Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অঞ্জলি || Sanjib Chattopadhyay

অঞ্জলি || Sanjib Chattopadhyay

অঞ্জলি

স্নান করে ঠাকুরঘরে ঢুকেই প্রভাত অবাক হয়ে গেল। গত পাঁচ বছরে এরকম ব্যতিক্রম তার কখনও চোখে পড়েনি। পুজোর সব আয়োজন ঠিক রয়েছে কিন্তু ফুল কোথায়? ফুলের থালা গঙ্গাজলের ঘটির ওপরে বসানো, কিন্তু থালা শূন্য। এক থালা ভর্তি লাল আর সাদা ফুল—সেই পরিচিত পবিত্র দৃশ্য আজ অনুপস্থিত! এই সময়টা তার খুব তাড়া থাকে। ৮টা পঞ্চান্নর ট্রেন ধরে তাকে কলকাতায় ছুটতে হবে। দশটায় অফিস। এক মিনিট এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। অথচ অফিস বেরোবার আগে কুলদেবতার পুজো করতেই হবে। ঠাকুরঘর থেকে গলা বাড়িয়ে প্রভাত চিৎকার করতে লাগল—কল্যাণী, আমার পুজোর ফুল কই? কী যে করো বুঝি না। একে দেরি হয়ে যাচ্ছে! কল্যাণী আঁচলে রান্নার হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এল। কী হয়েছে কী, চেঁচাচ্ছ কেন? ফুল নেই?

থাকলে চেঁচাই, নেই বলেই তো চেঁচাচ্ছি।

সে কী, পুতুল সেই সাতসকালেই ফুল তুলতে গেল! এখন বাজে ক’টা?

ক’টা আর সাড়ে সাতটা হবে, রেডিয়োয় খবর হচ্ছে।

সে কী গো, মেয়ে তো সেই ছয়টায় বাগানে গেল ফুল তুলতে। কোনওদিন তো এত দেরি করে না! দাঁড়াও দেখছি কী হল!

দেখতে দেখতেই বাজিমাত। বিনা ফুলেই পুজো করি। প্রভাত খুঁতখুঁত করতে করতে পুজোর আসনে বসল। কল্যাণী তাড়াতাড়ি মেয়েকে খুঁজতে গেল। উনুনে ভাত ফুটছে। একটু পরেই প্রভাত খেতে বসবে। তার আবার সাত্বিক ব্যাপার। নিরামিষ ভাতে ভাত খাওয়াই তার অভ্যাস। কোনওদিন একটু ঘি থাকে, কোনওদিন থাকে না। খাওয়ার ব্যাপারে প্রভাতের কোনও দৃকপাত নেই। কিন্তু পুজোর আয়োজনে সামান্য ত্রুটিও তার সহ্য হয় না।

আজ দশ বছর কি তারও বেশি হবে, পনেরো বছরও হতে পারে, কল্যাণীর ঠিক মনে পড়ছে না

তাদের বিয়ে হয়েছে। সুখের সংসারই বলা চলে। কোনও ঝামেলা নেই, নিঝঞ্চাট। একটি মাত্র মেয়ে বারো-তেরো বছর বয়স। ফুটফুটে সুন্দর। প্রভাতের বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। জোর করে ধরে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় দু-ভাই সন্ন্যাসী। পরিবারে অন্তত এই ভাইও যদি বিয়ে না করে বংশরক্ষা হয় কী করে?

এঘর-ওঘর পড়ার ঘর, সব ঘর খুঁজে দেখল কল্যাণী। না, সারা ঘরবাড়ির কোথাও পুতুল নেই। কী হল মেয়েটার? সেই সাতসকালে বাড়ির পিছনের বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিল। রোজই সে যায়। ফুল তোলা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। ফুল তোলার মতো বয়স তার হয়েছে। সকাল থেকে কল্যাণীকে এত ব্যস্ত থাকতে হয়—চা, জলখাবার, খাবার! পুতুল তাই ইদানীং মাকে ফুল তোলার কাজ থেকে ছুটি দিয়ে নিজেই সে কাজ করে। তার ভালো লাগে। ভোরের পাখি গাছে গাছে। ফুলে ফুলে চারিদিক সাদা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের সকাল যেন এক অসাধারণ কিছু। ঠিক রোদ উঠার আগের মুহূর্তে, পৃথিবী আর আকাশের মাঝখানে একটা হালকা কুয়াশার চাদর কাঁপতে থাকে। ফুল তোলার ফাঁকে ফাঁকে সে একটু আকাশ দেখে নেয়। কখনও নাম না-জানা কোনও পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে।

বাড়িতে যখন কোথাও মেয়েকে পাওয়া গেল না, তখন কল্যাণী পিছনের দিকে দরজা খুলে বাগানে চলে গেল। একবার মনে হল উনুনে ভাত ফুটছে, বোধহয় বেশি সিদ্ধ হয়ে গেল। প্রভাত আবার গলা ভাত খেতে পারে না। তারপর ভাবল একদিন না হয় খাবে, আগে দেখি মেয়েটা। কোথায় গেল। কল্যাণী ভেবেছিল বাগানের কোথাও হয়তো দেখবে গাছের তলায় কি পুকুরঘাটে বসে আছে চুপ করে, কি ঘুমিয়েই পড়েছে হয়তো কিংবা কোনও বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মত্ত।

খুব একটা বড় বাগান নয়। এ-কোণ ও-কোণ ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগল না। না, কেউ কোথাও নেই। পুকুরঘাটেও কেউ নেই! টলটলে জলের ওপর গাছের ছায়া দুলছে। পোষা মাছটা ঘাটের ধারে এসেছে খাবার আশায়। এসব দেখার সময় কল্যাণীর নেই। এইবার সে খুব ভাবনায় পড়ল। কোথায় গেল মেয়েটা? কখনও না বলে বাড়ির বাইরে যায় না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে উনুন থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রাখল—ফ্যান গালার কথা তার মনেই রইল না। হাত দুটো কোনওরকমে আঁচলে মুছেই ঠাকুরঘরে দৌড়োল। দরজার বাইরে থেকে দেখল প্রভাত আসনে স্থির হয়ে বসে আছে, দু-চোখের কোল বেয়ে জলের বিন্দু নেমেছে। খুব পরিচিত দৃশ্য। ওই দৃশ্য কল্যাণীর মনে কেমন একটা নির্ভরতার ভাব আনে। তার মনে হয় যার স্বামী এত ভক্ত, যে বাড়িতে এত পুজোআচ্চা, সে-বাড়িতে কোনও অমঙ্গল আসতে পারে না। কল্যাণীর মন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে পুতুলের চিন্তা চলে গেল।

প্রভাত আসন ছেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণী তাকে খবরটা জানাল। বাড়ির কোথাও পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না। ধ্যানের পর প্রভাতকে কেমন প্রশান্ত সুন্দর দেখাচ্ছিল! প্রভাতের মুখে কোনও বিকৃতি দেখা গেল না। শুধু জিগ্যেস করল, কটা বেজেছে। কল্যাণী বলল, ঘড়ি দেখিনি। প্রভাত

অনুমানের ওপর সময় ঠিক করে নিল। বলল, ঠিক আছে, আমি দেখছি, কোথায় আর যাবে, হয়তো আশেপাশে কোনও বাড়িতে গেছে।

কিন্তু এমন তো কোনওদিন করে না।

আহা ছেলেমানুষের খেয়াল। কী ভেবেছে, কোথায় কার বাড়িতে গিয়ে বসে আছে।

বলে যাবে তো!

ঠিক আছে, তুমি রান্নার কাজে যাও আমি দেখছি।

কল্যাণী রান্নাঘরে গেল। প্রভাত পুজোর চেলি ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরোল মেয়েকে খুঁজতে।

দূরে রেলের লাইন পাতা। সিগন্যাল পড়েছে। ডাউনের দিকে কোনও ট্রেন আসছে। প্রভাত বাড়ির বাইরে এসে একবার ভেবে নিল, এখন সে কী করবে! প্রথমে সে বিনোদবাবুর বাড়ি গিয়ে খোঁজ করল। সকালে প্রভাতকে দেখে সকলেই আশ্চর্য হলেন; বিনোদবাবুর মেয়ে ফুলা বলল— না, পুতুল তো আসেনি। আজ কেন সে গত দুদিন আসেনি। বিনোদবাবু প্রভাতকে বসতে বললেন।

না, এখন আর বসব না। বেরোতে হবে। তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে দেখি!

কোথায় আর যাবে? কাছাকাছি কোথাও আছে।

প্রভাত একে একে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের বাড়ি দেখল! না কোথাও পুতুল নেই এবং আসেওনি। সকাল থেকে তারা কেউ দেখেনি।

প্রভাতের মুখে বেশ ভাবনার রেখা পড়ল। মোক্ষদা পিসি বলেলেন—সে কী বাবা, দিনকাল বড় খারাপ। শুনছি, একটা করে ফুল শুঁকতে দিচ্ছে, তারপর ছেলে আর মেয়েগুলো সুড় সুড় করে। ছেলেধরার পিছু পিছু গ্রামের বাইরে চলে যাচ্ছে।

প্রভাত এসব বিশ্বাস করে না। পিসি কেমন আছ? বলে পাশ কাটিয়ে চলে এল।

কী হল একবার খবরটা দিয়ে প্রভাত? বড় চিন্তায় রইলুম। প্রভাত ‘আচ্ছা’ বলে বাড়িমুখো হল।

কল্যাণী মুখে একরাশ চিন্তা মেখে দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল প্রভাতের খবরের আশায়।

ভেবেছিল পুতুলের হাত ধরেই হয়তো সে এসে হাজির হবে আর কল্যাণী পুতুলকে খুব বকবে। এতক্ষণের উৎকণ্ঠা বকুনিতে ভেঙে পড়বে। স্বামীকে দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল।

পুতুল কোথাও নেই, কোনও বাড়িতেই সে যায়নি। সকাল থেকে তাকে কেউই দেখেনি।

সে কী?

এখন কী করা যাবে?

প্রভাতও জানে না, এর পর কী করার আছে। শুনেছে এর পর পুলিশে খবর দিতে হয়। খোঁজার পরিধি তখন আরও বেড়ে যাবে। গ্রাম থেকে গ্রামে, জেলা থেকে জেলা শহরে, কলকাতায়। সারা বাংলা কিংবা সারা ভারতবর্ষে থানায় থানায় খোঁজপত্র চলে। এসব তার শোনা আছে। নিজের জীবনে এইরকম একটা সমস্যা নেমে আসবে তার ধারণার অতীত।

আজ আর অফিস যেয়ো না।

সে তো বটেই।

এর পর চুপচাপ দুজন মুখোমুখি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোনও কথা মুখে জোগাল না। সব কথা যেন হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে। প্রভাত হঠাৎ বলল—চলো তো আর একবার বাগানটা দেখি। কল্যাণী আর প্রভাত বাগানে এল। স্থলপদ্মের গাছে বড় বড় ফুল ফুটেছে! টগর গাছ সাদা হয়ে আছে ফুলে। ছোট ছোট গোটাকতক প্রজাপতি ছটফট করে উড়ে বেড়াচ্ছে। সব জায়গা তারা। খুঁজল, আর একবার খুঁজল। যেন খুব ছোট একটা জিনিস হারিয়েছে। একবারের খোঁজায় হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। হয়তো পুতুল দুষ্টুমি করে চোর চোর খেলছে, গাছের আড়ালে আড়ালে। লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। দুজনে দুদিক থেকে খুঁজল। না পুতুল নেই।

প্রভাত এসে ঘাটের বাঁধানো রকে একটু বসল। জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগল —এর পর কী করবে? সত্যি থানায় যেতে হবে? না হঠাৎ পুতুল এসে ‘মা, মা’ করে ডাকবে। জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রভাত একটা জিনিস লক্ষ করল, পশ্চিম পাড়ে যেখানে জবাগাছের একটা ডাল জলের ওপর ঝুঁকে এসেছে তার একটু দূরে একরাশ ফুল জলের ওপর ভাসছে। জবা গাছ থেকে একটা-দুটো ফুল জলে পড়া বিচিত্র নয়। কিন্তু টগর এল কোথা থেকে? টগর গাছ তো। জল থেকে অনেক দূরে। জলের ওপর সাদা আর লাল একরাশ ফুলের অঞ্জলি কে ছড়িয়ে দিল?

স্বামীর পাশে এসে কল্যাণীও বসল।

প্রভাত শুধু বললে, দেখেছ। একটা জায়গাতেই কত লাল আর সাদা ফুল একসঙ্গে ভাসছে! কে যেন অঞ্জলি দিয়ে গেছে।

কল্যাণী অন্যমনস্ক। জিগ্যেস করে বসল, কেন?

প্রভাত বললে, কেন? মনকে শক্ত করো কল্যাণী। এই কেন-র উত্তর বড় সাংঘাতিক। মাঝপুকুরে ওটা কী ভাসছে দেখেছ? একটা সাজি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুকুরে জাল নামানো হল। সামান্য অনুসন্ধানেই জালে জড়িয়ে উঠে এল পুতুলের দেহ। ফুল ছাপ ফ্রক পরা এক সুন্দরী কিশোরী। যেন এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে, সে ঘুম আর ভাঙবে না কোনওদিন।

প্রভাত শুধু এই বলতে পারল, মা, এই ক’টা বছরের জন্যে মায়ার বাঁধনে কেন বাঁধতে এসেছিলিস! কার পুজো করছিলিস, বিরাটের? সে যে বড় নিষ্ঠুর!

তারপর কত বছর গড়িয়ে গেল রেলগাড়ির মতো জন্ম-মৃত্যুর জোড়া লাইন ধরে। প্রভাতের। ঠাকুরঘর এখন ওই দিঘির পাড়। রোজ সকালে সে নিজে ফুল তোলে, লাল আর সাদা। সাজি ভরে। প্রভাত আর কল্যাণীর বয়েস বেড়েছে। চুলে পাক ধরেছে, কপালে সময়ের রেখা পড়েছে। বয়েস বাড়েনি পুতুলের। সে এখনও সেই কিশোরী। প্রভাত যখন ফুল তোলে, গাছের আড়ালে। সে ঘোরে। প্রভাত তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, ‘বাবা! এদিক এসো, এদিকে। দেখ, এই ডালে কত ফুল!’ সাজি ভরতি ফুল আর ঠাকুরঘরে যায় না। প্রভাত প্রণামের ভঙ্গিতে দিঘির পাড়ে বসে সেই সমস্ত ফুল অঞ্জলি দেয় জলে। ভাসতে থাকে লাল আর সাদা ফুল। এই তো তোমার পূজা! আছ অনল, অনিলে, চির নভোনীলে। ভূধর সলিল গহনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *