Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অপদার্থ || Sharadindu Bandyopadhyay

অপদার্থ || Sharadindu Bandyopadhyay

ঘটনাটি ঘটিয়াছিল অম্লাধিক চল্লিশ বছর আগে। তাহাও আবার বিহার প্রদেশের অজ। পাড়াগাঁয়ে। সুতরাং ইহাকে আদিম কালের কাহিনী বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।

গঙ্গার তীরে চরের উপর গ্রাম দিয়ারা মনপন্থল। শহর হইতে চৌদ্দ পনেরো মাইল দূরে। সভ্যতার আলো এখানে মৃৎপ্রদীপের শিখা হইতে বিকীর্ণ হয়, কদাচিৎ হ্যারিকেন লণ্ঠনের ধোঁয়াটে কাচের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তবু গ্রামটি সমৃদ্ধ। প্রায় তিন শত ঘর ভূঁইয়া রাজপুত এখানে বাস করে।

সম্পৎ সিং এই গ্রামের বর্ধিষ্ণু জোতদার, দেড়শত বিঘা জমি চাষ করেন। গৃহে লক্ষ্মীর কৃপা উছলিয়া পড়িতেছে। পঞ্চাশ বছর বয়স, গ্রামের সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করিয়া চলে, বিপদে আপদে তাঁহার পরামর্শ ও সহায়তা অন্বেষণ করে। কিন্তু তাঁহার মনে সুখ নাই, একমাত্র পুত্র ভূপৎ সিং মানুষ হইল না।

ছেলেবেলা হইতেই ভূপতের স্বভাব কেমন এক রকম; কিছুতেই যেন আঁট নাই। তাহার স্বাস্থ্য ভাল, কিন্তু খেলাধূলায় তাহার মন নাই; লেখাপড়া ও না মা সি ধং পর্যন্ত করিয়া গুরুজির পাঠশালা ছাড়িয়া দিয়াছে। গ্রাম্য বড়মানুষের ছেলে অল্প বয়সে বখিয়া গেলে ভাঙ এবং গাঁজা ধরে, নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোকের সহিত অবৈধ ইয়ার্কির সম্বন্ধ পাতে। কিন্তু ভূপতের সে সব দোষ নাই, সে শুধু কাজ করিতে নারাজ।

অথচ গৃহস্থের সংসারে কত না কাজ। ক্ষেতে গিয়া চাষবাস তদারক করিতে হয়, ঘরে বসিয়া হিসাব নিকাশ করিতে হয়। যাহার দুচার বিঘা জমিজমা আছে তাহারই মামলা মোকদ্দমা আছে, শহরে গিয়া উকিল মোক্তারের সহিত দেখা করিয়া মোকদ্দমার তদ্বির করা প্রয়োজন। কিন্তু এই সব কাজ সম্পৎ সিংকে নিজেই করিতে হয়, উপযুক্ত পুত্র থাকিয়াও নাই।

পুত্রের চৌদ্দ বছর বয়স হইতেই সম্পৎ সিং তাহাকে সংসারে ছোটখাটো কাজে নিযুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু বিশেষ ফল হয় নাই। পিতার আজ্ঞায় ভূপৎ যথাসাধ্য উৎসাহ সংগ্রহ করিয়া কাজ করিবার চেষ্টা করিত; কিন্তু অল্পকাল পরেই তাহার উৎসাহ ফুরাইয়া যাইত, মন উদাস হইয়া পড়িত। একবার সম্পৎ সিং তাহাকে লইয়া মামলার তদ্বির করিতে শহরে গিয়াছিলেন। টাটু ঘোড়ায় চড়িয়া শহরে যাইতে মন্দ লাগে নাই; কিন্তু তারপর সারাদিন আদালতে উকিলের পিছু পিছু ঘুরিয়া এবং মামলা মোকদ্দমার অবোধ্য কচকচি শুনিয়া সে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। অতঃপর আবার শহরে যাইবার প্রস্তাব হইলে সে লুকাইয়া বসিয়া থাকিত। সম্পৎ সিং হতাশ হইয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলেন।

পুত্রের সতেরো বছর বয়সে সম্পৎ সিং তাহার বিবাহ দিলেন। বধূটির নাম লছমী, যেমন সুন্দরী, তেমনি মিষ্ট-স্বভাব; বয়স চৌদ্দ বছর, সেয়ানা হইয়াছে। সম্পৎ সিং ভাবিলেন, নিজের সংসার হইলে ভূপতের সংসারে মন বসিবে। কিন্তু হায় রাম! ভূপতের কর্মজীবনে তিলমাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না। বরং আগে যদি বা নৈষ্কর্মের পীড়নে উত্ত্যক্ত হইয়া সে ক্ষেত খামারের দিকে পা বাড়াইত, এখন নিরবচ্ছিন্ন ঘরের কোণে আড্ডা গাড়িল।

