আমার দিন কাটছে
আমার দিন কাটছে।
কেমন কাটছে?
বলা মুশকিল। ইনোর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি, আমি সময় কাটাচ্ছি আমার নিজের ঘরে। কখনো বিছানায় শুয়ে থাকি, কখনো উঠে বসি, কখনো হাঁটাহাঁটি করি। কুৎসিত জীবন। মাঝে মাঝে অসহ্য বোধ হয়, ইচ্ছে করে পেঁচিয়ে বলি, দয়া করে আপনারা আমাকে মুক্তি দিন। আমি মানুষ। এ জাতীয় বন্দি জীবনে আমি অভ্যস্ত নই। ঠিক তখনি ঘরের আলো কমে আসে, আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিংবা চেতনা বিলুপ্ত হয়, কিংবা অন্য কোনো জগতে চলে যাই। আবার একই ঘরে এক সময় জেগে উঠি, শুরু হয় পুরনো রুটিন।
কখনো কখনো মনে হয় ঘূম এবং জাগরণের এই চক্র চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় না, দীর্ঘ সময় তো নয়, অল্প কিছু দিন মাত্ৰ পাইল।
কত দিন পার হল তা টের পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। সময়ের সঙ্গে হাত ও পায়ের নখ বড় হয়। চুল লম্বা হয়। চুল কতটুকু বড় হল, বা নখ। কতটুক বড় হল, সেখান থেকে অতি সহজেই সময়ের হিসাব করা যায়। আমি তা করতে পারছি না। কারণ আমার নখ বড় হচ্ছে না বা চুলও বাড়ছে না। এটা মোটামুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, যা আমার প্রথম দিকের সন্দেহকে দৃঢ় করে। শুরু থেকেই আমি ভাবছিলাম, আমার শরীর বলে কিছু নেই। চারপাশে যা ঘটছে তার সবটাই কল্পনা। তবে এই তথ্যেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ আমার ক্ষুধা বা তৃষ্ণার বোধ না থাকলেও শীতবোধ আছে যা থাকার কথা নয়। নাড়ি ধরলে টিক টিক শব্দ পাওয়া যায়, যার মানে শরীরে রক্তপ্রবাহ চলছে। তাইবা কী করে হয়। ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় কীভাবে? এটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি। কোনো কূল-কিনারা পাই না।
এক দিন বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় একটা বুদ্ধি এল। একটা আলপিন বুড়ো আঙুলে ঢুকিয়ে দিলেই তো হয়। দেখা যাক রক্ত বেরোয় কিনা। দিলাম আলপিন ফুটিয়ে। ব্যথা পেলাম, রক্ত বেরুল। আর তখন দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা মাথায় এল–শরীরে কোনো একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলে কেমন হয়? টেবিলের উপর একটা কাঁচি আছে। কাগজ-কাটা কাচি। অতি সহজেই সেই কাঁচি ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখ বন্ধ করে কাঁচির একটা মাথা পায়ের উরুতে বসিয়ে হাচকা টান দেয়া। কঠিন কোনো কাজ নয়, তবে অবশ্যই মনের জোর লাগবে। আমি দেখতে চাই। ক্ষত সৃষ্টি হবার পরপর এরা কী করে। আমার শরীর বলে যদি সত্যি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তবে এদের তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসতে হবে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগেরও একটা সুযোগ হতে পারে।
আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। কচি পাওয়া গেল না। যদিও অল্প কিছুক্ষণ আগেও কাঁচিটা ছিল। কিন্তু এখন নেই। কোথাও নেই। পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এরা আমাকে লক্ষ করছে। তবে এতে উল্লসিত হবার কিছু নেই। মানুষ যখন গিনিপিগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তখন সে গিনিপিগদের দিকে লক্ষ রাখে। খেয়াল রাখে যাতে এই গিনিপিগরা নিজেদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এরাও তাই করছে। এর বেশি কিছু নয়।
আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম চোখ বন্ধ করে কোনো একটা সুখের কল্পনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু তেমন কোনো সুখের কল্পনা মাথায় আসছে না। এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করেছি। এই রকম অবস্থায় ব্যাপারটা ঘটল। ওদের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হল। আগেও অবচেতন অবস্থায় ওদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে, আজকেরটা সে রকম নয়। এর মধ্যে কোনো রকম অস্পষ্টতা নেই। যোগাযোগের মাধ্যমে টেলিপ্যাথিক। কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা কী বলছে, তা বুঝতে পারছি। আমি কী বলছি, তাও ওরা বুঝতে পারছে।
কীভাবে কথাবার্তা শুরু হল, তার একটা বর্ণনা দিতে চেষ্টা করি : বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধন করামাত্র মাথার বাঁ পাশে মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্ৰণা হল। বমি ভাব হল, তা স্থায়ী হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা হালকা বোধ হতে লাগল। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে যে রকম লাগে সে রকম। তার পরপরই শুনলাম কিংবা মনে হল কেউ এক জন জিজ্ঞেস করছে, তুমি কেমন বোধ করছ? এই প্ৰশ্ন বিশেষ কোনো ভাষায় করা হল না। কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম ওরা জানতে চাচ্ছে আমি কেমন বোধ করছি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ হল। আমি বললাম, ভালোই বোধ করছি।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার প্রশ্ন হল। প্রশ্নের মধ্যে কোথায় যেন কিছুটা প্রশ্রয় এবং কৌতূক মেশান।
তোমরা এত সহজে এত অস্থির হও কেন?
আমার অবস্থাটা সহজ মনে করছেন কেন? অনিশ্চয়তা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।
তোমরা বড় হয়েছ অনিশ্চয়তায়, তোমাদের জীবন কেটেছে অনিশ্চয়তায়–তার পরেও অনিশ্চয়তাকে ভয়।
আপনারা কারা?
তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আগে এক বার দিয়েছি। আবারো দিচ্ছি–আমরা পরিব্রাজক।
বুঝতে পারলাম না।
আমাদের অনেক কিছুই বুঝতে পারবে না। বুঝতে চেষ্টা করে জটিলতা বাড়াবে। তা কি ভালো হবে?
বুঝতে পারব না কেন?
তোমরা তোমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনা করতে পার না। তোমরা যখন একটি দৈত্যের ছবি আঁক, সেগুদেখতে মানুষের মতো হয়। তোমাদের কল্পনা সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ কল্পনায় আমাদের বোঝা মুশকিল।
তবু চেষ্টা করব। পরিব্রাজক ব্যাপারটা কী?
যিনি ঘুরে বেড়ান, তিনিই পরিব্রাজক। আমরা ঘুরে বেড়াই। এক দিন যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখনো চলছি। চলতেই থাকব।
কোথায়?
জানি না।
যাত্রা শুরু হয়েছিল কবে?
তাও জানি না।
আপনি কি একা, না আপনারা অনেকে?
আমরা একই সঙ্গে একা এবং একই সঙ্গে অনেকে।
বুঝতে পারছি না।
আগেই তো বলেছি বুঝতে পারবে না।
আপনার কি জন্ম-মৃত্যু আছে?
মৃত্যু বলে তো কিছু নেই। পদার্থবিদ্যায় পড় নি, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই?
আপনি কি এক ধরনের শক্তি?
শুধু আমি কেন, তুমি নিজেও তো শক্তি।
আপনি বলছেন আপনি ভ্রমণ করেন। এতে কী লাভ হয়?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না। লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কেন?
সব কিছুরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী?
জ্ঞানলাভ। আমি শিখছি।
কেন শিখছেন?
বিশ্বব্ৰাহ্মাণ্ডকে জানবার জন্য।
এই জ্ঞান দিয়ে কী করবেন?
তুমি অদ্ভুত সব প্রশ্ন করছ।
এই জাতীয় প্রশ্ন কি আপনি নিজেকে কখনো করেন না।
না। আমি দেখি। কত অপূর্ব সব রহস্য এই অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে। বড় ভালো লাগে। এই যে তোমাদের দেখা পেয়েছি, কী বিপুল রহস্য তোমাদের মধ্যে!
কী রহস্য?
এখনো পুরোপুরি ধরতে পারি নি। আরো কিছু সময় লাগবে।
শেষ পর্যন্ত আমাদের দিয়ে কী করবেন?
তোমরা যা চাও তা-ই করব কী চাও তোমরা?
যা চাই তা-ই করতে পারবেন? কেন পারব না?
পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারবেন?
সে তো খুবই সহজ ব্যাপার।
আপনি সত্যি বলছেন?
তাই তো মনে হয়। তুমি কি পৃথিবীতে যেতে চাও?
হ্যাঁ।
এক জন তরুণী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, সেই কারণে?
হ্যাঁ।
অবিকল ঐ তরুণীটিকে যদি তৈরি করে দিই, তাহলে কেমন হয়?
কীভাবে তৈরি করবেন?
একটি সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে প্রয়োজন হয় একটি ডিএনএ এবং একটি আরএনএ অণু। তোমার ভালোবাসার মেয়েটির একগুচ্ছ চুল তোমার সঙ্গে ছিল। সেখান থেকেই তৈরি করে দেয়া যায়।
আমি খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলাম। কী অদ্ভুত সব কথা! এসব কি সত্যি সত্যি শুনছি না ঘঘারের মধ্যে কল্পনা করে নিচ্ছি? আবার কথা শোনা গেল, অবিকল তোমাদের সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র আশেপাশে আছে। তার কাছাকাছি তোমাদের পৃথিবীর মতো একটি গ্রহও আছে। সেখানে তোমরা নতুন জীবন শুরু করতে পার।
নতুন জীবন শুরু করবার আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি আমার পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে চাই।
তোমার বান্ধবীর কাছে।
হ্যাঁ, তা-ই।
আমার মনে হল আমি হাসির শব্দ শুনলাম। কিংবা হাসির কাছাকাছি কোনো প্রক্রিয়া ঘটল। ওরা যেন খুব মজা পাচ্ছে।
তুমি অন্যদের মতো নও। তোমার সঙ্গীরা কেউ পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে চাচ্ছে না।
সেটা তাদের ইচ্ছা। আমি যা চাই তা বললাম।
ওরা কী চায় তা জানতে চাও?
না। ওদের প্রসঙ্গে আমার কোনো কৌতূহল নেই।
কৌতূহল না থাকার কারণ কী?
এমনিতেই আমার কৌতূহল কম।
তুমি ঠিক বলছ না। তোমার কৌতূহল যথেষ্ট আছে। আমাদের সম্পর্কে তুমি একগাদা প্রশ্ন করেছ।
শুধু আমি একা নিশ্চয়ই না, আমার সঙ্গীরাও নিশ্চয়ই আপনাদের একগাদা প্রশ্ন করেছে।
না, করে নি। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হয় নি।
কেন হয় নি?
তা বুঝতে পারছি না। তোমরা যাকে ইএসপি ক্ষমতা বল, সেই ক্ষমতা তোমার যেমন আছে তোমার সঙ্গীদেরও তেমনি আছে। কিন্তু তারা তা ব্যবহার করতে পারছে না, অথচ তুমি পরিছ। এই রহস্য আমরা ভেদ করতে পারছি না।
আমাদের আর কোন কোন রহস্য আপনারা ভেদ করতে পারেন নি?
অনেক কিছুই পারি নি।
অনেক কিছু না পেরেও অবিকল আমাদের মতো প্রাণ সৃষ্টি করে ফেললেন!।
জীন থেকে প্রাণ সৃষ্টি তেমন জটিল কিছু নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার সহজ প্রয়োগ।
আমাদের কোন ব্যাপারটি আপনারা বুঝতে পারছেন না, বলুন। আমি আপনাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করব। তবে তার বদলে আপনারা আমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবেন।
আবার হাসির মতো শব্দ হল। ভুল বললাম, শব্দ নয়, আমার কেন জানি ধারণা হল ওরা হাসছে। খুব মজা পাচ্ছে শিশুদের ছেলেমানুষি অথচ ভারিকি ধরনের কথায় আমরা যেমন মজা পাই।
ভয় নেই, আমরা তোমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাব।
আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
আবার সেই সঙ্গে এখানেও রেখে দেব।
তা কী করে সম্ভব?
খুব কি অসম্ভব?
পদার্থবিদ্যার একটি সূত্র হচ্ছে একটি বস্তু একই সঙ্গে দুটি স্থান দখল করতে পারে না।
পদার্থবিদ্যার সূত্র বহাল রেখেও করা যাবে। যখন করব তখন বুঝবে। তবে এই সঙ্গে তোমাকে বলে রাখি, তোমাদের পদার্থবিদ্যার অনেক সূত্ৰই কিন্তু সত্যি নয়।
তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি পদার্থবিদ নই। পদার্থবিদ্যার সমস্ত সূত্র রসাতলে যাক, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
তুমি তোমার বান্ধবীর কাছে ফিরে যেতে পারলেই খুশি?
হ্যাঁ, তা-ই।
সে কি এক জন অসাধারণ মহিলা?
হ্যাঁ, অসাধারণ।
আমাদের কাছে তাকে কিন্তু খুব অসাধারণ কিছু মনে হল না।
তার মানে!
আমরা তোমার বান্ধবীকে তৈরি করেছি।
আমি চুপ করে রইলাম। না, আর অবাক হব না। কোননো কিছুতেই না।
তোমার বান্ধবী সমস্ত ব্যাপারটাকে স্বপ্ন বলে ধরে নিয়েছে। আমরা তাকে তোমার কাছে পৌছে দেব। তুমি ধীরে-সুস্থে তাকে সব বুঝিয়ে বল।
তোমরা যে নিকি তৈরি করেছ, সে পৃথিবীর নিকি নয়।
সে অবিকল পৃথিবীরই নিকি, তবে তাকে তৈরি করা হয়েছে।
তার মানে, এই মুহূর্তে দুজন নিকি আছে?
হ্যাঁ, দুজন আছে। প্রয়োজনে আরো অনেক বাড়ান যেতে পারে। কাজেই এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে একই বস্তু একই সঙ্গে দুটি স্থান দখল করতে পারে।
হ্যাঁ, পারে।
তুমি কি তোমার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আগ্রহ বোধ করছ না?
না, করছি না। কারণ সে নিকি নয়, রোবট শ্রেণীর কেউ।
খুব ভুল বললে। আমি ভুল বলি নি।
বিশ্রাম নাও, তুমি ক্লান্ত। বিশ্রামের পর যখন জেগে উঠবে, তোমার বান্ধবী থাকবে তোমার পাশে।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।