতে যাচ্ছিলেন। সুজিত আবার বলল, কিন্তু আমার মাথায় যদি ঢোকে?
–আঃ, বলছি চুপ করে বসে। বীরেন্দ্র ধমকে উঠলেন।
প্রিয়নাথ হেসে উঠে বললেন, রিয়ালি হি ইজ অ্যান এনজয়েবল বয়।
শিবেনও হেসে বসল। বীরেন্দ্র শুরু করলেন, দেখুন মিঃ দাশ, সুনীতাকে আপনার টাকা দেবার কথাটা প্রথমে আমার ভাল লাগেনি। পরে ভেবে দেখেছি, এটা আপনার বদান্যতা, তাতে মেয়েটার অবিশ্যি দুর্নাম বাঁচে না।
অবিশ্যি, আমি জানি না, আপনার সঙ্গে ওর সম্পর্কে লোকে যা বলে
প্রিয়নাথ বলে উঠলেন, টোটালি ফলস স্যার, সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু সেটা কোনও কথা নয়, এখন এটা আমার ডিউটি, আমি ওকে লাখ খানেক টাকা দিয়ে দেব, যাতে ও কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারে। আমি যখন ওর দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন এটা আমি করব। কারণ, আমি নিজেও যখন বিয়ে করে সেটল হতে যাচ্ছি, ওরও একটা গতি হওয়া দরকার।
বীরেন্দ্র বললেন, বেশ। আর সেটা যাতে শিবেনের সঙ্গেই হয়, এটাই আমরা চাই। আপনিও তাই চান?
চাই বইকী! একজন দায়িত্বশীল ভদ্রলোকের ছেলে ওকে বিয়ে করুক তাই তো আমি চাইব ন্যাচারালি।
এবং শিবেনও তাই, দায়িত্বশীল ভদ্রলোকের ছেলে।
বীরেন্দ্র বললেন, এখন সমস্যা হচ্ছে, সুনীতা কোনও কথাই দিচ্ছে না। হ্যাঁ-ও বলছে না, না-ও বলছে না। আর ওই দ্যাট বাগার রঞ্জন মল্লিক, ডেভিল, সেটাও তো দেখছি গোলমাল করবার তাল করছে।
প্রিয়নাথ বললেন, কিন্তু সবটা সুনীতার ওপরেই নির্ভর করছে। আর সুনীতা বলছে, আটাশে মার্চ ও যা বলবার তা বলবে। অর্থাৎ, যা হোক কথা দেবে।
শিবেন বলল, আমাকেও তাই বলেছে। কেন যে সেই দিনটাই বেছে নিল, আমি বুঝতে পারছি না।
বীরেন্দ্র বললেন, আমিও তো তাই শুনেছি। ওই দিনটা কী ব্যাপার, আপনি জানেন মিঃ দাশ?
না। আমার মনে হয়, ওটা সুনীতার একটা খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুজিত বলে উঠল, কিছু একটা হয়তো আছে।
সবাই তার দিকে এক বার ফিরে তাকাল, এবং নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিল না।
বীরেন্দ্র বললেন, যাই হোক, শিবেনের যখন আপত্তি নেই সুনীতাকে বিয়ে করতে, তখন তোক। সত্যি বলতে কী, আমি চাই, এতগুলো টাকা যেন জলে না যায়, অন্তত আমাদেরই কারুর ভোগে লাগে। মিঃ দাশের অবিশ্যি টাকার অভাব নেই, কিন্তু শিবেনের পক্ষে
এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠল। সকলেই বাইরের ঘরের দিকে ফিরে তাকালেন। শিবেন বলল, ও কেউ হবে, বাড়ির কেউ খুলে দেবে এখন।
কিন্তু আবার অনেকক্ষণ ধরে, অধের্য তীব্র সুরে কলিং বেল বেজে উঠল। শিবেন উঠতে যাচ্ছিল। সুজিত বলে উঠল, আমি যাব দেখতে?
বীরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমিই যাও, আমরা কথা বলি।
সুজিত তাড়াতাড়ি নীচে নেমে, দরজা খুলে দিল। দরজা খুলেই সে যাকে দেখল, আগে কখনও তাকে দেখেনি। ফরসা স্বাস্থ্যবান, শিবেনেরই বয়সি একজন যুবক। দামি আঁট প্যান্ট এবং বুকখোলা শার্ট তার গায়ে। জামার হাতা গুটানো, বাঁ হাতের কবজির অনেক ওপরে সোনার ব্যান্ড দিয়ে ঘড়ি বাঁধা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, ঠিক আঁচড়ানো নেই, বা আঁচড়াবার দরকারই হয় না। চোখ দুটি আয়ত, কিন্তু ঈষৎ আরক্ত, এবং দৃষ্টির মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, তীব্রতা। সুজিতের মনে হয়, আসলে ঝড়ের সংগ্রামে রত একটা বিধ্বস্তপ্রায় ঈগল। ডানায় যার অসীম শক্তি, কিন্তু জয়-পরাজয়ে যে। অনিশ্চিত। সংগ্রামে জর্জরিত একটা দুর্ভাগ্যের ছায়া, এমনকী একটা শঙ্কার চমক তার চোখে। কিন্তু মুখের ভাব এমন কঠোর যে, হঠাৎ যেন লোকটিকে বোঝা যায় না। সুজিতের মন বলে উঠল, এ রঞ্জন! আর কেউ নয়।
সুজিত জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
গম্ভীর মোটা গলায় প্রশ্ন এল, শিবেন আছে?
–আছেন। আপনি বুঝি রঞ্জনবাবু?
যুবকটির ভ্রূ ও কপাল কুঞ্চিত হল, ঠোঁট দুটি শক্ত হল। চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সুজিতকে আপাদমস্তক দেখে, গম্ভীর স্বরেই বলল, আপনাকে আমি চিনি না।
সুজিত হেসে বলল, আমার নাম সুজিতনাথ মিত্র। কয়েক দিন হল কলকাতায় এসেছি, এখন এ বাড়িতেই থাকি। আপনার কথা শুনেছি কিনা দীপুর মুখে, তাই।
–দীপু কে?
–শিবেনবাবুর ছোট ভাই।
–ও, সেই ছেলেটি।
রঞ্জন আবার সুজিতের আপাদমস্তক দেখল। সুজিত হেসে বলল, আমার সব ধুতে গেছে কিনা, তাই শিবেনবাবুর জামাই গায়ে দিয়েছি। একটু বড় হয়েছে। কিন্তু আপনাকে বোধ হয় আমি ঠিকই চিনতে পেরেছি, না?
রঞ্জন অপরিবর্তিত স্বরে ও ভঙ্গিতে বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি এখন শিবেনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
সুজিত বলল, তবে কি আমি খবর দেব শিবেনবাবুকে? ওঁর ঘরে আরও দুজন ভদ্রলোক রয়েছেন।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আপনি চেনেন তাঁদের।
–হ্যাঁ। বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী আর প্রিয়নাথ দাশ।
রঞ্জনের চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠল। সে দরজার কাছ থেকে ওপরের দিকে এক বার ফিরে তাকাল। এ সময়ে গেটের বাইরে নতুন মডেলের যে মস্ত বড় গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল, তার ভিতর থেকে একজন নেমে এল। আরও দুটি গাড়ি ছিল গেটের ভিতরেই। বীরেন্দ্রনারায়ণের ও প্রিয়নাথের নিশ্চয়ই। যে লোকটা নেমে এল, সে যেন ঈষৎ টলায়মান। চোখ দুটি লাল। রঞ্জনকে বলল, কী হল, গেলি না?
রঞ্জন কোনও জবাব দিল না। লোকটি সুজিতের দিকে তাকিয়ে, চোখ গোল করে বলল, এই শেমিজ-পরা ব্যাটাছেলেটি আবার কে বাবা?
সুজিত হেসে বলল, আমার কথা বলছেন? আমার নাম সুজিত।
–অ? সুজিতকুমারী-টুমারী নয়তো আবার? যা দিনকাল পড়েছে, শালা কখন যে কাকে কী অবস্থায় দেখব!
