ছিপটা নিয়ে সহজে বেরোনো হয় না
ছিপটা নিয়ে সহজে বেরোনো হয় না আনুর। মা যা রাগ করেন। প্রথমদিন যখন ছিপটা দেখলেন একেবারে খেপে উঠলেন, ও কি! ও আবার কি! পানুর এই আক্কেল। নিজে গোল্লায় গেছে, আবার ছোটটাকে ধরিয়ে দিয়ে গেছে।
আরেকটু হলেই ছিপটা নিয়ে মা দুখানা করে ফেলতেন। আনু ধা করে হাতে নিয়ে দে ছুট। ডাকবাংলোর পুকুরে ছিপ ফেলে বসেছিল আনু। মা–র জন্যে মনটা অশান্তি লাগে। সেদিন পানু ভাইয়ের সঙ্গে যেমন, তেমন একটুও মনে হয় না। শুধু সারাক্ষণ কেমন ভয় ভয়। একটা মাছ ধরতে পারল না আনু। যাঃ, মনটাই খারাপ হয়ে গেছে আনুর।
তারপর থেকে একেকদিন বিকেলে আনু ছিপটা বের করে যেত না কোথাও। বাইরের ঘরে মাস্টার সাহেবের বিছানায় বসে সারাক্ষণ হাত বুলোত, দেখত নাড়াচাড়া করত। তার চোখের ভেতরে ফিরে আসত সেদিন দুপুরের নদীটা, খা খা করা পাড়, নীলচে ধূসর রং রিঠা মাছটা। যা মজা হয়েছিল খেতে। আনুও ধরবে ও রকম। একদিন সে নদীতে যাবে।
মাস্টার সাহেব বলেন, ছিপের ইংরেজি কি বলোত?
আনু জানে না, এতো জানাই কথা। মিষ্টি মিষ্টি হাসেন মাস্টার সাহেব। শেষে বলে, ফিশিং রড। দিস ইজ এ ফিশিং রড।
একটা রুমাল দেখে চমকে ওঠে আনু। সেদিন না সে দেখল এই রকম একটা রুমালে ফুল তুলতে বড় আপাকে। মাস্টার সাহেব তাড়াতাড়ি পকেটে ঢুকিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলে ওঠেন, ইস্, কী গরম পড়েছে!
তা সত্যি। পানু ভাই চলে যাওয়ার পর কয়েকমাস কেটে গেছে। শীত আর নেই। জোর গরম পড়তে শুরু করেছে। শীগগীরই হয়ত কালবোশেখী শুরু হয়ে যাবে। এদিকে নাকি একবার ঝড় তুফান উঠলে আর থামতে চায় না।
আনুর এখন ফুটবল খেলায় ভারী নেশা পেয়ে গেছে। সেই মনিরদের ওখান থেকে এসে বিকেলে সে যেত ইস্কুলের মাঠে। প্রথমে খেলা দেখত ছেলেদের তারপর আস্তে আস্তে করে সে নিজেই একজন ভারী খেলোয়াড় হয়ে উঠল। এখন তাকে না হলে চলে না। এ দল ও দল টানাটানি করে। খুব ভালো গোল দিতে পারে আনু। একটা এমন ঝেড়ে কিক দিতে পারে গোলির বাবা পর্যন্ত টের পায় না কোথা দিয়ে কি হয়ে যায়। আর ইস্কুলের খেলা তো! নিয়ম কানুন কিছু নেই। যার পায়ের কাছে বল সেই রাজা। পিন্টু পর্যন্ত তাকে আজকাল সমীহ করে চলে। তার সাথে আজকাল খাতির হয়ে গেছে আনুর। পুরনো কথা ভুলে গেছে। সে। পিন্টুর সঙ্গে গলা ধরে একেকদিন যায় ওদের বাড়িতে। ওর মা কত কী খেতে দেন। গল্প করেন। একেবারে ঠিক তার মার মতো। তার মতোই পাঁচ বোন পিন্টুর। বড়জন ঠিক বড় আপার মতো বড়। বাসায় এসে পিন্টুদের কত গল্প করে আনু। মেজ আপা তার সঙ্গে ঠোনা দিয়ে বলেন, তো যানা, বকশীদের বাড়িতে গিয়েই থাক তুই।
তখন রেগে যায় আনু।
যাঃ আমি বুঝি তাই বলছি। যা, আমি অব কিছু বলবো না কোনদিন।
সেদিন পিন্টু খেলাশেষে ওদের বাসায় যেতে টানছিল। আনু বলল, না ভাই, রাত হয়ে যাবে, মা বকবে।
সত্যি বেলা একেবারে পড়ে এসেছে। আশটা কেমন লাল দেখাচ্ছে। পথের ধারে কেরোসিনের বাতিগুলো দৌড়ে দৌড়ে মই লাগিয়ে সাফ করছে চৌকিদার। পথ দিয়ে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ কেমন গা ছমছম করে উঠল আনুর। বারবার পেছনে তাকাল, ডানে তাকাল, বামে তাকাল। কে যেন পাশে পাশে আসছে তার। পায়ের আবছা শব্দ শোনা যাচ্ছে যেন, অথচ চারদিকে কেউ নেই। আনু প্রায় দৌডুতে থাকে। বাসার কাছে এসে যখন পৌঁছায় তখন ভরসন্ধ্যে। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ক্ষীণ করুণ ধ্বনি থেমে থেমে ভেসে আসছে। ঝোঁপঝাড়গুলো একেবারে আঁধার হয়ে গেছে। এরি মধ্যে জোনাকি বেরিয়েছে। একটা দুটো।
বাসার ভেতরে পা দিয়েই যেন বোকা হয়ে গেল আনু। এখনো বাতি জ্বালেনি কেন কেউ? কি হয়েছে? ও কি! মাথা ঘুরছে আনুর। বুকটা খালি লাগছে। আঁধার বারান্দায় ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে মা, আপারা ডুকরে কাঁদছেন। এত কাঁদছেন যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কাটা কবুতরের মতো ছটফট করছে রুদ্ধ আওয়াজ। এমনকি বাবা পর্যন্ত অন্ধকার ঘরে চেয়ারের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে ছেলেমানুষের মতো ডেকে ডেকে কাঁদছেন। আনুর গলা যেন বুজে এলো। সেও যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছে না আর। তার হাত–পা সব পাথর হয়ে। গেছে। স্থানুর মতো সে দাঁড়িয়ে রইলো উঠোনে। তখন বড় আপা ছুটে এসে তাকে বুকে। চেপে ধরলেন।
টেলিগ্রাম এসেছে, পানু ভাই রেলের নিচে কাটা পড়েছেন।
পানু ভাই! চিৎকার করে উঠল আনু। সে চিৎকার বাইরে কেউ শুনতে পেল না। এক নিঃশব্দ, অন্ধ, তাড়িত পাখির মতো চিৎকারটা তার বুকের মধ্যে ফেটে পড়ল, ঘুরতে লাগল। মা তার মাথার ওপরে গাল রেখে আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন। অনেকক্ষণ পরে যখন চেতনা হলো আনুর, দেখল তার সারা মুখ অশ্রুতে ভারী হয়ে ফুলে উঠেছে। বাবা চেয়ারে বসে কেবল মাথাটা এপাশ ওপাশ করছেন আর আঃ আঃ ধ্বনি উঠছে অস্পষ্ট।
পরদিন রাতের ট্রেনে কাঠের বাক্সে সিল করা লাশ এলো পানু ভাইর। একটা কোলের বাচ্চা রেলের ওপর পড়ে গিয়েছিল, আর তখন ট্রেন আসছিল হু-হু করে, বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে গেল ট্রেন।
ডাকবাংলোর পেছনে, ভোরে, ফজরের নামাজের পর দাফন করা হলো। আনু মাটি দিল দুমুঠো ইয়াসিন তার হাতে মাটি তুলে দিয়েছিল। বাবার হাত শক্ত করে ধরে হাফেজ সাহেবের পেছনে পায়ে পায়ে ফিরে এলো আনু। পেছনে পড়ে রইলো সদ্য ঢাকা কবরটা। তার ওপরে বড়ই গাছের একটা ডাল পোতা। ঝুরঝুরে ধূসর মাটিগুলো ভিজে ভিজে। পাশে। বাঁধানো ঘেরা কবর থেকে মিষ্টি ফুলের ভারী একটা সুঘ্রাণ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ডাকবাংলোর পাশে ঘুমটি ঘরে বুড়োটা বাঁশের মাচায় বসে হুঁকো টানছে। মুড়ি মুড়কির। দোকানে ঝপ উঠলো এইমাত্র। একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে খলিলগঞ্জের দিকে ক্যাচ–ক্যাঁচ কাঁচ–কাঁচ করতে করতে। পিড়িং পিড়িং করে শালিখগুলো উড়ে যাচ্ছে, বসছে, আবার উড়ছে। আর পানু ভাইকে দেখতে পাবে না আনু। শরীরটা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে। গিয়েছিল তাই ওরা বাক্সে সিল করে দিয়েছে। না হলে বাবা–মা–ভাই–বোনেরা যে দেখে কষ্ট পাবে! আনু আর কোনদিন দেখতে পারবে না।
মাস্টার সাহেব আনুর কাঁধে হাত রাখলেন। বাবা গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। দুদিনে যেন দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে তার। শাদা চুলে মাথাটা ছেয়ে গেছে, খিলাল করেননি, এলোমেলো হয়ে গেছে সুন্দর একমুঠো তীব দাড়ি, চোখে কালি পড়ে গেছে, হাতের কবজি কত চিকন মনে হচ্ছে।
আনুকে মাস্টার সাহেব কোলের কাছে টেনে মুখটা মুছিয়ে দিলেন। তারপর তাকে বিছানার পাশে বসিয়ে চুপ করে রইলেন। যেন কিসের অপেক্ষা করছে দুজন।
তারপর থেকে গোটা বাসাটাই কেমন যেন বদলে গেল। কথা বলতে ভয় করে, হাসতে টান। পড়ে বুকের মধ্যে। আনু যেন কেমন একেলা হয়ে যায়। রোজ সকালে উঠে পড়তে বসে, ইস্কুলে যায়, ফিরে আসে, রাতে বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে জেগে থাকে—- এ বাড়ির কারো সাথে যেন তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে একটা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। এখন একেকদিন ছিপ নিয়ে বেরোয় মাছ ধরতে, কেউ আর তাকে কিছু বলে না। এখন আনু ভালো মাছ ধরতে শিখে গেছে। মাছগুলো সে বাসায় আনে না। ফেরার পথে যদি রাস্তায় ভিখিরি ছেলেমেয়েরা ভিড় করে তাদের দিয়ে দেয়। নইলে সেপাই ব্যারাকে গিয়ে ইয়াসিনকে। আনু যখন ছিপ নিয়ে বসে পানির মধ্যে পানু ভাইয়ের চেহারাটা ভেসে ওঠে। মাথার চুল উলুটিয়ে সিথি করা, হা–হা করে হাসছেন।
একেকদিন ভোরে বাবা তাকে নিয়ে যান পানু ভাইর কবর জেয়ারত করতে। বাবা তাকে আগাছাগুলো তুলে ফেলতে বলেন। আনু উপুড় হয়ে পড়ে, দুহাতে বাজে গাছগুলো তুলে ফেলে। মাটি আর মৃতের একটা মেলানো ঘ্রাণ তার সমস্ত বোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে। আনুর যেন কোনো জ্ঞান থাকে না আর।
মাঝে মাঝে মা এক কোণে বসে অঝোরে কাঁদেন। সেজ আপা সেলাই করতে গিয়ে কাঁদেন। হাতের সুই, সুতো নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন। বড় আপাকে যেন আর দিনের আলোতে দেখা যায় না। সারাদিন সবার আড়ালে আড়ালে তিনি ঘুরে বেড়ান।
বাবাকে আর কোনদিন আনু দেখেনি, ভোরে সেই হাসিভরা উজ্জ্বল মুখ নিয়ে শিউলি তলায় পায়চারি করতে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আর আনুকে ডাকেন না বাবা। আনু আর কুস্তি শিখতে যায় না ইয়াসিনের কাছে।
.
পুরো এক বছর হতে চলল আনুরা মহিমপুরে এসেছে। আবার শীত পড়ছে মন্থর গতিতে। গভীর রাতে গায়ে কাঁথা না দিলে গা কেমন শিন্–শিন্ করে ওঠে। হালকা কুয়াশা চাঁদরের মতো জড়িয়ে ধবে গাছগুলো। আর নিম গাছের ফাঁক দিয়ে একটু পরে যেটুকু রোদ এসে ছিটিয়ে পড়ে তাতে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগে। গাছে গাছে পাতা ঝরছে। পাতা পড়ছে। কেমন যেন উদাসীন মনে হয় এবারের শীত।
এক সকালে বাবা আনুকে বললেন, ভাবছি, আনু তোকে সামনের বছর বড় স্কুলে ভর্তি করে দেব। বোর্ডিং–এ থাকবি।
কথাটা শুনেই মা প্রতিবাদ করে ওঠেন, হ্যাঁ, অতটুকুন ছেলে বাপ–মা ছেড়ে বিদেশ বিভুয়ে থাকবে।
কেন তাতে হয়েছে কী? বারবার স্কুল বদলাতে হয় আমার সাথে সাথে, তাতে লেখাপড়া কিসসু হয় না। তার চেয়ে বোর্ডিং–এ দেওয়া ঢের ভালো মানুষ হবে।
বোর্ডিং–এ থাকা সে তো ঢের খরচ। আনু (তা জানে, বাবা কত গরিব। তবু বাবা কেন তাকে বোর্ডিং–এ রেখে পড়াতে চান? বুক ঠেলে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো আনুর। মাথা নিচু করে সে। নাশতা করতে লাগল। বাবা একবার আনুর মুখের দিকে তাকালেন। মা বললেন তাকে, তোমার চায়ে একটু দুধ দেব?
হ্যাঁ, দাও।
আনমনে উত্তর করলেন বাবা। তারপর আস্তে আস্তে চাটুকু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন আর একটা কথাও না বলে। আনুর চুলে হাত রাখলেন মা। বুলিয়ে দিতে দিতে মিষ্টি করে জিগ্যেস করলেন, তুই বোর্ডিং-এ থাকবি আনু?
আনু বুঝতে পারে, মা তাকে যেতে দিতে চান না। তখন মার জন্যে খুব মায়া করে আনুর। উত্তরে কিছুই বলতে পারে না সে। ম্লান একটুখানি হাসে শুধু। মা তাকে আরো আদর করতে থাকেন।
শীতকালের আকাশ আয়নার মতো পরিষ্কার। কখনো সখনো এক আধ টুকরো সাদা মেঘ খেয়ালির মতো ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। আর মাঝে মাঝে উত্তরে মেঘের ঝাঁপটে ধোঁয়াটে মেঘ আকাশ ভরে তোলে। শুকনো হিম–হিম বাতাস হু–হু করে বয়।
পড়তি বিকেলে বাইরের ঘরে বসে একটা কাগজ থেকে ছবি কাটছিল আনু। এমন সময় দমকা এক হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে আনুর হাত থেকে কাটা ছবিটা উড়িয়ে নিয়ে গেল আচমকা। ছবিটার পেছনে ধাওয়া করে বাইরে এসে আনু দেখে আকাশ জুড়ে কালো মেঘ, মেঘের ওপর মেঘ জমেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে দিনের আলো, রাস্তায় লোকেরা দৌড়চ্ছে, বাতাস বইছে এলোমলো। এক্ষুণি বোধ হয় ঝড় উঠবে।
ঝড় উঠবে কি, ঝড় উঠে গেছে ততক্ষণে। আকাশ চিরে ঝলক দিয়ে উঠল বিদ্যুৎ–এর আগুন। একবার, দুবার, বারবার খোলা দরজাটা আছড়ে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল আনুর হৃদস্পন্দন। দৌড়ে গিয়ে যখন দরজাটা বন্ধ করল সে, তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
শোবার ঘরে মা একেলা রয়েছেন। ভাবতেই ভেতরটা হিম হয়ে গেল আনুর। ঝড় বৃষ্টিকে মা–র যা ভয়। সামান্য একটু বৃষ্টি নামলেই সারাটা শরীর তাঁর থরথর করে কাঁপতে থাকে। সবাইকে বুকের কাছে নিয়ে ঘরের এককোণ ঘেঁষে বসে থাকেন। আর বিড়বিড় করে আল্লাকে ডাকেন আল্লা, বৃষ্টি থামিয়ে দাও। ভয়, এখুনি হয়ত ঘরদোর সব ভেঙে পড়বে মাথার ওপর। সয়লাব হয়ে যাবে দুনিয়া। আর আজ যা ঝড় বৃষ্টি নেমেছে, না জানি একেলা অন্ধকার ঘরে বসে মা কী করছেন।
প্রবল বাতাসের মধ্যে একবার যেন আনু শুনতেও পেল, আনু, বাবা আনু।
এত ক্ষীণ সে ডাক যে আনু ভালো করে বুঝতেও পারল না, তার আগেই মিলিয়ে গেল ডাকটা। কান পাতলো আনু, আবার ডাকছেন বুঝি। আনু এখন বাতাস ভরে কেবল মা–র কণ্ঠই শুনতে পাচ্ছে।
আনু, ও আনু।
মা ডাকছেন। বাতাসে একটা অনবরত হুইলের মতো আওয়াজ। আর তারই ভেতর থেকে উঠে আসছে ডাকটা। আনু চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিছুই সে বুঝতে পারে না কী করবে। তার ভীষণ প্রস্রাব পায়।
এমন সময় শোবার ঘরে ভারী কী যেন একটা ঝনঝন করে পড়ে গেল। আর সেই সঙ্গে রক্ত জমানো চিৎকার। বৃষ্টির মধ্যে একলাফে বেরুলো আনু। বেরিয়ে ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে। ঢুকলো। এই টুকুতেই সারা গা তার ভিজে গেছে। কিন্তু সেদিকে চোখ নেই তার। তাকিয়ে দেখে মা চৌকির এককোণে বসে গোঙাচ্ছেন, নিঃশ্বাস ফেলছেন জোরে জোরে। এক মুহূর্ত আনু বোকার মতো তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর চিৎকার করে ডাকে, মা, ও মা, মা। মা কোনো কথাই বলছেন না। হাঁপাচ্ছেন। কাঁদছেন। আনুর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। আনু পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে, মেঝের ওপর একরাশ ছোটবড় ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে সেই বড় ছবিটা, সব্বাইয়ের গ্রুপ ফটো, আনু তখন কোলে, মিনু আপা তখন হাফপ্যান্ট পরে। আর দেয়ালের যে জায়গাটায় ছবিটা ঝোলানো ছিল সে জায়গাটা বিশ্রী রকমে ফাঁকা। দুএকটা ঘেঁড়া মাকড়শার জাল হাওয়ায় কাঁপছে। আনু চোখ ফিরিয়ে আনে। দুহাতে মাকে ধরে আবার ডাকে, মা, মাগো।
তখন আনুর হঠাৎ ভয় হলো। ভীষণ ভয় হলো। মা চোখ বড় বড় করে হাঁপাচ্ছেন। আনুর মনে হলো, মা এক্ষুনি পড়ে যাবেন।
কী করবে ভেবে না পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল আনু। তারপর নিঃশ্বাস নিয়ে বৃষ্টি মাথায় করে প্রাণপণে ছুটে চলল থানায়, বাবার কাছে। তীরের মতো বৃষ্টির ফলা বিধছে শরীরে, মাথায় মুখে। জামাটা বুকে পিঠে লেপটে গেছে। চোখ আবছা হয়ে আসছে পানির ঝাঁপটায়। আনু তবু পাগলের মতো দৌড়ুচ্ছে! যখন থানার কাছে গিয়ে সে পৌঁছুলো তখন যেন তার মধ্যে সে আর নেই।
বাবা একটা অচেনা লোকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা কইছিলেন। আনুকে হঠাৎ এসময়ে এভাবে দেখে চমকে উঠলেন যেন।
আনু!
শীগগীর বাসায় চলো, মা কেমন করছে।
কেন, কী হয়েছে?
বাবা তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু আনু কি বলবে? কি জবাব দেবে এর? মা র কী হয়েছে কি করে বোঝাবে সে? কিছুই বলতে পারল না সে। অচেনা লোকটার জন্যে আরো লজ্জা করল। লোকটা কেমন ছুরির মতো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আনুর বিশ্রী লাগছে। কথ জড়িয়ে এলো তার। কোনোরকমে সে বলল, বৃষ্টিতে না ভয় পেয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে বাবা চিৎকার করে উঠলেন, আর তুমি তাই বাসা ছেড়ে এসেছ? বৃষ্টিতে ভিজেছ?
চমকে উঠল আনু। যেন উনি তার বাব; নন। বাবাকে এরকম চিৎকার করতে, বকতে, কোনদিন শোনেনি আনু! এ কি হয়েছে তার বাবার? ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল আনু। ঠকঠক করে বৃষ্টি ভেজা ঠাণ্ডায় সে কাঁপতে লাগল। বাবার চোখের দিকে তাকাতে তার প্রবৃত্তি হলো না।
ভারী রাগ হলো তার। এত রাগ হলো যে কোনো কথা না বলে সে বাবার কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। এতো রাগ হলো, ইচ্ছে হল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে একটা অনর্থ করে বসে আনু।
পেছনে কার পায়ের আওয়াজ পেল সে। তাকিয়ে দেখে, বাবা। তিনি খপ করে তার হাত ধরে টান দিয়ে বললেন, বৃষ্টিতে আবার ভিজে চলেছ কোথায়? দিন দিন বখাটে হয়ে যাচ্ছ, না? একদিন ধরলে মেরে লাশ বানাবো।
বাঁ পায়ের ওপর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল চাপিয়ে খুঁটতে থাকে আনু। বিস্ময় তার বাঁধ মানছে না। এ কী হয়ে গেছেন তার বাবা? আজ এরকম করছেন কেন? বাবা আবার চাপা গলায় ধমকে উঠলেন, এক গা পানি কাদা নিয়ে দৌড়ে আপিসে ঢোকা এই তোমার আক্কেল।
বৃষ্টিতে ভয় পেলে আমি কি করব। আমি কি করতে পারি?
ইয়াসিন।
ডাক শুনে ইয়াসিন দৌড়ে এসে হাজির হয়।
যাও, একে ছাতা করে দিয়ে এসো।
আনু বাসায় ফিরে এসেছে পাঁচ মিনিটও হবে না, বাবা এসে উপস্থিত। বারান্দায় চুপ করে বসে ছিল আনু। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন বাবা। বৃষ্টি এখন অনেকটা কমে গেছে। পাশের বাড়িতে আপারা আটকে ছিলেন, ওরাও এসে গেলেন একটু পরেই।
ছবিটা, ছবিটা ভেঙেছে কে?
বাবা প্রশ্ন করেন অবাক হয়ে। মা–র গলা শোনা যায়, বাতাসে ছিঁড়ে পড়ে গেছে।
বাতাস? ও।
বাবা আর কোনো কথা বললেন না। বারান্দা থেকে আনু দেখতে পেল, বাবা ভাঙা ছবিটা তুলে আলমারির তাকে উঠিয়ে রাখলেন। বাইরে আকাশ শান্ত। আর ঘরের ভেতরটা চুপচাপ। কারো কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না।
একটু আগেই বাবার ওপর খুব রাগ হয়েছিল আনুর, এখন যেন তা আর নেই। বদলে, কেমন লজ্জা করছে, অনুশোচনায় ভরে আসছে মন। সত্যি ওভাবে দৌড়ে যাওয়া ঠিক হয়নি তার। কতরকম লোক আসে বাবার কাছে, বাবা হয়ত জরুরি আলাপ করছিলেন। লোকটার চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে আনুর। কালো, চাপদাড়ি, গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে আংটি। ছুরির মতো চোখ তার। লোকটার আঙুল দশটা সারাক্ষণ অস্থির হয়ে টেবিলে এটা নাড়ছিল, ওটা ঠেলে রাখছিল; লোকটা আনুর দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। আনুর মনে হলো, তারই ভুল হয়েছে। বাবা রাগ করেছেন। নইলে কখনো বাবা তাকে বকেন না। আনুর কেমন ইচ্ছে হলো এখন বাবাকে একটু দেখতে। দরোজার কাছাকাছি সরে এসে চোর–চোখে আনু তাকাল ভেতরে। দেখল, বাবা একমনে বসে জুতোর ফিতে খুলছেন।
আনু জানে না রাত এখন কত। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেছে তার। আজকাল রাতে এরকম হঠাৎ চমকে ঘুম থেকে জেগে যায় আনু। বুকের মধ্যে ভয় করতে থাকে। পানু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে যেন দেখতে পায় রক্তাক্ত দু খণ্ড দেহটা। কাঠ হয়ে পড়ে থাকে আনু। ভারী তিয়াস পেল তার। চোখ মেলে দেখে পায়ের কাছে চৌকির নিচে হারিকেন জ্বলছে ছোট হয়ে। আনু বিছানা হাতড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘুম জড়ানো চোখে দুএক পা এগিয়েছে সে, এমন সময় কী যেন চোখে পড়ল তার। ঘরের ও পাশটায় খানিকটা জায়গা নিকষ অন্ধকার। একটা কুকুর অবিকল মানুষের মতো কেঁদে উঠল বাইবে। শুকনো গলায় আনু জিগ্যেস করল, কে? অন্ধকারটা নড়ে চড়ে উঠল।
আমি আনু, আমি।
বাবা। বাবা কথা কয়ে উঠলেন। যেন কী একটা করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন তিনি। গলাটা তাই কেমন জড়ানো। আনু এক পা এগিয়ে এসে বলল, পানি খাব।
হুঁ।
পানি খেয়ে এসে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল আনু। বাবা তো এত রাত অবধি কোনদিন জাগেন না। নির্জন অন্ধকার ঘরে চেয়ারে বসে বাবা কি ভাবছেন? সারাটা শরীর কেন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল আনুর। বুকের ভেতরটা পাথরের মতো ভার হয়ে এলো।
বেশ খানিক্ষণ পরে আনু টের পেল বাবা উঠে দাঁড়ালেন। হারিকেনটা হাতে নিয়ে বড় করলেন তিনি। তারপর আনুর বিছানার পাশে এলেন। আনু চোখ বুজে নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলো।
অনেকক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন আনুর পাশে। তারপর তার গায়ের কথাটা ভালো করে টেনে দিলেন। মশারিটা গুঁজে দিলেন আবার।
ঘুমে জড়ানো গলায় মা ও ঘর থেকে বললেন, তুমি শোওনি এখনো?
বলতে বলতে মা এলেন এ ঘরে। বাবা গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। মা তাঁর পায়ের কাছে বসলেন। বাবা বললেন, ছেলেটাকে হঠাৎ তখন বকেছি, মেজাজ ভালো ছিল না। ভারী রাগ করেছে দেখছি।
মা কোনো কথা বলেন না। বাবা আবার বলেন, সন্ধ্যে থেকে মুখ ভার করে আছে। খারাপ লাগছে এখন নিজেরই। অমন করে না বকলেই হতো।
আনুর তখন ইচ্ছে হলো, উঠে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে আমি একটুও রাগ করিনি।
মা হঠাৎ বললেন, তুমি কদিন হলো অমন ছটফট করছো কেন?
কোথায়?
তুমি না বললে কি হবে, আমার চোখ নেই?
বাবা তখন হাসলেন। ঢেউ ভাংগার মতো শব্দ হলো যেন। বললেন, ও তোমার চোখের ভুল।
রোজ এত রাত জেগে থাকলে, এত ভাবলে, কি থাকবে তোমার শরীরে? কি ভাবো এত? অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বা উত্তর করলেন, ভাবি, হাশরের মাঠে আল্লাহ, যখন ডাকবেন, গোলাম হোসেন। আমি তাকে মুখ দেখাবো কী করে?—- এবার আর ভাববো না পানুর মা। হাশরের মাঠে বলব, আমারে তুমি কি বাকি রেখেছিলে যে আমি তোমার রশি শক্ত করে ধরে থাকব। জীবনে পাপ করি নাই সজ্ঞানে, পানুর মা, তাই ঘুম হয় না।
আনু বুঝতেই পারে না, বাবা এ সব কী বলছেন? সব চেনা শব্দ, অথচ একসঙ্গে তাদের কোনো অর্থই স্পষ্ট হচ্ছে না তার কাছে। একটা ধাঁধার মতো লাগছে। কেবল এটুকু বোঝা যাচ্ছে, কী একটা ভাবনায় বাবা কদিন থেকে দিন রাত ডুবে আছেন। বাবা একটু পর বললেন, আবার বৃষ্টি আসবে বোধ হয় বাতাস বইছে।
মা তখন আস্তে আস্তে উঠে গেলেন।
পরদিন বাবা মফস্বল গেলেন। আনু স্কুল থেকে সবে ফিরেছে তখন। দেখে কাপড় চোপড় সব গোছানো হয়ে গেছে। ইয়াসিন সাইকেল পাম্প করছে।
বাবা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাইকেল হাতে নিলেন। পেছনে মা দাঁড়িয়েছিলেন। একবার তাকালেন শুধু। তারপর ধীরে ধীরে রাস্তায় গিয়ে উঠলেন। আনু তার পেছনে পেছনে চলল। খানিকটা পথ যাবার পর বাবা সাইকেল থেকে নেমে ডাকলেন, আনু।
একদৌড়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াল আনু। হড়বড় করে ভাঙা গলায় তিনি বললেন, আমার হাতঘড়িটা ফেলে এসেছি টেবিলের ওপর। শীগগীর যা।
বাবার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। ঠোঁট দুটো যেন কাঁপছে। আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন শুধু শুধু। বাসা থেকে দৌড়ে ঘড়িটা এনে তার হাতে দিল আনু। ঘড়িটা হাতে বাঁধতে বাঁধতে বাবা বললেন, বাসায় থেকো। বাইরে যেও না খেলতে। কেমন?
আনু ঘাড় কাৎ করে সায় দেয়। তার চোখ পানিতে ভরে আসে। যতদিন বাবা মফস্বলে যান, আনুর খুব খারাপ লাগে। আজ যেন আরো। কদিন থেকে বাবা কেমন অস্থির, সেদিন তাকে বকেছিলেন, রাতে মার সঙ্গে কথা—- এসব আলাদা মনে করে নেই; সব মিলিয়ে একটা অবোধ মমত্ব শুধু, সেটাই তাকে আজ অভিভূত করে ফেলে। সে যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে রইলো। বাবা একবারও তাকালেন না ফিরে। সঙ্গে ইয়াসিন। দুটো সাইকেল দেখতে দেখতে নদীর দিকে বাঁক নিয়ে মিলিয়ে গেল।
তখন ছিপ নিয়ে বেরুলো আনু। একটু আগেই বাবা বারণ করে গেলেন, তবু। জানে এখন বিকেল ফুরিয়ে আসছে, এখন আর কোথায় মাছ ধরতে যাবে, তবু। তবু সে ছিপ নিয়ে বেরুলো। বেরিয়ে গেল না কোথাও। কালভাটের পাশে ছিপটা হাতে করে ঠায় বসে রইলো। একটা গানের মতো কোথা থেকে সুর উঠছে। আনু ভালো করে কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করে। ছোট দারোগার বউ আবার হারমোনিয়ম টিপছে। একটা ঝিমোনো সুর বেরুচ্ছে। সেই সুর লতিয়ে চিনচিনে গলা শোনা যাচ্ছে–আমি যাবো না, যাবো না সই। সেই গানটা তার মনের মধ্যে রাগ এনে দিল। হঠাৎ সে টান অনুভব করল বাড়ির জন্যে। বড় বড় পা ফেলে বাড়িতে এসে সে ছিপটাকে তেল খাওয়াতে লাগল।
.
পরদিন মাস্টার সাহেব কোথা থেকে ছুটে এসে চড়া গলায় ডাকতে লাগলেন। ডাকতে ডাকতে আজ প্রায় বাসার মধ্যেই ঢুকে পড়েছেন তিনি।
আনু, আনু।
কী?
তোমার মা–কে ডেকে দাও তো শীগগীর।
কেন?
আনুর সারাটা শরীর শির শির করে উঠল শুনে। মাস্টার সাহেব এরকম গলায় কথা কইছেন কেন?
দরকারি কথা আছে।
মা এসে দরোজার পাশে দাঁড়ালেন। মাস্টার সাহেব একবার তাকে দেখলেন, একবার আনুকে, তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, আম্মা, থানায় খবর এসেছে দারোগা সাহেব অ্যারেস্ট হয়েছেন।
চকিতে মুখ তুলে তাকালেন মা। কথাটা যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আর আনু অবাক হয়ে গেছে। অ্যারেস্ট! মানে হাতকড়া লাগিয়েছে? তার বাবাকে? যেন এরচেয়ে অসম্ভব আর কিছু হতে পারে না। আনু আর দুকানে কিসসু শুনতে পায় না। হা করে তাকিয়ে থাকে। মাস্টার সাহেব রীতিমত হাঁপাচ্ছেন, যেন এক দু মাইল দৌড়ে এসেছেন তিনি। কথাটা শুনে মা–র চোখ ছলছল করে উঠল, মুখখানা বিষ হয়ে গেল, কিন্তু শান্ত কণ্ঠেই জিগ্যেস করলেন, কার কাছে শুনেছ?
ছোট দারোগা সাহেবের কাছে।
ক্রমে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল কথাটা। বড় দারোগা সাহেব এক খুনের মামলায় চার হাজার টাকা ঘুস নিয়েছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। আনুর কেন যেন মনে হয়, সেদিন বৃষ্টিতে দৌড়ে থানায় গিয়ে যে দাড়িওলা পাঞ্জাবি পরা লোকটার সঙ্গে বাবাকে কথা বলতে দেখেছিল, সেই ঘুস দিয়েছিল। কিন্তু কথাটা কাউকে জিগ্যেস করতে পারে না। ছোট দারোগার বউ গায়ে পড়ে এসে মিষ্টি কথা বলে যায় আর মুখ টিপে টিপে হাসে। আবার বলে, বাবা, আমার সাহেবের এ সব নাই। নামাজ রোজা করে না ঠিক, কিন্তু দিল সাফ। আবার কেউ কেউ যাচ্ছে তাই বলে। মুখের ওপর কথা শোনায়।
ছি,ছি, অমন দাড়িওলা পরহেজগার মানুষ। তার এই কাণ্ড?
টিটকিরি দেয় কেউ ঘরে সেয়ানা মেয়ের হাট। তা বুড়ো করবেই বা কী? জন্ম দেবার সময় হুশ ছিল না যে।
আশ্চর্য, কারো ওপরে একটু রাগ হয় না আনুর। বাবার ঘুস নেবার কথা শুনে একটুও ঘৃণা হয় না তার জন্যে। বরং মনটা খারাপ করে। বাবার সঙ্গে যেন এক হয়ে যায় আনু। বাবা তো গরিব। বাবার টাকা দরকার। মনিরের বাবার কাছে টাকা চাইলেন, দিল না। বাবা কী করবেন: আনু যেন বুঝতে পারে, বাবা কত অসহায়। বাবার জন্যে তার আরো মায়া করে। তখন। সে আপন মনে হাঁটতে থাকে। বশিদের মেয়েরা সব সেজে গুঁজে রাস্তায় বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে সে পালিয়ে যায়। এত একা লাগে নিজেকে। মনে হয়, বাবাকে যদি ওরা ছেড়ে দিত, তাহলে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত আনু।
আর বাসায় পানু ভাইয়ের এন্তেকালে সকলে যা না কেঁদেছে, এবার একেকজনে তাই কাঁদল। মা রাধতে গিয়ে কাঁদেন। খাওয়াতে গিয়ে কাঁদেন। আনুর মনে হয়, ঘুমের ঘোরেও কাঁদেন তিনি। বড় আপা কেঁদেছেন সবচেয়ে বেশি। কেঁদে কেঁদে তিনি দরিয়া করে ফেলেছেন। তখন আনুও আর থাকতে পারেনি। তার বুকের ভেতরে একতাল জমাট কান্না বড় আপার কোলে এক সময় ঝরঝর করে গলে পড়ে।
কোনো রাতে সার ভালো ঘুম হয় না অনুর। ছবির মতো মনে পড়ে সেই রাতে তার গায়ে বাবার কথা টেনে দেয়া। পানু ভাইয়ের লাশ এলো। ভোর সকালে বাবার সঙ্গে গোরস্তানে গিয়ে কবর থেকে আগাছা তুলে ফেলা! পথের ওপর দাঁড়িয়ে বাবা হাতঘড়ি বাঁধছেন। মাস্টার সাহেবের পকেট থেকে চেনা রুমালটা বেরিয়ে পড়ল হঠাৎ। সকাল বেলা ঘুম থেকে আধো জেগে উঠে কতদিন কান পেতে দেখেছে আনু, যেন এখুনি সে শুনতে পাবে বাবা সুরা পড়তে পড়তে পায়চারি করছেন। পর মুহূর্তেই ভুল ভেঙ্গেছে তার, আর বুক ঠেলে উঠেছে কান্না।
থানার হুকুমে একদিন এ বাসা ছাড়তে হলো। পানু ভাইয়ের কবর আছে বলে মা কিছুতেই মহিমপুর ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। মাস্টার সাহেব আর আনু গিয়ে বাসা ঠিক করে এলো—- একটা বড় ঘর আর রান্নাঘর, বাইরে শনের একটা ছোট্ট ঘর, ভাড়া আঠারো টাকা। কেমন নোংরা আর নির্জন। আনুর মনটা খারাপ হয়ে যায় বাসা দেখে। কিন্তু এরচেয়ে বেশি ভাড়া দেবার সাধ্য যে তাদের নেই। থানার কোয়ার্টার ছেড়ে আসবার সময় মা আরেকবার কেঁদে উঠেছিলেন। দেয়ালে একদিন পেন্সিল দিয়ে আনু বড় বড় করে লিখে রেখেছিল, বাবার সেই কথা আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ, মেক্স ম্যান হ্যাঁপি অ্যাণ্ড ওয়াইজ—- আসবার সময় ঘষে ঘষে মুছে দিয়ে এসেছে।
সকালে বাসা বদল হলো। বিকেলে মাস্টার সাহেব আনুকে বললেন, আনু, চলো নদীর পাড়ে বেড়িয়ে আসি।
তার সঙ্গে বেড়াতে গেল আনু। বিকেল পড়ে এসেছে। আকাশটা দেখাচ্ছে কেমন কোমল। নদীর ওপারে নীল হয়ে এসেছে গাছপালা, গ্রাম। একটা নৌকা পাল তুলে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে। ঝাউবনে সরসর করছে বাতাস। এক জায়গায় নারকোল আর গুড়ের নৌকাগুলো গলাগলি ধরে ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে যেন। মাঝিরা কেউ ছইয়ে বসে, কেউ নিচে নেমে গল্প করছে, মশলা পিষছে, হুঁকা টানছে। হাঁটতে হাঁটতে কতদূর চলে এসেছে ওরা।
একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো মাস্টার সাহেব। আনুও বসলো। দুজনে চুপ করে দেখতে লাগল নদী। নদীটা কেমন নীল আর লাল মেশানো রং নিচ্ছে—-আয়নায় আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছে। সেদিকে চোখ রেখেই মাস্টার সাহেব ডাকলেন, আনু।
জি।
আনু তাকালো তার দিকে। কিন্তু তিনি ফিরে তাকালেন না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে আস্তে বললেন, আনু, তুমি এখনো ছোট। তোমাকে এই কথাগুলো বলা এখন ঠিক হবে না। তবু যদি না বলি, তাহলে বড় হয়ে অনেক প্রশ্ন তোমার মনে আসবে, তুমি উত্তর পাবে না। বড় হলে বুঝবে, আজ আমি এ সব তোমাকে বলে ভালোই করেছি।
অবাক হয়ে যায় আনু। কিন্তু চমকে ওঠে না। মনে হয়, স্বপ্নের ভেতর থেকে কথা বলছে মাস্টার সাহেব। মনে হয়, এই তো আনু বড় হয়ে গেছে। বন্ধুর মতো দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। কথা বলছে। সে অপেক্ষা করে। সে যেন জানেই কী বলবেন উনি।
আনু, আমি বড় গরিব। মাস্টার সাহেব বলতে থাকেন, বড় কষ্ট করে লেখাপড়া করছি। তোমার বাবা জায়গির না রাখলে হয়ত বি.এ. পড়াই হতো না আমার। দ্যাখো না, কতদূব। রংপুর, রোজ ট্রেনে যাই কলেজে। তোমার কাছে লজ্জা কি? বিনা টিকিটে যাই। হাতে বই খাতা দেখে, আমার মুখের দিকে দেখে, চেকাররা কিছু বলে না। বুঝলে?
হ্যাঁ।
আবার চুপচাপ হয়ে যায় দুজন। আবার মাস্টার সাহেব বলেন, আনু, তোমার বড় আপাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম মনে মনে। শুধু আমি আর তোমার বড় আপা জানি। আর কেউ জানে না। তোমার বাবার বিপদ, আমি আর ভার হয়ে থাকতে চাই না।
কেন?
অবাক হয়ে আনু জিগ্যেস করে। বড় আপাকে বিয়ে করতে চান মাস্টার সাহেব, সেটা তাকে একটুও লজ্জিত করে না। বরং সে উদ্বিগ্ন হয়ে আবার শুধায়, আপনি চলে যাবেন?
হ্যাঁ আমার যাওয়াই ভালো। জানো আনু, তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে আমি যা কবছি, রুঢ় হলেও দরকার ছিল। আমি চলে যাচ্ছি। তাতে একটা লোক কমবে সংসারে, তোমাদের এমনিতে অভাব, কিছুটা সুবিধে হবে। তাছাড়া তোমার বড় আপাকে আমি যতই ভালোবাসি, এখন যদি থেকে যাই, কেউ নেই তোমাদের সংসারে যে বড়, তাতে লোকে মন্দ বলবে, তোমার আপাদের নামে কুৎসা ছড়াবে। আনু তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে আমি ভালোই করেছি, তোমাদের ভালোর জন্যেই আমি চলে যাচ্ছি। তোমার বড় আপা বোঝে না। তুমি বড় হলে বুঝবে। তোমাকে বলে যাচ্ছি।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন মাস্টার সাহেব। আনু তাকিয়ে দেখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। চোখে হাত দিয়ে দেখে, পানি। পানি মুছে দেখে সন্ধ্যায় কালো হয়ে গেছে নদী। তার কুলকুল আস্তে আস্তে বাড়ছে। দূরে নৌকা থেকে মাঝি আজান দিচ্ছে। একটা তন্দ্রার ঘোরে যেন ঝাউগাছগুলো এখনো একটু একটু নড়ছে।
সে রাতে মাস্টার সাহেব চলে গেলেন।
.
আনু একদিন শুনলো বাবাকে মহিমপুর হাজতে কয়েকদিনের জন্যে নিয়ে এসেছে। সেদিনই সে খোঁজ নিতে গেল। ছোট দারোগা তাকে দেখে নিয়ে গেলেন বাবার কাছে। আনু যেন চিনতে পারে না তাকে। চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে, পরনের জামাটা আধময়লা, কেমন এক শূন্যতা তার চারদিকে। তিনি ব্যগ্র দু চোখ মেলে দেখলেন আনুকে। আনু মাথা নামিয়ে রইলো।
প্রত্যেকদিন আনুরা সবাই যেত বাবার সঙ্গে দেখা করতে। শেষদিন যখন বাবাকে ওরা এখান থেকে নিয়ে যাবে, সেদিন একটু আগেই এলো আনু, আপারা, মা। আনু ছিল সবার পিছনে। কিন্তু বাবা তাকেই ডাকলেন প্রথমে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বারবার ডাকলেন।
আনু, ও আনু, আনু, বাবা।
উঁ।
সংক্ষেপে জবাব দেয় আনু। কী জানি যদি কান্না পেয়ে যায় তার। বাবা তখন তার কানের কাছে মুখ রেখে মাথার ওপর গলাটা ঠেকিয়ে বললেন, তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমাকে নিয়ে আমার কত আশা, কত ভরসা। ভালো করে লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া শেষ হলে কত বড় চাকুরি করবে। কিছুরই অভাব, কিছুরই ভাবনা থাকবে না তোমার। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা কোরো। আমি শীগগীই ফিরে আসব।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, নিঃশব্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল আনু। দৌড়ে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো, হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো অনেক দূরে। বাবা তার মাথাটা আরো কাছে টেনে নিলেন। আরো আদর করতে লাগলেন তিনি। চোখ তুলে তাকালে আনু দেখতে পেত তিনিও কাঁদছেন।