দূর বিহারের একটি অঞ্চল – Aparichit
দূর বিহারের একটি অঞ্চল, যেখান থেকে শহর বা রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব বেশ কয়েক মাইল। নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় কুড়ি বছর আগে। দিগন্তবিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর, অদূরেই পাহাড় ও অরণ্য মেশামেশি করে আছে। টাঙ্গা এবং আদ্যিকালের দুটি পুরনো মোটরগাড়ি শহরে যাত্রী বহন করে। দু-একজন ফরেস্ট ঠিকাদারের নিজস্ব গাড়িও আছে। বৈদ্যুতিক আলো এখানে এসে এখনও পৌঁছয়নি। একটি হিন্দি মাইনর স্কুল আছে। ছাত্র পাওয়া যদিও দুরূহ, তবু কোনও রকমে চলে।
মানসিক হাসপাতালের বাড়িটি নাকি কোনকালে কোন এক রাজা তৈরি করিয়েছিলেন। মস্ত বড় বাড়ি, প্রাসাদতুল্য। সিং-দরজাওয়ালা বড় গেট। খোলা গেটের ভিতর দিয়ে সামনে সুদীর্ঘ বাগান। দেখা যায়। তেমন যত্নকৃত বাগান বলতে যা বোঝায়, রংবেরঙের ফুল, সে সব কিছুই নেই। বড় বড় গাছের সংখ্যাই বেশি। ইউকালিপটাস, মেহগিনি, অশোক, জয়ন্তী বা গুলমোহর, এমনি বড় বড় গাছের ছায়ানিবিড়তার মধ্যে ক্যাসলের মতো বাড়িটি দেখা যায়। মাঝখান দিয়ে লাল রাস্তা বাড়ির সামনের বারান্দার সিঁড়ি অবধি চলে গেছে। হয়তো একদা মোরাম বিছানো ছিল। এখন আর বিলাসের সে প্রাচুর্য নেই।
সিংদরজার থামের একপাশে ছোট একটি ট্যাবলেট, তাতে একপাশে বাংলায় ও আর একপাশে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয়। চারপাশে অরণ্যের বিস্তৃতি জায়গাটিকে আরও মনোরম করেছে।
মনে হয়, বাড়িটিতে লোকজনের বাস নেই, এমনই স্তব্ধ নিবিড় শান্ত। কিন্তু একটি ঘরে দুজন বসে ছিলেন। যিনি বয়স্ক, তাঁর উশকো-খুশকো পাতলা চুল, অল্প দাড়ি, চোখে মোটা লেন্সের চশমা। তিনি যেন স্বপ্নের ঘোরে আবেগ-মন্থিত স্বরে কথা বলে চলেছিলেন। তাঁর সামনের সেক্রেটারিয়েট টেবিলটি তেমন গোছানো নয়। টেবিলে একটি টোবাকো পান করবার পাইপ রয়েছে। ভদ্রলোকের গায়ে কোঁচকানো সার্ট, অসংবৃত টাই, প্যান্টটা মোটামুটি ধরনের।
শ্রোতা একজন যুবক, সে অদূরেই একটি বেঞ্চিতে বসে আছে। কোলের ওপর হাত দুটি নিরীহভাবে ন্যস্ত। তার চুলগুলো আঁচড়ানো নেই। কোঁকড়ানো চুল কপালের অনেকখানি ঢেকে রেখেছে। মুখটি মিষ্টি, অনেকটা ছেলেমানুষের মতো। তার মুখের মুগ্ধ হাসি, আয়ত স্বপ্নিল চোখের দৃষ্টি, সবকিছুর মধ্যেই একটি শিশুর সারল্য মাখানো। গায়ে একটি প্রিন্স কোট। দেখলেই বোঝা যায় কোটটি পুরনো। বোতাম আছে, তবু প্রায় সবই ভোলা। স্বভাবতই ভিতরের শার্টটি দেখা যাচ্ছে। শার্টের চেহারাও তথৈবচ। হাতে কাঁচা, কোঁচকানো। প্রিন্স কোটের কলারের পাশ দিয়ে শার্টের এক পাশের কলার এমনভাবে খোঁচা হয়ে বেরিয়ে আছে, যেন একটি গাধার বড় কান। যুবক একটু নড়লে বা ঢোঁক গিললেই কলারটি এমনভাবে নড়ে উঠছে, যেন ঠিক গাধায় কান নাড়ছে। দৃশ্যটা হাসির উদ্রেক করে। শার্টের বোতামগুলোও তার ভাল করে লাগানো নেই। কোটের মতোই কালো রঙের একটি ভাঁজহীন প্যান্ট তার পরনে। একটু বেশি ঢলঢলেই মনে হয়। কিন্তু পায়ে মোজা নেই, অথচ পায়ে দুটি ভেলভেটের পুরনো নাগরা। এত পুরনো হয়েছে যে, অনেকটা ধূলিধূসর দেখাচ্ছে এবং ধারে-ধারে জরি উঠে গেছে, তার ফুপড়ি পর্যন্ত দেখা যায়। ডান পা-টি এমনভাবে বাঁ দিকের প্যান্টের খোলর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মনে হয়, মোজা নেই বলে শীত করছে। কিন্তু দেখলেই হাসি পেয়ে যায়।
ডক্টর ঘোষের আবেগ-মন্থিত কথা শেষ হয়ে আসার শেষেই, এ সব বিশেষ করে লক্ষে পড়ে। ডক্টর ঘোষই এই আশ্রমের একমাত্র ডাক্তার, আশ্রমটি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত। ঘরটি প্রায় আসবাবপত্রহীন। দেয়ালে একটি ক্যালেন্ডার ছাড়া বড় একটি বুদ্ধের শুধু মুখচ্ছবি। সেই মুখে করুণ মধুর হাসি, নিমীলিত চক্ষু, তবু চোখের তারা দুটি ঈষৎ দেখা যায়।
তিনি বলে চলেছিলেন, …তাই, আমার সব আবেদন তাই মানুষের কাছে। বুঝলে সুজিতনাথ, মানুষ, মানুষ, মানুষকে মানুষই সব দিতে পারে, বিশ্বসংসারে এই যে এত উন্মাদ, মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লোক দেখছ, এ সব কিছুই ঘটতে পারে না, যদি মানুষ আর একটু কম নিষ্ঠুর হত, কম স্বার্থপর হত। একটু…কী বলব, আর একটু সহজ, আর একটু স্নেহ-ভালবাসা প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক, আর একটু গভীর, নিবিড় করে নিয়ে দেখা, সেটাই সবথেকে বড় মহৌষধ। আমি আমার সারাটা জীবন ভরে এই অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করেছি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কী বলে আমি জানি না, জানতেও চাই না। জীবনে যে আমার প্রথম রুগি, যাকে দেখে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম…।
এই পর্যন্ত বলে, টেবিলের একপাশে একটি ফটোগ্রাফের দিকে তাকান। দু পাশের ঘন চুলের মাঝখানে ফুলের মতো নিষ্পাপ একটি পবিত্র মেয়ের মুখ। কথা বলতে বলতে সহসা ডক্টর ঘোষের গলা করুণ আর স্বপ্নাচ্ছন্ন শোনায়, কণ্ঠস্বর নেমে যায়। আবার বলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষের মনের অসুখ সারানোই হবে আমার জীবনের ব্রত। দেখেছিলাম, সংসারের কী ভয়াবহ নিষ্ঠুর পীড়ন তাকে একেবারে উন্মাদ করে দিয়েছে। আঃ, তার অপরাধ, সে শুধু ভালবেসেছিল…। তার মনকে আমি সুস্থও করে তুলেছিলাম, কিন্তু তার মৃত্যুকে আমি ঠেকাতে পারিনি… ।
ডক্টর ঘোষের কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। যুবকটির করুণ মুগ্ধ দৃষ্টি টেবিলের ছবির দিকে। কোন গহ্বর থেকে যেন ডক্টর ঘোষের গলা আবার ভেসে উঠল, এই আমার প্রথম রুগি, আর তুমি, সুজিত, তুমি আজ আমার শেষ রুগি।
সুজিত ফিরে তাকায় ডক্টরের দিকে। ডক্টর বলেন, তোমাকে ছ বছর ধরে চিকিৎসা করছি আমি, তোমার বেলাতেও আমি দেখলাম, ছেলেবেলা থেকে তুমি কী নিষ্ঠুর নির্দয় স্নেহ-ভালবাসাহীন অবস্থায় কাটিয়েছ, যা তোমার মস্তিষ্কের মনের সমস্ত ভারসাম্য পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছিল। আমার সৌভাগ্য, তোমারও সৌভাগ্য এখন তুমি ভাল হয়ে গেছ। এবার তোমার সংসারের পথে যাত্রা শুরু।
হঠাৎ ঢং ঢং করে ঘড়িতে চারটে বেজে উঠল। ঘণ্টার শব্দের মধ্যেই ডক্টর যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, চারটে? তোমার তো আর দেরি করার উপায় নেই সুজিত। সব গুছিয়ে নিয়েছ তোমার?
সুজিতও যেন খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠল। বেঞ্চির একপাশ থেকে সামান্য একটি পুঁটলি সে হাতে তুলে নিল। ডক্টর ঘোষ তাকে দেখলেন। পায়ের দিকে, প্যান্টের খোলের মধ্যে নাগরাসুদ্ধ একটা পা ঢোকানো দেখে, স্নেহ-করুণ সুরে বললেন, শীত করছে, না?
সুজিত সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।
ডাক্তার আবার তার পুঁটলি ও পোশাক দেখলেন। বললেন, এ আশ্রমে এমন একটা বিছানা বা সুটকেসও নেই যে তোমাকে দিই। আশ্রমের ঋণ অনেক, তাই সবাই…।
সুজিতের শার্টের কলার নড়ে উঠল, তার সহজ হাসিটা একটু যেন বোকাটে দেখায়। বলল, এই তো বেশ আছে।
ডাক্তারের দৃষ্টি করুণ ও চিন্তান্বিত। বললেন, বেশ ছাড়া উপায়ই বা কী। তোমাকে যিনি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছিলেন, সেই প্রতাপনারায়ণ সিংহ মশায়ের এক বছর ধরে কোনও চিঠি পাইনি, তোমার চিকিৎসার জন্যে কোনও টাকাও এক বছর পাঠাননি। ওঁর কোনও ঠিকানাও জানি না। আট-ন বছর তিনি নানান জায়গা থেকে টাকা আর চিঠি পাঠাতেন। তিনি যে তোমার কে, তুমিও জান না, আমিও জানি না। শুধু এইটুকু জানি, তুমি নাকি পিতৃমাতৃহীন, ওঁর আশ্রিত ছিলে। তোমাকে চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে বর্ধমানের এক গ্রাম থেকে নিয়ে উনি প্রথম পাটনায় যান। তখন থেকেই তোমার মধ্যে অদ্ভুত সব পাগলামির লক্ষ্মণ দেখা দেয়, হয় হাস, নয় মনমরা হয়ে বসে থাক। লেখাপড়া মাথায় কিছুই ঢোকে না। তোমার ষোলো বছর বয়সে আমার কাছে দিয়ে যান। কিন্তু আশ্চর্য। তোমার মধ্যে আমি প্রথমেই আবিষ্কার করলাম একটি অসহায় দুঃখী, কিন্তু বুদ্ধিমান সহৃদয় ছেলে।
সুজিত লজ্জিত হয়ে এমনভাবে হাসে, মনে হয় সে একটু যেন বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। সে মাথা চুলকোয় এবং বুকের কাছে আঙুল দিয়ে খসখসিয়ে দেয়। আসলে এটাই তার লজ্জা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গি। ওইভাবে হাসি হাসি মুখ নিয়েই পকেট থেকে সে হঠাৎ একটি ফটো বের করে ডাক্তারের সামনে মেলে ধরে। এবং তার মুখ কৌতূহলিত ও চোখ দুটি বড় বড় হয়ে ওঠে।
ডাক্তার বলে ওঠেন, ও হ্যাঁ, এই তো প্রতাপনারায়ণবাবুর ফটো। এটা তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?
সুজিত ঘাড় নাড়ে। ডাক্তার আবার বলেন, দেখো তো, এটার পিছনেই কলকাতার একটা ঠিকানা আছে। সেটা আমার কাছেও লেখা রয়েছে বলে আমি তোমাকে আপাতত কলকাতা যাবার টিকিটই কেটে দিয়েছি। হয়তো এ ঠিকানায় গেলে তুমি আপনার লোকজনের বা বাড়ি-ঘরের একটা সন্ধান পাবে।
সুজিত ফটোটা উলটে ধরে। পিছনে লেখা আছে, শ্ৰীবীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, ১৯, অলিভ রোড, কলিকাতা। ঠিকানাটা দেখতে দেখতে ডাক্তার বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ঠিকানা। আচ্ছা, তোমার বাবার নামটাও তো আমার পেশেন্ট বুকে–
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই সুজিত বলে ওঠে, ঈশ্বর অতীন্দ্রনারায়ণ মিত্র।
–ইয়েস ইয়েস, দ্যাটস্ অলরাইট। দেখ এখন কলকাতায় গিয়ে কী হয়। আমিও কাল সকালেই এ আশ্রম ছেড়ে যাব।
সুজিত করুণ সহজ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?
ডাক্তার হঠাৎ সুজিতের কাঁধে হাত দেন। দূরের দিকে তাকিয়ে বলেন, তা তো জানি না সুজিত। অনেক ছেলেমেয়ের চিকিৎসা করেছি, এখন ক্লান্তি বোধ করছি। এবার আমার ছুটি। দেখি, কোথায় ভাগ্য টেনে নিয়ে যায়।
একটু স্তব্ধতা। একটি লোক ঘরে প্রবেশ করে জানায়, টাঙ্গা আগ্যয়া বাবুজি।
ডাক্তারই প্রথম চমকে ওঠেন, বলেন, এসে গেছে? চলো চলো সুজিত, আর দেরি নয়, ছটায় তোমার গাড়ি, রাস্তা অনেকখানি। কিন্তু তোমার টিকেট ঠিক আছে তো? দেখো, পকেটে রেখেছ কি না।
সুজিত পকেটে হাত দিয়ে, বার্থ রিজার্ভেশন স্লিপসহ টিকেটটা দেখায়। ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, তোমার ফার্স্ট ক্লাস বার্থ রিজার্ভ আছে। তোমাকে সারাটা পথ হয়তো দাঁড়িয়ে যেতে হবে, তাই ফার্স্ট ক্লাসের টিকেটই কাটতে দিয়েছিলাম। এইটুকুনি আমার শেষ অবদান। আর টাকাটা কোথায় রেখেছ?
সুজিত পকেট থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে। ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, ওই টাকা দিয়েই টাঙ্গা-ভাড়া আর পথের খরচ চালিয়ে নিয়ো। আর ভবিষ্যতে যদি তোমার কোনও চিঠিপত্র আসে, সে-সব অলিভ রোডের ঠিকানাতেই পাঠানো হবে। এখানে আমি সে ঠিকানা রেখে দিয়েছি, এখন চলো।
সুজিত ঘাড় নেড়ে ডাক্তার ঘোষকে অনুসরণ করে। হাতে সেই পুঁটলি। বাইরে এসে, টাঙ্গায় ওঠবার আগে সুজিত থমকে দাঁড়ায়। সহসা এক পা পেছিয়ে এসে, নির্বাক শিশুর করুণ চোখে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়, এবং নিচু হয়ে ডাক্তারকে প্রণাম করে। ডাক্তার তাকে তাড়াতাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরেন। ডাক্তারও আবেগ-কম্পিত হয়ে ওঠেন, থাক থাক।
ডাক্তারের মুখ উজ্জ্বল কিন্তু করুণ। সুজিত ডাক্তারের কাছ থেকে সরে, অবাঙালি চাকরটির হাত চেপে ধরে নাড়া দিল একবার। চাকরটি এই আশাতীত প্রীতিতে সুজিতের হাত মুঠো করে ধরে…
.টাঙ্গা ছুটেছে বিহারের উঁচু-নিচু রুক্ষ অঞ্চলের ওপর দিয়ে। টাঙ্গা বেশ দ্রুতগামী। প্রায় এক ঘণ্টা ছুটে টাঙ্গা রেলস্টেশনে এসে দাঁড়াল। সুজিত পকেটে হাত দিয়ে দশ টাকার নোটটি বের করে। কিন্তু টাঙ্গাওয়ালা জানাল, তার ভাড়া মিটে গিয়েছে আগেই।
সুজিতের দিকে অ্যাটেনড্যান্ট টিকেট-কলেক্টর অবাক হয়ে তাকায়। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট সামনেই। গাড়ির গায়ে, কার্ডে প্রথম নামটা লেখা রয়েছে, মিঃ সুজিতনাথ মিত্র। লোয়ার বার্থ, টিকেট নং…। কার্ডে আরও দুটি নাম লেখা ছিল। সুজিত পড়ে নিয়েছে, মিঃ পি. দাশ ও মিস সুনীতা নাগ। অ্যাটেনড্যান্ট টিকেট-কলেক্টর সুজিতের টিকেটটা আবার দেখে, সুজিতকে আপাদমস্তক এক বার দেখল। সুজিতের শার্টের কলার নড়ে উঠল। পুঁটলিটা এক হাত থেকে আর এক হাতে গেল, এবং একটু হাসল।
অ্যাটেনড্যান্ট বলল, আপনিই মিঃ মিত্র?
সুজিত ঘাড় নাড়ল। অ্যাটেনড্যান্ট চাবি দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের দরজা খুলে ধরল। সুজিত ভিতরে ঢুকে গেল। অ্যাটেনড্যান্ট অদ্ভুতভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। সে অবাক হয়েছে।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে যে এক্সপ্রেস গাড়িটা আসবে এই বগিগুলো তার সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হবে।
সুজিত সুন্দর কামরাটি দেখল। ওপরে নীচে চারটি বার্থ। আয়নায় মুখটাও দেখল। তার সঙ্গে গোটা কামরাটা বেমানান। সে এক বার নিজের দিকে তাকাল এবং অসহায়ভাবে একটু ঘাড় নাড়ল।
গাড়ি চলেছে। সুজিতকে দেখা গেল সে চিত হয়ে নীচের বার্থে শুয়ে আছে। পুঁটলিটি মাথায়। সে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছিল বাকি দুজন যাত্রী উঠল না কেন!
.গাড়ি একটা বড় স্টেশনে ঢুকল। ঘড়িতে রাত্রি নটা দেখা গেল। সুজিত শুয়েই আছে। কাঁচের জানালা দিয়ে সে বাইরের দিকে দেখছে। ওয়ার্নিং ঘণ্টা বেজে গেল। একটু পরেই দরজায় দমাদম ঘা পড়তে লাগল। সুজিত দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে আগে একটি মেয়ে ঢুকল। পিছনে পিছনে একজন পুরুষ। তাদের পিছনে বেডিংসহ সুদৃশ্য সুটকেস নিয়ে কুলি। আরও একজন কুলি আরও ট্রাঙ্ক-সুটকেস নিয়ে ধড়াধড় ঢেলে দিল। তার আড়ালে প্রায় জবুথবু সুজিত চাপা পড়ে যাবার মতো। সে প্রায় হাঁ করে যাত্রী ও যাত্রিণীকে দেখছে।
যাত্রিণীটি অপূর্ব সুন্দরী শুধু নয়, রূপের একটি ধারালো ঝিলিক বলা যায়। বয়স অনুমান বাইশ-চব্বিশ। পোপাশাকের দিক থেকে অত্যাধুনিকাই বলতে হবে। কান ঢাকা চুল বাঁধার ভঙ্গিটা অপূর্ব, তবু এক গুচ্ছ চুল ভুরুর ওপর দিয়ে গালের ওপর এসে পড়েছে। লাল রং-এর একটি লেডিজ কোট গায়ের ওপর শুধু ফেলা রয়েছে। হাতে ব্যাগ। আপাতদৃষ্টিতে বেশেবাসে চেহারায় একটি রুক্ষতা আছে। তাকে মনে হচ্ছে চঞ্চল অস্থির। তার আয়ত চোখ দুটিতেও একটি অদ্ভুত তীব্রতা। তবু ভাল করে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, কোথায় যেন একটি অসহায় বিষণ্ণতাও রয়েছে। হয়তো তার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়া, চুলের গুছিটি সরিয়ে দিয়ে এক মুহূর্ত বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে সেটা সুজিতের মনে হয়। তারপরেই মেয়েটি জিনিসপত্রের দিকে এক বার তাকায়।
সঙ্গী ভদ্রলোকটির বয়স নিশ্চয় চল্লিশোধেঁ। গোঁফ আছে, জুলফির কাছে বেশ পাক ধরেছে চুলে। ভারী গম্ভীর আর অভিজাত বলেই মনে হয়। একেবারে পুরোপুরি বিদেশি কায়দায় বিলাতি স্যুট অঙ্গে। মাথায় ফেল্ট-এর টুপি। টুপিটা তিনি খুললেন। এরা ঢুকতেই কামরার মধ্যে এক ঝলক সুগন্ধও ছড়িয়ে পড়ল।
ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে পকেটে হাত দিলেন কুলিদের পয়সা দেবার জন্যে। তার আগেই মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে একটি টাকা বের করে কুলির হাতে দিয়ে দিল। ঘণ্টা বাজল, হুইও শোনা গেল। ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, আমিই তো দিচ্ছিলাম।
মেয়েটি কোনও জবাব না দিয়ে যেন জিনিসপত্রগুলো দেখতেই ব্যস্ত হল। এমন সময়ে একজন টি টি আই ঢুকে বিগলিত হেসে বলল, সব ঠিক আছে তো স্যার?
ভদ্রলোক–হ্যাঁ, সব, সব।
টি টি আই–্যাক, গাড়িটা যে ধরতে পেরেছেন—
বলতে বলতেই টি টি-র নজরে পড়ল সুজিতকে, মালপত্রের আড়ালে যাকে অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার বোতাম-খোলা কোট, কোঁচকানো শার্ট, উশকো-খুশকো চুল, এবং কোনও মালপত্র না দেখে হঠাৎ টি টি হুমকে উঠল, আপনি কে? এখানে কী করছেন? আপনি কি এ কম্পার্টমেন্টের প্যাসেঞ্জার?
যেন এ কথা শুনে, এই প্রথম যাত্রী ও যাত্রিণীর নজর পড়ল সুজিতের ওপর। সুজিত ঘাড় নেড়ে নীরবে জানাল, হ্যাঁ?
–দেখি, আপনার টিকেটটা দেখান।
টি টি-র গলায় রীতিমতো সন্দেহ। বাকি দুজনের চোখেও তাই। সুজিত টিকেট দেখাল। টি টি অবাক হয়ে বলল, আপনার মালপত্র কোথায়?
সুজিত পুঁটলিটা হাতে তুলে দেখাল। সকলেই আরও অবাক।
টি টি-ব্যস! কলকাতা অবধি যাবেন, আর এই আপনার?
সুজিত ঘাড় নাড়ল, একটু হাসল। কিন্তু গাড়ি তখন চলতে আরম্ভ করেছে। টি টি তাড়াতাড়ি নামতে নামতে বলল, স্ট্রেঞ্জ!…
সুজিত দেখল, যাত্রী যাত্রিণী দুজনেই তখনও তার দিকে তাকিয়ে। সে মনে মনে ভাবল, ট্রেনের গায়ে কার্ডে লেখা নাম-পরিচয়ের, একজন নিশ্চয় মিঃ, দাশ। আর একজন মিস্ সুনীতা নাগ।
যেন হঠাৎ খেয়াল হতে মিঃ দাশ তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা বন্ধ করলেন। এবং আবার সুজিতের দিকেই ফিরে তাকালেন। তারপরে চোখ ফেরালেন সুনীতার দিকে। কিন্তু সুনীতা দাশকে দেখছিল না। সে সুজিতকেই অবাক হয়ে দেখছিল। তার সুন্দর চঞ্চল অস্থির এবং ধূলিরুক্ষ অপ্রসন্ন মুখে যেন বিদ্যুৎচকিতে একটু হাসি খেলে গেল। সেটা বিদ্রূপ না করুণা কিংবা আর কিছু বোঝা গেল না। হাসিটা এত চকিত মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল, যেন কারুর নজরে পর্যন্ত পড়ে না।
কিন্তু সুজিত বোধ হয় দেখতে পেল, তাই একটা ঢোঁক গিলল বিব্রতভাবে। তার অবস্থাটা করুণ। সে বলল, আপনাদের এই ট্রাঙ্কটা একটু সরাবেন? আমার দুটো পায়ের ওপর পড়েছে কিনা।
মিঃ দাশ–আই সি।
মস্ত বড় ট্রাঙ্ক, তার ওপর বেডিং। মিঃ দাশ যদিও বা কোনও রকমে বেডিংটা ঠেলে একদিকে ফেললেন, ট্রাঙ্কটা তাঁর পক্ষে সরানো সম্ভব হল না। এবং মুখ লাল করে বলে উঠলেন, এটা আপনার পায়ের ওপর পড়ল কী করে?
সুনীতা বলে উঠল, সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে মিঃ দাশ, এখন নিন, ধরুন। বলে সুনীতা হাত দিয়ে ট্রাঙ্ক ধরল। দুজনে কোনও রকমে সরাল। তলায় দেখা গেল সেই নাগরা। হেঁড়েনি, তবে আকৃতি বদলে গেছে। সুজিত তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে পা দুটো একটু টিপল। টিপে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ তুলতেই সুনীতার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সুনীতার চোখে হয়তো একটা জিজ্ঞাসা ছিল। সুজিত তার সেই সরল শিশুর মতো হেসে বলল, লাগেনি।
সুনীতা ঠিক শব্দ করল না, কিন্তু যেন আশ্বস্ত হয়ে ঠোঁট নাড়ল। মিঃ দাশ এ সব দেখছিলেন। তিনি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আচ্ছা, জিনিসপত্রগুলো একটু সাজিয়ে ফেলা যাক, কী বলো সুনীতা?
সুনীতা ফিরতেই তাড়াতাড়ি বললেন, না না, তুমি বসো। আমি বরং বিছানাটা তোমাকে খুলে পেতে দিচ্ছি।
বলে তিনি বিছানাটা খুলতে গেলেন। তাঁর হাতের হিরের আংটি ঝলকে উঠল। কিন্তু বেডিং-এর বেল্ট কিছুতেই খুলতে পারছিলেন না। তাতে উনি বিরক্ত ও লজ্জিত হচ্ছিলেন।
সুজিত বলে উঠল, আমি যদি ওটা খুলে দিই, আপনি কি বিরক্ত হবেন?
মিঃ দাশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালেন। লোকটা তাঁকে বিদ্রূপ করছে কি না বোঝবার জন্যে। বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, তুমি–আই মিন, আপনি খুলে দেবেন?
সুজিত তার কোনও জবাব না দিয়ে বেল্টটা খুলে, একেবারে বিছানা বের করে ফেলল। এবং কিছু বিছানা হাত ভরে তুলে সিটের ওপর রাখল। আর এক বার চোখাচোখি হল সুনীতার সঙ্গে। সুজিত চোখ ফিরিয়ে বললে, এই মালপত্রগুলো কি একটু তুলে দেব?
মিঃ দাশ তাকালেন সুনীতার দিকে। সুনীতার চোখে বিস্ময়-কৌতুক। সুজিতের বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে কৌতুকোচ্ছলে প্রায় হেসেই উঠল সে। বলে উঠল, না না, আর কিছু সরাতে হবে না। একটা তো রাত। আপনি বসুন।
সুজিত ওর জায়গায় গিয়ে বসল। হাত দুটো এক বার দেখল। কিন্তু দুজনেই যে দু রকম ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এটা অনুভব করে সে দুজনের মুখের দিকেই এক বার তাকাল, একটু হাসল। সুনীতা তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে, মোটামুটি বিছানাটা ঠিক করে, বসে পড়ল। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। ওর মুখে আবার গাম্ভীর্য দেখা দিল, একটা বিশেষ উত্তেজনার ছায়াও ফুটে উঠল। ও হঠাৎ দাঁত দিয়ে ঠোঁট দংশন করল।
সুজিত সুনীতার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুজিতের কী মনে হল, কে জানে। ও বহু দিন বাইরের জগতের মানুষের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করেনি। আজকের জীবনটা সেজন্য ওর কাছে অনেকখানি নতুন। ওর চোখে সেই জন্যেই যেন প্রথম ঘুম ভাঙার বিস্ময়। এবং সেই বিস্ময় নিয়েই, সুনীতার দিকে তাকিয়ে, সে যেমন মুগ্ধ হচ্ছে, তেমনি একটা বিষণ্ণতাও তাকে ঘিরে ধরেছে। কেন, তা সে জানে না। অথচ এই প্রথম সে এই মেয়েটিকে দেখছে। পরিচয় একমাত্র সহযাত্রিণী। ওর মনে হতে থাকে, ও যেন এই রূপসী মেয়েটির ভিতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটির ভিতরে যেন একটা বিক্ষোভের ঝড় বইতে দেখছে। অথচ এই ঝড়ের ভিতর দিয়ে আসলে একটি অসহায় বেদনাই যেন মাথা কুটছে। কেন যে এ রকম মনে হচ্ছে, সুজিত নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছে না।
সুনীতা সহসা সচেতন হল, সুজিতের দৃষ্টিটা যেন সে অনুভব করল। সে মুখ ফেরাল না তখুনি, কিন্তু মুখভাব শান্ত হয়ে উঠল, এবং কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ মুখ তুলে সুজিতের দিকে তাকাল। এই তাকানোর মধ্যে দিয়ে দেখা গেল, সুনীতার চোখেও যেন একটি মুগ্ধ বিস্ময়।
সুজিত সচেতন হল, সুনীতা তাকে দেখছে।
এরকম ক্ষেত্রে সুজিতের ওর সেই স্বভাবহাসি হেসে ওঠবার কথা। কিন্তু ওর দৃষ্টি বিষণ্ণ ও গভীর, আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে ও দৃষ্টি নত করল। তারপর যেন খানিকটা অসহায় অস্বস্তিতেই কী করবে ভেবে পেল না। এবং যেন কিছু ভেবে না পেয়েই পুঁটলিটা মাথার দিকে রেখে শুতে গেল।
মিঃ দাশ হাতের সামনে একটা বিলিতি জার্নাল নিয়ে সুজিতকেই লক্ষ করছিলেন। তাকে শোবার উদ্যোগ করতে দেখে বলে উঠলেন, আপনি কি নীচেই শোবেন নাকি?
সুজিত বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসল। মুখখানি বিস্মিত বিব্রত। মিঃ দাশের দিকে তাকিয়ে আপার বার্থের দিকে দেখল। আবার মিঃ দাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ওপরে যাব?
মিঃ দাশ বললেন, আপনার অবিশ্যি লোয়ার বার্থ-ই রিজার্ভ করা আছে। সু
জিত বলল, তাতে কী? আমি ওপরেই যাচ্ছি।
সুনীতা তাকিয়ে ছিল সুজিতের দিকেই। সুজিত ওর পুঁটলিটা একবার আপার বার্থের ডাইনে রাখল, আর একবার বাঁয়ে, আবার ডাইনে। পায়ের নাগরাজোড়া খুলল। আপার বার্থে ওঠার শেকল ধরে আবার বার্থের দিকে তাকাল, শার্টের কলার নড়ে উঠল, এবং লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে, একটা পা বার্থের ওপর তুলে, গোটা শরীরটা নীচের দিকে এমনভাবে ঝুলে পড়ল, সেটা বিপজ্জনকও বটে।
সুনীতার চোখে একই সঙ্গে ভয় ও কৌতুক। মিঃ দাশ বিস্ময় অস্বস্তিতে কী করবেন ঠিক যেন ভেবে পাচ্ছেন না। কিন্তু সুজিত সমগ্র শরীরকে একটা ধাক্কা দিয়ে বার্থের ওপর উঠে গেল। কলার দুটো নড়ে উঠল। সুনীতার একটা নিশ্বাস পড়ল, সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোখ দুটি কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সমস্ত মুখে একটা বিস্ময় কৌতুক ও খুশির আভাস। মিঃ দাশের বিস্মিত মুখে গাম্ভীর্য নেমে এল, ম্যাগাজিনটা আবার তুলে নিলেন মুখের সামনে।
.
গাড়ি চলেছে। সুজিতের চোখ বুজে এসেছিল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমন্ত যেন সে মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছিল। মেয়ে এবং পুরুষের গলার অস্পষ্ট অস্ফুট কথাবার্তা। ওর ঘুমন্ত মুখের ভুরু একটু কোঁচকানো, চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠল। ঠিক সে সময়েই ওর কানে তীরের মতো তীব্র চাপা গলা এসে ঢুকল, আপনি চোখ বুজে থাকলেও, সংসারের সবাই চোখ বুজে নেই। একটু দয়া করে চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখুন তা হলেই বুঝতে পারবেন।
সুজিতের চোখ খুলে গেল। দু চোখে বিস্ময়, চোখের সামনে রেলগাড়ির ছাদ। ওকেই কিছু বলছে নাকি? সে কোথায়? সে কি স্বপ্ন দেখছিল?
পরমুহূর্তেই পুরুষের গম্ভীর গলা তার কানে এল। তোমার কি ধারণা, আমি বাইরের জগতের দিকে চোখ বুজে আছি?
সুজিতের মুখে কুটি-বিস্ময় ফুটে উঠল। কণ্ঠস্বর যেদিক থেকে এল, আড়চোখে সেদিকে দেখবার চেষ্টা করল। যদিও ঘাড় ফেরাল না। সবেমাত্র তার চোখে মিঃ দাশের মুখটি ভেসে উঠেছিল, সেই মুহূর্তেই আবার মেয়ে-গলা শোনা গেল, আমার ধারণা দিয়ে আপনার কী হবে। আপনি নিজেই এক বার ভেবে দেখুন না। সমাজে দুর্নামের দায় আপনি সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন। আপনার দায় নেই? চার বছর ধরে কলকাতার লোকে যখন দুর্নাম রটনা করছিল, আপনি কতটুকু প্রতিবাদ করেছিলেন?
মিঃ দাশের গলায়ও চাপা উত্তেজনা, কার কাছে প্রতিবাদ করব?
সুনীতা–আপনারই বন্ধুবান্ধবের কাছে, আপনাদের কলকাতার হাই সোসাইটির কাছে। ওই সব বহুরূপী সংদের মুখের সামনে আপনি কখনও প্রতিবাদ করে বোঝাতে চেয়েছেন, আপনার আমার সম্পর্ক কী। আপনি তখন ও-রকম একটা গোবেচারা ভাব নিয়ে চুপ করে থাকতেন কেন? যখন দুর্নাম পাকাপাকি রটে গেল, তখন আপনি তাড়াতাড়ি আমাকে মেয়েদের কোনও হোস্টেলে বা বোর্ডিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলেন।
মিঃ দাশ–এ সব তোমার নিজের ধারণা।
সুনীতা–আমার নিজের ধারণা বলেই বুঝি কলকাতার লোকেরা ভাবছে একটা কুমারী মেয়ের সঙ্গে আপনি অবৈধ সম্পর্ক পাতিয়ে বসে আছেন?
মিঃ দাশ–কিন্তু তুমি জান, আমাদের কোনও অবৈধ সম্পর্কই নেই।
সুনীতা–তবু সেটাই আপনাদের সমাজের বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস, আমি আপনার একটা একটা পোষা
উত্তেজনায় কথা আটকে যায় সুনীতার। সুজিতের মাথার ওপরে দুটো আলোই নেভানো। সে তার বড় বড় চোখের কোণ দিয়ে কৌতূহলিত হয়ে দেখল, সুনীতার অপরূপ মুখখানি রাগে এবং অপমানে রক্তাভ, নাসারন্ধ্র স্ফীত।
মিঃ দাশ বলে উঠলেন, সে জন্যে দায়ি তোমারই চালচলন।
সুনীতা–আমার চালচলন?
মিঃ দাশ–নয়? শিবেন রায়, অরূপ দত্ত, কুবের সিংহ, কলকাতার সব নামকরা বাড়ির বাজে ছেলেদের সঙ্গে তুমি দিনে-দুপুরে ফ্লার্ট করে বেড়াচ্ছ, ড্যান্স-ডিনার পার্টিতে যাচ্ছ নাচতে নাচতে, তোমাকে ঘিরে ধরে সবাই প্রেম নিবেদন করছে, আর তুমি মক্ষীরানির মতো…।
সুনীতার বাঁকা ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি দেখা দিল। বলে উঠল, জেলাস?
মিঃ দাশ উত্তেজিত অপমানে বলে উঠলেন, যা মুখে আসে তাই বোলো না।
সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসিতে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। সুজিত যেন কেমন বিভ্রান্ত বিস্ময়, কিছুটা উৎকণ্ঠায় ঢোঁক গিলতে লাগল।
হাসি থামিয়ে সুনীতা বলল, কিন্তু যা মুখে আসছে তা আপনি বলছেন। এই সব যা বলছেন, ফ্লার্ট, ড্যান্স-ডিনার, প্রেম নিবেদন, মক্ষীরানি, এ সব কবে থেকে?
বলতে বলতে হাসি অদৃশ্য হয় সুনীতার মুখ থেকে। তীব্র উত্তেজনা ফুটে ওঠে আবার। সে বলে, আপনি কি আমাকে সে পথে ঠেলে দেননি? আমার বাবা মারা যাবার সময় আপনাকে তার ছোট ভাই মনে করেই আপনার হাতে আমাকে সঁপে দিয়ে গেছিলেন, আপনিও আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যখন আমাকে আপনার চা-বাগান, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন, তখন কি আমি এরকম ছিলাম? আপনাদের অরূপ দত্ত, কুবের সিংহদের কি আমি চিনতাম?
একটু থামতেই মিঃ দাশ কিছু বলে উঠতে চাইলেন। কিন্তু সুনীতা সে সুযোগ দিল না। সে আরও তীব্র উচ্চস্বরে বলে উঠল হাঁ, আপনি যা বলছেন, আজ আমি তাই, আমি তাই। কিন্তু কবে থেকে? যখন দেখেছি, অকারণ চারদিকে আমার দুর্নামে কান পাতা দায়। আমাকে সবাই বিদ্রূপ করছে, অপমান করছে নোংরা ভাবছে, আপনি যার কোনও প্রতিকার করেননি। আর যখন সবাই ভাবছে, আমি একটা খারাপ মেয়ে, ঠিক তখনই আপনাদের এই উঁচু সমাজকে আমি বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছি। সে সমাজ এখন আমার এই পায়ে পায়ে ঘুরছে। …সুনীতা এমনভাবে শরীরকে দোলা দিয়ে, তার রঞ্জিত-নখ একটি সুন্দর পায়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, মনে হল সে যেন তার রূপ-যৌবনকেই দেখাচ্ছে, যা সত্যি দেখবার মতোই। তার রূপ-যৌবন সবই যেন তখন আগুনের শিখার মতো ঝলকাচ্ছিল। তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা থাকলেও, একটা রুদ্ধ আবেগে চেপে এল।
মিঃ দাশ বলে উঠলেন, আস্তে আস্তে কথা বলো।
সে কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সুনীতা বলেই চলল, আমি তো এই ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে একলা বেড়াতে এসেছিলাম, তবু আপনি যে কেন আমার পিছন পিছন ছুটে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন, তাও জানি। আপনি বিশ্বম্ভর রায়ের মেয়েকে বিয়ে করবেন, আর সেই মেয়ের সামনে আপনি আমাকে নিয়ে দাঁড় করাতে চান, আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চান, আপনার সঙ্গে আমার কোনও অবৈধ সম্পর্ক সত্যি কিছু নেই।
সুনীতার কথা শেষ হবার আগেই মিঃ দাশ বলে ওঠেন, আস্তে আস্তে কথা বলো সুনীতা, ভুলে যেয়ো না, এ কামরায় আর একজন লোক আছে।
সুনীতা হঠাৎ একটু থমকে, চকিতে একবার সুজিতের দিকে লক্ষ করে বলল, থাকলেও তিনি ঘুমোচ্ছেন।
তৎক্ষণাৎ সুজিতের মনে হল না ঘুমিয়ে ঘুমের ভান করে থাকাটা সুনীতাকে ঠকানো হচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলে উঠল, না না, মানে, আমি ঠিক ঘুমোচ্ছি না।
সুনীতা ও মিঃ দাশ দুজনেই স্তব্ধ বিস্ময়ে সুজিতের দিকে ফিরে তাকাল। হঠাৎ কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
সুজিত সংকুচিত লজ্জায় কয়েক বার ঢোঁক গিলল, শার্টের কলার ঠিক গাধার কানের মতো কেঁপে কেঁপে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, খানিকক্ষণ আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। মানে, আমার শরীরটা–না, মাথাটা তেমন ইয়ে নয় তো, গোলমাল হলে একদম ঘুমোতে পারি না।
মিঃ দাশ বলে উঠলেন, আপনি কি কোনও স্বাস্থ্য নিবাস থেকে ফিরছেন?
সুজিত বলল, আজ্ঞে না, আমি আসছি নবযুগ উন্মাদ আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয় থেকে।
মিঃ দাশ যেন আতঙ্কে শিউরে উঠে বললেন, বাই জোভ!
তারপর সুনীতার দিকে তাকিয়ে, চাপা শঙ্কিত গলায় বললেন, ম্যাড, হি ইজ ম্যাড! পাগলাগারদ থেকে আসছে। আমার আগেই যেন কেমন সন্দেহ হয়েছিল, একটা কিছু গোলমাল আছে।
সুনীতা কিন্তু বিস্মিত তীক্ষ্ণ চোখে সুজিতের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুজিত সুনীতার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর মিঃ দাশের দিকে ফিরে বলল, এখন আমি সুস্থ আছি। সেই জন্যেই আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
মিঃ দাশ প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললেন, সুস্থ? সুস্থ মানেটা কী, আপনার…আপনার সার্টিফিকেট আছে, আই মিন, ফিট সার্টিফিকেট?
সুজিত চোখ বড় বড় করে বলল, আজ্ঞে না তো!
যেন একটা অপরাধ করে ফেলেছে, এমন একটা ভাব তার। মিঃ দাশ আরও শঙ্কিত হয়ে চারদিকে এক বার অসহায়ের মতো তাকালেন। চারদিকে দরজা-জানালা বন্ধ, গাড়ি বেগে ছুটে চলেছে। সুনীতা সুজিতের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল।
কিন্তু মিঃ দাশ বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ, একটা পাগলের সঙ্গে…কামড়েই দেবে, না কি একটা…।
সুজিত নেমে আসবার উদ্যোগ করল। মিঃ দাশ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় আসছেন আপনি?
সুজিত অবাক হয়ে থমকে গেল। নীচের দিকে দেখিয়ে বলল, নীচে।
-কেন?
হাত দিয়ে বাথরুমের দরজার দিকে দেখাল, বলল, যাব। মানে, চোখেমুখে একটু জল না দিলে, শরীরটা যেন কেমন…।
সুজিত নেমে এল। মিঃ দাশ প্রায় আক্রমণের আশঙ্কাতেই যেন শক্ত হয়ে বসে আছেন। সুজিত বুঝতে পারছে, মিঃ দাশ লোকটি তাকে পাগল ভেবে ভয় পাচ্ছে। সে মনে মনে দুঃখিত ও বিব্রত বোধ করছে। ভাবছে, সুনীতাও হয়তো তাই ভাবছে। অথচ সুনীতার কথাবার্তা শুনে, সুনীতাকে দেখে, তার মনটা যেন কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সুনীতার এই রূপ, বা অভিজাত পোশাক, চালচলন, একটা দুর্বিনীত ভাবভঙ্গির মধ্যেও সে যেন একটি অসহায়, চারদিকে নানান কুটিল আক্রমণে ভীত দুঃখী মেয়েকে আবিষ্কার করেছে। এত ঐশ্বর্যের মধ্যেও সে যেন একটি ব্যাধতাড়িতা হরিণীকে দেখতে পাচ্ছে সুনীতার মধ্যে। এই ঝলকের মধ্যে, অপমানে-মুখ-গুঁজে-থাকা একটা মেয়েই যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবং নিজের এই অসহায়তা, ভয়, অপমানকে প্রকাশ হতে না দেবার জন্যেই যেন তার ওপরে এই দুর্বিনয়ের তীব্রতা, নিজের অস্তিত্বকে অস্বাভাবিক রূপে প্রকাশের কারণ। কেন যে সুজিতের এরকম মনে হচ্ছে, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। সে বুঝতে পারছে, সুনীতার জন্যে ইতিমধ্যেই তার মনে একটা সমবেদনার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গেই একটা কৌতূহল ও আকর্ষণও অনুভব করছে। কিন্তু নিজেকে সহজে প্রকাশ করা যায় না।
ওপরের বাঙ্ক থেকে নেমে সুজিত এক মুহূর্ত অন্য দিকে ফিরে একটু যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকে, এবং আস্তে আস্তে ফিরে সুনীতার দিকে এক বার তাকায়। সুনীতার ঠোঁটের কোণ দুটি টেপা, সুজিতের চোখ পড়তে–জোড়া এক বার কুঁকড়ে লতিয়ে ওঠে, এবং চকিতে একটা যেন হাসির ঝিলিক হেনে যায়। সুজিতের চোখে একটা বিষণ্ণতার আভাস, হঠাৎ একটি নিশ্বাস পড়ে তার। সুনীতার ঠোঁট ফাঁক হয়ে সহসা তার ঝকঝকে দাঁতের সার দেখা যায়, সে-ও যেন একটু বিমূঢ় হয়ে ওঠে।
সুজিত ল্যাভাটরির দিকে এগিয়ে যায়, এবং মিঃ দাশের পাশ ঘেঁষেই তাকে যেতে হয়। মিঃ দাশ তাঁর সন্দিগ্ধ শঙ্কিত চোখ এক বারও ফেরাতে পারেন না সুজিতের দিক থেকে। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁর প্রায় নিশ্বাস বন্ধই হয়ে আসে। সুনীতা মিঃ দাশকে দেখছিল।
সুজিত ল্যাভাটরিতে ঢুকে যাবার পর, সুনীতা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। মিঃ দাশ ফিরে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তুমি হাসছ?
সুনীতার হাসি হঠাৎ বিদ্রুপে বেঁকে ওঠে। বলে, হাসব না তো কী করব বলুন? একজন অত্যন্ত নিরীহ ভাল মানুষকে দেখে আপনি যদি
–হোয়াট ডু ইউ মিন! নিরীহ ভালমানুষ?
বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই, ঈষৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, নিঃশব্দে হেসে সুনীতা বলল, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। নিরীহ, সরল আর প্রায় শিশুর মতো মিষ্টি। ওর মতো লোকের সঙ্গে আমি বোধ হয় সারারাত একলা ট্রাভেল করতে পারি।
মিঃ দাশের চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে ওঠে। সুনীতা ল্যাভাটরির বন্ধ দরজার দিকে ফিরে তাকায়।
.গাড়ি হাওড়া স্টেশনে ঢুকছে। লোকজনের ভিড়। কুলিদের ছুটোছুটি। মিঃ দাশ মাথায় টুপি, হাতে ছড়ি, ঠোঁটে চুরুট, চোখে গগলস, ট্রেনের দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছেন। উদ্দেশ্য কুলিকে ডাকা। স্টেশনের ঘড়িতে বেলা আটটা।
কামরার মধ্যে সুজিত কোটের বোম বন্ধ করে। জুতোটা পায়ে দেয়। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সুনীতা কামরার দেয়ালে আয়নায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে, শাড়িটা ঠিক করে নিচ্ছে, চুলটা বিন্যস্ত করছে। ব্যাগ থেকে লিপস্টিকটি বের করে চট করে এক বার বুলিয়ে নিয়ে, ঈষৎ জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে ঠোঁট দুটি ফাঁক করতেই আয়নায় সুজিতকে চোখে পড়ে যায়। সুজিত তাকেই দেখছিল।
সুনীতা হঠাৎ ফিরে দাঁড়ায়। পুঁটলি বগলে সুজিত একটু হাসে, নমস্কারের ভঙ্গি করে। বলে, চলি।
সুনীতা যেন এক মুহূর্ত কেমন হয়ে যায় সুজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে। কী যেন সে বলতে চাইল, কিন্তু কথা ঠিক ফুটল না।
সুজিত হেসে, গম্ভীর স্বরে হঠাৎ বলে উঠল, আপনাকে, জানেন, আপনাকে যেন কেমন অসহায় বলে মনে হয়।
সুনীতা চমকে ওঠে। বলে ওঠে, অসহায়?
সুজিত করুণ গলায় বলে, কেমন যেন দুঃখী–
কথাটা শেষ হবার আগেই গাড়িটা দাঁড়ায়, ঝাঁকুনি লাগে। ঝাঁকুনিতে সুজিত দরজার দিকে সরে গিয়ে টাল সামলায়। সুনীতা আয়নার ওপর হাত দিয়ে নিজের পতনকে বাঁচায়, এবং মনে করে সুজিত নেমে চলে যাচ্ছে। সে ডেকে ওঠে, শুনুন?
সুজিত ফিরে তাকায়।
সুনীতা বলে, কলকাতায় আপনার বাড়ি কোথায়?
–আমার বাড়ি নেই তো?
–তবে কোথায় যাচ্ছেন?
–চেনা লোক খুঁজে নিতে যাচ্ছি?
তার কথা শেষ হবার আগেই মিঃ দাশের হুংকার শোনা যায়, এ্যাই কোলি! হুড়মুড় করে কুলিরা ঢুকে পড়ে। সুজিত আড়ালে পড়ে যায়। সুনীতা আর তাকে দেখতে পেল না।
.হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বিচিত্র শহর কলকাতার মাঝখানে এসে দাঁড়াল সুজিত। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না সে। জনতার ভিড়, গাড়ি-ঘোড়ার চলমান প্রবাহ। তার মাথার মধ্যেটা যেন বোঁ বোঁ করতে থাকে। সে কোনও কোনও লোককে জিজ্ঞেস করবার উদ্যোগ করে, অলিভ রোড কোথায়? কিন্তু জিজ্ঞেস করবার আগেই, সবাই যেন তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সে ঢোঁক গেলে, অসহায়ের মতো তাকায়। শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা এসে তার পিছনে ঠুন ঠুন করে ঘণ্টা বাজায়। সুজিত ফিরে তাকায়।
রিকশাওয়ালা কাঁহা যায়েগা বাবু?
সুজিত–অলিভ রোড।
রিকশাওয়ালা–অলিভ রোড? কাঁহা হ্যায়?
সুজিত–তা তো জানি না!
একজন চলমান পথিক, কথাটা কানে যেতে বলে ওঠে, আলিপুরের দিকে যান, নিউ আলিপুর।
রিকশাওয়ালা বলে ওঠে, আই বাবা, বহুত দূর, বাস মে চলা যাইয়ে।
সুজিত অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তার চোখের ওপর দিয়ে, গর্জন করে বড় বড় গাড়ি যায় আসে, কিন্তু কী করতে হবে, সে ঠিক করে উঠতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত তিন টাকায় রফা করে, একজন রিকশাওয়ালাই সুজিতকে নিয়ে এল তার গন্তব্যে। ১৯, অলিভ রোড মস্ত বড় গেটওয়ালা বাড়ি। নেমপ্লেট রয়েছে, মিঃ বি. এন. রায়চৌধুরী। অভিজাত পাড়া। সব বাড়িগুলোই অনেকখানি করে জমি নিয়ে বিস্তৃত। বাগান ও আধুনিক ইমারতে গোটা অঞ্চলটা যেন সেজেগুজে গম্ভীর হয়ে রয়েছে।
সুজিত এসে বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়ায়। এক পাশে প্লেটে লেখা আছে, বিওয়্যার অফ ডগ। দরোয়ানকে দেখা যাচ্ছে না। সুজিত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। ঠিক এ সময়েই পিছনে আচমকা মোটরের হর্ন বেজে ওঠে। সুজিত চমকে উঠে সরে যায়। দরোয়ান ছুটে এসে গেট খুলে দেয়। উর্দিপরা ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে। একজন যুবক বসে ছিল ড্রাইভারের পাশেই। গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকতে যেতে যুবক ড্রাইভারকে ইশারা করে থামিয়ে সুজিতের দিকে ফিরে তাকায়। গম্ভীর গলায়, চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে, কাকে চান?
সুজিত ঢোঁক গিলে বলে, বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।
যুবক সুজিতের আপাদমস্তক এক বার দেখে, কী ভেবে যেন দরোয়ানকে হুকুম করে, ইয়ে আদমিকো ওয়েটিং-রুম মে বৈঠাও।
পরমুহূর্তেই গাড়িটা বাগানের ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়ায়।
দারোয়ান সুজিতকে এক বার দেখে, হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকে।
.ওয়েটিং-রুম। একটি গোল টেবিল। কয়েকটি চেয়ার টেবিলের ওপরে ভিজিটরস নেমের স্লিপ। আর কোনও আসবাবপত্র নেই। একটি দরজা দিয়ে ভিতরের একটি ঘরের সামান্য অংশ দেখা যায়। সেখানে মানুষের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। এক বার সেখানে টেবিলের ওপর মুষ্ট্যাঘাত ও বাজখাঁই গলার হুংকার শোনা যায়, না ইমপসিবল!
সুজিত চমকে উঠে সোজা হয়, চোখ বড় বড় দেখায়, শার্টের কলার নড়ে ওঠে। একটু পরেই এক মাড়োয়ারি ও একটি স্যুটপরা লোকের সঙ্গে, একজন মাঝবয়সি লোককে দেখা যায়। মাড়োয়ারি ভদ্রলোক তখন মাঝবয়সি লোকটিকে বলছেন, আপনি মোশাই একটু মিঃ রায়চৌধুরীকে সমঝাইয়ে বলবেন, নেই তো এ বেওসাতে আমার চার লাখ টাকার ক্ষোতি হইয়ে যাবে।
মাঝবয়সি লোকটি চোখ টিপে, ফিসফিস করে বলল, বলব, বলব।
সুজিত হাঁ করে শুনছিল এদের কথা। লোক দুটি বেরিয়ে গেল। মাঝবয়সি লোকটি সুজিতকে বলল, আপনি মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করবেন?
সুজিত কোনও রকমে ঘাড় নাড়ে। লোকটি ডাকে, আসুন।
.
একটা ঘরের দরজায় মোটা পরদার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি লোকটি বলে, আপনি যান ভিতরে। বগলের এ পুঁটলিটা কি রেখে যাবেন বাইরে?
সুজিত তাড়াতাড়ি বলে, না না।
লোকটি একটু অবাক হয়। সুজিত একটু বোকার মতো হাসে। লোকটি বলে, তবে যান।
সুজিত পরদা সরিয়ে ভিতরে দেখল। প্রথমেই দেখল, বিরাট এক পুরুষ-মূর্তি, স্যুট পরা, কিন্তু পিছন ফেরা। পিছনে তাঁর কাঁচা পাকা চুল দেখা যায়। তিনি যেন দেয়ালে ছবি দেখছেন, এমনিভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, ডিয়ার স্যার, উই রিগ্রেট টু ইনফরম ইউ, দ্যাট, ডিউ টু হেভি কমজামশন, আওয়ার রিভার সার্ভিস ইজ কোয়াইট আনেবল টু গিভ ইউ এনি সার্ভিস…।
কথাগুলো অত্যন্ত দ্রুত বলেই তিনি একপাশে ফিরে তাকালেন। যেদিকে তাকালেন, সেখানে এক কোণে, গেটে দেখা গাড়ির সেই যুবকটিকে দেখা গেল। সে নোট নিচ্ছিল। নোট নিয়ে সে মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে সুজিতকে দেখতে পেল। বলে উঠল, কাকাবাবু সে-ই
কথা শেষ করবার আগেই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মিঃ রায়চৌধুরী সুজিতের দিকে ফিরে তাকালেন। ঘরটা একটা সুসজ্জিত অফিস-ঘর হলেও বড় বড় গদিওয়ালা চেয়ার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। দেয়ালে নানান রকমের কয়েকটি পেন্টিং। তা ছাড়া একটা বিরাট অংশ জুড়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ও আসামের জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথের নকশা। মেঝেতে পুরু গালিচা পাতা রয়েছে।
বীরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুজিত একটু হাসবার চেষ্টা করল।
বীরেন্দ্রনারায়ণ পুরোপুরি সাহেব, গম্ভীর, বছর পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে বয়স। তীক্ষ্ণ চোখে সুজিতকে আপাদমস্তক দেখেই বলে উঠলেন, কী চাই?
সুজিত ভদ্র নম্র হেসে বলল, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করবার
বীরেন্দ্র বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, কী চাই, আমি তাই জিজ্ঞেস করছি।
সুজিত–আজ্ঞে চাই না কিছুই, মানে–আমার নাম, শ্রীসুজিত মিত্র।
বীরেন্দ্র–অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু কী চাই?
ওঁর গলায় অসহিষ্ণুতার আভাস।
সুজিত বলল, আমাকে…মানে…আমার বাবার নাম ঈশ্বর অতীন্দ্রনাথ মিত্র।
বীরেন্দ্রনারায়ণ ধৈর্য হারিয়ে উচ্চ গলায় বলে উঠলেন, আই ডোন্ট লাইক টু হিয়ার ইওর ডেড ফাদারস নেম। আমি জিজ্ঞেস করছি, কী চাই?
সুজিত আবার ঢোঁক গিলে এক মুহূর্ত বীরেন্দ্রবাবুর চোখের দিকে তাকায়। বলে, ঠিক কিছু চাই না। প্রতাপনারায়ণ সিংহের ফটোর পিছনে
বীরেন্দ্রবাবু যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, কে? প্রতাপনারায়ণ সিংহ? তার সঙ্গে কী সম্পর্ক?
সুজিত–আজ্ঞে, তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, আমি ঠিক জানি না। তবে তাঁর ফটোর পিছনে আপনার নাম-ঠিকানাটা লেখা রয়েছে বলে, আপনার কাছেই এসেছি।
বীরেন্দ্রনারায়ণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুজিতের দিকে এক বার লক্ষ করলেন, বললেন, প্রতাপনারায়ণ সিংহ তো আমার আত্মীয়, আমার স্ত্রীর বড় ভাই তিনি। কিন্তু আপনার, মানে, তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতাপবাবুর ফটো তোমার কাছে গেলই বা কী করে? তুমি কে?
সুজিত বলল, আমি ঠিক জানি না আমি কে!
বীরেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর বিস্ময়ে ঘরের যুবকটির সঙ্গে চোখাচোখি করেন। যুবকটিও থ হয়ে আছে। বীরেন্দ্রনারায়ণ কয়েক পা অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি সরালেন না সুজিতের দিক থেকে। বললেন, তুমি…অর্থাৎ তুমি জান না, তুমি কে?
সুজিত সরলভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি সুজিত। শুনেছি, আমাদের বাড়ি বর্ধমানের কোনও এক গ্রামে। আমার বাবার নাম ঈশ্বর অতীন্দ্রনাথ মিত্র, প্রতাপবাবু আমাকে বছর দশ-বারো আগে পাটনায় নিয়ে গেছিলেন। তারপরে!
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল বীরেন্দ্রবাবুর। চমকে উঠে বললেন, কী বললে তোমার বাবার নাম, অতীন মিত্তির? হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রতাপের বন্ধু ও বিজনেস পার্টনার ছিলেন। কিন্তু তারা দুজনেই তো মারা গেছেন। প্রতাপ তো গত বছর ডালহৌসির পাহাড়ে, হার্ট কনজামশনে…।
একটু থেমে আবার বলে উঠলেন, কিন্তু তুমি..মানে তুমি এখন এলে কোত্থেকে?
সুজিত বলল, বিহারের গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম থেকে।
প্রায় চিৎকার করে উঠলেন বীরেন্দ্রনারায়ণ, উন্মাদ-আশ্রম?
ঘরের কোণের যুবকটির দিকে বড় বড় চোখে ফিরে তাকালেন। সুজিত ইতিমধ্যে উচ্চারণ করল, এবং মানসিক চিকিৎসালয়।
বীরেন্দ্র ফিরে তাকালেন। সুজিত আবার বলল, কিন্তু আমি এখন ভাল আছি বলেই এখানে এলাম।
সন্দিগ্ধভাবে তাকালেন বীরেন্দ্র। সুজিত বলল, আমি এখন ভাল আছি।
বীরেন্দ্র তখনও সন্দিগ্ধভাবে প্রায় একটা হুংকার দিলেন, হুঁ।
সুজিতকে দেখতে দেখতে সরে গিয়ে একটা চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন। সুজিত আবার বলল, প্রতাপনারায়ণ সিংহ তা হলে মারা গেছেন?
বীরেন্দ্র সহসা ভাব বদলে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? তুমি আমার কাছে কী চাও?
সুজিত–কিছু নয়। এমনি এলাম, মানে ওই ফটোর পিছনে আপনার ঠিকানাটা দেখলাম কিনা, ভাবলাম, আপনি হয়তো কিছু হদিস দিতে পারেন।
কীসের হদিস?
–প্রতাপবাবুর বিষয়, বা আমাদের বাড়ি কোথায়, আর কেউ আছে কি না আমার!
–কিছু না, কোনও খবরই দিতে পারি না।
হাত নেড়ে বলে উঠলেন বীরেন্দ্র, তা তুমি কলকাতায় এখন কোথায় যাচ্ছ?
–কোনও হোটেল-টোটেলে যাব। শুনেছি অচেনা লোকেরা হোটেলে যায়।
–হোটেলে যাবে? টাকা আছে?
–হ্যাঁ, টাকা সাত-আটেক আছে।
বীরেন্দ্র ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন, হরি! কলকাতায় এর আগে কখনও এসেছ?
সুজিত ঘাড় নেড়ে জানাল, কখনও আসেনি। বীরেন্দ্র কোণের যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছ? শুনেছ ব্যাপারটা? এর মাথা নাকি ঠিক আছে। দেখ, সত্যি করে বলল, তুমি কি আসলে আমার কাছে কোনও সাহায্য বা চাকরির জন্যে এসেছ?
সুজিত পরম আপ্যায়িতের ভঙ্গিতে সরলভাবে বলল, আপনি চাকরি দিতে পারেন? তা হলে তো খুবই ভাল হয়।
বীরেন্দ্র রাগতে গিয়ে, অসহায় বিস্ময়ে চুপ করে গেলেন। মুখটা কঠিন করে সুজিতকে দেখে বললেন, লেখাপড়া কদ্দূর করা হয়েছে?
সুজিত–কখনও স্কুলে গেছি বলে তো মনে পড়ে না।
বীরেন্দ্র– ইমপসিবল। কী করতে পার? কিছু কাজ-টাজ জানা আছে?
সুজিত প্রথমে ঘাড় নাড়ে। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে–হ্যাঁ, মানে, কাজ ঠিক না, আঁকতে পারি।
–কী আঁকতে পার?
–এই…এই ধরুন আপনি বসে থাকলে আপনাকে এঁকে দিতে পারি।
বীরেন্দ্র আবার তাকালেন কোণের ছেলেটির দিকে। বললেন, শুনেছ? আচ্ছা, আমি দেখতে চাই, সত্যি তুমি তা পার কি না। কীসে আঁকবে? কাগজ পেন্সিল হলে হবে? না রং-তুলি চাই?
কাগজ-পেন্সিল হলেই হবে।
–দ্যাটস অলরাইট। শিবেন, একে কাগজ-পেন্সিল দাও তো।
ঘরের কোণের ছেলেটিকে তিনি বললেন। শিবেনের চোখে তখন দুজনের প্রতিই বিস্মিত দৃষ্টি নিবদ্ধ। সশ্রদ্ধ নিচু স্বরে বলল, আজ্ঞে, দিচ্ছি।
সে ত্রস্ত হয়ে কাগজ আর পেন্সিল দিল সুজিতকে। বীরেন্দ্র বললেন, একটা চেয়ার দেখিয়ে, ওখানে বসো, বসে আঁকো।
বলে উনিও সামনের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। কৌতূহলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন সুজিতের দিকে। আর আপন মনেই যেন বললেন, হু, তুমিই তা হলে সেই, যার কথা প্রতাপ বলত, একজনকে মানুষ করে দাঁড় করিয়ে না যেতে পারলে আমার মুক্তি নেই।
সুজিত ততক্ষণ বসে গেছে কাগজ-পেনসিল নিয়ে। তার কাগজে খস খস করে রেখা আঁকা হয়ে চলেছে। বীরেন্দ্রবাবুর দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাতের মধ্যে ও আঁকতে আঁকতেই সে যেন খানিকটা আত্মগত ভাবেই বলল, বলতেন বুঝি? অথচ উনি আমার বাবার বিজনেসের একজন পার্টনার মাত্র। তবু আমার জন্যে তিনি যা করেছেন…না না, উঁহু, একদম মুখ ফেরাবেন না, হ্যাঁ, এমনি করে তাকিয়ে থাকুন আমার দিকে।
কথার মাঝখানেই সে বীরেন্দ্রবাবুকে তার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করল। বীরেন্দ্রনারায়ণ চমকে ফিরে তাকালেন, ভ্রু কোঁচকালেন, একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুললেন। আর সুজিত বাঁ হাত তুলে যেন বীরেন্দ্রকে খানিকটা চাঁটি দেখাবার মতো করল, হাতটা একবার ডানদিকে নিয়ে গেল, আর একবার বাঁ দিকে। আসলে মুখের দুটো পাশ আলাদা করে দেখে নিচ্ছে, মেপে নিচ্ছে।
বীরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কতক্ষণ লাগবে বলো তো?
সুজিত অদ্ভুত ভঙ্গি সহকারে আঁকতে আঁকতেই বলল, এই মিনিট পনেরো। ছেলেবেলা থেকেই আমার আঁকার দিকে খুব
কথা শেষ না করেই, যেন বিশেষ পরিশ্রমের কসরত করতে গিয়ে তার জিভ খানিকটা বেরিয়ে পড়ল। বীরেন্দ্রর দিকে তাকাল, আবার খস খস করল।
বীরেন্দ্র শিবেনের দিকে চোখের কোণ দিয়ে চকিতে এক বার দেখে বলে উঠলেন, আমি কি এখন শিবেনের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
সুজিত–পারেন, না তাকিয়ে।
বলে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত ও খস খস শব্দে এঁকে চলল। বীরেন্দ্র খুব জোরে এক বার খাঁকারি দিলেন। বললেন, তুমি ঠিক জান, ওরা আজই আসছে?
সুজিত বলে উঠল, কারা?
বীরেন্দ্র–আমি তোমাকে বলিনি। ইমপসিবল! শিবেন!
শিবেন তাড়াতাড়ি নিচু মোটা গলায় জবাব দিল, আজ্ঞে, হ্যাঁ কাকাবাবু, আসবেন, মানে এসে গেছেন?
বীরেন্দ্র কী করে জানলে?
শিবেন একটু সংকুচিত দ্বিধায় বলল, আমি এখন চৌরঙ্গি থেকে আসবার সময় মিস নাগের ওখান হয়ে এসেছি।
সুজিত আঁকতে আঁকতেই আপন মনে উচ্চারণ করল, মিস নাগ, হু….উঁহু, চোখটা অত পিটপিট করবেন না স্যার।
বীরেন্দ্রর ভ্রু কুঁচকে উঠল, মুখে বিরক্তি। ইতিমধ্যে শিবেন ওঁর মুখোমুখি ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছে, যাতে কথা বলার সুবিধে হয়। উনি সুজিতের কথায় অবাক হয়ে এক বার শিবেনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। আবার বললেন, দাশ কিছু বলল?
শিবেন–আপনার কাছে আসবেন তাড়াতাড়ি।
বীরেন্দ্র–দেখা করে আর কী হবে। ওই মেয়েটা, মিস নাগ, ওঁর জন্যে… সু
জিত আবার উচ্চারণ করল, মিস নাগ!
বীরেন্দ্রর ভ্রূ কোঁচকাল। সুজিতের দিকে তাকালেন। সুজিত তখন আঁকছে, যদিও তার চোখের সামনে সুনীতার মুখটা চকিতে চকিতে ভেসে উঠছে। সে সত্যি খেয়াল করছে না, এরা কী বলছে। কিন্তু মিস নাগ শুনলেই, সুনীতার কথা আপনা থেকেই তার মনে আসছে, তাই উচ্চারণ না করে পারছে না।
কিন্তু বীরেন্দ্র সুজিতের ওটা একটা খেয়াল ভেবেই, অবাক হলেও নিজের কথা চালিয়ে গেলেন–ওর জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছে দাশ, দু-একদিনের মধ্যেই দিয়ে দেবে। কী ভয়ংকর পাজি মেয়ে, কলকাতাটাকে একেবারে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আর সেই মেয়েকে কিনা তুমি বিয়ের প্রস্তাব করেছ, হুঁ? ওই হবে আর কী, বউ পাবে না, তার টাকাটাই পাবে। অবিশ্যি,আমি তাতে রাজি, কেনো, তোমরা যখন বলছ, তোমরা ভালবাসা।
শিবেনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তবু সে বীরেন্দ্রের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিল। বীরেন্দ্র আবার বললেন, তবু যা হোক, পঞ্চাশ হাজার টাকা তো। তোমার ভালই হবে।
সুজিত বলে উঠল, বউয়ের বদলে টাকা!
আঁকতে আঁকতেই হেসে উঠল। আবার বলল, মানুষ যে কী!
বীরেন্দ্র আর শিবেনের চোখাচোখি হল। সুজিত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে লাস্ট টাচ দিল। বলল, হয়ে গেছে স্যার।
বীরেন্দ্র লাফ দিয়ে উঠলেন। কৌতূহলিত হয়ে এগিয়ে গেলেন, এবং ছোঁ মেরে স্কেচটা তুলে নিয়ে দেখলেন। দেখে প্রায় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, বাঃ, বিউটিফুল! শিবেন, দেখো এ বাজে কথা বলেনি, সত্যি আঁকতে জানে, কী বলো? ঠিক আমার মুখটাই হয়েছে, না? ভেরি গুড, ভেরি গুড! তা হলে তো তোমাকে আমি একটা চাকরি দিতে পারি হে, আই মিন, দেওয়া উচিত, না কী বলল হে শিবেন?
শিবেনও সত্যি অবাক ও মুগ্ধ হয়েছিল। বলল, তাই তো মনে হয়।
বীরেন্দ্র বললেন, ঠিক আছে, আমাদের বিজ্ঞাপনের ছবি-টবি তো এর দ্বারা কিছু আঁকানো যেতে পারে অতএব, একে একটা কাজ দেওয়া যেতে পারে। এ মিথ্যে কথা বলেনি। বেশ ভাল আঁকা হয়েছে। আচ্ছা, এ স্কেচটার জন্যে, মানে এটা আমি কিনতে চাই, বুঝলে? তোমাকে আমি একশোটা টাকা দেব।
বলেই শব্দ করে হঠাৎ একটা ড্রয়ার খুললেন, এবং একটি একশো টাকার নোট বের করে সুজিতের হাতে দিলেন।
সুজিত হতচকিত বিস্ময়ে, খুশিতে টাকাটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত কী করবে ভেবে পেল না। খালি বলতে পারল, এটা আঁকবার জন্যে আমাকে একশোটা টাকা দিলেন?
বীরেন্দ্র–হ্যাঁ, খুবই সামান্য, তবু
কথা শেষ না করে ছবিটা দেখতে লাগলেন। সুজিত বলল, এ তো অনেক টাকা। একশো।
বলে খুশিতে ডগমগ হয়ে হাসতে লাগল।
বীরেন্দ্র বললেন, অনেক কোথায় হে? একটা তৃতীয় শ্রেণীর হোটেল-খরচাও ওতে হবে না। আমি দেখছি, তোমার জন্যে কী করতে পারি।
সুজিত হঠাৎ ঢোঁক গিলে বলল, আচ্ছা, আমার মানে, সেই কাল বিকেলে খেয়েছি কিনা, তাই খিদে পেয়েছে।
বীরেন্দ্র কয়েক মুহূর্ত মূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ইমপসিবল, ইমপসিবল। সে কথা বলবে তো! এই ছবিটা আমি এখুনি এক বার আমার স্ত্রীকে দেখাতে চাই, তুমিও চলো আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে। চলো চলো…
সুজিত তাড়াতাড়ি পুঁটলিটা তুলতে যায়। বীরেন্দ্র ধমকে ওঠেন, ওটা দিয়ে কী হবে? কী ঐশ্বর্য আছে ওটাতে শুনি, যে, বগলে নিয়ে যেতে হবে। দেখি, দেখি ওতে কী আছে?
বলেই উনি দ্রুত হাতে পুঁটলিটা খুলে ফেললেন। দু-একটা পায়জামা, পাঞ্জাবি, আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি, একজোড়া স্লিপার, অনেক কাগজপত্র। প্রতাপ সিংহের বহু চিঠিপত্র, সুজিতের এবং ওর বাবার ফটো, একটা পারিবারিক ফটোও রয়েছে যার মধ্যে সুজিতের মা রয়েছেন, আর সুজিতের একটা পরিচয়পত্র, যেটা উন্মাদ-আশ্রমের ডাক্তারের কাছে ছিল।
বীরেন্দ্র বললেন, হু, এ কাগজপত্রগুলো পরে দরকারে লাগতে পারে। ঠিক আছে, এই ড্রয়ারে এখন বান্ডিলটা থাক।
ড্রয়ারে রেখে বললেন, এসো, আমার সঙ্গে এসো।
আবার থমকে দাঁড়ালেন, একটু ভেবে, ফিরে দাঁড়িয়ে শিবেনকে বললেন, আচ্ছা শিবেন, তুমি যে বলছিলে তোমাদের দোতলার কোণের একটা ঘর খালি আছে, সেখানেই একে রাখো না। পেয়িং-গেস্ট হিসেবে তোমাদের বাড়িতে থাকবে, কী বলে?
শিবেন বলল, আপনি যা বলবেন।
বীরেন্দ্র–দ্যাটস অলরাইট, সেটাই ঠিক হবে, এ হোটেলে থাকবার উপযুক্ত নয়। এসো এসো।
বীরেন্দ্র এগিয়ে গেলেন। সুজিত পিছনে। অফিস-ঘরের পরেই, মস্ত বড় একটা হলঘর, আয়নার মতো চকচকে মেঝে। মাঝখানে মস্ত বড় গোল টেবিল। চারপাশে গদি-আঁটা চেয়ার। দেয়ালে বড় বড় ছবি। সুজিতের মনে হল, মেঝেয় ওর পা পিছলে যাবে। তাই টিপে টিপে চলল। ছবির দিকে চোখ দিতে গিয়ে দু-একবার পিছলে যাবার অবস্থা হল।
হলঘরের একেবারে শেষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বীরেন্দ্রকে অনুসরণ করে সে উঠল। সিঁড়ির ওপরে উঠে লম্বা মোজেকের বারান্দা, যেন একটি সুন্দর গালিচা পাতা। নানান ধরনের ক্যাকটাস আর ফুলের টব। অর্কিড আর মানিপ্ল্যান্টার নানান ভঙ্গিতে দোলানো, লতানো, পুরনো বেলোয়ারি ঝাড়ের অনুকরণে বৈদ্যুতিক আলোর বিন্যাস। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দার ডানপাশে নীচের মতোই একটি হলঘর। সুজিতের মনে হল, ছবিতে দেখা দরবারকক্ষের মতোই তার অঙ্গসজ্জা। বাঁ দিকে সারি সারি ঘর। বারান্দাটা এল প্যাটার্নে কোণ নিয়ে বেঁকেছে, সেদিকেও ঘর।
বারান্দায় পা দিয়েই বীরেন্দ্র হাঁক দিলেন, কিনু! কিনু!
একজন ভৃত্য ছুটে এসে জানাল, আজ্ঞে, মেমসাহেব তাঁর ঘরে আছেন।
বীরেন্দ্র এগিয়ে গেলেন বারান্দার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত, বাঁক নিলেন, এবং তারপরে আবার ডাকলেন, কিনু, এই দেখো, একজনকে নিয়ে এসেছি ।
বলে পরদা সরাতেই ভিতরে দেখা গেল, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেই, একজন মহিলা। দেখেই বোঝা যায়, মহিলা সুন্দরী, একদা বেশ রূপসীই ছিলেন। যদিও গতায়ুযৌবনা, তবু সব মিলিয়ে প্রৌঢ় বয়সের একটি স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ও কমনীয়তা রয়েছে। তিনি বিব্রত ও বিস্মিত হয়ে তাকালেন।
বীরেন্দ্র সুজিতকে ডাকলেন, এসো।
আবার কিনু অর্থাৎ কিরণের দিকে ফিরে বললেন, তোমার দাদা প্রতাপ
সেই মুহূর্তে কিরণের চোখ পড়ে সুজিতের ওপর। তিনি প্রায় অস্ফুটে আর্তনাদই করে ওঠেন, আমার দাদা?
বীরেন্দ্র বলে ওঠেন, ওঃ ইমপসিবল! আরে, এ তোমার দাদা হবে কেন? এর নাম সুরজিৎ।
সুজিত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আজ্ঞে না, আমার নাম সুজিত, সুজিত।
বীরেন্দ্র বললেন, ওই হল, সুজিত, দ্যাটস অলরাইট।
স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, তোমার দাদা, প্রতাপ সিংহের সেই পার্টনার, কী নামটা যেন! বলো না হে তোমার বাবার নামটা–?
–স্বর্গীয়—
স্বর্গীয় দরকার নেই, নামটা বলো না কেন।
প্রায় ধমকে ওঠেন বীরেন্দ্র। সুজিত ধমক খাওয়া বিষমের মধ্যেই যেন বলে ওঠে, ও হ্যাঁ, মানে মৃত ব্যক্তিদের আবার স্বর্গীয় বলার–
–ইমপসিবল! প্রায় চাপা গলায় গর্জে ওঠেন বীরেন্দ্র।
সুজিত তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করল, অতীন্দ্রনাথ মিত্র।
বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, অতীন মিত্তির, এ সেই অতীন মিত্তিরের ছেলে।
ঘরের অন্যদিকের বারান্দা, যে দিকটায় নিবিড় গাছপালা দেখা যাচ্ছিল, সেইদিকের দরজায় একটি মেয়ের আবির্ভাব হয়েছে। তাকে কেউ লক্ষ করেনি। বয়স সম্ভবত উনিশ-কুড়ি। দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী। চোখ-নাক আলাদা করে দেখলে কিছুটা কিরণময়ীরই ছাপ রয়েছে যেন। খোলা চুল পিঠে ছড়ানো। কপালের কাছে অবিন্যস্ত হয়ে ভুরুর ওপরে এসে পড়েছে চুলের গোছা। হঠাৎ কথা বলে উঠবে, যেন সেই ভয়েই রক্তিম ঠোঁট টিপে রয়েছে। কিন্তু ওর এক চোখে যেমন বিস্ময়, আর এক চোখে যেন একটি রুদ্ধ হাসি থমকে রয়েছে। মেয়েটি সুজিতের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
কিরণ ভ্রু কুঁচকে, স্মৃতি মন্থিত করে উচ্চারণ করলেন, অতীন্দ্র মিত্র।
বীরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই অতীন মিত্তিরের ছেলে, যাকে তোমার দাদাই এ যাবৎ মানুষ করছিলেন। এখন এ আসছে পাগলাগারদ থেকে।
কিরণময়ী প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, পাগলাগারদ?
বলে সুজিতের দিকে তাকালেন।
সুজিত অসহায় বিব্রতভাবে ঘাড় নেড়ে, তাড়াতাড়ি বলতে চাইল, সে পাগল নয়। তার আগেই বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, আহা কিনু, তুমি যা ভাবছ তা নয়, হি ইজ নট ম্যাড।
বীরেন্দ্র না থামতেই সুজিত বলে উঠল, হ্যাঁ, পাগল নই, আমি, মানে, ডক্টর ঘোষ বলতেন, অপরিণত মস্তিষ্ক, অর্থাৎ ভারসাম্যহীন..কী যে ঠিক মানে—
সুজিতও যেন কথার খেই হারিয়ে ফেলল। বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, মানে বোকা, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন একটি বোকা ছিলে তুমি।
সুজিত যে কত সুন্দর, সেটা হাসলে বোঝা যায়। এই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সেও ওকে যেন কোমল শিশুর মতো দেখায়। বীরেন্দ্রর কথায় পরম স্বস্তিতে হেসে ও বলল, হ্যাঁ, বোকা!
কিরণময়ীর চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠেছিল। হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি মিষ্টি মেয়ে-গলায় উদগত হাসির ঝংকারে সবাই ফিরে তাকালেন পিছনের দরজার দিকে। সেখানে এলায়িতকেশিনী, আয়তচোখ মেয়েটি মুখে আঁচল চেপে হেসে উঠেছে। কিরণময়ী সেই হাসি দেখে, ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো আক্রান্ত হয়ে, হঠাৎ আঁচল মুখে দিয়ে হাসতে লাগলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বীরেন্দ্রনারায়ণ এদের হাসি দেখে জাকুটি-সপ্রশ্ন চোখে সুজিতের দিকে তাকালেন। বলতে চাইছিলেন, এদের এ রকম হাসির মানে কী? কিন্তু বারুদ্ধ বিস্ময়ে দেখলেন, সুজিতও হেঁ হেঁ করে হাসতে আরম্ভ করেছে।
বীরেন্দ্রর হাতে সেই পোর্ট্রেট। তিনি প্রায় অসহায় হয়ে তিনজনের হাসি দেখতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন, এর মানে কী? এই হাসির মানে কী?
হাসি স্তব্ধ হল। যদিও হাসির রুদ্ধ বেগের রক্তিমা মুখে মুখে ছড়ানো। কিরণময়ী বললেন, মানে আবার কী থাকবে, তোমার যেমন বলার ছিরি। তুমি হঠাৎ একেবারে নিয়ে এলে, তরতর করে বলতে আরম্ভ করলে, তাতে কিছু বোঝা যায় নাকি? এখন বুঝতে পারছি, দাদা যার কথা প্রায়ই বলতেন, যাকে প্রতিষ্ঠা না করে গেলে ওর মরেও শান্তি নেই, এ সে-ই! অর্থাৎ অতীনদার ছেলে।
বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, একজ্যাক্টলি!
তার চেয়েও বেশি, এ আমাদের হিমানীর ছেলে।
বীরেন্দ্র আবার ধাক্কা খেলেন। বললেন, আমাদের হিমানী? কে হিমানী?
কিরণময়ীর বিস্ময়-অনুসন্ধিৎসু চোখ তখন সুজিতের ওপর। সুজিতও গভীর অভিনিবেশে তার বড় বড় দুটি চোখ মেলে কিরণময়ীর কথা শুনছিল। কিরণময়ীর অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটিতে ক্রমেই একটি করুণ ছায়া নেমে আসছিল। বললেন, তুমি নাম শুনেছ, ভুলে গেছ, অতীনদার স্ত্রীর নাম ছিল হিমানী, আমাদের থেকে দু-এক বছরের বড় ছিলেন। অতীনদা আর হিমানী দুজনেই আবার আমার দাদার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সে বন্ধুত্ব….
কিরণময়ী যেন মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তাঁর গলার স্বর এক অতীতের বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সকলেই কিরণময়ীর দিকে তাকিয়ে রইল।
পরমুহূর্তেই কিরণ যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও আমি দেখেছি ছেলেবেলায়, তোমার পাঁচ-ছ বছর বয়সে, বর্ধমানে আমার বাপের বাড়ির গ্রামে। এসো এসো, বসো।
সুজিত বসতে ভুলে গেল। কিরণময়ীকে সে দেখতে লাগল, যেন অতীত জন্মের এক ইতিবৃত্তের লিখন পাঠ করছে মুগ্ধ বিস্ময়ে। বলল, আপনি আমাকে ছেলেবেলায় দেখেছেন? আমার মাকে আপনি চিনতেন?
কিরণময়ী বললেন, চিনতাম বইকী! আমি, তোমার মা, বাবা, আমার দাদা, আমরা যে সব এক গ্রামেরই ছেলেমেয়ে। প্রায় একসঙ্গেই সবাই বড় হয়েছি। তোমার বাবা, আমার দাদা হরিহরাত্মা ছিলেন। দুজনে একসঙ্গে বিরাট ব্যবসা ফেঁদেছিলেন। তোমার বাবা হিমানীকে বিয়ে করলেন, আমার দাদা বললেন, এক বউ থাকলেই হবে, দুই বউ হলেই বিবাদ বিসংবাদ, সংসারের শান্তি নষ্ট। এই আমাদের সুখী পরিবার। দাদার সঙ্গেও তো হিমানীর ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুত্ব ছিল, যেমন অতীনদার সঙ্গে ছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই সুখী পরিবার।…
সহসা বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে কিরণময়ীর গলার স্বর ডুবিয়ে দিল। তিনি যেন দূর শূন্যের এক অস্পষ্ট ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
সুজিতের মুখে একটি বিস্ময়-স্বপ্নের ঘোর। তার চোখের দৃষ্টিও যেন দুর্নিরীক্ষ ছবিটি দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বহু দূর থেকে যেন সে প্রায় চুপি চুপি স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হল সেই সংসারের?
কিরণময়ীর চোখ দুটি ভিজে উঠেছে প্রায়। বললেন, ভেঙে গেছে বাবা!
-কেন?
সুজিতের ব্যাকুল জিজ্ঞাসার মুখে কিরণময়ী আবার সচকিত হয়ে উঠলেন, বললেন, সে অনেক কথা। তুমি বসো।
সুজিতের দুই চোখে করুণ অনুসন্ধিৎসা। সে বলল, শুধু ছবিই দেখেছি, বাবা-মাকে কখনও চোখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
সমস্ত আবহাওয়াটাই বিষণ্ণ আর করুণ হয়ে উঠল।
সুজিত আবার বলল, প্রতাপবাবুকেও না। তিনি যে আমার কে ছিলেন, তাও আজই ঠিক জানলাম। শুধু জানতাম, আমার খরচ উনিই চালান।
কিরণময়ী বললেন, বাবা-মাকে কী করে দেখবে? তোমার জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই। দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। তারপরে গ্রামে আত্মীয়-স্বজনের কাছে অত্যন্ত অবহেলায় তুমি মানুষ হয়েছ যে কারণে
–আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছল। ডক্টর ঘোষ বলতেন, আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছল।
–হ্যাঁ, বারো-তেরো বছর বয়সে দাদাই তোমাকে নিয়ে বাইরে চলে গেছলেন।
কী আশ্চর্য! মানুষের জীবনটা অদ্ভুত, না?
সে এমনভাবে হেসে বলল, বিষণ্ণতার মধ্যেও কিরণময়ীর মুখে হাসি দেখা দিল। আর দরজায় দাঁড়ানো সেই মেয়েটির আয়ত নিবিড় চোখেও আবার রুদ্ধ হাসি ফুটে উঠল। সুজিতের সরল নিষ্পাপ চেহারা। কপালে পড়া চুল, বিচিত্র বেশভূষা, কথা বলার বিচিত্র বোকাটে ভঙ্গিই ওই দুটি চোখের রুদ্ধ হাসির কারণ।
হঠাৎ সুজিত কিরণময়ীর দিকে দুপা এগিয়ে গেল। কিরণময়ী বিস্মিত হবার অবকাশ পেলেন না। সুজিত বলে উঠল, আমি আপনাকে একটা প্রণাম করি, অ্যাঁ?
বলে নিচু হয়ে প্রণাম করল। এমন অনুমতি চেয়ে যে কেউ প্রণাম করে, আর এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে, এটা কারুর জানা ছিল না। তাই আবার একটা হাসির তরঙ্গ ঢেউ দিয়ে উঠল, যদিও সরবে ফেটে আছড়ে পড়ল না। তবু দরজার কাছ থেকে একটু অস্পষ্ট ঝংকার ভেসে এল।
এইবার সুজিতের চোখ পড়ল দরজায়। আর হাসির দ্যুতি ছড়ানো সেই চোখে চোখ পড়তেই সুজিত যেন অসহায় লজ্জিত হয়ে পড়ল, এবং সেইভাবেই হাসল।
কিরণময়ী বলে উঠলেন, এ আমার মেয়ে, দোলা। তুমি বসো।
দোলা হাত তুলে নমস্কার করল। সেই নমস্কার দেখে যেন সুজিতের নমস্কারের কথা মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি দোলার মতো করেই হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ও, আচ্ছা!
দুবার তার চোখের পাতা পড়ল, এবং ঢোঁক গিলতে গিয়ে শার্টের কলার কেঁপে গেল। দোলার আবার হাসি সামলানো দায় হল।
বীরেন্দ্রনারায়ণ প্রায় হুংকার দিলেন, হুম! এখন কথা হচ্ছে প্রতাপের ফটোর পেছনে আমার ঠিকানা দেখে এ এখানে চলে এসেছে। একে নিয়ে কী করা যায় বুঝতে পারছিলাম না, বুঝলে কিনু। যাকে বলে কপর্দকহীন।
সুজিত তাড়াতাড়ি বলল, না, সাত-আট টাকা আছে বললাম যে?
বীরেন্দ্র ধমকে উঠলেন, তুমি থামো তো হে!
সুজিত–ও, আচ্ছা!
বীরেন্দ্র আবার বললেন, খোঁজ নিয়ে দেখেছি লেখাপড়াও কিছুই শেখেনি।
সুজিত ঘাড় নেড়ে অসহায় হেসে সম্মতি জানাল। যদিও তার সম্মতি কেউ জানতে চায়নি।
বীরেন্দ্র প্রায় উত্তেজিত সুরে বলে উঠলেন, বাট হি ইজ এ গুড আর্টিস্ট, জান কিনু? এই দেখো পনেরো মিনিটের মধ্যে আমার পোর্ট্রেট করে দিয়েছে।
কিরণময়ী স্কেচটা হাতে নিয়ে মুগ্ধস্বরে উচ্চারণ করলেন, বাঃ!
দোলাও কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখল এবং বিস্মিত প্রশংসায় সুজিতের দিকে তাকাল। বীরেন্দ্র বললেন, এখন কথা হচ্ছে, আমাদের পাবলিসিটি বিভাগে একে আমি আর্টিস্ট হিসেবে নিয়োগ করা ঠিক করেছি।
–আর স্কেচটার জন্যে উনি আমাকে একশোটা টাকাও দিয়েছেন।
সুজিত বলে উঠল। বীরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ইমপসিবিল।
সেটা এখন না বললেও চলবে।
সুজিত ভেবেছিল, বীরেন্দ্র হয়তো সেটা বলতে ভুলে যাচ্ছেন। দোলার হাসির নিক্কণ আবার বেজে উঠল। দোলার দিকে তাকিয়ে একটু অসহায় হয়ে পড়ল সুজিত।
বীরেন্দ্র বললেন, আর এ ঠিক হোটেলে থাকবার যোগ্য নয়, তাই শিবেনদের বাড়িতেই এর থাকার ব্যবস্থা করেছি।
কিরণময়ী বললেন, ভালই তো।
বীরেন্দ্র যেন হঠাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেললেন, আঙুল আর ঠোঁট নেড়ে বললেন, আরআর কী যেন?
সুজিত একটু লজ্জিত হেসে বলল, আর, মানে, আর আমার খিদে পেয়েছে। সেই কাল বিকেল থেকে খাইনি, তাই আপনি বলেছিলেন যে–
বীরেন্দ্রও লজ্জিত হয়েই যেন চিৎকার করে উঠলেন, ইমপসিবল। আরে সেটা মনে করাবে তো!
কিরণময়ী প্রায় তড়িতাহতের মতো চোখ বড় বড় করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ও মা!
কিন্তু দোলা ততক্ষণে হাসিতে প্রায় কুঁজো হয়ে পড়েছে। ও তাড়াতাড়ি কোনওরকমে বলল, তুমি কথা বলো মা, আমি দেখছি।
বলে এতক্ষণের সমস্ত রুদ্ধ হাসিকে ফেনিলোচ্ছাসের ঝরনায় মুক্তি দিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিরণময়ীর অবস্থা ততোধিক না হলেও, হাসিতে তিনিও আরক্ত। যদিও একটি করুণ ছায়াও নিবিড় হয়ে আছে তাতে।
সুজিত দোলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে দূরে চলে যাওয়া হাসির ঝংকার শুনল অবাক হয়ে। তারপরে ফিরে তাকাল প্রায় অপরাধীর মতো। বীরেন্দ্রনারায়ণও এবার তাঁর নাকের ডগাটা ঘষে কোনওরকমে গাম্ভীর্য রক্ষা করলেন।
কিরণময়ী আবার বললেন, বসো।
সুজিত করুণ হাসিমাখা মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বসল।
বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, নাউ ইট ইজ হাই টাইম টু গো আউট। কিনু, আমি চললাম। পার তো এ বেলাটা একে এখানেই খাইয়ে দিয়ো। অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ডে শিবেন এসে একে নিয়ে যাবে।
কিরণময়ী বললেন, একে আমি খাইয়ে দেব, সে জন্যে তুমি ভেবো না। বলতে বলতে কিরণময়ী স্বামীর কাছে এগিয়ে এলেন তাঁকে বিদায় দেবার জন্যে।
কিন্তু বীরেন্দ্রনারায়ণ ব্যস্ত উৎসুক চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে, জিজ্ঞেস করলেন, আবার কী হল?
বীরেন্দ্রনারায়ণ বলে উঠলেন, পোর্ট্রেট, দ্যাট পোর্ট্রেট, সেটা কোথায় গেল?
কিরণ নিজের হাতেই সেটা রেখেছিলেন। বললেন, এই তো আমার হাতে।
বীরেন্দ্রনারায়ণ সেটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, এটা আমি অফিসে নিয়ে যাচ্ছি কিনু, আমার বন্ধুদের এটা আমি দেখাতে চাই। আমাদের পাবলিসিটির চিফ আর্টিস্টকেও দেখাব। দিজ ইজ হিজ ট্রায়াল, বুঝলে না? ওর কাজ দেখিয়েই ওর জন্যে আমি ওকালতি করব।
বলতে বলতে উনি বারান্দায় এসে পড়েছিলেন। কিরণও কাছে কাছে হাঁটছিলেন। হঠাৎ বীরেন্দ্রনারায়ণ দাঁড়িয়ে, পিছন ফিরে সন্দেহজনক চোখে এক বার তাকালেন। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয় কিনু, ছেলেটা বদ্ধ পাগল-টাগল নয় তো? তোমাদের ভয়-টয় করছে না তো?
কিরণ বললেন, না না, কী যে বলো! কী রকম দুঃখী আর শান্ত মুখখানি ওর, দেখলে না?
বীরেন্দ্রনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, দেখিনি আবার। দেখলাম বলেই তো তোমার কাছে নিয়ে এলাম। দ্যাটস অল রাইট, আমি চলি।
দুপাশের দেওয়ালে ঠক ঠক শব্দ তুলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। কিরণ হাসি মুখে স্বামীর চলার পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। যেন তিনি একটি প্রাণখোলা চঞ্চল ছেলেমানুষকে দেখছেন, এমন একটি নিবিড় স্নেহ ও প্রেমের ছায়া নেমে এল তাঁর চোখে। অথচ বাইরে থেকে বীরেন্দ্রনারায়ণের রাশভারী গম্ভীর চেহারা দেখে সকলেই তাঁকে ভয়ের চোখে দ্যাখে। মুখের সামনে কথা বলতেই অনেকে ভরসা পায় না। কিরণ ভাবেন, বাইরের লোকে ওকে কতটুকুই বা জানে, কতটুকু বা বোঝে। বাইরে একটা ভঙ্গির মুখোশ নিয়ে ওঁকে চলতে হয় বটে, কিন্তু যে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, অতি দুর্দশা থেকে যিনি সম্মানে বিত্তে বৈভবে অনেক উঁচুতে উঠেছেন, তাঁর অনেক শত্রু থাকে বটে, কিন্তু তিনি নিজেকে কখনও ভোলেন না। অনেকে ভোলেও বটে, তাদের দেখলেই চেনা যায়, কিন্তু কিরণ বিশ্বাস করেন, তাঁর স্বামীর মধ্যে সেই সৎ কাজপাগলা পরোপকারী মানুষটি সম্পূর্ণ বর্তমান।
তিনি তাড়াতাড়ি আবার ঘরের দিকে ফিরে গেলেন।