Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay

নন্দবাবুর দিক চেয়ে রাখাল বলল

নন্দবাবুর দিক চেয়ে রাখাল বলল, “কী গো সন্নিসিঠাকুর, বলি আজও কি পেটে গামছা বেঁধে পড়ে থাকবে? আজ যে চমৎকার খাসির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। সঙ্গে ফুলকপির রোস্ট, আলুর চপ, চিংড়ির মালাইকারি আর কমলালেবুর পায়েস।”

নন্দবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেল, “তোমরা খাওগে। আমার খাওয়া ঘুচে গেছে।”

‘মা-ঠাকরোন তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, বলেছেন নন্দটাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আয়। উপোস থেকে থেকে ছেলেটা আমার আধখানা হয়ে গেল।”

নন্দবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আজ আমার একাদশী রাখালদা। বিরক্ত কোরো না।”

“আরে একাদশী তো সারা বছরই আছে। উপোস করতে চাইলে শুধু একাদশী কেন, অমাবস্যা, পূর্ণিমা অনেক পাবে। কিন্তু এমন খ্যাঁটখানা তো আর নিত্যি হবে না। আজ তিতলির জন্মদিন বলে কথা!”

নন্দবাবু শুকনো মুখে মাথা নাড়লেন, “ও হয় না, রাখালদা। লোভ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”

রাখাল তার পাকা চুলে ভর্তি মাথাটা নেড়ে বলল, “নাঃ, তোমার মাথাটাই দেখছি গেছে। এই বয়েসেই যদি তুমি এত কিছু ত্যাগ করে বসে থাকো, তবে বুড়ো বয়সে ত্যাগ করার যে আর কিছুই থাকবে না। আমাদের দেশে এক হতুকিবাবা ছিল। সব ছাড়তে ছাড়তে শেষে হকিতে এসে ঠেকেছিল। দিনান্তে একখানা হত্ত্বকি চিবিয়ে জল খেত। সারা দিনমানে আর কিছু নয়। তারপর একদিন বিশ্বনাথ দর্শন করতে গিয়ে সেই হকিও ছেড়ে দিল। পুঁকতে ধুকতে মরতে বসেছিল। তারপর এক ঘোড়েল লোক গিয়ে তার কানে কানে বলল, আরে, সব ছেড়েছ, কিন্তু কেক-বিস্কুট-পাউরুটি তো আর ছাড়োনি। ওগুলো খেয়ে প্রাণটা বাঁচাও। তা হকিবাবার তখন এতই খিদে যে, কথাটা লুফে নিল। কেক-বিস্কুট খেয়ে প্রাণটা বলি হকিবাবার। আমি তাই বলি, ওরকম দুর্দশা হওয়ার আগেই নিজেকে সামলাও।”

নন্দবাবু পাশ ফিরে শুয়ে বললেন, “তুমি এখন যাও রাখালদা। আমার সাঙ্গু ভেজানো আছে।”

রাখাল কটমট করে নন্দবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “ভাল জিনিসকে অবহেলা করলে কী হয় জানো? মা লক্ষ্মীর শাপ লাগে আত্মাকে কষ্ট দিতে নেই।”

নন্দবাবু একটু হেসে বললেন, “তুমি আত্মার তত্ত্বই জানো না। আত্মার কখনও খিদে পায় না আত্মার খাওয়া নেই, ঘুম নেই, তেষ্টা নেই।”

“বটে! তবে আত্মাটা আছে কী করে?”

“সেটাই তো রহস্য।”

“তবে থাকো তোমার রহস্য নিয়ে শুঁটকি মেরে।”

রাখাল রাগ করে চলে গেল।

রাখাল চলে যাওয়ার পর একা ঘরে নন্দবাবু চোখ বুজে প্রাণপণে মন থেকে বিরিয়ানি, চপ, রোস্ট ইত্যাদির চিন্তা তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

এমন সময় দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। নন্দবাবু চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন। ঘরে কেউ নেই।

নন্দবাবু আবার চোখ বুজলেন।

কে যেন বলে উঠল, “কাজটা খারাপ হল হে নন্দবাবু।”

নন্দবাবু ফের চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন। কেউ নেই।

হঠাৎ নন্দবাবু বুঝতে পারলেন, কথা বলছে আর কেউ নয়। তাঁর মন।

মন বলে উঠল, “কাজটা খুব বিবেচকের মতো করলে না হে নন্দলাল। আর একটু ভেবেচিন্তে দেখলে পারতে।”

নন্দবাবু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “বলিস কী রে মন? একাদশীতে বিরিয়ানি?”

“নন্দবাবু, তোমার সাধন-ভজন সবই ভস্মে ঘি ঢালা হল।”

“তার মানে কী রে মন?”

“বলছিলাম, যে-সাধক সাধন-ভজন করতে করতে ওপরে উঠে গেছে, তার কাছে আর কি খাদ্যাখাদ্য ভেদ থাকে? তার কাছে মুরগিও যা, গঙ্গাজলও তাই।”

“ওসব বলিসনি রে মন। তোর লোভ তোকে ওসব বলাচ্ছে।”

“আমি বলি কি নন্দবাবু, শাস্ত্রে একটা কথা আছে, তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। কথাটার মানে জানো?”

“খুব জানি। ত্যাগ করে ভোগ করো।”

“তবেই বোঝো, কেমন দামি কথা। যা ত্যাগ করবে, তা ভোগ করতে আর বাধা কিসে? ছেড়েই যখন দিয়েছ তখন আর খেতে বাধা কিসের?”

“ওরে লোভী মন, তুই আর আমাকে কুপথে নিস না, ত্যাগের জলে নিজেকে ধুয়ে নে। পরিচ্ছন্ন হ।”

“মেলা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো নন্দবাবু, ভাল রান্নাও একটা শিল্পকর্ম, বুঝলে? তাকে অবহেলা করলে শিল্পকেই অপমান করা হয়।”

“অনেক তো খেয়েছিস রে মন, আর কেন? এবার ওপরে ওঠ। ওপরে ওঠ।”

“তা উঠতে রাজি আছি। তবে দোতলা অবধি। তুমিও গা তোলো হে নন্দবাবু। রান্নাঘরটা একেবারে ম-ম করছে গন্ধে। ওই সাগুর গোলা যদি আজও তোমাকে গিলতে হয় তবে বরং ওর সঙ্গে একটু বিষ মিশিয়ে নাও। বৈরাগ্যের একেবারে চরম হয়ে যাবে।”

নন্দবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মন, তুই হচ্ছিস বিষাক্ত সাপের মতো। তোকে ঝাঁপিতে বন্ধ না করলে আর উপায় নেই।”

“বটে! আমাকে ঝাঁপিতে ভরবে? অত সোজা নয় হে নন্দবাবু। তোমার চেয়ে ঢের বড় বড় লায়েককে দেখেছি।”

নন্দবাবু এবার বেশ রেগে গিয়ে ধমক দিলেন, “চুপ কর বলছি। নইলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”

“খারাপ আর এর চেয়ে কী হবে হে নন্দবাবু? ওপরে সবাই বসে কোমরের কষি খুলে ভালমন্দ খাচ্ছে, আর তুমি একতলার ঘরে বসে সাগুদানা আর পাকা কলা গিলছ, এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে হে?”

নন্দবাবু বুঝলেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। খিদে বেশ চাগাড় দিচ্ছে। নন্দবাবু উঠে পড়লেন এবং সাগু মেখে খেতে বসে গেলেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় সাগু তাঁর গলা দিয়ে নামল না। দু-এক গ্লাস খাওয়ার পরই বিস্বাদে মন ভরে গেল। নন্দবাবু ঢকঢক করে পেট ভরে জল খেয়ে নিলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু মধ্যরাতে নন্দবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন, কে যেন কাঁদছে।

“কে কাঁদে?” বলে নন্দবাবু উঠে বসলেন।

কে যেন জবাব দিল, “তোমার পেট হে।”

নন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “পেট! পেট কেন কাঁদবে?”

“গরিব-দুঃখীরা কাঁদে কেন নন্দবাবু? গরিব বলেই তো কাঁদে। তোমার পেটটাকে যে তুমি গরিব করে রেখেছ, বেচারার যে কিছুই করার নেই। তাই কাঁদছে।”

নন্দবাবু নিজেও টের পেলেন, সত্যিই তাঁর দারুণ খিদে পেয়েছে, খিদেটা রাগী একটা হুলো বেড়ালের মতো তার পেটটাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালাফালা করে ফেলেছে।

মন একটু হেসে বলল, “ওঠো হে নন্দবাবু।”

“উঠে কী করব?”

“দোতলায় যাও নন্দবাবু। এখনও কিছু আছে বোধহয়।”

“ছিঃ মন, ওকথা বলতে নেই।”

“তোমার খিদে কিন্তু রেগে উঠছে নন্দবাবু। কাজটা ভাল হচ্ছে না। রাত এখন নিশুতি, কেউ টেরটিও পাবে না।”

নন্দবাবু বিরস মুখ করে বললেন, “তোর পেটে বড় জিলিপির প্যাঁচ রে মন।”

“নন্দবাবু, উপোস করে ধর্ম হয় না। খারাপই যদি হবে তবে বিরিয়ানি জিনিসটার সৃষ্টি হল কেন বলো? ওঠো নন্দবাবু, না উঠলে আমি তোমার সঙ্গে এমন ঝগড়া লাগাব যে, সাধন-ভজন চুলোয় যাবে।”

“উঠছি রে মন, উঠছি।”

নন্দবাবু উঠলেন, তারপর সিঁড়ি বেয়ে অনিচ্ছের সঙ্গে ওপরে উঠতে লাগলেন।

ওদিকে নিশুত রাতে ল্যাবরেটরির মধ্যে দুলালবাবুও চোখ মেলে চাইলেন।

চেয়ে তাঁর মনে হল, কী যেন একটা নেই।

কী নেই? দুলালবাবু উঠে বসে চারদিকে চাইলেন। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন।

দুলালবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, তাই তো! আমি লোক্টা কে? আমার নাম কী? আমি কোথায় ছিলাম? এখানেই বা এলাম কী করে?

এসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না।

দুলালবাবু উঠে চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। চারদিকে মেলা অকাজের জিনিস। শিলিং-এ গুচ্ছের গ্যাসবেলুন।

দুলালবাবুর হঠাৎ নজরে পড়ল, একটা বেঁটেমতো লোক অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটা টেবিলের তলায়।

দুলালবাবু গিয়ে লোকটাকে হঠাৎ জাপটে ধরলেন।

“এই, আমি কে?”

লোকটা ভড়কে গিয়ে ককিয়ে উঠল, “আজ্ঞে?”

“আমি কে, বল শিগগির।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটা বলা খুব শক্ত। আপনি যে কে তা আপনি ছাড়া আর কে জানবে বলুন। তবে আমি হচ্ছি গে পাঁচু মোদক।”

দুলালবাবু লোকটাকে আরও একটু কষে চেপে ধরে বললেন, “পাঁচু মোদক! নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে!”

লোকটা ককিয়ে উঠে বলল, “আজ্ঞে, অত জোরে ধরবেন না। আমার হাড়গোড় তেমন পোক্ত নয়। ভাঙলে আর এ বয়সে জোড়া লাগবে না।”

“নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে কেন বলো তো হে।”

এই বলে দুলালবাবু লোকটাকে ছেড়ে দিলেন। লোকটা অমনি ধুপ করে মেঝের ওপর বসে পড়ে কিছুক্ষণ ‘উঃ, আঃ করে নিয়ে বলল, “হাড়গোড় একেবারে নড়িয়ে দিয়েছেন মশাই। আপনার মতো গুণ্ডা প্রকৃতির লোক আমি জীবনে দেখিনি। লোহার ভীমও চূর্ণ হয়ে যায়।

দুলালবাবু আত্মবিস্মৃত হয়েছেন। পুরনো কথা তাঁর মনে নেই। তিনি যে নিতান্তই রোগা, দুর্বল এবং ভীরু প্রকৃতির মানুষ এটাও তিনি ভুলে বসে আছেন। লোকটার দিকে খনিকক্ষণ চেয়ে থেকে তিনি বললেন, “তোমার নামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। চমৎকার নাম। পাঁচু মোদক। আজ থেকে নামটা আমি নিলুম। তুমি অন্য নাম নাও।”

পাঁচু মোদক নিজের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তা নিতে পারেন, তবে পয়সা লাগবে।”

“তুমি কি নাম বিক্রি করো নাকি?”

“আগে কখনও করিনি, কেউ চায়ওনি। আজই প্রথম। বউনি বলে কথা। কম করেই দেবেন না হয়। পাঁচ টাকা।”

দামটা খুব বেশি বলে মনে হল না দুলালবাবুর। কিন্তু দরাদরি করার মজ্জাগত অভ্যাস যাবে কোথায়? তিনি একটু চিন্তিতভাবে বললেন, “পাঁচ টাকা! দরটা একটু বেশি হয়ে গেল না!”

পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “নামের তো একটা রেট আছে মশাই। পাঁচ অক্ষরের নাম, অক্ষরপ্রতি একটা করে টাকা এমন কি বেশি?”

দুলালবাবু কর গুনে দেখলেন, পাঁচু মোদক পাঁচ অক্ষরের নাম বটে। একেবারে জলের মতো সোজা হিসেব। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “তা বটে!”

পাঁচু সোৎসাহে বলল, “তার ওপর ভেবে দেখুন, আপনাকে বেচে দিচ্ছি বলে বাপের দেওয়া নামটা আমি তো আর ব্যবহারও করতে পারব না। সেই জ্ঞান বয়স থেকেই লোকে পাঁচু-পাঁচু বলে ডেকে আসছে। এখন থেকে তো আর পাঁচু নামে সাড়াও দেওয়া চলবে না। দুঃখের কথাটা একটু ভেবে দেখবেন তো।”

দুলালবাবুর চোখ ছলছল করতে লাগল। বললেন, “নামটা দিতে যদি তোমার কষ্ট হয় তা হলে বরং থাক আমি বরং অন্য কোনও নাম…”

পাঁচু জিভ কেটে তাড়াতাড়ি দুলালবাবুর পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, “কী যে বলেন আজ্ঞে, শুনলেও পাপ হয়। আমার নামটা যে আপনি নিলেন সেটাও আমার কম ভাগ্যি নাকি। আর দিয়ে যখন ফেলেছি তখন আর ফেরত নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”

দুলালবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। আসলে তাঁর এখন একটা নাম ভীষণ দরকার। নাম ছাড়া কি মানুষের চলে? তিনি গিয়ে তাঁর টিনের তোরঙ্গটি খুলে পাঁচটা টাকা বের করে পাঁচুর হাতে দিয়ে বললেন, “তা তুমি করোটরো কী?”

পাঁচু মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে কথাটা বলা কি উচিত হবে? কী করি তা শুনলে আপনি হয়তো খুশি হবেন না।”

“কেন বলো তো?”

পাঁচু বুঝে গেছে, লোকটা পাগল, বোকা আবার হাবা। তাই সে খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “কাজটা অবশ্য খুবই ভাল। লোকে ভাল চোখে না দেখলেও এ কাজে মোটা লাভ।”

“কী বলো তো?”

পাঁচু খুব লজ্জার সঙ্গে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, ওই চুরি আর কি।”

দুলালবাবু চুরি কথাটা খুব চেনেন। কিন্তু কী করলে চুরি করা হয়, তা তাঁর মনে পড়ল না। তাই তিনি পাঁচুর দিকে চেয়ে বললেন, “আমারও কিছু একটা করা দরকার। কাজ ছাড়া কি মানুষ থাকতে পারে? তা চুরি ব্যাপারটা কী আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও তো! আমিও লেগে পড়ি।”

পাঁচু জুলজুলে চোখে কিছুক্ষণ দুলালবাবুর দিকে চেয়ে থেকে ভাল করে লোকটাকে জরিপ করে নিল। বলল, “কাজটা কিছু শক্ত নয়। রেতের বেলা যে-কোনও বাড়িতে ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়বেন। তারপর সাড়াশব্দ না করে মালপত্র যা পাবেন সরাতে থাকবেন।”

দুলালবাবু সাগ্রহে বললেন, “তারপর?”

“তারপর আমার হাতে এনে দেবেন। আমি সেসব মালপত্র বেচে পয়সা এনে দেব আপনাকে। আর টাকা-পয়সা যদি সরাতে পারেন, তা হলে তো কথাই নেই। যা আসে তা-ই লক্ষ্মী।”

দুলালবাবুরও ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। তিনি খুশি হয়ে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, “বাঃ। এ তো খুব সোজা কাজ।”

“কাজ যেমন সোজা, তেমনি আমার মজাও আছে। গেরস্তর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে সময়টাও বেশ কেটে যায়। হাত-পায়ের দিবি ব্যায়াম হয়, বুদ্ধি খোলে, চোখ কান সব সজাগ হয়ে ওঠে, ভয়ডর সব কেটে যায়। চুরি করতে নামলে মানুষের মেলা উপকার হয় মশাই।”

দুলালবাবুর দেহ-মন চনচন করছিল, তিনি একেবারে টগবগ করতে লাগলেন উৎসাহে। বললেন, “তা হলে কখন কাজে নামব?”

“শুভস্য শীঘ্রম। এখন তো মোটে রাত দেড়টা কি দুটো। এখনই নেমে পড়লে হয়।”

দুলালবাবু ল্যাবরেটরিটার চারদিক চেয়ে দেখে নিয়ে বললেন, “এখান থেকে কিছু সরানো যায় না?”

পাঁচু ঠোঁট উলটে বলল, “এরকম সব বিটকেল জিনিস জন্মে দেখিনি বাবা। এসব অকাজের জিনিস কে-ই বা কিনবে? এ-জিনিস আমাদের লাইনের জিনিস নয় পাঁচুবাবু।”

পাঁচুবাবু সম্বোধন শুনে দুলালবাবু ভারি খুশি হয়ে বললেন, “তা হলে কী করা যায়?

পাঁচু একটু খাটো গলায় বলল, “এ বাড়িতে মেলা জিনিস। যদি কৌশল করে একবার ঢুকতে পারেন তো একেবারে পাথরে পাঁচ কিল।”

দুলালবাবু পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মতো পায়চারি করতে করতে বললেন, “নিশ্চয়ই পারব। পারব না মানে? পারতেই হবে। কিন্তু আমার এখন ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

একগাল হেসে পাঁচু বলল, “আজ্ঞে আমাদের তো খিদে পেয়েই আছে। যখন তখন পায়। তো তার জন্যে চিন্তা নেই। বাবুদের বাড়িতে আজ ভাল রান্নাবান্না হয়েছে। তার কিছু এখনও আছে বোধহয়। গিয়ে ঢুকে পড়ুন না আজ্ঞে।”

দুলালবাবু রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, “তুমিও সঙ্গে চলো। তা ইয়ে তোমাকে এখন থেকে কী নামে ডাকব বলো তো! নাম কিনতে গেলে তো মুশকিল।

মাঝরাতে তো আর কেউ নাম বেচবার জন্য বসে নেই। তবে আমার ঠাকুর্দার নাম ছিল নরহরি। আপনি আমাকে বরং নরহরি বলেই ডাকবেন।”

দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তাই হবে। তা হলে এখন কাজ শুরু করা যাক।”

“যে আজ্ঞে।”

দুলালবাবু ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন। পেছনে একটু তফাতে পাঁচু। আনন্দে দুলালবাবু শিস দিতে লাগলেন।

পাঁচু পিছন থেকে সতর্ক গলায় বলল, “আজ্ঞে শব্দ-টব্দ করবেন না। চুরিতে শব্দ করা বারণ কিনা।”

“ঠিক আছে নরহরি। মনে থাকবে।”

দু’জনে মিলে প্রকাণ্ড বাড়িটার চারদিক ঘুরে দেখে নেওয়ার পর দুলালবাবু বললেন, “এবার ঢুকি?”

“কীভাবে ঢুকবেন?”

“কেন, দরজা ভেঙে।”

পাঁচু জিভ কেটে বলল, “ওরকম হুটোপাটি করবেন না। এসব কাজে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। আর বুদ্ধি খাটাতে হয়।”

পাঁচু তার ঝোলা থেকে একটা যন্ত্র বের করে একটা জানালায় খুটখাট করে কী একটু করল। তারপর পাল্লাটা অনায়াসে খুলে গোটা দুই শিক কেটে ফেলল। বলল, “যান এবার ঢুকে পড়ুন।”

“আর তুমি?”

“আজ্ঞে আমি ওই আমগাছটার তলায় বসে বরং একটু জিরোই। বড্ড ধকল গেছে মশাই। আপনাকে দেখতে রোগাপাতলা বটে, কিন্তু গায়ে মশাই পাগলা হাতির জোর। যা জাপটে ধরেছিলেন, গা-গতরে ব্যথা হয়ে আছে।”

‘বটে?”

পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “শুনেছি পাগলদের গায়ে খুব জোর হয়।”

“আমি কি পাগল নরহরি?”

“তা একটু পাগল তো সবাই। উনিশ-বিশ, ও নিয়ে ভাববেন না। দুনিয়ায় যত ভাল-ভাল কাজ তো পাগলেরাই করেছে কিনা।”

দুলালবাবু এ কথাতেও খুশি হয়ে বললেন, “তা হলে পাগল হওয়াটা খারাপ নয়!”

“আজ্ঞে না। আপনার ভিতরে ঢোকার রাস্তা করে দিয়েছি। ঢুকে পড়ুন।”

দুলালবাবু বেড়ালের মতো লাফ মেরে জানালায় উঠে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। চুরির চেয়ে সোজা কাজ পৃথিবীতে কিছু আছে বলে তাঁর মনে হল না। তিনি ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। প্রথমেই চোখে পড়ল, দেওয়ালের সঙ্গে দাঁড় করানো একগাছ ঝাঁটা।

“পেয়েছি!” বলে দুলালবাবু গিয়ে বিজয়-গর্বে ঝাঁটাগাছ তুলে নিয়ে জানলার কাছে ছুটে এসে উত্তেজিত গলায় ডাকলেন, “নরহরি।”

নরহরি ছায়ার মতো এগিয়ে এসে বলল, “চেঁচাবেন না পাঁচুবাবু। একদম স্পিকটি নট। কিছু পেলেন?”

“এই যে।” দুলালবাবু ঝাঁটাগাছটা এগিয়ে দিলেন।

পাঁচু চাপা গলায় বলল, “পেতল-কাঁসা দেখুন। ঝাঁটা দিয়ে কোন কচু হবে?”

দুলালবাবু মাথা নেড়ে ফের চারদিকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু খিদের চোটে পেটে এমন ছুঁই ছুঁই করছে যে, দুলালবাবু আর থাকতে পারলেন না। এ-ঘর ও ঘর ঘুরে খাবার খুঁজলেন খানিক। তারপর সামনে সিঁড়ি দেখে দোতলায় উঠলেন।

হঠাৎ তাঁর নাকে বেশ ভাল-ভাল খাবারের গন্ধ আসতে লাগল। গন্ধ অনুসরণ করে তিনি একটা ঘরে এসে ঢুকলেন। তারপর আলো জ্বাললেন। খুঁজতে খুঁজতে একটা জালের আলমারির মধ্যে বাটিতে ঢাকা মেলা খাবার দেখে তাঁর চোখ চকচক করতে লাগল। দুলালবাবু তিন-চারটে বাটি বের করে নিলেন। তারপর চেয়ার-টেবিলে বসে মহানন্দে খেতে শুরু করে দিলেন।

হঠাৎ দরজার কাছে একটা শব্দ হল। দুলালবাবু তাকিয়ে দেখলেন, একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

দুলালবাবু লোকটাকে গ্রাহ্য না করে খেয়ে যেতে লাগলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress