Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্য কোনওখানে || Siddhartha Ghosh

অন্য কোনওখানে || Siddhartha Ghosh

অন্য কোনওখানে

গায়ে জেব্রার মতো ডোরাকাটা ছটা দাঁতালো ঘোড়া ছুটে চলেছে ছ-জন সওয়ারি নিয়ে। আরোহীরা যে যেমন লম্বা, তার বাহনও সেই অনুপাতে দীর্ঘ।

একটি লতানো বট গাছের ছায়ার কাছে সেন্ট্রল হাইকমান্ডের সদস্যদের পৌঁছে দিয়ে গেল কেন্দ্রীয় পরিবহণ। মাথার ওপরে বড় সূর্যের ঝলসানি আর দিগন্তপারে ছোট সূর্যটা কাত হয়ে ফিকে হলুদ রং ঢেলে দিয়েছে।

সিগমা উঠে গিয়ে বটের মূল গুঁড়িতে হাত বোলাতেই প্রান্তবর্তী ছ-টা ডাল থরথর করে কেঁপে নড়েচড়ে উঠল। আস্তে আস্তে সাপের ফণার মতো উঁচু হয়ে পাতার গুচ্ছ দিয়ে রোদ্দুরকে আড়াল করল। উপবিষ্ট সকলের শরীরে স্নিগ্ধ ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। সিগমা আবার সংকেত জানিয়ে হাত বোলাল গাছের গায়ে। শুধু ওই ছ-টা ডাল আর তাদের পাতাগুলো এখন চামরের মতো দুলছে। বিশাল গাছটার বাকি হাজার হাজার ডাল কিন্তু নিস্পন্দ। ভারী গুমট গরম, একটু বাতাসও নেই।

সিগমা ফিরে এসে শিকড়ের আসনের ওপর বসল। বৃত্তাকার বসেছে সকলে, যাতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখ দেখতে পায়। ওরা মনে মনে নীরবে একে অপরের সঙ্গে চিন্তা বিনিময় করে, কিন্তু চোখে চোখ না রাখলে সেটা সম্ভব নয়। শুধু পেছন থেকে কাউকে ডাকতে হলে শব্দের প্রয়োজন পড়ে।

রিয়াস শুরু করল আলোচনা।

–আমাদের এই দুই সূর্যের গ্রহের আয়ু তো ফোরাতে চলল, খুব বেশি হলেও যমজ সূর্যকে আর হাজার দশেকবার প্রদক্ষিণ করব আমরা। কালই ডানাওয়ালা সন্ধানী সবুজ দাড়ি উড়ে এসেছিল। পরীক্ষা করে দেখেছি, ওর টেম্পারেচার রেকর্ডার অনুযায়ী আমাদের এই টাউরেপাস গ্রহের উষ্ণতা দিনে দিনে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আটাকান বলল, আমি তুষারাঞ্চলের রিপোর্ট পেয়েছি, বরফ যে হারে গলছে…।

–কিন্তু আমরা নিশ্চয় এ-সব পুরানো কথা আলোচনা করার জন্য আজকে মিলিত হইনি!–এমার চিন্তায় কিছুটা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়। অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক নয়। ছায়াপথ গ্যালাক্সির বাসিন্দা, জোড়া সুর্যের গ্রহ টাউরেপাসের বাসিন্দারা দীর্ঘকাল যাবৎ আসন্ন মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের অদ্ভুত বোঝাঁপড়ার দৌলতে হয়তো তারা আরও দু-তিন পুরুষ টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু নক্ষত্রজগতের বিধানকে খারিজ করার সাধ্য তাদের নেই। এটা তারা স্বীকার করে নিয়েছে।

কথাটা যত সহজে বলা গেল, তত সহজে অবশ্য ঘটেনি। হাজার কুড়ি বছর পৃথিবীর হিসাব) শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পর হঠাৎ একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে অস্থির হয়ে উঠেছিল বিদ্বৎসমাজ। অন্তিম পরিণতির মোকাবিলায় তাদের কী করা উচিত? এক দলের মতে, নিকটবর্তী কোনও বাসযোগ্য গ্রহ অধিকার করে সেখানে নতুন বসতি স্থাপন করাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ভিন গ্রহে গিয়ে বসতি স্থাপনের সুযোগ পাবে ক-জন? শুধু তো মানুষের কথা ভাবলেই চলবে না, জীব এবং উদ্ভিদ জগৎকেও বঞ্চিত করা চলবে না। তার মানে, নির্বাচিত কয়েকজনই শুধু সে সুযোগ পাবে। কী ভিত্তিতে ঘটবে নির্বাচন?

ভিন গ্রহ দখলের সমর্থকরা বলেছিল, এটা কোনও সুযোগের ব্যাপার নয়। নির্বাচিতদের বিশেষ সুবিধাভোগী মনে করার কোনও কারণ নেই, বরং তাদের এক দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটা মারাত্মক লড়াই–যার পরিণতি কেউই জানে না।

কিন্তু তবু নির্বাচনের সমস্যা মিটল না। একদিকে নিশ্চিত মৃত্যু, অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ–এই দুইয়ের মধ্যে দেখা গেল কেউই বিপদের সম্মুখীন হতে পেছপা নয়।

বাধ্যতামূলক কোনও নির্দেশ জারি করাও সম্ভব ছিল না। সে প্রথা আদিমকালেই লুপ্ত হয়েছে। ছলনা বা সত্য গোপন করারও কোনও উপায় নেই, কারণ ওদের মন এখানে আয়নার মতো। একজনের চোখে চোখ রাখলেই সব কথা জেনে ফেলা যায়।

বহু আলোচনা ও তর্কবিতর্কের পর একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তারপরেও অবশ্য কেটে গেছে অনেকগুলো প্রজন্ম। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি, উপযুক্ত সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে তারা। ইতিমধ্যে স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই প্রথমে তারা রোধ করছে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের বৃদ্ধি। বর্তমানে দ্রুত কমে আসছে তাদের সংখ্যা। নক্ষত্রজগতের পদার্থবিদ্যার রীতি অনুসারে কিছুকাল পরে এই গ্রহ আর বাসযোগ্য থাকবে না। কিন্তু সেদিন আসার আগেই বুদ্ধিমান প্রাণের শেষ চিহ্নটুকুও লুপ্ত হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সময় ফোরাবার জন্য বসে না থেকে বুদ্ধিমানরাই সময়মতো সরিয়ে ফেলবে নিজেদের।

একটা বড় কাজ কিন্তু এখনও বাকি। তাদের এই মহান সভ্যতা, তার সংস্কৃতি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা–এসবের উত্তরাধিকার তারা যোগ্য হাতে অর্পণ করে দিয়ে যেতে চায়। তাহলে মহাপ্রলয় তাদের কায়িক চিহ্ন মুছে দিলেও তারা প্রসন্ন মনে শেষের সেই দিনটিকে আপ্যায়ন জানাতে পারবে।

এই উত্তরাধিকার কীভাবে অর্পণ করবে তা-ই নিয়েই কিছুকাল যাবৎ টাউরেপাসের সকলে মেতে রয়েছে। দু-জন প্রতিনিধিকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তোলা হয়েছে। কিন্তু উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সমস্যা আজও মেটেনি। ছায়াপথ গ্যালাক্সির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্র পরিবারে অন্তত পঁচিশটি গ্রহের জীবের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে খবরাখবর সংগ্রহ করে চলেছে এরা। আজকেও সেই অনুসন্ধানের ফল আলোচনা করার জরুরি মিটিং তলব করা হয়েছে।

মিটিং-এর প্রধান চিন্তক (পৃথিবীর ভাষায় বক্তা) ডোরে। তার চোখের পরদা ইনফ্রারেড ও আলট্রাভায়োলেট ছাড়াও তড়িৎচ্চুম্বক তরঙ্গের সূক্ষ্মতম কম্পন ও তার তারতম্য ধরতে পারে। জীবন্ত মানমন্দির হিসাবে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে সে অদ্বিতীয়।

ডোরে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে ভাবনা শুরু করল। স্ফটিকের রামধনু ফুলের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে গায়ক প্রজাপতি। এটা ওদের গ্রহের প্রতীক। ডোরের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতা অর্থাৎ গ্রাহকরাও একই দৃশ্যের কল্পনা শুরু করল, ইন্দ্রিয়গুলির সুর মেলাতে লাগল রামধনুর রঙে, প্রজাপতির ছন্দে। একবার টিউনিং হয়ে গেলে তারপর ডোরের ভাবা বা দেখা সকলেরই ভাবনা ও দর্শন হয়ে উঠবে।

মনের সুরে সুর মেলানো শেষ হতেই ডোরে মহাকাশযান ভয়েজার দুই-এর বর্ণনা দিল। নিষ্প্রাণ এই যন্ত্রযান ১৬০ কোটি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট থেকে সূর্য নামে এক নক্ষত্রের ষষ্ঠ গ্রহের (শনির বিবরণ পাঠাচ্ছে সূর্যের তৃতীয় গ্রহে (পৃথিবীতে)। এই শেষোক্ত গ্রহের বুদ্ধিমান জীবরাই নির্মাণ ও প্রেরণ করেছে। ভয়েজার দুই।

ডোরেকে থামতে হল। কারণ তার পরিসংখ্যানগুলো পৃথিবীর এককনির্ভর হয়ে গিয়েছিল। সময়, দৈর্ঘ্য ও ওজন সংক্রান্ত রাশিগুলোকে টাউরেপাসের পরিভাষায় পেশ করল সিগমা।

ডোরে আবার শুরু করল, ভয়েজারের আগেই তারা পাইওনিয়ার দশ নামে আরেকটি মহাকাশযান পাঠিয়েছিল, যা সূর্যের পরিবার ছাড়িয়ে বর্তমানে ছায়াপথ গ্যালাক্সি দিয়ে ছুটে চলেছে।

সাপার নিঃশব্দ হাসি সবাইকে হাসাতে শুরু করে দিল।

তরল জ্বালানি পুড়িয়ে এইরকম মন্থরগতি মহাকাশযান পাঠিয়ে যারা মহাশূন্যের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করে তাদের সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক মান সম্বন্ধে সন্দেহ জাগাই স্বাভাবিক। এত দিনের প্রতীক্ষার পর এটা কি একটা খবর হল? টাউরেপাসের অধিবাসীরা কমপক্ষে পঞ্চাশ পুরুষ আগে শেষবারের মতো যন্ত্রযান ব্যবহার করেছে।

ডোরে বাধা দিল। তার চিন্তা শেষ হয়নি। সভ্যতার বিচারে পৃথিবীর প্রাণীরা এখনও যন্ত্রযুগে পড়ে রয়েছে, খুবই অনগ্রসর তারা। কিন্তু সেটা মূল বিচার্য নয়। এ অবধি যে ক টি গ্রহে বুদ্ধিমানদের অস্তিত্ব জানা গেছে, তাদের সঙ্গে পৃথিবীর তফাত শুধু একটি। পৃথিবীর বাসিন্দারাই একমাত্র নিজেদের গ্রহের বাইরে বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি। এমনকী তারা নিজস্ব আদিম কায়দায় তাদের বহির্জগতের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও করছে।

মুহূর্তের মধ্যে জমায়েতের সকলেই ডোরের চিন্তায় মনোনিবেশ করল।

নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকাল ডোরে, হ্যাঁ, ঠিক তা-ই ঘটেছে। পৃথিবীর মানুষ নামে জীবরা ১৪২০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছে। ভিন গ্রহ বা নক্ষত্রের বুদ্ধিমানদের কাছে তারা নিজেদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করছে। পাইওনিয়ার দশ-এর মধ্যে একটি ধাতব ফলকে তাদের জগতের কেন্দ্র সূর্যের অবস্থানকে তারা চোদ্দোটি পালসারের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট করেছে। তা ছাড়া তাদের গ্রহ পরিবারের ছবি, নিজেদের চেহারা এবং পাইওনিয়ার দশের পথেরও নির্দেশ দিয়েছে। এই একটি কারণেই টাউরেপাসের উত্তরাধিকারী হিসাবে পৃথিবীকেই বোধহয় বেছে নেওয়া উচিত।

সর্বসম্মতিক্রমে পৃথিবীর নির্বাচন হয়ে গেলে টাউরেপাসের সবচেয়ে শিক্ষিত অভিজ্ঞ, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সাপা ও রেগাকে চিরতরে বিদায় জানাতে তৃণভূমি অঞ্চলে হাজার হাজার প্রাণী এসে জড়ো হল। এমনকী অর্ধচেতন গৃহপালিত উদ্ভিদরাও বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছিল। না হলে ফোটন রকেট (টাউরেপাসের শেষ যন্ত্রযান) সচল হওয়ার আগের মুহূর্তে সুরেলা গাছটা তার গান থামাবে কেন? ওদিকে হাজার হাজার ডানাওয়ালা বহুরূপী মনের দুঃখে আকাশে পাখা ঝাপটাচ্ছে আর রং বদলাচ্ছে। ওরাও কি জানতে পেরেছে যে, সাপা ও রেগা আর ফিরবে না? পৃথিবীর মানুষকে সব কথা জানাবার পর শেষ শিক্ষা হিসাবে, টাউরেপাসের সেরা উপহার হিসাবে তাদের প্রাণশূন্য দেহ দুটি তারা মানুষের হাতে তুলে দেবে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তাদের দেহ দুটি ব্যবচ্ছেদ করবেন। টাউরেপাসের প্রাণীজগতের বিবর্তনের পুরো পরিচয় লাভ করার পক্ষে এইটাই সবচেয়ে সোজা ও নির্ভরযোগ্য উপায়।

পৃথিবীর আকাশে সাপা আর রেগাকে নিয়ে কম্যান্ড মডিউলের ছোটাছুটি কারও চোখে পড়েনি তা নয়। ভিজে গেরুয়া মাটি-মাখা বুটজুতো পায়ে কে যেন সন্ধ্যার আকাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়। ব্যাপারটা সাদা চোখেও দেখা গিয়েছিল। তা নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন বিচলিত হয়নি, মেঘের পরে মেঘ জমে রঙের খেলা তো কতরকমই চোখে পড়ে। ঘুম ছুটে গেল মাউন্ট পালোমার, ককেশাসের র‍্যান-৬০০ এবং জডরেল ব্যাঙ্কের মানমন্দিরের অধিকর্তাদের। তাঁরা কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন আকাশের এই রহস্যময় জিনিসটির স্বরূপ জানার জন্য।

নিউ ইয়র্কের টাউনে ম্যাসির বিশাল মার্কেট মল। তারই ধ্রুট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল স্টেভি। যেন দ্বিধাগ্রস্ত, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে স্থির করতে পারছে না। এই অছিলায় তাকে এখন কিছুক্ষণ এখানে কাটাতে হবে, অথচ ভিসিআর ক্যামেরার চক্ষুশূল হওয়াও চলবে না। ডক্টর রাইন হোন্টের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা একটা হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারের মতো ঠেকা উচিত। ইন্টেলিজেন্সকে ফাঁকি দিতে হবে। ভয়টা অবশ্য স্টেভির নয়–রাইনহোল্টের কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা।

–হ্যালো স্টেভি! শেষ পর্যন্ত ফ্রেশ টম্যাটো, অ্যাঁ?

-হ্যালো হ্যালো! হোয়াট এ সারপ্রাইজ। এত জায়গা থাকতে শেষে এখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে, বিজ্ঞানীরাও তাহলে বাজার করে? হাঃ হাঃ–

–আমি তো আসতেই চাই, কিন্তু ওই টেলিস্কোপ যে আমায় ছাড়তে চায় না। হাসির জেরটা ঠোঁটের কোণে রেখেই রাইনোল্ট গলা নামিয়ে বলল, স্কুপ আছে। রাশিয়ানরা একটা কৃত্রিম উপগ্রহ ছেড়েছে। কিন্তু সেটার গতিবিধি মিস্টিরিয়াস। এ অবধি এমন উপগ্রহ আমরা কখনও সাইট করিনি। কিছুই ধরা যাচ্ছে না। আমাদের সমস্ত নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে, এটাকে কখন ছাড়া হল, কোথা থেকে ছাড়া হল, কিছুই জানতে পারিনি আমরা।

স্টেভি হতাশ বোধ করল। গত পাঁচ বছরে এইরকম আসন্ন পারমাণবিক যুদ্ধের কথা সে অন্তত পনেরোবার রিপোর্ট করেছে। কাজেই যদি ধরেও নেওয়া যায় যে সিচুয়েশন সাংঘাতিক, তবু খবরের কাগজে ছাপার হরফে সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে না। অন্তত যতক্ষণ না পালে বাঘ পড়ছে, নিউজ হিসাবে এটার কোনও ভ্যালু নেই। আর স্টেভিও এখন ক্ষুধার্ত–তার নিউজ চাই, জমকালো খবর–শুধু শুধু মাসে হেরাল্ড ডেইলি রাইনহোল্টকে গোছা গোছা ডলার পেমেন্ট করছে না।

স্টেভির মনের ভাব কিছুটা আন্দাজ করেই বোধহয় রাইনহোল্ট বলল, সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং কী জান? রাশিয়ানরাই প্রথম এদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখনও আমরা কিছুই জানতাম না। একটা দারুণ চাল চেলেছে। হোয়াইট হাউসে হটলাইনে খবর পাঠিয়েছে যে, ওটা নাকি আমাদেরই কীর্তি–পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত নতুন ধরনের উপগ্রহ। ওদের টেলিস্কোপে তার ছবি ধরা পড়েছে, রুশদের পাঠানো ছবি দেখেই আমরা এটার সন্ধান পেয়েছি।

–এমনও তো হতে পারে যে, এটা ইউএস এয়ারফোর্সের কারবার, আপনাদের কাছ থেকে গোপন করে…

–অ্যাবসার্ড! আমাদের ডিপার্টমেন্টকে গত দু-বছর এয়ারফোর্স হাইকম্যান্ডের অধীনে রাখা হয়েছে। যাক–অত কথায় কাজ নেই, আমি কৃত্রিম উপগ্রহটার একটা ফোটো এনেছি, শপিং ব্যাগের মুখটা একটু…

টুক করে ফোটোটা চালান হয়ে গেল টমেটোর প্যাকেটের সঙ্গে।

–দেখবেন ফোটোর সোর্সটা যেন…

মিস্টার রাইনহোল্ট, আজ অবধি আপনাকে নিয়ে কি কখনও টনাটানি হয়েছে?

–হয়নি বলেই না এখনও আমার কাছ থেকে নিষিদ্ধ সংবাদ পাচ্ছেন!

–তা পাচ্ছি, তবে সংবাদ মূল্যবান না হলেও আপনাকে মূল্য দিতেই হবে! তা-ই না?

–রাইনহোল্ট অনুভব করল, স্টেভি তার ট্রাউজারসের পকেটে এক গোছা আয়তাকার কাগজ পুরে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মধুর উত্তাপে শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল।

বার দশেক বৃথা চেষ্টার পর স্টেভি হাল ছেড়ে দিল। রাইনহোল্টের ফোটোগ্রাফের একটাও জুতসই ক্যাপশন লিখতে পারল না। অথচ কড়কড়ে অতগুলো ডলার গলে গেছে।

স্টেভি অ্যাপার্টমেন্টে পা দেওয়ামাত্র রিটা বুঝতে পেরেছিল সাহেবের মেজাজ শরিফ নেই। নীরবে টেবিলে বার দুয়েক কফির কাপ রেখে গেছে। তারপর ভিসিআর নিয়ে বসেছিল রিটা। চেয়ার ঠেলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এসে দেখল, স্টেভি ক্যামেলের প্যাকেটে টোকা দিয়ে একটা সিগারেট বার করে মুখে গুঁজছে। ভুরু কুঁচকে রয়েছে। টেবিলের ওপর ঝুঁকে ফোটোগ্রাফটা তুলে নিল রিটা। তারপর প্যাডের কাগজে লাল, নীল, বেগুনি–হরেক রঙে লেখা এবং শেষ অবধি কালো কালির টেড়া টেনে বাতিল করা ক্যাপশনগুলো পড়ল। এই মুহূর্তে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক জানলার সামনে আকাশে ভাসছে রাশিয়ার পারমাণবিক লাল স্যাটেলাইট।–এই শেষ লেখাটা কাটতে গিয়ে কাগজটাকেই ছিঁড়ে ফেলেছে।

স্টেভি! স্টেভি! হঠাৎ যেন হারিয়ে-যাওয়া কোহিনুরের হদিশ পেয়ে আনন্দে ঝলমল করে উঠল রিটা, আই হ্যাভ গট ইট!

স্টেভি শুধু একবার বেঁকিয়ে তাকাল। পায়চারি থামেনি। রিটা লাফিয়ে চলে এল তার পাশে। সে-ও পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভোরের পাখির মতো সরু গলায় বক্তৃতা।

–স্টেভি, এটা ইউএফও-দের বেচে দাও। আই মিন–উড়ন্ত চাকি নিয়ে যারা কারবার করে, তারাই ওই ছবিটার সবচেয়ে ভালো পারচেজার, সবচেয়ে ভালো দাম দেবে। আমি বলছি, হেরাল্ড ডেইলি যা দেবে, তার পাঁচগুণ পাবে ওদের কাছ থেকে। বিলিভ মি

স্টেভি থমকে দাঁড়াল। রিটা হয়তো ওর মন ভোলাবার জন্যেই বকবকানি জুড়েছে, কিন্তু আইডিয়াটা খারাপ নয়। গত পাঁচ বছর ধরে আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লায়িং অবজেক্ট (ইউএফও) বা উড়ন্ত চাকি গবেষণা-সংস্থার সাপ্তাহিক কাগজটার বিক্রি নাকি হু হু করে বাড়ছে–ওদেরই একটি জুনিয়র রিপোর্টারের মুখে শুনেছে স্টেভি। ইটি (এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল) অর্থাৎ গ্রহান্তরের জীব আর তাদের আগমন সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। ওদের কাগজের সার্কুলেশন আর বছরকয়েকের মধ্যেই হেরাল্ড ডেইলিকে ছাড়িয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, হেরাল্ড ডেইলি সম্ভবত এই ফোটোগ্রাফ আর নিউক্লিয়ার বিশ্বযুদ্ধের কাল্পনিক গল্প ছাপতে রাজি হবে না।

টেলিফোনে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে স্টেভি ও রিটা ইউএফও পত্রিকার অফিসের দিকে রওনা হল।

পরের দিন সকাল অবধি তর সইল না উড়ন্ত চাকিওয়ালাদের। সন্ধের মধ্যেই বেরিয়ে গেল তাদের টেলিগ্রাম। টেলিগ্রামের একটা কপি হাতে ঘরে ঢুকেই রিটা চেঁচিয়ে উঠল, লুক অ্যাট ইট! সত্যি বলছি, যতই আজগুবি খবর ছাপুক, দে নো হাউ টু রাইট। এমনভাবে লিখেছে, আমি তো সব জানি, তবু যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।

স্টেভি টেলিগ্রামটা হাতে তুলে নিল। শুধু ভিন গ্রহের থেকে আগত উড়ন্ত চাকির ফোটোগ্রাফটা ছেপেই ক্ষান্ত হয়নি। এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল প্রাণীর একটা বিদঘুটে ছবিও দিয়েছে। শিল্পীর কল্পনা নয়–সত্যিকার ফোটো বলে দাবি করেছে। গঙ্গাফড়িঙের মতো হাত-পা-ওয়ালা অথচ যন্ত্র ও মানুষের মাঝামাঝি চেহারার এই জীবটি যদি সত্যিই রাত্তিরবেলা কারও দরজায় কলিং বেল টিপে ডাক দেয়…

রিটার ডাক শুনে চমকে গেল স্টেভি। উঠে এল বসার ঘরে। রিটার চোখ দুটো টিভি স্ক্রিনের সঙ্গে যেন সেঁটে আছে।

স্টেভি কার্পেটে বসামাত্র রিটা বলে উঠল, আই অ্যাম সরি স্টেভি

–ব্যাপার কী?

–নিউজটা শোন, তাহলেই জানতে পারবে। ফোটোগ্রাফটা সত্যিই একটা নিউক্লিয়ার ওয়েপন ক্যারিয়ার স্যাটেলাইটের। রাশিয়ানদের সমস্ত অ্যাটমিক সাবমেরিন পজিশন নিতে বেরিয়ে পড়েছে। এখুনি ছবি দেখাল।

–সে কী!

এবার আমাদের প্রস্তুতির কথা বলবে। তারপরেই জাতির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ভাষণ। ব্রডকাস্ট টু নেশন। সব প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেছে। সমস্ত এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দিয়েছে।

পৃথিবীর হিসাবে সাপা আর রেগাকে নিয়ে কম্যান্ড মডিউল সাত দিন ধরে পরিক্রমা করছে। এর মধ্যে তারা পৃথিবীর গতির সঙ্গে গতি মিলিয়ে বারে বারে থমকে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামের ওপর। সংগ্রহ করে চলেছে তথ্য। এখন তারা ইংরেজি, চীনা ও রুশ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। পোশাক-আশাকও যা তৈরি করে নিয়েছে, তাতে যে কোনও মহাদেশে লোকের ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পারে। শুধু জুতো পায়ে দেওয়াটা অভ্যাস করতে বড় কষ্ট হয়েছে। পায়ের সাকশন-কাপগুলো বেশ জখম হয়েছে। তা হোক–ওরা তো আর টাউরেপাসে ফিরছে না!

পৃথিবীতে অবতরণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ হওয়ার মুখেই কিন্তু তাদের সব হিসাব বানচাল হয়ে গেল। তাদের ছবি বলে ইউএফও সাপ্তাহিকে যা ছাপা হয়েছে, যেসব কথা তাদের সম্বন্ধে লিখেছে–এ যেন একটা বিরাট থাপ্পড়। মিথ্যে কথা লিখেছে বলে তারা চিন্তিত নয়। পৃথিবীর সভ্যতা এখন যে স্তরে রয়েছে, তাতে শুধু দেহের পুষ্টির ব্যবস্থা করার জন্যও বহু লোককে মিথ্যা বলতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যি যখন তারা পৃথিবীতে পা দেবে–মানুষরা কীভাবে গ্রহণ করবে তাদের? চেহারায়, চালচলনে কোনও অমিল খুঁজে পাবে না ঠিকই, কিন্তু যে কোনও মানুষের (বা প্রাণীর) মনের কথা জেনে ফেলার ক্ষমতার পরিচয় তো পাবেই।

সাপা জানাল, আরও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এখনই অবতরণের কথা ভুলে যাও।

রেগাও একমত। কম্যান্ড মডিউল ত্যাগ করে পৃথিবীতে নামা মানেই ফেরার পথ বন্ধ। তা ছাড়া মনে মনে চিন্তা বিনিময়ের ক্ষমতাটুকু বাদে শারীরিকভাবে তাদের সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের কোনওই তফাত থাকবে না। পৃথিবীর মঙ্গলের কথা ভেবেই তারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কারণ, টাউরেপাসের কোনও ব্যাকটেরিয়াকে তারা পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চায় না। কিন্তু সাপা ও রেগা যতই পৃথিবীর ভালো করার কথা ভাবুক, পৃথিবীর মানুষ যদি ওদের কয়েদখানা নামে পরিচিত খাঁচার মধ্যে ভরে ফেলে, তখন কী হবে?

এইসব ভাবতে ভাবতেই পায়ে জুতো পরে হাঁটা অভ্যাস করছিল দু-জনে। হঠাৎ দু জনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল অবজার্ভেশন উইন্ডোয়। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচারিত বিদ্যুৎ চৌম্বক তরঙ্গে ভয়-দেখানো কী সব কথা আর ছবি ভেসে আসছে যেন! মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা আগাপাশতলা শুনল দু-জনে। তারপর নিজেদের মধ্যে কোনও ভাব বিনিময় না করেই টিউন করল মস্কো। সেখানকার অবস্থাও একই রকম। লক্ষ লক্ষ মানুষ মস্কো ত্যাগ করে শহরতলির দিকে এগিয়ে চলেছে। মার্কিন পারমাণবিক ওয়ারহেডের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সুড়ঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ড শেলটারে গিয়ে ঢুকছে।

সাপা ভাবল, একটা কথা হাইড্রোজেনের মতো পরিষ্কার! রাশিয়া বা আমেরিকা কোথাও নামা চলবে না। কারণ যেখানেই নামি না কেন, সেটা জানাজানি হবেই, আর তখুনি…

রেগা জানাল, কিন্তু আমরা যদি নামার আগে আমাদের পুরো পরিচয়, উদ্দেশ্য জানিয়ে দিই…

তাতেও লাভ হবে না। ধরলাম, আমাদের কথা ওরা বিশ্বাস করল। মানে, বিশ্বাস করে যাতে, তার জন্য না-হয় কিছু ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন ধর, সুরেলা গাছ বা বহুরূপী পাখি দেখালাম! কিন্তু তখন তো অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠবে।

-কেন?

–তখন তো আবার আমাদের নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়বে। বর্তমানে ওরা জানে, কোন দেশের হাতে কত এবং কী ধরনের অস্ত্র মজুত আছে। এতদিন যে লড়াই বাধেনি, তার কারণ দু-দেশের অস্ত্রের ঘরেই মজুত অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় সমান। এখন আমাদের কাছ থেকে বিশেষ কোনও দেশ যদি অদ্ভুত কোনও বিদ্যা শিখে ফেলে–বুঝতেই পারছ, নতুন বিদ্যামাত্রেই ওদের কাছে নতুন অস্ত্র বানাবার ফন্দি

–ঠিক, ঠিক। আমাদের জন্য ওদের ব্যালেন্স যদি নষ্ট হয়ে যায়…

নষ্ট হবার ভয়েই শুরু হয়ে যাবে, কী যেন বলে ওরা?

–তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

–তাহলে এখন কী করব?

–প্রথম কাজই হচ্ছে, ওদের দূরবীক্ষণের চোখ থেকে আমাদের কম্যান্ড মডিউলকে অদৃশ্য করা। কারণ, এ অবধি মাত্র বারকয়েক ওরা আমাদের ছবি তুলেছে। এখনও খুব নিশ্চিত হতে পারেনি বলেই পরস্পরকে দোষারোপ করছে আর শাসাচ্ছে। কিছুদিন না গেলে অবস্থাটা স্বাভাবিক হবে না। তখন চুপিসারে আফ্রিকার কোনও দেশে গিয়ে নামব।

–ঠিক ভেবেছ। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দুরবস্থা ওদের। টাউরেপাসে এসব ধনী গরিবের বালাই নেই বলেই বোধহয় কথাটা আমরা ভাবিনি।

লোলো নদীর তীরে কঙ্গোর প্রাগৈতিহাসিক গহন অরণ্য থেকে কাঠ কেটে নৌকায় তোলার সময়ে তারা লক্ষ করল, নীল আকাশের বুকে একটা হলদে তারা ক্রমেই আকারে বড় হয়ে উঠছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তারাটার আকার ভিমরুলের চাকের মতো।

অপদেবতার আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ল দামামার তালে তালে। নৌকা ফেলে সকলে ছুটে পালাল জঙ্গলের আশ্রয়ে। দামামা বেজে চলেছে। ওঝারা শুরু করে দিল প্রার্থনা।

সরল মানুষগুলোকে অভয় দিতে সাপা আর রেগা মনে মনে বার্তা পাঠাল। কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে নীরবে ভেসে এল তাদের চিন্তা–কোনও ভয় নেই। আমরা তোমাদের অনিষ্ট করব না। তোমাদের বনের ফল, শিকার, পানীয় ও বাসস্থান–তোমাদের যা যা অভাব, সব পূর্ণ করে দিতে আসছি আমরা। এমন বিদ্যা শিখিয়ে যাব যে, সাদা চামড়ারাও হার মানবে তোমাদের কাছে।

বার্তা পেয়েই যে যেখানে ছিল, থমকে দাঁড়াল। বোকার মতো চাইছে সবাই এ ওর দিকে। ইতিমধ্যে বনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ–সকলেই যে যার গোপন আস্তানা ছেড়ে ফাঁকা মাঠে বেরিয়ে এসেছে। মহাকাশযানের ঠিক নিচে এসে দাঁড়াবার জন্য ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি করছে, কিন্তু হিংস্রতার প্রকাশ নেই। টাউরেপাসের বুদ্ধিমানরা উদ্ভিদ ও পশু জগতের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে যে, সাপা ও রেগার নিঃশব্দ ভাবনা শুধু অরণ্যবাসীরাই নয়, জীবজগৎও অনুধাবন করতে পারছে।

চিরকালের যারা শত্ৰু, সেই সাপ আর ব্যাং-ও যখন গায়ে গা ঘেঁষে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল, তখন টনক নড়ল সবার। এটা কোনও অপশক্তির কাণ্ড নয়। নিশ্চয় দেবতার রথ এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে ওঝাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই বন্ধ কর ঝাড়ফুঁক। আমরা দেবতাদের বরণ করব।

নিমেষের মধ্যে কাঠকুঠো জড়ো করে জ্বালা হল আগুন। তরল সুগন্ধি ছেটানো শুরু হল। পুরোহিতরা দেবতাদের স্বাগত জানাতে নতজানু হয়ে শুরু করেছে স্তোত্রপাঠ। ছেলেমেয়েরা হাতে হাত ধরে আগুন ঘিরে নাচ জুড়েছে, কিন্তু তাদের চোখ রয়েছে। আকাশে। ডিম-ডি ডিমা-ডিম-মাদল বেজে চলে।

কম্যান্ড মডিউল মাটি থেকে মাত্র হাজার ফুটের মতো ওপরে এসে থমকে দাঁড়াল। শেষ মুহূর্তে লিভার টেনে ধরেছে সাপা। না হলে এতক্ষণে নেমে পড়ার কথা।

রেগা ভাবনা পাঠাল সাপাকে, কী হল? সাপা জানাল, অসম্ভব। আমরা মারাত্মক ভুল করতে যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছ না, ওরা আমাদের দেবতা বলে ভাবছে। অর্থাৎ অপ্রাকৃতিক–অলৌকিক একটা কিছু, যার ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু মঙ্গলকর শক্তি। আমাদের কাছ থেকে ওরা কিছু শিখতে চাইবে না, শুধু আমরা যা দেব–দান হিসাবে গ্রহণ করবে আর আঁকড়ে ধরে থাকবে আমাদের, আটকে রাখতে চাইবে। ওরা শুধু পুজো দেবে আমাদের আর ভাববে, আমরা সন্তুষ্ট হলেই ওদের সব দুঃখ যাবে ঘুচে।

-তা হয়তো ঠিক, কিন্তু ওদের দুঃসহ জীবনের কষ্ট কিছুটাও যদি..

–তার জন্য আসিনি আমরা। তা ছাড়া, দেবতা হিসাবে আমাদের আবির্ভাব ওদের ক্ষতিই করবে। আমরা চলে যাবার পর ওরা আবার দেবতার দ্বিতীয়বারের আগমনের জন্য বসে থাকবে। আমরা দেবতা নই। নিজেদের দেবতা বলে ওদের ভুল বোঝানোর কোনও অধিকার নেই আমাদের।

-তাহলে?

রেগার উত্তর আসার আগেই সাপা দেখল, তারা পৃথিবী ছেড়ে আবার মহাকাশের দিকে ছুটে চলেছে।

ছায়াপথে আরও তেইশটি গ্রহ আছে, যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। তারই মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। পৃথিবী তাদের হতাশ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *