অদলবদল
রোজ ভোরবেলা পার্কে কিছুক্ষণ বেড়ানো হরিপদবাবুর অনেককালের অভ্যাস। ৫ম পার্কটা বেশ বড়। কিন্তু হাঁটাচলার পর একটুখানি যে বসবেন কোথাও, তার উপায় নেই। এখানে-ওখানে যত বেঞ্চ আছে, কখন সবগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। ঘাসে বসারও বিপদ আছে। ছেলেপুলেদের যা পাঁয়তারা, কে কখন ঘাড়ে এসে পড়ে তার ঠিক নেই। তার চেয়ে বড় বিপদ ওদের ফুটবল। যেন কামানের গোলা।
তিতিবিরক্ত হরিপদ অগত্যা নিরিবিলি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বকুল গাছটার দিকে যান। বকুলতলায় এক টুকরো কালো পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, কখন পাথরটাও দখল হয়ে গেছে। হোঁতকা-মোটা, মাথায় টাক আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চ্যাপ্টা নাক, কুতকুতে চোখ নিয়ে একটা লোক আরামে বসে আছে।
যেদিনই যান, দেখেন তাঁর যাওয়ার আগে কখন লোকটা বকুলতলার আসনটা দখল করে ফেলেছে।
জায়গাটা যে এমন কিছু সুন্দর তাও নয়। একটু নিরিবিলি এই যা। ওদিকটায় বলের ঘা খাওয়া রিস্কও নেই। তবে ওখানে বসে আর কিছু না থোক, রেলগাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। রেলগাড়ি দেখতে ভালোই লাগে হরিপদবাবুর। মনে-মনে কঁহা কাহা মুল্লুক চলে যাওয়া যায়। কু-ঝিক-ঝিক…কু-ঝিক-ঝিক! কখনও রেলগাড়ির চাকা ছড়া বলে, টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিট বাবুর কত টাকা! ছেলেবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়।
শেষে জেদ চড়ে গেল হরিপদবাবুর। আগেভাগে গিয়ে পার্কের বকুলতলার পাথুরে আসনটা তাঁর দখল করা চাই-ই। সেদিন ভোরের আগে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিকঠিক চারটে। আবছা আঁধার লেগে আছে ঘরবাড়ির গায়ে। পার্কে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে। রাস্তায় কদাচিৎ চাপা গরগর শব্দে চলে যাচ্ছে একটা করে মোটরগাড়ি–তখনও হেডলাইট জ্বলছে। হরিপদবাবু পার্কে ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। বকুলতলা ঝুপসি হয়ে আছে আঁধারে– কুয়াশায়। ঘাসে শিশির চকচক করছে। পাথরটা খালি পড়ে আছে। হরিপদবাবু সিংহাসন দখল করার আনন্দে বসে পড়লেন তার ওপর। পাথরটা ঠান্ডা বটে, তাতে কিছু আসে যায় না। হরিপদবাবু খুশিতে বসে দুই পা দোলাতে থাকলেন। এমনকী গুনগুন করে গানও গাইতে লাগলেন।
আস্তে আস্তে কালচে রং ধূসর হতে থাকল। তারপর সাদা হল। একজন-দুজন করে লোক এসে পার্কে ভিড় করল। কেউ ধুকুরপুকুর দৌড়চ্ছে। কেউ যোগব্যায়ামেও বসে গেছে। কেউ কুকুর নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেঞ্চগুলোতে বুড়োরা এসে বসে পড়েছে। তারপর ছেলেপুলেদের পায়তারা শুরু হয়েছে ফুটবল নিয়ে। হরিপদ বাবু তেমনি নিরিবিলি বকুলতলায় গুনগুন করছেন আর ঠ্যাং দোলাচ্ছেন।
কতক্ষণ পরে আনমনে মাথায় হাত বুলোতে গিয়েই চমকে উঠলেন। এ কী! তার মাথাভর্তি একরাশ পাকা চুল ছিল। চুল কোথায় গেল?
বারবার হাত ঘষেও চুলের পাত্ত পেলেন না। চামড়ায় হাত ঠেকছে। তার মানে, হঠাৎ তার মাথায় টাক পড়ে গেল নাকি অবাক হয়ে মাথায় আঙুল ঠুকলেন। আরও চমকে গেলেন। সর্বনাশ! তার মাথাভর্তি টাক যে!
তারপর হাত গালে ঘষে ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিদিন দাড়ি কাটা অভ্যাস। পার্ক থেকে ফিরেই দাড়ি কাটেন। কালও কেটেছেন। চব্বিশ ঘণ্টায় এত দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল গজানো অসম্ভব। অথচ গজিয়েছে।
প্রচণ্ড আঁতকে উঠে হরিপদবাবু টের পেলেন, তাঁর গায়ের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি আঁটো হয়ে গেছে। চটিজুতোয় পা দুটো আর ঢুকছে না। এ তো ভারি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! আঙুল ফুলে কলাগাছ ব্যাপার কি একেই বলে?
হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছেন হরিপদবাবু। এমন সময় লাঠি ঠুকঠুক করে এক ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন,–ভোম্বলবাবু যে! আছেন কেমন? বহুদিন তো দেখাশোনাও নেই। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?
হরিপদবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন,–ভোম্বলবাবু কে মশাই? আমি হরিপদ তালুকদার।
ভদ্রলোক খিকখিক করে হাসলেন–চিরকাল থিয়েটারে অ্যাকটিং করে অভ্যাসটা এখনও ছাড়েননি দেখছি ডোম্বলবাবু! তা ইয়ে, আপনার জামাইবাবাজির খবর কী? শুনেছিলুম, পুলিশে নাকি…
হরিপদ তেড়ে উঠে বললেন,–কী যা তা বলছেন মশাই? আমার মেয়েই নেই তো জামাই।
আহা, ওতে লজ্জার কী আছে ডোম্বলবাবু?–ভদ্রলোক বললেন। পুলিশ কাউকে ধরলেই তো সে চোর হয়ে যায় না। আদালত আছে কী করতে?
হরিপদবাবু আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। তার জামাই নেই। যদি দৈবাৎ থাকতও, তাকে চুরির দায়ে পুলিশ ধরত-ভাবতেও মাথায় খুন চড়ে যায়। কথা না বাড়িয়ে তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে কেটে পড়লেন। ভদ্রলোক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
পার্ক থেকে বেরুবার মুখে আরেক ভদ্রলোক তাকে দেখে বলে উঠলেন, আরে ভোম্বলদা যে!
হরিপদবাবু কটমট করে তাকিয়ে জোরে হাঁটতে থাকলেন। পেছনে ভদ্রলোক তখন বলছেন,–হল কী ভোম্বলদা? আরে শোনো শোনো!
কোনদিকে না তাকিয়ে হরিপদবাবু গলিরাস্তায় পৌঁছলেন। তারপর নিজের বাড়ির দরজায় কলিংবেলের বোতাম টিপলেন। ততক্ষণে আরও টের পেয়েছেন, তাঁর গায়ে প্রচণ্ড জোরও এসে গেছে। কিন্তু বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। একটা দারুণ গণ্ডগোল নিশ্চয় ঘটে গেছে।
দরজা খুলে তার প্রিয় চাকর কাম-রাঁধুনি হরু গম্ভীরমুখে বলল, কাকে চাই?
হরিপদবাবু গর্জে উঠলেন এবার, কাকে চাই কী রে ব্যাটাচ্ছেলে? ভাঙ খেয়েছ সাতসকালে? তারপর হারুকে ঠেলে ঘরে ঢুকে গেলেন।
হারু হই-চই করে উঠল, আচ্ছা ভদ্রলোক তো মশাই আপনি! গায়ের জোরে পরের বাড়ি ঢুকে পড়লেন যে বড়? আরে! ও কী! কোথায় যাচ্ছেন?
হরিপদ সটান নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আঁতকে দেখলেন, রোজ পার্কের বকুলতলায় পাথরটার ওপর যে লোকটাকে বসে থাকতে দেখেছেন সেই লোকটাই বটে। হরিপদবাবু তার শরীটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু তার নিজের শরীরটা কোথায় গেল, সেটাই সমস্যা। আর ছ্যা ছ্যা, এমন বিচ্ছিরি নাক থাকতে আছে মানুষের।
হরু ততক্ষণে পাড়া মাথায় করে চেঁচাচ্ছে,–ডাকাত ডাকাত পড়েছে! এমন জোর করে শোওয়ার ঘরে ঢোকে যে, সে নিশ্চয় ডাকাত। হরিপদবাবু আয়নার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। পার্কে বেড়াতে গেলেন হরিপদবাবু হয়ে, ফিরে এলেন কোন হতচ্ছাড়া ডোম্বলবাবুটি হয়ে যিনি নাকি একসময় থিয়েটারে অ্যাকটিং করতেন এবং যাঁর জামাই লোকটা চোর না হয়ে যায় না! এ কী সর্বনেশে কাণ্ড রে বাবা!
কিন্তু তার চেয়ে সর্বনেশে কাণ্ড যে ঘটতে চলেছে, ঠাহর হল পাড়ায় লোকের হট্টগোলে। বাড়ির দরজায় ওরা চেষ্টাচ্ছে, কই ডাকাত? কোথায় ডাকাত? ধর ব্যাটাকে! মারমার! কেউ বলছে,-যাসনে, যাসনে! ভোজালি আছে। পুলিশ ডাক! তার মধ্যে হরু এন্তার চেঁচাচ্ছে, সব লুঠ হয়ে গেল যে! ওরে বাবা! এতক্ষণে সব লুঠ করে ফেললে রে!
সাহসী ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়ি ঢুকছে টের পেয়েই হরিপদবাবুর বুদ্ধি খুলে গেল। দড়াম করে দরজায় খিল এঁটে দিলেন। দরজার বাইরে ছেলেগুলো হল্লা করছে। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। হরিপদবাবু ভেতর থেকে শাসিয়ে বললেন, সাবধান! আমার কাছে বোমা আছে। উড়িয়ে দেব!
ছেলেগুলো ভয় পেয়ে গেল। বয়স্করা বললেন,–ওরে! সরে আয়! সরে আয়! পুলিশে খবর গেছে।
পুলিশের কথা শুনে হরিপদবাবুর বুকের ভেতর কাঁপুনি বেড়ে গেল। তখন ঘরের ভেতর থেকে করুণ স্বরে ডাকলেন, হরু! ওরে বাবা হারাধন! আমি তোর মনিব হরিপদ তালুকদার। সত্যি বলছি!
হরু বলল,–চালাকি হচ্ছে? আমার মনিবকে আমি চিনিনে? ওইরকম চেহারা নাকি ওনার? ওইরকম হেঁড়ে গলা নাকি? ছা-ছ্যা, যেন নিমতলার আস্ত পিচেশ!
গণ্ডগোল একটু থেমেছে। সবাই পুলিশের প্রতীক্ষা করছে। হরিপদবাবুর গলা আবার শোনা গেল ভেতর থেকে,–সত্যি বলছি আমি হরিপদ তালুকদার। দোহাই তোমাদের, এখন পুলিশ-টুলিশ ডেকো না! ও বাবা হারাধন! ওদের বুঝিয়ে বল না একটু। আমিই তোর কর্তাবাবু রে!
হারু তেড়েমেড়ে বলল, বলবটা কী মশাই! হরিপদবাবুর বাড়ি সেই এতটুকুন বাচ্চা বয়েস থেকে কাজ করছি। আমি কর্তাবাবুকে চিনিনে? থামুন, দারোগাবাবুকে আসতে দিন।
বলতে বলতে এসে গেলেন দারোগাবাবু। পেল্লায় গোঁফের ডগায় পাক খাইয়ে বললেন, কই? কোথায় ডাকাত?
সবাই একগলায় বলে উঠল,–ওই ঘরের ভেতর স্যার!
দাবোগাবাবু হাঁক মেরে বললেন,-গিরধর সিং! দরওয়াজা তোড়ো! জলদি তোড়!
শুনেই হরিপদবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে যাচ্ছেন, টাকে খাটের একটা ধার জোরে লাগল। উঃ করে ককিয়ে উঠলেন।
তারপর দেখলেন, প্রচণ্ড অবাক হয়েই দেখলেন, পড়ে গেছেন শিশিরভেজা ঘাসে এবং বকুলতলার সেই পাথরটাতে ঠোক্কর লেগেছে মাথায়। বেশ জোরেই লেগেছে।
এই সময় কেউ বলে উঠল, আহা! লাগল নাকি।
তাকিয়ে দেখে অবাক হরিপদ তালুকদার। সেই টাকওয়ালা লোকটা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল–রোজ যে এই পাথরের আসনটা দখল করে বসে থাকে এবং যে কিছুক্ষণ আগে তাকে সর্বনাশের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
লোকটা হাসতে-হাসতে বলল,–ওখানে বসলেই কিন্তু ঘুম পায়। বুঝলেন?
হরিপদবাবু মনে-মনে বললেন, বুঝেছি। তার মানে পাথরটা দখল করার জন্য রাত চারটেয় শেষ ঘুম বরবাদ করার শাস্তিটা ভালোই পেয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–মশায়ের নাম কি ডোম্বলবাবু?
–আজ্ঞে না। আমার নাম হরিপদ চাকলাদার।
শুনেই হরিপদবাবু হনহন করে কেটে পড়লেন। আর কক্ষনো এ ভুতুড়ে পার্কে এত ভোরে বেড়াতে আসবেন না। বাড়ির কাছাকাছি হতে হঠাৎ মনে হল, নামটা কী হরিপদ চাকলাদার বলল, না তালুকদার বলল? চাকলাদার না তালুকদার? তালুকদার না চাকলাদার?
তালুকদার হলে বেটাচ্ছেলে আমার মতোই বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে হরিপদ শেষে খিকখিক করে হেসে উঠলেন।