একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে
একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে। তার সঙ্গে এই মাত্র যোগ হল শেয়ালের ড্রাক। আমার মনে হল এত নির্জন জায়গায় এর আগে কখনও আসিনি।
জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হওয়া আসছিল, ফেলুদা পাল্লা দুটো বন্ধ করতেই একটা মটারের অ্যাওয়াজ পেলাম। এটা অন্য গাড়ি, সেই বিশাল প্রাচীন আমেরিকান গাড়ি নয়।
বিশ্বনাথ মজুমদার এলেন বলে মনে হচ্ছে ফেলুদা মন্তব্য করল। তার মানে এবার খেতে ডাকবে। সত্যি বলতে কী, বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। একটায় ট্রেন ধরব বলে। সকালে খেয়ে বেরিয়েছি; পথে রাণাঘাট স্টেশনে অবিশ্যি মিষ্টি আর চা খেয়ে নিয়েছিলাম। হয়তো এমনিতে খিদে পেত না, কারণ ঘড়িতে বলছে সবেমাত্র আটটা বেজেছে, কিন্তু এখানে তো আর কিছু করার নেই-এমন কী লন্ঠনের আলোতে বইও পড়া যাবে না।–তাই মনে হচ্ছিল খেয়ে-দোয়ে কম্বলের তলায় ঢুকতে পারলে মন্দ হয় না।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এবার দেখলাম আমাদের ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি রয়েছে, আর ফেলুদা সেটার দিকে চেয়ে আছে। ফোটো নয়; আঁকা ছবি আর বেশ বড়। সেটা যে কালীকিঙ্করবাবুর পূর্বপুরুষের ছবি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খালি গায়ে বসে আছেন বাবু চেয়ারের উপর; পাকানো গোঁফ, কাঁধ অবধি লম্বা চুল, টানাটানা চোখ, আর বিরাট চওড়া কাঁধ।
মুগুর ভাঁজা কুস্তি করা শরীর, ফিস ফিস্ করে বলল ফেলুদা। মনে হচ্ছে ইনিই সেই প্রথম ডাকাত জমিদার।
বাইরে পায়ের শব্দ। আমরা দুজনেই দরজার দিকে চাইলাম। গোকুল বাইরে একটা লণ্ঠন, রেখে গিয়েছিল, তার আলোটা ঢেকে প্রথমে একটা ছায়া ঘরের মেঝেতে পড়ল, আর তারপর একটা অচেনা মানুষ চৌকাঠের বাইরে এসে দাঁড়াল।
ইনিই কি বিশ্বনাথ মজুদার? না, হতেই পারে না। খাটা করে পর ধূতি, গায়ে ছাই রঙের পাঞ্জাবি, ঝুপে গোঁফ আর চোখে পুরু চশমা। ভদ্রলোক গলা বাড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বোধহয় আমাদের খুঁজছেন।
কিছু বলবেন রাজেনবাবু? ফেলুদা প্রশ্ন করল?
ভদ্রলোক যেন এতক্ষণে আমাদের দেখতে পেলেন। এবার সর্দি-বসা গলায় কথা এল—
ছোটবাবু ফিরেছেন। ভাত দিতে বলেছি; গোকুল আপনাদের খবর দেবে।
রাজেনবাবু চলে গেলেন।
কীসের গন্ধ বলো তো? আমি জিজ্ঞেস করলাম ফেলুদাকে।
বুঝতে পারছিস না? ন্যাফথ্যালিন। গরম পাঞ্জাবিটা সবেমাত্র বার করেছে ট্রাঙ্ক থেকে।
রাজেনবাবুর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার বুঝতে পারলাম। আমরা কী আশ্চর্য থমথমে পরিবেশের মধ্যে রয়েছি। এরকম জায়গায় দিনের পর দিন মানুষ থাকে কী করে? ফেলুদা পাশে থাকলে সাহসের অভাব হবে না জানি, কিন্তু না থাকলে এই আদ্যিকালের পোড়ো জমিদার বাড়িতে পাঁচ মিনিটও থাকার সাধ্যি হত না আমার। কালীকিঙ্করবাবু আবার নিজেই বললেন এ বাড়িতে নাকি এককালে খুন হয়েছিল। কোন ঘরে কে জানে!
ফেলুদা এর মধ্যে লণ্ঠন সমেত টেবিলটাকে কাছে টেনে এনে খাটে বসে খাতা খুলে সংকেত নিয়ে ভাবা শুরু করে দিয়েছে। দু-একবার যেন ত্রিনয়ন বলে বিড়বিড় করতেও শুনলাম। আমি আর কী করি, দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
ওটা কী? বুকটা ধড়াস করে উঠল। কী জানি একটা নড়ে উঠেছে বারান্দার ওদিকটায়-যেখানে লণ্ঠনের আলো অন্ধকারে মিশে গেছে।
দাঁত দাঁতে চেপে রইলাম অন্ধকারের দিকে। এবার বুঝলাম ওটা একটা বেড়াল। ঠিক সাধারণ সাদা বা কালো বেড়াল নয়; এটার গায়ে বাঘের মতো ডোরা। বেড়ালটা কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টি চেয়ে থেকে একটা হাই তুলে উলটা দিকে ফিরে হেলতে দুলতে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কিছু পরেই শুনলাম কৰ্কশ গলায় টিয়ার ডাক। তারপরেই আবার সব চুপচাপ। বিশ্বনাথ বাবুর ঘরটা কোথায় কে জানে। তিনি কি দোতলায় থাকেন না একতলায়? রাজেনবাবুই বা কোথায় থাকেন? আমাদের এমন ঘর দিয়েছে কেন যেখান থেকে কারুর কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না?
আমি ঘরে ফিরে এলাম! ফেলুদা খাটের উপর পা তুলে দিয়ে খাতা হাতে নিয়ে ভাবিছে! আর না পেরে বললাম, এরা এত দেরি করছে কেন বলে তো?
ফেলুদা ঘড়ি দেখে বলল, তা মন্দ বলিসনি। প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল। বলেই আধার খাতার দিকে মন দিল।
আমি ফেলুদার পাওয়া বইগুলো উলটে-পালটে দেখলাম। একটা বই আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে, একটার নাম ক্রিমিনালজি, আর একটা ক্রাইম অ্যান্ড ইটস ডিটেকশন। চার নম্বর বইটার নামের মানেই বুঝতে পারলাম না। তবে এটায় অনেক ছবি রয়েছে, তার মধ্যে পর পর দশ পাতায় শুধু বিভিন্ন রকমের পিস্তল আর বন্দুক। ফেলুদা রিভলভারটা সঙ্গে এনেছে কি?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মনে পড়ল ফেলুদা তো গোয়েন্দাগিরি করতে আসেনি; আর সেটার কোনও প্রয়োজনও নেই। কাজেই রিভলভারেরই বা দরকার হবে কেন?
বইগুলো সুটকেসে রেখে খাটে বসতে যাব, এমন সময় আচমকা অচেনা গলার আওয়াজ পেয়ে বুকটা আবার ধড়াস করে উঠল।
এবারের লোকটিকে চেনায় কোনও অসুবিধা নেই। ইনি গোকুল নন, রাজেনবাবু নন; গাড়ির ড্রাইভার নিন, আর রান্নার ঠাকুর তো ননই। কাজেই ইনি বিশ্বনাথবাবু ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।
আপনাকে অনেক দেরি করিয়ে দিলাম, ভদ্রলোক ফেলুদাকে নমস্কার করে বললেন। আমার নাম বিশ্বনাথ মজুমদার।
সেটা আমার বলে দিতে হয় না। ধাপের সঙ্গে বেশ মিল আছে চেহারায়। বিশেষ করে। চোখ আর নাকে। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে, মাথার চুল এখনও সবই কাঁচা, গোঁফ-দাড়ি নেই, ঠোঁট দুটো অসম্ভব রকম পাতলা। ভদ্রলোককে আমার ভাল লাগল না। কেন ভাল লাগল না সেটা অবিশ্যি বলা মুশকিল। একটা কারণ বোধহয় উনি আমাদের এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছেন, আর আরেকটা কারণ—যদিও এটা ভুল হতে পারে—ভদ্রলোক আমাদের দিকে চেয়ে হাসলেও সে হাসিটা কেন জানি খাঁটি বলে মনে হল না; যেন আসলে সত্যি করে। আমাদের দেখে খুশি হননি, সেটা হবেন আমরা চলে গেলে পর।
ফেলুদা আর আমি বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে নীচে নেমে সোজা গিয়ে হাজির হলাম খাবার ঘরে; আমি ভেবেছিলাম মাটিতে বসে খেতে হবে—এখন দেখছি বেশ বড় একটা ডাইনিং টেবিল রয়েছে, আর তার উপরে রুপোর থালা বাটি গেলাস সাজানো রয়েছে।
যে-যার জায়গায় বসার পর বিশ্বনাথবাবু বললেন, আমার আবার কি শীত কি গ্ৰীষ্ম দুবেলা চান করার অভ্যাস, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
ভদ্রলোকের গা থেকে দামি সাবানের গন্ধ পেয়েছি আগেই; এখন মনে হচ্ছে বোধহয় সেন্টও মেখে এসেছেন। বেশ শৌখিন লোক সন্দেহ নেই। সাদা সিস্কের শার্টের উপর গাঢ় সবুজ রঙের হাত কাটা কার্ডিগ্যান, আর তার সঙ্গে ছাই রঙের টেরিলিনের প্যান্ট।
বাট চাপা ভাত ভেঙে মোচার ঘণ্ট দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। থার্লার চারপাশে গোল করে সাজানো বাটিতে রয়েছে আরও তিন রকমের তরকারি, সোনা মুগের ডাল, আর রুই মাছের বোল।
বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন বিশ্বনাথবাবু।
হ্যাঁ, বলল ফেলুদা। উনি আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন।
বই উপহার দিয়ে?
হ্যাঁ। আজকের বাজারে ওই বই যদি পাওয়াও যেত, তা হলে দাম পড়ত কমপক্ষে পাঁচ-সাত শো টাকা।
বিশ্বনাথবাবু হেসে বললেন, আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন জেনে আমি বাবাকে বেশ একটু ধমকই দিয়েছিলাম। শহুরে লোকদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে ডেকে এনে কষ্ট দেবার কোনও মনে হয় না।
ফেলুদা কথাটার প্রতিবাদ করল।
কী বলছেন মিস্টার মজুমদার। আমার তো এখানে এসে দারুণ লাভ হয়েছে। কষ্টের কোনও কথাই ওঠে না।
বিশ্বনাথবাবু ফেলুদার কথায় তেমন আমল না দিয়ে বললেন, আমার তো এই চার দিনেই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে। বাবা যে কী করে একটানা এতদিন রয়েছেন জানি না।
বাইরে একবারেই যান না?
শুধু তাই না। বেশির ভাগ সময়ই ওঁর এই অন্ধকার ঘরে খাটের উপর শুয়ে থাকেন। দিনে কেবল দুবার কিছুক্ষণের জন্য বাগানে গিয়ে বসেন। এখন অবিশ্যি শরীরের জন্য সেটাও বন্ধ।
আপনি আর ক’দিন আছেন?
আমি? আমি কালই যাব। বাবার এখন ইমিডিয়েট কোনও ডেঞ্জার নেই। আপনারা তো বোধহয় সাড়ে আটটার ট্রেনে ফিরছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে আপনারাও যাবেন, আর আমিও বেরোব।
ফেলুদা ভাতে ডাল ঢেলে বলল, আপনার বাবার তো নানারকম শখ দেখলাম; আপনি নিজে কি একেবারে সেন্ট পার্সেন্ট ব্যবসাদার?
হ্যাঁ মশাই। কাজকৰ্ম্ম করে আর অন্য কিছু করার প্রবৃত্তি থাকে না।
বিশ্বনাথবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা যখন ঘরে ফিরে এলাম তখন বেজেছে প্রায় সাড়ে নটা। এখানে ঘড়ির টাইমের আর কোনও মানে নেই। আমার কাছে, কারণ সাতটা থেকেই মনে হচ্ছে মাঝরাত্তির।
ফেলুদাকে বললাম, বালিশগুলোকে উলটা দিকে করে শুলে তোমার কোনও আপত্তি আছে?
কেন বল তো?
তা হলে আর চোখ খুললেই ডাকাতবাবুটকে দেখতে হবে না।
ফেলুদা হেসে বলল, ঠিক আছে। আমার কোনও আপত্তি নেই। ভদ্রলোকের চাহনিটা যে আমারও খুব ভাল লাগছিল তা বলতে পারি না।
শোবার আগে ফেলুদা লন্ঠনের আলোটাকে কমিয়ে দিল, আর তার ফলে ঘরটাও যেন আরও ছোট হয়ে গেল।