দেবী চৌধুরাণী – PART-3
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এদিকে ভবানী ঠাকুরকে বিদায় দিয়া, রঙ্গরাজ সাদা নিশান হাতে করিয়া, জলে নামিয়া লেফটেনাণ্ট সাহেবের ছিপে গিয়া উঠিল। সাদা নিশান হাতে দেখিয়া কেহ কিছু বলিল না। সে ছিপে উঠিলে সাহেব তাহাকে বলিলেন, “তোমরা সাদা নিশান দেখাইয়াছ, ধরা দিবে?”
র। আমরা ধরা দিব কি? যাঁহাকে ধরিতে আসিয়াছেন, তিনিই ধরা দিবেন, সেই কথা বলিতে আসিয়াছি।
সাহেব। দেবী চৌধুরাণী ধরা দিবেন?
র। দিবেন। তাই বলিতে আমাকে পাঠাইয়াছেন।
সা। আর তোমরা?
র। আমরা কারা?
সা। দেবী চৌধুরাণীর দল।
র। আমরা ধরা দিব না।
সা। আমি দলশুদ্ধ ধরিতে আসিয়াছি।
র। এই দল কারা? কি প্রকারে এই হাজার বরকন্দাজের মধ্যে দল বেদল চিনিবেন?
যখন রঙ্গরাজ এই কথা বলিল, তখন ভবানী ঠাকুর বরকন্দাজ সৈন্য লইয়া চলিয়া যান নাই। যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। সাহেব বলিল, “এই হাজার বরকন্দাজ সব সবাই ডাকাইত; কেন না, উহারা ডাকাইতের হইয়া সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে।”
র। উহারা যুদ্ধ করিবে না, চলিয়া যাইতেছে দেখুন।
সাহেব দেখিলেন, বরকন্দাজ সৈন্য পলাইবার উদ্যোগ করিতেছে। সাহেব তর্জন গর্জন করিয়া বলিলেন, “কি! তোমরা সাদা নিশানের ভাণ করিয়া পলাইতেছ?”
রঙ্গরাজ। সাহেব, ধরিলে কবে যে পলাইলাম?
এখনও সিপাহীরা সাহেবের আজ্ঞা না পাইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল।
সাহেব ভাবিতেছিলেন, “উহাদের পশ্চাদ্ধাবিত হওয়া বৃথা। পিছু ছুটিতে ছুটিতে উহারা নিবিড় জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিবে। একে রাত্রিকাল, তাহাতে মেঘাড়ম্বর, জঙ্গলে ঘোর অন্ধকার সন্দেহ নাই। আমার সিপাহীরা পথ চেনে না, বরকন্দাজেরা পথ চেনে। সুতরাং তাহাদের ধরা সিপাহীর সাধ্য নহে।” কাজেই সাহেব সে অভিপ্রায় পরিত্যাগ করিলেন। বলিলেন, “যাক, উহাদের চাই না। যে কথা হইতেছিল, তাই হৌক, তোমরা সকলে ধরা দিবে?”
র। একজনও না। কেবল দেবী রাণী।
সা। পীষ্! এখন আর লড়াই করিবে কে? এই যে কয়জন, তাহারা কি আর পাঁচ শ সিপাহীর সঙ্গে লড়াই করিতে পারিবে? তোমার বরকন্দাজ সেনা ত জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল, দেখিতেছি।
রঙ্গরাজ দেখিল, বাস্তবিক ভবানী ঠাকুরের সেনা জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল।
রঙ্গরাজ বলিল, “আমি অত জানি না। আমায় আমাদের প্রভু যা বলিয়াছেন, তাহাই বলিতেছি। বজরা পাইবেন না, বজরার যে ধন তাহা পাইবেন না, আমাদের কাহাকেও পাইবেন না। কেবল দেবী রাণীকে পাইবেন।
সা। কেন?
র। তা জানি না।
সা। জান আর নাই জান, বজরা এখন আমার, আমি উহা দখল করিব।
র। সাহেব, বজরায় উঠিও না, বজরা ছুঁইও না, বিপদ ঘটিবে।
সা। পুঃ! পাঁচ শ সিপাহী লইয়া তোমাদের জন দুই চারি লোকের কাছে বিপদ!
এই বলিয়া সাহেব সাদা নিশান ফেলিয়া দিলেন। সিপাহীদের হুকুম দিলেন, “বজরা ঘেরাও কর।”
সিপাহীরা পাঁচখানা ছিপ সমেত বজরা ঘেরিয়া ফেলিল। তখন সাহেব বলিলেন, “বজরার উপর উঠিয়া বরকন্দাজদিগের অস্ত্র কাড়িয়া লও”।
এ হুকুম সাহেব উচ্চৈঃস্বরে দিলেন। কথা দেবীর কাণে গেল। দেবীও বজরার ভিতর হইতে উচ্চৈঃস্বরে হুকুম দিলেন, “বজরায় যাহার যাহার হাতে হাতিয়ার আছে, সব জলে ফেলিয়া দাও।”
শুনিবামাত্র, বজরায় যাহার যাহার হাতে অস্ত্র ছইল, সব জলে ফেলিয়া দিল। রঙ্গরাজও আপনার অস্ত্র সকল জলে ফেলিয়া দিল। দেখিয়া সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন, বলিলেন, “চল, এখন বজরায় গিয়া দেখি, কি আছে?”
র। সাহেব, আপনি জোর করিয়া বজরায় যাইতেছেন, আমার দোষ নাই।
সা। তোমার আবার দোষ কি?
এই বলিয়া সাহেব একজন মাত্র সিপাহী সঙ্গে লইয়া সশস্ত্রে বজরায় উঠিলেন। এটা বিশেষ সাহসের কাজ নহে; কেন না, বজরার উপর যে কয়জন লোক ছিল, তাহারা সকলেই অস্ত্র ত্যাগ করিয়াছে। সাহেব বুঝেন নাই যে, দেবীর স্থিরবুদ্ধিই শাণিত মহাস্ত্র; তার অন্য অস্ত্রের প্রয়োজন নাই।
সাহেব রঙ্গরাজের সঙ্গে কামরার দরজায় আসিলেন। দ্বার তৎক্ষণাৎ মুক্ত হইল। উভয়ে ভিতরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে দুই জনেই বিস্মিত হইলেন।
দেখিলেন, যে দিন প্রথম ব্রজেশ্বর বন্দী হইয়া এই ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সে দিন যেমন ইহার মনোহর সজ্জা, আজিও সেইরূপ; দেয়ালে তেমনি চারু চিত্র। তেমনি সুন্দর গালিচা পাতা। তেমনি আতরদান, গোলাবপাশ, তেমনি সোণার পুষ্পপাত্রে ফুল ভরা, সোণার আলবোলায় তেমনি মৃগনাভিগন্ধি তামাকু সাজা। তেমনি রূপার পুতুল, রূপার ঝাড়, সোণার শিকলে দোলান সোণার প্রদীপ। কিন্তু আজ একটা মসনদ নয়–দুইটা। দুইটা মসনদের উপর সুবর্ণমণ্ডিত উপাধানে দেহ রক্ষা করিয়া দুইটি সুন্দরী রহিয়াছে। তাহাদের পরিধানে মহার্ঘ বস্ত্র, সর্বাঙ্গে মহামূল্য রত্নভূষা। সাহেব তাদের চেনে না–রঙ্গরাজ চিনিল। চিনিল যে, একজন নিশি–আর একজন দিবা।
সাহেবের জন্য একখানা রূপার চৌকি রাখা হইয়াছিল, সাহেব তাহাতে বসিলেন। রঙ্গরাজ খুঁজিতে লাগিলেন, দেবী কোথা? দেখিলেন, কামরার এক ঘরে দেবীর সহজ বেশে দেবী দাঁড়াইয়া আছে, গড়া পরা, কেবল কড় হাতে, এলোচুল, কোন বেশভূষা নাই।
সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে দেবী চৌধুরাণী? কাহার সঙ্গে কথা কহিব?”
নিশি বলিল, “আমার সঙ্গে কথা কহিবেন। আমি দেবী।”
দিবা হাসিল, বলিল, “ইংরেজ দেখিয়া রঙ্গ করিতেছিস? এ কি রঙ্গের সময়? লেফটেনান্ট সাহেব! আমার এ ভগিনী কিছু রঙ্গ-তামাশা ভালবাসে, কিন্তু এ তার সময় নয়। আপনি আমার সঙ্গে কথা কহিবেন–আমি দেবী চৌধুরাণী।”
নিশি বলিল, “আ মরণ! তুই কি আমার জন্য ফাঁসি যেতে চাস না কি?” সাহেবের দিকে ফিরিয়া নিশি বলিল, “সাহেব, ও আমার ভগিনী–বোধ হয়, স্নেহবশতঃ আমাকে রক্ষা করিবার জন্য আপনাকে প্রতারণা করিতেছে। কিন্তু কেমন করিয়া মিথ্যা প্রবঞ্চনা করিয়া, বহিনের প্রাণদণ্ড করিয়া, আপনার প্রাণ রক্ষা করিব? প্রাণ অতি তুচ্ছ, আমরা বাঙ্গালীর মেয়ে, অক্লেশে ত্যাগ করিতে পারি। চলুন, আমাকে কোথায় লইয়া যাইবেন, যাইতেছি। আমিই দেবী রাণী।”
দিবা বলিল, “সাহেব! তোমার যিশুখ্রীষ্টের দিব্য, তুমি যদি নিরপরাধিনীকে ধরিয়া লইয়া যাও। আমি দেবী।”
সাহেব বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি তামাশা? কে দেবী চৌধুরাণী, তুমি যথার্থ বলিবে?”
রঙ্গরাজ কিছু বুঝিল না, কেবল অনুভব করিল যে, ভিতরে একটা কি কৌশল আছে। অতএব বুদ্ধি খাটাইয়া সে নিশিকে দেখাইয়া, হাতজোড় করিয়া বলিল, “হুজুর! এ-ই যথার্থ দেবী রাণী।”
তখন দেবী প্রথম কথা কহিল। বলিল, “আমার ইহাতে কথা কহা বড় দোষ। কিন্তু কি জানি, এর পর মিছা কথা ধরা পড়িলে, যদি সকলে মারা যায়, তাই বলিতেছি, এ ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা সত্য নহে।” পরে নিশিকে দেখাইয়া বলিল, “এ দেবী নহে। যে উহাকে দেবী বলিয়া পরিচয় দিতেছে, সে রাণীজিকে মা বলে, রাণীজিকে মার মত ভক্তি করে, এই জন্য সে রাণীজিকে বাঁচাইবার জন্য অন্য ব্যক্তিকে নিশান দিতেছে।”
তখন সাহেব দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেবী তবে কে?”
দেবী বলিল, “আমি দেবী।”
দেবী এই কথা বলিলে নিশিতে, দিবাতে, রঙ্গরাজে ও দেবীতে বড় গণ্ডগোল বাধিয়া গেল। নিশি বলে, “আমি দেবী,” দিবা বলে, “আমি দেবী,” রঙ্গরাজ নিশিকে বলে, “এই দেবী,” দেবী বলে, “আমি দেবী।” বড় গোলমাল।
তখন লেফটেনান্ট সাহেব মনে করিলেন, এ ফেরেববাওজির একটা চূড়ান্ত করা উচিত। বলিলেন, “তোমাদের দুই জনের মধ্যে একজন দেবী চৌধুরাণী বটে। ওটা চাকরাণী, ওটা দেবী নহে। এই দুই জনের মধ্যে কে সে পাপিষ্ঠা, তাহা তোমরা চাতুরী করিয়া আমাকে জানিতে দিতেছ না। ইহার পর প্রমাণের দ্বারা যে দেবী চৌধুরাণী বলিয়া সাব্যস্ত হইবে, সেই ফাঁসি যাইবে। যদি প্রমাণের দ্বারা এ কথা পরিষ্কার না হয়, তবে দুই জনের ফাঁসি যাইবে।”
তখন নিশি ও দিবা দুই জনেই বলিল, “এত গোলযোগে কাজ কি? আপনার সঙ্গে কি গোইন্দা নাই? যদি গোইন্দা থাকে, তবে তাহাকে ডাকালেই ত সে বলিয়া দিতে পারিবে, –কে যথার্থ দেবী চৌধুরাণী।”
হরবল্লভকে বজরায় আনিবে, দেবীর এই প্রধান উদ্দেশ্য। হরবল্লভের রক্ষার ব্যবস্থা না করিয়া, দেবী আত্মরক্ষার উপায় করিবে না, ইহা স্থির। তাঁহাকে বজরায় না আনিতে পারিলে হরবল্লভের রক্ষার নিশ্চয়তা হয় না।
সাহেব মনে করিলেন, “এ পরামর্শ মন্দ নহে।” তখন তাঁহার সঙ্গে যে সিপাহী আসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, “গোইন্দাকে ডাক।” সিপাহী এক ছিপের একজন জমাদ্দার সাহেবকে ডাকিয়া বলিল, “গোইন্দাকে ডাক।” তখন গোইন্দাকে ডাকাডাকির গোল পড়িয়া গেল। গোইন্দা কোথায়, গোইন্দা কে, তাহা কেহই জানে না, কেবল চারি দিকে ডাকাডাকি করে।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বস্তুতঃ হরবল্লভ রায় মহাশয় যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সে ইচ্ছাপূর্বক নহে, ঘটনাবিহীন। প্রথমে বড় ঘেঁষেন নাই। “শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং” ইত্যাদি চাণক্যপ্রদত্ত সদুপদেশ স্মরণ করিয়া তিনি সিপাহীদিগের ছিপে উঠেন নাই। একখানা পৃথক ডিঙ্গিতে থাকিয়া, লেফটেনান্ট সাহেবকে বজরা দেখাইয়া দিয়া, অর্ধ ক্রোশ দূরে পলাইয়া গিয়া ডিঙ্গি ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। তার পর দেখিলেন, আকাশের বড় ঘনঘটা। মনে করিলেন, ঝড় উঠিবে ও এখনই আমার ডিঙ্গি ডুবিয়া যাইবে, টাকার লোভে আসিয়া প্রাণ হারাইব–আমার সৎকারও হইবে না। তখন রায় মহাশয় ডিঙ্গি হইতে তীরে অবতরণ করিলেন। কিন্তু তীরে সেখানে কেহ কোথাও নাই দেখিয়া বড় ভয় হইল। সাপের ভয়, বাঘের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ভূতের ভয়। হরবল্লভের মনে হইল, কেন এমন ঝকমাবরি করিতে আসিয়াছিলাম। হরবল্লভের কান্না আসিল।
এমন সময়ে হঠাৎ বন্দুকের হুড়মুড়ি, সিপাহী বরকন্দাজের হৈ হৈ শব্দ সব বন্ধ হইয়া গেল। হরবল্লভের বোধ হইল, অবশ্য সিপাহীর জয় হইয়াছে, ডাকাইত মাগী ধরা পড়িয়াছে, নহিলে লড়াই বন্ধ হইবে কেন? তখন হরবল্লভ ভরসা পাইয়া যুদ্ধস্থানে যাইতে অগ্রসর হইলেন। তবে এ রাত্রিকালে, এ অন্ধকারে, এ বন-জঙ্গলের মাঝে অগ্রসর হন কিরূপে? ডিঙ্গির মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ বাপু মাঝি, –বলি, ওদিকে যাওয়া যায় কিরূপে বলতে্ পার?”
মাঝি বলিল, “যাওয়ার ভাবনা কি? ডিঙ্গিতে উঠুন না, নিয়ে যাচ্ছি। সিপাহীরা মারবে ধরবে না ত? আবার যদি লড়াই বাধে?”
হ। সিপাহীরা আমাদের কিছু বলিবে না। লড়াই আর বাধিবে না–ডাকাইত ধরা পড়েছে। কিন্তু যে রকম মেঘ করেছে, এখনই ঝড় উঠবে–ডিঙ্গিতে উঠি কিরূপে?
মাঝি বলিল, “ঝড়ে ডিঙ্গি কখন ডুবে না।”
হরবল্লভ প্রথমে সে সকল কথায় বিশ্বাস করিলেন না–শেষ অগত্যা ডিঙ্গিতে উঠিলেন। মাঝিকে উপদেশ দিলেন, কেনারায় কেনারায় ডিঙ্গি লইয়া যাইবে। মাঝি তাহাই করিল। শীঘ্র আসিয়া ডিঙ্গি বজরায় লাগিল। হরবল্লভ সিপাহীদের সঙ্কেতবাক্য জানিতেন, সুতরাং সিপাহীরা আপত্তি করিল না। সেই সময়ে “গোইন্দা! গোইন্দা!” করিয়া ডাকাডাকি হইতেছিল। হরবল্লভ বজরায় উঠিয়া সম্মুখস্থ আরদালির সিপাহীকে বলিল, “গোইন্দাকে খুঁজিতেছ? আমি গোইন্দা।”
সিপাহী বলিল, “তোমাকে কাপ্তেন সাহেব তলব করিয়াছেন।”
হ। কোথায় তিনি?
সি। কামরার ভিতর। তুমি কামরার ভিতর যাও।
হরবল্লভ আসিতেছে জানিতে পারিয়া দেবী প্রস্থানের উদ্যোগ দেখিল। “কাপ্তেন সাহেবের জন্য কিছু জলযোগের উদ্যোগ দেখি” বলিয়া ভিতরের কামরায় চলিয়া গেল।
এদিকে হরবল্লভ কামরার দিকে গেলেন। কামরার দ্বারে উপস্থিত হইয়া কামরার সজ্জা ও ঐশ্বর্য, দিবা ও নিশির রূপ ও সজ্জা দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন। সাহেবকে সেলাম করিতে গিয়া, ভুলিয়া নিশিকে সেলাম করিয়া ফেলিলেন। হাসিয়া নিশি কহিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! মেজাজ সরিফ্?”
শুনিয়া দিবা বলিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! আমায় একটা কুর্ণিশ হলো না–আমি হলেম এদের রাণী।”
সাহেব হরবল্লভকে বলিলেন, “ইহারা ফেরেব করিয়া দুই জনেই বলিতেছে, ‘আমি দেবী চৌধুরাণী।’ কে দেবী চৌধুরাণী, তাহার ঠিকানা না হওয়ায়, আমি তোমাকে ডাকিয়াছি। কে দেবী?”
হরবল্লভ বড় প্রমাদে পড়িলেন। ঊর্ধ্ব চতুর্দশ পুরুষের ভিতর কখনও দেবীকে দেখেন নাই। কি করেন, ভাবিয়া চিন্তিয়া নিশিকে দেখাইয়া দিলেন। নিশি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। অপ্রতিভ হইয়া, ‘ভুল হইয়াছে’ বলিয়া হরবল্লভ দিবাকে দেখাইলেন। দিবা লহর তুলিয়া হাসিল। বিষণ্ণ মনে হরবল্লভ আবার নিশিকে দেখাইল। সাহেব তখন গরম হইয়া উঠিয়া হরবল্লভকে বলিলেন, “টোম বডজাাট–শূয়র! তোম্ পছানটেে নেহি?”
তখন দিবা বলিল, “সাহেব, রাগ করিবেন না। উনি চেনেন না। উঁহার ছেলে চেনে। উঁহার ছেলে বজরার ছাদে বসিয়া আছে, তাহাকে আনুন–সে চিনিবে।”
হরবল্লভ আকাশ হইতে পড়িল, বলিল, “আমার ছেলে!”
দি। এইরূপ শুনি।
হ। ব্রজেশ্বর।
দি। তিনিই।
হ। কোথা?
দি। ছাদে।
হ। ব্রজ এখানে কেন?
দি। তিনি বলিবেন।
সাহেব হুকুম দিলেন, “তাঁহাকে আন।”
দিবা রঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করিল। তখন রঙ্গরাজ ছাদে গিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “চল, দিবা ঠাকুরাণীর হুকুম।”
ব্রজেশ্বর নামিয়া কামরার ভিতর আসিল। দেবীর হুকুম আগেই প্রচার হইয়াছিল, দিবার হুকুম পাইলেই ব্রজেশ্বর ছাদ হইতে নামিবে। এমনই দেবীর বন্দোবস্ত।
সাহেব ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি দেবী চৌধুরাণীকে চেন?”
ব্র। চিনি।
সা। এখানে দেবী আছে?
ব্র। না।
সাহেব তখন রাগান্ধ হইয়া বলিলেন, “সে কি, ইহারা দুই জনের একজনও দেবী চৌধুরাণী নয়?”
ব্র। এরা তার দাসী।
সা। এঃ! তুমি দেবীকে চেন?
ব্র। বিলক্ষণ চিনি।
সা। যদি এরা কেহ দেবী না হয়, তবে দেবী অবশ্য এ বজরার কোথাও লুকাইয়া আছে। বোধ হয়, দেবী সেই চাকরাণীটা। আমি বজরা তল্লাশি করিতেছি–তুমি নিশানদিহি করিবে, আইস।
ব্র। সাহেব, তোমার বজরা তল্লাশ করিতে হয়, কর–আমি নিশানদিহি করিব কেন?
সাহেব বিস্মিত হইয়া গর্জিয়া বলিল, “কেঁও বদজাত? তোম গোইন্দা নেহি?”
“নেহি।” বলিয়া ব্রজেশ্বর সাহেবের গালে বিরাশী সিক্কার এক চপেটাঘাত করিল।
“করিলে কি? করিলে কি? সর্বনাশ করিলে?” বলিয়া, হরবল্লভ কাঁদিয়া উঠিল।
“হুজুর! তুফান উঠা।” বলিয়া বাহির হইতে জমাদ্দার হাঁকিল।
সোঁ সোঁ করিয়া আকাশপ্রান্ত হইতে ভয়ঙ্কর বেগে বায়ু গর্জন করিয়া আসিতেছে শুনা গেল।
কামরার ভিতর হইতে ঠিক সেই মুহূর্তে–যে মুহূর্তে সাহেবের গালে ব্রজেশ্বরের চড় পড়িল–ঠিক সেই মুহূর্তে আবার শাঁক বাজিল। এবার দুই ফুঁ
বজরার নোঙ্গর ফেলা ছিল না–পূর্বেই বলিয়াছি, খোঁটায় কাছি বাঁধা ছিল, খোঁটার কাছে দুই জন নাবিক বসিয়াছিল। যেমন শাঁক বাজিল, অমনি তাহারা কাছি ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া বজরায় উঠিল। তীরের উপরে যে সিপাহীরা বজরা ঘেরাও করিয়াছিল, তাহারা উহাদিগরে মারিবার জন্য সঙ্গীন উঠাইল–কিন্তু তাহাদের হাতের বন্দুক হাতেই রইল, পলক ফেলিতে না ফেলিতে একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড হইয়া গেল। দেবীর কৌশলের এক পলক মধ্যে সেই পাঁচ শত কোম্পানির সিপাহী পরাস্ত হইল।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রথমাবধিই বজরার চারিখানা পাল খাটান ছিল। বলিয়াছি যে, মধ্যে নিশি ও দিবা আসিয়া, নাবিকদিগকে কি উপদেশ দিয়া গিয়াছিল। সেই উপদেশ অনুসারেই খোঁটার কাছে লোক বসিয়াছিল। আর সেই উপদেশ অনুসারে পালের কাছির কাছে চারি জন নাবিক বসিয়াছিল। শাঁকের শব্দ শুনিবা মাত্র তাহারা পালের কাছি সকল টানিয়া ধরিল। মাঝি হাল আঁটিয়া ধরিল। অমনি সেই প্রচণ্ড বেগশালী ঝটিকা আসিয়া চারিখানা পালে লাগিল। বজরা ঘুরিল–যে দুই জন সিপাহী সঙ্গীন তুলিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গীন উঁচু হইয়া রহিল–বজরার মুখ পঞ্চাশ হাত তফাতে গেল। বজরা ঘুরিল–তার পর ঝড়ের বেগে পালভরা বজরা কাত হইল, প্রায় ডুবে। লিখিতে এতক্ষণ লাগিল–কিন্তু এতখানা ঘটিল এক নিমেষ মধ্যে। সাহেব ব্রজেশ্বরের চড়ের প্রত্যুত্তরে ঘুঁষি উঠাইয়াছেন মাত্র, ইহারই মধ্যে এতখানা সব হইয়া গেল। তাঁহারও হাতের ঘুষি হাতে রহিল, যেমন বজরা কাত হইল, অমনি সাহেব টলিয়া মুষ্টিবদ্ধহস্তে দিবা সুন্দরীর পাদমূলে পতিত হইলেন। ব্রজেশ্বর খোদ সাহেবের ঘাড়ের উপর পড়িয়া গেল–এবং রঙ্গরাজ তাহার উপর পড়িয়া গেল। হরবল্লভ প্রথমে নিশিঠাকুরাণীর ঘাড়ের উপর পড়িয়াছিলেন, পরে সেখান হইতে পদচ্যুত হইয়া গড়াইতে গড়াইতে রঙ্গরাজের নাগরা জুতায় আটকাইয়া গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন যে, “নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে, আমরা সকলে মরিয়া গিয়াছি, এখন আর দুর্গানাম জপিয়া কি হইবে!”
কিন্তু নৌকা ডুবিল না–কাত হইয়া আবার সোজা হইয়া বাতাসে পিছন করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ছুটিল। যাহারা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার খাড়া হইয়া দাঁড়াইল–সাহেব আবার ঘুঁষি তুলিলেন। কিন্তু সাহেবের ফৌজ, যাহারা জলে দাঁড়াইয়াছিল, বজরা তাহাদের ঘাড়ের উপর দিয়া চলিয়া গেল। অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণরক্ষা করিল; কেহ দূর হইতে বজরা ঘুরিতেছে দেখিতে পাইয়া পলাইয়া বাঁচিল; কেহ বা আহত হইল; কেহ মরিল না। ছিপগুলি বজরার নীচে পড়িয়া ডুবিয়া গেল–জল সেখানে এমন বেশী নহে–স্রোত বড় নাই–সুতরাং সকলেই বাঁচিল। কিন্তু বজরা আর কেহ দেখিতে পাইল না। নক্ষত্রবেগে উড়িয়া বজরা কোথায় ঝড়ের সঙ্গে মিশিয়া চলিল, কেহ আর দেখিতে পাইল না। সিপাহী সেনা ছিন্নভিন্ন হইল। দেবী তাহাদের পরাস্ত করিয়া পাল উড়াইয়া চলিল, লেফটেনান্ট সাহেব ও হরবল্লভ দেবীর নিকট বন্দী হইল। নিমেষমধ্যে যুদ্ধ জয় হইল। দেবী তাই আকাশ দেখাইয়া বলিয়াছিল, “আমার রক্ষার উপায় ভগবান করিতেছেন।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বজরা জলের রাশি ভাঙ্গিয়া, দুলিতে দুলিতে নক্ষত্র-বেগে ছুটিল। শব্দ ভয়ানক। বজরার মুখে কৃষ্ণ তরঙ্গরাশির গর্জন ভয়ানক–ঝড়ের শব্দ ভয়ানক। কিন্তু নৌকার গঠন অনুপম, নাবিকদিগের দক্ষতা ও শিক্ষা প্রসিদ্ধ। নৌকা এই ঝড়ের মুখে চারিখানা পাল দিয়া নির্বিঘ্নে চলিল। আরোহিবর্গ যাঁহারা প্রথমে কুষ্মাণ্ডাকারে গড়াগড়ি দিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলে স্বপদস্থ হইলেন। হরবল্লভ রায় মহাশয়, অঙ্গুষ্ঠে যজ্ঞোপবীত জড়িত করিয়া দুর্গানাম জপিতে আরম্ভ করিলেন, আবার না ডুবি। লেফটেনান্ট সাহেব সেই মুলতবী ঘুঁষিটা আবার পুনর্জীবিত করিবার চেষ্টায় হস্তোত্তোলন করিলেন, অমনি ব্রজেশ্বর তাঁর হাতখানা ধরিয়া ফেলিল। হরবল্লভ ছেলেকে ভর্ৎসনা করিলেন। বলিলেন, “ও কি কর, ইংরেজের গায়ে হাত তোল?”
ব্রজেশ্বর বলিল, “আমি ইংরেজের গায়ে হাত তুলেছি, না ইংরেজ আমার গায়ে হাত তুলিতেছে?”
হরবল্লভ সাহেবকে বলিলেন, “হুজুর! ও ছেলেমানুষ, আজও বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, আপনি ওর অপরাধ লইবেন না। মাফ করুন।”
সাহেব বলিলেন, “ও বড় বদমাস। তবে যদি আমার কাছে ও জোড়হাত করিয়া মাফ চায়, তবে আমি মাফ করিতে পারি।”
হ। ব্রজ তাই কর। জোড়হাত করিয়া সাহেবকে বল, “আমাকে মাফ করুন।”
ব্র। সাহেব, আমরা হিন্দু, পিতার আজ্ঞা আমরা কখনও লঙ্ঘন করি না। আমি আপনার কাছে জোড়হাত করিয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমাকে মাফ করুন।
সাহেব ব্রজেশ্বরের পিতৃভক্তি দেখিয়া প্রসন্ন হইয়া ব্রজেশ্বরকে ক্ষমা করিলেন, আর ব্রজেশ্বরের হাত লইয়া আচ্ছা করিয়া নাড়া দিলেন। ব্রজেশ্বরের চতুর্দশ পুরুষের মধ্যে কখন জানে না, সেকহ্যাকণ্ড কাকে বলে–সুতরাং ব্রজেশ্বর একটু ভেকা হইয়া রহিল। মনে করিল, “কি জানি, যদি আবার বাঁধে।” এই ভাবিয়া ব্রজেশ্বর বাহিরে গিয়া বসিল। কেবল ঝড়, –বৃষ্টি নাই, –ভিজিতে হইল না।
রঙ্গরাজ বাহিরে আসিয়া, কামরার দ্বার বন্ধ করিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া বসিল–দুই দিকের পাহারায় বিশেষ, এ সময়ে বাহিরে একটু সতর্ক থাকা ভাল, বজরা বড় তীব্রবেগে যাইতেছে, হঠাৎ বিপদ ঘটাও বিচিত্র নহে।
দিবা উঠিয়া দেবীর কাছে গেল–পুরুষ-মহলে এখন আর প্রয়োজন নাই। নিশি উঠিল না–তার কিছু মতলব ছিল। সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত–সুতরাং অগাধ সাহস।
সাহেব জাঁকিয়া আবার রূপার চৌকিতে বসিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “ডাকাইতের হাত হইতে কিরূপে মুক্ত হইব? যাহাকে ধরিতে আসিয়াছিলাম, তাহারই কাছে ধরা পড়িলাম–স্ত্রীলোকের কাছে পরাজিত হইলাম, ইংরেজ মহলে আর কি বলিয়া মুখ দেখাইব? আমার না ফিরিয়া যাওয়াই ভাল।”
হরবল্লভ আর বসিবার স্থান না পাইয়া নিশি সুন্দরীর মসনদের কাছে বসিলেন। দেখিয়া নিশি বলিল, “আপনি একটু নিদ্রা যাবেন?”
হ। আজ কি আর নিদ্রা হয়?
নি। আজ না হইল ত আর হইল না।
হ। সে কি?
নি। আবার ঘুমাইবার দিন কবে পাইবেন?
হ। কেন?
নি। আপনি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিতে আসিয়াছিলেন?
হ। তা–তা–কি জান–
নি। ধরা পড়িলে দেবীর কি হইত, জান?
হ। আ–এমন কি–
নি। এমন কিছু নয়, ফাঁসি!
হ। তা–না–এই–তা কি জান–
নি। দেবী তোমার কোন অনিষ্ট করে নাই, বরং ভারী উপকার করিয়াছিল–যখন তোমার জাতি যায়, প্রাণ যায়, তখন তোমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়া, তোমায় রক্ষা করিয়াছিল। তার প্রত্যুপকারে তুমি তাহাকে ফাঁসি দিবার চেষ্টায় ছিলে। তোমার যোগ্য কি দণ্ড বল দেখি?
হরবল্লভ চুপ করিয়া রহিল।
নিশি বলিতে লাগিল, “তাই বলিতেছিলাম, এই বেলা ঘুমাইয়া লও–আর রাত্রের মুখ দেখিবে না। নৌকা কোথায় যাইতেছে বল দেখি?”
হরবল্লভের কথা কহিবার শক্তি নাই।
নিশি বলিতে লাগিল, “ডাকিনীর শ্মশান বলিয়া প্রকাণ্ড শ্মশান আছে। আমরা যাদের প্রাণে মারি, তাদের সেইখানে লইয়া গিয়া মারি। বজরা এখন সেইখানে যাইতেছে। সেইখানে পৌঁছিলে সাহেব ফাঁসি যাইবে, রাণীজির হুকুম হইয়া গিয়াছে। আর তোমায় কি হুকুম করিয়াছে, জান?”
হরবল্লভ কাঁদিতে লাগিল–জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমায় রক্ষা কর।”
নিশি বলিল, “তোমায় রক্ষা করিবে, এমন পাষণ্ড পামর কে আছে? তোমায় শূলে দিবার হুকুম হইয়াছে।”
হরবল্লভ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ঝড়ের শব্দ বড় প্রবল; সে কান্নার শব্দ ব্রজেশ্বর শুনিতে পাইল না–দেবীও না। সাহেব শুনিল। সাহেব কথাগুলা শুনিতে পায় নাই–কান্না শুনিতে পাইল। সাহেব ধমকাইল, “রোও মৎ-উল্লুক মর্নাি এক রোজ আল্বৎ হ্যায়।”
সে কথা কাণে না তুলিয়া নিশির কাছে জোড়হাত করিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাঁদিতে লাগিল। বলিল, হাঁ গা! আমায় কি কেউ রক্ষা করিতে পারে না গা?”
নি। তোমার মত নরাধমকে বাঁচাইয়া পাতকগ্রস্ত হইবে? আমাদের রাণী দয়ময়ী, কিন্তু তোমার জন্য কেহই তাঁর কাছে দয়ার ভিক্ষা করিব না।
হ। আমি লক্ষ টাকা দিব।
নি। মুখে আনিতে লজ্জা করে না? পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য এই কৃতঘ্নের কাজ করিয়াছ–আবার লক্ষ টাকা হাঁক?
হ। আমাকে যা বলিবে, তাই করিব।
নি। তোমার মত লোকের দ্বারা কোন্ কাজ হয় যে, তুমি, যা বলিব, তাই করিবে?
হ। অতি ক্ষুদ্রের দ্বারাও উপকার হয়–ওগো, কি করিতে হইবে বল, আমি প্রাণপণ করিয়া করিব–আমায় বাঁচাও।
নি। (ভাবিতে ভাবিতে) তোমার দ্বারাও আমার একটা উপকার হইলে হইতে পারে–তা তোমার মত লোকের দ্বারা সে উপকার না হওয়াই ভাল।
হ। তোমার কাছে জোড়হাত করিতেছি–তোমার হাত ধরিতেছি–
হরবল্লভ বিহ্বল–নিশি ঠাকুরাণীর বাঁউড়ী-পরা গোলগাল হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিয়াছিল আর কি! চতুরা নিশি আগে হাত সরাইয়া লইল–বলিল, “সাবধান! ও হাত শ্রীকৃষ্ণের গৃহীত। কিন্তু তোমার হাতে-পায়ে ধরিয়া কাজ নাই–তুমি যদি এতই কাতর হইয়াছ, তবে তুমি যাতে রক্ষা পাও, আমি তা করিতে রাজি হইতেছি। কিন্তু তোমায় যা বলিব, তা যে তুমি করিবে, এ বিশ্বাস হয় না। তুমি জুয়োচোর, কৃতঘ্ন, পামর, গোইন্দাগিরি কর–তোমার কথায় বিশ্বাস কি?”
হ। যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিতেছি।
নি। তোমার আবার দিব্য? কি দিব্য করিবে?
হ। গঙ্গাজল তামা তুলসী দাও–আমি স্পর্শ করিয়া দিব্য করিতেছি। নি। ব্রজেশ্বরের মাথায় হাত দিয়া দিব্য করিতে পার?
হরবল্লভ গর্জিয়া উঠিল। বলিল, “তোমাদের যা ইচ্ছা, তাহা কর। আমি তা পারিব না।” কিন্তু এ তেজ ক্ষণিকমাত্র। হরবল্লভ আবার তখনই হাত কচলা্ইতে লাগিল–বলিল, “আর যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিব, রক্ষা কর।”
নি। আচ্ছা, দিব্য করিতে হইবে না–তুমি আমাদের হাতে আছ। শোন, আমি বড় কুলীনের মেয়ে। আমাদের ঘরে পাত্র জোটা ভার। আমার একটি পাত্র জুটিয়াছিল, (পাঠক জানেন, সব মিথ্যা) কিন্তু আমার ছোট বহিনের জুটিল না। আজিও তাহার বিবাহ হয় নাই।
হ। বয়স কত হইয়াছে?
নি। পঁচিশ ত্রিশ।
হ। কুলীনের মেয়ে অমন অনেক থাকে।
নি। থাকে, কিন্তু আর তার বিবাহ না হইলে অঘরে পড়িবে, এমন গতিক হইয়াছে। তুমি আমার বাপের পালটি ঘর। তুমি যদি আমার ভগিনীকে বিবাহ কর, আমার বাপের কুল থাকে। আমিও এই কথা বলিয়া রাণীজির কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা করিয়া লই।
হরবল্লভের মাথার উপর হইতে পাহাড় নামিয়া গেল। আর একটা বিবাহ বৈ ত নয়–সেটা কুলীনের পক্ষে শক্ত কাজ নয়–তা যত বড় মেয়ে হৌক না কেন! নিশি যে উত্তরের প্রত্যাশা করিয়াছিল, হরবল্লভ ঠিক সেই উত্তর দিল, বলিল, “এ আর বড় কথা কি? কুলীনের কুল রাখা কুলীনেরই কাজ। তবে একটা কথা এই, আমি বুড়া হইয়াছি, আমার আর বিবাহের বয়স নাই। আমার ছেলে বিবাহ করিলে হয় না?”
নি। তিনি রাজি হবেন?
হ। আমি বলিলেই হইবে।
নি। তবে আপনি কাল প্রাতে সেই আজ্ঞা দিয়া যাইবেন। তাহা হইলে, আমি পাল্কী বেহারা আনিয়া আপনাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব।
হরবল্লভ হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল–কোথায় শূলে যায়–কোথায় বৌভাতের ঘটা। হরবল্লভের আর দেরি সয় না। বলিল, “তবে তুমি গিয়া রাণীজিকে এ সকল কথা জানাও।”
নিশি বলিল, “চলিলাম।” নিশি দ্বিতীয় কামরার ভিতর প্রবেশ করিল।
নিশি গেলে, সাহেব হরবল্লভকে জিজ্ঞাসা করিল, “স্ত্রীলোকটা তোমাকে কি বলিতেছিল?”
হ। এমন কিছুই না।
সা। কাঁদিতেছিলে কেন?
হ। কই? কাঁদি নাই।
সা। বাঙ্গালি এমনই মিথ্যাবাদী বটে।
নি। ভিতরে আসিলে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আমার শ্বশুরের সঙ্গে এত কি কথা কহিতেছিলে?”
নি। দেখিলাম, যদি তোমার শাশুড়ীগিরিতে বাহাল হইতে পারি।
দেবী। নিশি ঠাকুরাণি! তোমার মন প্রাণ, জীবন যৌবন সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করিয়াছ–কেবল জুয়াচুরিটুকু নয়। সেটুকু নিজের ব্যবহারের জন্য রাখিয়াছ।
নি। দেবতাকে ভাল সামগ্রীই দিতে হয়। মন্দ সামগ্রী কি দিতে আছে?
দেবী। তুমি নরকে পচিয়া মরিবে।
নবম পরিচ্ছেদ
ঝড় থামিল; নৌকাও থামিল। দেবী বজরার জানালা হইতে দেখিতে পাইলেন, প্রভাত হইতেছে। বলিলেন, “নিশি! আজ সুপ্রভাত!”
নিশি বলিল, “আমি আজ সুপ্রভাত!”
দি। তুমি অবসান, আমি সুপ্রভাত!
নি। যেদিন আমার অবসান হইবে, সেই দিনই আমি সুপ্রভাত বলিব। এ অন্ধকারের অবসান নাই। আজ বুঝিলাম, দেবী চৌধুরাণীর সুপ্রভাত–কেন না, আজ দেবী চৌধুরাণীর অবসান।
দি। ও কি কথা লো পোড়ারমুখী?
নি। কথা ভাল। দেবী মরিয়াছে। প্রফুল্ল শ্বশুরবাড়ী চলিল।
দেবী। তার এখন দেরী ঢের। যা বলি, কর দেখি। বজরা বাঁধিতে বল দেখি।
নিশি হুকুম জারি করিল–মাঝিরা তীরে লাগাইয়া বজরা বাঁধিল। তার পর দেবী বলিল, “রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা কর, কোথায় আসিয়াছি? রঙ্গপুর কত দূর? ভূতনাথ কত দূর?”
রঙ্গরাজ জিজ্ঞাসায় বলিল, “এক রাত্রে চারি দিনের পথ আসিয়াছি। রঙ্গপুর এখান হইতে অনেক দিনের পথ। ডাঙ্গা-পথে ভূতনাথে এক দিনে যাওয়া যাইতে পারে।”
“পাল্কী বেহারা পাওয়া যাইবে?”
“আমি চেষ্টা করিলে সব পাওয়া যাইবে।”
দেবী নিশিকে বলিল, “তবে আমার শ্বশুরকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দাও।”
দি। এত তাড়াতাড়ি কেন?
নি। শ্বশুরের ছেলে সমস্ত রাত্রি বাহিরে বসিয়া আছে, মনে নাই? বাছাধন সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কায় আসিতে পারিতেছে না, দেখিতেছ না?
এই বলিয়া নিশি রঙ্গরাজকে ডাকিয়া, হরবল্লভের সাক্ষাতে বলিল, “সাহেবটাকে ফাঁসি দিতে হইবে। ব্রাহ্মণটাকে এখন শূলে দিয়া কাজ নাই। উহাকে পাহারাবন্দী করিয়া স্নানাহ্নিকে পাঠাইয়া দাও।”
হরবল্লভ বলিলেন, “আমার উপর হুকুম কিছু হইয়াছে?”
নিশি চোখ টিপিয়া বলিল, “আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হইয়াছে। তুমি স্নানাহ্নিক করিয়া আইস।”
নিশি রঙ্গরাজের কাণে কাণে বলিল, “পাহারা মানে জল-আচরণী ভৃত্য।”
রঙ্গরাজ সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া হরবল্লভকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দিল।
তখন দেবী নিশিকে বলিল, “সাহেবটাকে ছাড়িয়া দিতে বল। সাহেবকে রঙ্গপুর ফিরিয়া যাইতে বল। রঙ্গপুর অনেক দূর, এক শত মোহর উহাকে পথখরচ দাও, নহিলে এত পথ যাইবে কি প্রকারে?”
নিশি শত স্বর্গ লইয়া গিয়া রঙ্গরাজকে দিল, আর কাণে কাণে উপদেশ দিল। উপদেশে দেবী যাহা বলিয়াছিল, তাহা ছাড়া আরও কিছু ছিল।
রঙ্গরাজ তখন দুই জন বরকন্দাজ লইয়া আসিয়া সাহেবকে ধরিল। বলিল, “উঠ।”
সা। কোথা যাইতে হইবে?
র। তুমি কয়েদী–জিজ্ঞাসা করিবার কে?
সাহেব বাক্যব্যয় না করিয়া রঙ্গরাজের পিছু পিছু দুই জন বরকন্দাজের মাঝে চলিল। যে ঘাটে হরবল্লভ স্নান করিতেছিলেন, সেই ঘাট দিয়া তাহারা যায়।
হরবল্লভ জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?”
রঙ্গরাজ বলিল, “এই জঙ্গলে।”
হ। কেন?
র। জঙ্গলের ভিতর গিয়া ফাঁসি দিব।
হরবল্লভের গা কাঁপিল। সে সন্ধ্যা-আহ্নিকের সব মন্ত্র ভুলিয়া গেল। সন্ধ্যাহ্নিক ভাল হইল না।
রঙ্গরাজ জঙ্গলে সাহেবকে লইয়া গিয়া বলিল, “আমরা কাহাকে ফাঁসি দিই না। তুমি ঘরের ছেলে ঘরে যাও, আমাদের পিছনে আর লেগো না। তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম।”
সাহেব প্রথমে বিস্ময়াপন্ন হইল–তার পর ভাবিল, “ইংরেজকে ফাঁসি দেয়, বাঙ্গালির এত কি ভরসা?”
তার পর রঙ্গরাজ বলিল, “সাহেব! রঙ্গপুর অনেক পথ, যাবে কি প্রকারে?”
সা। যে প্রকারে পারি।
র। নৌকা ভাড়া কর, গ্রামে গিয়া ঘোড়া কেন–নয় পাল্কী কর। তোমাকে আমাদের রাণী এত শত মোহর পথখরচ দিয়াছেন।
রঙ্গরাজ মোহর গণিয়া দিতে লাগিল। সাহেব পাঁচ থান মোহর লইয়া আর লইল না। বলিল, “ইহাতেই যথেষ্ট হইবে। এ আমি কর্জ লইলাম।”
র। আচ্ছা, আমরা যদি তোমার কাছে আদায় করতে যাই ত শোধ দিও। আর তোমার সিপাহী যদি কেহ জখম হইয়া থাকে, তাহাকে পাঠাইয়া দিও। যদি কেহ মরিয়া থাকে, তবে তাদের ওয়ারেশকে পাঠাইয়া দিও।
সা। কেন?
র। এমন অবস্থায় রাণী কিছু কিছু দান করিয়া থাকেন।
সাহেব বিশ্বাস করিল না। ভাল মন্দ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।
রঙ্গরাজ তখন পাল্কী বেহারার সন্ধানে গেল। তার প্রতি সে আদেশও ছিল।
দশম পরিচ্ছেদ
এদিকে পথ সাফ দেখিয়া, ব্রজেশ্বর ধীরে ধীরে দেবীর কাছে আসিয়া বসিলেন।
দেবী বলিল, “ভাল হইল, দেখা দিলে। তোমার কথা ভিন্ন আজিকার কাজ নয়। তুমি প্রাণ রাখিতে হুকুম দিয়াছিলে, তাই প্রাণ রাখিয়াছি। দেবী মরিয়াছে, দেবী চৌধুরাণী আর নাই। কিন্তু প্রফুল্ল এখনও আছে। প্রফুল্ল থাকিবে, না দেবীর সঙ্গে যাইবে?”
ব্রজেশ্বর আদর করিয়া প্রফুল্লের মুখচুম্বন করিল। বলিল, “তুমি আমার ঘরে চল, ঘর আলো হইবে। তুমি না যাও–আমি যাইব না।”
প্র। আমি ঘরে গেলে আমার শ্বশুর কি বলিবেন?
ব্র। সে ভার আমার। তুমি উদ্যোগ করিয়া তাঁকে আগে পাঠাইয়া দাও। আমরা পশ্চাৎ যাইব।
প্র। পাল্কী বেহারা আনিতে গিয়াছে।
পাল্কী বেহারা শীঘ্রই আসিল। হরবল্লভও সন্ধ্যাহ্নিক সংক্ষেপে সারিয়া বজরায় আসিয়া উঠিলেন। দেখিলেন, নিশি ঠাকুরাণী ক্ষীর, ছানা, মাখন ও উত্তম সুপক্ক আম্র, কদলী প্রভৃতি ফল তাঁহার জলযোগের জন্য সাজাইতেছে। নিশি অনুনয় বিনয় করিয়া, তাঁহাকে জলযোগে বসাইল। বলিল, “এখন আপনি আমার কুটুম্ব হইলেন; জলযোগ না করিয়া যাইতে পারিবেন না।”
হরবল্লভ জলযোগে না বসিয়া বলিল, “ব্রজেশ্বর কোথায়? কাল রাত্রে বাহিরে উঠিয়া গেল–আর তাকে দেখি নাই।”
নিশি। তিনি আমার ভগিনীপতি হইবেন–তাঁর জন্য ভাবিবেন না। তিনি এইখানেই আছেন–আপনি জলযোগে বসুন; আমি তাঁহাকে ডাকিয়া দিতেছি। সেই কথাটা তাঁকে বলিয়া যাউন।
হরবল্লভ জলযোগে বসিল। নিশি ব্রজেশ্বরকে ডাকিয়া আনিল। ভিতরের কামরা হইতে ব্রজেশ্বর বাহির হইল দেখিয়া উভয়ে কিছু অপ্রতিভ হইলেন। হরবল্লভ ভাবিলেন, আমার চাঁদপানা ছেলে দেখে, ডাকিনী বেটীরা ভুলে গিয়েছে। ভালই।
ব্রজেশ্বরকে হরবল্লভ বলিলেন, “বাপু হে, তুমি যে এখানে কি প্রকারে আসিলে, আমি ত তা এখনও কিছু বুঝিতে পারি নাই। তা যাক–সে এখনকার কথা নয়, সে কথা পরে হবে। এক্ষণে আমি একটু অনুরোধে পড়েছি–তা অনুরোধটা রাখিতে হইবে। এই ঠাকুরাণীটি সৎকুলীনের মেয়ে–ওঁর বাপ আমাদেরই পালটি–তা ওঁর একটি অবিবাহিতা ভগিনী আছে–পাত্র পাওয়া যায় না–কুল যায়। তা কুলীনের কুলরক্ষা কুলীনেরই কাজ–মুটে মজুরের ত কাজ নয়। আর তুমিও পুনর্বার সংসার কর, সেটাও আমার ইচ্ছা বটে, তোমার গর্ভধারিণীরও ইচ্ছা বটে। বিশেষ বড় বউমাটির পরলোকের পর থেকে আমরা কিছু এ বিষয়ে কাতর আছি। তাই বলছিলাম, যখন অনুরোধে পড়া গেছে, তখন এ কর্তব্যই হয়েছে। আমি অনুমতি করিতেছি, তুমি এঁর ভগিনীকে বিবাহ কর।”
ব্রজেশ্বর মোটের উপর বলিল, “যে আজ্ঞা।”
নিশির বড় হাসি পাইল, কিন্তু হাসিল না। হরবল্লভ বলিতে লাগিলেন, “তা আমার পাল্কী বেহারা এসেছে, আমি আগে গিয়া বৌভাতের উদ্যোগ করি। তুমি যথাশাস্ত্র বিবাহ করে বৌ নিয়ে বাড়ী যেও।”
ব্র। যে আজ্ঞা।
হ। তা তোমায় আর বলিব কি, তুমি ছেলেমানুষ নও–কুল, শীল, জাতি, মর্যাদা, সব আপনি দেখে শুনে বিবাহ করবে। (পরে একটু আওয়াজ খাটো করিয়া বলিতে লাগিলেন) আর আমাদের যেটা ন্যায্য পাওনা গণ্ডা, তাও ত জান?
ব্র। যে আজ্ঞা।
হরবল্লভ জলযোগ সমাপন করিয়া বিদায় হইলেন। ব্রজ ও নিশি তাঁহার পদধূলি লইল। তিনি পাল্কীতে চড়িয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া দুর্গানাম করিয়া প্রাণ পাইলেন। ভাবিলেন, “ছেলেটি ডাকিনী বেটীদের হাতে রহিল–তা ভয় নাই। ছেলে আপনার পথ চিনিয়াছে। চাঁদমুখের সর্বত্র জয়।”
হরবল্লভ চলিয়া গেলে, ব্রজেশ্বর নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ আবার কি ছল? তোমার ছোট বোন্ কে?”
নি। চেন না? তার নাম প্রফুল্ল।
ব্র। ওহো! বুঝিয়াছি। কি রকমে এ সম্বন্ধে কর্তাকে রাজি করিলে?
নি। মেয়েমানুষের অনেক রকম আছে। ছোট বোনের শাশুড়ী হইতে নাই, নহিলে আরও একটা সম্বন্ধে তাঁকে রাজি করিতে পারিতাম।
দিবা রাগিয়া উঠিয়া বলিল, “তুমি শীগ্গির মর। লজ্জা সরম কিছু নাই? পুরুষমানুষের সঙ্গে কি অমন করে কথা কহিতে হয়?”
নি। কে আবার পুরুষমানুষ? ব্রজেশ্বর? কাল দেখা গিয়াছে–কে পুরুষ, কে মেয়ে।
ব্র। আজিও দেখিবে। তুমি মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মত মোটা বুদ্ধির কাজ করিয়াছ। কাজটা ভাল হয় নাই।
নি। সে আবার কি?
ব্র। বাপের সঙ্গে কি প্রবঞ্চনা চলে? বাপের চোখে ধূলা দিয়া, মিছে কথা বহাল রাখিয়া আমি স্ত্রী লইয়া সংসার করিব। যদি বাপকে ঠকাইলাম, তবে পৃথিবীতে কার কাছে জুয়াচুরি করিতে আমাকে আটকাইবে?
নিশি অপ্রতিভ হইল, মনে মনে স্বীকার করিল, ব্রজেশ্বর পুরুষ বটে। কেবল লাঠিবাজিতে পুরুষ হয় না, নিশি তা বুঝিল। বলিল, “এখন উপায়?”
ব্র। উপায় আছে। চল, প্রফুল্লকে লইয়া ঘরে যাই। সেখানে গিয়া বাপকে সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলিব। লুকোচুরি হইবে না।
নি। তা হইলে তোমার বাপ কি দেবী চৌধুরাণীকে বাড়ীতে উঠিতে দিবেন?
দেবী বলিল, “দেবী চৌধুরাণী কে? দেবী চৌধুরাণী মরিয়াছে, তার নাম এ পৃথিবীতে মুখেও আনিও না। প্রফুল্লের কথা বল।”
নি। প্রফুল্লকেই কি তিনি ঘরে স্থান দিবেন?
ব্র। আমি ত বলিয়াছি যে, সে ভার আমার।
প্রফুল্ল সন্তুষ্ট হইল। বুঝিয়াছিল যে, ব্রজেশ্বরের ভার বহিবার ক্ষমতা না থাকিলে, সে ভার লইবার লোক নহে।