লোকটির কথা ঈষৎ জড়ানো। ডাকল, এই রঞ্জন।
রঞ্জন হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তীব্র গলায় বলল, গাড়িতে গিয়ে বোস।
-অ! আচ্ছা, দরকার হলে ডাকিস কিন্তু।
একটু টলতে টলতেই ফিরে যেতে গিয়ে, আবার দাঁড়াল। বলল, আমাকে আবার বাড়ির জন্যে বাজার করতে হবে মাইরি। তিন দিন তো বাড়ি ঢুকিনি, বউটা–
রঞ্জন ধমকে উঠল, গাড়িতে গিয়ে বসতে বলছি না।
লোকটা যেন ভয় পেয়ে, তাড়াতাড়ি গেটের বাইরে গাড়িতে উঠে বসল। লোকটার অবস্থা খুব করুণ মনে হল সুজিতের। কিন্তু ভাবটা পুরোপুরি যেন ডাকাতের মতো। রঞ্জন কোনও কথা না বলে, হঠাৎ সিঁড়িতে পা দিল। সুজিতও তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল। বলল, আমি কি কোনও খবর দেব?
রঞ্জন বলল, না, আমি নিজেই যাব। আপনি বাধা দেবেন?
সুজিত হেসে বলল, আমি কাউকে বাধা-টাধা দিতে পারি না। আপনার ইচ্ছে হলে যান, বললে, আমিও খবর দিতে পারি। তবে আমার মনে হয়, আপনি যে জন্যে এসেছেন, ওঁরা সে সব কথাই আলোচনা করছেন।
রঞ্জন সিঁড়ির মাঝপথে থমকে দাঁড়াল। বলল, আমি কী জন্যে এসেছি?
সুজিত বলল, সুনীতার ব্যাপার তো? মানে, আপনিও তো সুনীতাকে বিয়ে করতে চান, তাই না?
রঞ্জনের প্রস্তর কঠিন মুখে এবার বিস্ময়ের ঢেউ খেলে গেল। বলল, সে কথাও জানা আছে নাকি?
সুজিত বলল, হ্যাঁ, কিছু কিছু শুনেছি, মানে ওই দীপুর মুখেই।
রঞ্জন যেন বিস্মিত ও আত্মগত ভাবে উচ্চারণ করল, ও। ওই ছেলেটিকে সুনীতা যে কেন এত ভালবাসে! আচ্ছা ওই দীপু কি আপনাকে বলেছে, সুনীতা কাকে বিয়ে করতে চায়?
সুজিত দেখল, রঞ্জনের মুখটা সহসা রুদ্ধশ্বাস আরক্ত ও গভীর সংশয়ে থমথম করছে। সুজিত বলল, না তো। সে কথা দীপু কিছু জানে না।
রঞ্জন যেন ঝিমিয়ে পড়ল। সুজিত প্রশ্ন করল, আপনি বুঝি সুনীতাকে খুব ভালবাসেন?
রঞ্জন চমকে উঠল। প্রায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ভালবাসা! ভালবাসা! আমি জানি না, জানি না।
সুজিত বলল, জানেন না!
রঞ্জনের মুখটা সহসা স্ফীত এবং আরও রক্তাভ হয়ে উঠল। বলল, না, জানি না। শুধু জানি, ওকে আমার চাই, ওকে না পেলে আমার চলবে না। বলেই এক হাত দিয়ে সহসা সে সুজিতকে সরিয়ে দিয়ে, দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতেই জিজ্ঞেস করল, কোন ঘরে আছে শিবেন? শিবেনের দেখা চাই আমি।
সুজিত নিজেও উঠতে উঠতে বলল, সামনের ঘরেই আছে। দাঁড়ান, আমি খুলে দিই।
রঞ্জন তার জন্যে অপেক্ষা করল না। হ্যাঁন্ডেল ধরে, একটানে দরজাটা খুলে ফেলল। ঘরের সবাই তার দিকে তাকিয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন সত্যিই প্রত্যক্ষ করছেন তাঁরা, এমন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেন সবাই। কেউ উঠতে পারলেন না, কথাও বলতে পারছেন না। রঞ্জনের পেছনে তখন সুজিতও এসে দাঁড়িয়েছে। রঞ্জনের চোখ চকিতে এক বার সবাইকে দেখে, শিবেনের প্রতি নিবিষ্ট হল। তার মোটা গম্ভীর গলা থেকে একটা ভয়ংকর ধার যেন কেটে বসল, আসতে পারি?
সহসা কেউ কোনও জবাব দিতে পারল না। তিনটি মানুষকেই প্রায় মৃত মনে হল। যদিও ইতিমধ্যেই সকলের মুখের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বীরেন্দ্র রীতিমতো ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত, কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রিয়নাথ অনেকটা ভীত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শিবেন অবাক এবং একটা অসহায় ক্রোধের ছায়া পড়েছে তার মুখে।
রঞ্জন অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করল না। সে আস্তে আস্তে গিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। দুই হাত তার কোমরে। দুই চোখ তার শিবেনের প্রতি। কয়েক মুহূর্ত একভাবে থেকে, অনড় চোয়ালে রঞ্জন উচ্চারণ করল, শিবেন, সুনীতাকে আমি বিয়ে করতে চাই। এ বিষয়ে আমি কোনও বাধা সহ্য করব না।
কিন্তু কেউ কোনও কথা বলল না। শিবেন এক বার বীরেন্দ্র ও প্রিয়নাথের দিকে তাকাল। তাঁরাও শিবেনের দিকে তাকালেন। এবং আবার সকলেই রঞ্জনের দিকে তাকালেন। রঞ্জন তিন জনের দিকেই তাকিয়ে, পিছন ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সুজিতের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। সুজিত তখন ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল।
হঠাৎ শিবেন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিন্তু রঞ্জন, তোমার জানা উচিত, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।
রঞ্জন ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বলল, সেটা আমার অজানা ছিল না। বন্ধুর বাড়িতে আসা অন্যায় নয় নিশ্চয়ই?
শিবেন ফুঁসে উঠল, কে তোমার বন্ধু? আমি? আমি ঘৃণা বোধ করি তোমার বন্ধুত্বে। যে এভাবে এসে বাড়িতে ঢুকে কথা বলে যায়, তাকে আমার পরিচিত বলতেও লজ্জা হয়।
রঞ্জন বলল, তা ঠিক। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। চললাম।
সে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই প্রিয়নাথ বলে উঠল, কিন্তু অরূপ দত্ত বা কুবের সিংহকে আপনি কী বলবেন? তারাও সুনীতার পাণিপ্রার্থী।
রঞ্জন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, তাদের আমি চিনি, তারা সুনীতাকে বিয়ে করবার পাত্র নয়, কারণ তারা সতীত্বে বিশ্বাস করে, বড়লোক বলে মেয়েমানুষ নিয়ে বাজি খেলে। তাদের কী বলতে হবে আমি জানি।
রঞ্জন আবার ফিরে প্রায় দরজার কাছে চলে গেল। বীরেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ বলে উঠলেন, কিন্তু রঞ্জন, আই মিন, তোমার বাবা হারু মল্লিক এক সময়ে আমার বন্ধু ছিলেন, সেই জন্যেই নাম ধরে ডাকছি। তুমি আমার কথার একটা জবাব দিয়ে যাবে?
রঞ্জন ফিরল। বলল, বলুন?
–তোমাকে কি সুনীতা কোনও কথা দিয়েছে?
না।
–তবে তুমি এদের শাসিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? সুনীতার নিজের যা ইচ্ছে, সে তাই করবে, তার ওপরে কারুর হাত নেই।
রঞ্জন সহসা কোনও জবাব দিতে পারল না কথার। সে থমকে গেল। বীরেন্দ্র শিবেন আর প্রিয়নাথের দিকে তাকালেন, যেন একটা খ্যাপা হাতিকে বশ করবার গর্ব তাঁর চোখে। রঞ্জনের মুখে কোনও কথা নেই।
প্রিয়নাথ হঠাৎ হেসে উঠলেন। বললেন, সবথেকে সহজ কথা।
রঞ্জন তখনও কোনও জবাব দিতে পারল না। কিন্তু তার সমস্ত মুখ আরক্ত কঠিন হয়ে উঠল। শিবেনও হেসে উঠল, এবং বীরেন্দ্রও নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন। সুজিতের হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হতে লাগল। তার মনে হল যেন একটা হিংস্র বাঘকে খাঁচায় আটকে দেওয়া হয়েছে। এ কথা ঠিক, রঞ্জনকে তার ক্ষুধার্ত বাঘের মতোই হিংস্র মনে হচ্ছে। কিন্তু বাকি লোকগুলিকেও তার নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে।
রঞ্জন হঠাৎ দরজার ওধারে থেকে সকলের দিকে ফিরে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণধার গম্ভীর গলায় সে বলল, সুনীতার ইচ্ছেকে যাতে ঘোরানো যায়, আমি সে-রকম ব্যবস্থাই করব।
বলে সে পিছন ফিরে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ইতিমধ্যে ভুজঙ্গভূষণ কখন বেরিয়ে এসেছিলেন, সুজিত তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু উনি বাইরের ঘরের দিকেই আসতে চাইছিলেন। কোনওরকমে বুঝিয়ে সুজিত ওঁকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে পিছন ফিরতেই দেখল, রঞ্জন সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সুজিত এগিয়ে এসে বলল, চললেন? চলুন, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। নীচের দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল রঞ্জন। সুজিতকে বলল, আপনাকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনার কথার জবাব আমার দিতে ইচ্ছে করছে, সময় আছে হাতে? আসবেন আমার সঙ্গে?
–কোথায়?
–এই গাড়িতেই, কিংবা কাছেই কোনও হোটেল-রেস্তোরাঁয়?
সুজিত হেসে বলল, কিন্তু আমি যে কলকাতার রাস্তাঘাট চিনি না, ফিরে আসব কেমন করে? রঞ্জন বলল, আমিই পৌঁছে দিয়ে যাব।
সুজিত বলল, আপনার সঙ্গে আমার খুব মিশতে ইচ্ছে করছে। আপনি খুব রাগি অবিশ্যি, কিন্তু গুণ্ডা বলে তো একদম মনে হচ্ছে না আমার?
মনে হচ্ছে না? রঞ্জন হো হো করে হেসে উঠল। বলল, কিন্তু আমাকে তো সবাই গুণ্ডাই বলে শুনেছি, ঠিকই শুনেছেন আপনি। তা হলে আসবেন না?
–হ্যাঁ আসব, আপনাকে আমার বেশ ভাল লাগছে।
বটে! রঞ্জনের আবার হাসি পেল। খানিকটা আপন মনেই বলল, মজার লোক দেখছি! তা হলে আসুন।
গাড়ির ভিতর থেকে সেই লোকটি মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল, এই মরেছে, এ মালকে আবার টানাটানি করছিস কেন রঞ্জন?
রঞ্জন সে কথার কোনও জবাব দিল না। সুজিত একবার ওপরের দিকে তাকাল। বলল, ওদের জানিয়ে আসতে গেলে আমাকে বোধ হয় আর আসতে দেবে না। চলুন, চলে যাই।
দরজাটা টেনে দিয়ে, রঞ্জনের পিছনে পিছনে গিয়ে গাড়িতে উঠল সে। রঞ্জন নিজেই ড্রাইভ করতে বসল এবং এমনভাবে গাড়ি ব্যাক করল, বাঁকিয়ে গলি থেকে বের করে নিয়ে গেল গাড়ি। সুজিত দুবার সিটের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। রঞ্জনের সঙ্গীটি বলে উঠল, কী মশাই, মাল খেয়েছেন নাকি?
সুজিত অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, মানে মদ?
লোকটি চোখ ঢুলু ঢুলু করে বলল, জানেন তো দাদা ষোলো আনাই দেখছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, মদ।
সুজিত হেসে বলল, মানে মদকে যে মাল বলে, সেটা নতুন শিখেছি কিনা।
রঞ্জন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, নতুন?
সুজিত বলল, হ্যাঁ, এই কয়েক দিন আগে। শিবেনবাবুর বাবা তো মদ খান, ওখানেই জানলাম। তবে আমি মদ খাই না।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, কলকাতায় আসার আগে কোথায় ছিলেন?
–গুড়িয়াঁটাঁড়।
রঞ্জনের সঙ্গীটি হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে বলে উঠল, মরেছে! আমার তো মুখেই ফুটবে না।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, সেখানে কী করতেন?
সুজিত জানাল তার অপরিণত মস্তিষ্ক ও চিকিৎসার কথা। যথাপূর্বং আরোগ্যের কথা বলতে ভুলল না। রঞ্জন ও তার সঙ্গী অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। এই সময়ে গাড়ি নিউমার্কেটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। লোকটি চিৎকার করে বলল, রঞ্জন, মাইরি গাড়িটা দাঁড় করা, কয়েকটা টাকা দে, একটু বাজার করে নিয়ে আসি, নইলে বাড়ি ঢুকতে পাব না।
কিন্তু গাড়ি যথাপূর্বং এগিয়ে গেল। রঞ্জন বলল, হবে এখন।
লোকটি করুণ মুখে পিছন ফিরে তাকিয়ে রইল। গাড়ি একটা জায়গায় দাঁড়াল। সুজিতকে নিয়ে রঞ্জন একটা হাল-ফ্যাশনের রেস্তোরাঁয় ঢুকল। টেবিলের সামনে বসে বলল, চা না কফি?
চা।
তিন জনের মতো চায়ের অর্ডার হল। তারপর দুজনেই মুখোমুখি বসল। সুজিত দেখল, রঞ্জন তার দিকে তাকিয়ে নেই, অন্যদিকে স্থির অপলক শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। সুজিত বলল, আমি আসতে চেয়ে আপনাকে অসুবিধেয় ফেলিনি তো?
রঞ্জন চমকে উঠল, বলল, উম! না, তা নয়, আসলে ভেবে দেখলাম, আপনাকে আমার নতুন করে কিছুই বলার নেই। আপনাকে ডেকে নিয়ে এসেছি, তার কারণ আপনাকে হঠাৎ কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগল, একটু ভাল লাগল।…আর সুনীতাকে আমি ভালবাসি কি না জিজ্ঞেস করছিলেন, তার জবাব আমি সত্যি কিছু জানি না। আমি খারাপ এ কথা সবাই জানে, মেয়েদের সঙ্গে নষ্টামো করে বেড়ালে আমাদের বাড়ির লোকেরা কেউ কিছু মনে করে না, কিন্তু যেই বিয়ের কথা শোনে, তখনই ভয় পায়, খেপে যায়। আর আমি সুনীতাকে বিয়ে করতে চাই, এ কথা শোনার পর থেকেই আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, হয়তো আর বাঁচবেনই না। আর যে দিন থেকে সুনীতা আমার মাথায় ঢুকেছে, সে দিন থেকে নষ্টামো করার দিকেও মনোযোগ দিতে পারছি না। এতে আমার বন্ধুরাও অবাক হয়েছে! একেই ভালবাসা বলে কি না আমি জানি না। মোট কথা, এখন আমি আমার সবকিছুই বাজি ধরে বসে আছি।
সুজিত অবাক হয়ে বলল, বাজি?
–হ্যাঁ, বাজি। সুনীতা এখন
কথা শেষ হল না, বেয়ারা চা নিয়ে এল। এই সময়ে রঞ্জনের সঙ্গীটিও গাড়ি বন্ধ করে, চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে এসে কাছে বসল। এবং চা তৈরি করতে আরম্ভ করল। সুজিত আর রঞ্জন, দুজনের দিকেই তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঠোঁট দুটি কুঁচকে, কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। আবার চা তৈরি করতে করতে গুন গুন করে গান গেয়ে উঠল, আগে জানতেম যদি, প্রেমের এতই জ্বালা গো, কেন প্রাণ সঁপিলাম তারে।
সুজিত তার দিকে তাকাল। লোকটি বলল, আমার নাম কালাচাঁদ। মশায়ের নামটা কিন্তু আমার জানা হয়নি এখনও।
সুজিত বলল, আমাকে বলছেন? তখন বললাম যে সুজিতনাথ মিত্র।
বলেছিলেন, নাথ মিত্রটা বলেননি। অলরাইট স্যার, এই নিন চা।
বলে সে সুজিতকে চা দিয়ে পরে রঞ্জনকে দিল। রঞ্জন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, সুজিতবাবু, আপনি কি শুধু সকলের মুখে এ সব শুনছেন বলেই জানতে চাইলেন?
সুজিত বলল, না না, আমি যে সুনীতাকে চিনি।
–চেনেন?
কালাচাঁদ বলে উঠল, ও বাবা, এ যে বন থেকে বেরুলো টিয়ে, লাল
–চুপ! রঞ্জন ধমক দিল।
সুজিত বলল, হ্যাঁ, কয়েক দিন আগে সুনীতা যখন প্রিয়নাথ দাশের সঙ্গে ট্রেনে আসছিলেন, তখন আমিও সেই কামরাতেই ছিলাম।
রঞ্জন তার দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, আপনি–আপনি সেই লোক?
–কোন লোক?
রঞ্জন বলল, কোন লোক, তা ঠিক জানি না। তবে এখন মনে হচ্ছে আপনিই সেই লোক, যাকে ট্রেনে দেখে সুনীতার মনে হয়েছিল, জীবনে সেই প্রথম সে সৎ সুন্দর আর সত্যিকারের একজন মানুষ দেখেছিল। যে তাকে ঠিক বুঝতে পেরেছিল, চিনতে পেরেছিল। যাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, এমনি একটি মানুষকে সে সারা জীবন ধরে খুঁজছে।
সুজিতের মনে হল, রঞ্জনের কথা শুনে তার বুকের ভিতরটা কাঁপছে, থরথর করছে। সে হেসে উঠতে চাইল, কিন্তু তার ঠোঁট দুটিও যেন কেঁপে গেল। সহসা সেই দুঃখী দুর্ভাগা মেয়েটির মুখ তার মনে পড়ে গেল, তার ব্যাকুল চোখের দৃষ্টি সে দেখতে পেল, ডাক শুনতে পেল, শুনুন, শুনুন।
রঞ্জন তখনও বলে চলেছিল, তা হলে আপনাকেই সে ট্রেন থেকে নেমে চারদিকে আঁতিপাতি করে খুঁজেছিল। আপনি! আপনিই সেই লোক, যে মানসিক হাসপাতাল থেকে ফিরছিল, যাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, সংসারের সহজ আর সরলতম মানুষ।
সুজিত বলল, কবে বলেছে সে আপনাকে এ সব কথা?
–এর মধ্যেই কবে যেন একদিন আমাকে বলছিল। আমাকে ধিক্কার দিতে গিয়ে, আমাকে অপমান করতে গিয়ে। কিন্তু কিন্তু
রঞ্জনের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সুজিতের দিকে। প্রায় ফিসফিস শব্দে বলল, আপনার মধ্যে সে এ সব দেখেছে!
রঞ্জন যেন চোখ ফেরাতে পারল না সুজিতের ওপর থেকে। সেই কুটি-তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে সুজিতের মনটা যেন সহসা একটা শীতল সর্প-দেহের স্পর্শে, ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল। তার শিরদাঁড়ায় একটা কাঁপন অনুভূত হল। সেই ছেলেবেলায়, বর্ধমানের গ্রামে, সে যখন ভয়ার্ত পশুর মতো জীবনযাপন করত, তখন তার এ রকম মনে হত প্রায়ই। বহু দিন বাদে, তার সেই অনুভূতি যেন জেগে উঠতে চাইছে। এই অনুভূতি যত বেড়ে ওঠে, ততই তার মস্তিষ্কটা দুর্বোধ চিন্তায় ও বাষ্পে ভরে ওঠে, যখন সে আর কিছুই মনে রাখতে পারে না। বিস্মৃতির অতলে ডুবে যেতে থাকে। যে ব্যাধি তার জীবনটাকে প্রায় শেষ করে এনেছে।
পরমুহূর্তেই সুজিত সোজা হয়ে বসল। রঞ্জনের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে হেসে বলল, আমারই অবাক লাগছে আপনার কথা শুনে। অবিশ্যি এ কথা আমাকে প্রিয়নাথ দাশও বলেছিলেন।
রঞ্জন তখনও যেন পরম বিস্ময়ে সুজিতকেই দেখছিল। জিজ্ঞেস করল, কী বলছিল?
–প্রায় এরকম কথাই, সুনীতা বোধ হয় ওঁকেও বলেছে। কিন্তু রঞ্জনবাবু, তাতে কি আপনি দুঃখিত হচ্ছেন?
দুঃখিত? কী জানি, বুঝতে পারছি না, আপনাকেই শুধু দেখছি।
সুজিত হাসল। কালাচাঁদ এতক্ষণে বলে উঠল, সুনীতার বাপু মাথায় তা হলে গোলমালই আছে। একে দেখে যদি এরকম মনে হয়, তা হলে কালাচাঁদই বা কী দোষ করেছে? একটা রাস্তার পাগলও
চকিতে রঞ্জনের বাঁ হাতটা উঠল এবং প্রায় ছুরিকাঘাতের মতো কালাচাঁদের গালে সজোরে আঘাত করল। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, অনেকক্ষণ চুপ করতে বলেছি।
কালাচাঁদ গালে হাত দিল, এবং ঠোঁটের কষ ফেটে চুঁইয়ে আসা রক্ত হাতের চেটোয় মুছে নিয়ে বলল, বলেছিলি, না? আমার মাইরি মনে থাকে না। তা বলে এরকম মারবি? তুই বড্ড রাগি রঞ্জন।
কথাগুলি প্রায় স্বাভাবিক ভাবেই বলল কালাচাঁদ, কিন্তু তার চোখ দুটি ছলছলিয়ে উঠল। তার মুখটি দেখে, সুজিতের বুকটা চকিতে ব্যথায় ও যন্ত্রণায় টনটনিয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি কালাচাঁদের পিঠে একটি হাত রেখে ডেকে উঠল, রঞ্জন!
রঞ্জন তখন মাথা নিচু করে ছিল। কালাচাঁদ সহসা তার পিঠের ওপর রাখা সুজিতের হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ক্রুদ্ধ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে, একটু নড়েচড়ে বসল। সুজিত বিব্রত বিস্ময়ে হাত দুটি তার। নিজের কোলের ওপর ন্যস্ত করল।
রঞ্জন উঠে দাঁড়াল, গলা তুলে ডাকল, বেয়ারা!
বেয়ারা ছুটে এল। রঞ্জন টাকা দিল। বেয়ারা বিল নিয়ে আসারও সময় পেল না। রঞ্জন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল। কালাচাঁদও ছুটে চলে গেল। সুজিত যেন কিছুই স্থির করতে পারল না, সে কী করবে। কিন্তু দরজা আবার খুলে গেল, রঞ্জন মুখ বাড়িয়ে তাকে ডাকল, কই আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
সুজিত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। রঞ্জনের দৃষ্টি বাইরে স্থিরনিবদ্ধ। কালাচাঁদের ঠোঁটের কোণে রক্তের ভেজা দাগটা শুকিয়ে উঠছিল। সে আর একবার বলল, বাজারটা পেরিয়ে গেল মাইরি।
শিবেনদের গেটের সামনে গাড়িটা শব্দ করে থমকে দাঁড়াল। যেন একটা অতিকায় জানোয়ার আহত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রঞ্জন ফিরে তাকাল সুজিতের দিকে। হাত বাড়িয়ে সুজিতের একটি হাত ধরে বলল, আমাকে মাপ করে দিয়ে সুজিত।
সুজিত রঞ্জনের হাতটি ধরে, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল। এবং হঠাৎ হেসে বলল, রঞ্জন, মানুষ শুধু ভালবাসতেই পারে, তার প্রত্যক্ষ ফলের কথা কেউ কি জানে?…সে কথা যাক, আজ তোমাকে আমি ভালবেসেছি। তারা দুজনেই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। সুজিত এক বার রঞ্জনের হাতে একটু চাপ দিল। তারপর নেমে গেল। বাইরের থেকে বলল, চলি কালাচাঁদবাবু।
কালাচাঁদ কঠিন মুখে একবার তাকাল, এবং সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু হাসল, চোখ টিপল একটা, হাত তুলে নিঃশব্দে বিদায় জানাল। গাড়িটা বেরিয়ে গেল। সুজিত গেটের ভিতর ঢুকে দেখল, তখনও বীরেন্দ্রনারায়ণ ও প্রিয়নাথের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এঁরা এখনও রয়েছেন ভেবে সে অবাক হল। এগিয়ে গিয়ে কলিং বেলের বোতাম টিপল সে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে গেল। স্বয়ং শিবেন এসেছে দরজা খুলতে। দরজা খুলেই সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছলেন আপনি?
সুজিত বলল, রঞ্জনের সঙ্গে।
রঞ্জনের সঙ্গে কোথায়?
–একটা রেস্তোরাঁয়?
এই সময়ে ওপর থেকে ডাক ভেসে এল, ওকে ওপরে নিয়ে এসো শিবেন, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।
সুজিত একটু অবাক হলেও, সে ওপরে উঠল। শিবেন দরজা বন্ধ করে তার পিছনে পিছনে এল। ওপরের বারান্দাতেই বীরেন্দ্র ও প্রিয়নাথ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুজিতকে দেখেই বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, এই যে তুমি এসেছ, এসো এসো, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি আমরা।
সবাই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, শিবেন বলল, সুজিতবাবু রঞ্জনের সঙ্গে নাকি একটা রেস্তোরাঁয় গেছলেন।
বীরেন্দ্র সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, রেস্তোরাঁয় না বার-এ। মদ খেতে নিয়ে গেছল?
সুজিত তাড়াতাড়ি বলল, আজ্ঞে না, চা খেতে।
–কেন কেন, সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি, তোমাকেই হঠাৎ নিয়ে গেল কেন?
বীরেন্দ্রর পরেই প্রিয়নাথ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে কি ওর আগে আলাপ ছিল?
সুজিত বলল, না, আজই ওকে প্রথম দেখলাম। আজই আলাপ হল।
বীরেন্দ্র বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। তুমি জান, ও সাংঘাতিক গুণ্ডা?
–শুনেছি।
–তবু গেলে? তোমার সাহস হল?
–আমি ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও তার জবাব দেবে বলে আমাকে নিয়ে গেছল।
কী কথা?
–ও সুনীতাকে ভালবাসে কি না।
তিন জনেই অবাক হয়ে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল, এবং তিন জনেই তাকে ঘিরে ধরল। সবাই প্রায় একসঙ্গেই জিজ্ঞেস করলে, কী বললে সে?
সুজিত বলল, রঞ্জন বললে, সে জানে না, সে সুনীতাকে ভালবাসে কি না।
তিন জনেই আবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন, এবং সহসা সবাই হাসতে আরম্ভ করলেন। বীরেন্দ্র বললেন, তুমি জিজ্ঞেস করলে, আর সে এই জবাব দিল?
আর একবার হাসি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। সুজিত বলল, হ্যাঁ। আর বললে, যে ভাবেই হোক, আমি সুনীতাকে পেতে চাই, মানে বিয়ে করতে চাই, আমি আমার জীবনের সবকিছুই বাজি ধরে বসে আছি।
বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, তার মানে কী?
সুজিত বলল, তার মানে বোধ হয় এই যে ও যে সুনীতাকে বিয়ে করতে চাইছে, এ খবরে ওর বাবা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, হয়তো মারাই যাবেন। বাবা মারা যাক কিংবা ওকে জীবনে সবকিছুই ছেড়ে দিতে হোক, ও সুনীতাকে বিয়ে করবেই।
শিবেন সন্দিগ্ধ স্বরে বলে উঠল, এ সব কথা সে বলেছে?
সুজিত বলল, সত্যি। মিথ্যে কথা বললে আমার অসুখ করে।
সুজিতের কথায় সবাই তার মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপরে বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, একটা মাতাল বদমায়েশ, তার কথা নিয়ে এত চিন্তা করবার কিছু নেই। আটাশে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করবার নেই। এবার যাওয়া যাক। হ্যাঁ, যাবার আগে ওহে সুর–আঃ সুজিত, তোমাকে কিনু আর দোলা দু জনেই যেতে বলেছে, বুঝলে? আর হ্যাঁ, আর একটা কথা, ও হ্যাঁ, দোলা বলেছে, তোমাকে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে। আর…আর শিবেন, তুমি আমার সঙ্গে চলো, অন্তত ঘণ্টাখানেক একটু অফিসিয়াল কাজ আছে।
শিবেন বলল, চলুন।
এই সময়েই ভুজঙ্গভূষণ দরজায় এসে বললেন, কী, সব চলে যাচ্ছেন নাকি? গরিবের বাড়িতে একটু চা পান-টান হলে হত না।
তাঁর পিছনে পিছনে বিশু ছুটে এসেছে। শিবেনের চোখে ক্রোধ ফুটে উঠল। বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, আসুন আসুন মিঃ রায়। কেমন আছেন?
শিবেন তাড়াতাড়ি ওর বাবার দিকে এগিয়ে গেল। ভুজঙ্গ এগিয়ে এসে বললেন, বসুন বসুন, এর মধ্যেই কোথায় যাচ্ছেন? তা, মিঃ দাশের সেই সুনীতার কী গতি করলেন আপনারা? শেষপর্যন্ত ওকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে, কী ব্যবস্থা
শিবেন তীব্রস্বরে ডেকে উঠল, বাবা!
বীরেন্দ্র বললেন, বোধ হয় সে আপনারই পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে।
ভুজঙ্গ বললেন, বিলক্ষণ বিলক্ষণ। ও তো আপনাদেরই খায়-পরে। একবার ডিভাগড়ের রাজপরিবারে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেই কাহিনীটা তা হলে আপনাদের বলতে হল। আমি আবার সেই রাজার বিশেষ বন্ধু ছিলাম কিনা। রানির সঙ্গেও আমার….
শিবেন এসে বাবার হাত ধরল। বলল, চলুন, এখন ভেতরে চলুন, এঁদের আর দাঁড়াবার সময় নেই। চলুন, চলুন।
সে প্রায় জোর করেই ভুজঙ্গকে টেনে নিয়ে চলল। ভুজঙ্গ চলতে চলতেই বললেন, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ইউ জেন্টলমেন, মাই সন ডাজ নট লাইক দ্যাট আই টক উইথ ইউ। গুডবাই!
একটু পরেই শিবেন ফিরে এল। তার মুখে রাগ ও বিরক্তি গোপন নেই। তারপর সকলেই বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে প্রিয়নাথ সুজিতের পিঠ চাপড়ে বিদায় নিলেন।
.সুজিত একলা ঘরে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখনও রঞ্জনের কথাগুলিই তার মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। এক সময়ে তার খেয়াল হল, সকাল থেকে এক বারও সুনয়নীকে দেখা হয়নি। সে বাড়ির ভিতরে গেল, আস্তে আস্তে সুনয়নীর ঘরের দরজায় গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, ভুজঙ্গভূষণ সুনয়নীর দুটি অসাড় হাত নিজের বুকের উপর তুলে নিয়ে, সুনয়নীর মুখের সামনে ঝুঁকে আছেন। বলছেন,নয়ন, আমার গল্পগুলো তা হলে তুমিই শুনো, কেমন? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস কর, অ্যাঁ? চিরকালই করে এসেছ। ওরা বড় সত্যি-মিথ্যের যাচাই করে, কিন্তু আমরা তা করব না। আমরা ইচ্ছে করলে কোনও সময় রাজা-রানি হব, কোনও সময় খুঁটেকুড়ানির মেয়ে-জামাই হব, কী বলো?…বাঃ, লক্ষ্মী সোনা আমার!…ওকী ওকী, আবার রাগ কেন নয়ন? মদ খেতে যাব না? আচ্ছা যাব না। ঘরে নিয়ে এসে তোমার সামনে বসে খাব, কেমন? লক্ষ্মী-লক্ষী আমার! আবার চোখে জল কেন? আঃ, ছি নয়ন, অমন করে কাঁদিস না, দেখিস একদিন সব দুর্ভাগ্য কেটে যাবে।
সুজিত চুম্বনের শব্দ পেল। দরজার পাশ থেকে সে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে সরে এল। মুখে তার হাসি, কিন্তু চোখ দুটি কখন ভিজে উঠেছে, টের পায়নি। সে শুধু উচ্চারণ করল, ভালবাসা, ভালবাসা।…
সুজিত আবার বাইরের ঘরে এল, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে বারান্দা দিয়ে ঘুরে নিজের ঘরে গিয়ে, বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।
একটু বোধ হয় তন্দ্রা মতোই এসে পড়েছিল। কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দ সে পেয়েছিল। মনে মনে ভেবেছে, এর মধ্যেই আবার শিবেন বোধ হয় ফিরে এল। কিন্তু সে মুখ তোলেনি, চোখ খোলেনি, একভাবেই পড়েছিল। একটু পরেই তার ঘরের দরজার সামনে পায়ের শব্দ পেয়ে, মুখ ফিরিয়ে তাকাল, এবং তাকিয়েই তার হৃদস্পন্দন যেন সহসা স্তব্ধ হয়ে গেল। শরীর নিশ্চল মৃতবৎ মনে হল। প্রথমে মনে হল, সে স্বপ্ন দেখছে, এখনও সে নিদ্রিত। নইলে, তার সামনেই সুনীতাকে সে দেখছে কেমন করে? সুনীতার চোখের সঙ্গে তার চোখের দৃষ্টি এমন স্থির অপলক ভাবে মিলছে কেমন করে? দরজার সামনে যেন এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নেরই দ্যুতি, যৌবনের এক দুঃসহ বিজলি ঝলক স্থির নিশ্চল। রক্তাম্বরী, বিম্বেষ্ঠা, বক্ষে ও সর্বাঙ্গে নিটুট স্বাস্থ্য এক নিপুণ শিল্প হয়ে উঠেছে। যে শিল্পের মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য, বক্ষের জীবনকলি দিয়ে বিশ্বসংসারকে বিদ্ধ যাতনায় চকিত করছে। কিন্তু চোখ, সেই চোখ, যার মধ্যে অসহায় বিভ্রান্তি মাথা কুটছে।
সুজিত আস্তে আস্তে উঠে বসল। বসতেই, বারান্দার জানালা দিয়ে তার লক্ষ পড়ল, দীপু দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার সে সুনীতার দিকে ফিরে তাকাল। এবার চোখে পড়ল সুনীতার হাতে সুনীতারই মুখের সেই স্কেচ। সুনীতাও এক বার স্কেচটা দেখল, আবার চোখ তুলে তাকাল এবং সহসা তার দুই চোখ ঈষৎ ছোট হয়ে এল, নাসারন্ধ্র কিঞ্চিৎ স্ফীত হল, এবং একটি বিচিত্র আলো যেন বিচ্ছুরিত হল চোখ থেকে। সুজিত উঠে দাঁড়াল। সুনীতা ঘরের মধ্যে দু পা এগিয়ে এল। বলল, চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?
সুজিত প্রায় অস্ফুটে উচ্চারণ করল, সুনীতা!
সুনীতা ঈষৎ ঘাড় বাঁকাল। বলল, মনে আছে দেখছি।
সুজিত সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ভুলে যাব মনে করেছিলেন?
সুনীতা বলল, অসম্ভব কী! আমিই বরং আপনাকে একেবারে ভুলতে পারছিলাম না। আমি তারই জবাব নিতে এসেছি আজ।
সুজিত বলল, কীসের জবাব?
–সে দিন যা বলেছিলেন, যে কথা আমাকে আর কেউ কখনও বলেনি।
সুজিত যেন হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেল। বলল, বসুন আপনি। মানে… কোথায় যে বসতে দিই, এ ঘরে আবার চেয়ার-টেয়ার সে রকম কিছু
সুনীতা খাটের ওপর বসে পড়ল। বলল, দেখলেন, কোথায় বসা যায়।
সুজিত হাসল। বলল, ওতে বসতে আপনার অসুবিধে হবে না?
সুনীতা খাটের ধারে রেলিং-এ হেলান দিয়ে ভাল করে বসে বলল, তবে সুবিধে করেই বসলাম। বলে হেসে উঠল। আবার বলল, কিন্তু অমন করে অত কী দেখছেন বলুন তো?
সুজিত বলল, দেখছি, মনে হচ্ছে, যেন আপনাকে অনেক দিন থেকে চিনি।
সুনীতা কয়েক মুহূর্ত সুজিতের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। চোখের পাতা নামাল, বলল, সত্যি?
সুজিত বলল, সত্যি। কিন্তু আপনি যেন তাতে কিছু মনে করবেন না। আমার এরকম হঠাৎ হঠাৎ এক-এক জনকে দেখলে মনে হয়।
সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কেন মনে হয়?
–আমি তা বুঝতে পারি না।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা। এবং সহসা যেন কেউ-ই কারুর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। সুনীতা সহসা যেন একটু আরক্ত হল। ওর চোখের পাতা নত হল। বলল, আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছিলাম সেদিন।
–শুনেছি।
সুনীতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কার কাছে?
–প্রিয়নাথ দাশ আর
প্রিয়নাথ দাশ? ও আজ সকালে যখন এসেছিল?
–হ্যাঁ। কার কাছে শুনলেন?
–কেন, দীপুর মুখে। দীপু যে আজ সকালেই আমার কাছে ছুটে গেল এই পোর্ট্রেট নিয়ে।
সুনীতা হাতে তুলে স্কেচটা দেখাল। আবার ওরা কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। সুনীতার চোখে যেন চকিত আলোর বহু বিচিত্রের লীলা চলেছে, অথচ স্থির। সুজিতের চোখ স্নিগ্ধ উজ্জ্বল, যেন এক গভীর বিস্ময়ে, সুদুরে নিবদ্ধ এবং প্রশান্ত। সুজিত বলল, দীপু আজ সকালে ওটা আপনার কাছে নিয়ে গেছল?
জবাব এল দরজার বাইরে থেকে, হ্যাঁ।
সুজিত ফিরে তাকিয়ে দেখল, দীপু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, চৌকাঠ খুঁটছে। বলল, আপনি তো আবার মিছে কথা বলতে পারেন না, ভাবছেন দীপুটা মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমি যদি তখন বলতাম, ওটা আমার কাছে রয়েছে, তা হলে ওরা ঠিক নিয়ে নিত।
সুনীতা বলে উঠল, তুই ঠিক করেছিস দীপু।
সুজিত দীপুর দিক থেকে সুনীতার প্রতি ফিরল। দীপু বলল, আপনারা কথা বলুন সুনীতাদি, আমি একবার মাকে দেখে আসছি।
দীপু চলে গেল। সুনীতা জিজ্ঞেস করল, আপনি বুঝি মিথ্যে কথা বলতে পারেন না?
সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, না, আমার বুক ধড়ফড় করে।
সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপরে হঠাৎ থেমে বলল, সত্যি?
সুজিত বলল, সত্যি না বললে যে আবার সেই মিথ্যেই বলা হবে।
সুনীতা আবার হেসে উঠল। হাসি থামলে সুজিতের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, তখন প্রিয়নাথ দাশ আর কার কথা যেন বলতে যাচ্ছিলেন?
রঞ্জন।
রঞ্জন? রঞ্জনও এসেছিল আজ?
সুনীতার চোখে-মুখে উত্তেজনার রক্তাভা লাগল। সুজিত বলল, হ্যাঁ, রঞ্জন এসেছিল।
-কী বলল?
–শিবেনকে বলতে এসেছিল, সে যেন আপনাকে বিয়ে করার চেষ্টা না করে। মুহূর্তেই সুনীতার চেহারা যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। ট্রেনে দেখা সেই তীব্র উত্তেজনা, তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে, দুঃসহ ঘৃণায় যেন দপদপিয়ে উঠল। এবং পরমুহূর্তেই হাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসি অনেকক্ষণ ধরে বাজতে লাগল। সুজিতের মনে হল, এ হাসি স্বাভাবিক নয়, যেন হিস্টিরিয়ার অভিব্যক্তি। তার ইচ্ছা হল সুনীতাকে জোর করে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে থামিয়ে দেয়। শান্ত হতে বলে। সে যেন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, এ হাসির মধ্যে কোথাও এক বিন্দু সুখ নেই, আনন্দ নেই, একটা দুঃসহ ঘৃণা ও ব্যথা ঝরে পড়ছে। এ হাসি হাসতে সুনীতার কষ্ট হচ্ছে, অথচ এ হাসি আপনা থেকেই ওর ভিতর থেকে বিষের মতো উপচে পড়ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না সুজিত। একটি মেয়ের প্রাণান্তকর কষ্ট যেন তাকে অসহায় হয়ে দেখতে হচ্ছে।
আস্তে আস্তে হাসির বেগ কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলে, সুনীতা বলল, আপনি তো তা হলে আমার বিষয় সবই শুনেছেন।
সুজিত বলল, তা কিছু কিছু শুনেছি
জবাব শুনে সুনীতা আবার শার্সিভাঙা ঝনঝন শব্দে হেসে উঠল। তারপরে হঠাৎ থামল, যেন কেউ ওর গলা টিপে হাসি থামিয়ে দিল। বলল, কিছু কিছু মানে কী! আমার কী পরিচয়, আমাকে লোকে কী চোখে দ্যাখে, আমি কী চরিত্রের মেয়ে, সবই শুনেছেন আশা করি।
সুজিত বলল, মোটামুটি।
সুনীতা এক মুহূর্ত তাকিয়ে, সহসা ঈষৎ চোখ কোঁচকাল, ঠোঁটের কোণে বক্রতা দেখা দিল। বলল, মোটামুটি মানে, এই ধরুন আমি এক জন মস্ত বড়লোকের
সুজিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনি প্রিয়নাথ দাশের আশ্রিতা।
–আশ্রিতা? ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেই, সুনীতা আবার হেসে উঠল। বলল, খারাপ কথাকেও ভদ্র ভাষায় আপনি বলতে পারেন দেখছি।
সুজিত বলল, আমি যা সত্যি বলে জানি, তাই বললাম।
সুনীতা উচ্চারণ করল, যা সত্যি বলে জানেনা…সুজিতের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে আবার বলল, আর আমি যে নষ্ট ভ্রষ্ট পুরুষদের সঙ্গে হোটেলে ক্যাবারেয় ঘুরে বেড়াই, সে খবর জানেন না?
সুজিত বলল, শুনেছি, আপনি যা যা বললেন, সবই শুনেছি। কিছু কিছু কথা তো সেদিন আমি ট্রেনেই শুনেছিলাম, কিন্তু, তার মধ্যে আপনাকে চিনতে আমি ভুল করিনি।
সুনীতা আত্মগতভাবে নিচু স্বরে উচ্চারণ করল, আমাকে চিনতে।…
সহসা যেন সুনীতা চমকে উঠে বলল, হ্যাঁ, আপনি কেন আমাকে সেদিন ও কথা বলেছিলেন? আমার মধ্যে আপনি কোথায় খুঁজে পেলেন একজন অসহায় আর দুঃখীকে, আমাকে বলুন।
সুজিত বলল, আমি তা ব্যাখ্যা করতে পারি না, কিন্তু আমি যেন তাই দেখেছিলাম, এবং এখনও তাই দেখছি।
সুজিতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিল সুনীতা। সুজিত আবার বলল, সত্যি বলতে কী জানেন, এ যেন অনেকটা নিজেকেই দেখার মতো।
সুনীতা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। বলল, নিজেকে দেখার মতো?
সুজিত অনেকটা অবুঝ শিশুর মতো ঘাড় নাড়ল। এবং দুজনেই পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল।
সুনীতা বিস্ময়-বিমূঢ় নিচু স্বরে বলল, আমি আপনার কথা যেন ঠিক বুঝতে পারছি না। বোঝবার মনটা যেন আমার ক্ষয়ে গেছে মনে হয়।…
তারপর গলার স্বর একটু তুলে বলল, সেদিন ট্রেন থেকে নেমে তারপর আপনাকে অনেক খুঁজেছি, আমি যেন কেমন হয়ে গেছলাম আপনার কথা শুনে। কারণ আমি নিজেও জানি না। আমি অসহায় দুঃখী, আপনার কথা শোনার পর থেকেই ভয়ংকর অস্বস্তি হচ্ছিল, আর বারেবারেই মনে হতে লাগল, লোকটা কে? কে, কে? এমনকী, এ কথাও মনে হয়েছিল, সারাটা রাত্রিই গাড়িতে ভুল দেখেছি, আসলে আমি আর প্রিয়নাথ দাশ ছাড়া কোনও লোক ছিল না। মনে হয়েছিল, সমস্তটাই একটা ভৌতিক ব্যাপার। আমার কাছে যারাই এর মধ্যে এসেছে, তাদেরই বলেছি, সেই লোকটিকে আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ। কিন্তু সে লোকটা বোধ হয় আসলে লোক নয়, একটা বাতাসের বুকে ছায়া।…তারপরে আজ যখন দীপু এই স্কেচটা নিয়ে গেল আমার কাছে, বুকটা ধক করে উঠল। ও বলল, সুজিতদা এঁকেছে, মন থেকে। কে সুজিতদা? হঠাৎ যেন মনটা বলল, সে-ই কি? সেই লোক, যাকে আমি শেষ মুহূর্তে আয়নায় দেখেছিলাম? তৎক্ষণাৎ ওর সঙ্গে ছুটে চলে এসেছি।
সুজিতের মুখে ওর সরল হাসিটি শিশুর মতো ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ, আমি সে-ই!
সুনীতা স্কেচ-এর দিকে একবার দেখে বলল, কিন্তু একি সত্যি মন থেকেই আঁকা? শুধু স্মৃতি থেকে?
সুজিত বলল, তা ছাড়া আর তো কোনও উপায় ছিল না।
–কিন্তু কী করে সম্ভব? কী করে, আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
সুজিত এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হল। তারপরে হেসে বলল, আপনি যেমন আমাকে খুঁজছিলেন, বোধ হয় আমিও তেমনি মনে মনে আপনাকে খুঁজছিলাম।
খুঁজছিলেন?
–হ্যাঁ, আর খুঁজে পেয়েছিলাম, কাগজের ওপরেই তা দেখতে পাচ্ছেন।
সুজিত যেন খুশিতে হেসে উঠল। সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কেন খুঁজছিলেন?
সুজিত বলল, বুঝতে পারছিলাম না। মনটা কী রকম হচ্ছিল। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, জানেন।
–কেন?
সুজিত তার অপরিণত মস্তিষ্ক, চিকিৎসা, বর্তমান অবস্থা, এবং অতীতের দুই-একটি কথা, সংক্ষিপ্তে সবই বলল।
সুনীতা যেন গভীর অভিনিবেশে সমস্ত কথা শুনল। তারপরে বলল, ও, আপনি পিতৃমাতৃহীন?
সুজিত বলল, হ্যাঁ, কিন্তু পরম ভাগ্য, আমি ভাল লোকের আশ্রয় একটা পেয়েছিলাম।
এমন সময়ে কলিং বেল-এর শব্দ পাওয়া গেল। সুজিত বলে উঠল, শিবেনবাবু এলেন বোধ হয়।
সঙ্গে সঙ্গে সুনীতারও যেন সহসা পরিবর্তন হল। বলল, হ্যাঁ। শিবেনকে আপনার কেমন মনে হয়?
সুজিত বলল, এত চট করে কি বলা যায়।
–ওরা আজ কী বলাবলি করছিল?
–আপনার বিয়ের কথা। প্রিয়নাথবাবু আর বীরেন্দ্রবাবুর বোধ হয় ইচ্ছা, শিবেনের সঙ্গেই আপনার বিয়ে হয়।
সুনীতার ঠোঁট বেঁকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু রঞ্জনের সঙ্গে আপনার আলাপ হল কেমন করে?
দরজা খুলতে গিয়েই ওকে আমি চিনতে পারলাম, তাই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও আপনাকে ভালবাসে নাকি?
সুনীতা নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুজিতের দিকে। সুজিত আবার বলল, রঞ্জন বলল, সে তা জানে না, মোটের ওপর আপনাকে ওর চাই।
সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই অস্বাভাবিক, বিদ্রূপ আর ঘৃণা-মিশ্রিত তীব্র তীক্ষ্ণ হাসি।
সুজিত বলে উঠল, কিন্তু আপনি বুঝি আটাশে মার্চ আপনার কথা দেবেন বলে জানিয়েছেন?
সুনীতা উচ্ছ্বসিত হাসির মধ্যেই বলল, সে কথাও জানেন? সেদিন আপনিও আসবেন, আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ করছি।
–কিন্তু আটাশে মার্চেই কেন?
বাঃ, সেদিন যে একটা শুভদিন, হিন্দু মতে সেদিন যে পাকা দেখার দিন। পাঁজি দেখেন না?
বলতে বলতেই সুনীতা হাসির বেগে চৌচির হল এবং উঠে দাঁড়াল। বলল, হতে পারি খারাপ মেয়ে, ওরা আমাকে ছাড়বে না যখন, একটা দিন-ক্ষণ তো দেখতেই হবে।
সুজিত বলল, খারাপ আপনাকে কে বলেছে?
সুনীতার হাসি থামল। বলল, সবাই। যারা আমাকে চায়, তারা খারাপ জেনেই তো আমার চারপাশে ভিড় করেছে। একমাত্র তো আপনাকেই দেখলাম, যে আমাকে, আমাকে অন্যরকম দেখেছে।
বলে আবার একটু হাসল সুনীতা। এবং দুপা দরজার দিকে এগুতে গিয়ে সুজিতের সামনেই দাঁড়াল।
সুজিত বলল, একটা কথা বলব?
-বলুন।
–আপনার দরকার একটু শান্তি, একটু ভালবাসা।
–ভালবাসা?
সুনীতা পুনর্বার অজস্র হাসিতে ফেটে পড়ল, বলল, এই সমাজে, এই যুগে, আর আমার মতো একটা রূপসী আর বেওয়ারিশ মেয়ে, সমাজে যার দুর্নামে কান পাতা যায় না, তাকে আপনি শান্তি আর ভালবাসার কথা
সেই হিস্টিরিয়াব্যাধির মতোই হাসতে হাসতে প্রায় সুজিতের শরীরের কাছে এলিয়ে পড়ল সুনীতা। আবার বলল, এই সমাজে যে মেয়েদের ভাল আশ্রয় আছে, তাদেরই বা কজনের জীবনে ওই বস্তু দুটো আছে? আপনি এই যুগের কিছুই জানেন না, ছেলে হয়েও এ যুগের পুরুষদের আপনি মোটেই চেনেন না।
সুজিতের হাসির মধ্যে একটি করুণ ব্যথা ফুটে উঠল। বলল, তা হয়তো হবে। যুগের কথা আমি জানি না। আপনি আসার আগে, আমি এমন একটা আশ্চর্য অপরূপ দৃশ্য দেখেছি, মনে হল তার সঙ্গে যেন যুগের কোনও সম্পর্ক নেই, যেন সকল যুগের উর্ধ্বে। দেখে আমার মনটা কেমন করছিল, আনন্দে আরআর–ঠিক কী বলব, আমার যেন মনে হয় সত্যিকারের আনন্দের মধ্যে একটা ব্যথাও আছে, ব্যথার আনন্দ, সেইরকম, একটা সুখের ব্যথায়, আমি যেন কী রকম হয়ে গেছলাম, তাই অমনি করে বুক চেপে পড়ে ছিলাম।
সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কী সেই দৃশ্য?
সুজিত বলল, আমি দেখলাম, যাঁদের বয়স হয়ে গেছে, যৌবন আর নেই, এরকম এক দম্পতিকে। স্বামী প্রায় বৃদ্ধ, স্ত্রীও তাই; তার ওপরে স্ত্রী সম্পূর্ণ রুগ্ন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শুধু চোখের ভিতর দিয়েই কথা বলতে পারেন। আমি দেখলাম, সেই স্ত্রীকে বুকের কাছে ধরে স্বামীটি কী গভীর স্নেহে তাঁকে আদর করছেন, চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছেন, তুই বলে সম্বোধন করছেন, নিজের দুর্ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাইছেন, আর স্ত্রীকে চুমো খাচ্ছে। আমি দেখলাম, স্বামীটির চোখে জল, স্ত্রীর চোখেও, কিন্তু গভীর বিশ্বাস ও শান্তিতে, দু জনের চোখেই আশ্চর্য মিষ্টি হাসি।
সুনীতা সহসা রুদ্ধ গলায় বলে উঠল, আমাকে গল্প বলছেন?
না, গল্প নয় সুনীতা, আমি দেখলাম, অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যেও অবিশ্বাস্য সুন্দর ঘটনা।
সুনীতা চকিতে এক বার সুজিতের চোখের দিকে তাকাল, তারপর যেন রুদ্ধশ্বাস ব্যাকুলতায় ছটফট করে উঠল। ফিসফিস স্বরে উচ্চারণ করল, কিন্তু এ গল্প গল্পই শুধু। এ আমি শুনে কী করব, কী করব! সুজিত, এ সব নেই, এ সব নেই। তুমি ভয়ংকর সরল বলে এ সব বিশ্বাস করেছ। তুমি আলাদা মানুষ।
সুনীতা থামল, মুখ তুলল, ঘন সান্নিধ্যে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখল। পরমুহূর্তেই সুনীতা সহসা এগিয়ে দরজার বাইরে চলে গেল। থমকে দাঁড়াল এক বার। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। স্কেচটা ওর হাতেই ছিল। নিচু স্বরেই বলল, সুজিত, তুমি কোথা থেকে এলে বুঝতে পারছি না। তুমি যা বলছ, সে সব বোঝবার মন বোধ হয় আমার নষ্ট হয়ে গেছে।
বলতে বলতেই একটি চকিত যন্ত্রণার ছায়া পড়ল ওর মুখে। বলল, আশা করি, আবার তোমাকে দেখতে পাব। যাচ্ছি।
বলে সুনীতা যেন ছুটে চলে গেল। সুজিত তাড়াতাড়ি ওকে অনুসরণ করল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নেমেও ওকে আর ধরতে পারল না। ও ততক্ষণে গিয়ে ওর গাড়িতে বসেছে। বসা মাত্রই ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দিল। সুজিত দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটা বেঁকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তেই সুনীতার একটা হাত উঠল তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুজিত কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে, বিষণ্ণভাবে হাসল। দরজা বন্ধ করে নত মস্তকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। শেষ ধাপে উঠে চমকে তাকিয়ে দেখল, সামনেই দীপু দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দৃষ্টিতে বিরক্তি ও বিদ্রুপের আভাস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যেও একটা দুর্বিনীতের ভঙ্গি। কিন্তু সে হঠাৎ কোনও কথা বলল না।
সুজিত বলল, তোমার দাদা এসেছেন?
না। স্পষ্ট গম্ভীর জবাব দিল সে।
তবে কলিং বেল বাজাচ্ছিল কে?
একইভাবে জবাব দিল দীপু, পিয়ন এসেছিল।
–ও! কিন্তু তুমি আমার দিকে ওরকম করে দেখছ কেন? কী হয়েছে?
-কিছু না। বলেই কপালের চুল সরাবার জন্যে মাথাটা একবার ঝাঁকাল। সুজিত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দীপু হঠাৎ বলে উঠল, আপনারও তা হলে সুনীতাদিকে ভাল লেগেছে?
সুজিত ফিরে বলল, মানে?
–মানে জানি না। বলে সে বাড়ির ভিতরে চলে গেল হনহন করে।
সুজিত এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে, হেসে উঠে বলল, পাগল।