Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৪) – ফেলুদা || Satyajit Ray » Page 10

রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৪) – ফেলুদা || Satyajit Ray

আমরা বেরিয়েছিলাম দশটায়, ফিরতে ফিরতে হল পায় সাড়ে বারোটা। ফেলুদা তলোয়ারটা সোজা মহীতোষবাবুর হাতে তুলে দেবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু এসে শুনলাম উনি আর শশাঙ্কবাবু বেরিয়ে গেছেন। বনবিভাগের বড় কতা নাকি এসে কালিবুনি ফরেস্ট বাংলোতে –রয়েছেন, সেখানেই গেছেন। কাজেই তলোয়ারটা এখন আমাদের ঘরে, আমাদেরই কাছে।

ঘরে আসার আগে অবিশ্যি আমরা একতলায় কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছি। ফেলুদার মাথায় কী যেন ঘুরছিল; ও দোতলায় না গিয়ে সোজা চলে গেল ট্রোফি রুমে। সেই যেখানে জানোয়ারের ছাল আর মাথাগুলো রয়েছে, আর র্যাকে রাখা রয়েছে বন্দুকগুলো। ফেলুদা র্যাক থেকে একটা একটা করে বন্দুক নামিয়ে সেগুলো খুব মন দিয়ে দেখল। বন্দুকের নল, বন্দুকের বাঁট, বন্দুকের ট্রিগার, সেফটি ক্যাচ–প্রত্যেকটা জিনিস ও খুব্ধ মন দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। লালমোহনবাবু কী যেন একটা বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফেলুদা তাকে ধমকে থামিয়ে দিল।

এখন কথা বলার সময় নয়। লালমোহনবাবু, এখন চিন্তা করার সময়।

লালমোহনবাবু এত দিনে ফেলুদার মতিগতি খুব ভালভাবেই জেনে গেছেন, তাই আর দ্বিতীয়বার মুখ খুললেন না।

দোতলায় উঠে বারান্দা দিয়ে আমাদের ঘরের দিকে যেতে ফেলুদা থমকে থেমে গেল। তার দৃষ্টি দেবতোষবাবুর ঘরের দিকে।

সে কী, দাদার ঘরে তালা কেন?

সত্যিই তো! ভদ্রলোক ঘর ছেড়ে গেলেন কোথায়? আর তালা লাগিয়ে যাবারই বা কারণটা কী?

ফেলুদা কী ভাবল জানি না। মুখে কিছুই বলল না। আমরা আমাদের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।

ফেলুদার এখনকার অবস্থাটা আমার খুব চেনা। জটিল রহস্যের জট ছাড়ানোর প্রথম অবস্থায় ওর ভাবটা এ রকমই হয়। দু মিনিট ভুরু কুঁচকে চুপ করে বসে থেকেই আবার উঠে দাঁড়াল, তারপর খানিকটা পায়চারি করে আবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা হেঁট করে চোখ বুজে ডান হাতের মাঝের আঙুলের ডগা দিয়ে কপালে আস্তে আস্তে টাকা মারা, তারপর আবার হাঁটা, আবার বসা–এই রকম আর কী! এইভাবেই একবার খাট ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, কেউ যখন নেই, আর দেবতোষবাবুর ঘর যখন বন্ধ, তখন এই ফাঁকে একটু চোরা অনুসন্ধান চালালে বোধহয় মন্দ হয় না।

কথাটা বলে ফেলুদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখলাম, ও এদিক ওদিক দেখে মহীতোষবাবুর কাজের ঘরে ঢুকল।

বাঘের পায়ের ছাপ দেখে অবধি লালমোহনবাবুর সাহস অনেকটা বেড়ে গেছে। উনি এখন দিব্যি বাঘছালটার উপর চিত হয়ে শুয়ে বাঘের মাথাটা বালিশের মতো ব্যবহার করছেন। এইভাবে কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, কী শুভক্ষণেই বইটা মহীতোষবাবুকে উৎসর্গ করেছিলাম বলে তো। এমন একটা থ্রিলিং অভিজ্ঞতা কি না হলে হত? আজ সকালের কথাটাই চিন্তা করে–বাঁশের ভেতর বুলেট, ঘাসের মধ্যে সাপ, রয়েল বেঙ্গলের পায়ের ছাপ, পোড়ো মন্দির, গুপ্তধন, জরাগ্রস্ত অশ্বত্থ গাছ–আর কত চাই? এখন একবারটি ম্যান-ইটারের মুখোমুখি পড়তে পারলেই অভিজ্ঞতা কমপ্লিট।

শেষেরটা কি সত্যি করেই চাইছেন আপনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আর ভয় নেই, একটা বিরাট হাই তুলে বললেন, লালমোহনবাবু, মাধবলাল শিকারি। আর ফেলুমিত্তির শিকারি দুপাশে থাকলে মানুষখেকোর বাপের সাধ্যি নেই কিছু করে।

লালমোহনবাবু প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর আমি মহীতোষবাবুর শিকারের বইটা পড়ছিলাম, এমন সময় ফেলুদা ফিরে এল।

কিছু পেলেন?

ফেলুদার পায়ের আওয়াজ পেয়েই লালমোহনবাবু সোজা হয়ে বসেছেন।

ফেলুদা গভীর। বলল, যা খুঁজছিলাম তা পাইনি, আর সেটাই সিগনিফিক্যান্ট।

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটিতে ঠেকল কেন জানেন তো লালমোহনবাবু?

সেই অশ্বথামা হত ইতি গজ-র ব্যাপার তো?

হ্যাঁ। যুধিষ্ঠির পুরোপুরি সত্যি কথা বলেননি তাই। কিন্তু আজকের দিনে মিথ্যে বললেই যে চাকা মাটিতে ঠেকে যাবে এমন কোনও কথা নেই। এ যুগে মানুষের দোষের শাস্তি মানুষই দিতে পারে, ভগবান নয়।

এর পরে একটা জিপের আওয়াজ পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চাকর এসে খবর দিল যে, ভাত বাড়া হয়েছে, বাবু এসেছেন, খেতে ডাকছেন।

মহীতোষবাবুর বাড়িতে খাওয়াটা ভালই হয়। সব সময় হয় কি না জানি না, কিন্তু আমরা যে ক’দিন রয়েছি সে ক’দিন রোজই মুরগি হয়েছে। কাল রাত্রে বিলিতি কায়দায় রোস্ট হয়েছিল, লালমোহনবাবু কাঁটা চামচ ম্যানেজ করতে পারছেন না দেখে মহীতোষবাবু বললেন। যে পাখির মাংস হাত দিয়ে খেলে নাকি কেতায় কোনও ভুল হয় না। আজকেও খাওয়ার তোড়জোড় ভালই ছিল, কিন্তু প্রথম থেকেই কথাবাতা এমন গুরুগম্ভীর মেজাজে শুরু হল যে, খাওয়ার দিকে বেশি নজর দেওয়া হল না। আমরা খাবার ঘরে ঢুকতেই মহীতোষবাবু বললেন, মিস্টার মিত্তির, সংকেতের ব্যাপারটা যখন চুকেই গেছে, তখন তো আর আপনাদের এখানে ধরে রাখার কোনও মনে হয় না। কাজেই আপনি যদি বলেন তা হলে আপনাদের ফেরার বন্দোবস্ত আমার লোক করে দিতে পারে। জলপাইগুড়িতে লোক যাচ্ছে, আপনাদের রিজার্ভেশনটা করে আনতে পারে।

ফেলুদা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, আমাদের দিক থেকেও আপনার আতিথেয়তার সুযোগ আর নেব না বলেই ভাবছিলাম। তবে আপনার যদি খুব বেশি আপত্তি না থাকে, তা হলে আজকের দিনটা থেকে কাল রওনা হতে পারি। বুঝতেই তো পারছেন, আমি গোয়েন্দা মানুষ, আমি থাকতে থাকতে একজন এভাবে খুনি হলেন, তার একটা কিনারা না করে যেতে পারলে মনটা খুঁতখুঁত করবে। আমিই করি, বা পুলিশই করুক, কীভাবে ঘটনাটা ঘটল সেটা জেনে যেতে পারলে ভাল হত।

মহীতোষবাবু খাওয়া বন্ধ করে ফেলুদার দিকে সোজা তাকিয়ে গভীর গলায় বললেন, সুস্থ মস্তিষ্কে খুন করতে পারে এমন লোক আমার বাড়িতে কেউ নেই, মিস্টার মিত্তির।

ফেলুদা যেন কথাটা গায়েই করল না। বলল, আপনার দাদাকে কি অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে? ওঁর ঘরে তালা দেখছিলাম।

মহীতোষবাবু সেইরকম গভীরভাবেই বললেন, দাদা ঘরেই আছেন। তবে কাল রাত থেকে ওঁর একটু বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। ওষুধ খাননি। তাই ওঁকে একটু সংযত করে রাখা দরকার। নইলে আপনাদেরও বিপদ আসতে পারে। আপনারাও তো দোতলাতেই থাকেন। উনি বাইরের লোককে এমনিতেই সন্দেহের চোখে দেখেন। শুধু তাই না, যে সব ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে ওঁর মনে বিরূপ ভাব আছে, বাইরের লোককে সেইসব চরিত্র বা তাদের অনুচর বলে কল্পনা করেন। তড়িৎকে তো কালাপাহাড় ভেবে এক’দিন ওর টুটি টিপে ধরেছিলেন। শেষটায় মন্মথ গিয়ে কোনও মতে ছাড়ায়।

ফেলুদা খাওয়া না থামিয়ে দিব্যি স্বাভাবিকভাবে বলল, তড়িৎবাবুর খুন হওয়াটাই কিন্তু একমাত্র ঘটনা নয়। আপনার গুপ্তধনও কে যেন সরিয়ে ফেলেছে। খুব সম্ভবত সেই একই রাত্রে।

সে কী! -এবার মহীতোষবাবুর মুখের গ্রাস আর মুখ পর্যন্ত পীছল না।–গুপ্তধন নেই? আপনি দেখে এসেছেন?

হ্যাঁ। গুপ্তধন নেই, তবে তলোয়ারটা পাওয়া গেছে। আর তাতে রক্তের দাগও পাওয়া গেছে।

মহীতোষবাবু বেশ কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। এবার ফেলুদা তার তৃতীয় বোমাটা দাগাল।

তড়িৎবাবুকে যখন বাঘে খাচ্ছিল, তখন সেই বাঘের দিকে তাগ করে কেউ একটা গুলি ছেড়ে; সেটা বাঁশের গুড়িতে লাগে। গুলিটা সম্ভবত বাঘের গা ঘেঁষে গিয়েছিল, কারণ বাঘের কিছু লোম পাওয়া গেছে, মাটিতে পড়ে ছিল। কাজেই মনে হচ্ছে সে রাত্রে বেশ কয়েকজন লোক বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে জঙ্গলের একটা বিশেষ অংশে ঘোরাফেরা করছিল।

পোচার।

কথাটা অপ্রত্যাশিতভাবে বলে উঠলেন শশাঙ্কবাবু! পোচার মানে যে চোৱা শিকারি সেটা জানতাম। শিকারের বিরুদ্ধে আইন পাশ হবার পরেও এরা লুকিয়ে লুকিয়ে শিকার করে বাঘের চামড়া, হরিণের শিং, গণ্ডারের শিং, এই সব বিক্রি করে। এমনকী, বাঘভালুকের বাচ্চা ধয়েও মাঝে মাঝে বিক্রি করে।

শশাঙ্কবাবু বলে চললেন, তড়িৎকে যে-ই খুন করে থাকুক, তাকে বাঘে ধরে নিয়ে যাবার পর জঙ্গলে নিশ্চয়ই কোনও পোচার ঢোকে। পোচারই বাঘটাকে গুলি করেছিল, যে গুলি বাঘের গায়ে আঁচড় কেটে বাঁশের গুড়িতে লেগেছিল।

ফেলুদা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, সেটা অবিশ্যি অসম্ভব নয়। কাজেই বন্দুকের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। কিন্তু অন্য দুটো রহস্য রয়েই যাচ্ছে।

দুটো নয়, একটা, বললেন মহীতোষবাবু। গুপ্তধন। ওটা পাওয়া দরকার। ওটা না পেলে সিংহরায় বংশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ওটা পেতেই হবে।

তা হলে এক কাজ করুন না কেন, ফেলুদা বলল, আমরা সবাই চলুন আরেকটিবার ওখানে যাই। জায়গাটা হল কাটা ঠাকুরানীর মন্দিরের পাশে।

মহীতোষবাবু জঙ্গল অভিযানে আপত্তি করেননি। কিন্তু হলে কী হবে, বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে চারিদিক অন্ধকার করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সন্ধে ছটা পর্যন্ত যখন সে বৃষ্টি থামাল না, তখন আমরা জঙ্গলে যাবার আশা ত্যাগ করলাম। ফেলুদা গভীর থেকে এখন একেবারে গোমড়া হয়ে গেছে। মহীতোষবাবু যে আমরা চলে গেলে খুশি হন সেটা ওঁর কথায় পরিষ্কার বোঝা গেছে। কালও যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তা হলে হয়তো ফেলুদাকে তড়িৎবাবুর খুনের রহস্য সমাধান না করেই চলে যেতে হবে। অবিশ্যি আরেকবার কটা ঠাকুরানীর মন্দিরে গেলেই যে ফেলুদার মনের অন্ধকার কীভাবে দূর হবে তা জানি না। তবে ও যে মনে মনে খানিকটা অগ্রসর হয়েছে সেটা ওর চোখ মাঝে মাঝে যেভাবে জ্বলে উঠছিল তা থেকেই বুঝতে পারছিলাম।

এর মধ্যে আমরা তিনজনেই একবার বাইরের বারান্দায় বেরিয়েছিলাম। তখন গ্র্যান্ডফাদার ক্লাকে সাড়ে পাঁচটা বেজেছে। তখনও দেখলাম দেবতোষবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ। লালমোহনবাবু ফিসফিস করে বললেন, একবার খড়খড়ি ফাঁক করে দেখে এলে হত না ভদ্রলোক কী করছেন! এ তল্লটে তো কেউ নেই বলেই মনে হচ্ছে।

ফেলুদা অবিশ্যি লালমোহনবাবুর অনেক কথার মতোই এটাতেও কান দিল না।

সাতটার সময় মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে তারা দেখা দিল। মনে হচ্ছিল। কুচকুচে কালো আকাশের গায়ে তারাগুলো এই মাত্র পালিশ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেলুদা হাতে তলোয়ার নিয়ে খাটে বসে আছে! আমরা দুজনে সবে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় লালমোহনবাবু আমার শার্টের আস্তিনটা খামচে ধরে ফিসফিস গলায় বললেন, সরু টর্চ!

দারোয়ানের বাড়িটা আমাদের জানালা থেকে দেখা যায়। আমাদের বাড়ি, আর ওর বাড়ির মাঝামাঝি একটা গোলঞ্চ গাছ। তার নীচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আর একটা টার্চওয়ালা লোক সেই লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। এটা সেই ধরনের টর্চ যেগুলো বাড়ির প্লাগ পয়েন্টে গুঁজে দিলে চার্জ হয়ে থাকে। ছোট্ট কালৰ, ছোট্ট কাচের মুখ, কিন্তু আলোর বেশ তেজ।

এবার ফেলুদা ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল।

মাধবলাল, ফেলুদা ফিসফিস করে বলল।

যে লোকটা অপেক্ষা করছিল তাকে আমারও মাধবীলাল বলে মনে হয়েছিল, কারণ এই অন্ধকারেও হলদে শার্টের রংটা আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু যে লোকটার হাতে টর্চ সে যে কে তা বোঝা ভারী মুশকিল। সে মহীতোষবাবুও হতে পারে, ওঁর দাদাও হতে পারে, শশাঙ্কবাবুও হতে পারে, আবার অন্য লোকও হতে পারে।

এখন টর্চের আলো নিবে গেছে। কিন্তু দুজনে দাঁড়িয়ে যে খুব নিচু গলায় কথা বলছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ পর হলদে শার্টটা নড়ে উঠল। তারপর টর্চের আলোটা জ্বলে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে চলে এল। ফেলুদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরের বাতিটা জ্বলিয়ে দিল।

লালমোহনবাবু, বোধহয় নিজেই নিজের মনের মতো করে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাই তিনি হঠাৎ এক ফাঁকে বারান্দায় বেরিয়ে কী যেন দেখে এলেন।

কী দেখলেন? দরজায় এখনও তালা? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ! লালমোহনবাবু অপ্ৰস্তুত হাসি হেসে বললেন।

আপনার কি ধারণা উনিই গিয়েছিলেন মাধবীলালের সঙ্গে কথা বলতে?

আমি তো গোড়াতেই বলেছি মশাই, দাদাটিকে আমার ভাল লাগছে না। পাগল জিনিসটা বড় ডেঞ্জারাস। আমাদের নৰ্থ ক্যালকাটায় এক পাগল ছিল, সে আপার সারকুলার রোডের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ট্রাম আর বাস লক্ষ্য করে বেমক্কা টিল ষ্টুড়িত। কী ডেঞ্জারাস বলুন তো?

দেবতোষবাবুর দরজা বন্ধতে কী প্রমাণ হল?

তার মানে ভদ্রলোক নীচে যাননি।

কীি করে প্রমাণ হয় সেটা; ভদ্রলোক আদৌ ওই তালা-বন্ধ দরজার খিছনে আছেন কি না। সেটা আপনি কী করে জানলেন? সারাদিনে তাঁর কোনও সাড়াশব্দ পেয়েছেন কি?

লালমোহনবাবু যেন বেশ খানিকটা দমে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মশাই, কত চেষ্টা করি, আমার চিন্তা ঠিক আপনার চিস্তার সঙ্গে এক লাইনে চালাব–কোথায় যেন গাণ্ডগোল হয়ে যায়।

গণ্ডগোল না। কোলিশন। আপনি উলটো পথে চলেন কি না। আপনি আগে ক্রিমিনাল ঠিক করে নিয়ে তার ঘাড়ে ক্রাইমটা বসাতে চেষ্টা করেন, আর আমি ক্রাইমের ধাঁচটা বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী ক্রিমিনাল খোঁজার চেষ্টা করি।

এই ব্যাপারেও তাই করছেন?

ও ছাড়া তো আর রাস্তা নেই লালমোহনবাবু;

কোনখান থেকে শুরু করেছেন?

কুরুক্ষেত্র।

এর পরে আর লালমোহনবাবু কোনও প্রশ্ন করেননি।

আমাদের মশারি বদলে দেওয়াতে ঘুমটা ভালই হচ্ছিল, কিন্তু মাঝরাত্তিরে একটা চিৎকারে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসতে হল। চিৎকারটা করেছে ফেলুদা! জেগে দেখি, ও দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মাঝখানে, হাতে রয়েছে আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার। বাইরে থেকে চাঁদের আলো এসে ইস্পাতের ফলাটার উপর পড়াতে সেটা ঝিলিক মারছে; যে কথাটা শুনে ঘুমটা ভেঙেছিল সেটা ফেলুদা আরও দুবার বলল, তবে অত চেঁচিয়ে নয়। ইউরেকা! ইউরেকা!

আর্কিমিডিস কী যেন একটা আবিষ্কার করে উল্লাসের সঙ্গে এই গ্রিক কথাটা বলে উঠেছিল। তার মানে হল পেয়েছি। ফেলুদা যে কী পেয়েছে সেটা বোঝা গেল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress