Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 7

অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay

নন্দলালবাবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর

নন্দলালবাবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘরে বসে বিমর্ষ মুখে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। ভুবনবাবু তাঁকে কবিতা লেখার আদেশ দিয়েছেন। বাবার হুকুম অমান্য কার সাধ্য এ বাড়ির কারও নেই, কিন্তু কথা হল, কবিতার সঙ্গে নন্দলালবাবুর কোনও সম্পর্কই নেই। ভুত-প্রেত, সাধন-ভজন, হোমিওপ্যাথি কবিরাজি ইত্যাদি হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু কবিতার লাইনে যে তিনি কিছুই জানেন না। কবিতা লিখতে হবে ভাবলেই তার হাত-পা শরীরের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইছে, ম্যালেরিয়ার মতো একটা কাঁপুনিও উঠছে আর মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে কী যেন নেমে যাচ্ছে। কবিতার চেয়ে বিজ্ঞান ঢের ভাল ছিল।

আরও ভয়ের কথা, ভুবনবাবুর কবিতা লিখতে শুরু করার আগেই সেই কবিতা কেনার জন্য কলকাতা থেকে দুই মূর্তিমান এসে হাজির হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, দু’লাইন কবিতা শুনে তারা দুশো টাকা আগাম দিয়েছে ভুবনবাবুকে। ফলে ভুবনবাবু রীতিমত খেপে উঠেছেন। খাওয়ার পর নন্দলাল সবে ঘরে এসে বিশ্রাম করার উদ্যোগ করছিলেন, এমন সময় ভুবনবাবু এসে ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়লেন।

“কাণ্ডখানা দেখেছ!”

“আজ্ঞে না, বাবা।”

“দুলাইন লিখতে-না-লিখতে দু-দুশো টাকা!”

“যে আজ্ঞে, এ তো খুব ভাল কথা!”

“ভাল কথা! শুধু ভাল কথা বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেই হবে? ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাইছে না কেন বলো তো! দু’লাইন লিখেই যদি দুশো টাকা হাতে আসে তা হলে হাজার-হাজার লাইন লিখলে কত আসতে থাকবে তার হিসেবটা মাথায় খেলছে না?”

নন্দলালবাবু মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে তা বটে।”

ভুবনবাবু অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, “ধরো, দিনে যদি তুমি এক হাজার লাইনও লিখে ফেলতে পারে তা হলে কত দাঁড়াচ্ছে?”

নন্দলালবাবু সতর্কভাবে একটু কেসে নিয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আমি কিন্তু শুনেছিলাম যে, ওঁরা দু’লাইনের জন্য দুশো টাকা হিসেবে দিচ্ছেন না। ওঁরা কবিতা পিছু দুশো টাকা দেবেন। তা সে কবিতা হাজার লাইনেরও হতে পারে।”

ভুবনবাবুও এবার মাথা চুলকোলেন। তারপর বিরস মুখে বললেন, “তাই তো! তা তাই বা মন্দ কী? ধরো, যদি আমরা ছোট-ছোট কবিতাই লিখি, পাঁচ-সাত লাইনের, আর দিনে যদি ওরকম গোটা কুড়ি-পঁচিশ লিখে ফেলা যায় তা হলে কত হচ্ছে?”

“আজ্ঞে, খারাপ নয়। কুড়িটা কবিতায় চার হাজার আর পঁচিশটা হলে পুরো পাঁচ!”

“আর তিনজনে মিলে যদি লিখি, বাড়ির মেয়েরাও যদি কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা করে লিখে ফেলতে পারে, বাচ্চারাও যদি একটু-আধটু শুরু করে দেয় তা হলে তো প্রতিদিনই আমাদের কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা করে রোজগার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”

“আজ্ঞে, অত কবিতা ছাপবার জায়গা হবে কি?”

“খুব হবে, খুব হবে। ওঁরা তো কবিতার জন্য মুখিয়ে বসে আছেন। ফেলো কড়ি, মাখো তেল।”

বিপন্ন মুখে নন্দলাল বলে ফেললেন, “কিন্তু আপনার মধ্যে যে প্রতিভা আছে তা কি আর আমাদের মধ্যে পাওয়া যাবে?”

ভুবনবাবু মৃদু হেসে বললেন, “সে অবশ্য ঠিক কথা। উনিও বলছিলেন বটে, আমার মধ্যে নাকি কবিতার সমুদ্র রয়েছে। তা তোমাদের মধ্যে সমুদ্র না থাক, পুকুর টুকুর তো থাকতে পারে। আর বসে বসে বাড়ির অন্ন ধ্বংস করার চেয়ে একটা কাজের মতো কাজ করা অনেক ভাল। আজ থেকেই লেগে পড়ো। কাল সকালের মধ্যে অন্তত পাঁচখানা কবিতা আমার হাতে জমা দেবে।”

“পাঁচখানা!” নন্দলালবাবুর চোখ কপালে উঠল।

“আপাতত পাঁচখানা। এর পর মাত্রা বাড়াতে হবে। দিনে কুড়ি-পঁচিশটা করে লিখে ফেলতে হবে। কবিতাই হবে আমাদের ফ্যমিলি বিজনেস।”

নন্দলাল আতঙ্কিত গলায় বললেন, “বিজনেস।”

হাতে হাত ঘষতে ঘষতে ভুবনবাবু আহ্লাদের গলায় বললেন, “কিছু ভেবো না। কবিতা লেখাটা প্রথমে আমারও শক্ত মনে হয়েছিল। কিন্তু হাত দিয়েই বুঝলুম, একেবারে সোজা কাজ। যা লিখি, তা-ই কবিতা হয়ে যাচ্ছে।”

“আপনার কথা আলাদা।”

“তোমার মধ্যেও যে কালিদাস লুকিয়ে নেই তা কী করে বুঝলে? হয়তো লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে থেকে হয়তো টুকি দিয়ে যাচ্ছে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না। সেই কালিদাসকে খুঁজে বের করো। তারপর সব ফরসা, জলবত্তরলং।”

“কালিদাস যদি না থাকে?”

“কালিদাস না থাকলে অন্য কেউ আছে। ঘাবড়াচ্ছ কেন? ব্যাটকে আগে খুঁজে বের করো, তারপর সে কে তা বোঝা যাবে।”

“যে আজ্ঞে।” বলে নন্দলাল চুপ করে গেলেন।

ভুবনবাবু চারদিকে চেয়ে ঘরখানা দেখে নাক সিটকে বললেন, “এটা ঠিক কবির ঘর বলে মনে হচ্ছে না। বড্ড ন্যাড়া-ন্যাড়া। ফুলদানিতে কিছু ফুল রাখলেও তো পারো। ওতে খানিকটা ভাব আসে। আর একখানা ইজিচেয়ার। একখানা গ্রামোফোন রাখলেও বেশ হয়। গান শুনলেও ভাব আসে। কিছু কবিতার বই বালিশের পাশে নিয়েই শোবে। খাতা কলম সব সময়ে রেডি রাখবে।”

“যে আজ্ঞে।”

“তা হলে ওই কথাই রইল। আজ থেকেই আদা-জল খেয়ে লেগে যাও। আলসেমিকে প্রশ্রয় দেবে না। টাইম ইজ মানি।”

ভুবনবাবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে চলে গেলেন। তাঁর দম ফেলার সময় নেই।

নন্দবাবু অতিশয় বেজার মুখে শুয়ে-শুয়ে নিজের ভাগ্যকে যখন ধিক্কার দিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে ভারি অমায়িক গলায় কে যেন বলে উঠল, “আসতে পারি?”

নন্দবাবু উঠে বসলেন, “আসুন।”

যে লোকটি ঘরে ঢুকল তার মাথাটি ন্যাড়া, মস্ত গোঁফ, গলায় কণ্ঠি, কপালে তিলক। তবে পরনের জামাকাপড় একটু বিপর্যস্ত।

নন্দবাবু বললেন, “কাকে চান?”

“আজ্ঞে, আপনিই তো নন্দবাবু?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আপনার নাম শুনেই এলাম। বলছিলাম কি, কবিতা লেখা অতি যাচ্ছেতাই কাজ।”

“সে তো বটেই।”

“কবিতা লেখা বেশ শক্তও বটে।”

“‘হাঁ।”

“কিন্তু আপনার তো কবিতা না লিখলেই নয়!”

“আপনি জানলেন কী করে?”

“সবাই বলাবলি করছে কিনা। তবে উপায় একটা আছে।”

নন্দলালবাবু টান হয়ে বসে বললেন, “কী উপায়?”

“আমি কবিতার সাপ্লায়ার।”

“তার মানে?”

“যত কবিতা চাই আমি আপনাকে দেব। ঘাবড়াবেন না।”

“বটে!’ নন্দবাবু যেন মরুভূমিতে মরূদ্যান দেখলেন।

“রেটও কম। কবিতা-পিছু একশো টাকা করে। আগাম পেলে বিকেলের মধ্যেই পাঁচখানা কবিতা হাতে পৌঁছে দেব।”

.

ন্যাড়া মাথা, গোঁফওয়ালা, কণ্ঠি ও তিলকধারী লোকটিকে মোটেই কবি বলে মনে হয় না। অথচ বলছে বিকেলের মধ্যেই পাঁচ-পাঁচখানা কবিতা দিয়ে দেবে। যদি তাই হয় তা হলে এও তো কবিতা লিখেই বড়লোক হয়ে যেতে পারে।

নন্দবাবু একটু সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কবিতা লেখা যখন আপনার কাছে এতই সহজ কাজ, তখন নিজের নামে ছাপান না কেন? তাতে টাকাও বেশি, নামটাও ছড়ায়।”

লোকটা ভারি লাজুক হাসি হেসে বলল, “কী যে বলেন! আমার নাম শুনলে ওঁরা আর আমার কবিতা ছোঁবেনও না।”

“কেন আপনার নামটা কি খারাপ?”

লোকটা জিভ কেটে বলল, “আজ্ঞে না। বাপ-পিতেমোর দেওয়া নাম, তার আবার খারাপ-ভাল কী? কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলেও ক্ষতি নেই। আসলে আমার একটু বদনাম আছে কি না।”

‘কী রকম বদনাম?”

একটু মাথা চুলকে নিয়ে লোকটা লাজুক হাসি হেসে বলল, “ঠিক বদনামও বলা যায় না মশাই। আসলে আমি কবিতা লিখলে অন্য সব কবির কবিতা কেউ আর পড়তে চায় না। পাঠকদের গোছা-গোছা চিঠি আসে, যদি এক সংখ্যায় আমি না লিখি। তাই সব কবি এককাট্টা হয়ে যুক্তি করে সম্পাদকদের ধরে পড়ল, ওর কবিতা ছাপা যদি বন্ধ না করেন তবে কুরুক্ষেত্তর হয়ে যাবে। সম্পাদকরা ভয় পেয়ে গেলেন। তারপর থেকেই বুঝলেন কি না- সম্পাদকরা আর আমার নাম অবধি শুনতে চান না।”

“আপনার নামটা কী?”

“সেটা না-ই বা শুনলেন। পৈতৃক নামটা আমি একরকম ভুলেই গেছি। ব্যবহার করি না কিনা।”

“তবু একটা নাম তো মানুষের দরকার।”

“আজ্ঞে, আমাকে হারাধন বলেই ডাকবেন।”

“বেশ তো। তো হারাধনবাবু, আপনার রেটটা কিন্তু বড্ড বেশি। কবিতা পিছু একশো টাকা করে দিলে আমার থাকবে কী বলুন!

লোকটা ফের লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকে বলল, “দুলালবাবু যে রেট কমালে ভারি রাগ করেন।”

নন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “দুলালবাবুটা আবার কে?”

লোকটা ভারি অপ্রস্তুত হয়ে জিভ কেটে বলল, “নামটা ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ওটা ধরবেন না।”

“কিন্তু দুলালবাবু নামটা যে চেনা-চেনা ঠেকছে।”

হারাধন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে ভারি কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আজ্ঞে ও নামে মেলা লোক আছে। এই দুলালবাবু হলেন যে দুলাল পালমশাই। কবিতা মহাজন।”

“তার মানে?”

“আজ্ঞে, তাঁর কাছেই কবিতা সব মজুত থাকে কিনা। তিনি হলেন কবিতার একেবারে পাইকার।”

নন্দবাবু যদিও ভারি সরল-সোজা মানুষ, বু একথাটা তাঁর প্রত্যয় হল না। কেমন যেন একটু ধন্দ লাগল তাঁর, সন্দেহ হতে লাগল। এবং হঠাৎ লোকটার মুখোনাও তাঁর চেনা-চেনা ঠেকতে লাগল। এ হারাধন-টারাধন নয়। অন্য লোক। আর তোক বিশেষ সুবিধেরও নয়।

নন্দলাল একগাল হেসে বললেন, “তাই বলো। দুলাল পালমশাইকে আমিও খুব চিনি। ওই তো কাঠগুদামের পশ্চিমধারে দোতলা বাড়ি, সঙ্গে একটা মস্ত ঘেরা জায়গাও আছে। কতবার তাঁর বাড়িতে গেছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *