দেবী চৌধুরাণী – PART-3
তৃতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ
বৈশাখী শুক্লা সপ্তমী আসিল, কিন্তু দেবী রাণীর ঋণ পরিশোধের কোন উদ্যোগ হইল না। হরবল্লভ এক্ষণে অঋণী, মনে করিলে অনায়াসে অর্থসংগ্রহ করিয়া দেবীর ঋণ পরিশোধ করিতে পারিতেন, কিন্তু সে দিকে মন দিলেন না। তাঁহাকে এ বিষয়ে নিতান্ত নিশ্চেষ্ট দেখিয়া ব্রজেশ্বর দুই চারিবার এ কথা উথ্থাপন করিলেন, কিন্তু হরবল্লভ তাঁহাকে স্তোকবাক্যে নিবৃত্ত করিলেন। এদিকে বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমী প্রায়াগতা–দুই চারি দিন আছে মাত্র। তখন ব্রজেশ্বর পিতাকে টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। হরবল্লভ বলিলেন, “ভাল, ব্যস্ত হইও না। আমি টাকার সন্ধানে চলিলাম। ষষ্ঠীর দিন ফিরিব।” হরবল্লভ শিবিকারোহণে পাচক ব্রাহ্মণ, ভৃত্য ও দুই জন লাঠিয়াল (পাইক) সঙ্গে লইয়া গৃহ হইতে যাত্রা করিলেন।
হরবল্লভ টাকার চেষ্টায় গেলেন বটে, কিন্তু সে আর এক রকম। তিনি বরাবর রঙ্গপুর গিয়া কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। তখন কালেক্টরই শান্তিরক্ষক ছিলেন। হরবল্লভ তাঁহাকে বলিলেন, “আমার সঙ্গে সিপাহী দিউন, আমি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিব। ধরাইয়া দিতে পারিলে আমাকে কি পুরস্কার দিবেন বলুন।”
শুনিয়া সাহেব আনন্দিত হইলেন। তিনি জানিতেন যে, দেবী চৌধুরাণী দস্যুদিগের নেত্রী। তাহাকে ধরিতে পারিলে আর আর সকলে ধরা পড়িবে। তিনি দেবীকে ধরিবার অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন, কোন মতে সফল হইতে পারেন নাই। অতএব হরবল্লভ সেই ভয়ঙ্করী রাক্ষসীকে ধরাইয়া দিবে শুনিয়া সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন। পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হইলেন। হরবল্লভ বলিলেন, “আমার সঙ্গে পাঁচ শত সিপাহী পাঠাইতে হুকুম হউক।” সাহেব সিপাহীর হুকুম দিলেন। হরবল্লভকে সঙ্গে করিয়া লেফটেনাণ্ট ব্রেনান সিপাহী লইয়া দেবীকে ধরিতে চলিলেন।
হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের নিকট সবিশেষ শুনিয়াছিলেন, ঠিক সে ঘাটে দেবীকে পাওয়া যাইবে। সম্ভবতঃ দেবী বজরাতেই থাকিবে। লেফটেেনাণ্ট ব্রেনান সেই জন্য কতক ফৌজ লইয়া ছিপে চলিলেন। এইরূপ পাঁচখানি ছিপ ভাঁটি দিয়া দেবীর বজরা ঘেরাও করিতে চলিল। এদিকে লেফটেনাণ্ট সাহেব আর কতক সিপাহী সৈন্য লুক্কায়িত ভাবে, বন দিয়া বন দিয়া তটপন্থে পাঠাইলেন। যেখানে দেবীর বজরা থাকিবে, হরবল্লভ বলিয়া দিল; সেইখানে তীরবর্তী বনমধ্যে ফৌজ তিনি লুকাইয়া রাখিলেন, যদি দেবী ছিপের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া তটপথে পলাইবার চেষ্টা করে, তবে তাহাকে এই ফৌজের দ্বারা ঘেরাও করিয়া ধরিবেন। আরও এক পলাইবার পথ ছিল–ছিপগুলি ভাঁটি দিয়া আসিবে, দূর হইতে ছিপ দেখিতে পাইলে দেবী ভাঁটি দিয়া পলাইতে পারে, অতএব লেফটেনাণ্ট ব্রেনান অবশিষ্ট সিপাহীগুলিকে দুই ক্রোশ ভাঁটিতে পাঠাইলেন, তাহাদিগের থাকিবার জন্য এমন একটি স্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন যে, সেখানে ত্রিস্রোতা নদী এই শুকার সময়ে সহজে হাঁটিয়া পার হওয়া যায়। সিপাহীরা সেখানে তীরে লুকাইয়া থাকিবে, বজরা দেখিলেই জলে আসিয়া তাহা ঘেরাও করিবে।
সন্ন্যাসিনী রমণীকে ধরিবার জন্য এইরূপ ঘোরতর আড়ম্বর হইল। কিন্তু কর্তৃপক্ষেরা এ আড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন মনে করেন নাই। দেবী সন্ন্যাসিনী হউক আর নাই হউক, তাহার আজ্ঞাধীন হাজার যোদ্ধা আছে, সাহেবেরা জানিতেন। এই যোদ্ধাদিগের নাম “বরকন্দাজ”। অনেক সময়ে কোম্পানীর সিপাহীদিগকে এই বরকন্দাজদিগের লাঠির চোটে পলাইতে হইয়াছিল, এইরূপ প্রবাদ। হায় লাঠি! তোমার দিন গিয়াছে! তুমি ছার বাঁশের বংশ বটে, কিন্তু শিক্ষিত হস্তে পড়িলে তুমি না পারিতে, এমন কাজ নাই। তুমি কত তরবারি দুই টুকরা্ করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ, কত ঢাল-খাঁড়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিয়াছ–হায়! বন্দুক আর সঙ্গীন তোমার প্রহারে যোদ্ধার হাত হইতে খসিয়া পড়িয়াছে। যোদ্ধা ভাঙ্গা হাত লইয়া পলাইয়াছে। লাঠি! তুমি বাঙ্গালায় আব্রু পর্দা রাখিতে, মান রাখিতে, ধন রাখিতে, জন রাখিতে, সবার মন রাখিতে। মুসলমান তোমার ভয়ে ত্রস্ত ছিল, ডাকাইত তোমার জ্বালায় ব্যস্ত ছিল, নীলকর তোমার ভয়ে নিরস্ত ছিল। তুমি তখনকার পীনাল কোড ছিলে–তুমি পীনাল কোডের মত দুষ্টের দমন করিতে, পীনাল কোডের মত শিষ্টেরও দমন করিতে এবং পীনাল কোডের মত রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙ্গিতে। তবে পীনাল কোডের উপর তোমার এই সরদারি ছিল যে, তোমার উপর আপীল চলিত না। হায়! এখন তোমার সে মহিমা গিয়াছে! পীনাল কোড তোমাকে তাড়াইয়া তোমার আসন গ্রহণ করিয়াছে–সমাজ-শাসন-ভার তোমার হাত হইতে তার হাতে গিয়াছে। তুমি, লাঠি! আর লাঠি নও, বংশখণ্ড মাত্র! ছড়িত্ব প্রাপ্ত হইয়া শৃগাল-কুক্কুর-ভীত বাবুবর্গের হাতে শোভা কর; কুক্কুর ডাকিলেই সে ননীর হাতগুলি হইতে খসিয়া পড়। তোমার সে মহিমা আর নাই। শুনিতে পাই, সেকালে তুমি না কি উত্তম ঔষধ ছিলে–মানসিক ব্যাধির উত্তম চিকিৎসকদিগের মুখে শুনিতে পাই, “মূর্খস্য লাঠ্যৌষধং।” এখন মূর্খের ঔষধ “বাপু” “বাছা”–তাহাতেও রোগ ভাল হয় না। তোমার সগোত্র সপিণ্ডগণের মধ্যে অনেকেরই গুণ এই দুনিয়াতে জাজ্বল্যমান। ইস্তক আড়া বাঁকারি খুঁটি খোঁটা লাগায়েৎ শ্রীনন্দনন্দনের মোহন বংশী, সকলেরই গুণ বুঝি–কিন্তু লাঠি! তোমার মত কেহ না। তুমি আর নাই–গিয়াছ। ভরসা করি, তোমার অক্ষয় স্বর্গ হইয়াছে; তুমি ইন্দ্রলোকে গিয়া নন্দনকাননের পুষ্পভারাবনত পারিজাত-বৃক্ষ-শাখার ঠেকনো হইয়া আছ, দেবকন্যারা তোমার ঘায় কল্পবৃক্ষ হইতে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষরূপ ফল সকল পাড়িয়া লইতেছে। এক আধটা ফল যেন পৃথিবীতে গড়াইয়া পড়ে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যার লাঠির ভয়ে এত সিপাহীর সমাগম, তার কাছে একখানি লাঠিও ছিল না। নিকটে একটা লাঠিয়ালও ছিল না। দেবী সেই ঘাটে–যে ঘাটে বজরা বাঁধিয়া ব্রজেশ্বরকে বন্দী করিয়া আনিয়াছিল, সেই ঘাটে। সবে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে মাত্র। সেই বজরা তেমনই সাজান–সব ঠিক সে রকম নয়। সে ছিপখানি সেখানে নাই–তাহাতে যে পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল ছিল, তাহারা নাই। তার পর বজরার উপরেও একটি পুরুষমানুষ নাই–মাঝি-মল্লা, রঙ্গরাজ প্রভৃতি কেহ নাই। কিন্তু বজরার মাস্তুল উঠান–চারিখানা পাল তোলা আছে–বাতাসের অভাবে পাল মাস্তুলে জড়ান পড়িয়া আছে। বজরার নোঙ্গরও ফেলা নহে, কেবল দুগাছা কাছিতে তীরে খোঁটায় বাঁধা আছে।
তৃতীয়, দেবী নিজে তেমন রত্নাভরণভূষিতা মহার্ঘবস্ত্রপরিহিতা নয়, কিন্তু আর এক প্রকারে শোভা আছে। ললাট, গণ্ড, বাহু, হৃদয়, সর্বাঙ্গ সুগন্ধি চন্দনে চর্চিত; চন্দনচর্চিত ললাট বেষ্টন করিয়া সুগন্ধি পুষ্পের মালা শিরোদেশের বিশেষ শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে। হাতে ফুলের বালা। অন্য অলঙ্কার একখানিও নাই। পরণে সেই মোটা সাড়ি।
আর, আজ দেবী একা ছাদের উপর বসিয়া নহে, কাছে আর দুই জন স্ত্রীলোক বসিয়া। একজন নিশি, অপর দিবা। এই তিন জনে যে কথাটা হইতেছিল, তাহার মাঝখান হইতে বলিলেও ক্ষতি নাই।
দিবা বলিতেছিল–দিবা অশিক্ষিতা, ইহা পাঠকের স্মরণ রাখা উচিত–বলিতেছিল, “হাঁঃ, পরমেশ্বরকে না কি আবার প্রত্যক্ষ দেখা যায়?”
প্রফুল্ল বলিল, “না, প্রত্যক্ষ দেখা যায় না। কিন্তু আমি প্রত্যক্ষ দেখার কথা বলিতেছিলাম না–আমি প্রত্যক্ষ করার কথা বলিতেছিলাম। প্রত্যক্ষ ছয় রকম। তুমি যে প্রত্যক্ষ দেখার কথা কহিতেছিলে, সে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ–চক্ষের প্রত্যক্ষ। আমার গলার আওয়াজ তুমি শুনিতে পাইতেছ–আমার গলার আওয়াজ তোমার শ্রবণ প্রত্যক্ষ, অর্থাৎ কাণের প্রত্যক্ষের বিষয় হইতেছে। আমার হাতের ফুলের গন্ধ তোমার নাকে যাইতেছে কি?”
দি। যাইতেছে।
দেবী। ওটা তোমার ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষ হইতেছে। আর আমি যদি তোমার গালে এক চড় মারি, তাহা হইলে তুমি আমার হাতকে প্রত্যক্ষ করিবে–সেটা ত্বাচ প্রত্যক্ষ। আর এখনি নিশি যদি তোমার মাথা খায়, তাহা হইলে তোমার মগজটা তার রাসন প্রত্যক্ষ হইবে।
দি। মন্দ প্রত্যক্ষ হইবে না। কিন্তু পরমেশ্বরকে দেখাও যায় না, শোনাও যায় না, শোঁকাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না, খাওয়াও যায় না। তাঁকে প্রত্যক্ষ করিব কি প্রকারে?
নি। এ ত গেল পাঁচ রকম প্রত্যক্ষ। ছয় রকম প্রত্যক্ষের কথা বলিয়াছি; কেন না, চক্ষু কর্ণ, নাসিকা, রসনা ও ত্বক ছাড়া আর একটা জ্ঞানেন্দ্রিয় আছে, জান না?
দি। কি, দাঁত?
নি। দূর হ, পোড়ারমুখী! ইচ্ছা করে, কিল মেরে তোর সে ইন্দ্রিয়ের পাটিকে পাটি ভেঙ্গে দিই।
দেবী। (হাসিতে হাসিতে) চক্ষুরাদি পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; হস্তপদাদি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, আর ইন্দ্রিয়াধিপতি মন উভয়েন্দ্রিয় অর্থাৎ মন জ্ঞানেন্দ্রিয় বটে, কর্মেন্দ্রিয়ও বটে। মনঃ জ্ঞানেন্দ্রিয় বলিয়া মনের দ্বারাও প্রত্যক্ষ আছে। ইহাকে মানস প্রত্যক্ষ বলে। ঈশ্বর মানস প্রত্যক্ষের বিষয়।
নি। “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ–প্রমাণাভাবাৎ।”
যিনি সাংখ্যপ্রবচনসূত্র ও ভাষ্য পড়িয়াছেন, তিনি নিশির এই ব্যঙ্গোক্তির মর্ম বুঝিবেন। নিশি প্রফুল্লের এক প্রকার সহাধ্যায়িনী ছিল।
প্রফুল্ল উত্তর করিল, “সুত্রকারস্যোভয়েন্দ্রিয়শূন্যত্বাৎ–ন তু প্রমাণাভবাৎ”।
দি। রেখে দাও তোমার হাবাৎ মাবাৎ–আমি ত পরমেশ্বরকে কখন মনের ভিতর দেখিতে পাই নাই।
প্র। আবার দেখা? চাক্ষুষ প্রত্যক্ষই দেখা–অন্য কোন প্রত্যক্ষ দেখা নয়,–মানস প্রত্যক্ষও দেখা নয়। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের বিষয়–রূপ, বহির্বিষয়; মানস প্রত্যক্ষের বিষয়–অন্তর্বিষয়। মনের দ্বারা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ হইতে পারেন। ঈশ্বরকে দেখা যায় না।
দি। কই? আমি ত ঈশ্বরকে কখনও মনের ভিতর কোন রকম প্রত্যক্ষ করি নাই?
প্র। মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যক্ষশক্তি অল্প–সাহায্য বা অবলম্বন ব্যতীত সকল বস্তু প্রত্যক্ষ করিতে পারে না।
দি। প্রত্যক্ষের জন্য আবার সাহায্য কি রকম? দেখ, এই নদী, জল, গাছ, পালা, নক্ষত্র, সকলই আমি বিনা সাহায্যে দেখিতে পাইতেছি।
“সকলই নয়। ইহার একটি উদাহরণ দিব?” বলিয়া প্রফুল্ল হাসিল।
হাসির রকমটা দেখিয়া নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “কি?”
প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “ইংরেজের সিপাহী আমাকে আজ ধরিতে আসিতেছে জান?”
দিবা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “তা ত জানি।”
প্র। সিপাহী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?
দি। না। কিন্তু আসিলে প্রত্যক্ষ করিব।
প্র। আমি বলিতেছি, আসিয়াছে, কিন্তু বিনা সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছি না। এই সাহায্য গ্রহণ কর। এই বলিয়া প্রফুল্ল দিবার হাতে দূরবীক্ষণ দিল। ঠিক যে দিকে দেখিতে হইবে, দেখাইয়া দিল। দিবা দেখিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি দেখিলে?”
দি। একখানা ছিপ। উহাতে অনেক মানুষ দেখিতেছি বটে।
দেবী। উহাতে সিপাহী আছে। আর একখানা দেখ।
এরূপে দেবী দিবাকে পাঁচখানা ছিপ নানা স্থানে দেখাইল। নিশিও দেখিল। নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “ছিপগুলি চরে লাগাইয়া আছে দেখিতেছি। আমাদের ধরিতে আসিয়াছে, কিন্তু আমাদের কাছে না আসিয়া ছিপ তীরে লাগাইয়া আছে কেন?”
দেবী। বোধ হয়, ডাঙ্গা-পথে যে সকল সিপাহী আসিবে, তাহারা আসিয়া পৌঁছে নাই। ছিপের সিপাহী তাহাদের অপেক্ষায় আছে। ডাঙ্গার সিপাহী আসিবার আগে, ছিপের সিপাহী আগু হইলে, আমি ডাঙ্গা-পথে পলাইতে পারি, এই শঙ্কায় উহারা আগু হইতেছে না।
দি। কিন্তু আমরা ত উহাদের দেখিতে পাইতেছি; মনে করিলেই ত পলাইতে পারি।
দেবী। ওরা ত জানে না। ওরা জানে না যে, আমরা দূরবীন রাখি।
নি। ভগিনি! প্রাণে বাঁচিলে এক দিন না এক দিন স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবেক। আজ ডাঙ্গায় উঠিয়া প্রাণরক্ষা করিবে চল। এখনও যদি ডাঙ্গায় সিপাহী আসে নাই, তবে ডাঙ্গা- পথে এখন প্রাণরক্ষার উপায় আছে।
দেবী। যদি প্রাণের জন্য আমি এত কাতর হইব, তবে আমি সকল সংবাদ জানিয়া শুনিয়া এখানে আসিলাম কেন? আসিলাম যদি, তবে লোকজন সবাইকে বিদায় দিলাম কেন? আমার হাজার বরকন্দাজ আছে–তাহাদের সকলকে অন্য স্থানে পাঠাইলাম কেন?
দি। আমরা আগে যদি জানিতাম, তাহা হইলে তোমায় এমন কর্ম করিতে দিতাম না।
দেবী। তোমার সাধ্য কি, দিবা! আমি স্থির করিয়াছি, তা অবশ্য করিব। আজ স্বামিদর্শন করিব, স্বামীর অনুমতি লইয়া জন্মান্তরে তাঁহাকে কামনা করিয়া প্রাণ সমর্পণ করিব। তোমরা আমার কথা শুনিও, দিবা নিশি! আমার স্বামী যখন ফিরিয়া যাইবেন, তখন তাঁহার নৌকায় উঠিয়া তাঁহার সঙ্গে চলিয়া যাইও। আমি একা ধরা দিব, আমি একা ফাঁসি যাব। সেই জন্যই বজরা হইতে আর সকলকে বিদায় দিয়াছি। তোমরা তখন গেলে না। কিন্তু আমায় এই ভিক্ষা দাও–আমার স্বামীর নৌকায় উঠিয়া পলায়ন করিও।
নি। ধড়ে প্রাণ থাকিতে তোমায় ছাড়িব না। মরিতে হয়, একত্র মরিব।
প্র। ও সকল কথা এখন থাক–যাহা বলিতেছিলাম, তা বলিয়া শেষ করিব। যাহা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছিলে না, তা যেমন দূরবীক্ষণের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিলে, তেমন ঈশ্বরকে মানস প্রত্যক্ষ করিতে দূরবীন চাই।
দি। মনের আবার দূরবীন কি?
প্র। যোগ।
দি। কি–সেই ন্যাস, প্রাণায়াম, কুম্ভক, বুজরুকি, ভেল্কি–
প্র। তাকে আমি যোগ বলি না। যোগ অভ্যাস মাত্র। কিন্তু সকল অভ্যাসই যোগ নয়। তুমি যদি দুধ ঘি খাইতে অভ্যাস কর, তাকে যোগ বলিব না। তিনটি অভ্যাসকেই যোগ বলি।
দি। কি কি তিনটি?
প্র। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি। জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ।
তক্ষণ নিশি দূরবীন লইয়া এদিক ওদিক দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বলিল, “সম্প্রতি উপস্থিত গোলযোগ।”
প্র। সে আবার কি? আবার গোলযোগ কি?
নি। একখানা পান্সি আসিতেছে। বুঝি ইংরেজের চর।
প্রফুল্ল নিশির হাত হইতে দূরবীন লইয়া পান্সি দেখিল। বলিল, “এই আমার সুযোগ। তিনিই আসিতেছেন। তোমরা নীচে যাও।”
দিবা ও নিশি ছাদ হইতে নামিয়া কামরার ভিতর গেল। পান্সি ক্রমে বাহিয়া আসিয়া বজরার গায়ে লাগিল। সেই পান্সিতে–ব্রজেশ্বর। ব্রজেশ্বর, লাফাইয়া বজরায় উঠিয়া, পান্সি তফাতে বাঁধিয়া রাখিতে হুকুম দিলেন। পান্সিওয়ালা তাহাই করিল।
ব্রজেশ্বর নিকটে আসিল, প্রফুল্ল উঠিয়া দাঁড়াইয়া আনত মস্তকে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল। পরে উভয়ে বসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “আজ টাকা আনিতে পারি নাই, দুই চারি দিনে দিতে পারিব বোধ হয়। দুই চারি দিনের পরে কবে কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হইবে, সেটা জানা চাই।”
ও ছি! ছি! ব্রজেশ্বর! দশ বছরের পর প্রফুল্লের সঙ্গে এই কি কথা!
দেবী উত্তর করিল, “আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হইবে না–” বলিতে বলিতে দেবীর গলাটা বুজিয়া আসিল–দেবী একবার চোখ মুছিল –“আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার ঋণ শুধিবার অন্য উপায় আছে। যখন সুবিধা হইবে, ঐ টাকা গরীব-দুঃখীকে বিলাইয়া দিবেন–তাহা হইলে আমি পাইব।”
ব্রজেশ্বর দেবীর হাত ধরিল। বলিল, “প্রফুল্ল! তোমার টাকা–”
ছাই টাকা! কথা শেষ হইল না–মুখের কথা মুখে রহিল। যেমন ব্রজেশ্বর “প্রফুল্ল” বলিয়া ডাকিয়া হাত ধরিয়াছে, অমনি প্রফুল্লের দশ বছরের বাঁধা বাঁধ ভাঙ্গিয়া, চোখের জলের স্রোত ছুটিল। ব্রজেশ্বরের ছাই টাকার কথা সে স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গেল। তেজস্বিনী দেবী রাণী ছেলেমানুষের মত বড় কান্নাটা কাঁদিল। ব্রজেশ্বর ততক্ষণ বড় বিপন্ন হইলেন। তাঁর মনে মনে বোধ আছে যে, এ পাপীয়সী ডাকাইতি করিয়া খায়, এর জন্য এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলা হবে না। কিন্তু চোখের জল, অত বিধি ব্যবস্থা অবগত নয়, তারা অনাহূত আসায় ব্রজেশ্বরের চোখ ভরিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিলেন, হাত উঠাইয়া চোখ মুছিলেই ধরা পড়িব। কাজেই চোখ মোছা হইল না। চোখ যখন মোছা হইল না, তখন পুকুর ছাপাইল–গাল বাহিয়া ধারা চলিল–প্রফুল্লের হাতে পড়িল।
তখন বালির বাঁধটা ভাঙ্গিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিয়া আসিয়াছিলেন যে, প্রফুল্লকে ডাকাইতি করার জন্য ভারী রকম তিরস্কার করিবেন, পাপীয়সী বলিবেন–আরও দুই চারিটা লম্বা চৌড়া কথা বলিয়া আবার একবার জন্মের মত ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন। কিন্তু কেঁদে যার হাত ভিজিয়ে দিলেন, তার উপর কি আর লম্বা চৌড়া কথা হয়?
তখন চক্ষু মুছিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “দেখ প্রফুল্ল, তোমার টাকা আমার টাকা–তার পরিশোধের জন্য আমি কেন কাতর হব? কিন্তু আমি বড় কাতরই হইয়াছি। আমি আজ দশ বৎসর কেবল তোমাকেই ভাবিয়াছি। আমার আর দুই স্ত্রী আছে–আমি তাহাদিগকে এ দশ বৎসর স্ত্রী মনে করি নাই; তোমাকেই স্ত্রী জানি। কেন, তা বুঝি তোমায় আমি বুঝাইতে পারিব না। শুনিয়াছিলাম, তুমি নাই। কিন্তু আমার পক্ষে তুমি ছিলে। আমি তার পরও মনে জানিতাম, তুমিই আমার স্ত্রী–মনে আর কাহারও স্থান ছিল না। বলবে না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু বলাতেও ক্ষতি নাই–তুমি মরিয়াছ শুনিয়া, আমিও মরিতে বসিয়াছিলাম। এখন মনে হয়, মরিলেই ভাল হইত–না মরিয়াছিলে ত আমি মরিলেই ভাল হইত। এখন যাহা শুনিয়াছি, বুঝিয়াছি, তা শুনিতে হইত না, বুঝিতে হইত না। আজ দশ বৎসরের হারান ধন তোমায় পাইয়াছি, আমার স্বর্গসুখের অপেক্ষা অধিক সুখ হইত। তা না হয়ে প্রফুল্ল, আজ তোমায় পাইয়া মর্মান্তিক যন্ত্রণা।” তার পর একবার থামিয়া একটু ঢোক গিলিয়া, মাথা টিপিয়া ধরিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “মনের মন্দিরের ভিতর সোণার প্রতিমা গড়িয়া রাখিয়াছিলাম–আমার সেই প্রফুল্ল–মুখে আসে না–সেই প্রফুল্লের এই বৃত্তি!”
প্রফুল্ল বলিল, “কি? ডাকাইতি করি?”
ব্র। কর না কি?
ইহার উত্তরে প্রফুল্ল একটা কথা বলিতে পারিত। যখন ব্রজেশ্বরের পিতা প্রফুল্লকে জন্মের মত ত্যাগ করিয়া গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দেয়, তখন প্রফুল্ল কাতর হইয়া শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “আমি অন্নের কাঙ্গাল, তোমরা তাড়াইয়া দিলে–আমি কি করিয়া খাইব?” তাহাতে শ্বশুর উত্তর দিয়াছিলেন, “চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইও।” প্রফুল্ল মেধাবিনী–সে কথা ভুলে নাই। ভুলিবার কথাও নহে। আজ ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে ডাকাইত বলিয়া এই ভর্ৎসনা করিল; আজ প্রফুল্লের সেই উত্তর ছিল। প্রফুল্লের এই উত্তর ছিল, “আমি ডাকাইত বটে–তা এখন এত ভর্ৎসনা কেন? তোমরাই ত চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইতে বলিয়াছিলে। আমি গুরুজনের আজ্ঞা পালন করিতেছি।” এ উত্তর সম্বরণ করাই যথার্থ পুণ্য। প্রফুল্ল সে পুণ্য সঞ্চয় করিল, – সে কথা মুখেও আনিল না। প্রফুল্ল স্বামীর কাছে হাত জোড় করিয়া এই উত্তর দিল। বলিল, “আমি ডাকাইত নই। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি, আমি কখন ডাকাইতি করি নাই। কখন ডাকাইতির এক কড়া লই নাই। তুমি আমার দেবতা। আমি অন্য দেবতার অর্চনা করিতে শিখিতেছিলাম–শিখিতে পারি নাই; তুমি সব দেবতার স্থান অধিকার করিয়াছ–তুমিই একমাত্র আমার দেবতা। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি–আমি ডাকাইত নই। তবে জানি, লোকে আমাকে ডাকাইত বলে। কেন বলে, তাও জানি। সেই কথা তোমাকে আমার কাছে শুনিতে হইবে। সেই কথা শুনাইব বলিয়াই আজ এখানে আসিয়াছি। আজ না শুনিলে, আর শুনা হইবে না। শোন, আমি বলি।”
তখন যে দিন প্রফুল্ল শ্বশুরালয় হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল, সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত আপনার কাহিনী সকলই অকপটে বলিল। শুনিয়া ব্রজেশ্বর বিস্মিত, লজ্জিত, অতিশয় আহ্লাদিত, আর মহামহিমময়ী স্ত্রীর সমীপে কিছু ভীত হইলেন। প্রফুল্ল সমাপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমার এ কথাগুলিতে বিশ্বাস করিলে কি?”
অবিশ্বাসের জায়গা ছিল না–প্রফুল্লের প্রতি কথা ব্রজেশ্বরের হাড়ে হাড়ে বসিয়াছিল। ব্রজেশ্বর উত্তর করিতে পারিল না–কিন্তু তাহার আনন্দপূর্ণ কান্তি দেখিয়া প্রফুল্ল বুঝিল, বিশ্বাস হইয়াছে। তখন প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “এখন পায়ের ধূলা দিয়া এ জন্মের মত আমায় বিদায় দাও। আর এখানে বিলম্ব করিও না–সম্মুখে কোন বিঘ্ন আছে। তোমায় এই দশ বৎসরের পর পাইয়া এখনই উপযাচিকা হইয়া বিদায় দিতেছি, ইহাতেই বুঝিবে যে, বিঘ্ন বড় সামান্য নহে। আমার দুইটি সখী এই নৌকায় আছে। তাহারা বড় গুণবতী, আমিও তাহাদের বড় ভালবাসি। তোমার নৌকায় তাহাদের লইয়া যাও। বাড়ী পৌঁছিয়া, তারা যেখানে যাইতে চায়, সেইখানে পাঠাইয়া দিও। আমায় যেমন মনে রাখিয়াছিলে, তেমনি মনে রাখিও। সাগর যেন আমায় না ভুলে।”
ব্রজেশ্বর ক্ষণেক কাল নীরবে ভাবিল। পরে বলিল, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, প্রফুল্ল! আমায় বুঝাইয়া দাও। তোমার এত লোক–কেহ নাই! বজরার মাঝিরা পর্যন্ত নাই! কেবল দুইটি স্ত্রীলোক আছে, তাদেরও বিদায় করিতে চাহিতেছ। সম্মুখে বিঘ্ন বলিতেছ–আমাকে থাকিতে নিষেধ করিতেছ। আর এ জন্মে সাক্ষাৎ হইবে না বলিতেছ। এ সব কি? সম্মুখে কি বিঘ্ন আমাকে না বলিলে, আমি যাইব না। বিঘ্ন কি, শুনিলেও যাইব কি না, তাও বলিতে পারি না।”
প্র। সে সব কথা তোমার শুনিবার নয়।
ব্র। তবে আমি কি তোমার কেহ নই?
এমন সময় দুম্ করিয়া একটা বন্দুকের শব্দ হইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
দুম্ করিয়া একটা বন্দুকের শব্দ হইল–ব্রজেশ্বরের মুখের কথা মুখে রহিল, দুই জনে চমকিয়া সম্মুখে চাহিয়া দেখিল–দেখিল, দূরে পাঁচখানা ছিপ আসিতেছে, বটিয়ার তাড়নে জল চাঁদের আলোয় জ্বলিতেছে। দেখিতে দেখিতে দেখা গেল, পাঁচখানা ছিপ সিপাহী-ভরা। ডাঙ্গা-পথের সিপাহীরা আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তারই সঙ্কেত বন্দুকের শব্দ। শুনিয়াই পাঁচখানা ছিপ খুলিয়াছিল। দেখিয়া প্রফুল্ল বলিল, “আর তিলার্ধ বিলম্ব করিও না। শীঘ্র আপনার পান্সিতে উঠিয়া চলিয়া যাও।”
ব্র। কেন? এ ছিপগুলো কিসের? বন্দুক কিসের?
প্র। না শুনিলে যাইবে না?
ব্র। কোন মতেই না।
প্র। এ ছিপে কোম্পানির সিপাহী আছে। এ বন্দুক ডাঙ্গা হইতে কোম্পানির সিপাহী আওয়াজ করিল।
ব্র। কেন এত সিপাহী এদিকে আসিতেছে? তোমাকে ধরিবার জন্য?
প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কথায় বোধ হইতেছে, তুমি পূর্ব হইতে এই সংবাদ জানিতে।”
প্র। জানিতাম–আমার চর সর্বত্র আছে।
ব্র। এ ঘাটে আসিয়া জানিয়াছ, না আগে জানিয়াছ?
প্র। আগে জানিয়াছিলাম।
ব্র। তবে, জানিয়া শুনিয়া এখানে আসিলে কেন?
প্র। তোমাকে আর একবার দেখিব বলিয়া।
ব্র। তোমার লোকজন কোথায়?
প্র। বিদায় দিয়াছি। তারা কেন আমার জন্য মরিবে?
ব্র। নিশ্চিত ধরা দিবে, স্থির করিয়াছ?
প্র। আর বাঁচিয়া কি হইবে? তোমার দেখা পাইলাম, তোমাকে মনের কথা বলিলাম, তুমি আমায় ভালবাস, তাহা শুনিলাম। আমার যে কিছু ধন ছিল, তাহাও বিলাইয়া শেষ করিয়াছি। আর এখন বাঁচিয়া কোন্ কাজ করিব বা কোন্ সাধ মিটাইব? আর বাঁচিব কেন?
ব্র। বাঁচিয়া, আমার ঘরে গিয়া, আমার ঘর করিবে।
প্র। সত্য বলিতেছ?
ব্র। তুমি আমার কাছে শপথ করিয়াছ, আমিও তোমার কাছে শপথ করিতেছি। আজ যদি তুমি প্রাণ রাখ, আমি তোমাকে আমার ঘরণী গৃহিণী করিব।
প্র। আমার শ্বশুর কি বলিবেন?
ব্র। আমার বাপের সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করিব।
প্র। হায়! এ কথা কাল শুনি নাই কেন?
ব্র। কাল শুনিলে কি হইত?
প্র। তাহা হইলে কার সাধ্য আজ আমায় ধরে?
ব্র। এখন?
প্র। এখন আর উপায় নাই। তোমার পান্সি ডাক–নিশি ও দিবাকে লইয়া শীঘ্র যাও।
ব্রজেশ্বর আপনার পান্সি ডাকিল। পান্সিওয়ালা নিকটে আসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “তোরা শীঘ্র পলা, ঐ কোম্পানির সিপাহীর ছিপ আসিতেছে; তোদের দেখিলে উহারা বেগার ধরিবে। শীঘ্র পলা, আমি যাইব না, এইখানে থাকিব।”
পান্সির মাঝি মহাশয়, আর দ্বিরুক্তি না করিয়া, তৎক্ষণাৎ পান্সি খুলিয়া প্রস্থান করিলেন। ব্রজেশ্বর চেনা লোক, টাকার ভাবনা নাই।
পান্সি চলিয়া গেল দেখিয়া প্রফুল্ল বলিল, “তুমি গেলে না?”
ব্র। কেন, তুমি মরিতে জান, আমি জানি না? তুমি আমার স্ত্রী–আমি তোমায় শত বার ত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু আমি তোমার স্বামী–বিপদে আমিই ধর্মতঃ তোমার রক্ষাকর্তা। আমি রক্ষা করিতে পারি না–তাই বলিয়া কি বিপদ্কা লে তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব?
“তবে কাজেই আমি স্বীকার করিলাম, প্রাণরক্ষার যদি কোন উপায় হয়, তা আমি করিব।” এই বলিতে বলিতে প্রফুল্ল আকাশপ্রান্তে দৃষ্টিপাত করিল। যাহা দেখিল, তাহাতে যেন কিছু ভরসা হইল। আবার তখনই নির্ভরসা হইয়া বলিল, “কিন্তু আমার প্রাণ-রক্ষায় আর এক অমঙ্গল আছে।”
ব্র। কি?
প্র। এ কথা তোমায় বলিব না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আর না বলিলে নয়। এই সিপাহীদের সঙ্গে আমার শ্বশুর আছেন। আমি ধরা না পড়িলে তাঁর বিপদ ঘটিলেও ঘটিতে পারে।
ব্রজেশ্বর শিহরিল–মাথায় করাঘাত করিল। বলিল, “তিনিই কি গোইন্দা?”
প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বরের বুঝিতে কিছু বাকি রহিল না। এখানে আজিকার রাত্রে যে দেবী চৌধুরাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে, এ কথা হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের কাছে শুনিয়াছিলেন। ব্রজেশ্বর আর কাহারও কাছে এ কথা বলেন নাই; দেবীরও যে গূঢ় মন্ত্রণা, আর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা নাই। বিশেষ দেবী এ ঘাটে আসিবার আগেই কোম্পানীর সিপাহী রঙ্গপুর হইতে যাত্রা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই; নহিলে ইহারই মধ্যে পৌঁছিত না। আর ইতিপূর্বেই হরবল্লভ কোথায় যাইতেছেন, কাহারও কাছে প্রকাশ না করিয়া দূরযাত্রা করিয়াছেন, আজও ফেরেন নাই। কথাটা বুঝিতে দেরী হইল না। তাই হরবল্লভ টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ করেন নাই। তথাপি ব্রজেশ্বর ভুলিলেন না যে,
“পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতার প্রীতিমাপন্নে পীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”
ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে বলিলেন, “আমি মরি কোন ক্ষতি নাই। তুমি মরিলে, আমার মরার অধিক হইবে, কিন্তু আমি দেখিতে আসিব না। তোমার আত্মরক্ষার আগে, আমার ছার প্রাণ রাখিবার আগে, আমার পিতাকে রক্ষা করিতে হইবে।”
প্র। সে জন্য চিন্তা নাই। আমার রক্ষা হইবে না, অতএব তাঁর কোন ভয় নাই। তিনি তোমায় রক্ষা করিলে করিতে পারিবেন। তবে ইহাও তোমার মনস্তুষ্টির জন্য আমি স্বীকার করিতেছি যে, তাঁর অমঙ্গল সম্ভাবনা থাকিতে, আমি আত্মরক্ষার কোন উপায় করিব না। তুমি বলিলেও করিতাম না, না বলিলেও করিতাম না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকিও।
এই কথা দেবী আন্তরিক বলিয়াছিল। হরবল্লভ প্রফুল্লের সর্বনাশ করিয়াছিল, হরবল্লভ এখন দেবীর সর্বনাশ করিতে নিযুক্ত। তবু দেবী তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী। কেন না, প্রফুল্ল নিষ্কাম। যার ধর্ম নিষ্কাম, সে কার মঙ্গল খুঁজিলাম, তত্ত্ব রাখে না। মঙ্গল হইলেই হইল।
কিন্তু এ সময়ে তীরবর্তী অরণ্যমধ্য হইতে গভীর তূর্যধ্বনি হইল। দুই জনেই চমকিয়া উঠিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
দেবী ডাকিল, “নিশি!”
নিশি ছাদের উপর আসিল।
দেবী। কার ভেরী ঐ?
নি। যেন দাড়ি বাবাজীর বলিয়া বোধ হয়।
দেবী। রঙ্গরাজের?
নি। সেই রকম।
দেবী। সে কি? আমি রঙ্গরাজকে প্রাতে দেবীগড় পাঠাইয়াছি।
নি। বোধ হয়, পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে।
দেবী। রঙ্গরাজকে ডাক।
ব্রজেশ্বর বলিল, “ভেরীর আওয়াজ অনেক দূর হইতে হইয়াছে। এখান হইতে ডাকিলে ডাক শুনিতে পাইবে না। আমি নামিয়া ভেরীওয়ালাকে খুঁজিয়া আনিতেছি।”
দেবী বলিল, “কিছু করিতে হইবে না। তুমি একটু নীচে গিয়া নিশির কৌশল দেখ।”
নিশি ও ব্রজ নীচে আসিল। নিশি নীচে গিয়া এ বাঁশী বাহির করিল। নিশি গীত বাদ্যে বড় পটু, সে শিক্ষা রাজবাড়ীতে হইয়াছিল। নিশিই দেবীর বীণার ওস্তাদ। নিশি বাঁশীতে ফুঁ দিয়া মল্লারে তান মারিল। অনতিবিলম্বে রঙ্গরাজ বজরায় আসিয়া উঠিয়া দেবীকে আশীর্বাদ করিল।
এই সময়ে ব্রজেশ্বর নিশিকে বলিল, “তুমি ছাদে যাও। তোমার কাছে কেহ বোধ হয়, কথা লুকাইবে না। কি কথা হয়, শুনিয়া আসিয়া আমাকে সব বলিও।”
নিশি স্বীকৃত হইয়া কামরার বাহির হইল–বাহির হইয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “আপনি একটু বাহিরে আসিয়া দেখুন।”
ব্রজেশ্বর মুখ বাড়াইয়া দেখিল। দেখিতে পাইল, জঙ্গলের ভিতর হইতে অগণিত মনুষ্য বাহির হইতেছে। নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “উহারা কারা? সিপাই?”
নিশি বলিল, “বোধ হয় উহারা বরকউন্দাজ। রঙ্গরাজ আনিয়া থাকিবে।”
দেবীও সেই মনুষ্যশ্রেণী দেখিতেছিল, এমন সময়ে রঙ্গরাজ আসিয়া আশীর্বাদ করিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখানে কেন রঙ্গরাজ?”
রঙ্গরাজ প্রথমে কোন উত্তর করিল না। দেবী পুনরপি বলিল, “আমি সকালে তোমাকে দেবীগড় পাঠাইয়াছিলাম। সেখানে যাও নাই কেন? আমার কথা অমান্য করিয়াছ কেন?”
র। আমি দেবীগড় যাইতেছিলাম –পথে ঠাকুরজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল।
দেবী। ভবানী ঠাকুর?
র। তাঁর কাছে শুনিলাম, কোম্পানির সিপাহী আপনাকে ধরিতে আসিতেছে। তাই আমরা দুই জনে বরকরন্দাজ সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিয়াছি। বরকহন্দাজ জঙ্গলে লুকাইয়া রাখিয়া আমি তীরে বসিয়াছিলাম। ছিপ আসিতেছে দেখিয়া আমি ভেরী বাজাইয়া সঙ্কেত করিয়াছি।
দেবী। ও জঙ্গলেও সিপাহী আছে?
র। তাহাদের আমরা ঘেরিয়া ফেলিয়াছি।
দেবী। ঠাকুরজি কোথায়?
র। ঐ বরকন্দাজ লইয়া বাহির হইতেছেন।
দেবী। তোমরা কত বরকন্দাজ আনিয়াছ?
র। প্রায় হাজার হইবে।
দেবী। সিপাহী কত?
র। শুনিয়াছি পাঁচ শ।
দেবী। এই পনের শ লোকের লড়াই হইলে, মরিবে কত?
র। তা দুই চারি শ মরিলেও মরিতে পারে।
দেবী। ঠাকুরজিকে গিয়া বল–তুমিও শোন যে, তোমাদের এই আচরণে আমি আজ মর্মান্তিক মনঃপীড়া পাইলাম।
র। কেন, মা?
দেবী। একটা মেয়েমানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মারিবার বাসনা করিয়াছ–তোমাদের কি কিছু ধর্মজ্ঞান নাই? আমার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি একা মরিব– আমার জন্য চারি শ লোক কেন মরিবে? আমায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে, আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বাঁচাইব?
র। আপনি বাঁচিলে অনেক লোকের প্রাণরক্ষা হইবে।
দেবী রাগে, ঘৃণায় অধীর হইয়া বলিল, “ছি! সেই ধিক্কারে রঙ্গরাজ অধোবদন হইল–মনে করিল, “পৃথিবী দ্বিধা হউক, আমি প্রবেশ করি।”
দেবী তখন বিস্ফারিত নয়নে, ঘৃণাস্ফুরিত কম্পিতাধরে বলিতে লাগিল, “শোন, রঙ্গরাজ! ঠাকুরজিকে গিয়া বল, এই মুহূর্ত্তে বরকন্দাজ সকল ফিরাইয়া লইয়া যাউন। তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইলে, আমি এই জলে ঝাঁপ দিয়া মরিব, তোমরা কেহ রাখিতে পারিবে না।”
রঙ্গরাজ এতটুকু হইয়া গেল। বলিল, “আমি চলিলাম। ঠাকুরজিকে এই সকল কথা জানাইব। তিনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহা করিবেন। আমি উভয়েরই আজ্ঞাকারী।”
রঙ্গরাজ চলিয়া গেল। নিশি ছাদে দাঁড়াইয়া সব শুনিয়াছিল। রঙ্গরাজ গেলে, সে দেবীকে বলিল, “ভাল, তোমার প্রাণ লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার, তাহারও নিষেধ করিবার অধিকার নাই। কিন্তু আজি তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী–তাঁর জন্যেও ভাবিলে না?”
দেবী। ভাবিয়াছি ভগিনি! ভাবিয়া কিছু করিতে পারি নাই। জগদীশ্বর মাত্র ভরসা। যা হইবার, হইবে। কিন্তু যাই হউক নিশি–এক কথা সার। আমার স্বামীর প্রাণ বাঁচাইবার জন্য এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিবার আমার কোন অধিকার নাই। আমার স্বামী আমার বড় আদরের–তাদের কে?
নিশি মনে মনে দেবীকে ধন্য ধন্য করিল। ভাবিল, “এই সার্থক নিষ্কাম ধর্ম শিখিয়াছিল। ইহার সঙ্গে মরিয়াও সুখ।”
নিশি গিয়া, সকল কথা ব্রজেশ্বরকে শুনাইল। ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে আর আপনার স্ত্রী বলিয়া ভাবিতে পারিল না; মনে মনে বলিল, “যথার্থ দেবীই বটে। আমি নরাধম! আমি আবার ইহাকে ডাকাইত বলিয়া ভর্ৎসনা করিতে গিয়াছিলাম।”
এদিকে পাঁচ দিক হইতে পাঁচখানা ছিপ আসিয়া বজরার অতি নিকটবর্তী হইল। প্রফুল্ল সেদিকে দৃকপাতও করিল না, প্রস্তরময়ী মূর্ত্তির মত নিস্পন্দ শরীরে ছাদের উপর বসিয়া রহিল। প্রফুল্ল ছিপ দেখিতেছিল না–বর্ককন্দাজ দেখিতেছিল না। দূর আকাশপ্রান্তে তাহার দৃষ্টি। আকাশপ্রান্তে একখানা ছোট মেঘ, অনেক ক্ষণ হইতে দেখা দিয়াছিল। প্রফুল্ল তাই দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বোধ হইল, যেন সেখানা একটু বাড়িল; তখন “জয় জগদীশ্বর!” বলিয়া প্রফুল্ল ছাদ হইতে নামিল।
প্রফুল্লকে ভিতরে আসিতে দেখিয়া, নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কি করিবে?”
প্রফুল্ল বলিল, “আমার স্বামীকে বাঁচাইব।”
নি। আর তুমি?
দেবী। আমার কথা আর জিজ্ঞাসা করিও না। আমি যাহা বলি, যাহা করি, এখন তাহাতে বড় সাবধানে মনোযোগ দাও। তোমার আমার অদৃষ্টে যাই হৌক, আমার স্বামীকে বাঁচাইতে হইবে, দিবাকে বাঁচাইতে হইবে, শ্বশুরকে বাঁচাইতে হইবে।
এই বলিয়া দেবী একটা শাঁক লইয়া ফুঁ দিল। নিশি বলিল, “তবু ভাল।”
দেবী বলিল, “ভাল কি মন্দ, বিবেচনা করিয়া দেখ। যাহা যাহা করিতে হইবে, তোমাকে বলিয়া দিতেছি। তোমার উপর সব নির্ভর।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পিপীলিকাশ্রেণীবৎ বরকন্দাজের দল ত্রিস্রোতার তীর-বন সকল হইতে বাহির হইতে লাগিল। মাথায় লাল পাগড়ি, মালকোঁচামারা, খালি পা–জলে লড়াই করিতে হইবে বলিয়া কেহ জুতা আনে নাই। সবার হাতে ঢাল-সড়কি–কাহারও কাহারও বন্দুক আছে–কিন্তু বন্দুকের ভাগ অল্প। সকলেরই পিঠে লাঠি বাঁধা–এই বাঙ্গালার জাতীয় হাতিয়ার। বাঙ্গালী ইহার প্রকৃত ব্যবহার জানিত; লাঠি ছাড়িয়াই বাঙ্গালী নির্জীব হইয়াছে।
বরকন্দাজেরা দেখিল, ছিপগুলি প্রায় আসিয়া পড়িয়াছে–বজরা ঘেরিবে! বরকন্দাজ দৌড়াইল–“রাণীজি-কি জয়” বলিয়া তাহারাও বজরা ঘেরিতে চলিল। তাহারা আসিয়া আগে বজরা ঘেরিল–ছিপ তাহাদের ঘেরিল। আর যে সময়ে শাঁক বাজিল, ঠিক সেই সময়ে জন কত বরকন্দাজ আসিয়া বজরার উপর উঠিল। তাহারা বজরার মাঝি-মাল্লা–নৌকার কাজ করে, আবশ্যকমত লাঠি-সড়কিও চালায়। তাহারা আপাততঃ লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হইবার কোন ইচ্ছা দেখাইল না। দাঁড়ে হালে, পালের রসি ধরিয়া, লগি ধরিয়া, যাহার যে স্থান, সেইখানে বসিল। আরও অনেক বরকন্দাজ বজরায় উঠিল। তিন চারি শ বরকন্দাজ তীরে রহিল–সেইখান হইতে ছিপের উপর সড়কি চালাইতে লাগিল। কতক সিপাহী ছিপ হইতে নামিয়া, বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইযা তাহাদের আক্রমণ করিল। যে বরকন্দাজেরা বজরা ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অবশিষ্ট সিপাহীরা তাহাদের উপর পড়িল। সর্বত্র হাতাহাতি লড়াই হইতে লাগিল। তখন মারামারি, কাটাকাটি, চেঁচাচেঁচি, বন্দুকের হুড়মুড়, লাঠির ঠক্ঠতকি, ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল; কেহ কাহারও কথা শুনিতে পায় না–কেহ কোন স্থানে স্থির হইতে পারে না।
দূর হইতে লড়াই হইলে সিপাহীর কাছে লাঠিয়ালেরা অধিকক্ষণ টিকিত না–কেন না, দূরে লাঠি চলে না। কিন্তু ছিপের উপর থাকিতে হওয়ায় সিপাহীদের বড় অসুবিধা হইল। যাহারা তীরে উঠিয়া যুদ্ধ করিতেছিল, সে সিপাহীরা লাঠিয়ালদিগকে সঙ্গীনের মুখে হটাইতে লাগিল, কিন্তু যাহারা জল লড়াই করিতেছিল, তাহারা বরকন্দাজদিগের লাঠি-সড়কিতে হাত পা বা মাথা ভাঙ্গিয়া কাবু হইতে লাগিল।
প্রফুল্ল নীচে আসিবার অল্পমাত্র পরেই এই ব্যাপার আরম্ভ হইল। প্রফুল্ল মনে করিল, “হয় ভবানী ঠাকুরের কাছে আমার কথা পৌঁছে নাই–নয় তিনি আমার কথা রাখিলেন না; মনে করিয়াছেন, আমি মরিতে পারিব না। ভাল, আমার কাজটাই তিনি দেখুন।”
দেবীর রাণীগিরিতে গুটিকতক চমৎকার গুণ জন্মিয়াছিল। তার একটি এই যে, যে সামগ্রীর কোন প্রকার প্রয়োজন হইতে পারে, তাহা আগে গুছাইয়া হাতের কাছে রাখিতেন। এ গুণের পরিচয় অনেক পাওয়া গিয়াছে। দেবী এখন হাতের কাছেই পাইলেন–একটা সাদা নিশান। সাদা নিশানটি বাহিরে লইয়া গিয়া স্বহস্তে উঁচু করিয়া ধরিলেন।
সেই নিশান দেখিবামাত্র লড়াই একেবারে বন্ধ হইল। যে যেখানে ছিল, সে সেইখানেই হাতিয়ার ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ঝড় তুফান যেন হঠাৎ থামিয়া গেল, প্রমত্ত সাগর যেন অকস্মাৎ প্রশান্ত হ্রদে পরিণত হইল।
দেবী দেখিল, পাশে ব্রজেশ্বর। এই যুদ্ধের সময়ে দেবীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া, ব্রজেশ্বরও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। দেবী তাঁহাকে বলিল, “তুমি এই নিশান এইরূপ ধরিয়া থাক। আমি ভিতরে গিয়া নিশি ও দিবার সঙ্গে একটা পরামর্শ আঁটিব। রঙ্গরাজ যদি এখানে আসে, তাহাকে বলিও, সে দরওয়াজা হইতে আমার হুকুম লয়।”
এই বলিয়া দেবী ব্রজেশ্বরের হাতে নিশান দিয়া চলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর নিশান তুলিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইতিমধ্যে সেখানে রঙ্গরাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। রঙ্গরাজ ব্রজেশ্বরের হাতে সাদা নিশান দেখিয়া, চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “তুমি কার হুকুমে সাদা নিশান দেখাইলে?”
ব্র। রাণীজির হুকুম।
র। রাণীজির হুকুম? তুমি কে?
ব্র। চিনিতে পার না?
রঙ্গরাজ একটু নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “চিনিয়াছি। তুমি ব্রজেশ্বরবাবু? এখানে কি মনে করে? বাপ-বেটায় এক কাজে না কি? কেহ একে বাঁধ।”
রঙ্গরাজের ধারণা হইল যে, হরবল্লভের ন্যায় দেবীকে ধরাইয়া দিবার জন্যই ব্রজেশ্বর কোন ছলে বজরায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার আজ্ঞা পাইয়া দুই জন ব্রজেশ্বরকে বাঁধিতে আসিল। ব্রজেশ্বর কোন আপত্তি করিলেন না, বলিলেন, “আমায় বাঁধ, তাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু একটা কথা বুঝাইয়া দাও। সাদা নিশান দেখিয়াই দুই দলে যুদ্ধ বন্ধ করিল কেন?”
রঙ্গরাজ বলিল, “কচি খোকা আর কি? জান না, সাদা নিশান দেখাইলে ইংরেজের আর যুদ্ধ করিতে নাই?”
ব্র। তা আমি জানিতাম না। তা আমি জানিয়াই করি, আর না জানিয়াই করি, রাণীজির হুকুম মত সাদা নিশান দেখাইয়াছি কি না, তুমি না হয় জিজ্ঞাসা করিয়া আইস। আর তোমায়ও আজ্ঞা আছে যে, তুমি দরওয়াজা হইতে রাণীজির হুকুম লইবে।
রঙ্গরাজ বরাবর কামরার দরজায় গেল। কামরার দরজা বন্ধ আছে দেখিয়া বাহির হইতে ডাকিল, “রাণী মা!”
ভিতর হইতে উত্তর, “কে, রঙ্গরাজ?”
র। আজ্ঞা হাঁ–একটা সাদা নিশান আমাদের বজরা হইতে দেখান হইয়াছে–লড়াই সেই জন্য বন্ধ আছে।
ভিতর হইতে–“সে আমার হুকুম মত হইয়াছে। এখন তুমি ঐ সাদা নিশান লইয়া লেফটেনান্ট সাহেবের কাছে যাও। গিয়া বল যে, লড়াইয়ে প্রয়োজন নাই, আমি ধরা দিব।”
র। আমার শরীর থাকিতে তাহা কিছুতেই হইবে না।
দেবী। শরীরপাত করিয়াও আমায় রক্ষা করিতে পারিবে না।
র। তথাপি শরীরপাত করিব।
দেবী। শোন, মূর্খের মত গোল করিও না। তোমরা প্রাণ দিয়া আমায় বাঁচাইতে পারিবে না–এ সিপাহীর বন্দুকের কাছে লাঠি সোঁটা কি করিবে?
র। কি না করিবে?
দেবী। যাই করুক–আর এক বিন্দু রক্তপাত হইবার আগে আমি প্রাণ দিব,-বাহিরে গিয়া গুলির মুখে দাঁড়াইব–রাখিতে পারিবে না। বরং এখন আমি ধরা দিলে, পলাইবার ভরসা রহিল। বরং এক্ষণে আপন আপন প্রাণ রাখিয়া সুবিধা মত যাহাতে আমি বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারি, সে চেষ্টা করিও। আমার অনেক টাকা আছে। কোম্পানির লোক সকল অর্থের বশ–আমার পলাইবার ভাবনা কি?
দেবী মুহূর্ত জন্যও মনে করেন নাই যে, ঘুষ দিয়া তিনি পলাইবেন। সে রকম পলাইবার ইচ্ছাও ছিল না। এ কেবল রঙ্গরাজকে ভুলাইতেছিলেন। তাঁর মনের ভিতর যে গভীর কৌশল উদ্ভাবিত হইয়াছিল, রঙ্গরাজের বুঝিবার সাধ্য ছিল না–সুতরাং রঙ্গরাজকে তাহা বুঝাইলেন না। সরলভাবে ইংরেজকে ধরা দিবেন, ইহা স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাও বুঝিয়াছিলেন যে, ইংরেজ আপনার বুদ্ধিতে সব খোয়াইবে। ইহাও স্থির করিয়াছিলেন যে, শত্রুর অনিষ্ট করিবেন না, বরং শত্রুকে সতর্ক করিয়া দিবেন। তবে স্বামী, শ্বশুর, সখীদিগের উদ্ধারের জন্য যাহা অবশ্য কর্তব্য, তাহাও করিবেন; যাহা যাহা হইবে, দেবী যেন দর্পণের ভিতর সকল দেখিতে পাইতেছিলেন।
রঙ্গরাজ বলিল, “যাহা দিয়া কোম্পানীর লোক বশ করিবেন, তাহা ত বজরাতেই আছে। আপনি ধরা দিলে, ইংরেজ বজরাও লইবে।”
দেবী। সেইটি নিষেধ করিও। বলিও যে, আমি ধরা দিব, কিন্তু বজরা দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহার কিছুই দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহাদের কাহাকেও তিনি ধরিতে পারিবেন না। এই নিয়মে আমি ধরা দিতে রাজি।
র। ইংরেজ যদি না শুনে, যদি বজরা লুঠিতে আসে।
দেবী। বারণ করিও–বজরায় না আসে, বজরা না স্পর্শ করে। বলিও যে, তাহা করিলে ইংরেজের বিপদ ঘটিবে। বজরায় আসিলে আমি ধরা দিব না। যে মুহূর্তে ইংরেজ বজরায় উঠিবে, সেই দণ্ডে আবার যুদ্ধ আরম্ভ জানিবেন। আমার কথায় তিনি স্বীকৃত হইলে, তাঁহাদের কাহাকে এখানে আসিতে হইবে না। আমি নিজে তাঁহার ছিপে যাইব।
রঙ্গরাজ বুঝিল, ভিতরে একটা কি গভীর কৌশল আছে। দৌত্যে স্বীকৃত হইল। তখন দেবী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভবানী ঠাকুর কোথায়?”
র। তিনি তীরে বরকন্দাজ লইয়া যুদ্ধ করিতেছেন। আমার কথা শোনেন নাই। বোধ করি, এখনও সেইখানে আছেন।
দেবী। আগে তাঁর কাছে যাও। সব বরকন্দাজ লইয়া নদীর তীরে তীরে স্বস্থানে যাইতে বল। বলিও যে, আমার বজরার লোকগুলি রাখিয়া গেলেই যথেষ্ট হইবে। আর বলিও যে, আমার রক্ষার জন্য আর যুদ্ধের প্রয়োজন নাই–আমার রক্ষার জন্য ভগবান উপায় করিয়াছেন। ইহাতে যদি তিনি আপত্তি করেন, আকাশ পানে চাহিয়া দেখিতে বলিও– তিনি বুঝিতে পারিবেন।
রঙ্গরাজ তখন স্বয়ং আকাশ পানে চাহিয়া দেখিল–দেখিল, বৈশাখী নবীন নীরদমালায় গগন অন্ধকার হইয়াছে।
রঙ্গরাজ বলিল, “মা! আর একটা আজ্ঞার প্রার্থনা করি। হরবল্লভ রায় আজিকার গোইন্দা। তার ছেলে ব্রজেশ্বরকে নৌকায় দেখিলাম। অভিপ্রায়টা মন্দ, সন্দেহ নাই। তাহাকে বাঁধিয়া রাখিতে চাহি।”
শুনিয়া নিশি ও দিবা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। দেবী বলিল, “বাঁধিও না। এখন গোপনে ছাদের উপর বসিয়া থাকিতে বল। পরে যখন দিবা নামিতে হুকুম দিবে, তখন নামিবেন।”
আজ্ঞামত রঙ্গরাজ আগে বজ্রেশ্বরকে ছাদে বসাইল। তার পর ভবানী ঠাকুরের কাছে গেল, এবং দেবী যাহা বলিতে বলিয়াছিলেন, তাহা বলিল। রঙ্গরাজ মেঘ দেখাইল–ভবানী দেখিল। ভবানী আর আপত্তি না করিয়া, তীরের ও জলের বরকন্দাজ সকল জমা করিয়া লইয়া ত্রিস্রোতার তীরে তীরে স্বস্থানে যাইবার উদ্যোগ করিল।
এদিকে দিবা ও নিশি, এই অবসরে বাহিরে আসিয়া, বরকন্দাজবেশী দাঁড়ী-মাঝিদিগকে চুপি চুপি কি বলিয়া গেল।