Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কলিকাতা আর ভালো লাগে না, কিছুতেই না—এখানকার ধরাবাঁধা রুটিনমাফিক কাজ, বদ্ধতা, একঘেয়েমি—এ যেন অপুর অসহ্য হইয়া উঠিল। তা ছাড়া একটা যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন অস্পষ্ট ধারণা তাহার মনের মধ্যে ক্রমেই গড়িয়া উঠিতেছিল–কলিকাতা ছাড়িলেই যেন সব দুঃখ দূর হইবে—মনের শান্তি আবার ফিরিয়া পাওয়া যাইবে।

শীলেদের আফিসের কাজ ছাড়িয়া দিয়া অবশেষে সে চাপদানির কাছে একটা গ্রাম্য স্কুলের মাস্টারি লইয়া গেল। জায়গাটা না-শহর, না-পাড়াগাঁ গোছের—চারিধারে পাটের কল ও কুলিবস্তি, টিনের চালাওয়ালা দোকানঘর ও বাজার, কয়লার গুঁড়োফেলা রাস্তায় কালো ধুলা ও ধোঁয়া, শহরের পারিপাট্যও নাই, পাড়াগাঁয়ের সহজ শ্রীও নাই।

বড়োদিনের ছুটিতে প্রণব ঢাকা হইতে কলিকাতায় অপুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। সে জানিত অপু আজকাল কলিকাতায় থাকে না—সন্ধ্যার কিছু আগে সে গিয়া চাপদানি পৌঁছিল।

খুঁজিয়া খুঁজিয়া অপুর বাসাও বাহির করিল। বাজারের একপাশে একটা ছোট্ট ঘর—তার অর্ধেকটা একটা ডাক্তারখানা, স্থানীয় একজন হাতুড়ে ডাক্তার সকালে বিকালে রোগি দেখেন। বাকি অর্ধেকটাতে অপুর একখানা তক্তপোশ, একা আধময়লা বিছানা, খানকতক কাপড় ঝুলানন। তক্তপোশের নিচে অপুর স্টিলের তোরটা।

অপু বলিল—এসো এসো, এখানকার ঠিকানা কি করে জানলে?

—সে কথায় দরকার নেই। তারপর কলকাতা ছেড়ে এখানে কি মনে করে?-বাস্। এমন জায়গায় মানুষ থাকে?

-খারাপ জায়গাটা কি দেখলি? তাছাড়া কলকাতায় যেন আর ভালো লাগে না—দিনকতক এমন হল যে, বাইরে যেখানে হয় যাব, সেই সময় এখানকার মাস্টারিটা জুটে গেল, তাই এখানে এলুম। দাঁড়া, তোর চায়ের কথা বলে আসি।

পাশেই একটা বাঁকুড়ানিবাসী বামুনের তেলেভাজা পরোটার দোকান। রাত্রে তাহারই দোকানে অতি অপকৃষ্ট খাদ্য কলঙ্ক-ধরা পিতলের থালায় আনীত হইতে দেখিয়া প্রণব অবাক হইয়া গেল অপুর রুচি অন্তত মার্জিত ছিল চিরদিন, হয়তো তাহা সরল ছিল, অনাড়ম্বর ছিল, কিন্তু অমার্জিত ছিল না। সেই অপুর এ কি অবনতি। এ-রকম একদিন নয়, রোজই রাত্রে নাকি এই তেলেভাজা পরোটাই অপুর প্রাণধারণের একমাত্র উপায়। এত অপরিষ্কারও তো সে অপুকে কস্মিকালে দেখিয়াছে এমন মনে হয় না।

কিন্তু প্রণবের সবচেয়ে বুকে বাজিল যখন পরদিন বৈকালে অপু তাহাকে সঙ্গে লইয়া গিয়া পাশের এক স্যাকরার দোকানে নীচ-শ্রেণীর তাসের আড্ডায় অতি ইতর ও স্থল ধরনের হাস্য পরিহাসের মধ্যে বসিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া মহানন্দে তাস খেলিতে লাগিল।

অপুর ঘরটাতে ফিরিয়া আসিয়া প্রণব বলিল—কাল আমার সঙ্গে চল্ অপু—এখানে তোকে থাকতে হবে না—এখান থেকে চল্।

অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল, কেন রে, কি খারাপ দেখলি এখানে? বেশ জায়গা তো, বেশ লোক সবাই। ওই যে দেখলি বিশ্বম্ভর স্বর্ণকার-উনি এদিকের একজন বেশ অবস্থাপন্ন লোক, ওঁর বাড়ি দেখিস নি? গোলা কত! মেয়ের বিয়েতে আমায় নেমন্তন্ন করেছিল, কি খাওয়ানোটাই খাওয়ালেন— উঃ! পরে খুশির সহিত বলিল—এখানে ওঁরা সব বলেছেন আমায় ধানের জমি দিয়ে বাস করাবেননিকটেই বেগমপুরে ওঁদের—বেশ জায়গা-কাল তোকে দেখাব চল—ওঁরাই ঘরদোর বেঁধে দেবেন না বলেছেন-আপাতত মাটির, মানে, বিচুলির ছাউনি; এদেশে উলুখড় হয় না কিনা!

প্রণব সঙ্গে লইয়া যাইবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করিল–অপু তর্ক করিল, নিজের অবস্থার প্রাধান্য প্রমাণ করিবার উদ্দেশ্যে নানা যুক্তির অবতারণা করিল, শেষে রাগ করিল, বিবক্ত হইল— যাহা সে কখনও হয় না। প্রকৃতিতে তাহার রাগ বা বিরক্তি ছিল না কখনও। অবশেষে প্রণব নিরুপায় অবস্থায় পরদিন সকালের ট্রেনে কলিকাতায় ফিবিয়া গেল।

যাইবার সময় তাহার মনে হইল, সে অপু যেন আর নাই—প্রাণশক্তির প্রাচুর্য একদিন যাহার মধ্যে উছলিয়া উঠিতে দেখিয়াছে, আজ সে যেন প্রাণহীন নিষ্প্রভ। এমনতর স্থূল তৃপ্তি বা সন্তোষবোধ, এ ধরনের আশ্রয় আঁকড়াইয়া ধরিবার কাঙালপনা কই অপুর প্রকৃতিতে তো ছিল না কখনও?

স্কুল হইতে ফিরিয়া রোজ অপু নিজের ঘরের বোয়াকে একটা হাতলভাঙা চেয়ার পাতিয়া বসিয়া থাকে। এখানে সে অত্যন্ত একা ও সঙ্গীহীন মনে করে, বিশেষ করিয়া সন্ধ্যাবেলা। সেটা এত অসহনীয় হইয়া ওঠে, কোথাও একটু বসিয়া গল্প-গুজব করিতে ভালো লাগে, মানুষের সঙ্গ স্পৃহণীয় মনে হয়, কিন্তু এখানে অধিকাংশই পাটকলের সর্দার, বাবু বাজারের দোকানদার, তাও সবাই তাঁহার পরিচিত। বিশু স্যাকরার দোকানের সান্ধ্য আড্ডা সে নিজে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছে, তবুও নটা-দশটা। পর্যন্ত রাত একরকম কাটে ভালোই।

অপুর ঘরের বোয়াকটার সামনেই মার্টিন কোম্পানির ছোট লাইন, সেটা পার হইয়া একটা পুকুর, জল যেমন অপরিষ্কার, তেমনি বিস্বাদ। পুকুরের ওপারে একটা কুলিবস্তি, দু-বেলা যত ময়লা কাপড় সবাই এই পুকুরেই কাচিতে নামে। রৌদ্র উঠিলেই কুলি লাইনের ছাপমারা খয়েরি রংয়ের বাবো-হাতি শাড়ি পুকুরের ও-পারের ঘাসের উপর রৌদ্রে মেলানো অপুর বোয়াক হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। কুলিবস্তির ওপাশে গোটাকতক বাদাম গাছ, একটা ইটখোলা, খানিকটা ধানক্ষেত, একটা পাটের গাঁটবন্দী কল। এক এক দিন রাত্রে ইটের পাঁজার ফাটলে ফাটলে রাঙা ও বেগুনি আলো জ্বলে, মাঝে মাঝে নিভিয়া যায়, আবার জ্বলে, অপু নিজের বোয়াকে বসিয়া বসিয়া মনোযোগর সঙ্গে দেখে। রাত দশটায় মার্টিন লাইনের একখানা গাড়ি হাওড়ার দিক হইতে আসে—অপুর নোয়ক ঘেঁষিয়া যায়-পোঁটলা-পুটুলি, লোকজন, মেয়েরা—পাশেই স্টেশনে গিয়া থামে, একটু পরেই বাঁকুড়াবাসী ব্রাহ্মণটি তেলেভাজা পৱােটা ও তরকারি আনিয়া হাজির করে, খাওয়া শেষ করিয়া শুইতে অপুর প্রায় এগারোটা বাজে। দিনের পর দিন একই রুটিন। বৈচিত্র্যই নাই, বদলও নাই।

অপু কাহারও সহিত গায়ে পড়িয়া আত্মীয়তা করিতে চায় যে, কোন মতলব আঁটিয়া তাহা নহে, ইহা সে যখনই করে, তখনই সে করে নিজের অজ্ঞাতসারে—নিঃসঙ্গতা দূর করিবার অচেতন আগ্রহে। কিন্তু নিঃসঙ্গতা কাটিতে চায় না সব সময়! যাইবার মতো জায়গা নাই, করিবার মতো কাজও নাই—চুপচাপ বসিয়া বসিয়া সময় কাটে না। ছুটির দিনগুলি তো অসম্ভব-রুপ দীর্ঘ হইয়া পড়ে।

নিকটেই ব্রাঞ্চ পোস্টাফিস। অপু রোজ বৈকালে ছুটির পরে সেখানে গিয়া বসিয়া প্রতিদিনের ডাক অতি আগ্রহের সহিত দেখে। ঠিক বৈকালে পাঁচটার সময় সাব অফিসের পিওন চিঠিপত্রভরা সীলকরা ডাক ব্যাগটি ঘাড়ে করিয়া আনিয়া হাজির করে, সীল ভাঙিয়া বড়ো কাঁচি দিয়া সেটার মুখের বাঁধন কাটা হয়। এক একদিন অপুই বলে-ব্যাগটা খুলি চরণবাবু?

চরণবাবু বলেন–হা হা, খুলুন না, আমি ততক্ষণ ইস্টাম্পের হিসেবটা মিলিয়ে ফেলি এই নিন কঁচি!

পোেস্টকার্ড, খাম, খবরের কাগজ, পুলিন্দা, মনি-অর্ডার। চরণবাবু বলেন—মনি-অর্ডার সাতখানা? দেখেছেন কাণ্ডটা মশাই, এদিকে টাকা নেই মোটে। টোটালটা দেখুন না একবার দয়া করে—সাতান্ন টাকা ন আনা? তবেই হয়েছে—রইল পড়ে, আমি তো আর ইস্ত্রির গয়না বন্ধক দিয়ে টাকা এনে মনি-অর্ডার মিল করতে পারি না মশাই? এদিকে ক্যাশ বুঝে নেওয়া চাই বাবুদের রোজ রোজ

প্রতিদিন বৈকালে পোস্টমাস্টারের টহলদারি করা অপুর কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ। সাগ্রহে স্কুলের ছুটির পর পোস্টাফিসে দৌড়ানো চাই-ই তাহার। তাহার সবচেয়ে আকর্ষণের বস্তু খামের চিঠিগুলি। প্রতিদিনের ডাকে বিস্তর খামের চিঠি আসে—নানাধরনের খাম, সাদা, গোলাপী, সবুজ। চিঠি-প্রাপ্তিটা চিরদিনই জীবনের একটি দুর্লভ ঘটনা বলিয়া চিরদিনই চিঠির, বিশেষ করিয়া খামের চিঠির প্রতি তাহার কেমন একটা বিচিত্র আকর্ষণ। মধ্যে দু-বৎসর অপর্ণা সে পিপাসা মিটাইয়াছিল—এক একখানা খাম বা তাহার উপরের লেখাটা এতটা হুবহু সে রকম, যে প্রথমটা হঠাৎ মনে হয় বুঝি বা সেই-ই চিঠি দিয়াছে। একদিন শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসায় এই রকম খামের চিঠি তাহারও কত আসিত।

তাহার নিজের চিঠি কোনদিন থাকে না, সে জানে তাহা কোথাও হইতে আসিবার সম্ভাবনা নাই-কিন্তু শুধু নানা ধরনের চিঠির বাহ্যদৃশ্যের মোহটাই তাহার কাছে অত্যন্ত প্রবল।

একদিন কাহার একখানি মালিকশুন্য সাকিমশূন্য পোেস্টকার্ডের চিঠি ডেড-লেটার অফিস হইতে ঘুরিয়া সারা অঙ্গে ভক্ত বৈষ্ণবের মতো বহু ডাকমোহরের ছাপ লইয়া এখানে আসিয়া পড়িল। বহু সন্ধান করিয়া তাহার মালিক জুটিল না। সেখানা রোজ এ-গ্রাম ও-গ্রাম হইতে ঘুরিয়া আসে— পিওন কৈফিয়ত দেয়, এ নামে কোন লোকই নাই এ অঞ্চলে। ক্রমে—চিঠিখানা অনাদৃত অবস্থায় এখানে-ওখানে পড়িয়া থাকিতে দেখা গেল—একদিন ঘরঝট দিবার সময় জঞ্জালের সঙ্গে কে সামনের মাঠে ঘাসের উপর ফেলিয়া দিয়াছিল, অপু কৌতূহলের সঙ্গে কুড়াইয়া লইয়া পড়িল–

শ্রীচরণকমলেষু,

মেজদাদা, আজ অনেকদিন যাবৎ আপনি আমাদের নিকট কোন পত্রাদি দেন না এবং আপনি কোথায় আছেন, কি ঠিকানা না জানিতে পারায় আপনাকেও আমরা পত্র লিখি নাই। আপনার আগের ঠিকানাতেই এ পত্রখানা দিলাম, আশা করি উত্তর দিতে ভুলিবেন না। আপনি কেন আমাদের নিকট পত্র দেওয়া বন্ধ করিয়াছেন, তাহার কারণ বুঝিতে সক্ষম হই নাই। আপনি বোধ হয় আমাদের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন, তাহা না হইলে আপনি আমাদের এখানে না আসিলেও একখানা পত্র দিতে পারেন। এতদিন আপনার খবর না জানিতে পারিয়া কি ভাবে দিন যাপন করিতেছি তাহা সামান্য পত্রে লিখিলে কি বিশ্বাস করিবেন মেজদাদা? আমাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি একেবারেই ফুরাইয়া গিয়াছে? সে যা হোক, যেরূপ অদৃষ্ট নিয়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছি সেইরুপ ফল। আপনাকে বৃথা দোষ দিব না। আশা করি আপনি অসন্তোষ হইবেন না। যদি অপরাধ হইয়া থাকে, ছোট বোন বলিয়া ক্ষমা করিবেন। আপনার শরীর কেমন আছে, আপনি আমার সভক্তি প্রণাম জানিবেন, খুব আশা করি পত্রের উত্তর পাইব। আপনার পত্রের আশায় পথ চাহিয়া রহিলাম। ইতি

সেবিকা
কুসুমলতা বসু

কাঁচা মেয়েলি হাতের লেখা, লেখায় অপটুত্ব ও বানান ভুলে ভরা। সহোদর বোনের চিঠি নয়, কারণ পত্ৰখানা লেখা হইতেছে জীবনকৃষ্ণ চক্রবর্তী নামের কোন লোককে। এত আগ্রহপূর্ণ, আবেগভরা পত্ৰখানার শেষকালে এই গতি ঘটিল? মেয়েটি ঠিকানা জানে না, নয় তো লিখিতে ভুলিয়াছে। অপটু লেখার ছত্রে ছত্রে যে আন্তরিকতা ফুটিয়াছে তাহার প্রতি সম্মান দেখাইবার জন্য পত্রখানা সে তুলিয়া লইয়া নিজের বাক্সে আনিয়া রাখিল। মেয়েটির ছবি চোখের সম্মুখে ফুটিয়া উঠে-পনেরো-ষোল বৎসর বয়স, সুঠাম গঠন, ছিপছিপে পাতলা, একরাশ কালো কেঁকড়া কেঁকড়া চুল মাথায়। ডাগর চোখ।…কোথায় সে তাহার মেজদার পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় বৃথাই পথ চাহিয়া আছে! মানবমনের এত প্রেম, এত আগ্রহভরা আহ্বান, পবিত্র বালিকাহৃদয়ের এ অমূল্য অর্ঘ্য কেন জগতে এভাবে ধুলায় অনাদরে গড়াগড়ি যায়, কেহ পোঁছে না, কেহ তা লইয়া গর্ব করে না?

বিশ্বম্ভর স্যাকরার দোকানে সেদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত জোর তাসের আজ্ঞা চলিল সবাই উঠিতে চায়, সবাই বলে রাত বেশি হইয়াছে, অথচ অপু সকলকে অনুরোধ করিয়া বসায়, কিছুতেই খেলা ছাড়িতে চায় না। অবশেষে অনেক রাত্রে বাসায় ফিরিতেছে, কলুদের পুকুরের কাছে স্কুলের থার্ড পণ্ডিত আশু সান্যাল লাঠি ঠক ঠক করিতে করিতে চলিয়াছেন। অপুকে দেখিয়া বলিলেন, কি অপূর্ববাবু যে, এত রাত্রে কোথায়?

–কোথাও না; এই বিশু স্যাকরার দোকানে তাসের

থার্ড পণ্ডিত এদিক-ওদিক চাহিয়া ভিন্নসুরে বলিলেন—একটা কথা আপনাকে বলি, আপনি বিদেশী লোক—পূর্ণ দীঘড়ীর খপ্পরে পড়ে গেলেন কি করে বলুন তো?

অপু বুঝিতে না পারিয়া বলিল, খপ্পরে-পড়া কেমন বুঝতে পারছি নেকি ব্যাপারটা বলুন তো?

পণ্ডিত আরও সুর নিচু করিয়া বলিল-ওখানে অত ঘন ঘন যাওয়া-আসা আপনার কি ভালো দেখাচ্ছে, ভাবছেন? ওদের টাকাকড়ি দেওয়া ও-সব? আপনি হচ্ছেন ইস্কুলের মাস্টার, আপনাকে নিয়ে অনেক কথা উঠেছে, তা বোধ করি জানেন না?

-না! কি কথা!

–কি কথা তা আর বুঝতে পারছেন না মশাই? হুঁ-পরে কিছু থামিয়া বলিলেন—ওসব ছেড়ে দিন, বুঝলেন? আরও একজন আপনার আগে ওই রকম ওদের খপ্পরে পড়েছিল, এখানকার নন্দ ইয়ের আবগারি দোকানে কাজ করত, ঠিক আপনার মতো অল্প বয়স–মশাই, টাকা শুষে শুষে তাকে একেবারে—ওদের ব্যবসাই ওই। সমাজে একঘরে করবার কথা হচ্ছে—থার্ড পণ্ডিত একটু থামিয়া একটু অর্থসূচক হাস্য করিয়া বলিলেন,—আর ও-মেয়ের এমন মোহই বা কি, শহর অঞ্চলে বরং ওর চেয়ে ঢের–

অপু এতক্ষণ পর্যন্ত পণ্ডিতের কথাবার্তার গতি ও বক্তব্য-বিষয়ের উদ্দেশ্য কিছুই ধরিতে পারে নাই-কিন্তু শেষের কথাটাতে সে বিস্ময়ের সুরে বলিল—কোন্ মেয়ে, পটেশ্বরী?

-হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, থাক্ থাক, একটু আস্তে—

–কি করেছে বলছেন—পটেশ্বরী?

আমি আর কি বলছি কিছু, সবাই যা বলে আমিও তাই বলছি। নতুন কথা আর কিছু বলছি কি? যাবেন না ওসবে, তাতে বিদেশী লোক, সাবধান করে দি। ভদ্রলোকের ছেলে, নিজের চরিত্রটা আগে রাখতে হবে ভালো, বিশেষ যখন ইস্কুলের শিক্ষক এখানকার।

থার্ড পণ্ডিত পাশের পথে নামিয়া পড়িলেন, অপু প্রথমটা অবাক হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু বাসায় ফিরিতে ফিরিতে সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে পরিষ্কার হইয়া গেল।

পূর্ণ দীঘড়ির বাড়িতে যাওয়া-আসার ইতিহাসটা এইরূপ–

প্রথমে এখানে আসিয়া অপু কয়েকজন ছাত্র লইয়া এক সেবা-সমিতি স্থাপন করিয়াছিল। একদিন সে স্কুল হইতে ফিরিতেছে, পথে একজন অপরিচিত প্রৌঢ় ব্যক্তি তাহার হাত দুটি জড়াইয়া ধরিযা প্রায় ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, আপনারা না দেখলে আমার ছেলেটা মারা যেতে বসেছে—আজ পনেরো দিন টাইফয়েড, তা আমি কলের চাকরি বজায় রাখব, না রুগীর সেবা কবব? আপনি দিন-মানটার জন্যে জনকতক ভলান্টিয়ার যদি আমার বাড়ি—আর সেই সঙ্গে যদি দু-একদিন আপনি–

তেত্রিশ দিনে রোগী আরাম হইল। এই তেত্রিশ দিনের অধিকাংশ দিনই অপু নিজে ছাত্রদেব সঙ্গে প্রাণপণে কাটিয়াছে। রাত্রি তিনটায় ঔষধ খাওযাইতে হইবে, অপু ছাত্রদিগকে জাগিতে না দিয়া নিজে জাগিয়াছে, তিনটা না বাজা পর্যন্ত বাহিরের দাওয়ার একপাশে বই পড়িয়া সময় কাটাইয়াছে, পাছে এমনি বসিয়া থাকিলে ঘুমাইয়া পড়ে।

একদিন দুপুরে টাল খাইয়া রোগী যায়-যায় হইয়াছিল। দীঘড়ী মশায় পাটকলে, সে দিন ভলান্টিয়ার দলের আবার কেহই ছিল না, দুপুরে ভাত খাইতে গিযাছিল। অপু দীঘড়ী মহাশয়ের স্ত্রীকে ভরসা দিয়া বুঝাইয়া শান্ত রাখিয়া মেয়ে দুটির সাহায্যে গরম জল করাইয়া বোতলে পুরিয়া সেঁক-তাপ ও হাত-পা ঘষিতে ঘষিতে আবার দেহের উষ্ণতা ফিরিয়া আসে।

ছেলে সারিয়া উঠিলে দীঘড়ী মশায় একদিন বলিলেন—আপনি আমার যা উপকারটা করেছেন মাস্টার মশায়—তা এক মুখে আর কি বলব। আমার স্ত্রী বলছিল, আপনাব তত বেঁধে খাওয়ার কষ্ট—এই একমাসে আপনি তো আমাদের লোক হয়ে পড়েছেন—তা আপনি কেন আমাদের ওখানেই খান না? আপন বাড়ির ছেলের মতো থাকবেন, খাবেন, কোনও অসুবিধে আপনার হবে না।

সেই হইতেই অপু এখানে একবেলা করিয়া খায়।

পরিচয় অল্প দিনের বটে কিন্তু বিপদের দিনের মধ্য দিয়া সে পরিচয়-কাজেই ঘনিষ্ঠতা ক্রমে আত্মীয়তায় পরিণত হইতে চলিয়াছে। অপু পূর্ণ দীঘড়ীর স্ত্রীকে শুধু মাসিমা বলিয়া ডাকে তাহাই নয়, মাসের বেতন পাইলে সবটা আনিয়া নতুন-পাতানো মাসিমার হাতে তুলিয়া দেয়। সে-টাকার হিসাব প্রতি মাসের শেষে মাসিমা মুখে বুঝাইয়া দিয়া আরও চার-পাঁচ টাকা বেশি খরচ দেখাইয়া দেন এবং পরের মাসের মাহিনা হইতে কাটিয়া রাখেন। বাজারে বিশু স্যাকরা একদিন বলিয়াছিল—দীঘড়িবাড়ি টাকা রাখবেন না অমন করে, ওরা অভাবী লোক, বিশেষ করে দীঘড়ী-গিন্নি ভারি খেলোয়াড় মেয়েছেলে, বিদেশী লোক আপনি, আপনাকে বলে রাখি, ওদের সঙ্গে অত মেলামেশার দরকার কি আপনার?

মেয়ে দুইটিরও সঙ্গে সে মেশে বটে। বড় মেয়েটির নাম পটেশ্বরী, বয়স বছর চৌদ্দ-পনেরো হইবে, রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, তবে তাহাকে দেখিয়া সুন্দরী বলিয়া কোনদিনই মনে হয় নাই অপুর। তবে এটুকু সে লক্ষ করিয়াছে, তাহার সুবিধা-অসুবিধার দিকে বাড়ির এই মেয়েটিই একটু বেশি লক্ষ্য রাখে। পটেশ্বরী না আঁধিয়া দিলে অর্ধেক দিন বোধহয় তাহাকে না খাইয়াই স্কুলে যাইতে হইত। তাহার ময়লা রুমালগুলি নিজে চাহিয়া লইয়া সাবান দিয়া রাখে, ছোট ভাইয়ের হাতে টিফিনের সময় তাহার জন্য আটার রুটি পাঠাইয়া দেয়, অপু খাইতে বসিলে পান-সাজিয়া তাহার রুমালে জড়াইয়া রাখে। কি একটা ব্রতের সময় বলিয়াছিল, আপনার হাত দিয়ে ব্রতটা নেব মাস্টার মশায়! এ সবের জন্য সে মনে মনে মেয়েটির উপর কৃতজ্ঞ কিন্তু এ সব জিনিস যে বাহিরের দিক হইতে এরুপ ভাবে দেখা যাইতে পারে, একথা পর্যন্ত তাহার মনে কখনও উদয় হয় নাই—সে জানেই না, এ ধরনের সন্দিগ্ধ ও অশুচি মনোভাবের খবর।

সে বিস্মিত হইল, বাগও কবিল। শেষে ভাবিয়া চিন্তিয়া পরদিন হইতে পূর্ণ দীঘড়ীর বাড়ি যাওয়া-আসা বন্ধ করিল। ভাবিল-কিছু না, মাঝে পড়ে পটেশ্বরীকে বিপদে পড়তে হবে।

ইতিমধ্যে বাঁকুড়াবাসী বামুনটি রাশীকৃত বাজার-দেনা ফেলিয়া একদিন ঝাঝরা, হাতা এবং বেলুনখানা মাত্র সম্বল করিয়া চাপানির বাজার হইতে রাতারাতি উধাও হইয়াছিল, সুতরাং আহারাদির খুবই কষ্ট হইতে লাগিল।

দীঘড়ী-বাড়ি হইতে ফিরিয়া সে মনে মনে ভাবিল, এ-রকম বাবা-মা তো কখনও দেখি নি? বেচারিকে এভাবে কষ্ট দেওয়া—ছিঃ—যাক ওদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আর রাখব না।

সেদিন ছুটির পর অপু একখানা খবরেব কাগজ উলটাইতে উলটাইতে দেখিতে পাইল একটা শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধের লেখক তাহার বন্ধু জানকী এবং নামের তলায় ব্র্যাকেটের মধ্যে লেখা আছে— On deputation to England.

জানকী ভালো করিয়া এম.এ. ও বি.টি. পাস করিবার পর গভর্নমেন্ট স্কুলে মাস্টারি করিতেছে এ-সংবাদ পূর্বেই সে জানিত কিন্তু তাহার বিলাত যাওয়ার কোন খবরই তাহার জানা ছিল না। কে-ই বা দিবে? দেখি দেখি-বা রে! জানকী বিলাত গিযাছে, বাঃ

প্রবন্ধটা কৌতূহলের সহিত পড়িল। বিলাতের একটা বিখ্যাত স্কুলের শিক্ষাপ্রণালী ও ছাত্রজীবনের দৈনন্দিন ঘটনা সংক্রান্ত আলোচনা। বাহির হইয়া পথ চলিতে চলিতে ভাবিল, উঃ, জানকী যে জানকী সেও গেল বিলেত!

মনে পড়িল কলেজে জীবনের কথা-বাগবাজারের সেই শ্যামরায়ের মন্দির ও ঠাকুরবাড়ি গরিব ছাত্রজীবনে জানকীর সঙ্গে কতদিন সেখানে খাইতে যাওয়ার কথা। ভালোই হইয়াছে, জানকী কম কষ্টটা করিয়াছিল কি একদিন! বেশ হইয়াছে, ভালোই হইয়াছে।

এ-অঞ্চলের রাস্তায় বড়ো ধুলো, তাহার উপর আবার কয়লার গুঁড়া দেওয়া—পথ হাঁটা মোটই প্রীতিকর নয়। দুধারে কুলিবস্তি; ময়লা দড়ির চারপাই পাতিয়া লোকগুলা তামাক টানিতেছে ও গল্প করিতেছে। এ-পথে চলিতে চলিতে অপরিচ্ছন্ন, সংকীর্ণ বস্তিগুলির দিকে চাহিয়া সে কতবার ভাবিয়াছে, মানুষ কোন্ টানে, কিসের লোভে এ-ধরনের নরককুণ্ডে স্বেচ্ছায় বাস করে? জানে না, বেচারিরা জানে না, পলে পলে এই নোংরা আবহাওয়া তাহাদের মনুষ্যত্বকে, রুচিকে, চরিত্রকে, ধর্মস্পৃহাকে গলা টিপিয়া খুন করিতেছে। সূর্যের আলো কি ইহারা কখনও ভোগ করে নাই! বনবনানীর শ্যামলতাকে ভালোবাসে নাই। পৃথিবীর মুক্ত রূপকে প্রত্যক্ষ করে নাই।

নিকটে মাঠ নাই, বেগমপুরের মাঠ অনেক দূরে, রবিবার ভিন্ন সেখানে যাওয়া চলে না। সুতরাং খানিকটা বেড়াইয়াই সে ফিরিল।

অনেকদিন হইতে এ-অঞ্চলের মাঠে ও পাড়াগাঁয়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এদিকের গাছপালা ও বনফুলের একটা তালিকা ও বর্ণনা সে একখানা বড়ো খাতায় সংগ্রহ করিয়াছে। স্কুলের দু-একজন মাস্টারকে দেখাইলে তাহারা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। ও-সবের কথা লইয়া আবার বই! পাগল আর কাকে বলে!

বাসায় আসিয়া আজ আর সে বিশু স্যাকরার আড্ডায় গেল না। বসিয়া বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে জানকীর কথা মনে পড়িল। বিলাতে—তা বেশ। কতদিন গিয়াছে কে জানে? ব্রিটিশ মিউজিয়ম-টিউজিয়ম এতদিনে সব দেখা হইয়া গিয়াছে নিশ্চয়। পুরানো নর্ম্যান দুর্গ দু-একটা, পাশে পাশে, জুনিপারের বন, দূরে ঢেউ খেলানো মাঠের সীমায় খড়িমাটির পাহাড়ের পিছনে সন্ধ্যাধুসর আটলান্টিকের উদার বুকে অস্ত আকাশের রঙিন প্রতিচ্ছায়া, কি কি গাছ, পাড়াগাঁয়ের মাঠের ধারে বনের কি কি ফুল? ইংল্যান্ডের বনফুল নাকি ভারি দেখিতে সুন্দর-পপি, ক্লিম্যাটিস, ডেজি।

বিশ্ব স্যাকরার দোকান হইতে লোক ডাকিতে আসে, আসিবার আজ এত দেরি কিসের? খেলুড়ে ভীম সাধুখাঁ, মহেশ সবুই, নীলু ময়রা, ফকির আড্ডি-ইহারা অনেকক্ষণ আসিয়া বসিয়া আছে—মাস্টার মশায়ের যাইবার অপেক্ষায় এখনও খেলা যে আরম্ভ হয় নাই।

অপু যায় না—তাহার মাথা ধরিয়াছেনা-না—আজ সে আর খেলায় যাইবে না।

ক্রমে রাত্রি বাড়ে, পদ্মপুকুরের ওপারে কুলিবস্তির আলো নিবিয়া যায়, নৈশবায়ু শীতল হয়, রাত্রি সাড়ে দশটায় আপ ট্রেন হেলিতে-দুলিতে ঝকঝক শব্দে রোয়াকের কোল ঘেঁষিয়া চলিয়া যায়, পয়েন্টসম্যান আঁধারলণ্ঠন হাতে আসিয়া সিগন্যালের বাতি নামাইয়া লইয়া যায়। জিজ্ঞাসা করে— মাস্টারবাবু, এখনও বসিয়ে আছেন?

–কে ভজুয়া? হ্যাঁ—সে এখনও বসিয়া আছে।

কিসের ক্ষুধা! কিসের যেন একটা অতৃপ্ত ক্ষুধা।

ও-বেলা একখানা পুরানো জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল—একখানা খুব ভালো বই এ-সম্বন্ধে। শীলদের বাড়ির চাকরি জীবনে কিনিয়াছিল—এখান-হইতে অপর্ণাকে কতদিন নীহারিকা ও নক্ষত্রপুঞ্জের ফটোগ্রাফ দেখাইয়া বুঝাইয়া দিত-ও-বেলা যখন সেখানা লইয়া পড়িতেছিল, তখন তাহার চোখে পড়িল, অতি ক্ষুদ্র, সাদা রংয়ের—খালি চোখের খুব তেজ না থাকিলে দেখা প্রায় অসম্ভব—এরূপ একটা পোকা বইয়ের পাতায় চলিয়া বেড়াইতেছে। ওর সম্বন্ধে ভাবিয়াছিল—এই বিশাল জগৎ, নক্ষত্রপুঞ্জ, উল্কা, নীহারিকা, কোটি কোটি দৃশ্য-অদৃশ্য জগৎ লইয়া এই অনন্ত বিশ্ব—ও-ও তো এরই একজন অধিবাসী—এই যে চলিয়া বেড়াইতেছে পাতাটার উপরে, ও-ই ওর জীবনানন্দ–কতটুকু ওর জীবন, আনন্দ কতটুকু?

কিন্তু মানুষেরই বা কতটুকু? ওই নক্ষত্র-জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধই বা কি? আজকাল তাহার মনে একটা নৈরাশ্য সন্দেহবাদের ছায়া মাঝে মাঝে যেন উকি মারে। এই বর্ষাকালে সে দেখিয়াছে, ভিজা জুতার উপর এক রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছাতা গজায়—কতদিন মনে হইয়াছে মানুষও তেমনি পৃথিবীর পৃষ্ঠে এই রকম ছাতার মতো জন্মিয়াছে—এখানকার উষ্ণ বায়ুমণ্ডল ও তাহার বিভিন্ন গ্যাসগুলো প্রাণপোষণের অনুকূল একটা অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছে বলিয়া। এরা নিতান্তই এই পৃথিবীর, এরই সঙ্গে এদের বন্ধন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, ব্যাঙের ছাতার মতোই হঠাৎ গজাইয়া উঠে, লাখে লাখে পালে পালে জন্মায়, আবার পৃথিবীর বুকেই যায় মিলাইয়া। এরই মধ্য হইতে সন্ত্র ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনার আনন্দ, হাসি-খুশিতে দৈন্য-ক্ষুদ্রতাকে ঢাকিয়া রাখে—গড়ে চল্লিশটা বছর পরে সব শেষ। যেমন ওই পোকার সব শেষ হইয়া গেল তেমনি।

এই অবোধ জীবগণের সঙ্গে ওই বিশাল নক্ষত্রজগতের ওই গ্রহ, উল্কা, ধূমকেতু-—ওই নিঃসীম নাক্ষত্রিক বিরাট শূন্যের কি সম্পর্ক? সুদূরের পিপাষাও যেমন মিথ্যা, অনন্ত জীবনের স্বপ্নও তেমনি মিথ্যা—ভিজা জুতার বা পচা বিচালি-গাদার ব্যাঙের ছাতার মতো যাহাদের উৎপত্তি—এই মহনীয় অনন্তের সঙ্গে তাহাদের কিসের সম্পর্ক?

মৃত্যুপারে কিছুই নাই, সব শেষ। মা গিয়াছেন—অপর্ণা গিয়াছে-অনিল গিয়াছে-সব দাড়ি পড়িয়া গিয়াছে—পূর্ণচ্ছেদ।

ওই জোতির্বিজ্ঞানের বইখানাতে যে বিশ্বজগতের ছবি ফুটিয়াছে, ওই পোকাটার পক্ষে যেমন তাহার কল্পনা ও ধারণা অসম্ভব, এমন সব উচ্চতর বিবর্তনের প্রাণী কি নাই যাহাদের জগতের তুলনায় মানুষের জগৎটা ওই বইয়ের পাতায় বিচরণশীল প্রায় আণুবীক্ষণিক পোকাটার জগতের মতই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, নগণ্য?

হয়তো তাহাই সত্য, হয়তো মানুষের সকল কল্পনা, সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান মিলিয়া যে বিশ্বটার কল্পনা করিয়াছে সেটা বিরাট বাস্তবের অতি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ নয়—তাহা নিতান্ত এ পৃথিবীর মাটির…মাটির…মাটির।

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতের তুলনায় ওই পোকাটা এই জগতের মতো! হয়তো তাহাই, কে বলিবে হ্যাঁ কি না?

মানুষ মরিয়া কোথায় যায়? ভিজা জুতাকে রৌদ্রে দিলে তাহার উপরকার ছাতা কোথায় যায়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress