Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed » Page 3

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 3

ওসমান গনির অফিস ঘরটি ছোট। তাঁর সামনে একটি মাত্র চেয়ার। তিনি একসঙ্গে বেশি মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন না। এক জনের সঙ্গে কথা বলেন। আজ মিজান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মিজান সাহেব এখনো এসে পৌঁছান নি। গনি সাহেব হাতে ঘড়ি পরেন না। তাঁর এই ঘরে কোন ঘড়িও নেই। তবু তিনি জানেন যে এগারটার উপর বাজে।

তাঁর সেক্রেটারি মজনু মিয়া বলল, উনি কয়েকদিন ধরেই দেরি করে অফিসে আসছেন। পরশু এসেছেন লাঞ্চ টাইমের পরে।

গনি সাহেব হাসিমুখে বললেন, উনি দেরি করে আসছেন না সময়মত আসছেন। এই খোঁজ নেবার জন্যে তো আমি তোমাকে বলি নি বলেছি? তোমাকে বলেছি তাঁকে খবর দিতে। তুমি তাকে পাও নি। ব্যাস ফুরিয়ে গেল। ইতং বিতং এত কথা কেন? বেশি বলা ভালো না মজনু মিয়া। কথা বলবে কম। কাজ করবে বেশি বুঝতে পারলে?

জ্বি স্যার।

এখন আমার সামনে থেকে যাও। কাজ কর।

মজনু মিয়া বিরস মুখে বের হয়ে গেল। তাকে কাজ করতে বলা হয়েছে অথচ তার হাতে কোনো কাজ নেই। কখনো ছিল না। তার টেবিল ফাইলশূন্য।

বড় সাহেবের ফাইলপত্রে সেক্রেটারির খানিকটা অধিকার থাকে। মজনু মিয়ার কিছুই নেই। গনি সাহেব সমস্ত ফাইল নিজে দেখেন। চিঠিপত্র ড্রাফট নিজে করেন। টেলিফোনটিও তাঁর ঘরে। সেক্রেটারি হিসেবে মজনু মিয়া যে টেলিফোন প্ৰথমে ধরবে সেই সুযোগও নেই। মজনু মিয়া তার গদি আটা চেয়ারে কাত হয়ে বসে থাকে এবং ভাবে কেন অকারণে গনি সাহেব বেতন দিয়ে তাকে পুষছেন। মাঝেমাঝে এই চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। বাজার খারাপ। চাকরি ছেড়ে দিলে নতুন কিছু জোগাড় করা সম্ভব না। গনি সাহেব মালিক হিসেবে ভালো। দুই ঈদে বোনাসের ব্যবস্থা আছে। কট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মচারী কল্যাণ তহবিল খুলেছেন। এক জন ডাক্তারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। এই ডাক্তার সপ্তাহে তিনদিন আসেন এবং এক ঘন্টা থাকেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যে সব ওষুধ কেনা হয় তার অর্ধেক দাম কোম্পানি দেয়।

তার চেয়েও বড় কথা কোম্পানি বড় হচ্ছে। গনি সাহেব শিপিং বিজনেস শুরু করতে যাচ্ছেন এ রকম কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। অবশ্যি গনি সাহেব সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তাঁর সম্পর্কে যা শোনা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। গনি সাহেব এক ঘন্টা ধরে গভীর মনোেযোগ ফাইলপত্র দেখছেন। বিদেশে এলসি। বিষয়ক ফাইল। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত। একটা কিছু ঠিকমতো হয় নি বলে তাঁর মন বলছে, কিন্তু সেটা কী তা ধরতে পারছেন না। কর্মচারীদের কাউকে তিনি অবিশ্বাস করেন না আবার বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে সব সময় মনে হয় মানুষ এমন একটা প্রাণী যাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করা যায় না।

স্যার আসব?

গনি সাহেব ফাইল বন্ধ করে বললেন, আসুন, আসুন। বসুন। কেমন আছেন? মিজান সাহেব সঙ্কুচিত গলায় বললেন, ভালো। তিনি ভেবেছিলেন গনি সাহেব তাঁর দেরি করে আসার ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। আগে একদিন তাঁকে খোঁজ করে পান নি। কিন্তু গনি সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। হাসিমুখে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন, আপনার ছেলের খোঁজ পাওয়া গেছে?

জ্বি না স্যার।

কদিন হল?

পনের দিন।

আগেও কি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে?

জ্বি না, এই প্রথম।

বন্ধু-বান্ধব কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন? ওরা জানে কিনা?

জ্বি না।

বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা বা গয়না-টয়না কিছু নিয়েছে। সাধারণত এরা এই কাজটা করে। মোটা কিছু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মাস খানেক ঘোরে। তারপর ফিরে আসে। আপনি চিন্তা করবেন না।

আমি চিন্তা করছি না।

গুড, ভেরি গুড। আর ঐ পাশ ফেল নিয়েও চিন্তা করবেন না। আজকালকার পরীক্ষা-এর পাশও যা ফেলও তা। আমি আপনার ছেলের চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।

মিজান সাহেব বিস্মিত হলেন। গনি সাহেব এই জাতীয় কথা কখনও বলেন না।

গনি সাহেব বললেন, বুঝলেন মিজান সাহেব, আমি আসলে ফেল করা ছেলেই পছন্দ করি। ফেল করা ছেলের কোনো ক্যারিয়ার নেই। সে জানে অন্য কোথাও সে কিছু করতে পারবে না। কাজেই সে যা পায় তা নিয়েই প্রাণপণ খাটে। বুঝতে পারছেন?

মিজান সাহেব কিছু বললেন না, তবে লোকটার বুদ্ধির প্রশংসা মনে-মনে করলেন, নির্বোধ চেহারার রোগা বেঁটেখাটো এক জন মানুষ। অথচ লোকটির মাথা কাঁচের মতো পরিষ্কার।

মিজান সাহেব।

জ্বি স্যার।

এইটা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছিলাম। আরেকটা কথা, শুনলাম ফাইলপত্ৰ নিয়ে প্রায়ই বাড়ি যান। ফাইলে কোনো সমস্যা আছে।

জ্বি না।

হিসেবে কিছু গরমিল?

মিজান সাহেব ইতস্তত করে বললেন, তেমন কিছু না স্যার। সামান্য।

সামান্য থেকে বড় কিছু হয়। নদীতে বাঁধ দেয়া হয় জানেন তো? বাঁধ ভাঙে কী করে জানেন? প্রথমে সামান্য একটা ফাটল দেখা যায়। খুবই সামান্য। হয়ত ইঁদুর গর্ত করেছে সেই গর্ত থেকে ফাটল। বাঁধ শেষ পর্যন্ত ঐ ফাটল থেকেই ভাঙেমিজান সাহেব।

জি।

ফাইল আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি সমস্যা কি বের করে দেব।

আমি নিজেই পারব স্যার।

নিজে পারলে তো খুবই ভালো।

যাই স্যার।

আচ্ছা যান। ছেলের জন্যে চিন্তা করবেন না। এই বয়সের ছেলে এ রকম করেই। মাসখানিক যদি বাইরে বাইরে ঘোরে সেটা ভালো হবে।

গনি সাহেব আবার ফাইল খুললেন। গোড়া থেকে দেখা শুরু করলেন। এলসিতে ঝামেলা আছে। ঝামেলাটা তিনি ধরতে পারছেন না। বাঁধ হঠাৎ করে ভাঙে না। প্রথমে ক্ষুদ্র একটা ফাটল। ইদুরের গর্ত বিংবা সাপের গর্ত তারপর তিনি গর্ত খুঁজছেন।

টেলিফোন বাজছে।

কৰ্মীলোক টেলিফোন বাজলে খুব বিরক্ত চোখে তাকায়। গনি সাহেব কখনো বিরক্ত হন না। যখনই ফোন আসে রিসিভার হাতে নিয়ে মধুর গলায় বলেন, আসোলামু আলায়কুম, কাকে চান?

আজ বলার সুযোগ পেলেন না। ওপাশ থেকে তাঁর স্ত্রী বললেন, আপনে একটু বাসায় আসেন।

গনি সাহেবের স্ত্রী রাহেলা বেগম স্বামীকে আপনি করে বলেন। কথাবার্তা বলেন নেত্রকোণার উচ্চারণে। একটু টেনে-টেনে। গনি সাহেব বললেন, কী হয়েছে?

বাবু যন্ত্ৰণা করতাছে।

কি যন্ত্রণা?

জিনিসপত্র ভাঙছে। বড় জামাইয়ের হাতে কামড় দিছে।

বড় জামাই এখানে আসল কেন?

আমি খবর দিছি।

এক জনকেই খবর দিয়েছ না তিন জনকেই খবর দিয়েছ?

তিন জনরেই বলছি।

গনি সাহেব অসম্ভব বিরক্ত হলেন। বিরক্তি প্রকাশ করলেন না, সহজ গলায় বললেন, আমি আসছি।

রাহেলা বললেন, বড় জামাই আফনের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

আমি তো রওনাই হচ্ছি। কথা বলার কী আছে?

জ্বি আচ্ছা।

গনি সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তাঁর ছেলেমেয়ে চার জন। তিন মেয়ের পর এক ছেলে বাবু। বাবুর বয়স এগার। বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, জড় পদার্থের মতো। অথচ মেয়ে তিনটি অসম্ভব ধুরন্ধর। বিয়েও হয়েছে তিন ধুরন্ধরের সঙ্গে। গনি সাহেবের ধারণা, তাঁর তিন কন্যা এবং তিন জামাতা কবে সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা হবে সেই দিন গুনছে।

তিনি জাহাজ কিনছেন খবর শুনে তিন জামাই একসঙ্গে এসে উপস্থিত। বিনয়ে একেকজন প্রায় মাখনের মতো গলে যাচ্ছে। তাদের তিন জনেরই বক্তব্য হচ্ছে—জাহাজ কিনলে বিরাট লোকসান হবার সম্ভাবনা। এক্সপেরিয়েন্সড লোক ছাড়া এইসব কেউ সামাল দিতে পারে না।

গনি সাহেব তাদের দীর্ঘ কথাবার্তা মন দিয়ে শোনার পর বললেন, জাহাজ কিনলে লোকসান হবে?

জ্বি, বিদেশি কু রাখতে হবে। এদের বেতন দিতেই অবস্থা কাহিল। টোটাল লস হবে।

টোটাল লসটা কার হবে? আমার তো?

জামাইরা চুপ করে রইল। তিনি বললেন, আমার লসের ব্যাপারে তোমাদের এত মাথা ব্যথা কেন?

জামাইরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তিনি বললেন, কথাটা মনে থাকে যেন।

জামাইদের এই কথা মনে থাকে না। শ্বশুরের ইনকামট্যাক্স কত দেয়া হল তারা এই খবর বের করতে চেষ্টা করে। সাভারের পঞ্চাশ বিঘা জমিতে ইন্ডাস্ট্রি হবে, না জমি এমনি পড়ে থাকবে এই নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। রাহেলা বেগম তাঁর জামাইদের খুবই পছন্দ করেন। উঁচু গলায় সব সময় বলেন, জামাইরা যে মায়া মহত তাঁকে দেখায় তার ভগ্নাংশও নিজের মেয়েরা তাঁকে দেখায়। না। কথা মিথ্যা না।

তিনটি অতিরিক্ত বুদ্ধিমতী মেয়ের পর এ রকম জড় বুদ্ধির ছেলে তাঁর কী করে হল এই নিয়ে গনি সাহেব মাঝেমাঝে চিন্তা করেন। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই বিষয় সম্পত্তির একটা শক্ত ব্যবস্থা তিনি করে যেতে চান। অবশ্যি সবাই বাবুকে যতটা জড়বুদ্ধি ভাবে ততটা সে নয় বলেই গনি সাহেবের ধারণা। যা আছে তা বয়সের সঙ্গে কেটে যাবে বলেও তিনি মনে করেন।

গনি সাহেব বাসায় ফিরে দেখলেন গ্লাস ও কাপের ভাঙা টুকরো বাড়িময় ছড়ানো। বাবু পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে। চোখ রক্ত বর্ণ। অনেকখানি দূরে, শাশুড়ির সঙ্গে তিন জামাই দাঁড়িয়ে আছে। বড় জামাইয়ের বাঁ হাতে রুমাল বাঁধা। সে শ্বশুরকে দেখেই এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, খুবই ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে। আমার মনে হয় সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া দরকার। ডাক্তার এফ জামানকে কল দিয়েছি, উনি এসে পড়বেন। এফ জামান নামকরা নিউরোলজিস্ট আমার খুব চেনা জানা।

গনি সাহেব বড় জামাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাবুর দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বাবু, কী হয়েছে?

কিছু হয় নাই।

গ্লাস ভেঙেছ কেন?

ওরা শুধু আমাকে বিরক্ত করে।

কি করে?

ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলাম দেয় নাই।

তুমি নিজে ফ্ৰিজ খুলে ঠাণ্ডা পানি নিলে না কেন? বোতল তো পানি ভর্তি থাকে। যাও ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে খাও।

বাবু শান্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলল। গনি সাহেব অফিসে ফিরে গেলেন। এল-সির ফাইল ভালোমতো দেখতে হবে। একটা ঝামেলা আছে। সূক্ষ্ম একটা ফাঁক। সেই ফাঁকটা কী? বের করতে হবে। বসতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *