খুনের জায়গা
খুনের জায়গা (এখন থেকে আর অ্যাক্সিডেন্ট বলব না) থেকে হোটেলে ফিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল ওর একটু কাজ আছে–একটু পরে ফিরবে। আমি জানি যে যদি জিজ্ঞেস করি কী কাজ তা হলে উত্তর পাব না।
আমরা ফেরার পথে চৌমাথায় হেলমুটের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তাকে রুমটেকের নাচের কথা বলতে সেও যেতে চাইল। আর যাবেন নিশিকান্তবাবু। কোথায় গেলেন ভদ্রলোক? আর তার সেই হিজিবিজি তিব্বতি লেখার মানে করারই বা কী হ’ল?
একবার মনে হল ফেলুদা না আসা পর্যন্ত বাজারের রাস্তায় পায়চারি করে কাটিয়ে দিই। তারপর মনে হল–নাঃ, হোটেলেই যাই। সঙ্গে একটা গল্পের বই এনেছি, ঘরে বসে সেটা পড়তে পড়তেই ফেলুদা এসে যাবে।
হোটেলে চুকতেই দেখলাম নিশিকাস্তুবাবু গোমড়া মুখ করে ডাইনিং রুমে বসে আছেন। অবিশ্যি আমাকে দেখেই তাঁর সে পুরনো হাসি ফিরে এল। বললেন, ‘দাদা কই?’ বললাম, ‘একটু কাজে বেরিয়েছেন; আসবেন এক্ষুনি৷’
‘তোমার দাদার গায়ে খুব জোর, তাই না?’
এ আবার কী রকম প্রশ্ন করেন। ভদ্রলোক? আমি কিছু বলার আগেই আবার বললেন, ‘উনি ভরসা দিচ্ছেন বলেই রয়ে গেলুম; তা না হলে আজই পাততাড়ি গুটিয়ে দাৰ্জিলিং পালাতুম?’
‘কেন?’
ভদ্রলোক হাত কচলাতে শুরু করেছেন। বুঝলাম তাঁর নার্ভাসনেসটা আবার ফিরে এসেছে।
ভদ্রলোক এ দিক ও দিক দেখে আবার পকেট থেকে সেই কাগজটা বার করলেন। ‘জানি ভাই–সাতজন্মে কারুর কোনও অনিষ্ট করিনি, অথচ এ রকম শাসনি শেষটায় আমাকেই দিলে!’
‘ওটার মানে বের করেছেন নাকি?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘একটা অ্যাং-মানে অ্যাংজাইটি ছিল, তাই সোজা চলে গেলুম তিব্বত ইনস্টিটিউটে। কাগজটা দেখালুম। কী বললে জান? বললে এ লেখাটার মানে হচ্ছে ‘মৃত্যু। গিয়াংফুং–না। ওই জাতীয় একটা কী তিব্বতি কথা। মানে হচ্ছে ডেথ। থার্টি সেভেনে আমার একটা ফাঁড়া আছে তাও জানি।’
আমার একটু বিরক্ত লাগল। বললাম, ‘শুধু তো বলেছে মৃত্যু৷ এমন তো বলেনি যে আপনাকেই মরতে হবে।’
ভদ্রলোক হঠাৎ যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন।
‘তাও বটে। মৃত্যু মানে তো এনিবডিজ ডেথ হতে পারে।–তাই না?’
‘কাগজে লেখা আছে বলেই যে কাউকে মরতেই হবে তারই বা কী মানে আছে?’
কিন্তু তাও যেন ভদ্রলোক ভরসা পেলেন না! আবার তাঁর মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে প্রায় নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘দক্ষিণের জানালাটা খোলা ছিল.ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল, তার মানে হাওয়া ছিল…বাইরের জিনিস হাওয়ার সঙ্গে ঘরের ভিতর এসে পড়তে পারে। এটা যদি এমনি উট্কো কাগজের টুকরো হয়…হয়তো ছেড়া পুঁথিটুথির পাতা–কাছাকাছি তো ছোটখাটো গুম্ফাও রয়েছে…একটা তো শহরে ঢোকার মুখটাতেই…হুঁ…হুঁ…’
আমি আর কাল রাত্রে জানালা দিয়ে কী দেখেছি সেটা বললাম না। তা হলে যেটুকু ভরসা পাচ্ছেন ভদ্রলোক, তাও আর পেতেন না। শেষে যেন আর ভাবতে না পেরেই ভদ্রলোক জোর করে তাঁর মন থেকে দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘যাকগে! তোমার দাদাই তো রয়েছেন। বেশ কনফিডেন্স পাওয়া যায়। ভদ্রলোককে দেখে। খেলোয়াড়-টেলোয়াড় ছিলেন নাকি? না, এক্সারসাইজ করেন?’
‘এককালে ক্রিকেট খেলেছেন। এখন যোগব্যায়াম করেন৷’
‘ঠিক ধরেচি। আজকালকার বাঙালিদের মধ্যে আমন ফিট বডি চোখে পড়ে না। চা খাবে?’
পাহাড়ে ওঠানামা করতে বেশ পরিশ্রম হয়েছিল, তাই বললাম চায়ে আপত্তি নেই।
ভদ্রলোক বেয়ারাকে ডেকে দু কাপ চা অর্ডার দিলেন। চা এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ফেলুদা ফিরে এল। আসার দশ সেকেন্ডের মধ্যেই নিশিকান্তবাবু তাঁর ‘মৃত্যু’-র কথাটা ফেলুদাকে বলে দিলেন।
ফেলুদা আরেকবার কাগজটা দেখে বলল, ‘আপনাকে এতটা ইস্পার্ট্যান্স দিচ্ছে কেন সেটা আঁচ করতে পারছেন?’
নিশিকান্তবাবু মাথা নাড়লেন, ‘আমি স্যার আকাশ-পাতাল ভেবেও এর কুল-কিনারা করতে পারছি না।’
ফেলুদা বলল, ‘আর ভাববেন না। কারণ না থাকলে কেউ কারুর মৃত্যু কামনা করে না। আমার বিশ্বাস ওটা যে-ই ফেলে থাকুক না কেন, ঝড়ের রাতে অন্ধকারে ভুল করে ভুল ঘরে ফেলেছে। তিব্বতি তিব্বতিকেই তিব্বতি ভাষায় শাসায়। আপনাকে শাসতে হলে যে ভাষা আপনি জানেন তাতেই শাসানো স্বাভাবিক। নইলে তো শাসনি মাঠে মারা—তাই নয় কি?’
‘তা তো বটেই।‘
‘ব্যস-নিশ্চিন্ত থাকুন।’
‘আর গোলমাল হলে আপনি তো আছেনই।’
‘আমি থাকলে কিন্তু গোলমালটা মাঝে-মধ্যে একটু বেশিই হয়৷’
‘তাই বুঝি?’
ভদ্রলোকের মুখ আবার ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
ফেলুদা আর কোনওরকম সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা না করে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। আমি জানি কাঁদুনে ভিতু লোকদের ফেলুদা বরদাস্ত করতে পারে না। নিশিকান্তবাবু যদি ওর সিমপ্যাথি পেতে চান, তা হলে ওঁকে কাঁদুনি বন্ধ করতে হবে।
আমি চা শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখি ফেলুদা আবার তার নীল খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে। আমি ঢুকতেই বলল, ‘টেলিগ্ৰাফ অফিসগুলোতে বেশির ভাগ লোকই যে অশিক্ষিত সেটা আগেই জানা ছিল—তবে এটা একটু বেশি রকম বাড়াবাড়ি।’
‘হঠাৎ টেলিগ্ৰাফ আপিসে কেন?’
‘শশধরবাবুকে একটা কেব্ল করে দিলাম। ও পৌঁছবার আগেই অবিশ্যি পৌঁছে যাবে–তাও দেরি করে কোনও লাভ নেই৷’
‘কী লিখলে?’
‘হ্যাভ্ রিজন টু সাসপেক্ট শেলভাঙ্কারস ডেথ নট অ্যাক্সিডেন্টাল। অ্যাম ইনভেসটিগেটিং৷’
‘বাড়াবাড়িটা কীসে দেখলে।’
‘ও! সে অন্য ব্যাপার।’
ফেলুদা নাকি টেলিগ্ৰাফ আপিসে কেরানিদের ঘুষ দিয়ে গত ক’ দিনে শেলভাঙ্কারের নামে কোনও টেলিগ্রাম এসেছিল কি না সেটা জেনে নিয়েছে। একটা ছিল শশধর বাবুর টেলিগ্ৰাম—‘অ্যাম অ্যারাইভিং ফোর্টিন্থ।’
‘আর অন্যটা?’
‘পড়ে দ্যাখ’—বলে ফেলুদা তার নীল খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে
YOUR SON MAYBE IS A SICK MONSTER…PRITEX.
পড়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। সিক্ মনস্টার? রুগ্ণ রাক্ষস? সে আবার কী?
ফেলুদা বলল, ‘বোঝাই যাচ্ছে যে কোনও গোলমাল করেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে—কী গোলমাল। আসল টেলিগ্রামটা কী ছিল৷’
ফেলুদা বলল, ‘ওটা বোধহয় ছাপার ভুল নয়। মনে হয়, ওটা কোনও গোয়েন্দা এজেন্সির টেলিগ্রাফিক অ্যাড্রেস। PRI অর্থাৎ প্রাইভেট, আর TEX হল TEC-এর বহুবচন। TEC মানে যে ডিটেকটিভ সেটা নিশ্চয়ই তোকে বলে দিতে হবে না।’
‘এই টেলিগ্রামটা পেয়েই কি শেলভাঙ্কার ঘাবড়ে গিয়েছিল?’
‘কিছুই আশ্চর্য না।’
‘আর তার মানে এই এজেন্সিটা শেলভঙ্কারের ছেলের খোঁজ করছিল?’
‘তই তো মনে হয়। কিন্তু Sick Monste! হরি হরি!’
আমি বললাম, ‘কতগুলো রহস্য এক সঙ্গে সমাধান করবে বলো তো।’
ফেলুদা বলল, ‘সেইটেই তো ভাবছি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এইবেলা খাতায় নোট করে ফেলা উচিত। বল তো দেখি একটা একটা করে।’
‘এক–Sick Monster।’
‘তারপর?
‘পাথর কে ফেলল?’
‘গুড।‘
‘তিন—মূর্তিটা কোথায় গেল।’
‘ঠিক হ্যায়।’
‘চার–নিশিকান্তবাবুর ঘরে কাগজ কে ফেলল।’
‘আর, কেন ফেলল। বহুত আচ্ছা৷’
‘পাঁচ–খুনের জায়গায় কার বোতাম।’
‘অবিশ্যি সেটা শেলভাঙ্কারের নিজের শার্টের বোতামও হতে পারে। যাই হোক-বলে চল।’
‘ছয়–তিব্বতি ইনস্টিটিউটে গিয়ে, কে মূর্তির কথা জিজ্ঞেস করেছিল৷’
‘স্প্লেনডিড। আর বছর দশেকের মধ্যেই তুই গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে পারবি।’
ফেলুদা ঠাট্টা করলেও বুঝতে পারলাম যে আমি পরীক্ষায় পাশ করেছি।
‘শুধু একটি লোকের সঙ্গে এখন দেখা হওয়া দরকার। মনে হয় তিনি শেলভঙ্কার সম্বন্ধে জরুরি ইনফরমেশন দিতে পারেন৷’
‘কে লোকটা?’
‘ডক্টর বৈদ্য। যিনি ভবিষ্যৎ বলেন, আর প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগ স্থাপন করেন, আর অন্যান্য যাবতীয় ভেলকি প্রদর্শন করেন। শুনেটুনে লোকটাকে ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।‘