Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সমাজতান্ত্রিক শৈবাল

সেদিন শৈবাল অফিস থেকে বাড়ি ফিরল, গোরুর মাংস নিয়ে নয়, একবাক্স কেক নিয়ে। তার মেজাজটা খুব ফুরফুরে আছে আজ।

আজ তার মদ খাওয়ার জন্য ক্লাবে কিংবা তাসের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে হয়নি। মনটা খুব উদার হয়ে গেছে, সে ঠিক করেছে সন্ধ্যেটা সে একান্তই নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে কাটাবে। নানান ব্যস্ততার জন্য সে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তাও বলতে পারে না। এটা ঠিক নয়। রিডার্স ডাইজেস্টের একটা প্রবন্ধে সে পড়েছে যে, একালের বাবা-মায়েরা, ছেলে-মেয়েদের জন্য বেশি সময় দেয় না বলেই সামাজিক সমস্যা এত বাড়ছে।

আজ সকালে সে ছেলেকে বকেছে। সেটা অনুচিত।

এক-একদিন পর পর ভালো ঘটনা ঘটতে থাকে। আবার যেদিন খারাপ কিছু দিয়ে শুরু হয়, সেদিন শুধু খারাপই চলে। আজ সকালে গোড়ার দিকটা খুবই গোলমেলেভাবে শুরু হয়েছিল, তারপর অনন্তর ব্যাপারটা সমাধান করার পর থেকেই কিছু ভালো হয়ে গেল। অফিসে অনেক দিনের একটা পেণ্ডিং কেস অপ্রত্যাশিতভাবে মীমাংসা হয়ে গেছে আজ।

তা ছাড়া ম্যানেজিং ডাইরেক্টর তাকে আগামী মাসে একবার নেপাল ঘুরে আসতে বলেছেন। ঘুরে আসলেই বেশ কিছু পয়সা পকেটে আসে। এমনকী, ইচ্ছে করলে শৈবাল প্রমিতা আর ছেলে মেয়েদেরও নিয়ে যেতে পারে নেপালে বেড়াতে। ওই অফিসের খরচেই হয়ে যাবে। সামনের মাসে ছেলে-মেয়েদেরও স্কুলের ছুটি পড়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরে শৈবাল দেখল, হেনা নামের মেয়েটি কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নাঘরে রান্নায় মেতে গেছে। আর প্রমিতা তাকে শেখাচ্ছে।

রান্না করতে ভালো না-বাসলেও রান্না শেখাবার ব্যাপারে প্রমিতার খুবই উৎসাহ। প্রত্যেকবার নতুন রান্নার লোক এলে নতুন করে শেখাতে প্রবৃত্ত হয়।

প্রমিতার রান্না শেখাবার প্রধান অঙ্গ অবশ্য কী করে রান্নাঘর পরিষ্কার রাখতে হয়, সেই প্রণালী মুখস্থ করানো। রান্নায় নুন কম হোক কিংবা বেগুন ভাজতে গিয়ে পুড়ে যাক, তাতে খুব-একটা আপত্তি নেই প্রমিতার, কিন্তু রান্নাঘরের মেঝে ভিজে স্যাঁৎসেতে হয়ে থাকলে কিংবা তরকারির খোসা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে থাকলেই সে রেগে আগুন হবে।

শৈবালকে দেখেই প্রমিতা বলল, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি আসছি। চা খাবে তো?

ঠিক অফিস ছুটির পরই শৈবাল আজ বাড়ি ফিরেছে বলে প্রমিতা খুব খুশি। পুরুষমানুষ একবার বাড়ি থেকে বেরোলে আর সহজে ফিরতে চায় না।

ঝট করে গা-টা ধুয়ে পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে ফেলল শৈবাল। তার চা ঢাকা দিয়ে রাখা আছে শোয়ার ঘরের বেডসাইড টেবিলে। প্রমিতা আগেই চা খেয়ে নিয়েছে। তার সময় নেই, তাকে এখন থাকতে হবে রান্নাঘরে। অনন্ত নাকি রান্নাঘরটা একেবারে নরককুন্ড করে রেখে গেছে, সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার না করলেই নয়।

চা খাওয়ার পর শৈবালের হঠাৎ খেয়াল হল সে সিগারেট আনতে ভুলে গেছে। অফিস থেকে ফেরার পথে সে ভেবেছিল, পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে কিনে নেবে।

সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, অনন্ত। অনন্ত!

রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে এসে প্রমিতা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

সিগারেট নেই, সিগারেট আনতে হবে, অনন্তকে একটু পাঠাবে?

অনন্তকে তুমি কোথায় পাচ্ছ?

ফট করে শৈবাল লজ্জা পেয়ে গেল। সে একেবারে ভুলেই গিয়েছিল। সিগারেট ফুরিয়ে গেলেই অনন্তর নাম ধরে চেঁচানো তার অভ্যেস।

পড়া ছেড়ে উঠে বসে রিন্টুও বলল, অনন্তদাদা তো নেই। চলে গেছে।

এবার ছেলেকে আর না বকুনি দিয়ে, তার দিকে চেয়ে একগাল হেসে শৈবাল বলল, হ্যাঁ রে, একদম ভুলে গিয়েছিলুম। আমার কীরকম ভুলোমন দেখেছিস! যা, তুই পড়তে যা।

বাবা, অনন্তদাদা আর আসবে না?

হ্যাঁ, কেন আসবে না? অসুখ সেরে গেলেই আসবে।

রিন্টুকে কাছে ডেকে শৈবাল আদর করে হাত বুলিয়ে দিল তার চুলে। এটা তো বেশ পিতা হিসেবে তার দায়িত্বের পরিচয় দেওয়া হল। সন্তানদের শুধু বকাবকি করা উচিত নয়। মাঝে মাঝে বন্ধুর মতন ব্যবহার করতে হয়। শৈবালের কি তা ইচ্ছে করে না, নিশ্চয়ই করে। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া অফিসের জন্য কী তার সময় পাওয়া যায়?

রিন্টু পড়ার ঘরে ফিরে গেলে শৈবাল বলল, ওই মেয়েটিকে দিয়ে সিগারেট আনানো যায় না, না?

প্রমিতা বলল, কেন, তুমি গিয়ে সিগারেট আনতে পারছ না? তুমি আজকাল বড্ড কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছ কিন্তু।

প্রমিতার বোধ হয় ধারণা, শৈবাল সারাদিন অফিসে কুঁড়েমি করে এসেছে।

শৈবাল বলল, মেয়ে কাজের লোক নিয়ে এই এক অসুবিধে, যখন-তখন বাইরে পাঠানো যায় না। সিগারেট-ফিগারেট আনতে গেলে…।

প্রমিতা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, কী অদ্ভুত বাংলা। অফিসে সবসময় ইংরেজি বলতে বলতে তোমরা একদম বাংলা-টাংলা গুলিয়ে ফেলেছ?

কী ভুল বললাম?

মেয়ে কাজের লোক আবার কী? কাজের মেয়ে বলতে পার-না?

ওঃ হো, তাই তো! কাজের মেয়ে তা, এ-মেয়েটি সত্যিই কাজের তো?

স্বভাবটা নরম আছে। শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে।

ইরা ওকে ফেরত দিয়ে গেল হঠাৎ?

সেইটাই তো বুঝতে পারছি না। দুপুর থেকে তিন-চার বার ওকে ফোন করার চেষ্টা করলাম, একবারও বাড়িতে পাচ্ছি না।

মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করোনি?

ও তো কিছুই বলতে পারছে না। খালি বলছে, আমি কিছু জানি না। ওবাড়ির দিদিমণি আজ সকালে হঠাৎ বললেন, তুই জিনিসপত্তর গুছিয়ে নে, তোকে ওই দিদিমণির বাড়িতে রেখে আসব। কেন বললেন, তাও জানি না। বিশ্বাস করুন আমি কী দোষ করেছি, তাও জানি না।

ইরা আবার ওকে ফেরত নিতে আসবে না তো?

নিতে এলেই বা দিচ্ছে কে? বাবাঃ, লোক পাওয়া যা ঝঞ্ঝাট!

কাল সন্ধ্যেয় অন্তত সাত জায়গায় টেলিফোন করেছি! এই মেয়েটিকে রাখার আর-একটা কী বড়ো সুবিধে জানো?

কী?

ওকে ছুটি-ফুটি দিতে হবে না একদম। ও বলছিল, ও গ্রামে আর যেতে চায় না। গ্রামে গেলে খেতে পাবে না। ওর বাবাটা পাষন্ড, টাকা-ফাকা সব কেড়ে নেবে!

মেয়েটি গ্রামে গেলে খেতে পাবে না, সুতরাং ছুটিও নেবে না, এটা একটা সুবিধেরই ব্যাপার বটে।

শৈবালের একবার লোভ হল প্রমিতাকে খোঁচা দিয়ে দু-একটা মন্তব্য করতে। তারপরই মনে পড়ল, আজ সন্ধ্যেটা অন্যরকম।

প্রসঙ্গ পালটে শৈবাল জিজ্ঞেস করল, কেক এনেছি, ছেলে-মেয়েদের দিলে না?

প্রমিতা বলল, ওরা বিকেল বেলা একগাদা ফুচকা-মুচকা খেয়েছে। বাড়িতে ডেকে এনেছিল। কেকগুলো থাক, কাল ওদের টিফিনে দিয়ে দেবো। তুমি সিগারেট আনতে গেলে না? আমি কিন্তু চললুম রান্নাঘরে।

শৈবাল বলল, সিগারেট কিনতে গিয়ে যদি চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আর সে যদি টানতে টানতে অন্য কোথাও নিয়ে যায় আড্ডা মারার জন্য?

প্রমিতা তার নরম ডান হাতের মুঠিতে ছোট্ট কিল পাকিয়ে বলল, আজ সেরকম কিছু করলে তোমায় এমন মারব।

আজ এপরিবারে চমৎকার সুখ ও শান্তি।

শৈবাল বেরোবার মুখে প্রমিতা আবার বলল, ঠিক এক্ষুনি ফিরবে। আজ শুধু সেদ্ধভাতে ভাত, গরম গরম খেয়ে নিতে হবে। আর শোনো, দুটো মিষ্টি পান এনো তো!

সিগারেট কিনতে গিয়ে সত্যিই এক বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শৈবালের। অরুণ আর মার্থা।

ওরা শৈবালকে দেখে বলল, এই যে, তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম।

আজ শৈবাল পুরো সন্ধ্যেটা নিজের পরিবারের জন্য উৎসর্গ করবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আজ এইরকম কেউ না এসে পড়লেই ভালো হত। কিন্তু ওরা অনেক দিনের বন্ধু, শৈবালকে হাসতেই হল কৃত্রিম হাসি।

মার্থা গড়গড় করে সমস্ত বাংলা কথা বলতে পারে, যদিও উচ্চারণ যাচ্ছেতাই।

ওদের নিয়ে শৈবাল ফেরার পর প্রমিতা দরজা খুলতেই মার্থা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, প্ৰমিটা, ইউ মাস্ট হেলপ মি। আমার ডারুণ বিপড! এমন অসুবিডায় পড়েসি।

অরুণ হাসতে হাসতে বলল, আরে আগে বসতে দাও, ঢুকতে-না-ঢুকতেই

মার্থা বলল, ডেকেচো, ডেকেচো! অরুণ শুধু হাসে। আমাকে কোনো শাহাজ্যো করেনা।

কারুর বিপদের কথা শুনলেই প্রমিতা খুব ঘাবড়ে যায়। সে ভুরু তুলে বলল, কী হয়েছে?

মার্থা বলল, আমাডের কাজের লোক আবার পালিয়েসে?

শৈবাল আর প্রমিতা চোখাচোখি করল।

অরুণ আর মার্থা দু-জনেই চাকরি করে। ওদের একটি চার বছরের ছেলে আছে, ওরা দুই জনেই বেরিয়ে গেলে ছেলেকে কারুর কাছে তো রেখে যেতে হবে। বিশ্বাসী লোক দরকার।

প্রমিতাই অনেকবার ওদের জন্য কাজের লোক ঠিক করে দিয়েছে। আগে ওরা ছেলের বদলে শুধু মেয়ে চাইত। এখন আবার মত বদলে গেছে, মেয়ে চাই না, ছেলে চাই! কিন্তু ওদের বাড়িতে কাজের লোক বা কাজের ছেলে বেশি টেকে না। ওদের বাড়ির ম্লেচ্ছ পরিবেশ হয়তো বেশি দিন সহ্য করতে পারে না তারা। অরুণদের বাড়িতে নিয়মিত গাঁজা খাওয়ার আসর বসে। অল্পবয়েসি আলোকপ্রাপ্ত এবং আলোকপ্রাপ্তা তরুণ-তরুণীরা সেই আসরে যোগ দেয় এবং বাউল গান ও নিগ্রো স্পিরিচুয়ালস বিষয়ে আলোচনা করে।

শেষপর্যন্ত অরুণ তার এক দূর-সম্পৰ্কীয়া বয়স্কা আত্মীয়াকে এনে রেখেছিল। আসলে বাড়ির দাসী, কিন্তু তাঁর নাম মাসি। তিনিও নাকি গতকাল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কে জানে, কাশীর দিকে রওনা হয়েছেন কি না!

অন্যান্য আমেরিকানদের মতন মার্থাও নাকি সুরে কথা বলে। কিন্তু কোনো আমেরিকান যে অনবরত শুধু ঝি-চাকর বিষয়ে আলোচনা করতে পারে, তা মার্থাকে না দেখলে শৈবাল বিশ্বাসই করতে পারত না। শৈবালের এমন একটি দিনও মনে পড়ে না, যেদিন মার্থা ওই বিষয়ে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা বলেছে। অথচ শৈবালের ধারণা, আমেরিকায় ঝি-চাকরের প্রচলন নেই।

এইসময় হেনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মার্থার উদ্দেশ্যে বলল, ভালো আছেন বউদি?

কাজের লোক বা কাজের মেয়েদের এই এক স্বভাব। যে-বাড়ি থেকে তাদের কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছে বা যে-বাড়িতে তাদের রাখেনি, সে-বাড়ির লোকদের দেখলেও তারা হাসিমুখে কথা বলে।

হেনাকে দেখে আনন্দে, বিস্ময়ে মার্থার সারামুখ, চোখ একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেন সমুদ্রে ডুবন্ত কোনো মানুষ একটি ভাসমান ভেলা দেখতে পেয়েছে!

টুমি! টুমি অ্যাখুনো এখানে আস? টুমি চলে যাওনি?

তারপরই মার্থা প্রমিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, প্রমিতা টুমি অ্যাটো ডিন ওকে রেকে দিয়েসো? হাউ নাইস অব ইউ! আ–অ্যাম ভে-র-রি, ভে-র-রি গ্রেটফুল টু ইউ।

প্রমিতা নিরস ঠাণ্ডা গলায় বলল, ও এখন আমাদের এখানে কাজ করে।

মার্থা একেবারে আঁতকে উঠল। যেন, হাত থেকে সেই ভেলাটা আবার কেউ কেড়ে নিচ্ছে!–ও নো। বাট হোয়াই! টোমার টো কুব বালো একটা কাজের লোক আসে। টুমি ডু জনকে রাকটে চাও? কাম নাও, প্রমিটা! ইউ আর বিকামিং আ বুরঝয়া।

অরুণ আপন মনে সিগারেটে গাঁজা পাকাতে শুরু করেছে। যেকোনো জায়গায় গেলেই এটাই তার প্রথম কাজ। শৈবাল মুচকি মুচকি হাসছে।

প্রমিতার গলার স্বর গম্ভীর। সে বলল, দু-জন লোক রাখব কী করে? আমাদের আগের লোকটি চলে গেছে।

মার্থা বলল, সেই ছেলেটি? অনন্ট? সে টো খুব বিশ্বাসী কাজের লোক সিল!

প্রমিতা বলল, চলে গেছে। প্রমিতা মিথ্যে কথা বলে না। টেকনিক্যালি এটাও অবশ্য মিথ্যে নয়। অনন্ত নিজে থেকেই তো রিকশায় চেপে চলে গেছে। তাকে তো জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি।

মার্থা শেষ চেষ্টা করে বলল, প্রমিটা টুমি ওনেক লোক পাবে, টুমি এই মেয়েটিকে আমায় ডাও। আমার খুব ডোরকার।

গলায় কোনো কৌতুক নেই, তবু রসিকতার চেষ্টা করে প্রমিতা বলল, শোনো, তুমি একবার ওকে ফেরত দিয়ে গেছ। আর তুমি ওকে চাইতে পার না। আমাদের বাংলায় এটাই নিয়ম। আমি তোমাকে অন্য লোক খুঁজে দেব।

ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই যেন, প্রমিতা চায়ের সঙ্গে কেকের বাক্সটাও রাখল ওদের সামনে। শোকে-দুঃখে মার্থা তিন-চারখানা কেক খেয়ে ফেলল। অরুণ ততক্ষণে সিগারেটভরা গাঁজায় কয়েক টান দিয়ে ফেলেছে, সে এবার দার্শনিক আলোচনা শুরু করবে। ওরা উঠল রাত দশটায়।

যাওয়ার সময় মার্থা বেশ কয়েকবার লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে গেল হেনার দিকে। সাম্রাজ্য গ্রাসের দিন আর নেই, নইলে মার্থা বোধ হয় হেনাকে ধরে নিয়ে যেত।

ওরা চলে যাওয়ার পর শৈবাল বলল, যাক।

প্রমিতা হেনাকে ডেকে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, তোর কি ওদের বাড়িতে কাজ করার ইচ্ছে ছিল? তুই ওদের ওখানে যেতে চাস?

হেনা বলল, না বউদি। আমি এখানেই থাকব, আমি আর কোথাও যাব না।

তাহলে তুই ওদের সামনে অত ঘুর ঘুর করছিলি কেন?

হেনা ফিক করে হেসে ফেলে বলল, মেমসাহেব তো, কীরকম করে যেন বাংলা কথা কয়, তাই শুনতে ভালো লাগে!

শৈবাল হো হো করে হাসতে গিয়েও থেমে গেল। কে জানে, প্রমিতা আবার কী মনে করবে।

ঠিক সেইসময় ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন।

শৈবাল রিসিভার তুলল। ওপাশে ইরার গলা।

খুব কোমল বিনীত গলায় ইরা বলল, আপনি তখন নিশ্চয়ই কিছু মনে করেছেন, গাড়ি থেকে নামিনি, ভালো করে কথা বলিনি, আমার নামা উচিত ছিল।

না না, তাতে কী হয়েছে।

আসলে ব্যাপার কী জানেন, আজ আমার সারাদিন এত কাজ, এমন টাইট প্রোগ্রামে…সকাল বেলা ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তারপর ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা আরম্ভ আজ থেকে, ঠিক সময় উপস্থিত থাকতেই হবে, নাওয়া-খাওয়ার সময় পাইনি, দুপুরে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনার। তারপর বাড়ি ফিরতে-না-ফিরতেই…ছটার সময় আমার মেয়ের নাচের স্কুলে একটা ফাংশান, সেখানে না গেলে খারাপ দেখায়, সেখান থেকেই আবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা পার্টি, বাইরে থেকে কয়েকজন সাহেব এসেছে

ইরা এমনভাবে বলছে যেন, এই প্রত্যেকটি কাজই ওর কাছে বিড়ম্বনাবিশেষ। অথচ এইসব প্রত্যেক জায়গাতেই ও যেতে ভালোবাসে। এর কোনো একটা জায়গায় ওকে নেমন্তন্ন না করলে ও অপমানিত বোধ করে। এতসব কান্ড করেও ইরা বেশ হাসিখুশি থাকতে পারে।

শৈবাল জিজ্ঞেস করল, প্রমিতাকে দেব?

হ্যাঁ, দিন-না!

প্রমিতা ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কে?

শৈবালও কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে ওষ্ঠের ভঙ্গি করে জানাল, ইরা!

হেনা কাছেই দাঁড়িয়েছিল।

প্রমিতা তাকে বলল, এই, তুই রান্নাঘরে গিয়ে খাবার-টাবার গরম কর তো!

এরপর প্রমিতার সঙ্গে ইরার এক দীর্ঘ সংলাপ শুরু হল।

ইরা বলল, তোকে সারাদিন ফোন করতে পারিনি, এমন ব্যস্ত ছিলাম আমি, ডাক্তারদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তারপর…ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রমিতা বলল, আমিও তোকে ফোন করেছিলাম দু-বার—

হ্যাঁ, জানি, শুনেছি। কিন্তু বিকেলে বাড়ি ফিরেই..ইত্যাদি ইত্যাদি।

ও মা, তোর মেয়ের আজ নাচের ফাংশান ছিল বুঝি? ওইটুকু মেয়ে কেমন নাচল? আমরা খবর পেলুম না, তাহলে আমরাও দেখতে যেতাম…কেমন নেচেছিল কাবেরী?

প্রমিতা ইচ্ছে করেই যেন হেনার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। ইরাও সরাসরি কোনো কথা বলে না।

প্রায় মিনিটদশেক অন্যান্য বিষয় আলোচনা হওয়ার পর ইরা বলল, ভাই প্রমিতা, সত্যি করে বল, তুই আমার ওপর রাগ করিসনি? সত্যি, আমি খুব লজ্জিত!

প্রমিতা নিরীহ ভাব করে বলল, কেন, রাগ করব কেন? কী হয়েছে?

সকাল বেলা দুম করে মেয়েটাকে তোদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেলাম! এটা আমাদের খুবই অন্যায়, তোর কাছ থেকে কাজের লোক নিয়ে আবার তোর কাছেই ফেরত পাঠানো। অরুণ মার্থার মতন আমি জানি ওরা যখন-তখন এসে তোকে জ্বালাতন করে, আমি কিন্তু মোটেই তা চাইনি, আমি মেয়েটাকে বলেছিলাম, ওর গ্রামে পাঠিয়ে দেবো…কিন্তু ও গ্রামে যেতে চায় না, ও নাকি একলা একলা এখনও ট্রেনে চাপেনি, ওর সঙ্গে কারুকে যেতে হবে, কিন্তু আমি আর কাকে পাঠাই বল, তাই বাধ্য হয়েই তোর ওখানে।

ঠিক আছে, তাতে কিছু হয়নি।

তুই রাগ করিসনি? অন্য কোথাও কাজ জোগাড় না-হওয়া পর্যন্ত তোকেই তো ওকে খাওয়াতে হবে, তা ছাড়া রাখাটাও একটা প্রবলেম, ওই বয়েসি মেয়েকে যেখানে-সেখানে শুতে দেওয়া যায় না।

প্রমিতা ঢোক গিলে বলল, ওকে এখন কিছুদিন আমার কাছেই রাখব ঠিক করেছি।

তুই দু-জনকে রাখবি! কক্ষনো রাখিস না..না…না, আমি খরচের জন্য বলছি না। তোর কাজের ছেলেটি আর ওই মেয়েটি। কী যেন নাম, হেনা? হ্যাঁ হেনা, ওরা কাছাকাছি বয়েসি, তোরা যখন বাড়িতে থাকবি না…শেষকালে একটা কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়বি। ডায়মণ্ড হারবারে লক্ষ করিসনি? ওরা দু-জনে যেন সবসময় কাছাকাছি থাকতে চায়, না, না, আমি তোকে বলছি, প্রমিতা…

আমাদের অনন্ত কিছু দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। আজই বাড়ি চলে গেছে।

তাই নাকি? ইরা উল্লাসের চিৎকারে টেলিফোন যন্ত্রটা আর-একটু হলেই ফাটিয়ে ফেলেছিল আর কী! তাহলে তো তোকে এমনিতেই লোক খুঁজতে হত, যাক, তাহলে তোর ভালোই হল বল।

হ্যাঁ, তুই না জেনে আমার উপকার করে ফেলেছিলি।

যাক, আমার মন থেকে একটা ভার নেমে গেল। সারাদিন এমন খারাপ লাগছিল। মেয়েটা কিন্তু সত্যিই বেশ ভালো রে। নম্র, কথা শোনে, আমি রাখতে পারলুম না, আমার উপায় নেই।

কেন কী হয়েছিল?

সে এক লজ্জার ব্যাপার। মেয়েটার কিন্তু কোনো দোষ নেই। ওর একমাত্র দোষ এই যে, ওর বয়েস কম, ওর শরীরে যৌবন আছে!

সেটা দোষের কেন হবে?

সেই তো বলছি? ওর কোনো দোষ নেই! দোষ আমাদের

এরপর ইরা টেলিফোনেই ফিসফিস করতে লাগল। মোটকথাটা হল এই যে, ইরার এক মামাতো ভাই সোমনাথ কিছুদিন হল এসে আছে ওদের বাড়িতে। ছেলেটি লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট, দুর্গাপুরে ভালো চাকরি করে, ছ-মাসের একটা ট্রেনিং কোর্সের জন্য থাকতে হবে কলকাতায়। সেই সোমনাথ এখনও বিয়ে করেনি, তার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। সোমনাথ অত ভালোছেলে হলেও প্রায়ই একটু-আধটু ড্রিংক করে। সে তো আজকাল অনেকেই করে, এমনকিছু দোষের নয়। কিন্তু সোমনাথের মারাত্মক একটি দোষ আবিষ্কৃত হয় হয় দু-দিন আগে।

ইরাদের বাড়িতে ঝি-চাকরদের ব্যবহারের জন্য একতলায় একটা বাথরুম আছে, বাড়ির পেছন দিকে গ্যারেজের পাশে। তিনতলার ঝুল-বারান্দায় একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়ালে যে, সেই বাথরুমটির ভেতরটা দেখা যায় তা আগে কেউ জানত না। পরশুদিন সোমনাথকে সেখানে গভীর মনোযোগর সঙ্গে একদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরার খটকা লেগেছিল। সোমনাথের মুখ চোখের চেহারাই তখন অন্যরকম।

যাক, তখন ইরা সোমনাথকে কিছু বলেনি।

গতকাল সকালেও সোমনাথকে ছাদের ঠিক সেই জায়গাটায় সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তখন ইরা আবার তিনতলারই অন্য একটি ঘরের জানলা দিয়ে লক্ষ রাখে সোমনাথের ওপর। একটু পরেই একতলার বাথরুম থেকে ভিজে কাপড়ে হেনাকে বেরোতে দেখে সব ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল ইরার কাছে। তার অন্তরাত্মা অবশ্য ছি ছি করে ওঠেনি। ইরা বিদুষী মেয়ে, সে জানে, ফ্রয়েড বলেছেন, অনেক পুরুষমানুষের লোভ থাকে নিম্নজাতীয় মেয়েদের ওপর। ঝি, মেথরানি, গয়লানিদের প্রতি তারা বেশি করে যৌন আকৃষ্ট হয়। কত সুন্দরী ভালো পরিবারের মেয়ে সোমনাথকে বিয়ে করতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে। অথচ সোমনাথের ওইরকম নজর!

তখনও সোমনাথকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি ইরা। ভেবেছিল, অন্য কোনো সময় তাকে আকারে-ইঙ্গিতে নিষেধ করে দেবে।

হেনাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল ইরাদের বাড়ির চারতলার চিলেকোঠায়। কাল রাত বারোটার পর বাড়ির সবাই যখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে, তার কিছু পরে খুট করে একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিল ইরা। ইরার এমনিতেই সহজে ঘুম আসে না। তার ঘুম খুব পাতলা। শব্দ শুনে সে নিঃশব্দে বাইরে এসে দেখে সোমনাথ সিঁড়িতে পা টিপে টিপে চার তলার ছাদের দিকে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ইরা অমনি বাইরের আলো জ্বেলে ডেকেছিল, সোমনাথ।

সোমনাথের মুখ-চোখ ঠিক যেন তখন পাগলের মতন। ইরাকে দেখে যেন সে ভূত দেখল। তারপর দৌড়ে নেমে ঝড়ের বেগে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।

আজ সকালে অবশ্য সোমনাথ ইরার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু এরপর আর হেনাকে এবাড়িতে রাখা যায় না। হেনার কিছু দোষ নেই, তবুও।

ইরা প্রবলভাবে স্ত্রী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যেকোনো নির্যাতিতা-রমণীর হয়ে সে সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত। সে বার বার বলতে লাগল, হেনার কোনো দোষ নেই, দোষ সোমনাথের চরিত্রের বিশেষ একটি দিকের, ফ্রয়েড যা নির্দেশ করেছেন। কিন্তু হাজার হোক, সোমনাথ তার মামাতো ভাই, তাকে তো আর বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা যায় না? তা ছাড়া আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ব্যাপারটা জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হবে। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েই হেনাকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিতে হল।

ইরা প্রমিতাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, যেন সে, একথা আর কারুকে না বলে। এমনকী শৈবালকেও না। পুরুষমানুষদের বিশ্বাস নেই, তারা পেটে কথা রাখতে পারে না। শৈবাল যদি অন্যদের আবার বলে…! সোমনাথের খুব শিগগিরই বিয়ে দিতে হবে, তাহলেই ওই দোষ কেটে যাবে।

টেলিফোন সংলাপ শেষ হল ঠিক পঞ্চান্ন মিনিট পর। আরও পাঁচ মিনিট চললেও কোনো ক্ষতি ছিল না।

হেনা আলু, বেগুন, ডিমসেদ্ধ সমেত ফেনাভাত গরম করে টেবিলে দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, তা এতক্ষণে জুড়িয়েও প্রায় বরফ।

প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না প্রমিতা। শয়নকক্ষে শৈবালের জেরার চোটে ইরার বাড়িতে হেনা বিষয়ক সব ঘটনা তাকে বলতেই হল। অবশ্য, সেও প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল। শৈবাল যেন কিছুতেই অন্য কারুকে না বলে।

প্রমিতার ভুরুতে সামান্য দুশ্চিন্তার রেখা দেখে শৈবাল তার স্ত্রীর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে, হাতজোড় করে বলল, হে দেবী, ফ্রয়েড সাহেব যা-ই বলুন-না কেন, দাসী, গোয়ালিনি, মেথরানি জাতীয় স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র লালসা নেই। তুমি যখন বাড়ি থাকবে না, কিংবা যখন বাপের বাড়ি যাবে, তখনও আমি হেনার প্রতি কু-দৃষ্টি দেব না। আমি ট্যুরে গেলে তুমি যেমন অনন্তর সঙ্গে সেরকম কিছু করোনি, সেইরকম আমিও হেনার সঙ্গে… সুতরাং ওকে রেখে দাও, আর যেন লোক খুঁজতে না হয়। প্রমিতা শৈবালের গালে একটা আলতো চাঁটি কষিয়ে দিয়ে বলল, এমন অসভ্যের মতন কথা বল। ওই সোমনাথ ছেলেটি যেন কেমন কেমন, সব মেয়েদের দিকেই কীরকম যেন গিলে খাওয়ার মতন করে তাকায়।

তোমার দিকেও সেরকমভাবে কখনো তাকিয়েছে নাকি?

হ্যাঁ।

তাহলে ফ্রয়েডের থিয়োরি ওর সম্পর্কে খাটল না। ছেলেটি দেখা যাচ্ছে পরিচ্ছন্ন, সুস্থ একটি কামুক। একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে এই যা।

তুমি চুপ করো। আলো নেভাবে না? ঘুমে আমার চোখ টেনে আসছে একেবারে। সারাদিন যা টেনশান গেছে

মাঝরাত্রে আপনি আপনি ঘুম ভেঙে গেল শৈবালের। শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি, ছটফটানি। মনে হয়, প্রত্যেকটি রন্ধ্রে ঝাঁ ঝাঁ করছে। চোখ দুটিতে জ্বালা জ্বালা ভাব।

নিজের কপালে হাত বুলিয়েই টের পেল তার বেশ জ্বর এসেছে! নাকের ডগায় একটা কী যেন! ফুসকুড়ি না?

উঠে আলো জ্বেলে শৈবাল ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে দাঁড়াল। শুধু নাকের ডগায় নয়, ডান ভুরুর ওপরেও আর-একটা ফুস্কুড়ি উঠেছে। কোনো সন্দেহ নেই। চিকেন পক্স তাকেও ছুঁয়েছে।

আলো নিভিয়ে বিছানায় ফিরে যেতে যেতে শৈবাল ভাবল, তার এই ব্যাপারটাই যদি আগের রাত্রে হত, তাহলে আজ সকাল বেলা অনন্তকে অমনভাবে বিদায় করে দেওয়ার দরকার হত না।

প্রমিতাকে ডাকল না শৈবাল। কিন্তু সারারাত তার আর ঘুম এল না।

.

০৮.

পরদিন সকাল বেলা হল রিন্টুর। বিকাল বেলা হিমাংশুবাবুর মেয়ের। এরপরের চারদিনের মধ্যেই এ-বাড়ির সব কটা ফ্ল্যাটেই এক জন দু-জন করে চিকেন পক্সে শয্যাশায়ী। প্রথম প্রথম হিমাংশুবাবু খুব হম্বিতম্বি করে বলেছিলেন যে, শৈবালদের ফ্ল্যাটের কাজের লোক অনন্তর জন্যই আজ গোটাবাড়িটার সব কটি পরিবারের এমন দুর্ভোগ। অনন্তকে সিঁড়ির নীচে শুইয়ে রাখার মতন এমন অন্যায় কাজও কেউ করে?

কিন্তু এক তলার ভাড়াটে শরবিন্দুবাবুর ভালোমানুষ স্ত্রী, এবাড়ির সকলের সুধা বউদি নিজে থেকেই স্বীকার করলেন যে, তাঁর দেওর পাটনা থেকে এই অসুখ নিয়ে এসেছে অনন্তরও আগে। তাকে অতি যত্নে মশারির মধ্যে শুইয়ে রাখা হয়েছিল, সেইজন্য কেউ জানতে পারেনি। তা ছাড়া, পাড়ায় অনেক বাড়িতেই হয়েছে। গোটা কলকাতায় এ-বছর চিকেন পক্সের এপিডেমিকের অবস্থা। সুতরাং বিশেষ কোনো একজনকে দায়ী করার কোনো মানে হয় না।

রিন্টু খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠলেও তারপর পড়ল বাবলি। শৈবাল ভুগল বেশ কিছুদিন। তার পরও শরীর দুর্বল। অফিস থেকে ছুটি নেওয়ার ব্যাপারটা তার বাধ্য হয়েই গেল, কিন্তু মোটেই উপভোগ করতে পারল না। জিভ বিস্বাদ। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। সিগারেট টানতে গেলে বমি এসে যায়। মাঝখান থেকে তার নেপাল ট্যুরটা ক্যানসেল হয়ে গেল।

প্রমিতারও হয়নি, হেনারও হয়নি। এই সময়টায় হেনা খাটল প্রাণ দিয়ে। প্রমিতাকে কিছু দেখতে হয়নি, হেনা একাহাতে সব করেছে। প্রমিতার বাপের বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত হেনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

শৈবাল আর প্রমিতা মাঝে মাঝে আলোচনা করে যে, এবার যদি অনন্ত ফিরে আসে, তাহলে কী হবে? হেনাকে ছাড়াবার আর প্রশ্নই ওঠে না। অনন্তকেই-বা কী বলা হবে?

শৈবাল ভাবে, অনন্ত কি সত্যিই আর ফিরে আসবে? অসুস্থ অবস্থায় তাকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল…এতদিনে তার সেরে যাওয়ার কথা। তারপরই সে প্রমিতার সঙ্গে অন্য বিষয়ে কথা বলে। কেন যেন, অনন্তর কথা মনে পড়লেই তার অস্বস্তি হয়।

প্রমিতা বলে, আমি ভাবছি আর কখনো ছেলে রাখব না। মেয়েই ভালো। শোয়ার ঝামেলা নেই। আমাদের ছোটো ফ্ল্যাট। হেনার শোয়ার জায়গার সত্যিই ঝামেলা নেই। সে রিন্টু আর বাবলিদের ঘরের মেঝেতেই বিছানা পেতে শুয়ে থাকে। তাতে সুবিধে হয়েছে এই যে, রিন্টু মাঝরাতে রোজ একবার করে বাথরুমে যায়। আগে সে মাকে ডাকত, কেন-না, বাথরুমের আলোর সুইচটাতে তার হাত যায় না। এখন সে হেনাকে ডেকে তোলে।

প্রমিতার মাঝে মাঝে কোমরে ব্যথা হয়। সব মেয়েরই যেমন হয়। এখন সেরকম ব্যথা উঠলে হেনা যত্ন করে প্রমিতার কোমর টিপে দেয়। অনন্তকে দিয়ে তো আর একাজ করানো যেত না।

শৈবাল তবু জিজ্ঞেস করে, কিন্তু অনন্ত এলে কী বলবে? তাকে তো ছাড়িয়ে দেওয়া হয়নি, আমি ছুটি নেওয়ার কথা বলেছিলাম

প্রমিতা বলে, অনন্ত এলে ওকে অন্য কারুর বাড়িতে দিয়ে দেব। ওর মতন কাজের ছেলেকে পেলে যে-কেউ লুফে নেবে।

মাসখানেক পর সকলেই আবার সুস্থ স্বাভাবিক হল, শৈবাল অফিসে যেতে শুরু করল।

হেনা এখন সংসারের সব কাজ এমনই শিখে নিয়েছে যে, প্রমিতা তার ওপর স্কুলফেরত ছেলে-মেয়েদের খাবার খাওয়ানোর ভার দিয়ে সেই সময়টায় ফ্রেঞ্চ শিখতে যায়। এবং মাঝে মাঝেই বান্ধবীদের সঙ্গে মিটিং করে অবসর সময় কাটাবার জন্য সে বাচ্চাদের একটি স্কুল খোলার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে। সেটা অবশ্য কোনো দিনই কার্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

শৈবাল অফিসের বন্ধুদের পার্টি-টার্টিতে পরস্ত্রীদের সঙ্গে খানিকটা ফষ্টিনষ্টি করে বটে কিন্তু সে বাড়িতে একেবারে গৃহী-সন্ন্যাসী। হেনাকে সে নারী বলেই গণ্য করে না! হেনা ভিজে কাপড়েই থাকুক কিংবা তার বুক থেকে আঁচল খসে পড়ক, সেদিকে শৈবাল একবারের বেশি দু-বার তাকায় না কখনো।

এ বাড়িতে নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করে হেনার স্বাস্থ্যটি বেশ ভালো হয়েছে। গায়ের রং মাজা, মুখটা মন্দ নয়, হঠাৎ দেখলে ঝি বলে মনেই হয় না।

ইরা এবং অরুণ, মার্থা মাঝে মাঝেই আসে। প্রমিতার মুখে হেনার গুণপনার কথা শুনে প্রকাশ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা। দু-টি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা কারণে হেনাকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিল তারা। তাদের দুটি পরিবারেই যথারীতি কাজের লোক নিয়ে দারুণ সমস্যা চলেছে। ইরার বাড়ি অত্যন্ত অগোছালো। দামি দামি জিনিস এখানে-সেখানে পড়ে থাকে, তার বাড়িতে এক-একজন কাজের লোক বা কাজের মেয়ে আসে, দু-তিনদিন পরই, তারা কিছু-না-কিছু চুরি করে পালায়। ইরার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর সস্ত্রীক সোমনাথ লণ্ডন যাবে। তার ঝি-আসক্তির কথা জানাজানি হয়নি। বোধ হয় এতদিনে সে নিজেও ভুলে গেছে সেকথা।

মার্থা আগের মতনই নাকিসুরে অভিযোগ জানার। তার বাড়িতে কারুকে না ছাড়িয়ে দিতে হয় ঝাল রান্নার জন্য, কেউ-বা গোরুর মাংস দেখে ঘেন্নায় নিজে থেকেই পালায়। যত বলি জাল ডেবে না, লঙ্কা একডম ডেবে না, টবু থিক ডেবে! বেংগোলিয়া কি লোঙ্কা চারা কোনো কিসু রাঁডটে জানে না?

অরুণ অবশ্য একটু ঝাল রান্নাই ভালোবাসে। মেমবউয়ের পাল্লায় পড়ে আ-ঝালি, সেদ্ধ সেদ্ধ খাবার খেতে সে বাধ্য হয় বটে, কিন্তু অন্য কোনো বাড়িতে খেতে গেলেই সে কাঁচা লঙ্কা চেয়ে নেয়।

ইদানীং মার্থার আবার কাজের লোকের দারুণ সংকট চলছে। এক সপ্তাহ ধরে তাদের কেউ নেই। তাই সে ঘন ঘন আসছে প্রমিতার কাছে। তবে প্রমিতার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জটাও এখন বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। ঝি-চাকর আর পাওয়াই যায় না। অথচ সারাদেশে নাকি এখনও খেতে পায় না বহুলোক।

দু-মাস কেটে গেছে। অনন্ত ফিরে আসেনি। অর্থাৎ সে আর আসবে না। সে কি অভিমান করে এল না? নাকি দেশেই থেকে গেল?

এবাড়িতে কেউ আর অনন্তর নাম উচ্চারণ করে না। রিন্টুও এর মধ্যে ভুলে গেছে। অনন্তর একজোড়া চটি পড়েছিল পেছনের বারান্দায়, প্রমিতা একদিন জমাদার ডেকে সে চটিজোড়া ফেলে দিতে বলল।

শৈবালের একটা কাজ বেড়েছে আজকাল। বাজার করতে হয়। হেনাকে দিয়ে আর সব কিছুই হয়, কিন্তু বাজার করাটা সুবিধের হয় না। অনন্ত চমৎকার গুছিয়ে বাজার করত। দু-চার পয়সা সে চুরি করত কি না কে জানে। কিন্তু প্রমিতা খবরের কাগজের বাজার-দর পড়ে দেখত, অনন্ত ঠিক একই দাম বলে সব জিনিসের।

আর হেনা গ্রামের মেয়ে হলেও মাছ চেনে না একেবারেই। বেশি পয়সা দিলেও সে যা-তা মাছ নিয়ে আসে।

শৈবাল বাজার করা একদম পছন্দ করে না। শৈবালের ধারণা, সে অফিসে প্রচুর পরিশ্রম করে টাকাপয়সা রোজগার করে আনে বলে, বাড়িতে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তার আলস্য বিলাসিতা করার অধিকার আছে। কিন্তু রোজ রোজ আর কাঁহাতক পচা মাছ কিংবা কাঁটাভরা বাটামাছ খাওয়া যায়? বাধ্য হয়েই হিমাংশুবাবুর মতন ভোরে উঠেই চা খাওয়ার আগে বাজার যেতে হয় তাকে। অবশ্য সে পাজামার ওপর পাঞ্জাবি পরে। এবং বাজারে হিমাংশুবাবুকে দেখলে সে দূর থেকে এড়িয়ে যায়।

দাদাবাবু।

বাজার থেকে ফেরার পথে একদিন শৈবাল যেন সকাল বেলাতেই ভূত দেখল।

তার সামনে দাঁড়িয়ে অনন্ত। তারও হাতে ভরতি বাজারের থলে। সত্যি সত্যি ভয়েই কেঁপে উঠেছিল শৈবাল। অনন্ত যদি এখন তাকে একটা গালাগালি দেয় কিংবা মারার চেষ্টা করে! সে কী করবে?

অনন্ত টিপ করে শৈবালের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অত্যন্ত লাজুক বিনীত গলায় বলল, ভালো আছেন দাদাবাবু?

শৈবালের গলা শুকিয়ে গেছে। তারই তো অনন্তকে জিজ্ঞেস করার কথা যে, সে ভালো কি! শৈবাল কিছু বলতে পারল না। একটা অপরাধবোধ যেন তার গলা টিপে ধরেছে।

রিন্টু, বাবলি, বউদি, সব ভালো আছেন তো?

এবার শৈবাল কোনোক্রমে বলল, হ্যাঁ। তুই কেমন আছিস?

ঠিক ডানপাশের বাড়িটার দিকে হাত দেখিয়ে অনন্ত বলল, আমি এখন এই বাড়িতে কাজ করি।

শৈবালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কিংবা আক্রোশ দেখাবার বদলে অনন্ত মুখে এমন একটা হাসি ফুটিয়ে তুলল, যেন সেই অপরাধী।

তারপর যেন, কৈফিয়ৎ দেওয়ার সুরেই সে বলল, আমি তখন দেশে যাইনি। বালিগঞ্জ স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে শুয়েছিলাম। এবাড়ির ডাক্তারবাবু বাড়িতে নিয়ে এলেন।

শৈবাল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দেশে সত্যিকারের দয়ালু, মানবহিতৈষী লোক আছে তাহলে। রেলস্টেশন থেকে একজন বসন্তের রোগীকে বাড়িতে এনে চিকিৎসা করেছেন। পরমুহূর্তেই সে ভাবল, কিংবা এমনও হতে পারে, ওই ডাক্তারটিরও বাড়িতে কোনো কাজের লোকের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা মোটামুটি ভদ্র চেহারার ছোকরাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার মানুষ, ভালো করেই জানে যে, চিকেন পক্স এমন কিছু ভয়ের অসুখ নয়।

অনন্ত আবার বলল, আমি এখন এই ডাক্তারবাবুর চেম্বারে কাজ করি।

শৈবাল চোখ তুলে ডাক্তারটির সাইনবোর্ড দেখল, অনন্তর পদোন্নতি হয়েছে তাহলে। সে আর চাকর নয়। ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট। রুগিদের স্লিপ নিয়ে ডাক্তারের টেবিলে দিয়ে আসে। ডাক্তারবাবু আসবার আগে চেম্বারটা পরিষ্কার করে রাখে! অনন্ত লেখাপড়াও জানে কিছুটা।

একবার আসিস আমাদের বাড়িতে, একথা বলতে গিয়েও বলল না শৈবাল। যেন তার অধিকার নেই একথা বলার।

সামান্য কিছু বিড় বিড় করে সে, অনন্তর কাছ থেকে বিদায় নিল।

বাড়ি ফিরে সে খুবই নাটকীয় উত্তেজনার সঙ্গে খবরটা জানাল প্রমিতাকে।

প্রমিতার মধ্যে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তার নিজের এখন ভালো কাজের লোক আছে, পুরোনো লোকেরা কে কোথায় কাজ করে তা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই।

ছেলে-মেয়েরাও, একবারও বলল না, অনন্তকে ফিরিয়ে আনবার কথা। অথচ ওদের সঙ্গে খুবই ভাব ছিল অনন্তর।

তারপর থেকে প্রায়ই অনন্তর সঙ্গে দেখা হয় শৈবালের। সে যখন বাজারে যায়, তখনও ওই ডাক্তারের চেম্বার খোলার সময় হয় না। অনন্ত সেই সময়টা চেম্বারের দরজা খুলে ঝাড় পোঁছ করে। শৈবালের সঙ্গে চোখাচোখি হলে শ্রদ্ধা ও নমস্কারের ভঙ্গিতে হাসে অনন্ত। একদিন শৈবালের বাজারের থলি থেকে একটা জ্যান্ত কইমাছ লাফিয়ে পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়, অনন্তই ছুটে এসে তুলে দিয়েছিল মাছটা। শৈবাল জ্যান্ত কইমাছ ধরতে ভয় পায়। দেখা যাচ্ছে, অনন্ত এখনও পুরোনো মনিবকে খাতির করে।

সুখের নিয়মই এই যে, তা মাঝে মাঝেই চঞ্চল হয়ে পড়ে।

শৈবালদের সুখের সংসারেও ফাটল দেখা দিল আবার। চার-পাঁচ-মাস কাটতে-না কাটতেই প্রমিতার কাছ থেকে আবার হেনা সম্পর্কে অভিযোগ শুনতে হল শৈবালকে।

একদিন প্রমিতা বলল, যাই-ই বলো, গ্রাম থেকে ভালো মানুষটি সেজে এলেও এখানকার ঝানু ঝি-চাকরদের সঙ্গে মিশে দু-দিনেই ওরা সেয়ানা হয়ে ওঠে।

শৈবাল বলল, ঝি-চাকর বলছ যে? তুমিই না বলেছিলে—

এখানে তো আর কেউ শুনছে না।

কী করেছে ও? কাজ তো ভালোই করে।

তা করে। কিন্তু একটাই ওর প্রধান দোষ, একবার বাইরে গেলে কিছুতেই আর ফিরতে চায় না। কোথায় থাকে কে জানে? আজকাল সকালে চা দিতে কত দেরি করে দেখেছ? ভোরে দুধ আনতে গিয়ে ফেরে দেড় ঘণ্টা বাদে। বলে কিনা, মস্ত বড় লাইন। এতদিন লাইন ছিল না, আমার আগের লোকেরা সবাই আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসত, আর এখনই লাইন বড়ো হয়ে গেল? শুনলে বিশ্বাস করা যায়?

শৈবাল বলল, হুঁ!

কাল ওকে এক প্যাকেট মাখন কিনতে পাঠালাম, ফিরল ঠিক দু-ঘণ্টা পরে। আমি তো চিন্তায় মরি! গাড়িচাপা পড়ল না কি! আমাদের রাস্তাটা যা খারাপ! ও মা, সেসব কিছুই হয়নি, হেলতে দুলতে ফিরল।

কেন দেরি হল জিজ্ঞেস করলে না?

বলল, মাখন পায়নি।

মাখন পাইনি তো এত দেরি?

সেইকথাই তো বলছি। ওকে যত জিজ্ঞেস করি কোনো উত্তর দেয় না। আজকাল কেমন যেন উদাস ভাব। কথা বললে মন দিয়ে শোনে না।

হুঁ।

আমার কী মনে হয় জানো। ও কোনো আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশছে। চেহারাখানা তো খোলতাই হয়েছে বেশ! আজেবাজে গুণ্ডা বদমাশরা ওর দিকে নজর দেবেই। আর ও মেয়েটাও তো বোকা।

হুঁ।

হুঁ হুঁ করছ কী? আমার তো একটা কথা ভেবে ভয়ই ধরে গেছে। এই ধরো, গত রোববার আমরা চন্দননগর গেলাম, সারাদিন কেউ বাড়িতে ছিলাম না; ওর ওপর সব কিছুর ভার দিয়ে গেছি, ও যদি সেরকম কোনো আজেবাজে লোককে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকায়…একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারিতে পড়তে হবে না।

তা করবে না, মেয়েটা এমনিতে ভালো।

ভালো হলেই-বা, বোকা যে। তা ছাড়া এই বয়েসে

একটা কথা বলব?

কী?

শৈবাল ভালো করে সিগারেটে টান দিয়ে প্রমিতার চোখে চোখ রেখে বলল, হেনার একটা বিয়ে দিয়ে দাও।

বিয়ে?

হ্যাঁ। এই বয়েসেই গ্রামের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। শুধু গ্রামের মেয়ে কেন, ওর তো একুশ-বাইশ বছর বয়েস…ঝি-চাকরের কাজ করলেও ওদেরও তো একটা শরীরের ক্ষুধা আছে। যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। ওর যৌবন এসেছে, ও-ও তো কোনো পুরুষমানুষকে চাইবেই। আর কোনো পুরুষমানুষ যদি ওকে চায়, তাহলে ওই-বা আকৃষ্ট হবে না কেন? সেইজন্যই বলছি, ওর একটা সুস্থ সামাজিক জীবনের জন্য একটা বিয়ে দেওয়া দরকার।

ওর বিয়ে আমরা দেব কী করে? ওর বাবা এসে কী বলবে-না-বলবে।

ও তো গ্রামে নিজের বাবার কাছে ফিরতে চায় না শুনেছি।

আর-একটা কথা, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ও নিজেই একদিন বলেছিল যে, খুব কম বয়েসে ওর বাবা জোর করে একজন বুড়োর সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছিল! ওদের সমাজে বিয়েতে মেয়ের বাবা টাকা পায়। ওর সেই বর অবশ্য বিয়ের তিন-চার মাস বাদেই মারা গেছে। ও আসলে বিধবা।

বিদ্যাসাগরমশাই বিধবা বিবাহ আইন পাস করে গেছেন বহুদিন আগে!

প্রমিতা এবার রাগত সুরে বলল, বেশ তো, তুমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো। তোমার যদি অত গরজ থাকে।

শৈবাল চুপ।

প্রমিতা আবার বলল, ওর বিয়ে হলে ও আর আমাদের বাড়িতে কাজ করবে?

অনেক বিবাহিতা মেয়েও তো কাজ করে দেখেছি।

সে শুধু ঠিকের কাজ। তারা বাড়িতে থাকে না। যাদের বর নেয়-না কিংবা অন্যরকম গোলমাল আছে তারাই শুধু বাড়িতে থেকে কাজ করে।

শুধু আমাদের এখানে কাজ করবে বলেই ওই মেয়েটি সারাজীবন বিয়ে করতে পারবে না?

বেশ তো, টাকা পয়সা জোগাড় করে তুমি যদি ওর বিয়ে দিতে পার—

শৈবাল আবার চুপ।

ঝি-চাকরের কাজ যারা করে তাদেরও দেহের ক্ষুধা আছে, তাদের একটা সুস্থ সামাজিক জীবন দিতে গেলে ঠিক সময়ে বিয়ে হওয়া উচিত, এটা শৈবাল বিশ্বাস করে। কিন্তু সে নিজে উদ্যোগী হয়ে জোগাড় যন্ত্র করে এই হেনার মতন কোনো মেয়ের বিয়ে দেবে, এ শৈবালের পক্ষে সম্ভব নয়। তার সময় কোথায়? অফিসের কাজ আছে-না? যেসব অফিস ভালো মাইনে দেয়, তারা নাকে দড়ি দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। ম্যানেজিং ডাইরেক্টার বোম্বে ট্যুর থেকে ফিরলে তাঁকে রিসিভ করার জন্য রোববার সকালেও শৈবালকে ছুটতে হয় এয়ারপোর্টে।

এর দু-দিন পর প্রমিতা আবার রাত্তির বেলা চোখ বড়ো বড়ো করে শৈবালকে বলল, আজ কী হয়েছে জানো?

শার্ট, প্যান্ট, জাঙিয়া ছেড়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়েও শৈবাল ওয়ার্ডরোবে পাজামা খুঁজে পেল না। সে ঠিক সেই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, আগে তোমার কথাটা বলে নাও, তারপর পাজামাটা খুঁজে দিয়ো।

শৈবাল যে জায়গাটা খুঁজেছিল, ওয়ার্ডরোবের ঠিক সেই জায়গাটাতেই হাত দিয়ে ম্যাজিকের মতন একটা পাজামা বার করে আনল প্রমিতা। সেটা শৈবালের শরীরের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে সে বলল, রিন্টু-বাবলিকে হেনার কাছে রেখে আমি ফ্রেঞ্চ ক্লাসে গিয়েছিলাম। এসে দেখলাম হেনা নেই। কিছু বলে যায়নি ওদের। কোনো রকমে খাবারটা দিয়ে চলে গেছে। ফিরল আমি ফেরারও এক ঘণ্টা পরে। জিজ্ঞেস করলে কিছু উত্তর দিল না। এমন আস্পর্ধা হয়েছে!

শৈবাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, এবার এবাড়ি থেকে হেনার পাট উঠল। দু চারদিনের মধ্যেই প্রমিতা ওকে তাড়াবে।

তাড়াতে আর হল না, তার পরদিনই হেনা উধাও হয়ে গেল। সন্ধ্যে বেলা কী একটা ছুতো করে সে বেরিয়েছিল, রাত্রে আর ফিরে এল না। ভদ্রলোকেরা যেমন কথায় কথায় প্রেমে পড়ে, ওদের মধ্যে কি সেরকম প্রেম চালু আছে? বেঁচে থাকার তাগিদটাই ওদের জীবনে প্রধান নয়?

কিংবা স্বাস্থ্যবতী অথচ বোকা মেয়ে হেনা হয়তো পড়েছে লম্পট গুণ্ডাদের পাল্লায়। তারা ওর যৌবন লুটে পুটে নিয়ে ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তখনও যদি ছিটেফোঁটা যৌবন অবশিষ্ট থাকে, তাহলে হেনা নাম লেখাবে কালীঘাটে কিংবা সোনাগাছির বেশ্যাপল্লিতে আর যদি চেহারাটা একেবারে ভাঙাচোরা হয়ে যায় তাহলে পাঁচ বাড়িতে ঠিকে ঝির কাজ নিয়ে পেট চালাবে।

ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে শৈবাল এই সব সাত-পাঁচ ভাবে। হেনা কিংবা অনন্ত চলে যাওয়ার ফলে তার বাড়িতে খুবই গন্ডগোলের সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু ওরা দু-জনে যদি জীবনে সুখী হয়…।

ডাক্তারবাবুটির কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়তো অনন্তকে চাকরি থেকে তাড়ানোর আসল কারণটি বলে দিতে পারেন, কিন্তু শৈবাল জিজ্ঞেস করতে চায় না। যদি ব্যাপারটি সত্যি এ-রকম নিষ্ঠুর হয়। নিষ্ঠুর ঘটনার মুখোমুখি হতে চায় না শৈবাল।

তার বদলে মাঝে মাঝে সে একটি দৃশ্য কল্পনা করে। হেনাকে বিয়ে করে অনন্ত ফিরে গেছে সুন্দরবনে তার নিজের বাড়িতে। মাতলা নদীর ধারে ছবির মতন ছোট্ট একটি মাটির বাড়ি। সামনের খানিকটা জমিতে বেগুন আর লঙ্কাগাছ। রান্নাঘরের দু-পাশে একটি গোয়ালঘর আর একটি ধানের গোলা। কিছু দূরে মাঠে হাল, বলদ আর লাঙল নিয়ে অনন্ত চাষ করছে নিজের জমিতে। আকাশ-ছাওয়া বৃষ্টিভরা কালো মেঘ। বাড়ির সামনের জায়গাটায় শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে স্বাস্থ্যবতী হেনা জল দিচ্ছে বেগুন গাছগুলোর গোড়ায়। সে গুনগুন করে গাইছে একটা পল্লিগীতি। একটা এক বছরের শিশু ধুলোবালি মেখে খেলছে মাটিতে আর খলখল করে হাসছে। হেনা মাঝে মাঝে গান থামিয়ে ছেলের দিকে তার ঘামেভেজা মুখটি ফিরিয়ে বলছে, দাঁড়া তো রে দুষ্টু, দেখাচ্ছি তোকে–

এই মনোরম দৃশ্যটি কল্পনা করে আদর্শবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক শৈবাল ভারি তৃপ্তি পায়।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress