গ্রিন সিগন্যাল (Green Signal)
এই যে এতক্ষণ পঁয়তারা করলাম, তা থেকে বোঝাই যাবে যে, ফেলুদা আমায় গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে। শুধু ফেলুদা কেন, নয়নের মামলা নিয়ে লিখছি শুনে জটায়ু একটা কান-ফাটানো হাততালি দিয়ে বললেন, গ্রেট! গ্রেট! ইয়ে, আমার ভূমিকাটা ইনট্যাক্ট থাকবে তো? সব কিছু মনে আছে তো? আমি বললাম, কোনও চিন্তা নেই; সব নোট করা আছে।
আসল মামলায় পৌঁছতে অবিশ্যি আরও কিছুটা সময় লাগবে। কোথায় শুরু করব জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা বলল, তরফদারের শো। দ্যাট ইজ দ্যা স্টার্টিং পয়েন্ট। আমি ওর কথামতোই স্টার্ট করছি।
তরফদার হলেন ম্যাজিশিয়ান। পুরো নাম সুনীল তরফদার। শোয়ের নামচমকদার তরফদার। আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো ম্যাজিশিয়ান গজাচ্ছে এই পশ্চিম বাংলায়। এর মধ্যে কিছু আছে যারা সত্যিই ম্যাজিক নিয়ে সাধনা করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপে অনেককেই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে হয়। যারা টিকে থাকে তাদের মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। ইয়াং বয়সে ফেলুদার ম্যাজিকের নেশা ছিল, সেটা আমিই একটা গল্পে জানিয়ে ফেলেছিলাম। ফলে এ সব উঠতি ম্যাজিশিয়ানদের অনেকেই ওর কাছে আসে শোয়ে নেমন্তন্ন করার জন্য। আমরা কয়েকবার গিয়েছি, আর গিয়ে হতাশ হইনি।
সুনীল তরফদারও এই উঠতিদের মধ্যে একজন। বছর খানেক হল শো করছেন। এখনও তেমন নাম করেননি, যদিও দু-একটা কাগজে বেশ প্রশংসা বেরিয়েছে। গত ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে এক দিন সকালে ইনি আমাদের বাড়িতে এসে ফেলুদাকে টিপ করে এক প্রণাম করলেন। কেউ ওর পায়ে হাত দিলে ফেলুদা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ে; তরফদারের প্রণামে ও হাঁ হাঁ করে উঠল।
ভদ্রলোকের বয়স ত্রিশ-বিক্রিশের বেশি নয়, লম্বা একহারা চেহারা, ঠোঁটের উপরে একটা সরু সাবধানে-ছটা গোঁফ। প্ৰণাম সেরে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, স্যার, আমি আপনার একজন গ্রেট ফ্যান। আমি জানি এককালে আপনার নিজেরই ম্যাজিকের শখ ছিল। আমার শো হচ্ছে মহাজাতি সদনে। আপনাদের জন্য তিনটে ফাস্ট রোয়ের টিকিট দিয়ে যাচ্ছি। আগামী রুবিধার সাড়ে ছুটয় যদি আপনার আসেন তা হলে আমি সত্যিই খুশি হব।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ হ্যাঁ না কিছুই বলছে না দেখে ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে ফেলুদার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি আপনাদের রোববার ডাকছি। এই কারণে যে, সেদিন আমার প্রোগ্রামে একটা নতুন আইটেম অ্যাড করছি। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এ জিনিস আর কেউ কখনও স্টেজে দেখায়নি।
ফেলুদা যাব বলে কথা দিয়েছিল। রবিবার বিকেলে সাড়ে পাঁচটায় লালমোহনবাবু তাঁর সবুজ অ্যাশ্বাসাড়র নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। চা-ডালমুট খেয়ে আমরা ছ। টায় রওনা হয়ে শোয়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে মহাজাতি সদনে পৌঁছে গেলাম। কাগজে বেশ চোখে পড়ার মতো একটা বিজ্ঞাপন দুদিন আগেই বেরিয়েছিল, ভিড় দেখে মনে হল সেটায় কাজ দিয়েছে। আমরা মাঝের প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সামনের সারির মাঝামাঝি পাশাপাশি তিনটে চেয়ারে বসলাম।
কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলেন? ফেলুদার দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
দেখেছি, বলল ফেলুদা।
তাতে যে বলছে অভূতপূর্ব নতুন আকর্ষণ জ্যোতিষ্ক-এই জ্যোতিষ্কটি কী বস্তু, মশাই? একটু ধৈর্য ধরুন—যথাসময়ে জানতে পারবেন।
তরফদার দেখলাম পাংচুয়ালি সাড়ে ছটায় শো আরম্ভ করে দিলেন। পদৰ্ণ সরাতেই ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি তার চোখ নিজের রিস্টওয়াচের দিকে, ভুরু ঈষৎ তোলা, আর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি; আমি তো জানি ও পাংচুয়ালিটির উপর কত জোর দেয়। ও বলে বাঙালিদের উন্নতির পথে একটা বড় রকম বাধার সৃষ্টি করে এই সময়ানুবর্তিতার অভাব। তরফদার যে এই নিয়মের ব্যতিক্রম, সেটা দেখেই ফেলুদা খুশি।
শো কিছুক্ষণ চলার পরেই বুঝতে পারলাম, জাদুকরের ঝলমলে পোশাক ছাড়া আজকের সফল ম্যাজিশিয়ানদের তুলনায় ইনি জাঁকজমকের দিকটায় একটু কম দৃষ্টি দেন। এও লক্ষ করলাম যে এমন অনেক আইটেম আছে, যাতে নতুনত্ব বলে বিশেষ কিছু নেই।
ইন্টারভ্যালের পর প্রোগ্রামের দ্বিতীয় অংশে এল প্রথম চমক। এটা স্বীকার করতেই হল যে, হিপনটিজম বা সম্মোহনে তরফদারের সমকক্ষ বাঙালি জাদুকরের মধ্যে আর নেই বললেই চলে। তিনজন দর্শককে পর পর স্টেজে এনে চোখের দৃষ্টি আর আঙুল-ছাড়ানা দুই হাতের আন্দোলনের জোরে সম্মোহিত করে তাদের দিয়ে যা-খুশি-তাই করিয়ে ভদ্রলোক প্রচুর হাততালি পেলেন।
কিন্তু তার পরেই তরফদার একটা বেচাল চললেন। ফেলুদার দিকে চেয়ে দর্শকদের উদ্দেশ করে বললেন, আমি এবার প্রথম সারিতে বসা স্বনামধন্য গোয়েন্দাপ্রবর শ্ৰীপ্ৰদোষচন্দ্ৰ মিত্ৰকে অনুরোধ করছি মঞ্চে আসতে।
ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে জটায়ুর দিকে দেখিয়ে বলল, আমাকে না ডেকে এই ভদ্রলোককে ডাকুন। আমাকে ডাকলে বিপত্তির সম্ভাবনা আছে।
তরফদারের বয়স বেশি না বলেই হয়তো তিনি একটু একরোখা। একটা ভয়ংকর রকম কনফিডোন্ট হাসি হেসে বললেন, না স্যার, আমি চাই আপনিই আসুন।
বিপত্তি কথাটা ভুল নয়; তরফদারের বার বার নানারকম চেষ্টা সত্ত্বেও ফেলুদা যেমন সজাগ তেমনই সজাগ রয়ে গেল। এদিকে আমার অপ্ৰস্তুত লাগছে; হলে ভর্তি লোক, তার মধ্যে ম্যাজিশিয়ানের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। শেষে তরফদার যেটা করলেন সেটাই বোধহয় এই অবস্থায় মান বাঁচানোর একমাত্র উপায়।
তিনি সবিনয়ে হার স্বীকার করে দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, ফেলুমিত্তির বস্তুটা যে কী, সেটা আপনাদের দেখানোর জন্যই আমি একে মঞ্চে ডেকেছিলাম। এর কাছে হার স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। আমি চাই আপনারা এই আশ্চর্য মানুষটিকে যথোপযুক্ত সন্মান দেখান।
হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। ফেলুদা স্টেজ থেকে নেমে নিজের জায়গায় এসে বসতে লালমোহনবাবু তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, আপনার মশাই ফিজিয়লজিটাই আলাদা।
কিন্তু একটা চূড়ান্ত চমক—যেটা আমার হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল—এখনও বাকি ছিল। সেটাই তরফদারের নতুন এবং শেষ আইটেম।
যাকে নিয়ে এই আইটেম, সে হল আট-ন বছরের একটি ফুটফুটে ছেলে—যাকে সঙ্গে নিয়ে তরফদার মঞ্চে হাজির হলেন। একটা বেশ বাহারের চেয়ার স্টেজের মাঝখানে রাখা ছিল, ছেলেটিকে তাতে বসিয়ে তরফদার দর্শকদের দিকে ঘুরে বললেন, এই বালকের নাম জ্যোতিষ্ক; এর আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় আপনারা এখনই পাবেন। আমি স্বীকার করছি এতে আমার কোনও বাহাদুরি নেই। একে মঞ্চে উপস্থিত করতে পেরে আমি গর্কিত। এ ছাড়া আমার আর কোনও ক্রেডিট নেই।
এবার তরফদার ছেলেটির দিকে ফিরে বললেন, জ্যোতিষ্ক, দর্শকদের দিকে দেখো তো।
ছেলেটির দৃষ্টি সামনের দিকে ঘুরল।
তরফদার বললেন, সামনের সারিতে প্যাসেজের ডান দিকে লাল সোয়েটার আর কালো প্যাস্ট পরা যে ভদ্রলোকটি বসে আছেন, তাঁর কাছে কি কোনও টাকা আছে?
যাঁর কথা বলা হচ্ছে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
আছে, মিহি, সুরেলা গলায় বলল জ্যোতিষ্ক।
কত টাকা বলতে পার?
পারি
কত?
কুড়ি টাকা তিরিশ পয়সা।
ভদ্রলোক ইতিমধ্যে পকেট থেকে পার্স বার করে তার থেকে দুটো দশ টাকার নোট বার করেছেন। প্যাসেজের ওদিকে বসলেও দিব্যি বুঝতে পারছি যে, ভদ্রলোকের চোখ ছানাবিড়া, মুখ হ্যাঁ।
ওনার হাতে যে দুটো দশ টাকার নেট, তার নম্বর বলতে পার?
এগারো ই-এক এক এক তিন শূন্য দুই। আর চোদ্দ সি–দুই আট ছয় শূন্য দুই পাঁচ।
ভদ্রলোকের ভুরু আরও ইঞ্চিখানেক উপরে উঠে গেল।
মাই গড—হি ইজ অ্যাবসোলিউটলি রাইট!
চারদিক থেকে তুমুল হাততালি আর উচ্ছাসের কোরাস।
এবার তরফদার দর্শকদের দিকে ফিরে বললেন, এখন অবিশ্যি আমি জ্যোতিষ্ককে প্রশ্ন করছি, কিন্তু ইচ্ছে করলে আপনাদের যে কেউ করতে পারেন। শুধু এটা মনে রাখতে হবে যে, প্রশ্ন এমন হতে হবে যার উত্তর সংখ্যায় হয়। এই ভাবে উত্তর দিতে জ্যোতিষ্কর যথেষ্ট মানসিক পরিশ্রম হয়, যদিও সেটা বাইরে থেকে বোঝা নাও যেতে পারে। তাই জ্যোতিষ্ক আর মাত্র দুটো প্রশ্নের জবাব দেবে, তার পর তার ছুটি।
দুটোর একটায় একজন তরুণ দর্শক প্রশ্ন করল, আমি এখানে এসেছি মোটর গাড়িতে। সে গাড়ির নম্বর তুমি বলতে পার?
জ্যোতিষ্ক নম্বর বলে দিয়ে বলল, তোমাদের কিন্তু এ ছাড়াও আর একটা গাড়ি আছে। সেটার নম্বর ডব্লিউ এম এফ ছয় দুই তিন দুই।
তারপর তরফদার একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এ বছর কোনও পরীক্ষা দিয়েছ?
মাধ্যমিক, বলল ছেলেটা। তরফদার জ্যোতিষ্কর দিকে ফিরে বললেন, এই ছেলেটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলায় কত নম্বর পেয়েছে বলতে পার?
জ্যোতিষ্ক বলল, একাশি। ওর চেয়ে বেশি কেউ পায়নি।
উত্তর শুনে ছেলেটি নিজেই হাততালি দিয়ে উঠল।
শোয়ের পর ফেলুদা বলল, এক বার ব্যাকস্টেজে যাওয়া দরকার। তরফদারকে একটা ধন্যবাদ তো দিতেই হয়।
আমরা গেলাম। তরফদার আয়নার সামনে বসে মেক-আপ তুলছেন—আমাদের দেখেই এক-গাল হেসে উঠে দাঁড়ালেন।
কেমন লাগল ফ্র্যাঙ্কলি বলুন, স্যার।
দুটো আইটেমের তারিফ করতেই হয়, বলল ফেলুদা। এক, আপনার হিপ্নটিজম, আর দুই–জ্যোতিষ্ক। কোথেকে পেলেন এই আশ্চর্য ছেলেকে?
কালীঘাটের ছেলে। ওর আসল নাম নয়ন; জ্যোতিষ্ক নামটা আমিই দিয়েছি; বিজ্ঞাপনেও জ্যোতিষ্কই ব্যবহার করছি। কথাটা আপনাদের বললুম, আপনারা কাইন্ডলি আর কাউকে বলবেন না।
না না, বলল ফেলুদা। কিন্তু শুধু কালীঘাট বললে তো কিছুই বলা হল না।
বাপ অসীম সরকার থাকেন নিকুঞ্জবিহারী লেনে! ছেলের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে আমার কাছে নিয়ে আসেন। যদি আমি ওকে কাজে লাগাতে পারি। আসলে ভদ্রলোক অভাবী, তাই ভাবলেন ছেলেকে দিয়ে যদি কিছু একস্ট্রা ইনকাম হয়।
সেটা যে হবে সে বিষয় আমার কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটি কি বাপের কাছেই থাকে?
আজ্ঞে না। আমি ওকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছি! ওর পড়াশুনোর জন্য টিউটর ঠিক করেছি; কাল এক ডাক্তারকে ডেকেছিলাম, উনি নয়নের ডায়েট বাতলে দিয়েছেন।
এ সব তো রীতিমতো খরচের ব্যাপার!
জানি স্যার। তবে এও জানি যে, নিয়ন ইজ এ গোলন্ডমাইন। ওর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি ধার-দেনাও করতে হয়, সে টাকা ক’দিনের মধ্যে উঠে আসবে।
হুঁ…তবে আইডিয়াল হত যদি আপনি একটি পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করতে পারতেন।
সেটা আমিও বুঝি স্যার। দেখি আর দুটো দিন…
আপনার অনেকটা সময় নিয়েছি। আর মাত্র দুটো কথা বলে আপনাকে রেহাই দেব। এক—এই স্বর্ণখনিটি যাতে বেহাত না হয়, সেদিকে আপনার কড়া নজর রাখতে হবে। সেকেন্ড রো-তে মনে হল। কয়েকজন সাংবাদিককে দেখলাম, তাই না?
ঠিক দেখেছেন, স্যার। এগারোজন সাংবাদিক আজকে আমার শো দেখেছেন। তারা সকলেই আগামী শুক্রবারের সিনেমার পাতায় আমার শোয়ের বিষয় লিখবেন। ইতিমধ্যে কোনও চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হয় না।
যাই হোক, এটা বলে গেলাম যে, যদি নয়ন সম্বন্ধে কোনও এনকোয়ারি বা টেলিফোন আসে যা আপনার মনে খটকা জাগায়, তা হলে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না।
মেনি থ্যাঙ্কস, স্যার। এবার আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।
কী?
এবার থেকে আমায় আপনি না বলে তুমি বলবেন কাইন্ডলি।