লছমী মেয়েটি বড় বুদ্ধিমতী। সে দুচার মাসের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির হালচাল বুঝিয়া লইল। শ্বশুরের দুঃখ অনুভব করিল, স্বামীও যে সুখী নয় তাহা অনুমান করিল। কিন্তু কেন যে স্বামীর মন কর্মবিমুখ তাহা বুঝিতে পারিল না। নির্জনে সে চোখের জল ফেলিয়া ভাবিতপাড়াপড়শী মেয়েরা বলে তাহার স্বামী অলস অপদার্থ অকর্মণ্য, তাহা সত্য নয়, তাহার স্বামী মানুষের মত মানুষ। কেবল নিয়তির দোষে এমন হইয়াছে। হে ভগবান, তুমি আমার স্বামীর নিয়তির দোষ কাটাইয়া দাও, আমি বুকের রক্ত দিয়া পূজা দিব।

ভূপতের নিয়তির দোষ কাটিল না। বছরের পর বছর কাটিয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু ভূপৎ গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনও কাজই করিল না।

ভূপতের বিবাহের আট বছর পরে একটি ঘটনা ঘটিল। ভূপতের বয়স তখন পঁচিশ, সে চারিটি সন্তানের পিতা। সম্পৎ সিংয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু তিনি এখনও সমস্ত সংসারের কর্মর্ভর একাই বহন করিতেছেন।

গ্রামে একটি যাযাবর বায়োস্কোপ কোম্পানী আসিল। তখন নির্বাক চলচ্চিত্র দেশে বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। লাইলাইটের পরিবর্তে বিদ্যুৎ বাতির সাহায্যে চলচ্চিত্র প্রদর্শন প্রচলিত হইয়াছে। একদল ব্যবসায়বুদ্ধিসম্পন্ন উৎসাহী লোক গরুর গাড়িতে যন্ত্রপাতি লইয়া গ্রামে গ্রামে বায়োস্কোপ দেখাইয়া ফিরিতেছে এবং প্রচুর পয়সা পিটিতেছে। এক আনা দুআনার টিকিট, বায়োস্কোপ দেখিবার জন্য প্রত্যেক গ্রামে ছেলেবুড়ো ভাঙ্গিয়া পড়ে।

গ্রামের মাঠে তাঁবু পড়িয়াছে। সন্ধ্যার পর ডায়নামো চালাইয়া বিদ্যুৎ-বাতি জ্বালা হইল। বিদ্যুৎ বাতি গ্রামের কেহ পূর্বে দেখে নাই, আলো দেখিয়াই সকলের চক্ষু স্থির। তারপর যখন ছবি দেখিল তখন আর কাহারও মুখে বাক্য রহিল না।

ভূপৎও ছবি দেখিতে গিয়াছিল। কিন্তু তাহার চক্ষে ছবির চেয়ে বিদ্যুতের আলোই বেশী সম্মোহন বিস্তার করিয়াছিল। এ কি অপূর্ব আলো! এমন আলো মানুষ জ্বালিতে পারে! কেমন করিয়া জ্বালে? তেল নাই, দেশলাই নাই; ফুঁ দিলে নেভে না, দেয়াল টিপিলেই জ্বলিয়া ওঠে!

রাত্রে ভূপৎ ভাল ঘুমাইতে পারিল না। যখন ঘুমাইল তখন দেখিল শত শত হুরীপরী বিজলি বাতির মতো ভাস্বর মূর্তিতে তাহাকে ঘিরিয়া নাচিতেছে। জাগিয়া দেখিল ঘরের কোণে রেড়ির তেলের মিটিমিটি আলো। কনুয়ে ভর দিয়া উঠিয়া সে লছমীর ঘুমন্ত মুখ দেখিল। না, এ আলোতে লছমীর মুখ ভাল দেখায় না, ওই আলো জ্বালিয়া লছমীর মুখ দেখিতে হয়। গাঢ় আবেগ ভরে সে লছমীর শিথিল অধরে চুম্বন করিল, লছমী আধ-জাগ্রত হইয়া তাহার গলা জড়াইয়া লইল।

সকালে ভূপৎ গিয়া বায়োস্কোপের মিস্ত্রির সহিত ভাব করিয়া ফেলিল, তাহাকে পেঁড়া গুলাবজামুন খাওয়াইল। মিস্ত্রি যত্ন করিয়া তাহাকে বিদ্যুজ্জনন যন্ত্র দেখাইল এবং প্রক্রিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিল। ভূপৎ কিছুই বুঝিল না কিন্তু চমৎকৃত হইয়া রহিল।

ব্যবসা এখানে ভাল চলিতেছে দেখিয়া বায়োস্কোপের দল দুই তিন-দিন থাকিয়া গেল। তারপর একদিন সকালবেলা মালপত্র যন্ত্রপাতি গরুর গাড়িতে বোঝাই করিয়া প্রস্থান করিল। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল ভূপৎ গ্রামে নাই। বায়োস্কোপ দলের সঙ্গে সঙ্গে সেও অন্তর্ধান করিয়াছে।

সেরাত্রে বেশী খোঁজ খবর লওয়া চলিল না। পর দিন প্রাতে সম্পৎ সিং চারিদিকে লোক পাঠাইলেন। কয়েক মাইল দূরের একটি গ্রামে বায়োস্কোপ দলের সন্ধান মিলিল, কিন্তু ভূপৎকে পাওয়া গেল না। সে তাহাদের সঙ্গে আসে নাই।

সম্পৎ সিং অতিশয় কাতর হইলেন, নাতি নাতিনীদের কোলে লইয়া বাবুয়া রে বাবুয়া রে বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। একে পুত্রস্নেহে তাঁহার হৃদয় বিকল, উপরন্তু তাঁহারই কোন অনীতি অবহেলার ফলে ভূপৎ অভিমানে গৃহত্যাগ করিয়াছে এই কথা ভাবিয়া তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল।

লছমী কিন্তু কাঁদিল না, সে শক্ত রহিল। ভূপৎ তাহাকে কিছু বলিয়া যায় নাই, কিন্তু সে মনে মনে বুঝিয়াছিল। শ্বশুরের কান্নাকাটি দেখিয়া সে দ্বারের আড়াল হইতে নিম্নস্বরে বলিল— বাবুজি, হয়রান হবেন না, কোনও ভয় নেই।

সম্পৎ সিং চক্ষু মুছিয়া ভগ্নস্বরে বলিলেন— বেটি, তুমি কিছু জানো? কেন সে চলে গেল? কোথায় চলে গেল?

লছমী বলিল— জানি না। কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না, উনি শিগগির ফিরে আসবেন।

পুত্রবধূর দৃঢ়তায় সম্পৎ সিং আশ্বাস পাইলেন।

কিন্তু ছয় মাস কাটিয়া গেল, ভূপতের দেখা নাই। সম্পৎ সিং আবার ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিলেন। লছমীর মনেও অজানিত আশঙ্কার স্পর্শ লাগিল।

তারপর হঠাৎ একদিন ভূপৎ ফিরিয়া আসিল। ছোট বড় করিয়া চুল ছাঁটা, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, একমুখ হাসি। ভূপৎ যেন আর সে ভূপৎ নয়, তাহার আকৃতি-প্রকৃতি সমস্ত বদলাইয়া গিয়াছে।

ভূপৎ পিতার পদধূলি লইল। সম্পৎ সিং বাবুয়া রে বলিয়া পুত্রকে জড়াইয়া ধরিলেন।

অতঃপর তিনি একটু শান্ত হইলে ভুপৎ গত ছয় মাসের কাহিনী বলিল।–

বায়োস্কোপ দলের মিস্ত্রির নিকট ঠিকানা জানিয়া লইয়া সে কলিকাতায় গিয়াছিল। কলিকাতায় একটি ইলেকট্রিক কোম্পানীর কারখানায় চাকরি লইয়া বিদ্যুৎ বিদ্যা শিখিয়াছে। কোম্পানীর বড় সাহেব বিদ্যুৎ সম্বন্ধে তাহার সহজাত বুদ্ধি দেখিয়া তাহাকে চাকরি দিয়াছেন। শীঘ্রই পাটনায় বিদ্যুৎবাতি আসিবে, ভূপৎ কোম্পানীর পক্ষ হইতে পাটনায় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও মেরামতির দোকান খুলিবে। পঞ্চাশ টাকা মাহিনা ও কমিশন।

সম্পৎ সিং বলিলেন—বেটা, তুমি পরের নৌকরি করবে কেন? তোমার কি পয়সার অভাব?

ভূপৎ বলিল— পয়সার জন্যে নয় পিতাজি, আমি বিজলির কাজ করব। বিজলির কাজ করতে আমি ভালবাসি। পাটনায় বাসা ঠিক করে আমি আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি। বুতরুদেরও নিয়ে যাব।

সম্পৎ সিং তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–তোমার যে-কাজ ভাল লাগে তাই কর বেটা। আমিও তোমার সঙ্গে পাটনায় যাব, তোমার ঘর বসত করে দিয়ে আসব।

পরদিন ভূপৎ পিতা ও স্ত্রীপুত্র লইয়া পাটনা চলিয়া গেল। ভূপতের অপদার্থ নাম ঘুচিয়াছে, সে তাহার স্বধর্ম খুঁজিয়া পাইয়াছে।

ভাবিতেছি, ভূপৎ যদি শতবর্ষ পূর্বে, এমন কি পঞ্চাশ বছর পূর্বেও জন্মগ্রহণ করিত তাহা হইলে কী হইত? তখন বিদ্যুৎ-যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নাই, ভূপত সম্ভবত নিষ্কর্মা অপদার্থ বদনাম লইয়াই জীবন কাটাইয়া দিত। বর্তমানেও এমনি কত অপদার্থ মানুষ অজ্ঞাত ভবিষ্যতের পানে চাহিয়া নিষ্ক্রিয় নিরর্থক জীবন কাটাইয়া দিতেছে কে তাহার হিসাব রাখে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *