Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আবু সেই যে দুপুরে

আবু সেই যে দুপুরে এক পলক এসেই বেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। হাশেম ছিল বিছানায় শুয়ে। যাবার আগে বলে যেতে এসে বীথি তাকে ঘুমন্ত দেখেছিল। ইতস্তত করে ফিরে যাচ্ছিল। তখন হাশেম বলে উঠেছে, শোন। মনে করেছিলাম চোখ বুজে তোকে ফাঁকি দেব। কই, পারলাম না।

বীথি কাছে আসেনি। ঘরের মাঝখানেই অধোমুখে দাঁড়িয়েছিল। তাকে ওরকম দেখে হাশেম বলেছে, যা তুই। জেলখানায় না দ্বীপান্তরে যাচ্ছিস যে বিদায় নিতে হবে তোর। আসিস একবার, কেমন?

শুনে খোরশেদ চৌধুরী হা হা করে হেসে উঠেছিলেন।

দ্বীপান্তরেই তো! কী বলিস, বীথী? আসতে যেতে ছআনা লাগে রিকশায়, সোজা কথা? যাবার আগে মরিয়ম বীথিকে কোলের কাছে বসিয়ে অনেকক্ষণ আদর করেছিলেন। বলেছিলেন, শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখিস, মা। বড় চাচিকে বলিস, কদিন হলো ভালো নেই তুই। তোর চাচাকেও বলে দিলাম। কাল তোকে দেখতে আসব।

তন্ময় ছবিটা থেকে মরিয়ম চমকে ফিরে এলেন বর্তমানে। যাবার সময়ে বীথির চোখে পানি ছিল, এখন তার চোখে। কোনো মতে আঁচল ঠেকিয়ে হাশেমকে বললেন, তুই এখানেই বসবি? না, ভেতরে যাবি?

এখানেই ভালো।

তাহলে বোস। আমি রান্নাঘরটা দেখে আসি।

মরিয়ম উঠে দাঁড়ালেন।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বীথির খালি ঘরটা চোখে পড়ল। ভেজানো ছিল দরজাটা। বাতাসে কখন আধো খুলে গেছে। বীথি থাকতেও মাঝে মাঝে এমনি কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না।

.

আবু সোজা এসে তার নিজের ঘরে ঢুকল। কামালের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে যে বেপরোয়া আড়াই মেরেছে তা নয়, তার সঙ্গে প্রথম শোর ছবিও দেখেছে। অর্থাৎ মনটাকে নিয়ে ঘণ্টা পাঁচেক কৌতুক করেছে আবু। এখন আবার সেই ভাবনাগুলো ফিরে এসেছে। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে বিলকিসের শাড়ির পাড়ে আঁকা ময়ূর, বাড়ি, গাছ। মনে করেছিল, ক্লান্তি অবোধ করে রাখবে মনটাকে। কিন্তু তা হলো কই? ক্লান্তি এসেছে ঠিকই, ভীষণ ক্লান্তি, কিন্তু মনটা আরো সূচীমুখ হয়ে উঠেছে। অনেকক্ষণ ভুলে থাকার পর, বাড়ি ফেরার পথে, মাথার ভেতরে নাচ শুরু হয়েছিল আবার। এখনো সেটা থামে নি।

কাপড় বদলে নিচে নামল আবু। আজ তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। এমন খিদে যদি সবদিন পেত, মায়ের আর কোনো অনুযোগ থাকত না। মাকে আজ তাক লাগিয়ে দেবে আবু। বীথির দরজা বন্ধ দেখে ভাবলো, অন্ধকারে শুয়ে মেয়েটা হয়ত দুপুরের কথা ভাবছে। বড় অবিচার করা হয়েছে তার ওপর। ভাবল, ফিরে এসে ডাকবে। ডেকে বলবে, বীথি তুই আমার কথায় কিছু মনে করিস নে।

খেতে বসে দেখল, মা নেই। মা না থাকলে বীথি থাকে। মাকে গিয়ে ডাকল আবু। মরিয়ম বললেন, আমার শরীরটা ভালো নেই রে।

বলতে বলতে উঠে আসেন তিনি। আবু বলে, থাক।

বলেই সে নেমে আসে খাবার ঘরে। তন্ময় হয়ে খাচ্ছিল, মরিয়ম এসে পিছনে দাঁড়ালেন। বুঝতে পারলেন, আবু এখনো টের পায়নি। যদি জানতে পারে বীথি চলে গেছে, তাহলে কী হবে?

মায়ের মন মরিয়মের। আবু সত্যি সত্যি বীথিকে ভালবাসত কিনা জানতে ইচ্ছে করল তার। কথাটা বলে দেখলে কেমন হয়? বীথির চলে যাওয়ার সংবাদে ওর মুখ চোখ তো তাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তার চোখে পড়বেই। আশায় তিনি সমুখে এসে দাঁড়ালেন।

প্রায় চমকে উঠেছিল আবু। মাকে দেখে রুষ্ট কণ্ঠে বলল, তোমাকে না বললাম এসো না?

তুই কি একা বসে খেতে পারবি?

আবু কোনদিন একা বসে খেতে পারে না। কেউ না কেউ থাকবে, কথা বলবে কী সঙ্গে খাবে, এই অভ্যেস। মরিয়ম হাসলেন। বললেন, তোর বড় চাচা এসেছিল।

আবু কথা বলল না। ভাবল, হাশেম ভাইকে দেখতে এসেছিল। মাথা নিচু করে খেয়ে চলল সে।

বীথিকে নিয়ে গেল।

চমকে মায়ের দিকে তাকাল আবু। দেখল, মা দুচোখ মেলে তাকে দেখছেন। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল সে। কিছু একটা বলা দরকার। বলল, কখন?

বিকেলে। বীথি এখন থেকে ওঁর কাছেই থাকবে।

আবুর থমথমে মুখ দৃষ্টি এড়াল না মরিয়মের। ছেলে তক্ষুনি হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল। পীড়াপীড়ি করতে ভুলে গেলেন তাকে আরো খাওয়ার জন্যে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। যেন এই ছেলেটা পর হয়ে গেল তাঁর।

সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে এক পলকের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আবু। বীথি চলে গেছে! দুপুরের ঘটনাটি মনে পড়ল তার।

বীথি কি জানতো যে আজই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে?

.

বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল আবু। বীথির আজ দুপুরের চেহারা, কথা আর পথ থেকে হঠাৎ চলে যাওয়া, মনে পড়তে থাকে। চলে যাবে জানলে কাল রাতের প্রতিজ্ঞাটা কক্ষনো ভাঙ্গতে না সে। মনে মনে আবছা অনুতাপ হয় তার।

বীথি চলে গেছে বলে প্রথমে যেমন এখন আর অতটা খারাপ লাগছে না। থেকে থেকে কেবল মনে হচ্ছে, বীথি ছিল বলে একটা আশ্রয় ছিল তার।

আর কিছু না। গেছে যাক। আসলে বিলকিস আজ তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। মাথার ভেতরে যে নাচ হচ্ছে তার উৎস বিলকিস।

উঠে এসে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে থাকে আবু। তারপর নেবে এসে নিমগাছের নিচে। সেখান থেকে বাগানে। বাগানের সিঁড়িতে বসে ঠাণ্ডা বাতাসে প্রীত হতে থাকে আবু। মনে মনে আলোড়ন চলতে থাকে বিলকিসকে নিয়ে। নিজেকে যেন সারাদিন পর আবার সে ফিরে পাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিলকিসকে। তার সারাটা শরীর আর আত্মা থরথর করে কাঁপতে থাকে। নিজেকে শান্ত করবার জন্যে, ঘুম পাড়াবার জন্যে, ফিসফিস করে উচ্চারণ করতে থাকে সে বিলকিসের নাম। তখন একটা অলৌকিক মায়ার মতো সৃষ্টি হয় তার চারদিকে। বিলকিস হয়তো এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। না, ঘুমিয়ে পড়বে কেন? তার পরীক্ষা; হয়ত রাত জেগে, বাম হাতে কপালের ভার নামিয়ে লেখাপড়া করছে। আলোর আভায় গড়ে উঠেছে। তার মুখ ঘরের অন্ধকারের ভেতর থেকে। সব ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষ, দালান, বাড়ি, রাস্তা, দেয়ালের ওপরে থাবা বিছিয়ে শুয়ে থাকা বেড়ালটা। বিলকিসের শরীর থেকে কুয়াশার মতো এক দীপ্তি আর কোন স্মরণাতীত কাল থেকে উথিত চেনা অগুরুর ঘ্রাণ যেন তার। ইন্দ্রিয়ের দুয়ারে এসে আঘাত করছে।

কোনদিন বলা হয়নি বিলকিসকে। ভয়, সে যদি প্রত্যাখ্যান করে।

কিন্তু আজ, এখন, নিজেকে এত নিঃশঙ্ক আর প্রস্তুত মনে হচ্ছে। আবু উঠে দাঁড়াল। বারান্দায় তার পায়ের শব্দ পেয়ে হাশেম ডাকল, শোন।

কাছে আসতেই শুধালো, ঠিকানা পেলি?

আবু লজ্জিত হয়। আরো আগেই জানানো উচিত ছিল তার। বলে, হ্যাঁ, পেয়েছি। এখুনি দেব, না, সকালে?

সকালেই দিস।

হাশেম যেন আলস্যে চোখ বুঁজলো।

.

অনেক রাত অবধি আবু অনেকগুলো কাগজ ছিড়বার পর বিলকিসের কাছে এই চিঠিটা লিখতে পারে—

চিঠি পেয়ে অবাক হবেন না, অপ্রত্যাশিত হলেই যে তা অসঙ্গত হবে এমন কথা নেই। কোনদিন কেউ আমাকে ডাকে নি। অমন একটা ডাকের জন্যে আমি বারবার মরে জন্ম নিতে পারি, সব তুচ্ছ করতে পারি। আপনাকে আমি এমন করে লিখতে পারছি, কারণ, অলক্ষ্যে আপনি আমার আপনতম হয়ে উঠেছেন। আমার যে কী আত্মমোহ ছিল! বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি নিজেকে নিয়েই। একেকদিন একাকীত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। তখন মনে হতো, বুকের ভেতরে কে যেন কাঁদছে। তখন অস্থির হয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়াতাম, ভিড়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজেকে ভোলাতাম—-যেন শিশুকে খেলনা দিয়ে ভোলাচ্ছি।

একদিন ঈশ্বর হাসলেন। আমার চোখের সমুখে তুলে ধরলেন একজনকে। তাকে আর ভুলতে পারলাম না। আমার মোহ ভাংগল, চূর্ণ হলো আমার অহংকার। চলমান পৃথিবী তার সমস্ত সবুজ আর রৌদ্র দিয়ে আমার দিকে কৌতুক আঙ্গুল তুলে, সমস্ত হাওয়া দূর দূরান্ত থেকে করতালি দিতে দিতে যেন বলে গেল একাকী থাকলে পারলে না।

এত কথা হলো, এতকাল ধরে ধরে এত বিনিময় করলাম, কিন্তু যে কথা বলব, তা আর বলা হলো না।

এত অনুভব করি, বলতে পারি না কেন? এত চাই, কাছে আসতে পারি না কেন?

একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। আমার বছর বারো বয়স, তখন একদিন জোর করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকের দুধ খেয়েছিলাম। যে দুধ খেয়ে আমার ছোটভাই বেঁচে আছে তার স্বাদ কেমন জানতে চয়েছিলাম।

ভাইটি মারা গেছে।

সেদিন দুধ মুখে দিয়ে থুতু করে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে দুধ ছিল ক্ষীণ, নোনা আর পানসে।

জীবন কি আবার এমনি করে আমাকে তাড়িয়ে দেবে? না, আপনাকে বিব্রত করব না কোন প্রশ্ন করে। তারে একটা টংকার পড়লে সুরটা কিছুক্ষণের মধ্যে অনন্তে যায় মিলিয়ে। কিন্তু রেশ থাকে অনেকক্ষণ।

আজ সারাটা দিন আমার এমনি।

আনন্দ-পুত্র হতে চেয়েছি পৃথিবীতে। চেয়েছি, আনন্দ যেন আমার জন্ম হয়, আনন্দ যেন আমার মৃত্যু হয়। আমার যে শূন্যতা আপনার স্পর্শে আনন্দ হয়ে উঠেছে, সে শূন্যতাকে বললাম—- সার্থক তোমার প্রতীক্ষা। আর সত্তাকে বললাম—-অন্য আর কিইবা বলতে পারতাম? তুমি অনন্তকালের জন্যে সঞ্চয় করে রাখো এই আনন্দের মহিমাকে।

সেই গল্পটা মনে করুন। একটা কক্ষ ভরে দিতে হাজার টাকার কার্পেট লাগে, আবার এক পয়সার মোম জ্বালিয়েও তা ভরে দেওয়া যায়। আপনার যতটুকু পেলাম তাই আমার আলো। শূন্য হাত বাড়িয়ে রইলাম আরো অনেক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। আমার ভয় কী? আমার যে বিশ্বাস রয়েছে আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। কাল আসবো।

ইতি, আবু।

.

পারিজাত বলল, ফিরে যাবেন না। আপা আপনাকে বসতে বলেছেন।

বিলকিসদের বসবার ঘরে এসে আবু গত তরশুর সেই সোফায় বসল। ঠিক আগের মতই। দুপা ক্রস করে, দুহাত ছড়িয়ে; যেন তার অবচেতন মনে এটা একটা মায়ায় দাঁড়িয়ে গেছে। আশ্চর্য, বিলকিস কী করে জানলো বকুলকে ভালবাসত হাশেম ভাই? হাশেমের জীবনের কতটুকু জানে এই মেয়েটা? সেদিন অমন করে হঠাৎ উঠে আসতে না হলে সে জিজ্ঞেস করতে পারত। আজো জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু কিন্তু আজ সকালে বিলকিস তার চিঠি পেয়েছে। এখন যেন মনে হচ্ছে চিঠিটা না লিখলেই পারত। লিখলেও, না এলে হতো। বলতে কী, আবুর বুকের মধ্যে কাঁপন উঠেছে, বিলকিস যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়! চিঠির কথা যতক্ষণ ভুলে থাকা যায়—- ভালো। বিলকিস যতক্ষণ এ ঘরে না আসছে ভালো।

অনেকক্ষণ পরে বিলকিস এলো। মুখে তার স্নিগ্ধ হাসি। আটপৌরে শাদা শাড়ি পরনে তার, চওড়া সবুজ পাড় নেয়ে উঠেছিল। সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। একটা স্নিগ্ধ শ্রী ঘিরে রেখেছে তার কান্তি। আবু তাকে দেখে মধুর হাসলো। যেন দুজনের মধ্যে কিছুই হয়নি।

আবু বলল, হঠাৎ এসে পড়লাম।

কেন, চিঠিতে তো জানিয়েছিলেন।

কত সহজে চিঠির উল্লেখ করতে পারল বিলকিস। বিস্মিত হলো আবু। তার আশা হলো। কিন্তু অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না।

ওদিকে বিলকিসের মনটাও উদাস হয়ে উঠেছে থেকে থেকে। এ কথা তো বলা যায় না আবুকে। আজ যে মন্টির জন্মদিন। সকাল থেকে প্রস্তুত হয়েছিল যে মন, বাকবিতণ্ডা তুলে তাকে সে কিছুতেই নষ্ট করতে পারবে না।

চিঠিটা পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল বিলকিস। সে জানত, একদিন না একদিন এমন একটা কাণ্ড করে বসবে আবু। কিন্তু সেটা মণ্টির জন্মদিনেই ঘটবে তা কে জানতো? ঠিক যেদিনটাতে সে একজনকে অনুভব করবে বলে জেগে উঠেছে সেই একই দিনে আরেকজনের কী ব্যাকুল আবির্ভাব। একেবারে ভোর সকালে সবার আগে ঘুম ভেঙ্গেছিল তার। গোসল করে এসে টেবিলে মাথা রেখে মন্টির জন্যে অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে কল্যাণ কামনা করেছে সে। ততক্ষণে ফুটে বেরিয়েছে দিনের আলো। সে আলোর বাধ ভাঙ্গা বন্যা এসে জাগিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। পৃথিবীর আর কারো কথা মনে ছিল না তার।

ঠিক তখন, নটার ডাকে, আবুর চিঠি এসে হাজির। পড়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি সে। এ সব কী লিখেছে লোকটা? আবার যখন পড়েছে তখন বুক কেঁপে উঠেছে। এ যে প্রার্থনা! এ যে আমন্ত্রণ।

হাশেমের ছোট ভাই আবু, এই কথাটা জানত না বিলকিস। তরশু দিন কথাটা জেনে অবধি আবুর মুখ বারবার ভেসে উঠেছিল তার চোখে। হাশেম, সেই ছেলেটা বকুল আপা যাকে ভালবেসেও কাছে করতে পারেনি। কেন পারেনি, জানতো না বিলকিস। আজ যেন মনে। হচ্ছে, তার নিজেকে দিয়ে মনে হচ্ছে, সেও পারবে না আবুকে কাছে করতে কিন্তু কেন পারবে না তা আবু কোনদিনও জানবে না।

শিউরে উঠেছিল বিলকিস।

না, তাকে স্পষ্ট হতে হবে, কঠিন হতে হবে। বকুল নিজেকে অস্পষ্টতার আড়ালে রেখে, বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রেখে যে অন্যায় করেছে, আবুর বেলায় তা কিছুতেই হতে দেবে না বিলকিস।

আবুর সামনে বসে এতক্ষণ চুপ করে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। বিলকিস তাই শুধালো, কেমন আছেন, বলুন।

ভালো। আপনি?

আমিও।

এই কথাগুলো বলতে চায়নি ওরা। তবু বলতে হচ্ছে। আবু হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলল, ভালো আছি বললে মিথ্যে বলা হয়।

কেন?

একা যে।

কেন একা থাকেন?

কেন? যদি জানতাম, কষ্ট থাকত না।

আবু খুব জেদ করে কথা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাকে নির্বাপিত হতে হল যখন। বিলকিস বলল, এ সব কথা আমি বুঝতে পারি না। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে এমন করে সবাইকে ফিরে যেতে হতো না। তাছাড়া, আমি আর বুঝতে চাইও না।

আবুর তীব্র ইচ্ছে হলো চীৎকার করে বিলকিসকে জিজ্ঞেস করে, হাত গুটিয়ে রেখে কী আনন্দ হচ্ছে তার? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পাবে না। বদলে বিলকিসের কথাই শুনতে থাকে। তন্ময় হয়ে বিলকিস বলছে, আমার এখন পায়ে দড়ি। যাবার পথ নেই। দেবার উপায় নেই। বিশ্বাস করুন, কেউ ইচ্ছে করে ফিরিয়ে দেয় না। আপনি এখন তরুণ, কত বড় হতে হবে। আপনাকে, আপনি কেন এমন আবর্তে পড়ে ভুগে ভুগে মরবেন?

কক্ষনো না। কথাগুলো আসলে তিরস্কার। কিন্তু সেই তিরস্কারের জন্যেই আবুর ভালোবাসা যেন আরো প্রবল হয়ে উঠলো। মনে করেছিল, বিলকিস তাকে ফিরিয়ে দিলে প্রলয়কাণ্ড হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বাইরে রোদ আছে তেমনি। জানালা দিয়ে সকৌতুকে উঁকি দিচ্ছে ডালিম গাছ নিত্যকার মতো। বিদ্যুৎ ঘুরিয়ে চলেছে পাখা। তার হাত ঘড়িটাও চলছে। যতখানি কষ্ট হবে মনে হয়েছিল, তার এক কণাও নয়; এমন কি হৃদপিণ্ডটাও এতটুকু লাফিয়ে উঠল না। যেন প্রত্যাখ্যানের কথা তার আগে থেকেই জানা ছিল।

পায়ের পাতা দিয়ে মেঝের পরে নকশা কাটতে লাগল আবু। বলল, মরব কেন? জানেন, নিজেকে আমি সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসি। আমি কেন মরব?

বিলকিস বুঝতে পারল, এতো আবুর শক্তি নয়, শক্তির মুখোশে কান্না। বলল, এ কী অলুক্ষণে কথা আপনার! যাকে ভালবেসেছেন, তাকে সাক্ষী রেখে নিজে কষ্ট পাবার কোনো মানে হয়

আবু নিজেকে নিয়ে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে দেখে বিলকিস চুপ করে থাকে।

অবশেষে বলে, পাওয়াটাই কি সব? যা আপন করে দেখেছেন, তার জন্য তুচ্ছ স্বার্থটাকে বিলোতে পারলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবেন যে।

হঠাৎ করে ফেটে পড়ে আবু। আর্তনাদের মতো বলে, তাহলে আমি কী করব

হুহু করে ওঠে বিলকিসের অন্তর। বকুল আর হাশেমের কথা মনে পড়ে। লুসিয়েন আর অগাস্টাস এসে সচকিত করে দেয়। পৃথিবী জুড়ে মানুষের একী বন্ধন! বকুল তো পারল না তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সুখী হতে। ভেঙ্গে পড়েছে অগাস্টাস। আর মন্টি? মন্টি পাগলের মতো গলায় ক্ষুর দিতে চায়। ভয় দেখিয়ে লেখে, ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরবে। মন্টিকে আজ চিঠি লেখা দরকার। আবুর চোখে চোখ রেখে বিলকিস বলে, আমি জানি না। আমার অত থাকলে দুনিয়া শুষ্টু লোককে পথ বাতলে দিতাম। নিজেই পথ খুঁজে মরতাম না। যদি আপনার জন্যে মায়াই না থাকত, আজ দেখাও করতাম না।

আবু পাথর হয়ে বসে থাকে। এত সহজে সব কিছু এমন নির্ধারিত হয়ে যাবে কে জানত? বিলকিস বলল, জীবনে আঘাত পেলে কী ভাঙ্গতে আছে? আঘাতই বা কেন? যা পেলেন না তা আপনাকে শক্তি দিক, নইলে শান্তি পাবো না।

তখন বিলকিসের জন্যে মমতা হয় আবুর। না, সে কষ্ট পাবে না, দুঃখ করবে না, ভেঙ্গে পড়বে না। তাকে বড় হতে হবে। ইচ্ছে করে, কথাটা বলে।

কিন্তু সংকোচ হয়। বলতে পারে, আমাকে একটু পানি দেবেন? বড় তেষ্টা পেয়েছে। পানি আনতে গেল বিলকিস। সারাটা ঘরে সে এখন একা। সারাটা জীবন যেন তাকে একা থাকতে হবে।

পানি দিয়ে বিলকিস বলল, কী সব আমরা বকছি বলুন তো! আসুন, তার চেয়ে গল্প করি। তার কণ্ঠের সঙ্গীত কী অন্তরঙ্গ সুন্দর। আবুর মনটা এক নিমেষে পাখির মতো হালকা হয়ে গেল। সে বলল, একটা কথা, কিছু মনে করবেন না তো?

না, না।

আবু মহা উৎসাহে শুরু করল, অনেকদিন ধরে ভাবতাম আপনার কথা। আপনার গল্প বলুন না? আমি শুনবো।

বিলকিস আশ্চর্য হয়। একটু লজ্জিতও হয় যেন। বলে, আমার আবার গল্প কী?

আবু যেন বিরাট একটা আলোচনার সূত্র পেয়ে গেছে। বলে, সব মানুষেরই গল্প আছে, আপনি জানেন না বুঝি? মানুষ কত কীভাবে, কত হাজার হাজার দিন পার হয়ে আসে—- এর চেয়ে ভালো গল্প কেউ লেখে নি।

তখন বিলকিস খুব খুশি হয়ে উঠল। তার ভালো লাগল আবুর মুখোশহীন কথা বলার ঢং। বলল, আমার কথা কেন শুনতে চান?

আপনাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয় আমার। তাই শুনতে চাই।

আমি বললে আপনাকেও বলতে হবে।

আবু ইতস্তত করে একটু।

কী হলো?

বেশ বলবো।

বিলকিস হঠাৎ দেখে, আবু ম্লান হয়ে গেছে। দেখে ভয় করে তার। জিগ্যেস করে, কী ভাবছেন?

কিছু না।

বিলকিস তখন হাসল। বলল, আমাদের দুজনের অবস্থা একই রকম। বেশ তো, এত তাড়াহুড়ো কী? অন্য কোনদিন শোনা যাবে।

আচ্ছা।

আবু বুঝতে পারে না, তার ভেতরটা তবু এত অস্থির আর শূন্য লাগছে কেন! বিলকিস হঠাৎ জিগ্যেস করে, আপনার হাশেম ভাই কেমন আছেন?

চমকে উঠল আবু। মনে মনে হাশেম ভাইয়ের কথাই ভাবছিল সে, অথচ নিজেই ঠাহর করতে পারছিল না। বিলকিসের কথা শুনে কুয়াশা ছিঁড়ে গেল।

সে বলল, ভালো। ঠিকানাটা উনিই চেয়েছিলেন। আমি কিসসু বুঝতে পারছি না কেন?

ঠিক তখন ভেতর থেকে ডাক পড়ল বিলকিসের। বিলকিস যদিও আবুকে বলল, আপনি একটু বসুন; আবু উঠে দাঁড়াল।

না, থাক। অনেকক্ষণ কষ্ট দিয়েছি আপনাকে।

যাবেন? আচ্ছা।

বিলকিসের মুখ ছায়া হয়ে এলো।

আসুন। মাঝে মাঝে খবর নেবেন কেমন থাকি না থাকি।

আচ্ছা।

আবু বেরিয়ে আসে। হঠাৎ করে নিজেকে খালি খালি মনে হয়। আর যেন তার কোন কাজ নেই।

যেন তার জন্ম হয়নি, তার মৃত্যু হবে না; জীবন ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে কিন্তু তাকে স্পর্শ করবে না আর।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *