Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শীতকালের দিকে একদিন কলেজ ইউনিয়নে প্রণব একটা প্রবন্ধ পাঠ করিল। ইংরেজিতে লেখা, বিষয়–আমাদের সামাজিক সমস্যা; বাছিয়া বাছিয়া শক্ত ইংরেজিতে সে নানান সমস্যার উল্লেখ করিয়াছে; বিধবা-বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি। সে প্রত্যেক সমস্যাটি নিজের দিক হইতে দেখিতে চাহিয়াছে এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সনাতন প্রথার স্বপক্ষে মত দিয়াছে। প্রণবের উচ্চারণ ও বলিবার ভঙ্গি খুব ভালো, যুক্তির ওজন অনুসারে সে কখনও ডান হাতে ঘুষি পাকাইয়া, কখনও মুঠাদ্বারা বাতাস আঁকড়াইয়া, কখনও বা সম্মুখের টেবিলে সশব্দে চাপড় মারিয়া বাল্যবিবাহের প্রয়োজনীয়তা ও স্ত্রীশিক্ষার অসারত্ব প্রমাণ করিয়া দিল। প্রণবের বন্ধুদলের ঘন ঘন করতালিতে প্রতিপক্ষের কানে তালা লাগিবার উপক্রম হইল।

অপর পক্ষে উঠিল মন্মথ-সেই যে-ছেলেটি পূর্বে সেন্ট জেভিয়ারে পড়িত। লাটিন জানে বলিয়া ক্লাসে সকলে তাহাকে ভয় করিয়া চলে, তাহার সামনে কেহ ভয়ে ইংরেজি বলে না, পাছে ইংরেজির ভুল হইলে তাহার বিদ্রুপ শুনিতে হয়। সাহেবদের চালচলন, ডিনারের এটিকেট, আচারব্যবহার সম্বন্ধে ক্লাসের মধ্যে সে অথরিটি—তাহার উপর কারুর কথা খাটে না। ক্লাসের এক হতভাগ্য ছাত্র সাহেবপাড়ার কোন রেস্তোরাতে তাহার সহিত খাইতে গিয়া ডান হাতে কাটা ধরিবার অপরাধে এক সপ্তাহকাল ক্লাসে, সকলের সামনে মন্মথর টিটকারি সহ্য করে। মন্মথর ইংরেজি আরও চোখা, কম আড়ষ্ট, উচ্চারণও সাহেবি ধরনের। কিন্তু একেই তাহার উপর ক্লাসের অনেকের রাগ আছে, এদিকে আবার সে বিদেশী বুলি আওড়াইয়া সনাতন হিন্দুধর্মের চিরাচরিত প্রথার নিন্দাবাদ করিতেছে; ইহাতে একদল ছেলে খুব চটিয়া উঠিল—চারিদিক হইতে shame shame.withdraw, withdraw, রব উঠিল—তাহার নিজের বন্ধুদল প্রশংসাসূচক হাততালি দিতে লাগিল-ফলে এত গোলমালের সৃষ্টি হইয়া পড়িল যে, মন্মথ বক্তৃতার শেষের দিকে কি বলিল সভার কেহই তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারিল না।

প্রণবের দলই ভারী। তাহারা প্রণবকে আকাশে তুলিল, মন্মথকে স্বধর্মবিরোধী নাস্তিক বলিয়া গালি দিল, সে যে হিন্দুশাস্ত্র একছত্রও না পড়িয়া কোন্ স্পর্ধায় বর্ণাশ্রম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সভায় কথা বলিতে সাহস করিল, তাহাতে কেহ কেহ আশ্চর্য হইয়া গেল। লাটিন-ভাষার সহিত তাহার পরিচয়ের সত্যতায়ও দু-একজন তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিল (লাটিন জানে বলিয়া অনেকের রাগ ছিল তাহার উপর)। একজন দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,-প্রতিপক্ষের বক্তার সংস্কৃতে যেমন অধিকার, যদি তাঁহার লাটিন ভাষার অধিকারও সেই ধরনের

আক্ৰমণ ক্রমেই ব্যক্তিগত হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া সভাপতি-অর্থনীতির অধ্যাপক মিঃ দে বলিয়া উঠিলেন-Come, Come, Manmatha has never said that he is a Seneca or a Lucretius-have the goodness to come to the point.

অপু এই প্রথম এরকম ধরনের সভায় যোগ দিল–স্কুলে এসব ছিল না, যদিও হেডমাস্টার প্রতিবারই হইবার আশ্বাস দিতেন। এখানে এদিনকার ব্যাপারটা তাহার কাছে নিতান্ত হাস্যাস্পদ ঠেকিল। ওসব মামুলি কথা মামুলিভাবে বলিয়া লাভ কি? সামনের অধিবেশনে সে নিজে একটা প্রবন্ধ পড়িবে। সে দেখাইয়া দিবে-ওসব একঘেয়ে মামুলি বুলি না আওড়াইয়া কি ভাবে প্রবন্ধ লেখা যায়। একেবারে নূতন এমন বিষয় লইয়া সে লিখিবে, যাহা লইয়া কখনও কেহ আলোচনা করে নাই।

এক সপ্তাহ খাটিয়া প্রবন্ধ লিখিয়া ফেলিল। নাম-নূতনের আহ্বান; সকল বিষয়ে পুরাতনকে ছাটিয়া একেবারে বাদ। কি আচার-ব্যবহার, কি সাহিত্য, কি দেখিবার ভঙ্গি—সব বিষয়েই নুতনকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। অপু মনে মনে অনুভব করে, তাহার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যাহা খুব বড়ো, খুব সুন্দর। তাহার উনিশ বৎসরের জীবনের প্রতিদিনের সুখদুঃখ, পথের যে-ছেলেটি অসহায়ভাবে কাঁদিয়া উঠিয়াছে, কবে এক অপরাহের ম্লান আলোয় যে পাখিটা তাহাদের দেশের বনের ধারে বসিয়া দোল খাইত, দিদির চোখের মমতা-ভরা দৃষ্টি, লীলার বন্ধুত্ব, রানুদি, নির্মলা, দেবব্রত, রৌদ্রদীপ্ত নীলাকাশ, জ্যোৎস্না রাত্রি নানা কল্পনার টুকরা, কত কি আশা-নিরাশাব লুকোচুরি—সবসুদ্ধ লইয়া এই যে উনিশটি বৎসর—ইহা তাহার বৃথা যায় নাই—কোটি কোটি যোজন দূর শূন্যপার হইতে সূর্যের আলো যেমন নিঃশব্দ জ্যোতির অবদানে শীর্ণ শিশু-চারাকে পত্রপুস্পফলে সমৃদ্ধ করিয়া তলে, এই উনিশ বৎসরের জীবনের মধ্য দিয়া শাশ্বত অনন্ত তেমনি ওর প্রবধমান তরুণ প্রাণে তাহার বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছে—ছায়ান্ধকার তৃণভূমির গন্ধে, ডালে ডালে সোনার সিঁদুর-মাখানো অপরুপ সন্ধ্যায়; উদার কল্পনায় ভরপুর নিঃশব্দ জীবনমায়ায়।—সে একটা অপূর্ব শক্তি অনুভব করে নিজের মধ্যে—এটা যেন বাহিরে প্রকাশ করিবার জিনিস-মনে-মনে ধরিয়া রাখার নয়। কোথায় থাকিবে প্রণব আর মন্মথ?…সবাই মামুলি কথা বলে। সক বিষয়ে এই মামুলি ধরন যেন তাহাদের দেশের একচেটে হইয়া উঠিতেছে—যেমন গরুড়ের মতো ডিম ফুটিয়া বাহির হইয়া সারা পৃথিবীটার রসভাণ্ডার গ্রাস করিতে ছুটিতেছে, সে তীব্র আগ্রহ ভরা পিপাসার্ত নবীন মনের সকল কানা তাহাতে তৃপ্ত হয় না। ইহারই বিরুদ্ধে, ইহাদের সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইবে, সব ওলট-পালট করিয়া দিবার নিমিত্ত সঙ্ঘবদ্ধ হইতে হইবে তাহাদিগকে এবং সে-ই হইবে তাহার অগ্রণী।

দিন কতক ধরিয়া অপু ক্লাসে ছেলেদের মধ্যে তাহার স্বভাবসিদ্ধ ধরনে গর্ব করিয়া বেড়াইল যে, এমন প্রবন্ধ পড়িবে যাহা কেহ কোনদিন লিখিবার কল্পনা করে নাই, কেহ কখনও শোনে নাই ইত্যাদি। লজিকের ঘোকরা-প্রোফেসার ইউনিয়নের সেক্রেটারি, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি বলে নোটিশ দেবো তোমার প্রবন্ধের হে, বিষয়টা কি?

পরে নাম শুনিয়া হাসিয়া বলিলেন,-বেশ, বেশ! নামটা বেশ দিয়েছ—but why totপুরাতনের বাণী? অপু হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিল। নির্দিষ্ট দিনে যদিও ভাইস-প্রিন্সিপ্যালের সভাপতি হইবার কথা নোটিশে ছিল, তিনি কাৰ্যবশত আসিতে পারিলেন না। ইতিহাসের অধ্যাপক মিঃ বসুকে সভাপতির আসনে বসিতে সকলে অনুরোধ করিল। ভিড় খুব হইয়াছে, প্রকাশ্য সভায় অনেক লোকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিছু করা অপুর এই প্রথম। প্রথমটা তাহার পা কাঁপিল, গলাও খুব কাঁপিল, কিন্তু ক্ৰমে বেশ সহজ হইয়া আসিল। প্রবন্ধ খুব সতেজ-এ বয়সে যাহা কিছু দোষ থাকে—উচ্ছাস, অনভিজ্ঞ আইডিয়ালিজম-ভালো মন্দ নির্বিশেষে পুরাতনকে ছাঁটিয়া ফেলিবার দম্ভ-বেপরোয়া সমালোচনা, তাহার প্রবন্ধে কোনটাই বাদ যায় নাই। প্রবন্ধ পড়িবার পরে খুব হৈ-চৈ হইল। খুব তীব্র সমালোচনা হইল। প্রতিপক্ষ কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিতে ছাড়িল না। কিন্তু অপু দেখিল অধিকাংশ সমালোচকই ফাঁকা আওয়াজ করিতেছে। সে যাহা লইয়া প্রবন্ধ লিখিয়াছে, সে বিষয়ে কাহারও কিছু অভিজ্ঞতাও নাই, বলিবার বিষয়ও নাই, তাহারা তাহাকে মন্মথর শ্রেণীতে ফেলিয়া দেশদ্রোহী, সমাজদ্রোহী বলিয়া গালাগালি দিতে শুরু করিয়াছে।

অপু মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। হয়তো সে আরও পরিস্ফুট করিয়া লিখিলে ভালো করিত। জিনিসটা কি পরিষ্কার হয় নাই? এত বড়ো সভার মধ্যে তাহার নিতান্ত অন্তরঙ্গ দু-একজন বন্ধু ছাড়া সকলেই তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছে,টিটকারি গালাগালি অংশের জন্য মন্মথকে হিংসা করার তাহার কিছুই নাই। শেষে সভাপতি তাহাকে প্রতিবাদের উত্তর দিবার অধিকার দেওয়াতে সে উঠিয়া ব্যাপারটা আরও খুলিয়া বলিবার চেষ্টা করিল। দু-চারজন সমালোচক—যাহাদের প্রতিবাদ সে বসিয়া নোট করিয়া লইয়াছিল, তাহাদিগকে উত্তর দিতে গিয়া যুক্তির খেই হারাইয়া ফেলিল। অপর পক্ষ এই অবসরে আর এক পালা হাসিয়া লইতে ছাড়িল না। অপু রাগিয়া গিয়াছিল, এইবার যুক্তির পথ না ধরিয়া উচ্ছাসের পথ ধরিল। সকলকে সংকীর্ণমনা বলিয়া গালি দিল, একটা বিদ্রুপাত্মক গল্প বলিয়া অবশেষে টেবিলের উপর একটা কিল মারিয়া এমার্সনের একটা কবিতা আবৃত্তি করিতে করিতে বক্তৃতার উপসংহার করিল।

ছেলেদের দল খুব গোলমাল করিতে করিতে হলের বাহির হইয়া গেল। বেশির ভাগ ছেলে তাহাকে যা তা বলিতেছিল নিছক বিদ্যা জাহির করিবার চেষ্টা ছাড়া তাহার প্রবন্ধ যে অন্য কিছুই নহে, ইহাও অনেকের মুখে শোনা যাইতেছে। সে শেষের দিকে এমার্সনের এই কবিতাটি আবৃত্তি করিয়াছিল—

I am the owner of the sphere
Of the seven stars and the solar year.

তাহাতেই অনেকে তাহাকে দাম্ভিক ঠাওরাইয়া নানারূপ বিদ্রুপ ও টিটকারি দিতেও ছাড়িল। কিন্তু অপু ও-কবিতাটায় নিজেকে আদৌ উদ্দেশ করে নাই, যদিও তাহার নিজেকে জাহির করার স্পৃহাও কিছু কম ছিল না বা মিথ্যা গর্ব প্রকাশে সে ক্লাসের কাহারও অপেক্ষা কম নহে, বরং বেশি।

তাহার নিজের দলের কেহ কেহ তাহাকে ঘিরিয়া কথা বলিতে বলিতে চলিল। ভিড় একটু কমিয়া গেলে সে সকলের নিকট হইতে বিদায় লইয়া কলেজ হইতে বাহির হইতে যাইতেছিল, গেটের কাছে একটি সতেরো-আঠারো বছরের লাজুক প্রকৃতির ছেলে তাহাকে বলিল—একটুখানি দাঁড়াবেন?

অপু ছেলেটিকে চেনে না, কখনও দেখে নাই। একহারা, বেশ সুশ্রী, পাতলা সিল্কের জামা গায়ে, পায়ে জরির নাগরা জুতা।

ছেলেটি কুষ্ঠিতভাবে বলিল,-আপনার প্রবন্ধটা আমায় একটু পড়তে দেবেন? কাল আবার আপনাকে ফেরত দেব।

অপুর আহত আত্মাভিমান পুনরায় হঠাৎ ফিরিয়া আসিল। খাতাখানা ছেলেটির হাতে দিয়া বলিল,-দেখবেন কাইন্ডলি, যেন হারিয়ে না যায়—আপনি বুঝি-সায়েন্স-ও।

পরদিন কলেজ বসিবার সময় ছেলেটি গেটেই দাঁড়াইয়াছিল—-অপুর হাতে খাতাখানা ফিরাইয়া দিয়া ছোট একটি নমস্কার করিয়াই ভিড়ের মধ্যে কোথায় চলিয়া গেল। অন্যমনস্ক ভাবে ক্লাসে বসিয়া অপু খাতাখানা উলটাইতেছিল, একখানা কি কাগজ খাতাখানার ভিতর হইতে বাহির হইয়া ইলেকট্রিক পাখার হাওয়ায় খানিকটা উড়িয়া গেল। পাশের ছেলেটি সেখানা কুড়াইয়া তাহার হাতে দিলে সে পড়িয়া দেখিল, পেন্সিলে লেখা একটি কবিতা–তাহাকে উদ্দেশ করিয়া–

শ্ৰীযুক্ত অপূর্বকুমার রায়

করকমলেষু–

বাঙ্গালী সমাজ যেন পঙ্কময় বদ্ধ জলাশয়
নাহি আলো স্বাস্থ্যভরা, বহে হেথা বায়ু বিষময়
জীবন-কোরকগুলি, অকালে শুকায়ে পড়ে ঝরি,
বাঁচাবার নাহি কেহ, সকলেই আছে যেন মরি।
নাহি চিন্তা, নাহি বুদ্ধি, নাহি ইচ্ছা, নাহি উচ্চ আশা,
সুখদুঃখহীন এক জড়পিণ্ড, নাহি মুখে ভাষা।
এর মাঝে দেখি যবে কোনো মুখ উজ্জ্বল সরল,
নয়নে আশার দৃষ্টি, ওষ্ঠপ্রান্তে জীবন হরষ–
অধরে ললাটে ভূতে প্রতিভার সুন্দর বিকাশ,
স্থির দৃঢ় কণ্ঠস্বরে ইচ্ছাশক্তি প্রত্যক্ষ প্রকাশ,
সম্ভমে হৃদয় পুরে আনন্দ ও আশা জাগে প্রাণে,
সম্ভাষিতে চাহে হিয়া বিমল প্রীতির অর্ঘ্যদানে।
তাই এই ক্ষীণ-ভাষা ছন্দে গাঁথি দীন উপহার
লজ্জাহীন অসংকোচে আনিয়াছি সম্মুখে তোমার,
উচ্চলক্ষ্য, উচ্চআশা বাঙ্গালায় এনে দাও বীর
সুযোগ্য সন্তান যে রে তোরা সবে বঙ্গ-জননীর।

গুণমুগ্ধ

শ্রী–

ফার্স্ট ইয়ার, সায়েন্স, সেকশন বি।

অপু বিস্মিত হইল। আগ্রহের ও ঔৎসুক্যের সহিত আর একবার পড়িল—তাহাকে উদ্দেশ করিয়া লেখা এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। একে চায় তো আরে পায়,—একেই নিজের কথা পরকে জাক করিয়া বেড়াইতে সে অদ্বিতীয়, তাহার উপর তাহারই উদ্দেশে লিখিত এক অপরিচিত ছাত্রের এই পত্র পাইয়া আনন্দে ও বিস্ময়ে সে ভুলিয়া গেল যে, ক্লাসে স্বয়ং মিঃ বসু ইতিহাসের বক্তৃতায় কোন এক রোমান সম্রাটের অমানুষিক ঔদরিকতার কাহিনী সবিস্তারে বলিতেছেন। সে পাশের ছেলেকে ডাকিয়া পত্ৰখানা দেখাইতে যাইতেই জানকী খোঁচা দিয়া বলিল,—এই! সি.সি.বি. এক্ষুনি শকে উঠবে—তোর দিকে তাকাচ্ছে, সামনে চা—এই!

আঃ—কতক্ষণে সি.সি.বি.-র এই বাজে বকুনি শেষ হইবে! বাহিরে গিয়া সকলকে চিঠিখানা দেখাইতে পারিলে যে সে বাঁচে।—ছেলেটিকেও খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।

ছুটির পর গেটের কাছেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা হইল। বোধ হয় সে তাহারই অশ্বক্ষায় দাঁড়াইয়াছিল। কলেজের মধ্যে এইরূপ একজন মুগ্ধ ভক্ত পাইয়া অপু মনে মনে গর্ব অনুভব করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেই তাহার পুরাতন মুখচোরা লোগ! তবে তাহার পক্ষে একটু সাহসের বিষয় এই দাঁড়াইল যে, ছেলেটি তাহার অপেক্ষাও লাজুক। অপু গিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া তাহার হাত ধরিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হইল। কেহই কাগজে লেখা পদ্যটার কোনও উল্লেখ করিল না, যদিও দুজনেই বুঝিল যে, তাহাদের আলাপের মূলে কালকের সেই চিঠিখানা। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি বলিল-চলুন কোথাও বেড়াতে যাই, কলকাতার বাইরে কোথাও মাঠে–শহরের মধ্যে হাঁপ ধরে—কোথাও একটা ঘাস দেখবার জো নেই—

কথাটা শুনিয়াই অপুর মনে হইল, এ ছেলেটি তো সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির। ঘাস না দেখিয়া কষ্ট হয় এমন কথা তো আজ প্রায় এক বৎসর কলিকাতার অভিজ্ঞতায় কলেজের কোন বন্ধুর মুখে শোনে নাই।

সাউথ সেকশনের ট্রেনে গোটাচারেক স্টেশন পরে তাহারা নামিল। অপু কখনও এদিকে আসে নাই। ফাঁকা মাঠ, কেয়া বোপ, মাঝে মাঝে হোগলা বন। সরু মেঠো পথ ধরিয়া দুজনে হাঁটিয়া চলিতেছিল-ট্রেনের অল্প আধঘণ্টার আলাপেই দুজনের মধ্যে একটা নিবিড় পরিচয় জমিয়া উঠিল। মাঠের মধ্যে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপরে দুজনে গিয়া বসিল।

ছেলেটি নিজের ইতিহাস বলিতেছিল–

হাজারিবাগ জেলায় তাহাদের এক অদ্রের খনি ছিল, ছেলেবেলায় সে সেখানেই মানুষ। জায়গাটার নাম বড়বনী, চারিধারে পাহাড় আর শাল-পলাশের বন, কিছু দূরে দারুকের নদী। নিকট পাহাড়ের গায়ে একটা ঝরনা…পড়ন্ত বেলায় শালবনের পিছনের আকাশটা কত কি রঙে রঞ্জিত হইত-প্রথম বৈশাখে শাল-কুসুমের ঘন সুগন্ধ দুপুরে রৌদ্রকে মাতাইত, পলাশবনে বসন্তের দিনে যেন ডালে ডালে আরতির পঞ্চপ্রদীপ জ্বলিত-সন্ধ্যার পরই অন্ধকারে গা ঢাকিয়া বাঘেরা আসিত ঝরনার জল পান করিতে—বাংলো হইতে একটু দূরে বালির উপর কতদিন সকালে বড়ো বড়ো বাঘের পায়ের থাবার দাগ দেখা গিয়াছে।

সেখানকার জ্যোৎস্না রাত্রি! সে রাত্রির বর্ণনা নাই, ভাষা জোগায় না। স্বর্গ যেন দূরের নৈশকুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণীর ওপারে–ছায়াহীন, সীমাহীন, অনন্তরসক্ষরা জ্যোৎস্না যেন দিকচক্রবালে তাহারই ইঙ্গিত দিত।

এক-আধদিন নয়, শৈশবের দশ-দশটি বৎসর সেখানে কাটিয়াছে। সে অন্য জগৎ, পৃথিবীর মুক্ত প্রসারতার রুপ সেখানে চোখে কি মায়া-অঞ্জন মাখাইয়া দিয়াছে—কোথাও আর ভালো লাগে না! অভ্রের খনিতে লোকসান হইতে লাগিল, খনি অপরে কিনিয়া লইল, তাহার পর হইতেই কলিকাতায়। মন হাঁপাইয়া উঠে-খাঁচার পাখির মতো ছটফট করে। বাল্যের সে অপূর্ব আনন্দ মন হইতে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে।

অপু এ ধরনের কথা কাহারও মুখে এ পর্যন্ত শোনে নাই—এ যে তাহারই অন্তরের কথার প্রতিধ্বনি। গাছপালা, নদী, মাঠ ভালোবাসে বলিয়া দেওয়ানপুরে তাহাকে সবাই বলিত পাগল। একবার মাঘ মাসের শেষে পথে কোন গাছের গায়ে আলোকলতা দেখিয়া রমাপতিকে বলিয়াছিল, কেমন সুন্দর! দেখুন দেখুন রমাপতিদা–

রমাপতি মুরুব্বিয়ানার সুরে বলিয়াছিল মনে আছে—ওসব যার মাথায় ঢুকেছে তার পরকালটি একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে।

পরকালটা কি জন্য যে ঝরঝরে হইয়া গিয়াছে, একথা সে বুঝিতে পারে নাই—কিন্তু ভাবিয়াছিল রমাপতিদা স্কুলের মধ্যে ভালো ছেলে, ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র, অবশ্যই তাহার অপেক্ষা ভালো জানে। এ পর্যন্ত কাহারও নিকট হইতেই সে ইহার সায় পায় নাই, এই এতদিন পরে ইহাকে ছাড়া। তাহা হইলে তাহার মতো লোকও আছে!…সে একেবারে সৃষ্টিছাড়া নয়!…

অনিল বলিল-দেখুন, এই এত ছেলে কলেজে পড়ে, অনেকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি ভালো লাগে না—dull, unimaginative mind, পড়তে হয় পড়ে যাচ্ছে, বিশেষ কোন বিষয়ে কৌতূহলও নেই, জানবার একটা সত্যিকার আগ্রহও নেই। তাছাড়া এত হোট কথা নিয়ে থাকে যে, মন মোটে-মানে, কেমন যেন,—যেন মাটির উপর hop করে বেড়ায়। প্রথম সেদিন আপনার কথা শুনে মনে হল, এই একজন অন্য ধরনের, এ দলের নয়।

অপু মৃদু হাসিয়া চুপ করিয়া রহিল। এসব সে-ও নিজের মনের মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করিয়াছে, অপরের সঙ্গে নিজের এ পার্থক্য মাঝে মাঝে তাহার কাছে ধরা পড়িলেও সে নিজের সম্বন্ধে আদৌ সচেতন নয় বলিয়া এ জিনিসটা বুঝিতে পারিত না। তাহা ছাড়া অপুর প্রকৃতি আরও শান্ত, উগ্রতাশূন্য ও উদার,—পরের তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণের ধাতই নাই তাহার একেবারে। কিন্তু তাহার একটা মহৎ দোষ এই যে নিজের বিষয়ে কথা একবার পাড়িলে সে আর ছাড়িতে চায় না—অপরেও যে নিজেদের সম্বন্ধে বলিতে ইচ্ছা করিতে পারে, তরুণ বয়সের অনাবিল আত্মম্ভরিতা ও আত্মপ্রত্যয় সে বিষয়ে তাহাকে অন্ধ করিয়া রাখে। সুতরাং সে নিজের বিষয়ে একটানা কথা বসিয়া যায় নিজের ইচ্ছা, আশা-আকাঙক্ষা, নিজের ভালোমন্দ লাগা, নিজের পড়াশুনা। নিজের কোন দুঃখদুর্দশার কথা বলে না, কোন ব্যথা-বেদনার কথা তোলে না-জলের উপরকার দাগের মতো সেসব কথা তাহার মনে মোটে স্থান পায় না। আনকোরা তাজা নবীন চোখের দৃষ্টি শুধুই সম্মুখের দিকে, সম্মুখের বহুদূর দিকচক্রবাল রেখারও ওপারে—আনন্দ ও আশায় ভরা এক অপূর্ব রাজ্যের দিকে।

সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরিয়া চিমনি-ভাঙা পুরোনো হিক্কসের লণ্ঠনটা জ্বালিয়া সে পকেট হইতে অনিলের চিঠিখানা বাহির করিয়া আবার পড়িতে বসিল। আমায় যে ভালো বলে, সে আমার পরম বন্ধু, আমার মহৎ উপকার করে, আমার আত্মপ্রত্যয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে সাহায্য করে, আমার মনের গভীর গোপন কোনও সুকানো রতুকে দিনের আলোয় মুখ দেখাইতে সাহস দেয়।

পড়িতে পড়িতে পাশের বিছানার দিকে চাহিয়া মনে পড়ে—আজ আবার তাহার ঘরের অপর লোকটির এক আত্মীয় কাঁচরাপাড়া হইতে আসিয়াছে এবং এই ঘরেই শুইবে। সে আত্মীয়টির বয়স বছর ত্রিশেক হইবে; কাঁচরাপাড়া লোকো অফিসে চাকরি করে, বেশি লেখাপড়া না জানিলেও অনবরত যা-তা ইংরেজি বলে, হরদম সিগারেট খায়, অত্যন্ত বকে, অকারণে গায়ে পড়িয়া ভাই ভাই বলিয়া কথা বলে, তাহার মধ্যে বারো আনা থিয়েটারের গল্প, অমুক অ্যাকট্রেস তারাবাঈ-এর ভূমিকায় যে রকম অভিনয় করে, অমুক থিয়েটারের বিধুমুখীর মতো গান—বিশেষ করিয়া হীরার দুল প্রহসনে বেদেনীর ভূমিকায়, নয়ন জলের ফাঁদ পেতেছি নামক সেই বিখ্যাত গানখানি সে যেমন গায়, তেমন আর কোথায়, কে গাহিতে পারে?—তিনি এজন্য বাজি ফেলিতে প্রস্তুত আছেন।

এসব কথা অপুর ভালো লাগে না, থিয়েটারের কথা শুনিতে তাহার কোনও কৌতূহল হয় না। এ লোকটির চেয়ে আলুর ব্যবসাদারটি অনেক ভালো। সে পাড়াগাঁইয়ের লোক, অপেক্ষাকৃত সরল প্রকৃতির, আর এত বাজে কথা বলে না; অন্তত তাহার সঙ্গে তো নয়ই। এ ব্যক্তিটির যত গল্প তাহার সঙ্গে।

মনে মনে ভাবে—একটু ইচ্ছে করে—বেশ একা একটি ঘর হয়, একা বসে পড়াশুনো করি, টেবিল থাকে একটা, বেশ ফুল কিনে এনে গ্লাসের জলে দিয়ে সাজিয়ে রাখি। এ ঘরটায় না আছে জানালা, পড়তে পড়তে একটু খোলা আকাশ দেখবার জো নাই, তামাকের গুল রোজ পরিষ্কার করি, আর রোজ ওরা এইরকম নোংরা করবে—মা ওয়াড় করে দিয়েছিল, ছিড়ে গিয়েছে, কি বিশ্রী তেলচিটচিটে বালিশটা হয়েছে। এবার হাতে পয়সা হলে একটা ওয়াড় করব।

অনিলের সঙ্গে পরদিন বৈকালে গঙ্গার ধারে বেড়াইতে গেল। চাদপাল ঘাটে, প্রিন্সেপ ঘাটে বড়ো বড়ো জাহাজ নোঙর করিয়া আছে, অপু পড়িয়া দেখিল : কোনটার নাম বম্বে, কোনটা নাম ইদজ্জু মারু। সেদিন বৈকালে নতুন ধরনের রং-করা একখানা বড় জাহাজ দেখিয়াছিল, নাম লেখা আছে শেনানডোয়া, অনিল বলিল, আমেরিকান মাল জাহাজ-জাপানের পথে আমেরিকায় যায়। অপু অনেক শ দাঁড়াইয়া জাহাজখানি দেখিল। নীল পোশাক পরা একটা লস্কর রেলিং ধরিয়া কিয়া পরা কালের মধ্যে কি দেখিতেছে। লোকাট কি সুখী। কত দেশবিদেশে বেড়ায়, কত সমুদ্রে পাড়ি দেয়, চীন সমুদ্রে টাইফুনে পড়িয়াছে, পিনাং-এর নারিকেলকুগের গুয়ায় কত দুপুর কাটাইয়ারে কত ঝড়বৃষ্টির মাত্র এই রকম রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া বাত্যা, উত্তাল, উন্মত্ত মহাসমুদ্রের রুপ দেখিয়াহে। কি ও লোকটা বোৰে কি? কিছুই না। ও কি দূর হইতে ফুজিয়ামা দেখিয়া আত্মহারা হইয়াছে? দক্ষিণ আমেরিকার কোনও বন্দরে নামিয়া পথের ধারে কি গাছপালা আছে তাহা নিবিষ্ট মনে সাগ্রহে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে? হয়তো জাপানের পথের ধারে বাংলা দেশের পরিচিত কোনও ফুল আছে, ও লোকটি জানে না, হয়তো ক্যালিফোর্নিয়ার শহরবন্দর হইতে দূরে নির্জন Sierra-র ঢালুতে বনঝোপের নানা অচেনা ফুলের সঙ্গে তাহাদের দেশের সন্ধ্যামণি ফুলও ফুটিয়া থাকে, ও লোকটা কি কখনও সেখানে সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় বড়ো একখণ্ড পাথরের উপর আপন মনে বসিয়া নীল আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিয়াছে?

অথচ ও লোকটারই অদৃষ্টে ঘটিতেছে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, সমুদ্রে-সমুদ্রে বেড়ানোযাহার চোখ নাই, দেখিতে জানে না; আর সে যে শৈশব হইতে কত সাধ পুষিয়া রাখিয়া আসিতেছে মনের কোণে, তাহার কি কিছুই হইবে না? …কবে যে সে যাইবে! …কলিকাতার শীতের রাত্রের এ ধোঁয়া তাহার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। চোখ জ্বালা করে, নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে, কিছু দেখা যায় না, মন তাহার একেবারে পাগল হইয়া ওঠে—এ এক অপ্রত্যাশিত উপদ্রব! কে জানিত শীতকালে কলিকাতার এ চেহারা হয়।

ওই লোকটার মতো জাহাজের খালাসী হইতে পারিলেও সুখ ছিল!
Ship ahoy! …কোথাকার জাহাজ?…
কলিকাতা হইতে পোর্ট মর্সবি, অস্ট্রেলেশিয়া,
ওটা কি উঁচুমতো দুরে?

প্রবালের বড়ো বাঁধThe Great Barrier Reef–

এই সমুদ্রের ঠিক এই স্থানে, প্রাচীন নাবিক টাসম্যান ঘোর তুফানে পড়িয়া মাস্তুল ভাঙা পালহেঁড়া ডুবু ডুবু অবস্থায় অকূলে ভাসিতে ভাসিতে বারো দিনের দিন কুল দেখিতে পান সেইটাই—সেকালে ভ্যান ডিমেনল্যান্ড, বর্তমানে টাসমেনিয়া।…কেমন দূরে নীল চক্রবালরেখা!…উড়ন্ত সিন্ধু-শকুনদলের মাতামাতি, প্রবালের বাঁধের উপর বড়ো বড় ঢেউয়ের সবেগে আছড়াইয়া পড়ার গম্ভীর আওয়াজ।

উপকূলরেখার অনেক পিছনে যে পাহাড়টা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, ওটা হয়তো জলহীন দিক-দিশাহীন ধু ধু নির্জন মরুর মধ্যে…শুধুই বালি আর শুকনা বাবুল গাছের বন,…শত শত ক্রোশ দূরে ওর অজানা অধিত্যকায় লুকানো আছে সোনার খনি, কালো ওপ্যালের খনি…এই খর, জ্বলন্ত, মরুরৌদ্রে খনির সন্ধানে বাহির হইয়া কত লোক ওদিকে গিয়াছিল আর ফেরে নাই, মরুদেশের নানা স্থানে তাহাদের হাড়গুলা রৌদ্রে বৃষ্টিতে ক্ৰমে সাদা হইয়া আসিল।

অনিল বলিল, চলুন, আজ সন্ধে হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাহাজ দেখে আর কি হবে?…

অপু সমুদ্র-সংক্রান্ত বহু বই কলেজ লাইব্রেরি হইতে পড়িয়া ফেলিয়াছে! কেমন একটা নেশা, কখনও কোন ছাত্র যাহা পড়ে না, এমন সব বই। বহু প্রাচীন নাবিক ও তাহাদের জলযাত্রার বৃত্তান্ত, নানা দেশ আবিষ্কারের কথা, সিবাস্টিয়ান ক্যাবট, এরিকসন, কটেজ ও পিজারো কর্তৃক মেক্সিকো ও পেরু বিজয়ের কথা। দুর্ধর্ষ স্পেনীয় বীর পিজারো ব্রেজিলের জঙ্গলে রুপার পাহাড়ের অনুসন্ধানে গিয়া কি করিয়া জঙ্গলের মধ্যে পথ হারাইয়া বেঘোরে অনাহারে সসৈন্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইল—আরও কত কি।

পরদিন কলেজ পালাইয়া দু-জনে দুপুরবেলা স্টান্ড রোডের সমস্ত স্টিমার কোম্পানির অফিসগুলি ঘুরিয়া বেড়াইল। প্রথমে পি. এভ, ও.। টিফিনের সময় কেরানীবাবুরা নিচের জলখাবার ঘরে বসিয়া চা খাইতেছেন, কেহ বিড়ি টানিতেছেন। অপু পিছনে রহিল, অনিল আগাইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—আচ্ছে, আমরা জাহাজে চাকরি খুত্ষজছি, এখানে খালি আছে জানেন?

একজন ঢাক-পড়া নোগা চেহারার বাবু বলিলেন,চাকরি? জাহাজে…কোন জাহাজে?

-যে কোন জাহাজে–

অপুর বুক উত্তেজনায় ও কৌতূহলে টিপ টিপ করিতেছিল, কি বুঝি হয়।

বাবুটি বলিলেন, জাহাজের চাকরিতে তোমাদের চলবে না হে হোকরা-দ্যাখো, একবার ওপরে মেরিন মাস্টারের ঘরে খোঁজ করো।

কিছুই হইল না। বি.আই.এস.এন তথৈবচ। নিপইউশেনকাইশাও তাই! টার্নার মরিসনের অফিসে তাহাদের সহিত কেহ কথাও কহিল না। বড়ো বড়ো বাড়ি, সিঁড়ি ভাঙিয়া ওঠানামা করিতে করিতে শীতকালেও ঘাম দেখা দিল। অবশেষে, মরীয়া হইয়া অপু গ্লাডস্টোন ওয়াইলির অফিসে চারতলায় উঠিয়া মেরিন মাস্টারের কামরায় ঢুকিয়া পড়িল। খুব দীর্ঘদেহ, অত বড়ো গোঁফ সে কখনও কাহারও দেখে নাই। সাহেব বিরক্ত হইয়া ঘণ্টা বাজাইয়া কাহাকে ডাক দিল। অপুর কথা কানেও তুলিল না। একজন প্রৌঢ় বয়সের বাঙালিবাবু ঘরে ঢুকিয়া ইহাদের দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—এ ঘরে কি? এসো, এসো, বাইরে এসো।

বাহিরে গিয়া অনিলের মুখে আসিবার উদ্দেশ্য শুনিয়া বলিলেন, কেন হে ছোকরা? বাড়ি থেকে রাগ করে পালাচ্ছ?

অনিল বলিল-না রাগ করে কেন পালাব?

-রাগ করে পালাচ্ছ না তো, এ মতি হল কেন? জাহাজে চাকরি খুঁজছে–কোন্ চাকরি হবে জানো? খালাসির চাকরি…এক বছরের এগ্রিমেন্টে জাহাজে উঠতে হবে। বাঙালির খাওয়া জাহাজে পাবে না…কষ্টের শেষ হবে, লস্করগুলো অত্যন্ত বদমায়েস, তোমাদের সঙ্গে বনবে না। আরও নানা কষ্ট-স্টোকারের কাজ পাবে, কয়লা দিতে দিতে জান হয়রান হবে—সে সব কি তোমাদের কাজ?

-এখন কোন জাহাজ ছাড়ছে নাকি?

-জাহাজ তো ছাড়ছে গোলকুণ্ডা—আর সাতদিন পরে মঙ্গলবারে ছাড়বে মাল জাহাজ কলম্বো হয়ে ডারবান যাবে।

দুজনেই মহা পীড়াপীড়ি শুরু করিল। তাহাদেব কোনও কষ্ট হইবে না, কষ্ট কবা তাহাদের অভ্যাস আছে। দয়া করিয়া তিনি যদি কোন ব্যবস্থা করেন। অপু প্রায় কাদ-কাদ হইয়া বলিল—তা হোক, দিন আপনি জোগাড় করে—ওসব কিছু কষ্ট না—দিন আপনি—গোরা লস্করে কি করবে আমাদের? কয়লা খুব দিতে পারব

কেরানীবাবুটি হাসিয়া বলিলেন,—একি ছেলেখেলা হে ছোকরা! কয়লা দেবে তোমবা বুঝতে তো পারছে না সেখানকার কাণ্ডকারখান! বয়লারের গরম, হাওয়া নেই, দম বন্ধ হয়ে আসবে, চার শভেল কয়লা দিতে না দিতে হাতের শিরা দড়ির মতো ফুলে উঠবে—আর তাতে ওই ডেলিকেট হাত-হপ জিবুতে দেবে না, দাঁড়াতে দেখলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মারবে চাবুক দশ হাজার ঘোড়ার জোরের এঞ্জিনের স্টিম বজায় রাখতে হবে সব সময়, নিঃশ্বাস ফেলবার সময় পাবে না—আর গরম কি সোজা! কুম্ভীপাক নরকের গরম ফার্নেসের মুখে। সে তোমাদের কাজ?…

তবুও দুজনে ছাড়ে না।

ইহারা যে বাড়ি হইতে পালাইয়া যাইতেছে, সে ধারণা বাবুটির আরও দৃঢ় হইল। বলিলেন,নাম ঠিকানা দিয়ে যাও তো তোমাদের বাড়ির। দেখি তোমাদের বাড়িতে না হয় নিজে একবার যাব।

কোনো রকমেই তাহাকে রাজি করাইতে না পারিয়া অবশেষে তাহারা চলিয়া আসিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress