Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জটায়ু আর আমার পিছনে যেহেতু কেউ লাগেনি, বিকেলে আমরা দুজনে সমুদ্রের ধারে গেলাম হাওয়া খেতে; হিঙ্গোয়ানির কপালে কী আছে জানি না, তবে এটা মনে হচ্ছে যে, নয়নের আর কোনও বিপদ নেই। যদি তেওয়ারির টাকা ফেরত দিয়েও হিঙ্গোয়ানির কাছে বেশ কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে, তা হলে তরফদারের শো হতে কোনও বাধা নেই। আর প্রথম শো থেকেই তো টিকিট বিক্রির টাকার অংশ আসতে শুরু করবে। মনে হয় হিঙ্গোয়ানি এখনও বেশ কিছু দিন চালিয়ে যাবেন।

জটায়ুকে বলতে তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন, তপশ, আই অ্যাম শকড়। লোকটা একটা ক্রিমিনাল, পরের সিন্দুক থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে, আর সে লোক নয়নকে ভাঙিয়ে খাবে, এটা ভেবে তুমি খুশি হচ্ছে?

খুশি নয়, লালমোহনবাবু। হিঙ্গোয়ানির বিরুদ্ধে যা প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে তো তাকে এই মুহূর্তে জেলে পোরা যায়। কিন্তু তার পার্টনার যদি পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে তার উপর দয়াপরবশ হয়ে তাকে রেহাই দেন-তাতে আমার-আপনার কী বলার আছে?

লোকটা জুয়াড়ি—সেটা ভুলো না। আমার অন্তত কোনও সিমপ্যাথি নেই হিঙ্গোয়ানির উপর।

তেষ্টা পাচ্ছিল দুজনেরই। লালমোহনবাবু কোল্ড কফি খাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এখানকার কফিটা একটা প্লাস পয়েন্ট সেটা স্বীকার করতেই হবে।

সমুদ্রের কাছেই একটা কাফে আবিষ্কার করে আমরা একটা টেবিল দখল করে বেয়ারাকে কোন্ড কফি আড়ার দিলাম। কাফেতে অনেক লোক, বুঝলাম। এদের ব্যবসা ভালই চলে।

মিনিটখানেকের মধ্যে ঠকঠক করে দুটো গেলাস এসে পড়ল আমাদের টেবিলের উপর। আমরা দুজনেই ঘাড় নিচু করে প্লাস্টিকের স্ট্রয়ের ডগা ঠোঁটের মধ্যে পুরে দিলাম।

হ্যাভ ইউ টোল্ড ইয়োর টিকটিকি ফ্রেন্ড?

লালমোহনবাবু একটা বিশ্ৰী শব্দ করে বিষম খেলেন।

মুখ তুলেই দেখি টেবিলের উলটাদিকে চকুরা-বকরা হাওয়াইয়ান শার্ট পরে দণ্ডায়মান মিস্টার নন্দলাল বসাক।

লালমোহনবাবু সামলে নিতে ভদ্রলোক বললেন, শুধু এইটে বলে দেবেন। মিত্তিরকে এবং তরফদারকে যে, নন্দ বসাক পায়ের তলায় ঘাস গজাতে দেয় না। পাঁচিশে ডিসেম্বর যদি শো হয়, তা হলে সেই শো থেকে শেষের আইটেমটি বাদ যাবে, এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।

আমাদের পাশেই কাফের দরজা। ভদ্রলোক কথাটা বলেই সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে অন্ধকার, তাই তিনি যে কোনদিকে গেলেন সেটা বুঝতেই পারলাম না।

তেষ্টা মেটেনি, তাই কফিটা শেষ করে দাম চুকিয়ে আমরা আর দশ মিনিটের মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে হোটেলমুখে রওনা হলাম।

হোটেলে পৌঁছতে লাগল আধঘণ্টা। ভিতরে ঢুকে দেখি লবি লোকে লোকারণ্য। শুধু লোক নয়, তার সঙ্গে অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাঁড় করানো অজস্র লাগেজ। বাঝাই যাচ্ছে, একটা বিদেশি টুরিস্ট দল সবেমাত্র এসে পৌঁছেছে। ফেলুদাকে বসাকের খবরটা এক্ষুনি দিত হবে, তাই আমরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে লিফটে ঢুকে চার নম্বর বাতামটা টিপে দিলাম।

চারশো তেত্ৰিশের সামনে গিয়েই বুঝলাম, ঘরে ফেলুদা ছাড়াও অন্য লোক আছে, আর বেশ গলা উচিয়ে কথাবাতা হচ্ছে।

বেল টেপার প্রায় পনেরো সেকেন্ড। পরে দরজা খুলল ফেলুদা, আর আমাকে সামনে পেয়েই এক রামধমক।

দরকারের সময় না পাওয়া গেলে তোরা আছিস কী করতে?

কাঁচুমাচু ভাবে ঘরে ঢুকে দেখি, মাথায় হাত দিয়ে কাউচে বসে আছেন সুনীল তরফদার।

ব্যাপারটা কী মশাই? ভয়ে ভয়ে শুধোলেন জটায়ু।

সেটা ঐন্দ্রজালিককে জিজ্ঞেস করুন, শুকনো গভীর গলায় বলল ফেলুদা।

কী মশাই?

আমিই বলছি। বলল ফেলুদা। ওর মুখ দিয়ে কথা বেরোবে না। খচু করে লাইটার দিয়ে ঠোঁটে ধরা চারমিনারটা জ্বলিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফেলুদা বলল, নয়ন হাওয়া। কিড়নাপড়। ভাবতে পারিস? এর পরেও ফেলু মিত্তিরের মান-ইজ্জত থাকবে? পই পই করে বলে দিয়েছিলাম ঘর থেকে যেন না বেরোয়, নয়ন যেন ঘর থেকে না বেরোয়। –আর এই ভর সন্ধেবেলা-গিজগিজ করছে লবি, তার মধ্যে শঙ্করবাবু নয়নকে নিয়ে গেছেন বুকশপে।

তারপর?—আমার বুকের ধুকপুকুনি আমি কানে শুনতে পাচ্ছি।

বাকিটা বলে চমকদার মশাই, বাকিটা বলো! নাকি এই কাজটাও আমার উপর ছাড়তে হবে?

ফেলুদাকে এত রাগতে আমি অনেকদিন দেখিনি।

তরফদার হেঁট মাথা অনেকটা তুলে চাপা গলায় বললেন, নয়ন এক ঘরে বসে অস্থির হয়ে পড়ে বলে শঙ্কর ওর জন্য গল্পের বই কিনতে গিয়েছিল। বই পেয়েও ছিল। দোকানের মেয়েটি দুটো বই প্যাক করে ক্যাশ মেমো করে দিচ্ছিল-শঙ্কর তাই দেখছিল। হঠাৎ মেয়েটি বলে ওঠে-দ্যাট বয়? হায়্যার ইজ দ্যাট বয়?-শঙ্কর পিছন ফিরে দেখে নয়ন নেই; ও তৎক্ষণাৎ দোকান থেকে বেরিয়ে লবিতে খোঁজে, নয়নের নাম ধরে ডাকে, একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কোনও ফল হয় না। লবিতে এত ভিড়–তার মধ্যে একজন ন বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে…

এটা কখনকার ঘটনা?

সেখানেই বলিহারি! চেঁচিয়ে উঠল ফেলুদা! দেড় ঘণ্টা আগে ব্যাপারটা ঘটেছে, আর সুনীল এই সবে দশ মিনিট হল এসে আমাকে রিপোর্ট করছে। –হুঁ!

বসাক, বললেন জটায়ু। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট।

আপনি দেখি ভয়ংকর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কালছেন কথাটা।

আমি কাফের ঘটনাটা ফেলুদাকে বললাম। ফেলুদা গম্ভীর।

আই সি…আমি এটাই আশঙ্কা করেছিলাম। অর্থাৎ কুকীর্তিটা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তোদের সঙ্গে দেখা হয়। হুঁ…

শঙ্করুবাবু কোথায়? জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।

তরফদার মাথা না তুলেই বলল, থানায়।

শুধু পুলিশে খবর দিলে তো চলবে না, বলল ফেলুদা, তোমার পৃষ্ঠপোষক আছে, তোমার থিয়েটারের মালিক আছেন। তিনি কি নয়ন ছাড়া শো করতে রাজি হবেন? আই হ্যাভ গ্রেট ডাউটস।

তা হলে হিঙ্গোয়ানিকে…

জটায়ু একবার ফেলুদার, একবার তরফদারের দিকে চাইলেন।

তাঁকে খবর দেবার সাহস নেই। এই সম্মোহক প্রবারের। বলছে—আপনি কাইন্ডলি কাজটা করে দিন, মিস্টার মিত্তির! আমি গেলে সে লোক আমাকে টুটি টিপে মেরে ফেলবে।

শুনুন— লালমোহনবাবু হঠাৎ যেন ঘুম থেকে উঠলেন—আপনারও যেতে হবে না, সুনীলবাবুরও যেতে হবে না। আমরা যাচ্ছি। —কী তপেশ, রাজি তো?

ফেলুদা ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট আর কপালে ভ্রূকুটি নিয়ে সাফায় বসে পড়ে বলল, যেতে হলে এখনই যান। তোপ্‌সে, তুই ইংরেজিতে হেলপ করিস।

হিঙ্গোয়ানির ঘরের নম্বর দুশো আটাশি। আমরা সিঁড়ি দিয়েই নেমে গিয়ে তাঁর দরজায় বেল টিপলাম।

দরজা খুলল না।

সময়-সময় এই বেলগুলো ওয়র্ক করে না, বললেন জটায়ু। এবার বেশ জোরে চাপ দিয়ে তো।

আমি বললাম, ভদ্রলোকের তো বেরোবার কথা না। ঘুমোচ্ছেন নাকি?

তিনবার টেপাতেও যখন ফল হল না, তখন আমাদের বাধ্য হয়ে লবিতে গিয়ে হাউস টেলিফোনে ২৮৮ ডায়াল করতে হল।

ফোন বেজেই চলল। নো রিপ্লাই।

ইতিমধ্যে লালমোহনবাবু রিসেপশনে গিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করতে। তারা বলল—মিঃ হিঙ্গোয়ানি নিশ্চয়ই ঘরেই আছেন। কারণ, তাঁর চাবি এখানে নেই।

এবার জটায়ুর মুখ দিয়ে তোড়ে ইংরিজি বেরোল, ভাষা টেলিগ্রামের।

বাট ইম্পর্ট্যান্ট সি হিঙ্গোয়ানি-ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। নো ডুপ্লিকেট কি? নো ডুপ্লিকেট কি?

কাজটা খুব খুশি মনেই করে দিল রিসেপশনের লোকেরা।

চাবি হাতে বয়কে সঙ্গে নিয়ে আমরা লিফটে দোতলায় উঠে আবার হিঙ্গোয়ানির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ইয়েল লক চাবি ঘোরাতেই খড়াৎ করে খুলে গেল, বয় দরজা ঠেলে দিল, আমি বললাম থ্যাঙ্ক ইউ, জটায়ু আমার আগেই ঘরে ঢুকে তৎক্ষণাৎ তড়িাক করে পিছিয়ে আমারই সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। তার পর অদ্ভুত স্বরে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তিন টুকরো কথা বেরোল।

হিং-হিং-হিক।

ততক্ষণে আমিও ভিতরে ঢুকে গেছি, আর দৃশ্য দেখে এক নিমেষে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

খাটের উপর চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন মিঃ হিঙ্গোয়ানি। তাঁর পা দুটো অবিশ্যি নীচে নেমে মেঝের কার্পেটে ঠেকে আছে। তাঁর গায়ে যে লাল নীল সাদা আলোর খেলা চলেছে, সেটার কারণ হচ্ছে বাঁয়ে টেবিলের উপর রাখা টিভি-যেটাতে হিন্দি ছবি চলেছে, যদিও কোনও শব্দ নেই। ভদ্রলোকের বোতাম খোলা জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সাদা শার্টের উপর ভেজা লাল ছোপ, আর তার মাঝখানে উঁচিয়ে আছে একটা ছোরার হাতল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress