Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্য ভাই || Bani Basu

অন্য ভাই || Bani Basu

শমী এসেছে আগে। ধৈর্য ধরতে না পেরে। মেয়েকে নিয়ে একলা। ওর স্বামী বিনায়ক কথা দিয়েছে শিগগির আসবে। দু-একদিন থেকে ওদের নিয়ে ফিরে যাবে। সময় জিনিসটা ওর কখনও হয় না। ছুটি জিনিসটাও ও কক্ষনো নাকি পায় না। আসল কথা, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের কারও অতিথি হয়ে থাকতে বিনায়কের ভীষণ আপত্তি। কতবার শমী বলেছে, দিদির তো নিজের সংসার। শ্বশুরবাড়ির কেউ নেই। সংকোচ কিসের? অতবড়ো বাংলো, গেলেই একখানা পুরো ঘর, বাথরুম, সামনের ব্যালকনি ছেড়ে দেবে। ব্যালকনিতে তুমি যত খুশি যোগাসন কর না, কেউ দেখতে আসবে না। অত করে বলে জুলি, যেতে দোষ কি? দিদি বেশি বড়ো নয়, শমী তাকে জুলি বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। বিনায়কের সঙ্গে কথায় কেউ পারবে না। বলবে—কী আশ্চর্য, দিদি অমন একখানা গ্ল্যামারাস শালী, যেতে বলছে, আমি কি উপায় থাকলে যেতুম না!

শমী এর চেয়ে বেশি কথা বলতে পারে না। তার ছিপছিপে নাতিদীর্ঘ শরীরের ওপর পাতলা ঈষৎ পাণ্ডুর মুখ। গভীরভাবে বসানো চোখের বাদামি মণি হঠাৎ হঠাৎ বড়ো বড়ো পল্লব দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে সে। কোনো তর্কাতর্কির সম্ভাবনা দেখলেই এই তার প্রতিক্রিয়া। নাকের পাটা একটু কাঁপে। কপালের ওপর একটা লম্বা শিরা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। শমী বেশি কথা বলতে পারে না।

হঠাৎ দেখলে মনে হবে সে খুব ধাতস্থ। কাণ্ডজ্ঞানের বেড়া ভাঙবার মতো ভাবাবেগের কারবারি আদৌ নয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ভাবাবেগে কখনও কখনও তার গলার কাছের পেশি ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। তারপর বহু চেষ্টায় মস্ত বড়ো একটা খাদ্যপিণ্ডের মতো এবার নেমে যাচ্ছে গলনালি দিয়ে। এসব জিনিস কেউ বড়ো একটা লক্ষ করে না। শমীর স্বামী বিনায়কও না। কাজেই শমী যে কী, শমী যে কে এ প্রশ্ন অনুত্তরই থেকে যায়। আরও অনেক মেয়ে, কিছু কিছু পুরুষ অর্থাৎ আরও কিছু কিছু মানুষের মতো এ লোকযাত্রায় শমী পরিচয়হীন রয়ে গেছে। ছাইয়ের ওপর হালকা ফুলছাপ শিফন শাড়ি পরে, একটা পাতলা সুটকেস একহাতে, আর তার সযত্নলালিত বারো বছরের মেয়ে লোপামুদ্রাকে আর একহাতে নিয়ে শমী যখন প্ল্যাটফর্মে পা দিল, তার দিদি জুলি আর জামাইবাবু বরুণদা দু ধার থেকে মহা হইচই বাধিয়ে দিলেন, যাক শমী তুই শেষ পর্যন্ত আসতে পারলি তা হলে। সূর্যটা তো ঠিক দিকেই উঠেছিল রে।

দেখো চাঁদটা লক্ষ করতে হবে। চাঁদের একটা কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে।

জুলি আদর করে কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই খুব রোগা হয়ে গেছিস। বরুণদা বললেন, নিজের সঙ্গে তুলনা করলে তুমি সবাইকেই রোগা দেখবে জুলি। ওটা কোরো না।

নিজেকে বাদ দিয়ে কথা বলো না। জুলি খ্যাঁক করে উঠল, যতই হোক তোমার মতো ভুড়ি আর ডবল গাল তো আমি বাগাতে পারিনি। জানিস শমী, তোর বরুণদার ক্লাবের ওপর কী টান, কী টান। ক্লাবে গিয়ে রোজ সন্ধেবেলা কী হয় বলো তো?

শমী একটু মৃদু স্বভাবের। সে বাধা দিয়ে বলল, ওঃ জুলি, বরুণদার কী সুন্দর লালচে গাল হয়েছে, তুই শুধু ফ্যাটটাই দেখলি!

বরুণদা গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, দেখো বাবা গালাগাল দিচ্ছে না তো?

লোপামুদ্রা ওরফে লুপ তখন তার তিন বছরের বড়োদাদা সীজারের সঙ্গে গল্পে মত্ত। উত্তেজিত হাত-পা নাড়ার মধ্যে থেকে স্টেফি, এডবার্গ, লেন্ডল বুলেটের মতো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। দুজনে এগিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে স্টেশন ছাড়িয়ে। বড়োরা কেউ এল, না এল লক্ষই নেই।

বরুণদা বলল, চলো, জুলি শমী তাড়াতাড়ি পা চালাও, সুটকেসটা আমার হাতে দাও, কী এমন মহামূল্যবান সম্পত্তি ওতে করে নিয়ে এসেছ যে তখন থেকে আঁকড়ে রয়েছ?

জুলি বলল, হ্যাঁরে শমী, তাড়াতাড়ি পা চালা, নইলে স্টিয়ারিং সীজারের হাতে চলে যাবে।

শমী ভুরু কুঁচকে বলল, সে কী? ওর কি লাইসেন্স আছে নাকি! ওর বয়সের ছেলেকে কি লাইসেন্স দ্যায়?

জুলি বলল, ষোল-আঠারো ওসব সাধারণ মানুষের নিয়ম শমী। জিনিয়াসদের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনও বাধাই নয়।

বরুণদা বললেন, তা ছাড়া গাড়ির স্টিয়ারিং তো সামান্য কথা জীবনের স্টিয়ারিংটাই আমার ছেলের হাতে চলে বাবার উপক্রম হয়েছে।

শমী হেসে ফেলল, তা হলে আর দেরি নয়, শিগগির চলুন যদি আটকাতে পারি।

বরুণদা কটাক্ষে দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আটকাবে সিজারকে? বলে হাতি ঘোড়া গেল তল, এখন মশা মাপে কত জল!

জুলি রেগে উঠল, দ্যাখো আমাকে যখন তখন হাতি, ঘোড়া, জলহস্তী, বাইসন যা খুশি বলল আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বোনকে খবরদার মশা মাছিটাছি বলতে পারবে না।

বরুণদা হাসতে হাসতে বলল, মাছির আগে যদি টুক করে একটা মউ বসিয়ে দিই? তবে? তবে গ্রাহ্য হবে তো?

শমী বলল, জুলি রাজি হসনি। মউমাছি কী রকম ভিনভিন করে দেখেছিস? ঘেন্না লাগে না ঘুরঘুর করলে? আর সুযোগ পেলেই হুল ফোঁটায়। আমাদের বারান্দার পাশে দোলনচাঁপার অত সুন্দর গাছটা কেটেই ফেলতে হল মউমাছির জ্বালায়।

বরুণদা বলল, দুই বোনই দেখছি সমান বিচক্ষণ। গাড়ি যখন জুলিদের বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকল তখন তামাটে দিগন্তে সূর্য একটি গনগনে লাল গোলা। দু-দিকের দুটো দরজা খুলে সিজার আর লুপ আগে পিছে দৌড় দিয়েছে। শমী বলল, কী সুন্দর রে জুলি। রোজ ভোরবেলা বেড়াতে যাব।

বরুণদা বলল, খবরদার এটি কোরো না। ভীষণ ডাকাতের উপদ্রব এ অঞ্চলে, ভোরই বলো, সন্ধেই বলো, নির্জন সময়ে পায়ে হেঁটে এসব রাস্তায় বেরোনোর কথা কল্পনাও কোরো না।

শমী হতাশ গলায় বলল, কী যে বলেন বরুণদা। ওসব আপনার বাহানা। বেরোলে সাহেবের প্রেসটিজ যায় নাকি?

বরুণদা বলল, বেশ তো দিদিকে জিজ্ঞেস করো।

সত্যি রে, জুলি বলল, আমাদের থেকে দক্ষিণে কোণাকুণি ওই বাড়িটা, ওখানে চ্যাটার্জিরা থাকে, রবিবার সকালে চাবি দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে এসে দ্যাখে স্কুটার টিভি টোস্টার—মানে যাবতীয় গ্যাজেট চুরি গেছে। সেই সঙ্গে ভালো ভালো জামাকাপড়। তা ছাড়াও শুনেছি, গ্যাং রাস্তার মাঝখানে পথ আটকে কত লোকের ঘড়ি আংটি হার সব খুলে নিয়েছে।

শমী বলল, এসব পরাই বা কেন! সিজার, লোপামুদ্রা কখন ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা খেয়াল করেনি, সিজার বলে উঠল, ডোন্ট ওয়ারি মাসি। আমি তোমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবো। শুধু টাইমটা আমার বলে দিয়ো। গ্যাং-ট্যাং এলে কী করবি? শমী হেসে বলল।

গ্যাং? আমি নিজেই তো একটা গ্যাং। কী করবে ওরা আমি থাকতে? ফুঃ।

বরুণদা জনান্তিকে বললেন, সিজারের বাণী কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ হয় না, বুঝেছ শমী? সাধারণত উনি এত উদার হন না। হয়েছেন যখন অফারটা নিয়ে। নাও।

টেনে বাঁধা চুল খুলতে খুলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল শমী। তামাটে রঙের মাটি। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ছবির মতো। সন্ধে হতেই ঝুপ করে নির্জনতা নেমে পড়ল যেন পাখা বিস্তার করে। জুলি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে—এখানে জঙ্গল নেই, না রে?

নাঃ। জঙ্গল এখানে পাবি না। তবে এত গাছ, এত সুন্দর সাজানো, সযত্নে গড়ে তোলা পার্ক যে জঙ্গলের অভাব তুই টেরই পাবি না।

শমী ভুরু কুঁচকোল—কী যে বলিস? সাজানো পার্ক আর জঙ্গল এক হল? জঙ্গল যে অরণ্য, আদিম একেবারে প্রাথমিক, স্বতঃস্ফূর্ত, বলতে বলতে শমী হঠাৎ যেন সংকুচিত, হয়ে থেমে গেল। সে বেশি কথা বলতে পারে না। যখন বলে, বলে ফেলে, তখন এমনি করে সংকুচিত হয়।

জুলি ঈষৎ অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখে যেন ভৎসনার দৃষ্টি। বলল, শমী তোর জঙ্গল জঙ্গল বাই এখনও গেল না? সাজানো গাছপালা, বীথিকা, মানুষের হাতে পরিকল্পনা করে পোঁতা গাছ অনেক ভালো বুঝলি? জুলি নিঃশ্বাস ফেলল একটা। তারপর বলল, হ্যাঁ রে, বিনায়ক ঠিক আসবে তো?

না এলে কী? আমি একলাই তো এলাম। একলাই আবার চলে যেতে পারব।

তা নয়, মানে হ্যাঁরে শমী। তোরা একসঙ্গে বেড়াতে যাস না? এই যে তুই চলে এলি ওর দেখাশোনা কে করবে? শাশুড়ি? কিন্তু তোর মন খারাপ করবে না?

শমী হেসে ফেলল, বলল, কেন বেড়াতে যাব না, এই তো গত বছরই গোয় ঘুরে এলাম, জানিসই তো! আর শাশুড়িই তো বরাবর দেখাশোনা করে এসেছেন, এখনই হঠাৎ সেটা বদলে যাবে কেন?

জুলি স্বস্তির হাসি হাসে, বলে, যাই বলিস বাবা, বরছাড়া বিয়ের পর কোথাও যেতে কেমন কেমন লাগে। যেন মনে হয় লোকে মনে করবে দুজনে বনিবনা নেই।

তুই কি তাই-ই ভাবছিস না কি? এবার গম্ভীর হয়ে শমী জিজ্ঞেস করল।

না তা ঠিক নয়।

জুলি ভুলে যাস না তেরো বছর বিয়ে হয়ে গেছে আমার। ছোটোখাটো হলেও একটা কাজকর্ম আমি করি। বনিবনার বাইরের চেহারাটা তোদের মতো গাঢ় নাও হতে পারে।

ভেতরের চেহারাটা ঠিক থাকলেই হল জুলি হেসে বলল—যাক চল তো এখন, তোর বরুণদা চায়ের জন্য অনেকক্ষণ ধরে হাঁকডাক করছে।

চায়ের আসরে দুই ছেলেমেয়েকে দেখা গেল না। শমী ব্যস্ত হলে বরুণদা বললেন, তুমিও যেমন, সিজার নিশ্চয় লুপকে নিয়ে ক্লাবে চলে গেছে। দুজনেই খেলা পাগল, এখন ক্লাবে জুনিয়রদের টেনিস হবে।

শমী বলল, বলে যাবে তো!

বলে যাবে সিজার? তা হলেই হয়েছে। বলে-টলে যাবার কথা তার স্মরণে থাকলে তো! জুলি কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শমীর ঘুম আসে না। চারদিক থেকে একটা নিবিড় আরাম ঘিরে ধরেছে তাকে। এই ফাঁকা ফাঁকা কলোনি, নিষ্কলঙ্ক বিশুদ্ধ বাতাস, বাতাসে গাছের গন্ধ, এ তার কিশোরী বয়সের প্রতিবেশ। গত চার বছর ধরে জুলিরা এখানে আছে। প্রথম থেকেই তাকে ডাক দিচ্ছে। এতদিনে তার আসার সময় হল। যেন মনে হচ্ছে সে এখানেই ছিল। মাঝখানটা অর্থাৎ হোস্টেল, গোয়াবাগান, এন্টালি, বিনায়ক এই সবসুদ্ধ জীবনের অংশটা স্বপ্ন। দরজায় টুকটুক করে আওয়াজ। উঠে দরজা খুলে দিল শমী। যা ভেবেছে তাই। জুলি উঠে এসেছে। ফিসফিস করে বলল-ঘুমোসনি তো! আমিও ঘুমোতে পারিনি। কতদিন পরে দু-বোনে, বল তো! তোর মেয়ে ঘুমিয়েছে?

অনেকক্ষণ। আমিই এপাশ ওপাশ করছি।

কেন রে? বালিশ-টালিশ ঠিক হয়েছে তো? তুই তো পাতলা বালিশে শুস।

বালিশটা কোনো সমস্যা নয়। আমার ঘুম হচ্ছিল না…

নতুন জায়গা বলে না কি রে?

নতুন বলে নয় রে জুলি পুরোনো বলে, শমী যথাসম্ভব ফিসফিস করে বলল।

বিছানার ওপর উঠে এসে জুলি সাবধানে লোপামুদ্রাকে সরিয়ে দিল। তারপর বোনের পাশে ঝপাং করে শুয়ে পড়ল।

তোর এ জায়গাটা পুরোনো লাগল?

দিনের আলোয় লাগেনি। এখন রাতের অন্ধকারে লাগছে…।

শমী বেশি কথা বলতে পারে না। জুলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী করে যে তোর পুরোনো লাগছে জানি না। কোথায় সে শালের জঙ্গল? বনকাটা বসত কই? রোজই কোয়ার্টাস উঠছে নতুন নতুন…সদ্য কাটা গাছের গুঁড়ি, ডালপালার ছাঁট রাস্তার পাশে সে সব কই?

না-ই থাকল, ছোট্ট গলায় জবাব দিল শমী, অন্ধকারে আমি শালমঞ্জরীর গন্ধ পাই এ রকম ফাঁকা জায়গায় এলেই। আসিনি অনেকদিন। গন্ধটাও পাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেইসব দিনের গন্ধ। শমী পাশ ফিরে জুলিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। জুলি বলল, শমী, তুই কি চিরকাল ছেলেমানুষ থাকবি! শমী জুলিকে ছেড়ে সরে শুল, বলল, আমি তো ছেলেমানুষ নই! আমি তো কোনো কালেও ছেলেমানুষ ছিলাম না জুলি, চিরকাল জ্ঞানবৃদ্ধ, তৌল করে, মেপে চলি, চলি না!

জুলি তরল গলায় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই একেবারে ঠাকুমা-দিদিমা আমি জানি। এখন চুপ কর তো! লুপটা ঠিক তোর মতো হয়েছে। না রে?

শমী অবাক হয়ে বলল, লুপকে তুই আমার মতো কোথায় দেখলি? ও কি দস্যি জানিস! তা ছাড়া ও খুব মিশুক। খেলাধুলো করে। ওর চেহারাও খানিকটা ওর বাবার মতো। সবাই বলে।

সবাই বলুক। ভীষণ একটা আদল আছে। আসলে আজকাল ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার ধরনটা এমন হয়েছে যে ওরা খানিকটা দস্যিগিরি দলে পড়েই করে। এগুলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরে ভেতরে ও তোর মতন।

আমার মতো হয়ে আর কাজ নেই। তুই একদিন দেখেই ওর ভেতরটা বুঝে ফেললি।

তোরা রোজ দেখিস তো! আমরা মাঝে মাঝে দেখি বলে আদলটা ঝট করে ধরতে পারি। চুলের ফেরটা ঘাড় কাত করে তাকাবার ভঙ্গিটা। দেখিস ও-ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ তোর মতো চুপ হয়ে যায়।

তোর ছেলে কিন্তু তোরও এক কাঠি বাড়া হয়েছে রে জুলি।

যা বলেছিস। সমস্ত গ্যাজেটস-এর পার্টস খুলে ফেলে জানিস, যখন তখন কার্নিশ বেয়ে বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে, লগি দিয়ে বাথরুমের ছিটকিনি ফেলে দিচ্ছে। বাড়িতে লোক এলে তার স্কুটার নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে, যা-তা একেবারে।

পার্টস খুলে ফেলে? তার মনে ও এঞ্জিনিয়ার হবে, দেখিস।

মেকানিকও হতে পারে, জুলি মস্ত বড়ো একটা হাই তুলল।

আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি, মা, বাবা, মাসি, আমার পাহাড়ে… স্কুটার নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল সীজার।

সিজার, সিজার সিজারের বাবা আতঙ্কিত রুষ্ট গলায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন। কিন্তু স্কুটারের আওয়াজে বেচারার গলায় আওয়াজ একেবারে চাপা পড়ে গেল।

জুলি, তুমি কিছু বললে না।

বলবার সময় পেলে তো বলব। জুলি স্যান্ডউইচে মাখন মাখাতে মাখাতে উত্তর দিল। স্যান্ডউইচগুলো হাতে করে তৈরি করে প্রথমেই দুই ছেলেমেয়েকে দিয়েছে। দুধ ঢেলে দিয়েছে কাপে। সিজার তো খায় না, গেলে। চোঁ করে দুধ খাওয়া হয়ে গেল। তিন চার কামড়ে স্যান্টউইচ শেষ। লুপকে বলল, দেরি করছিস কেন? আর স্টাইল করে খেতে হবে না। এখনও গোঁফে দুধ লেগে যায়। আবার কড়ে আঙুল উঁচু করে কাপ ধরা হয়েছে!

জুলি একটা ধমক দিল, ওর তোর মতো সাপের গেলা নয়। দাঁত আছে তার ব্যবহার করছে। স্টাইল আবার কি? ভদ্রভাবে খাচ্ছে। তোর মতো হাউমাউ করছে এ আমাদের অনেক ভাগ্য।

লুপ কিন্তু একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়েছে—হাতে তখনও স্যান্ডউইচের টুকরো, আমার হয়ে গেছে। চুল নাড়িয়ে সুর করে সে বলল। বলতে বলতে দু-জনেই খোলা দরজা দিয়ে ছুট। তিনজনেই ভেবেছে ওরা বাগানে যাচ্ছে। সিজার যে সোজা গ্যারাজে গিয়ে স্কুটার বার করে ফেলবে, ভাবেনি কেউ।

জুলি বলল, এমনিতে কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু ট্যাঁকে খুঁজে মেয়েটাকেও নিয়ে গেল যে, দলমা পাহাড় কি এখানে?

শমীর চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে, আর থাকতে না পেরে বলল, কী হবে বরুণদা! পাহাড়ের পথে স্কুটারের পেছনে। লুপের তো স্কুটারে চড়ার কোনো অভ্যেসই নেই।

বরুণদার মুখে চোখে ছেলের প্রতি গভীর বিরক্তি ফুটে উঠেছে। কিন্তু উদ্বেগ খুব বেশি নেই। বললেন, ভাবনার কিছু নেই। বিপদের ভয় নেই। ও ছেলেকে এখানে সবাই চেনে। আমার আপত্তি হচ্ছে এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটাতে। নিজে প্ল্যান করেছে, বলবার জানাবার দরকার মনে করে না। মায়ের আদরের ফল। ফল ভোগ তো করতে হবেই। চোদ্দ পনেরো বছরের ধেড়ে ছেলেকে সব সময়ে আমার জোনি, আমার যিশু করে ন্যাকামি করার ফল পেতেই হবে।

জুলি বলল, আর তুমি যে একেকটা দুরন্তপনামি করে আর বাহবা-বাহ-বাহা করে ওঠো? শুধু জোনি যিশু করলেই আদর হয় না। সবেতে ও-রকম আমার ছেলে কী দারুণকীর্তি করেছে ভাব দেখালে প্রশ্রয় হয় যেটা আদরের চেয়েও খারাপ। জানিস শমী, সেদিন ভুলে চাবি না নিয়ে সদর দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়েছে। তিনজনেই বেরিয়েছি। চাবি না নেওয়ার দোষটা ওর। তারপরে ফিরে রাত নটায় আর বাড়ি ঢুকতে পারি না। ওদিকে উনি, মানে সিজারচন্দ্র কোত্থেকে লাঠি জোগাড় করে পেছন দিকের দরজা দমাদ্দম পিটিয়ে তার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে। সে এক কাণ্ড! আর তোর বরুণদার সে কি স্মিতমুখ, ভাবটা ছেলের মতো ছেলে তৈরি করেছি একখানা। গণ্ডগোলটা নিজে পাকিয়েছিল কিনা! এখন তুইই বল রাত নটায় ওভাবে খিড়কির দরজার ছিটকিনি খোলার কৌশলটা যদি চোর-ডাকাতের চোখে পড়ে যায়?

বরুণদা বলল, লুপের জন্য তুমি ভেবো না শমী। সিজার কিন্তু সত্যিই খুব ডিপেন্ডেবল।

দুপুর একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে জুলি বলল, খেয়ে নিই আমরা। ভীষণ খিদে পেয়েছে।

শমীর ইচ্ছে নেই—বলল, আরেকটু দেখি, ওরা খেল না।

বরুণদা আর জুলি হাসি হাসি মুখে চোখাচোখি করল, বরুণদা বললেন, একটা বেজে গেছে অথচ সিজার খায়নি এ হতে পারে না। আর সিজার খেলে লুপুও খাবে। শমী তুমি বিনা দুশ্চিন্তায় খেয়ে নাও।

খেয়ে-টেয়ে মশলা মুখে দিয়ে দু বোনে সব তোলাতুলি করছে, দুই মূর্তি ঢুকল। আওয়াজে আগেই জানান দিয়েছিল।

জুলি মারমুখী হয়ে বলল, কী ব্যাপার? পিঠে বেত ভাঙব নাকি? নিজে তো যা খুশি করছ, বোনটার যে মুখ শুকিয়ে গেছে না খেয়ে না দেয়ে। সে খেয়াল নেই?

সিজার উবাচ, না খেয়ে না দেয়ে? লুপ! বলে লুপের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।

লুপ বলল, না মাসি আমরা নটরাজ থেকে খেয়ে এলুম। সিজারদা অনেক খাইয়েছে।

রেস্ত কোথায় পেলি? জুলি সিজারের দিকে তাকিয়েছে।

তোমার ব্যাগ। অম্লানবদনে উত্তর দিলেন সিজারবাবু।

বরুণদা বললেন, ওকে চুরি বলে, তুই চোর তা হলে?

সিজার বলল, পকেট মানি দিচ্ছ না যে! গার্লফ্রেন্ডদের কাছে আমার প্রেসটিজ থাকে না।

সিজার আঙুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

শমী-জুলি চুপ। বরুণদাও। লুপ চুপিচুপি মার কানে কানে বলল, মা খুব রাগ করেছ? সীজারদা ব্রেকফাস্টের সময়েই ঠিক করল পাহাড়ে যাবে, বলবার দরকার নেই বলল। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে মা। দারুণ।

শমী যেন অনেক দূরে চলে গেছে, জবাব দিচ্ছে না, কিন্তু তার মুখে রাগের চিহ্নমাত্র নেই। সেও কি যাচ্ছে? স্কুটারে না, সে সময়ে স্কুটারের এত চল তো ছিল না। সাধারণ বাইসাইকেলে ডবল ক্যারি করছে তাকে একটি ছিপছিপে চেহারার লম্বা ছেলে। খুব কোমল মুখ। সবে গোঁফ দাড়ি গজিয়ে মুখটা জঙ্গল হয়েছে। ত্বকের লালিত্য যায়নি এখনও। চোখ দুটো স্বপ্নে ভরা। শালজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কখনও সাইকেলে, কখনও সাইকেলকে হাঁটিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে, শুকনো শালপাতা দু পায়ে মাড়িয়ে মড়মড় শব্দ করতে করতে।

এই জঙ্গলটা পার হলেই একটা ছোট্ট টাকলামাকান মরুভূমি বুঝলে শমী। বালিতে পা ডুবে যাবে। মরুভূমি পার হলে তবে অজয়। অজয়ে হাঁটুজল। পার হলে কেন্দুবিল্ব। যদি কপালে থাকে, আর রাত জাগতে পারো তো আসল বাউলের গান শুনতে পাবে—ভালো করে পড়গা ইস্কুলে—এ-এ, নইলে কষ্ট পাবি শেষকালে।

জুলি বলল, গেছিস, গেছিস। মাকে না বলে গেছিস কেন রে?

দ্যাখ, মা কী ভীষণ অভিমান করেছে, লুপু আর এ রকম করিস না। জুলি দাঁড়াল না, তার অনেক কাজ। বরুণদা ঘরে চলে গেছে। এই একটা দিনই তো বিশ্রাম। নুপু মায়ের ঊরু জড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ে বলল, মা তুমি সত্যি রাগ করেছ? সিজারদাটা যে কি? এমন করে বলে আমি না বলতে পারি না। ওর যা এনথু না! মা, সিজারদাটার মাথায় কয়েকটা স্কু ঢিলে আছে, কিন্তু একেবারে ফ্যানটা!

শমী মৃদু হেসে বলল, এখনও কিছু প্রোগ্রাম আছে না কি তোদের?

তেমন কিছু না। ওয়ার্ড-মেকিং খেলি একটু! খেলি?

এতদূর থেকে রোদে রোদে টহল দিয়ে এলি একটা বইটই নিয়ে বসলে তো হত।

দূর, টহল আবার কি। লুপ ফিক করে হেসে ফেলল।

সত্যিই ওদের বয়সে শুয়ে বসে থাকা কারোই রুটিনে লেখে না। জুলি বেড়াত সারাক্ষণ টঙস টঙস করে। শমী একটু শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু সেও পড়াশোনার সময়টুকু ছাড়া দেখো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন গড়ে উঠেছে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কলোনি। দেখতে দেখতে উঠে যাচ্ছে সামনে পেছনে জমিশুদ্ধ সুন্দর সুন্দর কোয়ার্টার্স। লরিতে করে কাটা গাছের গুড়ি যখন তখন হু হু করে চলে যাচ্ছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। শমীদের বাড়িটা তখনও শেষ বাড়ি। তারপর থেকেই জঙ্গলের সীমানা আরম্ভ হয়েছে। শালের ঘন জঙ্গল। তার সঙ্গে প্রচুর সেগুন, মহুয়া, ছাতিম, শিরীষ গাছ। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরাটাই ওর প্রধান করণীয়। তার ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া পড়াশোনা ছোটখাটো ঘরের কাজকর্ম। বাবা সকালবেলা ইনস্টিটুটে চলে যাবেন। দুপুরবেলা কোনোদিন খেতে আসবেন। কোনোদিন টিফিন ক্যারিয়ার পৌছে দিতে হবে। বেশিরভাগ দিনই বাড়ির কম্বাইন্ড-হ্যান্ড দীনবন্ধু যায়, সে না পারলে জুলি চলে যায় সাইকেলে চড়ে। কেউ নেই আর, কেউ কোথাও নেই, একমাত্র মেজপিসিমার ছেলে রিনটিনদা ছাড়া। সে ইলেকট্রিক্যাল পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। যখনই সময় পায় হঠাৎ হঠাৎ করে দুই বোনের কাছে চলে আসে। জঙ্গল চষা হয় আরও ভালো করে। অনেক দূর চলে গেছে ছুটির দিন সন্ধেবেলায়। সপ্তপর্ণী বৃক্ষের পেছন থেকে চাঁদ ওঠা দেখা হয়েছে। জুলি বলছে, রিনটিনদা তোর খিদে পায়নি, আমরা বেরিয়েছি তখন আড়াইটে, তিনটে হবে। দেখ তো কটা বাজে! জঙ্গলে শেয়াল ডাকছে।

ঘড়িটা রিনটিন রুমাল দিয়ে চট করে বেঁধে ফেলল। বলল, সময়কে একটু ভোলো, ভুলতে শেখো, খিদে তো আমারও পেয়েছে। খিদে পাওয়ার ফিলিংটা অদ্ভুত সুন্দর নয়? লেট ইট লাস্ট এ লিটল মোর। সুগন্ধ রাতটাকে সিল্কের চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে হিম আর জ্যোৎস্না মেখে বাড়ি ফেরা। বাবা টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছেন, কিছুই খেয়াল নেই। দীনবন্ধু বাইরে দাঁড়িয়ে। মুখ গম্ভীর। তার সব খেয়াল আছে। হিম লেগে পরদিন শমীর ঠেসে জুর! গনগনে মুখের ওপর জুলি ঝুঁকে পড়েছে ওষুধটা খা। শমী। শমী মুখ টিপে আছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রিনটিনদা বলছে, জ্বর হলে আমিও চট করে ওষুধ খাই না। জ্বরের ফিলিংটা আমার অসাধারণ লাগে। কী রকম দাঁত কষতে ইচ্ছে করে। কী রকম একটা ঝিমুনি ধরে। লালচে ঝিমুনি! শমী, দেখো, চোখ চেয়ে দেখলে ঘরবাড়ি জীবন সব এখন স্বপ্ন মনে হবে। আসলে জ্বরটর হলেই সত্যি বোঝা যায় জীবনটা স্বপ্ন।

জীবনটা স্বপ্ন? জুলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে।

জ্বরোজ্বরো গায়ে শমী মুগ্ধ হয়ে ভাবছে জীবনটা স্বপ্ন!

রিনটিন জানলার কাছে থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছে, শমীর বিছানার খুব কাছে–হ্যাঁ! ঘুমিয়ে পড়েছি, সামহোয়ার এলস দেখছি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–আমি শমী, আমি জুলি, আমি রিনটিন, আমার কত কাজ, কত ইচ্ছা, সাধ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে, বুঝতে পারব…।

কী বুঝতে পারব? আমি জুলি নই! জুলি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করছে।

শমী উদগ্র আগ্রহে উত্তরটার জন্যে অপেক্ষা করছে। রিনটিন হেসে বলছে, জানি না, জানি না তো কী বুঝতে পারব। এখনও তো ঘুম ভাঙেনি!

যত্ত বাজে কথা। রোজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেগুলো দেখি সেগুলো তবে কী?

স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। তার ভেতর আরও স্বপ্ন। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসবে স্বপ্নগুলো।

জ্বরের ঘোরে শমী শুনছে আর তলিয়ে যাচ্ছে, কোনো গভীর গহন, অন্যরকম অন্যলোকে। সমস্ত অন্তরঙ্গতা, বন্ধুতা, ভালোবাসাগুলো তো স্বপ্নই। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসে। ঠিক যেমন শুনেছিল। অবিকল। নিশ্বাস ফেলে শমী পাশ ফেরে। ম্যাগাজিন হাতে করে, ছবি আর লেখার ওপর চোখ, মনের মধ্যে অন্য ছবি অন্য শব্দ। দিনের জাগরণবেলা নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। বিকেলের ঘুম ভাঙে।

লুপের বাবা এসে গেছে। জুলি বলল, এসেছ খুব ভালো কথা, আমরা হাতে চাঁদ পেয়েছি, কিন্তু ঘোড়ায় জিন দিয়ে এলে কেন? দুদিন থাকো!

বিনায়ক বলল, উপায় নেই। সময় নেই। নাই নাই নাই যে সময়। দিদি কত। কষ্ট করে একটা উইকএন্ড বার করেছি যদি জানতেন।

উইকএন্ড আবার বার করতে হয় না কি? ও তো প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে থাকেই!

আরে? শমীকে জিজ্ঞেস করুন! কত শনিবার আমাকে হুটহাট করে টুরে চলে যেতে হয়!

শমী হাসছে। গুছিয়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে সব। পেছনের বাগানে শুকোচ্ছে তোয়ালে, পেটিকোট, পটির কাছটায় একটু ভিজে। শাড়িটা পাট করে নিচ্ছে। ঘরে এল। লুপ পেছন পেছন বাগানে গিয়েছিল। এখন আবার পেছন পেছন ঘরে ফিরে এসেছে। বায়না ধরেছে, ও মা, আর দুদিন পর তো এমনিই ছুটি ফুরিয়ে যেত। আর একটা দিন, জাস্ট একটা দিন থেকে গেলে কী হয়!

বাবা বলল, তোর তো দিনপঞ্জি মাসির আদরে এখন সবই ওলটপালট হয়ে গেছে রে লুপু। অভ্যেসে ফিরতেই তো ও দুটো দিন লেগে যাবে।

পকেটে হাত, ঠোঁটে সিগারেট বাবা চলে যাচ্ছে। এখন কেউ নেই। বাবা, মাসি, মেসো সব লনে নেমে গেছেন, গল্প করছেন। মাসি লুপের জন্য রং-বেরঙের একটা জাম্পার বুনেছেন, তাড়াতাড়ি করে ঘর বন্ধ করছেন এখন। একটু পরেই বেরোতে হবে। এখানে শুধু মা, মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে লুপু কাঁদছে। বুকভাঙা কান্না। যেন লুপু নয়, তার বুকের ভেতর বসে অন্য কেউ এ কান্না কাঁদছে। শমী আশ্চর্য হয়ে গেছে, আবার তো ছুটি পড়বে লুপু তখন আসব, গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে বেশি করে থাকিস। তখন আম পাকবে, কাঁঠাল পাকবে, মাসি বলছিল শুনিসনি?

গুমরে গুমরে কাঁদছে লুপ। আম-কাঁঠালের জগৎ থেকে অনেক দূরে।

লুপু শোন, এ রকম বোকার মতো কাঁদে না।

সিজারদা যে জানে না। ও যে নেই! টুর্নামেন্ট খেলতে গেল টেলকোয়। কাল আসবে, দেখা হবে না। লুপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল।

তাতে কী হয়েছে! টুর্নামেন্ট খেলতে গেছে জানি তো। আবার পরে যখন আসবি, দেখা হবে!

আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভাঙা ভাঙা বোজা গলায় লুপ বলল।

শমী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্তম্ভের মত অনড়। নির্বাক। থোকা থোকা চুল লুপুর মাথায়। তার কোলের ওপর। চারদিকে ছড়িয়ে আছে লুপুর সাদা নাচ-ফ্রক লাল-কালো স্কার্ট, ব্লু জিনস, লুপুর ছোটোবেলা। টুকরো টুকরো এইসব যাত্রার আয়োজন এবং মেয়ের ছোটোবেলা সামনে রেখে শমী ফিরে যাচ্ছে তার নিজস্ব সেই অন্ধকার বারান্দায়। ওই তো জুলি কিছুদুরে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল পাকাচ্ছে। রিনটিন বলছে, ট্রেনের সময় হয়ে এল, এবার তো আমায় যেতেই হবে। জুলি, শমীকে বলো একবার আমার দিকে ফিরতে, একটিবার আমার সঙ্গে কথা বলতে, ওকে বুঝিয়ে বলো জুলি। আমি…আমি যে আর আসব না।

শমী যে বেশি কথা বলতে পারে না। নিজের ভেতরের অনুভব বাইরে প্রকাশ করতে অসীম সংকোচ। ধূসর অন্ধকারের মধ্যে সে শুধু ধূসরতর ছায়া। বিবর্ণ। প্রাণশূন্য। জুলি ফিসফিস করে বলল, তুই কেন এলি? আমরা তো বেশ ছিলাম। রিনটিনদা তুই কেন এলি? তার গলায় অভিমান, তিরস্কার।

বোধহয় সত্যি আসিনি জুলি, স্বপ্নে এসেছিলাম … তোরা একবার বল আমি শমীকে নিয়ে যেতে আবার আসব…

না। জুলি চাপা ক্রুব্ধ গলায় বলল, যা, তুই যা প্লিজ।

রিনটিনের পায়ের শব্দ কোনদিনই হয় না। নিঃশব্দে সে কখন চলে গেছে।

এখন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শমীর গলা দিয়ে মস্ত বড়ো একটা পিণ্ড নামছে। গলার পেশি, ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে। মা বলল, লুপ এখনই এত অধীর হলে চলবে কী করে? এইটুকুতেই যদি ভেঙে পড়ো। তা হলে এর পর?

কান্নাভেজা মুখ তুলল লুপ। মায়ের গলা নির্লিপ্ত, উদাসীন, যেন অনেক দূর থেকে বলছে। মা কখনও লুপকে তুমি বলে না! দুঃখ? অধীর? এর পর? আরও আছে? এর পর আরও আছে?

যাও, মুখ ধুয়ে এসো।

অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়েছে লুপুর মুখে। জুলি মাথায় হাত বুলিয়ে ভিজে গালে চুমু খেয়ে বলল, মন খারাপ করছিস কেন? আবার আসবি মাসির কাছে। অনেক দিন থাকবি।

শমী মনে মনে বলল, না জুলি না, আর আসব না, আর ও থাকবে না। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। ওই সিঁদুরে আগুন আমাকে পার হতেই হবে।

ট্রেনে উঠে বিনায়ক ডবল সিটে গুছিয়ে বসল মেয়েকে নিয়ে। মৃদু আলো জ্বলছে—ও কী রে লুপু! তোর মুখখানা যে কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে মা। এত কেঁদেছিস কেন?

লুপ কিছু বলছে না। বিনায়ক বলল, কী ব্যাপার শমী? কীসের কষ্ট ওর? অত কেঁদেছে। জাস্ট মাসিদের জন্য মন কেমন! কিছু বলছে না যে! বাবার মুখে উদ্বেগ। ট্রেনের শব্দ। গতিবেগ বাড়ছে। বাইরে অন্ধকার লম্বা দৌড়ে নেমেছে। শমী তার ঈষৎ ভাঙা অথচ কেমন এক রকম মিষ্টি গলায় যেন আপন মনে বলল, জানলে তো বলবে! ও যে জানেই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress