Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাজশাহী থেকে খবর এল

রাজশাহী থেকে খবর এল, স্কুল ফাইন্যাল দিয়েই নবুমামা কাউকে কিছু না বলে কলকাতা চলে গেছেন। নানাজানের মুখ গম্ভীর হল। নানীজনের কেন জানি ধারণা, নবুমামা আর কখনো ফিরবে না। তিনি গানের মত সুরে যখন কাঁদতে থাকেন তখন বলেন, এক মেয়ে পাগল, এক ছেলে বিরাগী, এক বউ বাঁজা।

শুনলে হাসি পায়, আবার দুঃখও লাগে। বাদশা মামা মাঝে-মধ্যে গিয়ে নানীজনকে ধমক দেন, কি মা, আপনি সব সময় বাঁজা বউ বাঁজা বউ করেন!

নানীজান ক্ষেপে গিয়ে বলেন,

ও বাঁজা বউকে আমি আর কি বলে ডাকব?

আহা, এলাচি মনে কষ্ট পায়।

নানীজনে কপালে করাঘাত করেন। আর বলেন,

হা রে বউ, তুই কি জাদুটাই না করলি!

বাদশা মামা চিন্তিত, বিরক্ত আর ক্লান্তমুখে চলে আসেন।

নবুমামা হঠাৎ করে কলকাতা চলে যাওয়ায় খুশি মনে হয় শুধু সফুরা খালাকে। আমাকে ডেকে বলেন, আমি ছেলে হলে নবুর মত কাউকে না বলে আমিও চলে যেতাম।

আট-দশ দিন পর নবুমামা কলকাতা থেকে টাকা চেয়ে পাঠাল। নানাজান লোক মারফত টাকা পাঠালেন। নির্দেশ রইল, ঘাড় ধরে যেন তাকে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নবুমামাকে বিয়ে দেওয়া হবে। নানাজান মেয়ে দেখতে লাগলেন। নানীজান মহাখুশি। লালমামিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, নতুন বউয়ের এক বৎসরের ভিতর ছেলে হবে–আমি স্বপ্ন দেখেছি।

টাকা নিয়ে লোক যাওয়ার কয়েকদিন পরেই নবুমামা এসে পড়লেন। সরাসরি এসে বাড়িতে তিনি উঠলেন না, লোক মারফত খবর পাঠালেন কাউকে কিছু না বলে আমি যেন আজিজ খাঁর বাড়িত চলে আসি।

আজিজ খাঁর বাইরের ঘরের চেয়ারে নবুমামা গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। মাথায় বেড়েছেন কিছু। গায়ের রঙ ফর্সা হয়েছে। আমাকে দেখে রহস্যময় হাঁসি হাসলেন, বাড়িতে কেউ জানে না তো আমি এসেছি যে?

না।

গুড।

কি ব্যাপার নবুমামা?

একটা প্ল্যান করেছি। রঞ্জু। লালমামিকে একবার চমকে দেব। গ্রামোফোন কিনেছি একটা। ঐ দেখ টেবিলে।

আমি হা করে টেবিলে রেখে দেয়া বিচিত্র যন্ত্রটি তাকিয়ে দেখি। নবুমামা হাসি মুখে বলেন, পাঁচটা রেকর্ড আছে। একশ পনের টাকা দাম।

নবুমামার প্ল্যান শুনে আমার উৎসাহের সীমা থাকে না। রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নবুমামা গ্রামোফোন নিয়ে চুপি চুপি যাবেন। যে ঘরটায় আমি আর নবুমামা থাকি সেই ঘরটায় চুপ চুপি এসে গ্রামোফোন বাজানোর ব্যবস্থা করা হবে। গান শুনে হকচাকিয়ে বেরিয়ে আসবেন লালমামি। অবাক হয়ে বলবেন,

রঞ্জ কি হয়েছে রে, গান হয় কোথায়?

তখন হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবেন নবুমামা। উৎসাহে নবুমামা টগবগ করছেন। আমি বললাম,

নবু মামা, এখন একটা গান শুনি।

নবুমামা হা হা করে ওঠেন, না না, এখন না। পরে শুনবি। ফাস্টে কোনটা বাজাব বল ত?

কি করে বলব, কোনটা?

সেদিন সন্ধ্যার আগে-ভাগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। সে কি বৃষ্টি! ঘরদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। নবুমামা বিরক্ত মুখে বসে। রইলেন। রাতের খাওয়া-দাওয়া আজিজ খাঁর ওখানেই হল।

রাত যখন অনেক হয়েছে, লোকজন শুয়ে পড়েছে, সবখানে, তখন আমরা উঠলাম। বৃষ্টি থামেনি, গুড়ি গুড়ি পড়ছেই। মাথায় ছাতা ধরে আধভেজা হয়ে বাড়িতে উঠলাম। কাদায়-পানিতে মাখামাখি। বাড়িতে জেগে কেউ নেই। শুধু নানাজানের ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। দুজনে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। দরজা খোলা হল অত্যন্ত সাবধানে। একটু ক্যাচ শব্দ হতেই দুজনে চমকে উঠছি।

অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে বের করলেন নবুমামা। বহু কষ্ট করে চোঙ্গ ফিট করা হল। দম দিতে গিয়ে বিপত্তি, ঘাস ঘ্যাস শব্দ হয়। তবে ভরসার কথা, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কোন গানটা দিয়েছি কে জানে। একটা খুব বাজে গান আছে। এটা প্রথমে এসে গেলে খারাপ হবে খুব।

আমি বললাম, নবুমামা, দেরি করছি কেন?

দিচ্ছি। বৃষ্টিটা একটু কমুক, নয়ত শুনবে না।

বৃষ্টির বেগ একটু কমে আসতেই গান বেজে উঠল,

আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।

লালমামি গান শুনে মুগ্ধ হবে কি, আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। কি অপূর্ব কিন্নর কণ্ঠে গান হচ্ছে। বাইরে ঝমকামিয়ে বৃষ্টি। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল।

নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কি ব্যাপার, ভাবী আসে না যে? ও রঞ্জু।

আমি সে কথায় জবাব দিলাম না। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। জানালার কপাটে শব্দ খট খট। নবুমামা জানালা বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লালমামি ডাকলেন,

রঞ্জু, রঞ্জু!

নবুমামা ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে থাক, কথা বলবি না। আমি চুপ করে রইলাম। নবুমামা অন্য রেকর্ড চালিয়ে দিল—

‘যদি ভাল না লাগে তো দিও না মন’

লালমামি দরজায় ঘা দিলেন, ও রঞ্জু, কি ব্যাপার, গান হয় কোথায়? নবুমামা উত্তেজনায় চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন, ভাবী তোমার জন্য আনলাম। তোমার জন্য আনলাম। নবুমামা লালমামির হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। কি ফুর্তি তার! লালমামি বললেন, কলের গান না? ছোটবেলায় দেখেছিলাম একবার। চোঙ আছে? বাতি জ্বালাও না।

বাতি জ্বালানো হল। লালমামিকে দেখব কি? নবুমামার দিকেই তাকিয়ে আছি। আনন্দে উত্তেজনায় নবুমামার চোখ জ্বল জ্বল করছে। মামি বললেন, ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো গানটা আরেকবার দাও।

সেই অপূর্ব গান আবার বেজে উঠল। বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টি।

সে রাতের কথা আমার খুব মনে আছে।

একটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে মনে রাখবার মত ঘটনা তো খুব সীমিত। কত মানুষ আছে, সমস্ত জীবন কেটে যায় কোনো ঘটনাহ মনে রাখার মত আবেগ তার ভেতরে সৃষ্টি করে না। আমি নিজে কত কিছুই তো ভুলে বসে আছি। কিন্তু মনে আছে, সে রাতে গান শুনতে নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি এসেছিল। নবুমামা আর লালমামি যেন দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। নবুমামা বললেন,

ভাবী, আমার নাচতে মন চাইছে।

নাচ না।

নবুমামা বললেন,

রঞ্জু, তুই নাচবি আমার সঙ্গে?

আমি সে কথার জবাব দিলাম না। মামি বললেন,

নবু, ঐ রেকর্ডটা আবার।

সারারাত হবে আজকে। বুঝলে ভাবী।

ক্লান্তি নেই নবুমামার। লালমামির উৎসাহও সীমাহীন। শুনতে শুনতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। নবুমামা বললেন, গাধা! এত ফাইন গান আর ঘুমায় কেমন দেখ।

লালমামি বললেন,

আজ তাহলে থাক। ঘুমো তোরা।

না না, থাকবে না। যতক্ষণ ঝড়-বৃষ্টি হবে ততক্ষণই গান হবে। কথা শেষ হতে-না হতেই কড় কড় করে বাজ পড়ল।

ফুর্তিতে নবুমামা হো হো করে হেসে ফেললেন। মামি বললেন, রঞ্জু, ঘুম পাচ্ছে। এগুলি নিয়ে আমার ঘরে এসে পড়, নবু আমাকে ভাঙা ঘরের চাঁদের আলো গানটা শুনে শুনে লিখে দিতে পারবি কাগজে?

নিশ্চয়ই পারব। নিশ্চয়ই।

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, উঠে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বড় নানীজনের ঘরের লাগোয়া গাব গাছটি ভেঙে পড়ে গেছে। কেমন নেড়া দেখাচ্ছে জায়গাটা। ভালই ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। কে জানে গতবারের মত এবারেও হয়ত বান ডাকবে। গতবার এ রকম সময়ে বাড়ি থেকে নদীর শো শো শব্দ শোনা গেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি, নবুমামা বলছেন, ভাবী, তুমিও গাও। সঙ্গে, সঙ্গে–

না না, আমি পারব না। তুই গা, মাটি সে পৌরনটা গা।

নবুমামা হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন—

মাটি মে পৌরন, মাটি মে শ্রাবণ
মাটি মে তনবিন যায়গা
যব মাটি সে সব মিল জায়গা।

গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লালমামি বললেন, দক্ষিণের জানালা বন্ধ কর নবু, ভিজে যাচ্ছি।

নবুমামা বললেন, বাদশা ভাই কোথায়?

দু’দিন ধরে দেখা নেই। কোথায় কে জানে। যদি ভাল না লাগে গানটা দে। ঘুম আসছে যে আবার। ও নবু, তোর ঘুম পায় না?

শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল। শুয়ে শুয়ে গান শুনতে কি ভালোই না লাগে! ক্রমে ক্রমে ঝড়ের মত বাতাসের বেগ হল। বাড়ির লম্বা থামে বাতাসের শো শো শব্দ উঠতে লাগল। ধরাম ধরাম শব্দ করে দরজা নড়তে লাগল। উঠে দাঁড়িয়েছি হ্যাঁরিকেন জ্বালাব বলে, ওমনি সফুরা খালা ডাকলেন,

রঞ্জু, ও রঞ্জু!

দরজা খুলে দেখি সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে সফুরা খালা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এদিকে গান হচ্ছে না-কি রঞ্জু?

হ্যাঁ, নবুমামা কলের গান বাজাচ্ছিলেন। কলেব গান এনেছেন নবুমামা।

নবু, কোথায়?

লালমামি আর নকুমামা গান বাজাচ্ছেন।

সফুরা খালা আরো একটু এগিয়ে এসে বললেন, কই গান শুনছি না তো?

আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সফর খালা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, রঞ্জু, আমার ভীষণ ভয় লাগছে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *