Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অপরিচিত || Samaresh Basu » Page 3

অপরিচিত || Samaresh Basu

গাড়িটা ছেড়ে দিতেই সুজিত হঠাৎ বলে উঠল, ও হো, একটা কথা দোলাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

এখনকার শিবেন সেই বীরেন্দ্রনারায়ণের সামনের শিবেন না। সেই বিনীত শান্তভাবের মধ্যে তার নিজস্বতা ফুটে বেরিয়েছে। সে এখন গম্ভীর, এবং আত্মসচেতন। গাড়ি ঘোরাতে বলব? জরুরি কথা নাকি!

সুজিত তাড়াতাড়ি বলল, না না, তেমন কিছু নয়। আপনাকেও বলতে পারি। মানে কথাটা হল, মিঃ রায়চৌধুরী তো আপনার কাকা হন, না?

সুজিতকে নিয়ে শিবেন পিছনের সিটে বসেছিল। সকালবেলার পোশাক এখন তার গায়ে নেই। পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত সে এখন পুরোপুরি সাহেব। সে সিগারেট ধরাতে গিয়ে থেমে বলল, কাকা হবেন কেন?

–আপনি যে কাকাবাবু বলে ডাকছিলেন তখন?

শিবেন বাইরের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইল। তারপরে বলল, আমার ছেলেবেলায় মিঃ রায়চৌধুরী আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, অর্থাৎ প্রায় বন্ধুর মতোই। আমাদের বাড়িতেও যাতায়াত ছিল। এখন উনি আমার বস, আমি ওঁর সেক্রেটারি। তবে বাড়িতে উনি আমাকে কাকাবাবু ডাকবারই পারমিশন দিয়েছেন। ছেলেবেলায় ডাকতাম তো।

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, ও। তাই আমি ভাবছিলাম, খুড়তুতো বোনের দিকে আপনি ওভাবে তাকাচ্ছিলেন কেন, আর কথাই বা বলতে পারছিলেন না কেন।

–তার মানে? কী বলতে চান আপনি?

শিবেনের চোখে জাকুটি-বিস্ময় ফুটে উঠল। সুজিত হেসে বলল, আপনি কেমন করে যেন তাকাচ্ছিলেন, না? যেন…যেন…ওকে আপনার ভাল লাগছে, কথা বলতে চান, অথচ…মানে

সুজিত তার সহজ সরল হাসি-মাখানো চোখ দুটি শিবেনের দিকে তুলে ধরল। শিবেন তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে কুঞ্চিত জ সরল হয়ে এল তার, মুখে সহজভাব নেমে এল। বলল, হুম! আফটার অল সি ইজ ডটার অফ মাই বস। আই রিগার্ড হার।

সুজিত বলে উঠল, ডটার মানে তো কন্যা, না?

শিবেনের চোখ আবার সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। সুজিত বলল, আমি কয়েকটা ইংরেজি কথা শিখেছিলুম ওয়ার্ডবুক পড়ে।…এটা তো ট্রাম, না? হাওড়া থেকে আসবার সময় রিকশাওয়ালা আমাকে বলেছিল, এগুলো ট্রাম। দোতলা বাসগুলো কী ভীষণ দেখতে।

সুজিত অবাক হয়ে কলকাতাকে দেখতে লাগল। শিবেনের মুখে আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কত দিন সেখানে ছিলেন?

–কোথায়?

–ওই উন্মাদ-আশ্রমে?

অনেক দিন, আট-ন বছর হবে বোধ হয়। তবে আমি উন্মাদ ছিলাম না।

শিবেন সরস সুরে বলল, কী ছিলেন?

সুজিত যেন বাইরের থেকে তার বিস্ময়-চকিত, কৌতূহলিত চোখ ফেরাতে পারছিল না। সেইদিকে চোখ রেখেই বলল, ডক্টর ঘোষ বলতেন, আমার অপরিণত মস্তিষ্ক ছিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, এখন ভাল হয়ে গেছি।

শিবেন ঘাড় নেড়ে হেসে বলল, ও? তা, মিঃ রায়চৌধুরীর বাড়িতে কেমন লাগল আপনার?

-খুব ভাল। মাসিমা খুব ভাল।

–মাসিমা?

–হ্যাঁ, মানে মিসেস রায়চৌধুরী, ওঁকে আমি মাসিমা বলে ডেকেছি। দোলাও খুব ভাল, সুন্দর। মুখখানি কী সুন্দর, আর হাসিটা। ও খুব সুখী আর পবিত্র মেয়ে। দুঃখ কী, কিছুই জানে না, তাই না?

শিবেনের সারা মুখ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। বলল, আপনি কি দোলাকে নাম ধরে ডেকেছেন নাকি?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, মাসিমা যে বললেন, ও আমার থেকে ছোট। ওকে তুমিই বলেছি।

–আপনি কী করে বুঝলেন, ও সুখী আর পবিত্র কি না?

–মুখ দেখে। আমি মুখ দেখলেই বলতে পারি।

শিবেন আবার হাসতে লাগল। বলল, ও!

সুজিত আবার দু চোখ ভরে কলকাতাকে দেখতে লাগল আর আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগল। যত বিস্ময়, তত যেন তার অস্বস্তি। যেন ঠিক খুশি হতে পারছে না। সবই বড় দ্রুত, ব্যস্ত, চলন্ত। মনেই হচ্ছে না সময়টা ভর-দুপুর। এই রকম দুপুরে সবই তো একটু নিশ্ৰুপ নিঝুম থাকে। এখানে হয় ঘরের নিরালা, নয় দরজা খুললেই হাট। কোথাও একটু শব্দহীন, নিরালার নিবিড়তা নেই। কষ্ট হয় না মানুষের? কী এটা? ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল? ওটা মনুমেন্ট? খেলার ময়দান, চৌরঙ্গি, ওই দূরে গভর্নরের প্রাসাদ? কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সুজিতরা। ইটালি! ও! এন্টালি, একটা রাস্তার নাম? সেখানে বুঝি শিবেনবাবুদের বাড়ি? কে কে আছেন? অসুস্থ মা, আর বুড়ো বাবা, এবং একটি ছোট ভাই?

সুরেন ব্যানার্জি রোড দিয়ে গাড়িটা চলেছে। সুজিত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি কত টাকা মাইনে পান?

এই আদবহীন প্রশ্নে শিবেন একটু দ্বিধান্বিত হল। তারপরে বলল, আটশো টাকা।

–আট-শো? এত টাকা কী করেন?

শিবেন হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, আটশো টাকায় কী হয়? মাসের পনেরো দিন চলতে চায় না।

তাই নাকি? বলেন কী!

সন্দিগ্ধ চোখে সুজিত তাকাল শিবেনের দিকে। ঠাট্টা করছে কি না বুঝতে পারছে না। বলল, পনেরো দিন চলতে চায় না?

শিবেন বলল, তাই তো। আমিই তো একমাত্র আর্নিং মেম্বার।

–এই গাড়িটা তবে কার?

–কোম্পানির। মানে মিঃ রায়চৌধুরীরই বলতে পারেন।

-আপনার বাবা কী করেন?

–কিছুই না। এক সময়ে খুব বড়লোক ছিলেন। বড় ব্যবসা ছিল।

–ও! তারপরে আবার গরিব হলেন কী করে?

–যেভাবে সবাই হয়, বুদ্ধির দোষে। পার্টনাররা প্রচুর চুরি করেছিল, নিজেও বেহিসেবি ছিলেন আমার বাবা। মিঃ রায়চৌধুরীও বাবার বিজনেসের পার্টনার ছিলেন।

সুজিত চোখ বড় করে বলল, তার মানে উনিও চুরি করেছিলেন?

শিবেন বলল, সেটা আমরা জানি না। কে যে চুরি করেছিল আর করেনি, এটা তো হাতেনাতে ধরা যায়নি, ঋণের দায়ে যখন ব্যবসা লাটে উঠে গেল, তখন জানা গেল, পুকুরচুরি হয়ে গেছে। কিন্তু দেখবেন, এ সব কথা আবার মিঃ রায়চৌধুরীকে বলতে যাবেন না যেন।

বলব না? আচ্ছা। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে।

শিবেন বলল, বাবার সব পার্টনাররাই এখন বেশ বড়লোক, বড় ব্যবসা করে।…হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, আমার বাবার একটু ইয়ে আছে, মানে মাথায় একটু গোলমাল আছে। একটু আবোল-তাবোল বকেন। খুব একটা বিপজ্জনক নন, তবে, ওই আর কী, একটু দেখে-শুনে চলবেন।

সুজিত বলল, ও, তাই নাকি। বোধ হয় শোকে-দুঃখেই ওরকম হয়ে গেছেন।

শিবেন গম্ভীর ও নির্বিকার মুখে বলল, বোধ হয়। আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন বলেই কথাটা বলতে হল।

বলাটা যে মনঃপূত নয়, সুজিত তা অনুমান করল শিবেনের মুখের দিকে তাকিয়ে। বলল, সেজন্যে আপনি ভাববেন না। ওরকম লোকদের আমি অনেক দেখেছি আশ্রমে।

শিবেন বিরক্ত চোখে তাকাল সুজিতের দিকে। সুজিত হাসল। শিবেনদের বাড়িটা বেশ বড় আর দোতলা, কিন্তু পুরনো এবং সেকেলে ধরনের। সামনে খানিকটা জমি আছে, তাতে বাগান বলে কিছু নেই। দেখেই বোঝা যায়, বাড়িটায় অনেক কাল চুনকাম বা রং করা হয়নি। গোটা বাড়িটা তাই শ্যাওলার রং ধরেছে। ওপরে নীচে অধিকাংশ দরজা-জানালাই বন্ধ। মনে হতে পারে, বাড়িটায় লোক নেই। কিন্তু ড্রাইভারকে তিনটের সময় আসতে বলে, শিবেন দরজার চৌকাঠে কলিং বেলের বোতাম টিপল। একটু পরেই একজন এসে দরজা খুলে দিল। দেখেই বোঝা যায়, সে বাড়ির ভৃত্য।

শিবেন জিজ্ঞেস করল, কোনও চিঠিপত্র এসেছে?

চাকর জবাব দিল, না।

চাকরটি সুজিতকেই দেখছিল। দরজা দিয়ে ঢুকে, বাঁ দিকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। সামনাসামনি যে দরজাটা আছে, সেটা বন্ধ। শিবেন সুজিতকে ডেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, দীপেন কোথায়?

চাকর জবাব দিল, ইস্কুলে।

বাবা?

বসবার ঘরে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শোনা যাচ্ছিল ওপরে। তারপরেই সেটা থেমে গিয়ে মোটা শ্লেষা-জড়ানো গলায় শোনা গেল, হ্যালো, ইয়েস! আপনি কে? ও ও ও, মহাশয়া শিবেন রায় মহাশয়কে চান? জাস্ট এ মিনিট প্লিজ, একটা কলিং বেলের শব্দ পাওয়া গেছে, হয়তো

ঠিক সেই সময়েই শিবেনের সঙ্গে সুজিত ওপরের বসবার ঘরের দরজায় দাঁড়াল। সুজিত দেখল, ঘরের একপাশে হাফ-হাতা পাঞ্জাবি গায়ে ময়লা কাপড় কিন্তু কোঁচা লুটানো এক ভদ্রলোক টেলিফোনের রিসিভার নিয়ে কথা বলছেন। বয়স ষাট নিশ্চয়ই। বেশিও হতে পারে। বেশ কয়েক দিনের না কামানো গোঁফ-দাড়ি। চুল উশকোখুশকো। চোখ দুটি বড় বড়, কিন্তু রক্তিম এবং গর্তে ঢোকানো। শিবেনকে দেখেই, –টেনে চোখ বড় বড় করে বলে উঠলেন, এই যে মিঃ শিবেন রায়।…হ্যালো, আপনি যাকে চাইছেন, তিনি এসেছেন।

বলে রিসিভার মুখের কাছ থেকে সরিয়ে খানিকটা যেন ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললেন, এই যে আসুন বড় রায়মহাশয়, আপনার ফোন, মনে হচ্ছে কোনও যুবতী আপনাকে ডাকছেন।

বৃদ্ধের কথা শেষ হবার আগেই শিবেন দ্রুত এগিয়ে, রিসিভারটা প্রায় কেড়ে নিল। বলল, তা অত গাঁক গাঁক করে চেঁচাবার কী আছে? যান, ওদিকে গিয়ে বসুন।

বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে বললেন, বসবই তো, বসবই তো, বহু দিনই তো বসে আছি। ৪৮৮

বলতে বলতে তিনি সরে এলেন। ইতিমধ্যে শিবেনের গম্ভীর স্বরে আবেগ ঝংকৃত হয়ে উঠল, ও, তুমি!–হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, না আমাকে আবার মিঃ রায়চৌধুরী নিজে একজন গেস্ট দিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে থাকবার জন্যে, তাকে নিয়ে এইমাত্র…হ্যাঁ, না, কই আমি তো সে বিষয়ে কিছু বলিনি।…তা শুনেছি বটে, এবং ইন দি মিনটাইম কুবের কলকাতাতে ছিলও না, সেই জন্যেই বোধ হয়…না, রঞ্জনের কথা আমি কিছুই জানি না, আর আমি বিশ্বাসও করতে পারি না যে তুমি রঞ্জনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যাবে। অ্যাঁ? হ্যাঁ, তা জানি বইকী, বারো হাজার টাকার নেকলেস তোমাকে রঞ্জন দিয়েছে, অ্যাঁ? না, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তা হলে কলকাতার অনেক গুণ্ডা বদমায়েশ সম্পর্কেই…ও! তা বেশ…। হ্যাঁ, আজ সকালেই তো বললাম তোমাকে…।

সুজিত অবাক হয়ে টেলিফোনের কথা শুনছিল। অদ্ভুত লাগছিল তার। এবং তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলেও মনে হল কুবের নামটা একাধিকবার শুনেছে সে। এক বার রাত্রে ট্রেনে, আর এক বার কিরণময়ীর মুখে। রঞ্জন নামটা নতুন শুনতে পেল সে।

অবাক হয়েই শুনছিল সে। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ সুজিতের দিকে এগিয়ে, হাত প্রসারিত করে বললেন, আপনি নিশ্চয় বড় রায়ের সঙ্গে এসেছেন? আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক।

সুজিত হেসে আপ্যায়িত হয়ে ভিতরে এল। বৃদ্ধের ভাবভঙ্গির মধ্যে ঈষৎ বিদ্রুপের বক্রতা থাকলেও, গলাটা বেশ দরাজ, কিন্তু বাজখাঁই নয়। মুখে গাম্ভীর্য আছে, কিন্তু রাশভারী গোছের নন। মনে মনে ভাবল, ইনি কি শিবেনের বাবা?

বৃদ্ধ সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, লুকিং ভেরি ফ্রেশ, অ্যাঁ? চোখ দুটি তো এখনও দেখছি নির্দোষ নিষ্পাপ ভাবের, মুখখানিও ছেলেমানুষের মতন। যেন ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানা নেই।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, ভাজা মাছ?

ভাজা মাছ বইকী! আর ভাজা মাছ বললে, বেশ বড় সাইজের কালবোস মাছই বলতে হবে মিষ্টি আর নরম, স্পেশাল ফর ফ্রাই। তা বলে ওই এঁদো গলির রেস্টুরেন্টের বোয়াল মাছের বারো আনা দামের ফিস ফ্রাই নয়, সত্যিকারের বাঙালির মাছভাজা যাকে বলে।…আমি অবিশ্যি আপনার পরিচয় জানি না।

সুজিত তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করল, শ্রীসুজিতনাথ মিত্র আমার নাম।

বৃদ্ধ বললেন, হতে পারে আপনার নাম সুজিতনাথ মিত্র, আমার নাম ভুজঙ্গভূষণ রায়, এখন অনেকে অনেক কিছু নাম বলে, এক সময়ে শুধু বি-বি বললেই আমাকে চেনা যেত। কিন্তু সুজিতনাথবাবু, আপনাকে একটু গোবেচারার মতো দেখতে বলেই, ভাজা মাছের কথা বলছি আমি, অনেক সময় বেড়ালকেও তপস্বীর মতো দেখায় কিনা।

সুজিত অবাক স্বরে বলল, বেড়ালকে?

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, হ্যাঁ, বেড়াল, মার্জার যাকে বলে। কিন্তু মাছভাজার কথাই যখন উঠল, তখন বলে পারছি না, কিন্তু তার আগে বলুন, আপনার জন্ম কত সালে?

সুজিত ঠিক খেই ধরতে পারছে না, তাই আরও অবাক হয়ে বলল, আমার জন্ম? তা এই চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হয়েছে।

ভুজঙ্গ বললেন, ও, সে আপনার জন্মেরও আগের কথা তা হলে। তখন যিনি ছোটলাট ছিলেন, আমি আবার সাহেবদের নাম মনে রাখতে পারি না, যাই হোক ছোটলাট, কয়েক জন পশ্চিম দেশীয় রাজা, আর বিলাতি কোম্পানির কয়েক জন কর্তাকে আমি একটা পার্টি দিয়েছিলাম।

সুজিত মুগ্ধ বিস্ময়ে উচ্চারণ করল, ও!

-হ্যাঁ, আমার অনেকগুলো পুকুর ছিল। অর্ডার দিয়ে সেখান থেকে কালবোস মাছ ধরিয়েছিলাম, আধমন-তিরিশ সের ওজনের কালবোস এক-একটা। কালচে নীল রং তাদের।

কালচে নীল?

-হ্যাঁ, কালচে নীল, আর পেটের দিকটা লাল। গোয়ানিজ সূপকারকে দিয়ে সে মাছের ফ্রাই বানিয়ে যখন পরিবেশন করানো হল, সবাই হাত গুটিয়ে নিল। কেউ মাছভাজা খাবেন না, গলায় নাকি কাঁটা ফুটবে, নেটিভদের মতো তাঁরা কাঁটা বাছতে পারেন না। মানে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেন না। আমি লাটবাহাদুরকে কোনওরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুখে ভোলালাম। মুখে দিয়েই লাটবাহাদুরের মুখ রসে ভরপুর।

সুজিত দেখল, ভুজঙ্গবাবুরই মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ার অবস্থা। উনি ঝোল টেনে বললেন, ব্যস, আর যায় কোথায়। দেখলাম, খালি হুইস্কি আর কালবোস ফ্রাই খেল সবাই, বাকি খাবার সব পড়ে রইল। কিছু ছুঁলেই না। অতএব, বুঝতেই পারছেন, ভাজা মাছ উলটে খেতে সবাই জানে। আপনি কি জানেন না?

ভুজঙ্গভূষণ তাঁর কাঁচাপাকা লোমশ জ্বর তলা থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন সুজিতের দিকে। সুজিত বিব্রত বিস্ময়ে বলল, মানে, ভাজা মাছ?

–হ্যাঁ, উলটে খেতে।

সুজিত ঘাড় কাত করে হেসে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি তো।

ভুজঙ্গভূষণ হা হা করে হেসে উঠলেন। মনে হল, দেওয়ালগুলি সব কেঁপে উঠল সেই হাসির শব্দে। বললেন, জানি, জানি, মুখ দেখতে যেমনই হোক–

সহসা তীব্র উচ্চ গলায় ধমকে উঠল শিবেন, আস্তে আস্তে।

সুজিত দেখল, শিবেন রিসিভারের স্পিকারের মুখে হাত চেপে ক্রুদ্ধ চোখে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ভুজঙ্গভূষণ তা ফিরে তাকিয়ে দেখলেন না। গলার স্বর একেবারে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেই চললেন, অর্থাৎ বেড়ালের মুখ, তা সে দেখতে যেমনই হোক, সাদা কালো হলদে, সাদা চোখো, হলদে চোখখা, ভাজা মাছ উলটে খেতে সবাই জানে।

উনি থামতেই, আবার শিবেনের গলা সে শুনতে পেল, ফোনে সে তখনও বলে চলেছে, কিন্তু তুমি জান যৌতুকের কথা আমি কিছুই চিন্তা করিনি। অ্যাঁ? না..মানে…শুনেছি বটে, উনি তোমাকে…আশ্চর্য! এতে এত হাসবার কী আছে?

ভুজঙ্গভূষণ হঠাৎ সুজিতের কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে চুপিচুপি স্বরে বললেন, বিশ্ব সংসারের সবটাই যখন হাসির, তখন উনি বললেন কিনা, হাসির কী আছে, বুঝুন এক বার ব্যাপারটা।

পরমুহূর্তেই জিজ্ঞেস করলেন, কিছু অনুমান করতে পারছেন ব্যাপারটা?

সুজিত হেসে ঘাড় নাড়ল, সে বুঝতে পারছে না। ভুজঙ্গও ঘাড় নেড়ে বললেন, আমিও কিছুই পারছি না। তবে একটা বেকায়দার ব্যাপার কিছু হয়েছে নির্ঘাত, নইলে অতক্ষণ ধরে ফোনে বকরবকর…তা সে যাকগে, বুঝতে পারছি, এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বড় রায়ের যোগাযোগ নেই, অ্যাঁ?

সুজিত বলল, আজ্ঞে না।

কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না। বসুন বসুন।

ঘরের মধ্যে সোফা এবং চেয়ার ছিল। কিন্তু সবই প্রায় পুরনো জীর্ণ হয়ে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে এর ওপর যথেষ্ট ঝাড়ামোছা করে মোটামুটি একটু শ্ৰী বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। টেবিলের ওপরে ফুলদানিও আছে, এবং ফুলদানিগুলি যে মাজলেও পরিষ্কার হয় না, তাও অনুমান করা যায়। ফুলগুলি প্ল্যাস্টিকের। প্রত্যহ নতুন নতুন টাটকা ফুল কিনে সাজানো নিশ্চয় সম্ভব হয় না। ঘরটা যেন কেমন অন্ধকার মতো। অধিকাংশ জানালা-দরজা বন্ধ বলেই বোধ হয়। দেয়ালে কিছু ছবি টাঙানো আছে, অধিকাংশই পুরনো।

ভুজঙ্গ প্রায় এক কোণে সুজিতকে টেনে নিয়ে গেলেন, সোফা দেখিয়ে বললেন, এখানে বসুন। না, না আপনি যা ভাবছেন তা মোটেও নয়, ওতে ধুলো নেই, সোফার কাপড়টার রংই ওরকম। অবিশ্যি পুরনো হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কার।

–আজ্ঞে না না, আমি তা ভাবছি না।

সুজিত লজ্জিত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বসে পড়ল ধপাস করে। বড় সোফা, পাশাপাশি ভুজঙ্গ বসলেন। এক বার তাকালেন শিবেনের দিকে। সে তখন এদিকে পিছন ফিরে ফোনে কথা বলেই চলেছে, যদিও গলার স্বর আগের থেকে অনেক নিচু।

ভুজঙ্গ শুরু করলেন, কী যেন নাম বলছিলেন আপনার। সুজিত, সুজিতনাথ মিত্র! বেশ নাম। যদি কিছু মনে না করেন, ওর সঙ্গে, মানে বড় রায়, যিনি ফোনে কথা বলছেন, ওর সঙ্গে আপনি কোথা থেকে আসছেন? কী দরকার?

বলেই তাড়াতাড়ি শিবেনের দিকে এক বার দেখে নিয়ে বললেন, অবিশ্যি, এমনি জিজ্ঞেস করছি, মানে এ সময়ে তো কাউকে আসতে দেখি নে। আর আপনার মতো একজন, যদি কিছু মনে না করেন নিতান্তই চালচুলোহীন ছোকরা, বগলে কাগজের বান্ডিল..অবিশ্যি এ কথা ঠিক আপনার মুখখানি সত্যি সুন্দর, চোখ দুটিও, খুবই নিরীহ আর ভালমানুষ বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু কী মনে করে এসেছেন, সেটা আমি জানতে ইচ্ছুক।

ভুজঙ্গ থামলেন। ইতিমধ্যে কয়েকবারই ভুজঙ্গভূষণের জবাব দেবার চেষ্টা করেছে সুজিত, কিন্তু ওঁর প্রশ্নের স্রোতে ভেসে গিয়েছে। উনি থামতে সে বলল, আমি আসছি এখন বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বাড়ি থেকে।

–আচ্ছা? আপনি বীরেনের বাড়িতে থাকেন?

না না, আজই এসেছি ওখানে।

–কোথা থেকে?

–গুড়িয়াঁটাঁড়, মানে বিহার থেকে।

–ও, সেখানে কি আপনি বীরেনদের কোম্পানির?

–আজ্ঞে না, আমি আসছি উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয় থেকে। আমি ওখানকার রুগি ছিলাম, এখন ভাল আছি, আর ইতিমধ্যেই

–দাঁড়ান দাঁড়ান।

হাত তুলে সুজিতকে থামিয়ে ভুজঙ্গ জ্ব তুলে বললেন, আপনি ছিলেন?

সুজিত হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, আজ্ঞে না, আমার মাথাটা…মানে, বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না আর কী। এখন ঠিক আছে। আমাকে বীরেন্দ্রনারায়ণবাবু একটা চাকরিও দেবেন বলেছেন, তবে আমার তো কোথাও থাকবার জায়গা নেই, এ বাড়িতে শুনলাম দোতলায় কোথায় একটা ঘর আছে, সেখানেই আমি থাকব পেয়িংগেস্ট হিসেবে…।

–সে তো খুবই ভাল কথা। সে কথা আমাকে বলুন, আমিই তো এ বাড়ির কর্তা। আপনি যার সঙ্গে এসেছেন, আমি সেই শিবেন রায়েরই বাবা।

ভুজঙ্গভূষণ যেন খুবই সুখী হলেন। বললেন, অবিশ্যি এসেছেন ভালই করেছেন, এ বাড়িতে পেয়িংগেস্ট একদা চিন্তা করাই যেত না। ভদ্রলোকের ছেলে মুখ ফুটে বললেই যথেষ্ট যে, আমি থাকব এবং খাব। কিন্তু এখন! এই বাড়িটার চেহারা কী ছিল আপনি ভাবতেই পারেন না।

সুজিত ফাঁক পেয়েই বলল, আমি অবিশ্যি অনুমান করেছিলাম, আপনিই শিবেনবাবুর বাবা।

–হ্যাঁ, সেটা মানতেই হবে।

আপনাদের অবস্থা এককালে যথেষ্ট ভাল ছিল, সে কথাও শুনেছি।

ভুজঙ্গ হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর ও ধীর স্বরে বললেন, সে কথা অনেকেই শুনেছে, আর এখনও অনেকে দেখছে আমাদের। আমার এখনও মনে আছে, যে বার লেডি লকফিল্ড এলেন এবাড়িতে…।

হঠাৎ থেমে গিয়ে তিনি শিবেনের দিকে তাকালেন। ওঁর ভ্র জোড়া কয়েকবার কেঁপে উঠল। উনি যেন কান পেতে শুনলেন, শিবেন তখন বলছে, হ্যাঁ, এখন তো অফিসেই বেরিয়ে যাব, এখন ছেড়ে দিচ্ছি..। অ্যাঁ? কী বললে?

হঠাৎ ভুজঙ্গভূষণ সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা, আমি একটু উঠব। আপনার কাছে কি কিছু টাকা আছে সুজিতনাথবাবু?

সুজিত অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, টাকা?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, গোটা-চারেক টাকার একটু দরকার ছিল। সুজিত হেসে তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে। আপনার কত চাই বলুন? ভুজঙ্গ চকিতে এক বার শিবেনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই গোটা দশ-পনেরো? সুজিত তাড়াতাড়ি বীরেন্দ্রনারায়ণের দেওয়া একশো টাকার নোটটা বের করে বলল, দশ-পনেরো টাকা তো ভাঙানো নেই, তা হলে এটার থেকে…।

–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ভাঙিয়ে নিয়ে আসছি, আপনি বসুন।

একশো টাকার নোটটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে যখন বেরিয়ে গেলেন, শিবেন রিসিভার রেখে ফিরে দাঁড়াল। ফিরে দাঁড়িয়েই বাবার পথের দিকে তাকিয়ে সুজিতকে জিজ্ঞেস করল, কী হল, উনি কোথায় গেলেন?

সুজিত তার সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলল, টাকা ভাঙাতে গেলেন?

–টাকা?

–হ্যাঁ, আমার কাছে দশ-পনেরো টাকা আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন, তা আমি বীরেনবাবুর দেওয়া সেই একশো টাকার নোটটা

শিবেন বিকৃত মুখে প্রায় চিৎকার করে উঠল, একশো টাকার নোট! উনি চাইলেন, আর আপনি অমনি দিয়ে দিলেন?

কথা শেষ হবার আগেই শিবেন ছুটে গেল। ছুটতে ছুটতে এক বার চিৎকার করে ডাক দিল, বিশু।

ডেকেও সে দাঁড়াল না। বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলে গেল। পরমুহূর্তেই সেই চাকরটিকে দেখা গেল। ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়েই সে-ও সিঁড়ির দিকে শিবেনকে অনুসরণ করল। সুজিত কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। পূর্বাপর ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারল না। তাকে শিবেন ওরকম ধমকাল কেন, বা ওর বাবার পিছনে ওরকম ছুটেই বা গেল কেন? হঠাৎ তার মনে পড়ল, শিবেন বলেছিল বটে, ওর বাবার মাথাটা একটু গোলমাল আছে, আবোল-তাবোল বকে। কিন্তু সুজিতের তো সেরকম বিশেষ কিছু মনে হয়নি। একটু বেশি কথা বলছেন, এই যা। তা ছাড়া তো টাকা চেয়েছেন, নিশ্চয়ই কোনও দরকার পড়েছে। উনি চাইলেন আর সুজিত কি না বলবে? তাই কি কখনও সম্ভব? তা হলে তো মিথ্যে কথা বলা হয়। এরকম মিথ্যে কথা আবার বলে নাকি কেউ!

কিন্তু ব্যাপারটা কী? সে আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেল। কাউকে দেখতে না পেয়ে, চারিদিকে এক বার তাকিয়ে, বারান্দায় এগিয়ে গেল। সিঁড়ির দিকে উঁকি দিল। দেখল শিবেন বিশুকে নিয়ে ওপরে উঠছে। শিবেনের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে ক্রুদ্ধ এবং উত্তেজিত। বলছিল, দেখতে পেলি তো ডাকলি না?

বিশু বলল, হ্যাঁ ডেকেছিলাম, উনি লাফ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন, আমার কথাই শুনলেন না।

সুজিত মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বলুন তো? আপনারা ওরকম ছুটোছুটি করছেন কেন?

শিবেন তাকাল, কিন্তু কোনও জবাব দিল না। বিশু তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। শিবেন সুজিতের পাশ ঘেঁষেই ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ঘরে আসুন।

সুজিত ঘরে ঢুকল শিবেনের পিছু পিছু। শিবেন বিশুকে বলল, তুই ভেতরে যা, আমি যাচ্ছি।

বিশু ভিতরে চলে গেল। সুজিতের দিকে ফিরে বলল, আপনাকে বলেছিলাম না, বাবার মাথার একটু গোলমাল আছে?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আমি দেখলাম একটু বেশি কথা বলেন।

যাই হোক, আপনি টাকা দিতে গেলেন কেন?

উনি যে চাইলেন।

–চাইলেই দিতে হবে? আপনার কাছে টাকা আছে সে কথা বললেন কেন?

সুজিত অবাক হয়ে বলল, একী বলছেন? আমার কাছে আছে, আমি না বলব?

শিবেন উত্তেজিত স্বরে, প্রায় ভেংচে উঠল, হ্যাঁ তাই বলবেন।

–কেন?

বিস্মিত রাগে শিবেন নির্বাক হয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। সুজিত আবার বলল, তার মানে, মিথ্যে কথা বলতে বলছেন?

শিবেন বলে উঠল, আপনি…আপনি একটা কী? আপনার মাথায় কী আছে বলতে পারেন?

সুজিত আবার বলল, কেন?

-কেন? আপনার কাছে যা থাকবে, সবই বলে দেবেন?

–তাতে কী হয়েছে?

শিবেন অসহায় রাগে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, আপনি…আপনি একটা উজবুক!

–ও!

–হ্যাঁ, আপনি আবার চিকিৎসা করাতে যান।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, কীসের চিকিৎসা?

শিবেন সামনেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারের হাতলটা ভাঙবার জন্যেই যেন কয়েকবার মোচড়াল। তারপরে বলল, আপনি শুনে রাখুন, আপনার টাকা আপনি আর ফেরত পাবেন না।

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, ও!

–হ্যাঁ, ওর একটি পয়সাও আর ফেরত পাবার আশা নেই।

সুজিত বলল, ও! সব টাকাটাই কি আপনার বাবার দরকারে লাগবে? কী করবেন উনি অত টাকা দিয়ে?

শিবেন বলল, মদ খাবেন।

সুজিত চোখ বড় বড় করে বলল, অত টাকার মদ খাবেন। একশো টাকার মদ কতখানি হবে?

শিবেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সুজিতের দিকে। তার চোখে আবার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কিন্তু সুজিত তারপরেও জিজ্ঞেস করল, বেশি মদ খেলে তো শুনেছি লোকে মাতাল হয়ে যায়।

শিবেন বলল, শুনেছেন, দেখেননি?

সুজিত কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, হ্যাঁ, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের রাস্তাঘাটে দেখেছি, হাটের দিনে মেয়ে-পুরুষ সবাই হাঁড়িয়া খেয়ে মাতলামি করত। কিন্তু ওরা মাঝে মাঝে বিচ্ছিরি মারামারি করত। এক বার নাকি একজনকে মেরেই ফেলেছিল। তা বলে ভুজঙ্গবাবুও কি সেরকম করবেন?

শিবেনের সন্দিগ্ধ চোখ আবার সহজ হয়ে এল। বলল, তা করতে পারেন। উনিও মাতাল। মাতালদের কোনও কিছুরই ঠিক নেই। কিন্তু আপনার টাকাটার কী হবে?

কী আবার হবে? উনি তো সব টাকার মদই খেয়ে ফেলবেন। আর আমি তো চাকরিতেই লেগে যাচ্ছি, আমার অসুবিধে কী? আমি যখন মাইনে পাব, তখন আপনাদের বাড়ির টাকাটা দেব, মানে আমার থাকার আর খাওয়ার খরচ। তাতে অসুবিধে হবে না তো?

শিবেন হঠাৎ আবার একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, সেজন্য আপনাকে ভাবতে হবে না। এখন চলুন আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিই।

শিবেনের সঙ্গে দোতলার বারান্দা দিয়ে, পুব দিকে গিয়ে, একটা কোণের ঘরে পৌঁছল সুজিত। মাঝারি ঘর। পুরনো কটা সিঙ্গল খাটে শুধু তোশক পাতা ছিল। পুব দক্ষিণ দুই-ই ভোলা। উত্তর দিকের একটা জানালা খুলে দিল শিবেন। সুজিত সেদিকে উঁকি দিয়ে প্রথমেই দেখল, একতলা ভাঙা পুরনো বাড়ি একটা। একটা বড় উঠোন, উঠোনের একপাশে কলের মুখ থেকে জল পড়ছে। সেখানে মেয়ে-পুরুষেরা একসঙ্গে এলোমেলো চান করছে। মোটামুটি খারাপ লাগল না। শিবেন জানাল, বিশু এসে এখুনি ঘরটা ঝাঁট দিয়ে, তোশকের ওপর চাদর পেতে দিয়ে যাবে। বাথরুম এবং আর সবই দেখিয়ে দেবে। এ ঘর থেকে সুজিত যখন খুশি বাইরে চলে যেতে পারবে। আবার আসতেও পারবে। শিবেনের কাছ থেকে আরও জানল সে, নীচে ভাড়াটেরা থাকে।

.সুজিতের ঘুমন্তই মনে হল, কীসের একটা শব্দ তার কানে আসছে। গুঁড়িয়াটাঁড়ের আশ্রমের ঘরে সে ছোলা ছড়িয়ে দিলে যেমন ময়ুরটা এসে ঠুক ঠুক করে খেত, সেইরকম শব্দ। ভুজঙ্গভূষণের কথা ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে জানে, এই বিশ্ব-সংসারের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক সত্যি কথা বলা যায় না। বললেও, তাদের বিশ্বাস করানো যায় না। যেমন সুনীতার কথা। ভুজঙ্গভূষণের কথাও সে যতই ভাবছিল, ততই তার মনটা যেন এক ব্যথিত অন্যমনস্কতায় ভরে উঠছিল। যত বারই সেই বড় বড় চোখ লোমশ –মুখখানি তার মনে পড়ছিল, তত বারই তার ভিতরে একটা হাসি উথলে উঠছিল। সে হাসিতে কোনও বিদ্রূপ বা ব্যঙ্গের ছাপ ছিল না। বরং একটা কষ্টের ছায়া পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল ভুজঙ্গভূষণ যেন একটা দুষ্টু দুর্ভাগা ছেলে। যার মা নেই, বাবা নেই, মাথার ওপরে কেউ নেই, যে একটু ভালবাসবে, স্নেহ করবে। চারদিক থেকে সবাই তাড়া দিয়ে আসে কেবল শাসন করতে। অথচ সেই দুষ্টুটা অনেক সাধ অনেক বাসনা পূরণ করবার জন্যে মাঝে মাঝে দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। অথচ উনি এক সময়ে কত টাকা ঘেঁটেছেন। বন্ধুদের ষড়যন্ত্রে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনও একটু ভাল পানে ভোজনে বসনে থাকতে ভালবাসেন। তার উপায় নেই। তাই খানিকটা উঞ্ছবৃত্তিও অবলম্বন করেছেন হয়তো। কারণ, সারা জীবনের সবকিছু দেখে, এখন যেন সমূহ নিয়ম-কানুন, কথায় কথায় মানুষেরা যে সব সতোর কথা বলে, সে সবের ওপর ওঁর বিশ্বাস সম্ভবত একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জীবনে যিনি ঠকেছেন, তাঁর বিশ্বাস হারানোটা বিচিত্র নয়। কিন্তু জীবনে যারা কিছুই হারায়নি, তারা অধিকাংশ যে আবার কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না। যেমন শিবেন! ওর সঙ্গে কথা বলে, ও যে ঠিক কীসে বিশ্বাসী, তা বোঝাই যায় না। কেবল এইটুকু মনে হয়, ও টাকাকে বিশ্বাস করে, টাকাকে খুব ভালবাসে। সেটা আবার কেমন বিশ্বাস বা ভালবাসা, সুজিত বুঝতে পারে না অথচ ও কী হারিয়েছে, কে জানে! বাবার প্রতি ওর কী ভীষণ রাগ! খেতে বসে, সুজিতকে এমনভাবে কথা বলছিল যেন, ও নিজে একটা ভয়ংকর পাজি নচ্ছার আর হৃদয়হীন শয়তান ছেলের বাপ। সুজিতের সন্দেহ এবং ভয় হচ্ছিল, ভুজঙ্গভূষণকে ধরে শিবেন মারধোর করে কি না।…টাকা নিয়েছেন তো কী হয়েছে। সুজিতের যদি থাকত, তবে ভুজঙ্গভূষণকে সে অনেক টাকা দিত। তা হলে উনি মুক্তিতে আনন্দবোধ করতেন, আর মুক্তি পেলেই তো মানুষ সহজ হয়ে ওঠে। যার পাবার আশা আছে, সে কখনও চুরি করে না। শিবেন তাকে নিজের মুখেই বলেছে, ভুজঙ্গভূষণের এখনও সামান্য কিছু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু, একলা চেক সই করে উনি যাতে টাকা না পান, শিবেনেরও যাতে সই থাকে, সে ব্যবস্থা করে নেওয়া হয়েছে। এবং শিবেন কিছুতেই চেক সই করে না। এমনকী পাঁচটা টাকা চাইলেও না। সারাদিনে চারটি চুরুট আর খাওয়া, এই ওঁর বরাদ্দ। এই বাড়ি উনি নিজে করিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এ বাড়ি শিবেন তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। শিবেন ভাবে, এ সবই জোর করে করানো হয়েছে। মাতাল এবং দুষ্ট চরিত্রের বৃদ্ধকে জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা এক বারও ভাবল না, হয়তো ছেলেকে ভালবেসেই তা দিয়েছেন। বুঝেছেন হয়তো, ওঁর কাছে থাকলে কোনওদিন ঝোঁকের মাথায় বিক্রি করে দেবেন। নিজের জন্যে তো উনি কিছুই রাখেননি।

শিবেনের কথাও ভাববার আছে। এই সংসারের মধ্যে কোথাও তার শান্তি নেই। চিররুগ্না মা, তাঁকে সুজিত এখনও দেখেনি। ছোট ভাইটি স্কুলে পড়ে। বাবাকে তার একদম পছন্দ নয়। ভাইটির প্রতিও তার তেমন মনোযোগ নেই, বোঝা গিয়েছে। শিবেনের কথা নাকি বিশেষ শোনে না। কেন শোনে না, কে জানে। এর থেকে বোঝা যায়, এরকম কোনও সংসারে একটা লোক নিজেকে সুখী ভাবতে পারে না। কিন্তু সুজিতের মনে হয়, শিবেন কি এখানে একটা সুখী আবহাওয়া তৈরি করতে পারে না! এটা তো পরিষ্কার, এ বাড়িতে শিবেনকে সবাই ভয় পায়। সেই ভয়কে কি ভালবাসায় পরিণত করা যায় না?

যাই হোক, ভুজঙ্গভূষণকে সুজিতের খুবই ভাল লেগেছে। টাকাটার জন্যে তার একটুও কষ্ট হয়নি। একশো টাকার নোট সে কখনও হাতে করেনি, নিজের হাতে জীবনে সে কখনও টাকা খরচ করেছে কি না স্মরণ করতে পারে না। তবে একশোটা টাকা যে অনেকগুলি টাকা, এটা সে জানে। এবং একটা স্কেচ এঁকে দিলে যে কেউ একশো টাকা দিতে পারে, তাও তার কাছে অকল্পিত ছিল। হয়তো টাকা সম্পর্কে তার কোনও কৌতূহল আবেগ বা উত্তেজনা নেই বলেই ব্যাপারটা মোটেই দুঃখিত করেনি তাকে। শিবেন অবিশ্যি বলেছে, টাকার মূল্য আপনি বোঝেন না, কারণ টাকা আপনাকে আয় করতে হয় না, জীবনধারণের কোনও ধারণা আপনার আজও গড়ে ওঠেনি। হয়তো তাই। কিন্তু জীবনধারণের কোনও ধারণাই কি সুজিতের নেই? ছেলেবেলা থেকে কি সে হিংসা ও নিষ্ঠুরতা বর্জিত একটি নিবিড় শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে আসেনি? যদিও এ সব কথা আর শিবেনের সঙ্গে সে আলোচনা করেনি। তার সত্যি ঘুম পাচ্ছিল। শিবেন চলে যাবার পর শুয়ে শুয়ে সে অনেক কথা ভেবেছিল। এবং যত বারই ভুজঙ্গভূষণের, টাকাটা নেবার আগে সেই ভয়চকিত চোখে বারে বারে শিবেনের দিকে তাকানো মুখখানি মনে পড়ছিল, তত বারই তার হাসি পাচ্ছিল। অথচ সেই হাসির মধ্যে একটি ব্যথার রেশ ঝংকৃত হয়ে উঠছিল।

শিবেন আরও বলেছিল, বাংলার লাটবাহাদুর, রাজা মহারাজা, মাছের ফ্রাই, সে সব নাকি সবই ভুজঙ্গভূষণের বানানো গল্প। শুনে সুজিতের হাসিটা আরও উচ্ছ্বসিত ও ব্যথাটা আরও তীব্র অনুভূত হয়েছে। কেন, তা সে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

ইতিমধ্যে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, এবং আশ্চর্য, একটু আগেই সে সুনীতাকে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছিল। দেখছিল, হাওড়া স্টেশনের অনেক জনারণ্যের ভিড়ে সে নিজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সুনীতা উদ্বেগ-ব্যাকুল চোখে তাকে খুঁজছে। তাকে ডাকছে, শুনুন, কোথায় গেলেন, শুনুন। আপনি কোথায় গেলেন? শুনুন! অথচ সুজিত নড়তে পারছে না, তার কণ্ঠে স্বর নেই। সে যেন একটা পাথরের মূর্তি। নিজেকে সে নড়াবার চেষ্টা করছে, চিৎকার করে সাড়া দিতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। এত কাছাকাছি, অথচ এই পারার দুঃসহ কষ্টে তার চোখে প্রায় জল এসে পড়ার উপক্রম করছে। এবং এই কষ্টের মধ্যেই তার ঘুম ক্রমে পাতলা হয়ে আসছিল। তার মধ্যেই সে শুনতে পেল, আশ্রমের ঘরে ছোলা ছিটিয়ে দিলে ময়ুরটা এসে যেমন খুট খুট করে খেত, সেইরকম শব্দ হচ্ছে।

আস্তে আস্তে সে চোখ মেলে চাইল। ঘরটা যেন ঈষৎ অন্ধকার মনে হল তার। সেই ঈষৎ অন্ধকারের মধ্যেই একটি মুখ সে পরিষ্কার দেখতে পেল। একটি ছেলের মুখ। পনেরো-ষোলো বয়সের একটি ছেলের মুখ। রুক্ষু চুলের একটি গোছা তার কপালে পড়েছে যেন কালো একটি ছুরির ফলার মতো। প্রায় ভুরুর ওপরে এসে পড়েছে। কালো দুটি চঞ্চল চোখের তারায় সুজিতকে দেখছে। কৌতূহলিত হয়ে। অথচ যেন মোটেই কৌতূহল নেই, মুখে এমনি একটি নির্বিকার ভাবও বজায় রাখার চেষ্টা আছে। সুজিতকে দেখছে, আর আপন মনে পকেট থেকে চিনেবাদাম বের করছে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে মুখে ফেলছে এবং চিবোচ্ছে।

সুজিত তাড়াতাড়ি উঠে বসল। যতটা অন্ধকার সে মনে করেছিল, ঘরের মধ্যে ঠিক ততটা অন্ধকার নয়। তবে বাইরে সন্ধ্যা ঘনায়মান। উত্তরের বারোয়ারি উঠোনটা থেকে মেয়ে-পুরুষ এবং শিশুদের গলার স্বর ভেসে আসছে।

সুজিত ছেলেটিকে কী বলবে, ঠিক ভেবে পেল না। ছেলেটির আঁট প্যান্ট, পায়ের ওপর পা দিয়ে, টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো, বুকখোলা জামা, এবং সুজিতের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকা, সমস্ত ভঙ্গির মধ্যেই যেন একটি উদ্ধত অবিনীত ভাব ফুটে উঠেছে। সুনীতা স্বপ্ন, আর এটা আশ্রম নয়, এটা সে নিশ্চিন্ত হয়েছে ইতিমধ্যেই। এটা শিবেনদের বাড়ির সেই দোতলা ঘর। এবং ছেলেটি কি শিবেনের সেই ছোট ভাই? যদিও ওর ভঙ্গিতে একটা ঔদ্ধত্বের ভাব আছে, কালো চোখ দুটি সত্যি মিষ্টি, চঞ্চল, দুষ্টুমিতে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কেবল যেন একটু ছায়া-পড়া পুকুরের জলের মতো দেখাচ্ছে এখন। হাওয়া লাগলেই চলকে উঠবে।

হঠাৎ প্রায় একটি যুবতীর মতো গলার স্বরে, খানিকটা কৌতূহলমিশ্রিত স্বরে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, আপনি সুজিতবাবু?

বলেই খুট খুট করে আবার বাদাম চিবোতে লাগল। সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

বাদাম চিবোতে চিবোতেই পরবর্তী জিজ্ঞাসা, আপনি এখন এখানে থাকবেন? সুজিত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। এক মুহূর্ত বাদাম চিবোনো বন্ধ। আবার চিবোতে চিবোতে তার পরবর্তী জিজ্ঞাসা, আপনি পাগলা গারদ থেকে এসেছেন?

সুজিত বলল, মানসিক হাসপাতাল থেকে।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ। হঠাৎ ঠোঁটের কোণ একটু কুঁচকে উঠল ছেলেটির। বলল, বাবা আপনাকে আজ খুব ভোগা দিয়েছে, না?

সুজিত উচ্চারণ করল, ভোগা?

–হ্যাঁ। ভোগা জানেন না? গ্যাঁড়া যাকে বলে, গ্যাঁড়া মারা?

সুজিত চোখ বড় বড় করে উচ্চারণ করল, গ্যাঁড়া মারা?

ছেলেটি পর পর কয়েকটি বাদাম চিবিয়ে বলল, হাপিস মশাই, হাপিস বোঝেন তো?

সুজিত বড় বড় চোখে ঘাড় নেড়ে জানাল, সে জানে না।

ছেলেটি বলে উঠল, যা বাব্বা! এ যে কিছুই জানে না দেখছি।

বলে সে কয়েকবার প্যান্টের দুই পকেটে হাত দিয়ে ঘাঁটল, এবং দুটি পকেটই বাইরে টেনে বের করে, ঝেড়ে ঝেড়ে আপন মনেই বলল, সব খতম, আর নেই। তারপর মাথাটা ঝেকে, চুলগুলি কপাল থেকে সরাবার চেষ্টা করে বলল, বাবা আজ আপনার কাছ থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে কেটে পড়েছে তো?

সুজিত অনুমান ঠিকই করেছিল, এ শিবেনের ভাই। সে বলল, কেটে পড়েছে মানে, টাকাটা চেয়ে নিয়ে গেছেন, ওঁর দরকার বলে।

দরকার? ছেলেটি ঠোঁট উলটে হেসে সুজিতের দিকে যেন অবাক হয়ে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এতক্ষণে সব দরকার মিটে গেছে। কোথায় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে। আমাকেই খুঁজতে যেতে হবে।

সুজিত জিজ্ঞেস করল, তোমার নামই বুঝি দীপেন?

–হ্যাঁ, দীপেন রায়।

একটু যেন গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করল সে। যেন পনেরো-ষোলো বছরটাকে সে পঁচিশ-ছাব্বিশে টেনে তুলতে চাইল।

সুজিত বলল, তা দাঁড়িয়ে কেন? এসো, এখানে বসো।

খাটের পাশেই জায়গা নির্দেশ করে সুজিত তাকে ডাকল। দীপেন সুজিতের দিকে চোখ তুলে তাকাল। যেন খানিকটা অবাক হল, এবং বসবে না বলে ঘাড় ফেরাতে গিয়েও হঠাৎ সুজিতের পাশে গিয়ে বসল। বসে পা দোলাতে দোলাতে সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা অনেকগুলো টাকা নিয়ে গেছে আজ, কোথায় যে পড়ে থাকবে কে জানে।

সুজিত বলল, তোমার বুঝি বাবার জন্যে খুব ভয় করছে?

–ভয়?…দীপেন এক বার ঠোঁট ওলটাল। তারপরে হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। বলল, মদ বেশি খেলে তো বাবার খুব কষ্ট হয়, চলতে পারে না, রাস্তায় পড়ে যায়। আমিই তো বাবাকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসি কিনা।

সুজিত বলল, কেন, শিবেনবাবু যেতে পারেন না?

দীপেন চোখ বড় করে বলল, দাদা? আমি বাবাকে খুঁজতে গেলে আমার ওপরেই রাগ করে, ও আবার নিজে খুঁজতে যাবে? শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, মানে?

কীসের মানে?

–ওই যে শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর?

দীপেন অবাক হল। বলল, ওর আবার মানে কী? দাদা যাবে না, তাই বলছি। তারপর সুজিতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, আপনি সব কথা এখনও বুঝতে পারেন না, না?

–পারি তো! কোনও কোনও কথা অবিশ্যি বুঝতে পারি না।…তুমি বুঝি বাবাকে খুব ভালবাস দীপেন?

দীপেন গম্ভীর হয়ে বলল, ভালবাসলেই বা কী। বাবা ও সব কিছু বোঝে না।

সুজিত বলল, তাই কি কখনও হয়! ভালবাসা সবাই বোঝে।

দীপেন তাকাল এক বার সুজিতের দিকে। তারপর ঘন ঘন পা দোলাতে লাগল। সুজিত জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?

–টেন।

-ও! বেশ ভালই তো। আমি একটা কথা বলছি তোমাকে আমার তো কোনও কাজ নেই। তোমার বাবাকে যখন খুঁজতে যাবে, আমাকে বোলো, আমিও যাব, কেমন?

দীপেন অবাক হয়ে বলল, আপনি যাবেন?

–হ্যাঁ, যাব। ওঁকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার মনে হয়, তোমার মতো আমিও ওঁকে ভালবাসি।

দীপেন কয়েক মুহূর্ত সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, কিন্তু বাবাকে কেউ ভালবাসে না।

–তুমি বাস তা আমি জানি।

দীপেন আবার তাকাল সুজিতের দিকে। তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবাকে এ বাড়িতে কেউ বোঝে না। বাবা খুব দুঃখী।

সুজিত দীপেনের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি তা জানি দীপেন।

দীপেন যেন গভীর বিস্ময়ে সুজিতের চোখ থেকে চোখ সরাতে পারল না। সুজিত হাসল দীপেনের দিকে তাকিয়ে। দীপেনের মুখেও আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল। চোখে তার ঈষৎ লজ্জা নেমে এল, কিন্তু একটি খুশি ও কৌতুকচ্ছটা দেখা দিল। বলল, আপনি ভারী আশ্চর্য!

সুজিত বলল, দীপেন, আমার চায়ের তেষ্টা পাচ্ছে। বিশুকে বললে দেবে?

দীপেন লাফ দিয়ে উঠে বলল, দেবে বইকী। আমি বলে আসছি।

সে ছুটে যেতে গিয়ে, দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে দীপু বলে ডাকবেন, ওইটা আমার ডাকনাম।

বলে সে আবার ছুটে চলে গেল। সুজিত খুশি হয়ে হেসে উঠল। দীপেন ফিরে এল একটু পরেই। বলল, চা নিয়ে আসছে, কিন্তু আপনি যদি আমার সঙ্গে বাবাকে খুঁজতে যান, দাদা তা হলে রাগ করবে না?

সুজিত বলল, দাদা রাগ করবে কেন? আমি তো আমার ইচ্ছেয় যাচ্ছি। না হয় বলেই যাব। তোমার দাদার তো অফিস থেকে আসার সময় হল।

দীপেন চোখ বড় করে বলল, দাদা কি এখন বাড়ি আসে নাকি! ও তো আসে রাত্রে।

-কেন?

–ছুটির পরে তো মিঃ রায়চৌধুরীদের বাড়ি যায়, তাঁর সঙ্গেই। সেখানেই চা খায়, কাজকর্ম থাকলে মেটায়। তারপরে নির্ঘাত আজ সুনীতাদির ওখানে যাবে।

–সুনীতাদি? সুজিত অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসায় তাকাল দীপেনের দিকে।

দীপেন বলল, হ্যাঁ, সুনীতাদি। দাদা তো এখন সুনীতাদিকে বিয়ে করার জন্যে খুব খেপেছে।

তাই নাকি? কে সুনীতাদি?

দীপেন বলল, সে আপনি চেনেন না। সুনীতা নাগ। খুব সুন্দর দেখতে।

সুজিত বলল, আমি বোধ হয় চিনি।

–চেনেন? কোথায় থাকে বলুন তো?

–তা জানি না।

দীপেন হেসে ফেলল। আপনার কথার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝি না। আপনি সুনীতাদিকে চিনবেন কী করে?

সুজিত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ওর গলাবন্ধ কোটের পকেট থেকে সুনীতার স্কেচটা বের করে দেখাল। বলল, দেখো তো, এই কি তোমার সুনীতাদি?

স্কেচটা হাতে নিয়ে দীপেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, এই তো সুনীতাদির ছবি। কোথায় পেলেন?

সুজিত বলল, আমি এঁকেছি।

–আপনি এঁকেছেন? কোথায় দেখলেন আপনি ওকে?

সুজিত জানাল যে, সে গতকাল রাত্রে ট্রেনে ওকে দেখেছে এবং আজ স্মৃতি থেকে দোলাদের বাড়িতে বসে এঁকেছে।

কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে ও অবিশ্বাসে কথাই বেরুল না দীপেনের মুখ থেকে। তারপরে বলল, আপনি এটা মন থেকে এঁকেছেন? মানে, আপনি তা হলে আঁকতে পারেন?

–পারি।

–কিন্তু…! ঠিক কী যে বলবে যেন স্থির করে উঠতে পারছে না দীপেন। কয়েক মুহূর্ত সুজিতের মুখের দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপরে আবার বলল, আপনার এতটা মনে ছিল সুনীতাদির মুখ যে, শুধু মনে করে করেই এঁকে ফেললেন?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, তাই তো। কেন?

–আমার মুখটাও পরে মনে করে আঁকতে পারবেন?

সুজিত একটু থমকাল। বলল, তা ঠিক বলতে পারি না। এক-একটা মুখ আমার এত মনে থাকে যে, আমি যখন খুশি আঁকতে পারি।

দীপেন তেমনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সুজিত বলল, কিন্তু তুমি যা বলছিলে তা তো বলা হল না। তোমার দাদা সুনীতাকে বিয়ে করতে চান বলছিলে না?

দীপেনের ঠোঁট বেঁকে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাবার চেষ্টা করল। বলল, বিয়ে করতে চাইলেই তো আর সুনীতাদিকে বিয়ে করতে পারবে না। অনেক ব্যাপার আছে। বলে দীপেন খুব গম্ভীর হয়ে উঠল।

সুজিত বলল, তাই নাকি?

দীপেন বলল, তাই বইকী। সুনীতাদি তো আমাকে নিজের মুখেই বলছিল এদের কাউকে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, এদের মানে? আরও কেউ আছেন নাকি?

–নেই? দীপেন একেবারে চোখ কপালে তুলল। সুজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু হেসে উঠল। বলল, ও, আপনি তো সব কথা জানেন না। সুনীতাদিকে বিয়ে করার জন্যে অনেকে রেষারেষি করছে। কুবের সিং, অরূপ দত্ত, রঞ্জন মল্লিক, এরা সবাই। সেই জন্যেই তো সুনীতাদিকে আমার খারাপ লাগে।

-কেন?

–এই যে সকলের সঙ্গেই সুনীতাদির ভাব, সকলের সঙ্গেই মিশবে, কথা বলবে, গাড়িতে করে বেড়াতে যাবে, পাটিতে ড্যান্সে ডিনারে ছুটবে। এ সব আমি দুচোখে দেখতে পারি না।

সুজিত বলল, ও, তোমার সঙ্গে বুঝি সুনীতাদির ভাব আছে?

দীপেনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল কথাগুলি বলতে বলতে। তার অন্তরের গভীরে যে একটা তীব্র ক্ষোভ আছে, তা চোখে-মুখে ফুটে উঠল। বলল, ভাব থাকলে কী হবে। আমার কথা তো শোনে না সুনীতাদি। কলকাতায় কি আর লোক নেই ওরা ছাড়া? ওদের সঙ্গে যে সুনীতাদি কেন মেশে!

সুজিত বলে উঠল, ও, তুমি চাও, খালি শিবেনবাবুর সঙ্গে যেন মেশে, না?

–দাদার সঙ্গে? দীপেনের ঠোঁট আবার বেঁকে উঠল। ঠোঁট তার এমনিতেও যেন প্রায় সবসময় বেঁকেই থাকে। যেন এই বিশ্ব সংসারের প্রতি তার নিয়ত বিদ্রূপ এবং বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ছে। বলল, দাদা কি ওই অরূপ দত্ত, কুবের সিং, রঞ্জনদের চেয়ে ভাল নাকি? আপনি জানেন না, দাদা তো আগে ভেবেছিল, বীরেন রায়চৌধুরীর মেয়ে দোলাকে বিয়ে করবে। সেখান থেকে ধাক্কা খেয়ে আরও অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছে। সুবিধে করতে পারেনি।

মুহূর্তে সুজিতের চোখের সামনে দোলা আর শিবেনের ব্যবহারটা মনে পড়ে গেল। আর সমস্ত কুয়াশা কেটে গিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল।

দীপেন আবার বলল, আসলে দাদা কী চায় জানেন তো? টাকা। যেখানে বিয়ে করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে, সেখানেই দাদা বিয়ে করবে।

দীপেনের মুখ থেকে এবংবিধ কথা শুনতে সংকোচ ও লজ্জা হচ্ছিল সুজিতের। কিন্তু সে জানে, দীপেন একটা পরিবেশের মধ্যে থেকে এ সব জেনেছে, শিখেছে এবং বলতেও অভ্যস্ত হয়েছে। সহসা তাকে পরিবর্তন করা যায় না। সে বলল, কিন্তু সুনীতাদির কি মেলাই টাকা আছে?

দীপেন বলল, আগে ছিল না। কিন্তু এখন তো সুনীতাদি অনেক টাকা পাবে। ওই যে প্রিয়নাথ দাশ বলে লোকটা আছে, যার কাছে সুনীতাদি ছিল, সে অনেক টাকা দেবে সুনীতাদিকে। প্রায় এক লাখ টাকার মতো।

-কেন?

দীপেন যেন একটু থতিয়ে গেল। হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না। মুখখানি তার শুকিয়ে কালো হয়ে উঠল। ভ্রূ কুঁচকে, ঠোঁট বেঁকিয়ে, হাত নেড়ে বলল, কী জানি, কেন টাকা দেবে তা জানি না। তবে দেবে শুনেছি। অথচ সুনীতাদি লোকটাকে এত ঘেন্না করে, বলবার নয়।

কাকে?

–ওই প্রিয়নাথ দাশটাকে। সুনীতাদির বাবা যে কেন মরবার সময় ওই লোকটার হাতে সুনীতাদিকে দিয়ে গেছল বুঝতে পারি না।

একটু থেমে দীপেন যেন খানিকটা আত্মগতভাবেই ফুঁসে উঠল, একটা শয়তান। ওর জন্যেই সুনীতাদির এত দুর্নাম। আর এখন সুনীতাদিকে ভাগিয়ে, তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে বলে, টাকাটা দিতে চাইছে।

গত রাত্রের ট্রেনের কথাগুলি সুজিতের মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তোমার সুনীতাদি প্রিয়নাথ দাশকে বিয়ে করবে ভেবেছিল বুঝি?

স্ফুরিত ঘৃণায় অদ্ভুত দেখাল দীপেনের মুখ। তীব্র ক্ষোভে উচ্চারণ করল, ওই লোকটাকে? ওই লোকটাকে সুনীতাদি গাড়ল বলে।

সুজিত কয়েক মুহূর্ত দীপেনের ঘৃণা-প্রজ্বলিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই সময়ে বিশু চা দিয়ে গেল। সুজিত চা খেতে খেতে আবার কথা না বলে পারল না। দীপেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন টাকা দেবে, তুমি তো জান, তবে বলতে চাইছিলে না কেন দীপু?

দীপেন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে নিচু স্বরে বললে, সুনীতাদির বিষয়ে কোনও খারাপ কথা বলতে আমার লজ্জা করে।

-তাই নাকি?

–হ্যাঁ, কষ্ট হয়।

সুজিত কাপে মুখ নামাতে গিয়ে থমকে গেল। দেখল, দীপেনের গম্ভীর কিশোর-মুখের সমস্ত রুক্ষতা ছাপিয়ে একটি ব্যথা ফুটে উঠেছে। আর সেই ব্যথাটা সুজিতের বুকেও যেন বিদ্ধ হল। সে বলল, আচ্ছা দীপু, তোমার সুনীতাদি যখন প্রিয়নাথ দাশকে বিয়ে করতেই চায় না, গাড়ল না কী সব বলে বলছিলে, অথচ এই লোকটার জন্যেই যখন ওঁর দুর্নাম, তখন লোকটার কাছ থেকে টাকা নিতে তুমি বারণ করছ না কেন?

দীপেন যেন আবার একটু উৎসাহিত হল। বলল, বারণ তো করেছি, সুনীতাদি যে শোনে না। বলে, তুই জানিস না দীপু, এই লোকগুলোকে সাজা দিতে হলে ওদের টাকার ওপরে ঘা দিতে হয়। ওরা মনে করে, মানুষ কিছু নয়, যা করে টাকাই সব করে, টাকার শোকই ওদের বেশি। ওদের সুনামে দুর্নামে কোনও ভয় নেই, টাকাকেই ভয়। সুনীতাদির কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না।

সুজিত অবাক হয়ে কথাগুলি শুনল। সুনীতার সেই তীব্র বিদ্রুপে জ্বলন্ত, শ্লেষের ছুরি-বিদ্ধ মুখখানি চোখের ওপর ভাসতে লাগল। এ কেমন প্রতিশোধ, সে ঠিক বোঝে না। কিন্তু একটা অন্ধ অসহায় আক্রোশে যে সুনীতা জ্বলছে, তা সে বুঝতে পারে। সে আবার বলল, দীপু, যে লোকগুলোর কথা তুমি বলছিলে, যারা খারাপ, তাদের সঙ্গে তোমার সুনীতাদিকে মিশতে বারণ কর না কেন?

দীপেন বলল, অনেক বার বারণ করেছি, সুনীতাদি শোনে না!

বলে মুখ নামাতে গিয়ে, আবার বলল, কেন যে শোনে না, তা আমি জানি।

-কেন?

–ওই যে প্রিয়নাথ দাশ, ওর কাছ থেকে সুনীতাদির এত দুর্নাম হয়েছে যে, সমাজের কেউ। সুনীতাদির সঙ্গে আর মেশে না। সবাই ওকে–ওকে–

দীপেনের বলতে দ্বিধা হল। কিন্তু সুজিতের মনে পড়ে গেল গত রাত্রে ট্রেনে সুনীতার তীব্র উত্তেজিত কথাগুলি। সে বলল, বুঝেছি দীপু।

দীপেন ঘাড় কাত করে সুজিতের দিকে চেয়ে বলল, বুঝেছেন তো? আর সমাজের অনেক বড় বড় লোকেরাই তো সুনীতাদির সঙ্গে আড়ালে আড়ালে ভাব জমাতে চায়। ওই যে কুবের সিং, অরূপ দত্ত, ওরা তো সব সমাজের খুব উঁচু লোক, যাকে বলে কোটিপতি। সুনীতাদির নামে ওরাই দুর্নাম রটায়, আবার ওরাই সুনীতাদির সঙ্গে ভাব করার জন্য নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে। সুনীতাদিকে অনেক জিনিস প্রেজেন্ট করে। আর সুনীতাদি আমাকে যখন এ সব বলে, তখন ঘরের মধ্যে হাততালি দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, দীপু, এই জন্তুগুলোর খেলা আমার বেশ লাগে!

সুজিত অবাক হয়ে বলে, তোমাকে বলে?

দীপেন সরলভাবেই বলল, তবে আর কাকে বলবে? কিন্তু জানেন, সুনীতাদি যখন হেসে ওরকম বলে, তখন আমার কী রকম একটা ভয় ভয় করে। মনে হয়, সুনীতাদি পাগল হয়ে যাবে।

সুজিতের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ঠিক এই কথাটা তারও এই মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল। সুনীতার সমস্ত অসহায় রূপটা যেন তার কাছে আরও স্পষ্ট ও নিষ্ঠুর হয়ে ফুটে উঠল। সুনীতা সকলের মুখের ওপর তীব্র হেসে যতই বিদ্রূপ করুক, সুজিত দেখতে পাচ্ছে, সুনীতার সর্বাঙ্গে শিকলের বেষ্টনী। তার কড়া ধরে সবাই টানাটানি করছে। এক দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। স্টেশনে বিদায় মুহূর্তের সেই বিস্ময়-চকিত ব্যাকুল চোখ দুটি আবার দেখতে পেল সুজিত। শুনতে পেল, শুনুন।…যেন ডাক শুনেই সুজিত যেন হঠাৎ বাইরের দিকে ফিরে তাকাল।

বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘরের অন্ধকার আরও ভারী। দীপেন তাড়াতাড়ি দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে আলোর সুইচটা টিপে দিল। ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। সুজিত ফিরে তাকাল দীপেনের দিকে। দীপেনও তাকিয়ে ছিল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছেন আপনি?

সুজিত বলল, তোমার সুনীতাদি বড় দুঃখী দীপু।

দীপেন অবাক হয়ে বলল, আপনি বুঝতে পারেন।

–পারি।

দীপেন হঠাৎ উত্তেজিত অথচ করুণ সুরে বলে উঠল, উঃ, একদিন সুনীতাদি এত কেঁদেছিল আমার সামনে! আমার ভয় হয়েছিল সেই কান্না দেখে। কেন যে কেঁদেছিল, কিছুই জানি না। খালি বার বার বলেছিল, কেন যে জন্মেছিলাম এ সংসারে। কেন যে জন্মেছিলাম।…

বলতে বলতে, দীপেনের চোখ দুটিই আরক্ত হয়ে উঠল। গলার স্বর নিচু হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না কেউ। টেবিলের ওপরে রাখা সুনীতার স্কেচটার দিকে সুজিত অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।

দীপেন সহসা দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, আমি মাকে একটিবার দেখে আসি, আপনি বসুন।

সুজিত আস্তে আস্তে সুনীতার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, আশ্চর্য, এর সঙ্গে আমার জীবনের কোথাও কোনও যোগাযোগ নেই। তবু এর কথা আমি ভুলতে পারছি না।

আবার দীপেন এল। বলল, জানেন, আজ আমার পড়তে বসতে একদম ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, খালি আপনার সঙ্গে কথা বলি।

সুজিত বলল, তোমার ক্ষতি হবে না তো?

–এক দিন না পড়লে আর কী ক্ষতি হবে।

–তা হলে, বেশ তো, এসো গল্প করি। কিন্তু বাবাকে খুঁজতে যাবে না?

দীপেন বলল, দাঁড়ান, এখুনি গেলে হবে না। আর একটু রাত হোক, তখন বাবাকে ঠিক ধরে নিয়ে আসা যাবে। এখন গেলে বকবে, ধমকাবে, হাত-পা ছুড়বে। বাবার যখন আর গায়ে একদম শক্তি থাকবে না, তখন ধরে নিয়ে আসব। তার আগে, সব হোটেলগুলোতে ফোন করে জেনে নেব, বাবা ঠিক কোথায় আছে। সবাই তো চেনে বাবাকে।

–তাই বুঝি।

দীপেন গিয়ে খাটে বসে পা দোলাতে লাগল। তারপরে হঠাৎ বলল, ও, রঞ্জনের কথাই তো বলিনি।

–কে রঞ্জন?

রঞ্জন মল্লিক। দাদার সঙ্গে এক সময় বন্ধুত্ব ছিল। সেও তো সুনীতাদির জন্যে পাগল। রঞ্জন কিন্তু খুব সাংঘাতিক ছেলে, জানেন?

-তাই নাকি? সে কে?

–খুব বড়লোকের ছেলে, কিন্তু সাংঘাতিক গুণ্ডা। ছেলেবেলা থেকে বখাটে হয়ে গেছল কিনা। ও যা সব গাড়িতে চেপে বেড়ায় না! দারুণ বড় বড় গাড়ি। সবাই বলে, ও নাকি খুনও করতে পারে। ওকে ভয় পায় না, এমন লোক কলকাতায় নেই।

বলো কী?

হ্যাঁ, ও পুলিশ-টুলিশ কাউকে কেয়ার করে না, একেবারে শাহেনশা যাকে বলে। চেহারাটাও দারুণ।

–গুণ্ডার মতো?

না, দেখতে বেশ ভালই। কিন্তু চোখগুলো এমন যে, তাকানো যায় না। ওর সঙ্গে নাকি সবসময় রিভলবার থাকে। এই তো কমাস আগে সুনীতাদিকে বারো হাজার টাকার একটা নেকলেস প্রেজেন্টেশন দিয়েছে।

–তোমার সুনীতাদি নিলেন?

নেয়ানেয়ির কী আছে। রঞ্জন এল, ঘরে ঢুকে নেকলেসটা রেখে বলল, উপহার দিয়ে গেলাম।

ব্যস?

–হ্যাঁ, বেশি কথা বলে না। আর রঞ্জন থাকতে সুনীতাদিকে বোধ হয় কেউ কোনওদিন বিয়ে করতে পারবে না।

কৌতূহলের পর কৌতূহল বেড়েই চলল সুজিতের। বলল, সে কী, বিয়েই করতে পারবে না কেউ?

দীপেন দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, না। ও যে বলেছে, আমি বেঁচে থাকতে সুনীতাকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না।

যদি তোমার সুনীতাদি না করেন?

–সেখানেই তো ও জব্দ। ও বোধ হয় পৃথিবীতে একমাত্র সুনীতাদিকেই কেয়ার করে। ও বলে, সুনীতা নাগ যদি ওর বাড়িতে আমাকে কুকুরের মতো রাখে, আমি তাও থাকব। সারা জীবন আমি তার চাকরের মতো থাকব, আমাকে যা হুকুম করবে, তাই মানব।

সুজিত সহসা কোনও কথা বলতে পারল না। রঞ্জনের কথাগুলি তাকে চমকে দিল, স্তব্ধ করে দিল। এতক্ষণ ধরে যতগুলি লোকের কথা সে শুনেছে, কারুর কথাই এমন বিস্ময়কর, চমকপ্রদ মনে হয়নি। কারুর কথার মধ্যেই যেন ঠিক এই সুরটা বাজেনি। সে জিজ্ঞেস করল, রঞ্জনের এ সব কথা তুমি কেমন করে জানলে দীপু?

দীপেন বলল, সবাই তো জানে এ সব কথা। আর সত্যি কথা বলতে কী, এই রঞ্জনের ভয়েই অনেকে সুনীতাদির কাছে ঘেঁষে না। ওর সব মারাত্মক দলবল আছে। কিন্তু সুনীতাদি তো ওকে একদম ভয় পায় না। ও-ই বরং সুনীতাদিকে ভয় পায়।

ভয় পায়? সে আবার কী রকম?

দীপেন ঠোঁট উলটে বলল, কী রকম তা জানি না। রঞ্জনকে যখন বাইরে দেখি তখন এক রকম, আর সুনীতাদির সামনে যখন দেখি তখন আর এক রকম। অনেকটা ভাল মানুষের মতো।

সুজিত আপন মনেই উচ্চারণ করে, ভাল মানুষের মতো। তারপর হঠাৎ বলল, তোমাদের এই রঞ্জনকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে।

দীপেন বলল, একদিন না একদিন দেখতে পাবেনই, কলকাতায় যখন আছেন। তবে ও এখন খালি ছায়ার মতো সুনীতাদির পেছন পেছন ঘোরে। হয়তো সুনীতাদিও জানতে পারে না, ও কখন পেছনে পেছনে রয়েছে।

সুজিত জিজ্ঞেস করল, রঞ্জনকে তোমার সুনীতাদি ভালবাসেন, না?

দীপেন অভিমত দিল, ওকে আবার কেউ ভালবাসতে পারে নাকি?

এই পর্যন্ত বলেই দীপেন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আপনাকে আমি সুজিতদা বলব।

–নিশ্চয়ই।

দীপেন টেবিলের ওপর থেকে সুনীতার স্কেচটা তুলে নিয়ে বলল, আমাকে এই ছবিটা দেবেন সুজিতদা?

সুজিত এক মুহূর্ত ভেবে ছবিটার দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, হ্যাঁ, তুমি যখন সুনীতাদিকে ভালবাস, তখন ওটা তোমারই হওয়া উচিত!

দীপেনের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, সুনীতাদিকে এটা আমি দেখিয়ে আপনার কথা বলব তো?

–আমার কথা?–সুজিত একটু ভেবে হেসে বলল, বলো, কিন্তু দীপু–কথাটা শেষ হল না। কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। দীপেনের প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, দাদা এসে পড়ল নাকি এর মধ্যে?

পরমুহূর্তেই শঙ্কা ফুটে উঠল তার মুখে। বলল, বাবার কোনও অ্যাকসিডেন্টের খবর-টবর আসেনি তো?

বলেই সে ছুট দিল। তার পিছনে পিছনে সুজিতও এগিয়ে গেল। বারন্দা দিয়ে এগিয়ে, উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে সে দেখল, দীপেন সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার নীচের দিকে। সুজিত সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যাবার আগেই শুনতে পেল, ভুজঙ্গভূষণের গলা। উনি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছিলেন, বড় রায় নেই? খুব ভাল কথা। এখন সে আমার সামনে থাকলে অনেক সত্যি কথা তাকে শুনতে হত। কারণ এখন আমি আর তাকে ভয় পাই না।…আর দীপু রায় কোথায়, আমার চোদ্দোপুরুষের শাসক মহাশয়, ভুজঙ্গভূষণের বাপ।

বলতে বলতে সিঁড়ির উচ্চতম ধাপে উঠেই, প্রায় দীপেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পিছনে চাকর বিশু।

ভুজঙ্গ বললেন, কে? অ, দীপু। অমন চোখখাবলার মতন তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে খুঁজতে যেতে হয়নি, আজ তো আমি অনেক তাড়াতাড়ি ফিরেছি বাপু।

দীপেন এক পাও সরল না। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ভুজঙ্গভূষণ টলছিলেন। চোখ তাঁর আধবোজা। তিনি দীপেনের বুকের ওপর একটা হাত রেখে বললেন, সর, আমাকে যেতে দে।

দীপেন তৎক্ষণাৎ বুকের ওপর থেকে বাবার হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল। দিয়ে সরে দাঁড়াল।

ভুজঙ্গভূষণের মাথাটা ঝুলে পড়ল। বললেন, রাগ করেছিস। ওই যে সেই ছেলেটার টাকা নিয়ে গেছি বলে, না? কিন্তু আমি সব টাকা খরচ করিনি, সত্যি বলছি। এমনকী অনেক খেয়ে রাস্তায় পড়েও থাকিনি, দ্যাখ, কেমন তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি।

দীপেনের কিশোর মুখটি রাগে দপ দপ করছিল। ফুঁসে উঠে বলল, কেন আপনি পরের টাকা নিয়েছিলেন?

ভুজঙ্গভূষণ আবার দীপেনের কাঁধে হাত দিলেন, বললেন, আমার আর আপন পরের কী আছে রে? আমি বেঁচে আছি না মরে আছি, তাই বুঝতে পারি না। এখন কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি মানে যার টাকা নিয়েছিলাম, সে কি রাগ করে চলে গেছে না আছে?

দীপেন বলল, তার খোঁজে আর আপনার এখন কী হবে?

ভুজঙ্গভূষণ গলার স্বর নামিয়ে বললেন, না, ওর খোঁজটা চাই। ছেলেটা এত বোকা যে, ওর সব টাকাগুলো খরচ করে ফেলতে আমার মায়া হল। ও আমার থেকেও বেচারি।

দীপেন সুজিতের দিকে তাকাল। সুজিতও তাকাল ওর দিকে আর ঠিক সেই সময়েই ভুজঙ্গভূষণ দীপেনের মুখের দিকে তাকালেন, এবং তার দৃষ্টি অনুসরণ করে, মুখ ফিরিয়ে বারান্দার একপাশে সুজিতকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত ঢুকিয়ে, খুবই গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, এই যে সুজিতনাথবাবু, আমি খুবই লজ্জিত যে আপনার টাকাটা ফেরত দিতে দেরি হল।

কাছে এগিয়ে এসে পকেট থেকে হাত বের করে কতকগুলো নোট বাড়িয়ে ধরে বললেন, নিন, আপনার টাকাটা দয়া করে নিন। অবিশ্যি আপনাকে আমি বলেছিলাম দশ-পনেরো টাকার দরকার, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ টাকা খরচ করে ফেলেছি। আপনি কিছু মনে করছেন না তো?

সুজিত হেসে বলল, মনে করব কেন? আপনার দরকার হয়েছে, তাই খরচা করছেন। দরকার হলে ওটাও আপনি খরচ করতে পারেন।

–পারি? যেন বিস্ময়েই কয়েকটা হেঁচকি তুলে, টাকাটা পকেটে ঢোকাবার উদ্যোগ করে ভুজঙ্গ বললেন, আপনার হৃদয়টি, সত্যি বলতে কী–

কথা শেষ করবার আগেই তীক্ষ্ণ গলায় ডাক শোনা গেল, বাবা!

ভুজঙ্গ চমকে উঠে বললেন, কে?বলেই পকেটে টাকাটা না ঢুকিয়ে হাতেই রাখলেন, অ্যা, কী বলছ?

কিন্তু ফিরে তাকালেন না। যেন ইতিমধ্যে কিছুই ঘটেনি, এমনভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে চললেন, এই টাকাটা আপনি রাখুন সুজিতনাথ, এটা আমার আর এখন খরচা করবার দরকার নেই। পরে দরকার। হলে, ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছিল আপনার হৃদয় নিয়ে! আপনার হৃদয়টি, সত্যি বলতে কী অনেক নির্বোধের মতো সুন্দর এবং উদার। আজকাল সব এত চালাক হয়ে গেছে, অনেকটা ছুঁচোর মতো, বুঝলেন না, তাদেরকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। কিন্তু আপনি… ।

কথা অতিরিক্ত জড়িয়ে যেতে লাগল ভুজঙ্গভূষণের, মাঝে মাঝে টলে উঠলেন। তবু থামলেন না। বলেই চললেন, আপনি দানবীর। এই প্রসঙ্গেই আমার মনে পড়ছে, আমার এক জমিদার বন্ধু

দীপেন বাধা দিয়ে বলে উঠল, আবার আপনি এ সব গালগল্প আরম্ভ করছেন? বলে সে ভুজঙ্গভূষণের হাত থেকে টাকাগুলি নিয়ে বলল, আপনি এক বার মায়ের কাছে যান না। এ বেলা তো এক বারও যাননি।

হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, সুনয়নীকে এক বারও এবেলা দেখিনি। এক বার দেখে আসি। কিন্তু তুই যে ভাবছিস দীপু আমি মিছে গালগপ্পো বলি, তা মোটেই নয়।

বলে তিনি বাড়ির ভেতর দিকে যেতে গিয়ে, ফিরে আবার বললেন, সুজিতনাথবাবু আপনিও আসতে পারেন আমার সঙ্গে, গৃহকত্রীকে এক বার দেখে যেতে পারেন। তিনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে পারবেন না, কারণ তিনি অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত পঙ্গু যাকে বলে। এই দীপুর জন্মের পর থেকেই, আর আমার অবস্থার অবনতির সময় থেকে, তিনি একেবারেই যাকে বলে, জীবন্তে মৃত। আপনাকে দেখলে, আমার স্ত্রী সুখীই হবেন।

সুজিত দীপেনের দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। দীপেন বলল, যান, মাকে দেখে আসুন। বলে সুজিতের হাতে টাকাগুলি গুঁজে দিল। সুজিত আর এক বার দীপেনের গম্ভীর কিশোর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুজঙ্গভূষণকে অনুসরণ করল। পর পর দুটি ঘর পার হয়ে একটি স্বল্পালোকিত ঘরের দরজায় ভুজঙ্গভূষণ দাঁড়ালেন! সুজিত পাশ দিয়ে দেখতে পেল, পুরনো আমলের একটি উঁচু খাটের ওপর একজন মহিলা শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দরজার দিকে ঈষৎ ফেরানো। মাথার চুল তাঁর বিন্যস্ত আঁচড়ানো, সিঁথিতে সিঁদুর, চোখ সম্পূর্ণ খোলা। অনেকটা দীপেনেরই মুখের ছায়া যেন, অর্থাৎ এই মুখেরই ছাপ রয়েছে দীপেনের মুখে।

ভুজঙ্গভূষণ দরজার চৌকাঠ ধরে ডাকলেন, নয়ন।

সুনয়নীর মুখ ফিরল না, চোখের তারা চকিত হল, ভুজঙ্গের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ভুজঙ্গ এগিয়ে গেলেন। পাছে টলে পড়েন, সেই ভয়ে সাধ্যমতো শক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আস্তে আস্তে গিয়ে, সুনয়নীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মুখোমুখি হলেন। বললেন, কেমন আছ নয়ন?

সেই মুহূর্তেই সুজিতের প্রতি চোখ পড়ল সুনয়নীর। তাঁর মুখ ফেরানো সম্ভব হল না, কিন্তু চোখের তারার আন্দোলনে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। ভুজঙ্গ তা লক্ষ করে বলে উঠলেন, ওঁর নাম সুজিতনাথ, ওঁকে নিয়ে এসেছে শিবেন, বুঝলে? খুব ভাল ছেলে, চমৎকার, একটু বোকাসোকা ধরনের, তা সে ভালই বলতে হবে। এখন থেকে উনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন খাবেন, পেয়িং গেস্ট যাকে বলে।

সুজিতের মনে হল, ভুজঙ্গভূষণ এখন যেন বেশ সহজভাবে কথা বলছেন। কিন্তু সুনয়নীর চোখের তারা সহসা স্থির হয়ে গেল, দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হল, নাসারন্ধ্র স্ফীত ও কুঞ্চিত হল, যদিও মুখের চামড়া একটুও কাঁপল না। ভুজঙ্গও সহসা অসহায়ভাবে বলে উঠলেন, হ্যাঁ নয়ন, আজ আমি মদ খেয়েছি, রাগ করো না। বুঝতে পেরেছি, তুমি সব কথাই শুনেছ, কিন্তু তুমি এঁকে জিজ্ঞেস কর, ইনি রাগ করেননি, ইনি অত্যন্ত উদার প্রাণ। নয়ন, নয়ন! লক্ষ্মীটি, আমার দিকে ফিরে তাকাও। নয়ন, আমার যে ইচ্ছে হয়, আমি সব সময় অচৈতন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি, আমাকে যেন আর কিছুই চোখ চেয়ে, মন দিয়ে দেখতে না হয়। কিন্তু অনেক মদ খেয়েও তা পারি না। নয়ন!

ভুজঙ্গ তাঁর কম্পিত একটি হাত সুনয়নীর কপালে রাখলেন। সুনয়নীর চোখ ছাপিয়ে সহসা জল এসে পড়ল। তিনি চোখ বুজলেন। সুজিতের মনে হল, ওর চোখ ফেটেও জল এসে পড়বে।

ভুজঙ্গ বালিশের পাশ থেকে তোয়ালে নিয়ে সুনয়নীর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ পরে সুনয়নী আস্তে আস্তে চোখ খুললেন, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল সুজিতের প্রতি। কয়েকবার চোখের পাতা কেঁপে উঠল তাঁর। ভুজঙ্গ তাড়াতাড়ি সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, কাছে আসুন সুজিতনাথবাবু, নয়ন আপনাকে ডাকছে।

সুজিত তাড়াতাড়ি কাছে এল। ভাবলেশহীন মুখের সেই নিষ্পলক চোখের দিকে তাকাতে এক মুহূর্ত যেন কেমন অস্বস্তি হল, পরমুহূর্তেই সে-ও হাঁটু পেতে বসল। ভুজঙ্গ বলে উঠলেন, আ-হা-হা, আপনি কেন ওরকম করে বসছেন, আপনি

সুজিত বলল, তাতে কী হয়েছে। আমার যে বসতে ইচ্ছে করছে ওঁর কাছে।

সুনয়নীর চোখের তারা কেঁপে উঠল। ভুজঙ্গ বললেন, ও, আচ্ছা আচ্ছা, আপনি বসুন, নয়ন তাই বলছে। নয়ন, ছেলেটি ভালই, কী বলে?

সুনয়নীর চোখ দুটি যেন একটু উজ্জ্বল দেখাল, চোখের তারা কাঁপল। সুজিতের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। সুজিত দেখল, সেই চোখের মধ্যে গভীর স্নেহ যেন উথলে উঠছে। সে যেন দেখতে পেল, সুনয়নী হাসছেন, বলছেন, এসো বাবা, বস, বড় ভাল লাগছে তোমাকে দেখে। আর সে ভাবছে, এ কী মানুষের অসহায় রূপ। ভিতরে যাঁর সকল ভাবের খেলা নানান তরঙ্গে বইছে, বাইরে তিনি প্রস্তরীভূত। যেন শাপগ্ৰস্তা অহল্যা।

সুজিত বলল, আমি এখানে থাকব, সময় পেলেই আপনার কাছে আসব।

সুনয়নীর চোখের তারা নড়ে উঠল। চোখ উজ্জ্বল, আরক্ত হল, এবং আবার জল এল। এবার সুজিতই তোয়ালেটা দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল।

ভুজঙ্গ বলে উঠলেন, অথচ এ সবের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না সুজিতনাথবাবু, জীবনটাকে আমি ভালভাবেই আরম্ভ করেছিলাম। লোকে বলে পাপ করলে সাজা পায়। আমি কী পাপ করেছি, তা জানি না।

সুনয়নীর চোখের তারা ভুজঙ্গের প্রতি নিবদ্ধ হল, এবং নড়াচড়া করল। ভুজঙ্গ বললেন, তা বেশ, কিছুই বলব না। কিন্তু ভাগ্যের একী খেলা।

সুজিত মনে মনে বলল, ভাগ্য এমনি। তার রথের দুই চাকা দুপাশে। একটা সৌভাগ্য, আর একটা দুর্ভাগ্য। এবং ভাগ্য অন্ধ। কোনদিকে তার সৌভাগ্যের চাকাটা পড়ছে, আর কোনদিকে দুর্ভাগ্যের, তা সে নিজেও বোধ হয় জানে না। সুজিত কিছু বলল না। তার শুধু একটি নিশ্বাস পড়ল, এবং সে অসংকোচে সুনয়নীর কপালে একটি হাত রাখল। সুনয়নী এক বার তাকালেন সুজিতের দিকে, তারপর চোখ বুজলেন।

সুজিত বলল, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকুন।

ভুজঙ্গ বললেন, সেটা আমার মনে হচ্ছে বটে, তোমাকে আপনি করে বলার কোনও মানেই হয় না। যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি দেখলাম, নয়ন তোমাকে খুবই ভালভাবে নিয়েছে, মানে কী বলব, ওর ছেলের মতোই। তোমার মতো একটা হাবাগোবা লোকের মধ্যে আমি দেখছি একটা বেশ প্রাণের ব্যাপার আছে। আমি খুবই খুশি হয়েছি তোমার ব্যবহারে—

সুজিত বলে উঠল, আমি বলছিলাম কী, এ টাকাগুলো আপনি রাখুন। তবে বেশি মদ খাবেন না।

ভুজঙ্গ যেন চমকে উঠে বললেন, মানে? তুমি কি বলতে চাও, তোমার টাকার জন্যেই আমি–

-না না, আপনার দরকার, তাই আমি বলছিলাম।

ভুজঙ্গ হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, দীপুকে বলবে না তো।

সুজিত বলল, ও জিজ্ঞেস করলে আমি বলব অবিশ্যি।

ভুজঙ্গ দু-হাত পিছনে সরে গিয়ে, ভ্র জোড়া কুঁচকে বললেন, তার মানে?

তার মানে, আমি আবার মিছে কথা বলতে পারি না কিনা।

–মিছে কথা বলতে পার না!

আজ্ঞে না, মিছে কথা বলতে গেলেই আমার বুক ধড়ফড় করে, মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাব।

ভুজঙ্গ নির্বাক বিস্ময়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, তার মানে তুমি একটা ব্রিলিয়ান্ট কাওয়ার্ড, ভীরু! মিছে কথা বলতে গেলে বুক ধড়ফড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে!

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার সেই রকমই মনে হয়। ছেলেবেলায় দু-একবার চেষ্টা করেছি কিনা, তাইতেই বুঝতে পেরেছি। তার ওপরে আমার নার্ভ খুব খারাপ। মিছে কথা বলবার আগের থেকেই আমার ঘাম হতে থাকে।…তবে আমি দীপুকে বললেও, তাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলব, যাতে সে আপনার ওপর রাগ না করে।

ভুজঙ্গ এক বার দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। তারপর সুজিতের হাত থেকে টাকাগুলো টেনে নিয়েই, কোমরের কষিতে গুঁজে, বলতে আরম্ভ করলেন, হ্যাঁ, তোমাকে যা বলছিলাম

এমন সময় আবার কলিং বেল বেজে উঠল। ভুজঙ্গ থমকে বলে উঠলেন, বড় রায়, এ আর দেখতে হবে না। আমি গিয়ে শুয়ে পড়ছি, তুমি বাইরের ঘরে চলে যাও। খবরদার, টাকার কথা যেন বোলো না।

বলেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। সুজিত হেসে বাইরের ঘরের দিকে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress